সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৮

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৮
Jannatul Firdaus Mithila

কথায় আছে এই ইহলোকে এমন অনেক সৌন্দর্যই আছে যা কিনা মানুষকে বরাবরই মুগ্ধ করতে যথেষ্ট! তন্মধ্যে একইরকম দেখতে মানুষগুলোও যেন পৃথিবীর সেই সকল সৌন্দর্যের একটি।এই মুহুর্তে আগন্তুকটির কাছেও আহিয়া আর মাহিয়াকে মনোমুগ্ধকর ঠেকছে! আগন্তুক খেয়াল করলো দুজনকে দেখতে একেবারে একইরকম লাগে।সেম গায়ের রং, সমান উচ্চতা এমনকি ড্রেসআপ হতে হেয়ার স্টাইল পর্যন্ত একইরকম দুজনের। আগন্তুক এতক্ষণে সবটা উপলব্ধি পারলো যে– কেনো মেয়েটি তাকে অচেনা বলছিলো! ওর হয়তো অপর মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছিলো সেদিন। আগন্তুক চোখের চশমাটা ঠিক করে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে,

~ আ’ম এক্সট্রিমলি সরি! আমি আসলে বুঝতে পারিনি আপনারা জমজ।
মাহিয়া এখনো সবটা বুঝে উঠতে পারছে না — এখানে আসলে হচ্ছে টা কি! সে এবার মুখ খুললো,আগন্তুকের উদ্দেশ্যে বললো,
~ এই আপনি সেই না যার সাথে গতকাল লাইব্রেরিতে আমার দেখা হয়েছিলো?
মাহিয়ার কথায় ছেলেটি যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। যাক মেয়েটি তবে তাকে ভুলেনি! সে আহিয়ার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

~হুম আমি-ই সে। আসলে আমি জানতাম না আপনারা টুইনস।আমি একটা কাজে এদিকটা দিয়ে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই রেস্টুরেন্টের ওপাশ থেকে আপনার মতো দেখতে ওনাকে (আহিয়া) দেখে ভেবেছিলাম আপনিই হয়তো,তাইতো ভাবলাম বইটা যেহেতু পড়া শেষ সেহেতু আপনাকে এখানেই দিয়ে দেই।কিন্তু এখানে আসার পর আপনার বোনের সাথে মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয় কিছুটা।
দুজনের কথােপকথনে আহিয়ার এতক্ষণে সবটা বোধগম্য হয়।সে বুঝতে পারে এতক্ষণ ছেলেটি তাকে মাহিয়া ভেবেই সবটা বলেছে।মনে মনে কিছুটা লজ্জিতবোধ করে ও।আড়চোখে একবার আগন্তুকের দিকে তাকাতেই দুজনের একসঙ্গে চোখাচোখি হয়।আহিয়া হকচকিয়ে যায়, তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সেখান থেকে ।আগন্তুক সেদিকে একপলক তাকিয়ে মুচকি হাসে,পরক্ষনেই স্বাভাবিক করে নেয় মুখভঙ্গি।
মাহিয়া আগন্তুকের কাছে সবটা শোনার পর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। বলে,

~ তা-ই তো বলি আহি কেনো এতোটা রাগ দেখাচ্ছিলো।আসলে আহি সচরাচর এমনটা করে না অবশ্য ও হয়তো আপনার নিজ থেকে কথা বলতে আসাটা স্বাভাবিক নিতে পারেনি তাই এমনটা করেছে।মনে কষ্ট নিবেন না প্লিজ!
আগন্তুক শ্লেষ হাসে।আঙুলের ডগার সাহায্যে কপাল চুলকে আড়চোখে তাকায় আহিয়ার পানে।বলে,
~ আরে না! সমস্যা নেই। ওটা জাস্ট একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিলো। বাই দা ওয়ে, আপনাদের সাথে তো এখনো ঠিকঠাক পরিচিত হলাম না।আমি শাহানুর ইফতি আর আপনারা?
মাহিয়া স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দেয়,

~ আমি মাহিয়া এহসান আর ও আহিরা এহসান।
মাহিয়ার মুখে তাদের পদবীর নাম শুনে কিছুটা ভড়কায় ইফতি। চোখ সরু রেখে জিজ্ঞেস করে,
~ এহসান! আপনারা এহসান পরিবারের?
মাহি এবং আহি দুজনেই অবাক হয় এমন বাক্যে।মাহি অবাক কন্ঠে বলে,
~ হ্যা তো? আপনি কি আমাদের পরিবারকে চিনেন?
ইফতি এখনো অনুভুতিশুন্য চোখে তাদের দিকেই তাকিয়ে। রাশভারি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
~ জনাব কবির এহসান, উনি আপনাদের কি হয়?
আহিয়া তার কথার প্রতিত্তোরে তৎক্ষনাৎ জবাব দেয়,
~ আমাদের বড় আব্বু তিনি।কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন বড় আব্বু কে? আপনি কি তাকে আগে থেকেই চিনেন?
ইফতি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নেয়, বারকয়েক ঘনঘন নিশ্বাস ছাড়ে।বিড়বিড় করে বলতে থাকে,

~ তাকে আমি কি করে ভুলি!
মাহিয়া ও আহিয়া দুজনেই ইফতির কর্মকাণ্ডে ভ্রু কুচকায়। মাহিয়া গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করে,
~ জ্বি! কি বললেন আপনি?
ইফতি হকচকায়! আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে ওঠে,
~ হুহ! নাহ তেমন কিছু না।আসলে ব্যাবসায়িক পারপাসে ওনার বেশ নামডাক শুনেছি তাই আরকি!
আহিয়ার কাছে যেন ইফতির কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না।সে ভ্রুকুঞ্চন করে বলে,
~ ব্যস এতটুকুই?
ইফতি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে ওঠে,
~হুহ মিস আহি,এতোটুকুই! আচ্ছা আজ আমি আসছি আমার কিছু জরুরি কাজ আছে। নাইস টু মিট বোথ অফ ইউ!
বলেই একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে চলে যায় আহি, মাহির সামনে থেকে। ইফতির চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে আহিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,

~ আচ্ছা এই ছেলেটা হঠাৎ বড় আব্বুর কথা শুনে এমন অদ্ভুত বিহেভ করলো কেন? আই থিংক সামথিং ইজ ফিসি!
আহির কথা শুনে মাহি বিরক্তির সঙ্গে ভ্রুকুচকে তার দিকে তাকায়। খেঁকখেঁক করে বলে,
~ তুই আর তোর গোয়েন্দাগিরি! দুটোই সাধারণের জন্য বিপদজনক। ওতো বললো ও বিজনেস পার পাসে চিনে বড় আব্বুকে। তারপরও ওর প্রতি সন্দেহ করাটা নিতান্তই বোকামি!
মাহির মুখে ইফতিকে নিয়ে তরফদারিটা মোটেও পছন্দ হলোনা আহির।সে সন্দেহপ্রবন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
~ওয়েট আ সেকেন্ড! তুই কেন ওই ছেলের এতোটা পক্ষ টানছিস?
পরক্ষণেই দুহাত ভাজ করে ভ্রু – উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
~কাহিনি কি খুলে বল!
মাহিয়া ভড়কে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
~কি যা তা বলছিস! আমি কেন তার পক্ষ নিতে যাবো! আমিতো জাস্ট এমনিতেই বললাম।
~শিওর?
~হুম। শিওর! চল এখন বাড়িতে যাওয়া যাক।
বলেই দুবোন চলে যায় বাড়ির উদ্দেশ্যে।

~আম্মু প্লিজ! আমি জাস্ট যাবো আর আসবো।তাছাড়া এখান থেকে ফারিয়ার বাসা মাত্র ১০ মিনিটের পথ।হেনাও তো আসবে।এখন আমি যদি না যাই ওরা সত্যি অনেক রাগ করবে।
রাফিয়া বেগমকে অরিনের এতো – শতো বোঝানোতে আদৌও কোন কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।রাফিয়া বেগম ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আপনমনে চুলে তেল দিয়ে যাচ্ছেন! অরিন ফোস করে নিশ্বাস ফেলে।ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে ধুম করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাফিয়া বেগমকে।আহ্লাদী স্বরে বলতে থাকে,
~ আম্মু!আজকে ফারিয়ার ছোট্ট ভাতিজার জন্মদিন।মেয়েটা সেই কবে থেকে আমাকে ইনভাইট করে রেখেছিলো।তাছাড়া হেনাও আসছে সেখানে। এখন যদি আমিই না যাই তাহলে ফারিয়াতো কষ্ট পাবে তাই না বলো! প্লিজ একটু যেতে দাও।কথা দিচ্ছি রাত আটটার মধ্যেই ফিরে আসবো।
রাফিয়া বেগম অরিনের কান্ডে মৃদু হাসে।তবুও চিন্তিত কণ্ঠে বলে,

~দেখ অরিন! তোকে আমি যেতে না করছি না।কিন্তু দিনকালের যে অবস্থা! কি করে তোকে একা পাঠাই বলতো!
অরিন মায়ের কথায় চিন্তার রেশ বেশ বুঝতে পারে।সে আশ্বাস দেওয়ার সুরে বলে,
~আম্মু,এখান থেকে কাছেই তো! আচ্ছা তবুও যদি তোমার আমাকে নিয়ে চিন্তা হয় তাহলে আমি নাহয় ড্রাইভার চাচ্চুকে নিয়ে যাচ্ছি!
রাফিয়া বেগম সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হতে পারলেন না তবুও।কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর না-ও করতে পারলেন না তিনি।অতপর একটি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলেন,
~ঠিক আছে যাও তবে।কিন্তু আটটার মধ্যে আমি যেন তোমাকে বাড়িতেই পাই ওকে!
অরিন একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের গালে শব্দ করে চুমু খায়। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে ওঠে,
~আম্মুওও ইউ আর দি বেস্ট!
রাফিয়া বেগম মেয়ের আহ্লাদিপানায় মুচকি হাসলেন। বললেন,
~হয়েছে থামো এবার।যাও রেডি হতে।আর সাবধানে যেও কেমন!
অরিনও মায়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে একছুটে চলে যায় নিজের রুমে। এদিকে রাফিয়া বেগম মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেন,
~পাগলি একটা!

~স্যার আসবো?
ওয়ার্ড বয়ের ডাকে হাতের ফাইল হতে দৃষ্টি সরিয়ে সেদিকে তাকায় রৌদ্র। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
~হুম আসুন।
ওয়ার্ড বয় অনুমতি পেয়ে কেবিনে প্রবেশ করে।তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে বলেন,
~স্যার ইমারজেন্সি একটা কেস চলে এসেছে।
রৌদ্র তার কথায় ভ্রুকুঞ্চন করে। গম্ভীর থেকেই বলে ওঠে,
~মানে! কে সে? আর তাছাড়া আমার ডিউটি টাইমও তো ওভার।
~জি স্যার কিন্তু সারোয়ার স্যার আরেকটা কেসে আটকে থাকায় ইমার্জেন্সি কেসটি টেকওভার করতে পারছেন না।আপনি যদি একটু দেখতেন!

রৌদ্র তৎক্ষনাৎ ভ্রু- শিথিল করে নেয়। চেয়ারের গা থেকে এপ্রনটি নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেয়। স্ট্যাথোস্কোপটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে।ওয়ার্ড বয়ও পিছুপিছু ছুটে তার।সরু করিডর দিয়ে হেটে চলে আসে ইমার্জেন্সি পেশেন্টের কামরায়। কামরায় প্রবেশ করতেই পা-দুটো থমকে দাড়ায় রৌদ্রের।অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে বেডের পাশে বসে থাকা ফুপিয়ে কান্নারত রমনির দিকে। এই মুহুর্তে যেন নিজের চোখদুটোকেও বিশ্বাস হচ্ছে না তার।রৌদ্রকে দেখতে পেয়ে রুমে থাকা এক তরুণ ছুটে আসে তার নিকট। ধরে আসা গলায় বলতে লাগলো,
~ ড: প্লিজ তারাতাড়ি আমার আব্বুকে দেখুন।উনি.. উনি..
বাকিটা বলার আগেই তরুনের গলায় আটকে যায় অশ্রুধারা। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোটা নোনতা জল। তরুনের কথায় সৎবিৎ ফিরে পায় রৌদ্র। খেয়াল করে তরুনের দিকে,যে কিনা এই মুহুর্তে তার সামনে নিজের অশ্রুকনা লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রৌদ্র তার কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করার ন্যায় বলে ওঠে,
~ ডোন্ট ওরি! আমি দেখছি।

বলেই দ্রুত কদমে চলে আসে পেশেন্টের কাছে।রৌদ্রকে বেডের পাশে দাড়াতে দেখে এক তরুণী এসে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকা রমনির মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,
~আম্মু! এবার ওঠো।ডাক্তারকে দেখতে দাও আব্বুকে।
রমনীটি তৎক্ষনাৎ মাথা উঁচিয়ে তার ফোলা ফোলা নেত্রদ্বয় তাক করে রৌদ্রের পানে।বসা ছেড়ে ওঠে রৌদ্রের হাতদুটোকে নিজ হাতের মুঠোয় নিয়ে ছলছল নয়নে ভেঙে যাওয়া গলায় বলেন,
~ বাবা! তুমি আমার স্বামীকে বাঁচাও! ও ছাড়া যে আমি একেবারেই নিঃস্ব, পরাস্ত!
কথাটি শেষ হতেই আবারও হু হু করে কেঁদে ওঠেন তিনি। মহিলাটির এমন অবস্থা দেখে রৌদ্রের বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে! সে সঙ্গে সঙ্গে মহিলাটির হাতের মুঠো হতে নিজ হাত ছাড়িয়ে আলতো করে চোখ বেয়ে আসা অশ্রুকনাগুলো সযত্নে মুছে দেয়! মহিলাটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।কেন জানি তার মনে হচ্ছে সে এই ছেলেটাকে বড্ড চেনে! মহিলাটির নিজ ধ্যানে তদবির থাকা অবস্থায় তার কানে আসে এক মায়াভরা আশ্বাস দেওয়া সুর,
~ কিচ্ছু হবে না আংকেলের! আমি আছি তো! আপনি শুধু তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।

কি ছিলো রৌদ্রের আশ্বাসে? মহিলাটির সকল কান্নাই যেন একমুহূর্তে ছুটে পালালো এই আশ্বাস শুনে।মনে জাগলো এক অপার বিশ্বাস — তার স্বামীর কিচ্ছু হবে না!
মহিলাটি রৌদ্রের কথায় মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে সরে আসে। রৌদ্র যথারীতি চেক করতে থাকে রোগীকে। বেশকিছুক্ষন নিরিক্ষার পর ওয়ার্ড বয়কে আদেশের সুরে বললো,
~ওনাকে আইসিইউতে শিফট করো কুইকলি!
ওয়ার্ড বয় রৌদ্রের আদেশ পাওয়া মাত্রই ছুটে যায় সেদিকে।রৌদ্রও কেবিন থেকে বের হয়।তাকে দেখা মাত্রই তরুনটি ছুটে আসে তার কাছে।বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
~ড: আব্বু কেমন আছে? ইজ এভরিথিং ওকে?
রৌদ্র কোনরূপ ভনিতা ছাড়াই বলে ওঠে,

~আপনার আব্বুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আরও কিছু জরুরি পরিক্ষা করে তারপর দেখতে হবে তার অপারেশন করা লাগবে কি না! আপনি একটি কাজ করুন।তার বিগত সকল মেডিক্যাল রিপোর্টস কালেক্ট করুন।আমার আগে ওনার সকল মেডিক্যাল হিস্ট্রি জানা প্রয়োজন।
তরুনটির যেন এই মুহূর্তে বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। তার গলা থেকে একটা শব্দও বের হচ্ছে না।সে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র যেন ছেলেটার মনের অবস্থা বুঝলো,কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করলো,
~চিন্তা করোনা! নিজেকে সামলাও। এই মুহূর্তে তোমার নিজে ভেঙে পড়ার থেকে ফেমিলিকে আগলে রাখাটা জরুরি।
তরুনটি কি বুঝলো? সে তো কোনরকমে নিজেকে সামলিয়ে মাথা ঝাকালো।রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে চলে গেলো সেখান থেকে।

তরুনটি রৌদ্রের চলে যেতেই নিজের শার্টের হাতা দিয়ে চোখগুলো মুছে নিলো।গলা সামান্য খাঁকারি দিয়ে স্বাভাবিক করলো কন্ঠ। পেছন ফিরে চিন্তিত মা-বোনের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎকাল। পরক্ষণেই মনে মনে মহান রবের নিকট আর্জি জানিয়ে বলতে লাগলো,
~ ইয়া রাহমানুর রাহিম।আমার জিবনের করা একটি মাত্র ভালো কাজের উসিলায় হলেও আপনি আমার বাবাকে সুস্থ করে দিন। সুস্থ করে দিন আমাদের বটবৃক্ষকে!
কখন যে তরুনের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু বেয়ে পড়লো তা মোটেও টের পেলোনা সে। আবারও চোখ দু’টি মুছে মায়ের সামনে গিয়ে দাড়ায়।মহিলাটি কিছু বলার পূর্বেই ছেলেটি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,
~আব্বু হার্ট অ্যাটাক করেছে মা!
কথাটা মহিলাটির কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই তিনি ছেলের পিঠ খামচে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন।ছেলেটি একাধারে তার মাকে বুঝিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এতে কাজ হলে তো! ইতোমধ্যেই ছেলেটির বোনও কাঁদতে শুরু করে বাবার খবর শুনে।ছেলেটা আদরের বোনের কান্নার শব্দ পেয়ে একহাত বাড়িয়ে বুকে সযত্নে চেপে ধরে বোনকে। অতপর জলে টইটম্বুর নয়নে আশ্বাস দিতে থাকে দুজনকে!

~ড: রৌদ্র! আপনার কি মনে হয় অপারেশনটা কি আমাদের করা উচিত? আমার মনে হচ্ছে এই রিস্কটা না নেওয়াই বেটার! কেননা পেশেন্টের ফেমিলি মেম্বারস তাকে আনতে বেশ সময় লাগিয়ে ফেলেছেন।এই মুহুর্তে ওনার রিকোভার হওয়ার সম্ভাবনা ৪০%। এজ দিস সারকামস্ট্যান্স, আই থিংক উই শুড নট গো এহেড ফর দিস অপারেশন।
মিটিং রুমে উপস্থিত রয়েছে এখানকার বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ।সকলের মাঝে বলা ড: সারোয়ারের কথায় টুঁ-শব্দটিও করছে না রৌদ্র। কি বলবে সে? ওনার সব কথাইতো সত্যি! এই অপারেশনটা যদি বিফল হয় তাহলে একজন ডাক্তার হিসেবে তার ক্যারিয়ারে বিরূপ প্রভাব ফেলবে কেসটা। কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে তাকে যে এই মানুষটাকে বাচাতেই হবে! এই মানুষটার সাথে তার যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। রৌদ্র একবার চোখ দুটো বন্ধ করে। মুহুর্তেই তার কল্পনার মানসপটে ভেসে ওঠে তার প্রিয় মানুষটার কান্নারত মলিন মুখখানা। চট করে চোখ মেলে তাকায় রৌদ্র। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আত্মবিশ্বাসের সহিত বলে ওঠে,

~যাই হয়ে যাক না কেন, এই অপারেশনটা আমি করবই।আর চিন্তা করবেন না, এই অপারেশনের সকল দ্বায়ভার কেবলমাত্র আমারই থাকবে।
উপস্থিত ডাক্তারদের মাঝে সিনিয়র ড: ফজলে রাব্বি রৌদ্রের কথায় নাখোশ হলেন।সে আরও একবার নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললেন,
~রৌদ্র আপনি শিওর সবটা বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন?
রৌদ্র কালবিলম্ব না করে জবাব দেয়,
~জ্বি। আমি সবটা জেনে- বুঝেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।
উপস্থিত ডাক্তাররা আর কিছু বললেন না।অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে চলে গেলেন সকলে।

রৌদ্র অপারেশনের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হয়ে আইসিইউ-র সামনে দাড়ায়।তাকে দাড়াতে দেখে মহিলাটি তার ছেলের হাত ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র অনিমেষ তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মহিলাটি ধরে আসা গলায় বললেন,
~আমার স্বামী বাঁচবে তো?
রৌদ্র সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে নিলো।মাস্কের আড়ালে ঠোঁট কামড়ে ধরে। ক্ষনিকের মধ্যেই রাশভারি কন্ঠে বলে,
~ইনশাআল্লাহ! আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো বাকিটা আল্লাহর হাতে।
কথা শেষ করে সাথে সাথে ঢুকে পড়ে রৌদ্র। শুরু হয় সকলের মৃত্যুসম যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষার প্রহর।
প্রায় ৪ ঘন্টা পর 🍁🍁

আইসিইউ থেকে একে একে বের হয় সকল ডাক্তাররা।সকলের মুখেই কিঞ্চিৎ হাসি।তারা বের হবার প্রায় মিনিট পাঁচেক পর রৌদ্র বের হয়।তাকে দেখে তরুনটি তার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
~ড: আমার আব্বু!
রৌদ্র মুখ হতে মাস্কটি খোলে। মুখে সাফল্যের হাসি টেনে বলে,
~আলহামদুলিল্লাহ! অপারেশন সাকসেসফুল। এখন বাকিটা রোগীর জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা।
তরুনটি ছলছল চোখে রৌদ্রের দিকে তাকায়। এই মুহূর্তে ঠিক কিভাবে রৌদ্রের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে সেই ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা ও। সে রৌদ্রকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রৌদ্র তাকে থামিয়ে বললো,
~তুমি তোমার ফেমিলিকে নিয়ে আমার কেবিনে আসো।রাইট নাও!
একপ্রকার আদেশের মত কথাগুলো বলে সেখান থেকে চলে যায় রৌদ্র। তরুনটি তেমন সাত-পাঁচ না ভেবে নিজ পরিবারকে নিয়ে মিনিট খানেক পর হাঁটা ধরে রৌদ্রের কেবিনের উদ্দেশ্যে।

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৭

রৌদ্রের কেবিনের বন্ধ দরজার সামনে উপস্থিত হতেই থমকে দাড়ায় তরুণটি এবং তার মা। দুজনেই অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায় ইতোমধ্যে। উভয়ই একে-অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে কিয়ৎকাল। মহিলাটি পরমুহুর্তেই দুপা পিছিয়ে যায় সেখান থেকে। কেবিনের দরজায় লেখা নামটি যে তার বড্ড চেনা।কি করে ভুলবে এই নামকে ওনি! মুখে ওড়নার একাংশ গুজে সেখান থেকে চলে যাবার উদ্দেশ্যে যেই না একপা বাড়াবে ওমনি কেও পেছন থেকে তার হাতের কব্জি টেনে ধরে। মহিলাটি হকচকিয়ে যায়। অবাক নেত্রে পেছনে ফিরে দেখতে পায় রৌদ্র তার হাত টেনে ধরেছে।তিনি হাত ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা চালাতে লাগলেন।তক্ষুনি তার কানে ভেসে আসে এক মৃদু অভিমানী কন্ঠ,
~তোমার টোটনের গায়ে জাদুর পরশ একে না দিয়েই চলে যাবে ফুপ্পি!

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here