সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৯
Jannatul Firdaus Mithila
~তোমার টোটন কে জাদুর পরশ একে না দিয়েই চলে যাবে ফুপ্পি!
কথাটি কর্ণগোচর হতেই মুহুর্তে থমকে যান আমরিন বেগম।দ্রুততার সহিত পেছনে ফিরলেন তিনি।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
~তুমি আমার টোটন?
রৌদ্র তার কথায় কোন প্রতিত্তোর করলো না। চোখের পলকে ঝট করে বুকে ঝাপিয়ে পড়ে আমরিন বেগমের। শক্ত করে জড়িয়ে রেখে ধিমি স্বরে উত্তর দেয়,
~এতো সহজে ভুলে গেলে আমায়?
আমরিন বেগম যেন পরমুহুর্তেই সকল বাধা-বিপত্তি,নিষেধাজ্ঞা ভুলে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন রৌদ্রকে বুকে নিয়ে। পরে রৌদ্রের মুখটি বুক থেকে উঠিয়ে অগণিত স্নেহময় পরশ একে দিতে লাগলেন তিনি। রৌদ্রও চুপটি করে অনুভব করছে সবটা।কান্নার জোয়ারে ধরে আসা গলায় আমরিন বেগম বললেন,
~আমার টোটন! আমার রোদ! কত্ত বড় হয়ে গেছিস তুই আব্বু।আমায় ভুলে যাসনিতো বাপ?
রৌদ্র তার কথায় মুচকি হাসলো। ফুপুর চোখদুটো সযত্নে মুছে দিয়ে বলতে লাগলো,
~নাহ! তোমার টোটন তোমায় কখনো ভুলেনি এবং ভুলবেও না।
আমরিন বেগম যেন আরও আহ্লাদী হলেন। রৌদ্রের বুকে মুখ গুজে বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। রৌদ্র তাকে আটকালো না।ঝড়ুক না কিছু জমানো কষ্ট, ব্যাথা চোখ বেয়ে অশ্রু বেশে!
বেশকিছুক্ষন পর আমরিন বেগম মাথা তুললেন। ফোলা ফোলা ভেজা চোখ দুটো ওড়নার আঁচলে মুছলেন।রৌদ্র তাকে স্বাভাবিক হতে দেখে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
~ভেতরে এসো।
আমরিন বেগমও এক কথায় সায় দিলেন ।ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঢুকে পড়লেন রৌদ্রের কেবিনে। কেবিনে ঢুকে আমরিন বেগম তার ছেলে-মেয়েকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন,
~টোটন! ও আমার ছেলে শাহানুর ইফতি।বুয়েটে পড়ছে। আর ও আমার মেয়ে সায়্যেদা জান্নাত ইকরা।অনার্স ১ম বর্ষে পড়ে।
রৌদ্র তাদের দিকে তাকায়। ইফতি আর ইকরার সঙ্গে কথা বলে অনেক্ক্ষণ। কথা বলার এক পর্যায়ে আমরিন বেগম কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
~বাড়ির সবাই কেমন আছে টোটন!
রৌদ্র তার ফুপুর মনের অবস্থা বুঝতে পারে।টের পায় ফুপুর মনের উচাটন অবস্থা! রৌদ্র চোখ থেকে খয়েরী ফ্রেমের চশমাটি খুলে টেবিলের ওপর রাখে।ঠান্ডা স্বরে বলে,
~আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে।
আমরিন বেগম কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে মাথা নাড়ালেন।মনের মধ্যে তার অসংখ্য কথা,জমানো অসংখ্য অভিযোগ, অভিমান অথচ ব্যক্ত করতে যে ঘোর দ্বিধা!
~এই কারা আপনারা? ছাড়ুন আমায়! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন এভাবে। ছাড়ুন বলছি।
অরিনের এতকথা বলার পরও তার হাতে-পায়ের বাঁধন খুলছে না তার সামনে উপস্থিত থাকা তিনজন পুরুষ। অরিনের মনে এবার প্রচন্ড ভয় হয়।যদি এই লোকগুলো তার সঙ্গে খারাপ কিছু করে ফেলে তখন! এভাবে একা নিজেকে কি করে বাঁচাবে ও! কিভাবে করবে নিজের আত্মরক্ষা!
🌼কিছুক্ষন আগের কথা…..
~অরি, তুই একা যেতে পারবি তো?
ফারিয়ার প্রশ্নে চোখ-মুখ কুচকায় অরিন।এই পর্যন্ত এ নিয়ে ১০ বার এ-ই একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে ফারিয়া। অরিন অতিষ্ঠ গলায় বললো,
~আর কয়বার জিজ্ঞেস করবি বলতো? তুই একই প্রশ্ন বারবার করে না হাঁপালেও আমি উওর দিতে দিতে যথেষ্ট হাঁপিয়ে উঠেছি। যাকগে, আমি আবারও বলছি আমি যেতে পারবো,পারবো,পারবো। এবার খুশি?
ফারিয়া তবুও সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত হতে পারলো না।কিন্তু এ মুহুর্তে অরিনকে আরেকটা কথা বললেও যে মেডাম একেবারে চটে যাবে এটা সে ১০০% শিওর। তাই ফারিয়া চুপ রইলো। অরিনকে গাড়িতে ঠিকঠাক মতো বসিয়ে দিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত গাড়ি তার চোখের সীমানা ছাড়িয়ে না যায় ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো। গাড়িটি চক্ষু আড়াল হতেই একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ত্যাগ করে বাড়িতে ঢুকে পড়ে ফারিয়া।
অরিনের গাড়িটি কিছুটা সামনে এগোতেই হঠাৎ ব্রেক কষে। অরিন সঙ্গে সঙ্গে সামনে ছিটকে পড়ে।কপালে হালকা ব্যাথা লাগায় এক হাত দিয়ে ঘষতে থাকে বারংবার। পরক্ষণেই চিন্তিত কন্ঠে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে,
~ চাচা কি হয়েছে? হঠাৎ মাঝরাস্তায় ব্রেক করলেন যে!
ড্রাইভার নিজেও যেন চিন্তিত। অনবরত গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করতে গিয়েও বরাবর ব্যার্থ হচ্ছেন। তিনি কিছুটা সংকোচ নিয়ে বললেন,
~ মামুনি আফনি দুইডা মিনিট বইয়েন।আমি অহনি যামু আর আমু।আসলে ইঞ্জিনে মন হয় কিছু একটা সমস্যা হইছে।আপনি চিন্তা কইরেন না। বইয়েন এনো।
বলেই তিনি বের হয়ে গেলেন গাড়ি থেকে।
এদিকে অরিন শুষ্ক ঢোক গিলছে বারেবার। কাঁপা কাঁপা হাতে পার্স থেকে ফোনটা বের করে। মুহূর্তেই মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে যায় ওর।কথায় আছে “অভাগা যেদিকে যায়, নদীও সেদিকে শুকায়” এই মুহূর্তে অরিনের মনে হচ্ছে এই কথাটা তার জন্য একেবারেই প্রযোজ্য! কি দরকার ছিলো ওর এতো তারাহুরো করে বাসা থেকে বের হওয়ার যার জন্য নিজের ফোনটাতেই চার্জ দিতে ভুলে গেলো! এই প্রথম অরিনের ইচ্ছে করছে নিজের দুগালে চটাশ করে দুটো লাগিয়ে দিতে। মা একদম ঠিকই বলে,
“অরিন, তুই তোর খামখেয়ালীপনার কারনে অনেক বড় বিপদে পড়বি!” অরিনের এখন ভিষণ করে উপলব্ধি হচ্ছে তার মায়ের কথা-ই সঠিক। মনে মনে আবার বলছে,
~আল্লাহ! এবারের মতো কোন বিপদ দিয়োনা।ভালোয় ভালোয় যেন বাড়িতে পৌছুতে পারি।
অরিনের ভাবনার মাঝেই তার কানে ভেসে আসে ড্রাইভারের আত্মচিৎকার। সাথে সাথে আঁতকে ওঠে অরিন। ভয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে হাত বাড়িয়ে গাড়ির দরজা আনলক করে বেরিয়ে পড়ে গাড়ি থেকে।অথচ সে একটিবারও বুঝলোনা তারাহুরোয় সে নিজের জন্য কি কালটাই না ডেকে এনেছে! অরিন গাড়ি থেকে নামার পরমুহূর্তে একজন পুরুষ এসে তার মুখের ওপর একটি কালো কাপড়ের তৈরি মুখোশ পেচিয়ে ধরে। অন্য একজন ততক্ষণে তার দুহাত একত্রে বেধে ফেলেছে। অরিন ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে যায়। হতবিহবলতায় চিৎকার করতেও ভুলে যায় সে।যখন লোকগুলো তাকে টেনে হিঁচড়ে অন্য একটি গাড়িতে ওঠায় তখন অরিন নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চিৎকার করে কিন্তু এখন কি তা আর কোন কাজে দিবে?
বর্তমান
অরিন এক নাগাড়ে চিৎকার করে অনুনয় করে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার অথচ কারো কানেই যেন তা বিশেষ কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না। অরিন একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।তার মুখমণ্ডল এখনো কালো কাপড়টি দিয়ে আচ্ছাদিত।ফলস্বরূপ ও নিজেও বুঝতে পারছে না ওরা ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
প্রায় ৩০ মিনিট পর……
একটি নির্জন জায়গায় থামানো হয় গাড়িটি। আশপাশ যতদূর চোখ যায় মনে হবে সম্পূর্ণ স্থানই বিরান! কিন্তু এই নির্জন জায়গায় কিছুটা দূরে একটিমাত্র টিনেরঘর বানানো। অরিনকে নিয়ে লোকগুলোর গন্তব্যস্থলও সেখানেই। লোকগুলো অরিনকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বিকৃত হাসি দেয়। রাতের জোৎস্নার আবছা আলোয় লোভাতুর দৃষ্টিতে অরিনের পা থেকে মাথা অবধি পরোক্ষ করে তারা।তাদের মধ্য থেকে একজন কন্ঠে পৈশাচিক সূচনা এনে বলতে থাকে,
~ ভাই,মাইয়াডা কিন্তু এক্কেবারে খাসা। হালার কিন্তু চয়েস আছে।
~হুম ঠিকই কইছস।কিন্তু দেখ আমগো কপাল! আমরা এতো কষ্ট কইরা এই মালেরে তুইল্লা আনছি আর ঐ হালায় হুদা বইয়া বইয়া হুকুম ঝাড়বো আর একলা একলা মজা লইবো।
তাদের দু’জনের কথা শুনে ৩য় জন বললো,
~ভাই তাইলে একখান কাম করি।আগে আমরা মজা লইয়া লই এরপরে ঐ হালারে দেই কি কন?
~আরে না আহাম্মক! হেইতের তে তো এই মালের লাইগ্যা এডভান্স লইছি।ঠিকঠাক মতো না পৌঁছাইলে আবার বাকি টেকা পামুনা।এরচেয়ে ভালা আগে দেই তারপর হের মজা করনের পরে আমরাও নাহয় করমু কি কস?
১ম ব্যাক্তিটির কথায় বাকি দু’জনও সম্মতি জানায়। এদিকে অরিনের তাদের এসব কথা শুনে গা ঘিনঘিন করে ওঠে। সে আবারও ফুপিয়ে কান্না করে ওঠে। তার কান্নার আওয়াজ কানে যেতেই উপস্থিত লোকগুলো তার মুখে টেপ পেচিয়ে দেয়।অরিন গুঙিয়ে যায় একেধারে।মনে মনে দোয়া করছে— অন্তত কেও একজন আসুক তাকে এই বিপদ হতে উদ্ধার করতে!
রাত:৮ :১৫🌼🌼
~ আজকে শুধু বাসায় আসুক একবার! ওর ধিঙিপনা বের করবো। কতবার করে বলে দিলাম ৮ টার মধ্যে বাসায় ফিরতে,অথচ এখনো ফেরার নামগন্ধও নেই!
রাফিয়া বেগম চিন্তিত সুরে কথাগুলো বলে কিছুটা দম নিলেন। পাশ থেকে জুবাইদা বেগম তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
~চিন্তা করিস না রাফু। মেয়েটা সচরাচর কোথাও যায়না,আজকে হয়তো বান্ধবীদের পেয়ে আড্ডায় বসে গেছে। আর তাছাড়া বাড়ির গাড়িও তো ওর সাথে আছে তা-ই না!
জুবাইদা বেগমের এহেন আশ্বাসেও নিজের মনের মধ্যে ওঠা বিদঘুটে চিন্তাভাবনার ইতি টানতে পারলেন না রাফিয়া বেগম। পারবেনই বা কিভাবে? মায়ের মন বলে কথা! রাফিয়া বেগম চিন্তিত গলায় বললেন,
~এমনটাই যেন হয়রে জবা! মেয়েটা যেন সুস্থভাবে বাড়িতে ফিরে।
অনিক বাসায় এসে জানতে পারে তার বনু এখনো বাড়িতে ফিরে নি। সেই থেকে অনিক অনবরত অরিনের ফোনে কল দিয়ে যাচ্ছে। আজকে তার খুব রাগ উঠছে অরিনের ওপর। মানলো বনু ফ্রেন্ডের বাসায় গেছে তাই বলে কি ফোনটাও সুইচড অফ রাখবে! সে কি বোঝে না তার জন্য বাড়ির প্রতিটি মানুষ কেমন চিন্তা করে। অনিক নিজের ঘরে পায়চারি করছে আর একের পর এক অরিনের ফোনে কল দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বরাবরই একই কথা আসছে ওপাশ থেকে “আপনার ডায়াল কৃত নম্বরটি এই মুহুর্তে বন্ধ আছে”
অনিক আর একমুহূর্ত দেরি না করে গায়ে শার্ট জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে বাসা থেকে। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে ছুটে চলে ফারিয়াদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
প্রায় মিনিট বিশেক পর অনিক হন্তদন্ত হয়ে পৌঁছায় ফারিয়াদের বাসার সামনে।অনিক কালবিলম্ব না করে গাড়ি থেকে বের হয়। ব্যস্ত হাতে বাসার কলিং বেল চাপতে থাকে। প্রায় মিনিট দুয়েক পরে ফারিয়া এসে সদর দরজা খুলে দেয়। অনিককে এসময় নিজের বাড়িতে দেখে কিছুটা চমকায় ফারিয়া।। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
~ ভাইয়া আপনি হঠাৎ এ-সময়!
অনিক এ-প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
~ অরিন কোথায়? ওকে ডেকে দাও বাড়িতে ফিরতে হবে।
অনিকের মুখে এ-কথা শুনে ফারিয়া যেন আকাশ থেকে পড়লো। তৎক্ষনাৎ বিচলিত হয়ে বলল,
~কি বলছেন ভাইয়া! অরিনতো সেই এক ঘন্টা আগেই এখান থেকে চলে গিয়েছে। ও এখনো বাড়িতে পৌঁছায়নি?
অনিকের চোখেমুখে যেন নিমিষেই আধার নেমে আসে। বুকটা অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে ওঠে তৎক্ষনাৎ। গলার স্বর যেন কোথাও একটা আটকে গেছে তার। থেমে থেমে জিজ্ঞেস করে,
~ ১ ঘন্টা আগে বের হয়েছে?
ফারিয়া মাথা ঝাকায়। তারও এখন বড্ড চিন্তা হচ্ছে। কোথায় গেলো মেয়েটা?ও ঠিক আছেতো!
অনিক ফারিয়াকে আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে আসে গাড়ির নিকট। মাথায় তার রাজ্যের দুশ্চিন্তা। কোথায় আছে তার বনু? কোন বিপদ হলো নাতো?এসব ভাবনা মাথায় রেখে অনিক গাড়িতে বসে। গাড়ি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আশপাশে খুজতে থাকে। ফারিয়াদের বাড়ির উল্টো পথে গাড়ি ছোটায় অনিক।কিছুটা সামনে যেতেই চোখে পড়ে তাদের বাড়ির গাড়িকে।অনিক সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ব্রেক কষে। ব্যস্ত পায়ে নেমে আসে গাড়ি থেকে।পরক্ষণেই দেখতে পায় রাস্তায় আহত অবস্থায় পড়ে থাকা ড্রাইভারকে।অনিক সেদিকে একপলক তাকায়।গাড়ির ভেতর,বাহিরে, চারিদিকে হন্য হয়ে খুজতে থাকে নিজের বনুকে। কিন্তু কোথাও অরিনের হদিস নেই! অনিক খেয়াল করলো এখন ততটা রাত নাহলেও এদিকটা অনেকটাই নির্জন। অনিক চিৎকার দিয়ে ডাকতে থাকে অরিনকে,পাগলের মতো খুজতে থাকে এদিক-ওদিক। কোথাও অরিনকে না পেয়ে অনিক আবারও চলে আসে ড্রাইভারের কাছে।ড্রাইভারের মাথার পাশ বেয়ে রক্ত ঝড়ছে!সেদিকে খেয়াল করা মাত্রই অনিকের বুকটা আবারও মোচড় দিয়ে ওঠে। অনিক কি করবে ভাবতে ভাবতেই হুট করে তার মনে পড়ে রৌদ্রের কথা।অনিক সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে ফোন বের করে কল লাগায় রৌদ্রের নাম্বারে। একবার -দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হয় কলটি।
~ভাইয়া!
রৌদ্র ড্রাইভ করছিলো।অনিকের এমন কন্ঠ শুনে ভ্রুকুটি করে ও।চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে,
~ অনিক আর ইউ ওকে?
অনিকের গলা ধরে আসছে,কোনরকম নিজের কান্নাগুলো দমিয়ে রেখে কাপা কাপা কন্ঠে বলতে লাগলো,
~ভাইয়া,আমার অরিন!
সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ব্রেক কষে রৌদ্র। বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে,
~কি হয়েছে অরির? কোথায় ও? অরি ঠিক আছে তো?
~………
~কি ব্যাপার জবাব দিচ্ছিস না কেন? কি হয়েছে অরির? ওর কাছে ফোনটা দে!
অনিক বহুকষ্টে নিজেকে সামলে একে একে সবটা খুলে বললো।রৌদ্র সবটা শোনার পর স্তব্ধ হয়ে রইলো কিয়ৎক্ষন! অতপর অনিকের কানে আসে এক অন্যরকম স্বর,
~তোর লোকেশন সেন্ড কর!
বলেই খট করে ফোন কেটে দেয় রৌদ্র । অনিকও তার কথামতো লোকেশন দিয়ে সেখানেই গাড়ির গা ঘেঁষে বসে পড়ে মাটিতে। ভাবতে থাকে — কিভাবে বলবে বাড়িতে অরিনের নিখোঁজ হওয়ার কথা। না বলেই বা কিভাবে খুজবে ও অরিনকে।
অনিক চোখ বন্ধ করে। সেখান থেকে অবিরাম গড়িয়ে পড়ে নোনতা জল।বিড়বিড়িয়ে বলে,
~ কোথায় তুই বনু! কোথায়!
প্রায় কিছুক্ষণ পর দুর্বার গতিতে গাড়ি নিয়ে অনিকের সামনে উপস্থিত হয় রৌদ্র। গাড়ি থামিয়ে হন্তদন্ত পায়ে নেমে আসে, অনিক বুঝি রৌদ্রকে দেখে এতক্ষণ যাবত নিজের দমিয়ে রাখা কান্নাগুলো আর আটকাতে পারলোনা। ছুটে এসে রৌদ্রকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কান্নার জোয়ারে ধরে আসা কন্ঠে থেমে থেমে বললো,
~ আম-মার বনু কই ভাইয়া।ওকে এনে দাও প্লিজ! ওর যাতে কিচ্ছু নাহয়।
রৌদ্রের বুকটায় বুঝি কেও হাতুড়ি পেটা করছে।সে অনিককে শক্ত করে এক হাত দিয়ে আগলে ধরে। শক্ত কন্ঠে বলে,
~ পেয়ে যাবো ওকে। চিন্তা করিস না। আমার অরির গায়ে সামান্য ফুলের টোকাও দেবে এমন কোন বাপের বেটা এই পৃথিবীতে জন্মায়নি!
সহসা অনিকের কান্না থেমে যায়। হাতদুটো ঢিল হয়ে আসে তার।অবাক চোখে তাকিয়ে রয় রৌদ্রের দিকে। রৌদ্রের চোখের দিকে তাকাতেই ভড়কে যায় ও।রৌদ্রের চোখদুটো ইতোমধ্যেই লাল রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। রৌদ্র চোয়াল শক্ত রেখে বললো,
~ চল!
বলেই গাড়ির দিকে দ্রুতপদে হাটা ধরে সে। অনিকও তার কথামতো পিছুপিছু আসে।অতপর দুজনে গাড়িতে উঠে যাত্রা শুরু করে।
অরিনকে লোকগুলো ধরে আনে নির্জন জায়গাটির সেই পুরনো পরিত্যক্ত টিনের ঘরটিতে। লোকগুলো ভেতরে ঢুকে বিনম্র শ্রদ্ধায় সালাম জানায় তাদের সামনে উপস্থিত অরিনের কন্ট্রাক্ট দেওয়া লোকটিকে। মানবটি রহস্যময় বাঁকা হেসে তাদেরকে বললো,
~গুড জব! পাখিকে ঠিকঠাক মতো খাঁচায় বন্দী করতে পেরেছো তবে!
পরক্ষণেই তাদের উদ্দেশ্যে একটি সাইন করা চেক এগিয়ে দেয়।
~এই নে, তোদের বাকি পাওনা।এবার বিদেয় হো।
লোকগুলোর মধ্যে একজন এগিয়ে এসে চেকটি হাতে নেয়।কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলতে থাকে,
~ ইয়ে ভাই একটা কথা আছিলো।
মানবটি বাঁকা হাসে।আঙুল দিয়ে ঘাড় চুলকিয়ে বললো,
~জানি কি বলতে চাচ্ছিস। তোদের চোখমুখ দেখেই বোঝা যায় সবটা। কিন্তু শুনে রাখ আমি সিহাব নিজের ব্যাবহারকৃত সামান্য জিনিসপত্রও অন্যকে এলাও করিনা সেখানে তোরা আমার পছন্দের মানুষকে চাচ্ছিস! জানিস এই মুহূর্তে তোদের আমি এখানেই জ্যান্ত পুতে ফেলতে পারি। নিজেদের ভালো চাইলে এখান থেকে এক্ষুনি সর।
লেকগুলো সিহাবের কথায় দমে যায়।ফাঁকা ঢোক গিলে মাথানত করে সেখান থেকে প্রস্থান ঘটায়। তাদের চলে যেতে দেখে সিহাব ধীর কদমে এগিয়ে যায় অরিনের দিকে।অরিনের সামনে হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে, আলতো হাতে মুখমন্ডলের ওপরের মুখোশটি খুলে দেয়। অরিন সাথে সাথে চোখ উঠিয়ে সামনে তাকায়।সম্মুখে থাকা মানুষটিকে দেখে আপনাআপনি চোখ বড়সড় হয়ে আসে অরিনের। সিহাব মুচকি হেসে অরিনের মুখ থেকে টেপটি সরিয়ে দেয়। আলতো গলায় বললো,
~ওয়েলকাম মেডাম!
অরিন বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলো সিহাবের দিকে।অবাক হয়ে বলে ওঠে,
~আপনি!
~আমার অরি কই? কোথায় নিয়ে গিয়েছে ওকে? তোরা থাকতে কিকরে এরকমটা হলো। উত্তর দে!
হুংকার ছেড়ে একের পর এক থাপ্পড় দিয়ে বলতে থাকে রৌদ্র। মার খেতে থাকা লোকগুলো ভয়ে তটস্থ! রৌদ্রকে কি বলবে তারা? তারাতো ঠিকই নজর রেখেছিলো অরিনের ওপর কিন্তু হুট করে কি থেকে কি হয়ে গেলো তারাও বুঝতে পারছে না! তারা অরিনের নিখোঁজ হওয়ার খবর পেতেই খোজাখুজির তোড়জোড় চালিয়েছে। রাস্তায় থাকা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অরিনকে কিডন্যাপ করা গাড়িটির নম্বরও পেয়েছে। তারা এখন সেই গাড়িটির জিপিএস ট্রাক করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। যদি কোনভাবে ট্র্যাক করতে পারে তাহলে খুব সহজেই তারা অরিন অবধি পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু এতসবেও যেন রৌদ্রের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। সে একের পর এক হুংকার দিয়ে যাচ্ছে সকলকে।অনিক চোখমুখ লাল করে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে সেই কখন থেকে।মনে মনে চাইছে,”বনুটা যেন সুস্থ থাকে”
রৌদ্র কিছুটা দম নেয়। ঠোট কামড়ে ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে ম্যাসাজ করতে থাকে। অতঃপর আরেক হুংকার ছেড়ে বলে ওঠে,
~ আমার সানশাইনের যদি কিছু হয়, আই সয়্যার তোদের সব-কয়টাকে আমি নিজ হাতে জবাই করবো।
লোকগুলো এরূপ হুংকারে শুষ্ক ঢোক গিলে। আবারও মনোযোগ দেয় নিজেদের কাজে।তক্ষুনি তাদের মধ্যে থেকে একজন চেচিয়ে উঠে,
~ বস! লোকেশন পেয়েছি।
লোকটার বলতে দেরি রৌদ্রের আসতে দেরি নেই।সে কম্পিউটারের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা লোকেশনটি দেখে নিয়ে চোয়াল শক্ত করে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। অনিকও ছোটে তার সঙ্গে।
~ কি মেডাম, সারপ্রাইজ হলে! বলেছিলাম না আমাদের আবারও দেখা হবে।
~কেন ধরে এনেছেন আমায়?
সিহাব বাঁকা হাসে।অরিনের মুখের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে নিলে অরিন দূরে সরে যায়।সিহাব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।ঠান্ডা স্বরে বলে,
~এখন এটুকু স্পর্শ সহ্য হচ্ছে না তোমার, অথচ আর কিছুক্ষণ পর তোমার সর্বাঙ্গে শুধু আমার কেবলমাত্র আমারই স্পর্শ থাকবে মেডাম!
অরিন আতকে ওঠে। পরপর শুকনো ঢোক গিলে।
~মানে!
সিহাব অরিনের আরেকটু কাছে চলে আসে,হাস্কি স্বরে বললো,
~মানে আরেকটু পর তুমি আমার বউ হবে জানেমন!
তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে ভেসে এক গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বর,
~ ওকে বিয়ে করার মতো কলিজা আছে তোর! দেখিস আবার বিয়ে করতে গিয়ে একেবারে মরে টরে যাস না যেন।
সিহাব সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ফিরে। কিছু বুঝে ওঠবার আগে তার নাক বরাবর এলোপাথাড়ি ঘুষি পড়তে থাকে। রৌদ্র তার শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে মেরে যাচ্ছে সিহাবকে।অনিক ছুটে এসে অরিনকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আস্তে ধিরে খুলে দেয় বোনের হাত-পা।
অরিনও ভাইকে পেয়ে কাঁদতে শুরু করে একাধারে। অন্যদিকে রৌদ্র এখনো মেরে যাচ্ছে সিহাবকে।সিহাব যেন রৌদ্রের সাথে কিছুতেই পেরে উঠছে না।রৌদ্রের হাতে,গায়ে সিহাবের মুখের রক্ত লেগে যাচ্ছে তাই অবস্থা। তখনি কানে ভেসে আসে অরিনের ধীমী স্বর,
~রোদ ভাই!
হঠাৎ পরিচিত ডাকে রৌদ্রের হাতদুটো তৎক্ষনাৎ থমকে যায়। শরীরের শিরা-উপশিরায় বয়ে যায় মৃদু ঝংকার। মনে পড়ে যায় এখানে অরিনের উপস্থিতির কথা। সাথে সাথে সিহাবের কলার ছেড়ে দেয় সে। পাশে থাকা তার লোক গুলোকে চোখ দিয়ে ইশারায় সিহাবকে নিয়ে যেতে বলে।লোক গুলোও রৌদ্রের ইশারা মোতাবেক কাজে লেগে পড়ে।অন্যদিকে অরিন এখনো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে।তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না তার রোদ ভাই কাওকে মারতেও পারে! তারওপর রোদ ভাইয়ের গায়ে রক্ত দেখে হাত-পা কাপছে ওর। রক্তে যে তার মারাত্মক ফোবিয়া! অরিনের চোখের সামনে সবকিছুই কেমন আবছা হয়ে আসছে।নিভু নিভু চোখে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে যেই না মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিবে ওমনি রৌদ্র এসে তাকে খপ করে ধরে নেয়। অরিন নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে রয় রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র অরিনের গালে হালকা চাপড় দিয়ে বিচলিত কন্ঠে বলতে থাকে,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৮
~ জানবাচ্চা,চোখ খোল! তাকা আমার দিকে সোনা।কিচ্ছু হবে না তোর।আমি থাকতে তোর গায়ে একটা আঁচড়ও পড়তে দিবো না! এ-ই, এই জানবাচ্চা! কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোর!
অরিন আর কি বলবে! ফোবিয়ার কারনে সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায় তার রোদ ভাইয়ের বাহুডোরে।