সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৩
Jannatul Firdaus Mithila
বর্তমান : ১১ বছর পর
কপালে হাত রেখে অতীতের সেই স্মৃতিগুলো মনের কোনে আওরাতে আওরাতে একটা সময় ঘুমিয়ে পরলেন কবির সাহেব।
চারিদিকে ফজরের আযান ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ পরেই জেগে উঠলেন জুবাইদা বেগম। পাশেই স্বামীর ঘুমন্ত নির্মল মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিয়ৎক্ষন।ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে তিনি উঠে চলে গেলেন ওয়াশরুমে। বেশকিছুক্ষন পর একেবারে অযু করে বের হলেন তিনি,বের হয়ে আবারও স্বামীর দিকে তাকালেন , আর ভাবলেন হয়তো রাতে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ক্লান্ত সে,,তাই তিনি স্বামী কে ডাকলেন না।নিজেই নামাজ পড়তে চলে গেলেন।
নামাজ শেষে কিছুক্ষণ কোরআন পড়লেন জুবাইদা বেগম,এটা যে তার রোজকার অভ্যাস।এখনও কবির সাহেব গভীর ঘুমে। কোরআন পড়া শেষে তিনি চলে গেলেন তাদের বাগানে।
বলাবাহুল্য এহসান বাড়ি এখনো যৌথ থাকায় বাড়িটি বেশ ভালোই বড়। নিচ তলায় চার রুমে কবির এহসান,, সাব্বির এহসান,, তায়েফ এহসান,, তাশরিক এহসান এই চার ভাই থাকেন। আর দোতলায় আছে পাঁচ রুম,,সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে একেবারে বামদিকের কর্নারের রুমটা অনিকের,, তার পাশের রুমটা আহি আর মাহির,, তার পাশেরটা রিমির। এই তিনটা রুমের পরেই মাঝে একটা ছোট্ট বসার মতো ড্রয়িং রুম সেখানেও সোফা সেট বিছানো। এর ঠিক ডান পাশের প্রথম রুমটা অরির।
তার পাশের রুমটা রৌদ্রর। বিশাল এই ডুপ্লেক্স বাড়িটির সামনে রয়েছে গেট অবধি বেশ খানিকটা চওড়া রাস্তা। বাড়িটার একপাশে রয়েছে ফুল বাগান।বাগানটিতে রয়েছে বেশ কয়েকধরণের ফুল গাছ।গোলাপ,, রজনীগন্ধা,,ঢালিয়া,, গাধা,,সূর্যমুখী,,আর সবশেষে রয়েছে রৌদ্রর শখের কাঠ গোলাপ গাছটি।
জুবাইদা বেগম চলে এলেন বাগানে হাটতে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
তার ছেলে রৌদ্রর হাতে করা বাগান এটা। রোজ তিনি এখানে আসেন হাটতে। এখানে আসলে তার মনটা আপনা আপনিই ভালো হয়ে যায়। ছুয়ে ছুয়ে দেখতে থাকেন ছেলের রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো। প্রতিদিন তিনি এগুলোর যত্ন নেন। এমনকি ছেলের রুমটিও রোজ নিয়ম করে গোছান তিনি। আসলেই কি গোছানো,, শুধু ছেলের রুমে গিয়ে চুপচাপ একবার বিছানায় হাত মরানো,, ছেলের ছবির ফ্রেমে চুমু খেয়ে চোখ থেকে দু-তিন ফুটো অশ্রু গড়ানো,, ছেলের স্কুল থেকে জিতে আনা প্রাইজ গুলো নিজের শাড়ির আচল দিয়ে বারবার মুছে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটানো,,ছেলের স্কুল ড্রেসটি নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বুকে জড়িয়ে থাকাই যেনো তার রোজকার রুটিনের এক বিরাট অংশ। এগুলো তিনি প্রতিদিনই করেন,, আর করবে না-ই বা কেন? মা তো! নাড়ি ছেঁড়া ধন তার। কতগুলো বছর সামনে থেকে দেখেন না।একটু ছুঁতে পারেন না। একটু জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেতে পারেন না,,এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কি-ই বা আছে। রৌদ্র চলে যাবার পর প্রথম পাঁচ বছরে ছেলেটা প্রতি বছরে একবার করে আসতো কিন্তু আস্তে আস্তে ছেলের পড়ার চাপও বাড়তে থাকে আর ছেলের আসা ও বন্ধ হয়ে যায়। আজ প্রায় ৬ বছর ছেলেটা আসে না। এগুলো ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। হঠাৎ ঘাড়ে কারো শীতল স্পর্শ পেতেই পেছনে ফিরেন তিনি,তাকিয়ে দেখেন রাফিয়া বেগম দাড়িয়ে আছেন। জুবাইদা বেগম কে চুপ থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন রাফিয়া বেগম,,
“রোদের কথা মনে পড়ছে জবা?”
এ কথার উওরে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলেন জুবাইদা বেগম। রাফিয়া বেগম যেনো তার উওর পেয়ে গেছেন,, তাইতো একহাতে জড়িয়ে নিলেন প্রানপ্রিয় বান্ধবী কম বোন কে,,মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন, ” চিন্তা করিস না জবা,,আমাদের রোদ ভালো আছে,, এইতো আর কটাদিন, এর পরেই তো শেষ। ইনশাআল্লাহ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে। তুই শুধু দোয়া কর বোন। ”
অতঃপর দু’হাতে আগলে ধরলেন জুবাইদা বেগমের মুখখানা,, গড়িয়ে পড়া অশ্রু গুলো মুছে দিলেন সযত্নে। জুবাইদা বেগম ও মন এবং নিজেকে ধাতস্থ করে নিলেন শীঘ্রই। তারপর দু’জনে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন।ইতোমধ্যেই মাইমুনা বেগম ও রাইসা বেগম ও উঠে পড়েছেন ঘুম থেকে। তারপর চার জা মিলে হাতে হাতে সকালের নাস্তার প্রস্তুতি করতে লাগলেন।
সকাল ৮:০০,, কবির সাহেব ঘুম থেকে উঠলেন সবে।রোজ ভোরে নামাজ পড়ে হাটতে বের হন তিনি কিন্তু আজ শরীর ততোটা ভালো না থাকায় গেলেন না ।অতঃপর ফ্রেশ হতে চলে গেলেন তিনি। ফ্রেশ হয়ে বের হতে না হতেই দেখলেন তার ঘরে তার ভাইয়েরা উপস্থিত । তিনি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন সকলের পানে।ওয়াশরুমের দরজার আওয়াজ পেতেই তিন ভাই চাইলেন সেদিকে,, কবির সাহেব কে দেখেই তারা তড়িঘড়ি করে কবির সাহেব কে ধরাধরি করে বিছানায় বসিয়ে নিজেরা বসলেন তাকে ঘিরে। কবির সাহেব খাটে,, তার ডান হাত ধরে বসে আছেন সাব্বির সাহেব,, বামহাত ধরে বসে আছেন তায়েফ সাহেব আর দু’পায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে আছেন তাশরিক সাহেব। কবির সাহেব কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইলেন ভাইদের কান্ড দেখে।কিছুক্ষণ পর নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন তার আগেই তার ভাইয়েরা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন একে একে,,
“ভাইজান তোমার নাকি কাল রাতে শরীর খারাপ করেছে? ” বেশ চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন সাব্বির সাহেব।
“ভাইজান তোমার নাকি বুকে ব্যাথা উঠেছিলো? “পরপরই একই ভাবে জিজ্ঞেস করলো তায়েফ এহসান।
“ভাইজান এখনও কি খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকবো?”এবার জিজ্ঞেস করলেন তাশরিক সাহেব।
“ওরে তোরা কি শুরু করলি বাচ্চাদের মতো, একে একে প্রশ্ন করেই যাচ্ছিস,, আমাকে অন্তত বলতে দে কিছু,,,আমার কিছু হয়নি,, আমি ঠিক আছি আলহামদুলিল্লাহ ” কবির সাহেব হাত দুটো ছাড়াতে চেয়ে বললেন।
“কিন্তু ভাবিমা যে বললো তোমার নাকি শরীর খারাপ করেছিলো রাতে,,আবার তুমি নাকি ঔষধ ও খেয়েছো বুকে ব্যাথার,,” সকলে একসাথে বলতে লাগলো।
“ও কিছু না,, এই বয়সে এসব একটু আধটু হয়,,তোরা এত চিন্তা করিস না, ” ভাইদের আশ্বাস দিয়ে বলতে লাগলেন কবির সাহেব।
“চিন্তা হবে না কেনো ভাইজান,, তুমি ছাড়া আমাদের আর কে-ই বা আছে বলো,,তুমিই যে আমাদের বাবা-মা সব” তিন ভাই বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে কথাগুলো বলে একসাথে বড় ভাইয়ের কোলে মাথা রেখে কোমর জড়িয়ে ধরে। কবির সাহেব ভাইদের এমন অকৃত্রিম ভালোবাসায় সন্তুষ্টির হাসি হাসেন। অতপর নিজেও তাদের আগলে জড়িয়ে ধরেন।দরজার বাহির থেকে রুমে উঁকি দিয়ে এতক্ষণ দাড়িয়ে ছিলেন বাড়ির বউরা।চার ভাইয়ের এমন মিল,,অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখে সকলেরই যেনো চোখ এবং মন জুড়িয়ে যায়। কেউ দেখলে বলবে এদের এতো বয়স হয়েছে,, অথচ দেখো এখনও কেমন বাচ্চাদের মতো করে। এসব দেখে মনে মনে সকলে দোয়া করতে লাগলেন আল্লাহ যেনো সর্বদা এদের জুটি সহিসালামত রাখেন।
প্রায় আধঘন্টা পর চার ভাই মিলে খাবার টেবিলে উপস্থিত হন। তার প্রায় ৫ মিনিট পরেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে অনিক একদম ফর্মাল গেটআপে। সেই কিশোর অনিক যে এখন একজন সুঠাম দেহি যুবক। ৫’১১” ইঞ্চি উচ্চতার ২৬ বছরের বলিষ্ঠ গড়নের যুবক সে।ফর্সা গায়ের রং আর থুতনিতে ভাগ পড়া ছেলেটার হাসি দেখলেই যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। সবসময় প্রানবন্ত আর হাস্যজ্জ্বল থাকাই যেনো অনিকের অন্যতম পজিটিভ দিক।
অনিক একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করেছে,, এইতো সবে তিনমাস হলো। অনিকের ইচ্ছে ছিলো ইন্জিনিয়ারিং পড়ার তাইতো সে রৌদ্রর মতো মেডিক্যালে না গিয়ে বুয়েটে পড়েছে। কবির এহসান তাকেও তার এসএসসির পর বিদেশে পড়াশোনার জন্য যেতে বলেছিলেন কিন্তু অনিকের এক কথা সে কিছুতেই বিদেশে পড়তে যাবে না,দেশেই স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। অগত্যা তাকে আর কেউ জোর করে নি। অনিকের পড়াশোনা শেষে সাব্বির সাহেব তাকে বলেছিলেন পারিবারিক ব্যাবসায় যোগ দিতে কিন্তু অনিক এই প্রস্তাব একেবারেই নাকচ করে দেয়,, সেদিন সে তার বাবাকে বলেছিলো,” বাবা আমার ইচ্ছে হচ্ছে ইন্জিনিয়ার হিসেবে কোথাও জব করা। ব্যাবসার প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। প্লিজ জোর করো না এ বিষয়ে”
“ইন্টারেস্ট নেই মানে,, রোদ তো এখানে নেই,থাকলে তাকেই বলতাম ব্যাবসায় জয়েন করতে। কিন্তু তুমিরু তো আছো,, দেখো আমার আর ভাইজানের বয়স হয়েছে, আমরা আর কতোদিন সবটা সামলাতে পারবো বলো? এখন যদি তোমরা না সামলাও তাহলে কিভাবে হবে.?” সাব্বির সাহেব কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বলতে থাকেন।
“আহ সাব্বির থাম তুই। ওর যেই প্রফেশনে ইচ্ছে ও সেই প্রফেশনে যাবে। ওর ওপর কোনপ্রকার জোর করিস না। তোরা কি ভুলে গেলি আমি কখনোই তোদের কাওকে নিজ নিজ প্রফেশন বেছে নেওয়া থেকে বাধা দেয়নি। তুই নিজ ইচ্ছেতে আমার সাথে ব্যাবসায় যোগ দিয়েছিস,,তায়েফ নিজ ইচ্ছানুযায়ী পুলিশ হয়েছে এবং তাশরীক ও প্রফেসর হয়েছে স্বেচ্ছায়। তাহলে তুই কেনো ছেলেকে জোর করছিস এ বিষয়ে? মনে রাখবি জিবন টা ওর,, আমি চাইনা ওর জীবনে ও আমাদের জোরের বসে এমন প্রফেশনে জড়াক যেটা ও পছন্দই করে না।কেননা আমি চাইনা শেষ বয়সে ওর নিজের জিবন নিয়ে কোন আফসোস থাকুক। বাবা অনিক তোমার যেটা হতে ইচ্ছে করে সেটাই হও তুমি। মনে রেখো বড় আব্বু সবসময় তোমার সাথে আছি”।
কবির সাহেবের এমন কথায় সকলের মনে আরো একবার তার জন্য শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। অনিকতো পারে না খুশি হয়ে তার বড় বাবাকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু পরক্ষণেই নিজের অতি আবেগ সামলে নেয়।
খাবার টেবিলের সামনে উপস্থিত হয়েই অনিক আগে কবির সাহেব কে জিজ্ঞেস করে, ” বড় আব্বু এখন কেমন আছো তুমি? শরীর কি খুব খারাপ করেছিলো রাতে? ও বড় মা রোদ ভাইয়াকে কল করে বলেছে এ ব্যাপারে কিছু? ”
“নারে বাবা এখনো বলিনি,, ভাবছি একটু পর কল করবো,,এখন তো বোধহয় ওখানে ভোর রাত”। জুবাইদা বেগম খাবার সার্ভ করতে করতে বলেন।পাশেই দাড়িয়ে আছেন তার বাকি জা-য়েরা । এটা ওটা সকলকে এগিয়ে দিচ্ছেন তারা।
“অনিক চিন্তা করো না,, আমি এখন আগে থেকে কিছুটা সুস্থ আছি।তুমি নাস্তা করতে বসো।অফিসে লেট হচ্ছে না তোমার।” কবির সাহেব বললেন।
“সত্যি ঠিক আছো তো বড় আব্বু? ”
“হ্যা,হ্যা বসো এখন “বলেই খাওয়া শুরু করলেন কবির সাহেব। এরইমধ্যে তায়েফ এহসান জিজ্ঞেস করলেন, ” ভাইজান রোদ কি বলেছে কবে আসবে ও? ওর তো পড়া আরও দু’বছর আগে শেষ হলো,,দেশে আসবে কবে? ”
” হ্যা,, ও-তো বললো সেখানকার এক হসপিটালে নাকি ডাঃ হিসেবে জয়েন করেছে। ওর ধারণা আপাতত বাহিরে কোন হসপিটালে চিকিৎসক হিসেবে থেকে স্পেশালাইজড হয়ে তারপর নাকি দেশে ফিরবে। রোদ তো বললো বিডি বেক করে কোন এক হসপিটালে যেনো জয়েন করবে,, কি যেন ছিলো নামটা..? ” মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন কবির সাহেব।
“ভাইজান NICVD হসপিটাল ” তাশরিক সাহেব বলে উঠেন।
“হ্যা হ্যা ঠিক বলেছিস ” মাথা নাড়িয়ে জবাব দিতে লাগলেন কবির সাহেব।
“হ্যা তা বুঝলাম,, জয়েন করেছে তাও তো দু’বছর আগে। এখন তো রৌদ্র মাশাআল্লাহ বেশ অভিজ্ঞ একজন হার্ট সার্জন হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। বলি কি এবার ছেলেটা কে ফিরে আসতে বলো।” সাব্বির সাহেব কিছুটা সময় নিয়ে বললেন কথাগুলো।
” হুম দেখি ওর সাথে কথা বলবো নাহয় এ বিষয়ে” কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললেন কবির এহসান।
এসব কথার মাঝেই তারা নাস্তা শেষ করলেন। তারপর সকলে যার যার কর্মস্থলে চলে গেলেন।
বাড়ির কর্তাদের বিদায় দিয়ে গৃহিণীরা অপেক্ষা করতে লাগলেন বাকি ছেলে মেয়েদের।
জুবাইদা কবির দম্পতির মেয়ে রুহি এবার অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী। ম্যানেজমেন্ট সাবজেক্ট নিয়ে ইডেন মহিলা কলেজে পড়ছে সে।উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং,, ৫’৪” উচ্চতা এবং ছিমছাম গায়ের গড়ন তার।উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং হলেও মুখটায় যেনো রাজ্যের মায়া এই মেয়ের। মায়া মায়া জোড়া ভ্রুর ডাগর ডাগর আঁখি গুলোর দিকে তাকালে যেন চোখ ফেরানো দায়। মাইমুনা বেগমের দু মেয়েও যেন এক চেহারার দুটি পুতুল। জমজ হওয়ায় একই উচ্চতা ৫’২” তাদের। হয়তো বয়সের সাথে আর-ও লম্বা হবে। দুজনের গায়ের রং একই হলুদ ফর্সা। বাহির থেকে দেখলে হুটহাট কেউ ধরতে পারবে না কে আহিরা কে মাহিরা। কিন্তু তাদের আলাদা করার জন্য ছোট্ট একটা পার্থক্য হচ্ছে আহিরার বা-চোখের ভ্রুর সামনে একটি তিল আছে যা মাহিরার নেই। এই পার্থক্যটি অবশ্য ওদের পরিবারের মানুষজন ছাড়া তেমন কেউ ধরতে পারে না। ওরা দু’জন এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে।
রাইসা বেগমের ছেলে পুতুল। নামে যেমন দেখতেও তেমন গুলুমুলু নাদুসনুদুস বাচ্চা টা। ফর্সা টুকটুক গায়ের রং। ফুলো ফুলো গাল গুলো দেখলেই যে কারোর ইচ্ছে করবে টেনে দিতে। পুতুল এখন সবে ক্লাস ৮ এ পড়ে।
আরেকজন সদস্য বাকি আছে তিনি আর কেও নন রাফিয়া বেগমের মেয়ে আর সকলের আদরের অরিন। ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার হালকা নাদুসনুদুস গায়ের গড়ন তার।গায়ের রং বুঝি ছোট বেলার থেকে আর-ও একধাপ ফর্সা হয়েছে যেন একটুখানি টোকা দিলেই সেখান থেকে রক্ত বেরোবে। মেয়েটা যেমন ছটফটে তেমনি প্রানবন্ত ঠিক যেন ভাইয়ের জেরক্স কপি। হাসলে যেমন ফুলো ফুলো গাল দুটিতে টোল পড়ে তেমনি তার সাথে তার হরিণি চোখ দুটি ও হাসে। অরিন এবার এইচএসসি দিয়েছে। তার ইচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তাই তাকে ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার কোচিং-এ দেওয়া হয়েছে। বাড়ির সকলের মধ্যমনি এ মেয়ে। তার চঞ্চলতাই যেনো পুরো বাড়িকে মাথায় তুলে রাখে।
রোদের মিষ্টি হাতছানি ছুয়ে যাচ্ছে চেহারায়,,বারান্দা থেকে ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির। সবকিছুই জানান দিচ্ছে একটি নতুন প্রভাতের। কিছুক্ষন পর আড়মোড়া ভেঙে হামি দিতে দিতে বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসে অরিন। চোখে এখনো রাজ্যের ঘুম,,কিন্তু এখন যে আর তার ঘুমানো হবেনা। কখন না জানি মা এসে ধুমসে বকুনি দিয়ে বসে তাকে।
হঠাৎ করেই নাকে আসে এক মিষ্টি ঘ্রাণ, হ্যা শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। বারান্দার পাশেই আছে বহু পুরাতন একটি শিউলি ফুল গাছ।এটি অবশ্য তার রোদ ভাই ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন টিফিনের টাকা জমিয়ে কিনে এনেছিলো। পরে নিজেই নাকি লাগিয়েছে গাছটা। গাছটি লাগানো হয়েছে রৌদ্রর ঘরের বারান্দা বরাবর কিন্তু এখন গাছটি বেশ বড় হওয়ায় কয়েকটা ডাল অরিনের রুমের বারান্দার পাশেও উকি দিচ্ছে। শিউলি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ অরিনের যে বেশ পছন্দ। অবশ্য এই রুমটা অরিনই বাছাই করে নিয়েছে এই রুমের বারান্দার পাশের শিউলী ফুল গাছ টার জন্য তাছাড়া এই রুমের বারান্দা টাও বেশ সুন্দর আবার এ রুমের বারান্দা থেকে রৌদ্রর বারান্দা টা ও দেখা যায়।
এসব ভাবতে ভাবতেই কিছুক্ষণ পর সামনের দেয়ালে থাকা ঘড়িটায় হঠাৎ চোখ গেলো তার । ঘড়ি দেখতেই চক্ষু চড়কগাছ,, ৯ টা বাজতে আর মাত্র ৫ মিনিট,, ঠিক ১০ টায় তার কোচিং। না আর দেরি করা চলবে না তার,, তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে। পাক্কা ২০ মিনিট পর একেবারে রেডি হয়ে নিচে নামে সে।
অরিন নিচে নেমেই ড্রয়িং রুমে হালকা উঁকি ঝুঁকি মেরে ডাইনিং এরিয়ায় চলে যায়,,গিয়েই দেখতে পায় টেবিলে রুহি,, আহিরা আর মাহিরা বসে নাস্তা করছে ,, পুতুল আরও আগেই নাস্তা করে স্কুলে চলে গিয়েছে। তার সেজো মা,,আর ছোট মা তাদের সার্ভ করছে। অরিন গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে। যেই না খাবার প্লেট থেকে এক টুকরো পরোটা মুখে দিবে ওমনি কেউ তার কান টেনে ধরলো,,ব্যাথায় চোখ -মুখ কুচকে কানে ধরা হাতটির মালিকের দিকে তাকাতেই ব্যাথা ভুলে দাঁত বের করে লম্বা হাসি দেয় সে।কান যে আর কেউ না রাফিয়া বেগম ধরেছে। মেয়ের হাসি দেখে কটমটিয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন,, “না,,না,, এবার আর আপনার হাসিতে ভুলছি না আমি,, বেয়াদব মেয়ে,, দিন দিন বেশ পাজি হচ্ছো তুমি,, সকাল কয়টা বাজে হ্যা? অলরেডি ৯:২৫ বেজে গেছে,, ১০ টায় ক্লাস। এতবড় হয়ে ও কেনো তোমাকে আমার ঘুম থেকে তুলতে হবে বলো? কয়বার গিয়ে রুমে ডেকে আসছি তোমায় সে খেয়াল আছে তোমার? ১৮ বছরের মেয়ে হয়েও ১০ বছরের বাচ্চার মতো করো তুমি। সকলের আদর পেয়ে পেয়ে দিন দিন বাঁদর হচ্ছো তুমি,, আর কিছু বলতে গেলেই নিজের হাসি দেখাও,,কি ভেবেছো কি তুমি, প্রতিবার তোমার হাসি দেখিয়ে ভুলিয়ে দিবে আমায়,, আজ আর এক চুলও ছাড় দিচ্ছি না তোমায় পাজি মেয়ে ”
মায়ের মুখে এমন আপনি আর তুমি সম্বোধন শুনেই বেশ বুঝতে পারছে অরিন তার মা খুব রেগে গেছে কেননা রাফিয়া বেগম খুব রেগে থাকলেই আপনি অথবা তুমি করে বলে।
” আম্মু বিশ্বাস করো,, আমি এলার্ম দিয়েছিলাম কিন্তু কি জানি কি হয়েছে ফোনে এলার্ম টা বাজলোই না” বেশ ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে কথাগুলো বললো অরিন।
“তা কি করে বাজবে? যতবার এলার্ম বাজে ততবারই তুমি এলার্ম অফ করে আবার শুয়ে পড়ো,,তোমাকে আমার বেশ ভালো মতই চেনা আছে। ”
চুরি ধরা পড়ার মতো চেহারার অবস্থা হয়েছে এখন অরিনের। অন্যদিকে ওর দিকেই তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে রুহি।অরিন জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে আবারও সাফাই গাইতে গাইতে বলতে লাগলো, ” আম্মু সত্যি এলার্ম বাজে নি,,মনে হয় ফোন টায় কোন সমস্যা হয়েছে ”
“হয়েছে এবার থামো,,আর বলতে হবে না। মনে রেখো তুমি আমার পেটে হয়েছো আমি তোমার পেটে না”
“আহ! থামতো রাফু,,কি শুরু করলি মেয়েটার সাথে সকাল সকাল, মেয়েটা কে তো খেতে অবধি দিচ্ছিস না,এবার একটু চুপ যা,, বাচ্চা টা খেয়ে নিক” – রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে বলতে লাগলেন জুবাইদা বেগম।
“হ্যা গো মেজো বু , অনেক হয়েছে আর কিছু বলো না মেয়েটাকে,, অরিন মামনি খাওয়া শুরু করো” মাইমুনা বেগম আর রাইসা বেগম একসাথে বলে উঠলেন।
“এই খবরদার একদম ওর পক্ষ নিতে আসবি না তোরা,,তোদের সবার আদরেই ও দিনদিন বাঁদর হচ্ছে ” রাফিয়া বেগম মেয়ের মাথায় চাটি দিয়ে বলতে লাগলেন।
“উফফ আম্মু ব্যাথা পাচ্ছি তো” হাত দিয়ে মাথা ডলতে ডলতে বলতে লাগলো অরিন।
“আহা রাফু কি করছিস,, মেয়ে টা কে শুধু শুধু কেনো মারছিস,, যা তো সর এখান থেকে ” রাফিয়া বেগমকে সরিয়ে দিয়ে বলতে থাকেন জুবাইদা বেগম।
অতঃপর অরিনের মাথায় স্নেহের সহিত হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,, “থাক মা মন খারাপ করিস না,,তোর না কোচিং ক্লাসে দেরি হয়ে যাচ্ছে আয় বড়মা তোকে খাইয়ে দেই।”
অরিনও নাকচ করেনি এই প্রস্তাব, আনন্দের সাথে খেতে থাকে বড় মার হাতে,এদিকে ওদের এমন দৃশ্য দেখে রুহি ভাণ ধরে বলতে থাকে, “হ্যা রে আহি, মাহি,, দিনদিন আমরা কেমন পাত্তাহীন হয়ে যাচ্ছি মনে হয়,, কেউ একটু এমন করে খাইয়েও দেয় না”
“তুই কি এখনো ছোট আছিস রুহি যে তোর ও আমাদের হাতে খেতে হবে, ” জুবাইদা বেগম বলে উঠেন।
“আহ জবা,, মেয়ে টাকে এভাবে বলিস কেনো,,কি এমন চাইছে ও,, একটু আমাদের হাতেই তো খেতে চাচ্ছে,, আয় মা মেজো মা তোকে খাইয়ে দিচ্ছি”। বলেই রুহির দিকে লোকমা তুলে দিতে লাগলেন রাফিয়া বেগম। রুহিও বেশ মজা করে খেতে লাগলো।
এদিকে আহি ও মাহিও বলতে লাগলো,” তাহলে আমাদের কি দোষ? ”
ওদের কথা শুনে মুচকি হাসলেন সকলে।
রাইসা বেগম বললেন,, “আহি, মাহি, আয় মা ছোটমা তোদের খাইয়ে দিচ্ছি”
“ছোটো তোর একা কষ্ট করে দু’জনকে খাওয়ানো লাগবে না, তুই আহিরা কে খাইয়ে দে আমি মাহিরাকে দিচ্ছি, ” মাইমুনা বেগম খাবার প্লেট সামনে নিয়ে বলতে লাগলেন।
ওদের খাওয়ার মাঝেই রাফিয়া বেগম জুবাইদা বেগম কে জিজ্ঞেস করেন,” হ্যা রে জবা, রোদকে কল করবি না। এতক্ষণে তো মনে হয় ঘুম ছেড়ে উঠে পড়েছে ছেলেটা। আর-ও দেরি করে ওকে এসব জানালে পরে না আবার রাগ করে ছেলেটা ”
“তা যা বলেছো মেজোবু, ছেলেটার বুঝি বয়সের সাথে রাগটাও কেমন পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে” মেয়েকে খাইয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন মাইমুনা বেগম।
“হ্যা, ঠিকই বলেছিস তোরা, এজন্যই তো ওকে নিয়ে আমার এত চিন্তা,, যাকগে এখন কল দেই আগে। ” মোবাইলে ছেলেকে কল দিতে দিতে বললেন জুবাইদা বেগম।
“হ্যালো বাবা”
ওয়ালাইকুমুসসালাম বাবা,,কেমন আছিস?
___________
হ্যা হ্যা আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আমি,,বাড়ির সবাই ও ভালো আছে, শুধু তোর আব্বু একটু অসুস্থ।
__________
না তেমন গুরুতর না।আসলে কাল রাতে বোধহয় আবারও প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে।
__________
হ্যা হ্যা তোর দেয়া ঔষধই দিয়েছি।
________
আর বলিসনা বাপ। তোর বাবা কি আর আমার কথা শোনে, এতবার করে বললাম আজকে বাসায় থেকে রেস্ট করতে, কিন্তু কে শোনে কার কথা,, ঠিকই সুড়সুড় করে অফিস চলে গিয়েছে।
__________
আচ্ছা আসলে বলবোনে
_________
বাবা তুই দেশে ফিরবি কবে? আর যে সহ্য হয় না আমার। তুই তাড়াতাড়ি ফিরে আয়।
_________
সত্যি বলছিস বাবা।
_________
আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। আমি অনেক খুশি বাবা। তুই সহিসালামতে ফিরে আয়।রাখছি তবে।
টুট টুট টুট
এতক্ষণ মা ছেলের কথোপকথন শুনছিলেন উপস্থিত সবাই। ফোন রাখতেই রাফিয়া বেগম প্রশ্ন করলেন ” কিরে জবা, কি হয়েছে? এত খুশি যে? কোন সুসংবাদ আছে নাকি?”
“হ্যা,হ্যা,হ্যা। আমার রোদ,, আমার রোদ ফিরছে দেশে,, ও আসছে আগামী সপ্তাহে। আমার খোকা ফিরছে আলহামদুলিল্লাহ ” খুশিতে কান্না করে বলতে লাগলেন জুবাইদা বেগম।
“সত্যি বড় বু?” রাইসা বেগম উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করছেন।
“যাক আলহামদুলিল্লাহ। ছেলেটা সুস্থ মতো ফিরুক তবে” আচল দিয়ে চোখের কোন মুছতে মুছতে বললেন রাফিয়া বেগম।
“মা সত্যি ভাইয়া ফিরছে?”
“হ্যা রে হ্যা তোর ভাই ফিরছে” মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন জুবাইদা বেগম।
“বড়বু এত খুশির সংবাদ আর তুমি কাঁদছ ” বললেন মাইমুনা বেগম।
“ওরে এগুলো খুশির কান্না রে সেজো। আমার রোদ যে ৬ টা বছর পর আসছে। এতগুলো বছর পর আমাকে সামনে থেকে আম্মা ডাকবে। আমারতো খুশিতে গড়াগড়ি করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে “। বলেই চোখ মুছলেন তিনি।
তার এরুপ কথা শুনে বাকি জা-য়েরাও না চাইতে হেসে দেয়।
আহি, মাহি তো ভাইয়ের আসার কথা শুনে হাততালি দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সকলের এত এত উচ্ছ্বাসের মাঝেও একজন রইলো নির্বিকার। সে যে অরিন। সে কি রৌদ্রর আসার কথা শুনে খুশি হয়নি? হয়েছে বৈকি। একটু বেশিই খুশি হয়েছে কিন্তু খুশির চেয়েও বেশি মেয়েটির মনে অন্য এক অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে। এই অচেনা অনুভুতির জেরে যে তার হৃৎপিণ্ডের গতি হঠাৎ করেই স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি জোরে হচ্ছে। আচ্ছা এমনটা হচ্ছে কেনো? কেনো সে রোদের আসার খবর শুনে স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। হঠাৎ করে কি হলো তার।বুকটা কি জোরে জোরে কাপছে। হঠাৎ করেই বুক চেপে ধরলো অরিন। ওর এমন কান্ডে হতচকিত হয়ে তেড়ে আসে রুহি,” কি হয়েছে অরিন,, বুকে এভাবে হাত চেপে রেখেছিস কেনো,,খাবার আঁটকেছে নাকি? ” চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করছে রুহি। রুহির এমন কথায় সকলে নিজেদের উচ্ছ্বাস বাদ দিয়ে অরিনের জন্য ব্যাস্ত হয়ে উঠে।
“আমি ঠিক আছি রুহিপু, কিছু হয়নি, আচ্ছা আমি এখন উঠি আমার ক্লাসে লেট হয়ে যাচ্ছে। ” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো অরিন।
“অরি তুই ঠিক আছিস তো মা?”
“হ্যা আম্মু তুমি টেনশন করো না , আসছি কেমন।”
“সাবধানে যাস ” জুবাইদা বেগম বললেন।
“ওকে ” ছোট করে উত্তর দিলো অরিন। এরপর চলে গেলো সে। বাড়ির বাহিরে গিয়ে রাস্তায় দাড়াতেই রিক্সা পেয়ে যায় অরিন। তাই আর দেরি না করে চলে যায় ক্লাসে। অরিন আবার গাড়িতে করে ততটা যাতায়াত করতে পছন্দ করে না।তার এমন খোলা রিকশায় বাতাস গায়ে মেখে যাতায়াত করতে ভালো লাগে। বাড়িতে যে কয়টা গাড়ি আছে তার মধ্যে একটা নিয়ে কবির সাহেব আর তার বাবা বের হন,,একটা নিয়ে তাশরিক সাহেব বের হন।তায়েফ সাহেব তো পুলিশের জিপই ব্যাবহার করেন। আর একটা দিয়ে বাড়ির ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজ দিয়ে আসা হয়।অরিনকে অনেকবার করে বলা হয়েছে গাড়ি দিয়ে যেতে। কিন্তু অরিন যে একরোখা। তাই আর কেউ তাকে রিকশায় যাতায়াতে বারন করে নি।
এদিকে বাড়ি থেকে রুহি,,আহিরা,,মাহিরা ওরাও যার যার কলেজে চলে যায়।
খোলা রিকশায় বসে ব্যাস্ত ঢাকা শহর দেখছে অরিন।বাতাস এসে দোলা দিয়ে যাচ্ছে চোখে -মুখে তার।বসে বসেই ভাবছে সে রৌদ্রর প্রতি এমন অদ্ভুত অনুভূতির উৎপত্তিক্ষনটা।সময়টা ছিলো তখনকার যখন অরিনের বয়স ১২ বছর।অরিন তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। রৌদ্র বাড়িতে এসেছিলো প্রায় ১৫ দিনের জন্য। কিন্তু তখনও অরিন জানতো না যে এরপর তার রোদ ভাই আর আসবে না।
দিনটা ছিলো সোমবার। অরিন স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরবে এমন সময় তার ভাই অনিক আসে তাকে নিয়ে যেতে। অরিনও খুশিমনে স্কুল থেকে ফিরছিলো কিন্তু হঠাৎ অনিক বলে, “বনু তুই একটু দাড়াবি এখানে, আমার একটা কাজ আছে, আমি দু’মিনিটেই ফিরে আসছি কেমন”
“আচ্ছা ভাইয়া” মাথা কাত করে সম্মতি দেয় অরিন।
অরিনকে স্কুলের গেটের সামনে রেখেই অনিক পাশের দোকানে যায়।হুট করে সেখানে কোথাথেকে উপস্থিত হয় রিমন অনিকের ক্লাসমেট। একই ক্লাসে পড়ার দরুন বেশ কয়েকবার বাড়িতে এসেছে সে এবং সেই থেকে অরিনও তাকে চেনে। রিমনকে এমন হুট করে সামনে দাড়াতে দেখে অরিন একটু ঘাবড়ে যায় কিন্তু নিজেকে বাহির থেকে শান্ত রাখে সে।
“কি ব্যাপার অরিন,, এখানে এই রোদের মধ্যে দাড়িয়ে আছো কেন? স্কুল তো ছুটি দিয়েছে বাসায় যাচ্ছো না যে?” রিমন অরিনের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে উঠে। কেনো জানি এই হাঁটুর বয়সী মেয়ে টাকে রিমনের বেশ ভালো লাগে। কি সুন্দর দেখতে মনে হয় যেন আস্ত একটা জীবন্ত পুতুল। আর এর হাসিটা তো একেবারে বুকে গিয়ে বিধে রিমনের।রিমন আরও কিছু বলবে তার আগেই অরিন বলে উঠে, ” আসলে ভাইয়া আমি ভাইয়ুর জন্য অপেক্ষা করছি,,ও একটা কাজে গিয়েছে। চলে আসলেই বাসায় যাবো”
“তাই বলে এই রোদের মাঝে এভাবে দাড়িয়ে থাকবে,আচ্ছা ওয়েট আ সেকেন্ড ” বলেই পাশের একটা দোকানে চলে গেলো সে। কিছুক্ষণ পরেই রিমন হাতে দুটো আইসক্রিম আর কয়েকটি ডেইরি মিল্ক নিয়ে ফেরত আসে। সেগুলো অরিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নাও অরি আইসক্রিম টা খাও ভালো লাগবে আর চকলেট গুলো বাসায় গিয়ে খেয়ো কেমন”
” নাহ ভাইয়া লাগবে না ধন্যবাদ ”
” আরে না বলছো কেনো,আমি কি অপরিচিত কেউ,,আমাকে তো তুমি চিনোই আমি তোমার ভাইয়ের ফ্রেন্ড। নাও ধরো এখন।আর না করবে না একদম ওকে।” এই বলে জোর করে খাবার গুলো হাতে দিতে লাগলো অরিনের।
অনেক্ক্ষণ জোরাজোরির পর বাধ্য হয়ে সেগুলো হাতে নিলো অরিন। যেই না আইসক্রিম টি মুখে দিবে ওমনি কেও ওর হাতটি খপ করে ধরে নেয়। ধরে রাখা হাতের মালিকের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় রৌদ্র ওর দিকে রক্তলাল চোখ দিয়ে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে। অরিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই রৌদ্র রিমনের দিকে তাকিয়ে কটমট করে আঙুল উঁচিয়ে বলতে থাকে,” ওর জন্য তোমার এত দরদ না দেখালেও চলবে। আর হ্যা নেক্সট টাইম কখনো যেনো ওর ছায়ার আশেপাশে ও না দেখি গট ইট! আর যদি আমার কথা অমান্য করার দুঃসাহস ও দেখাও তাহলে এর ফলাফল মোটেও তোমার জন্য ভালো হবে না।আই রিপিট একদম ভালো হবে না। ” বলেই গটগট পায়ে সেখান থেকে অরিনকে টেনে নিয়ে চলে যায় রৌদ্র। আর রিমন পেছন থেকে তাকিয়ে রইলো তাদের প্রস্থান। পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললো সে।এই রৌদ্রকে বেশ ভালো মতই চেনে ও। একবার কোন এক ছেলে যেনো কলেজে ওকে কি এক কথা বলেছিলো আর ওমনি ও ছেলেটা কে মারতে মারতে আধমরা করে ছেড়েছে।এরপর থেকে এ ছেলেকে বেশ ভালোই ভয় পায় ও।অনিকের সাথে বেশ কয়েকবার ওদের বাড়িতে গিয়েছিলো তাও রৌদ্রের অনুপস্থিতিতে কেননা এই ছেলের উপস্থিতিতে তার বাড়িতে যাওয়াও যে এক বিরাট ব্যাপার। কথাগুলো ভেবেই ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লো রিমন।
রিমনের সামনে থেকে অরিনকে নিয়ে কিছুটা দূরে এসে হেচকা টানে অরিনকে নিজের সামনে দাড় করায় রৌদ্র। অরিনের হাতে এখনও রিমনের দেওয়া খাবার দেখেই মেজাজ চটে যায় রৌদ্রর।এক টানে অরিনের হাত থেকে সেগুলোকে নিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয় সে। এতক্ষণের এসব কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে আছে অরিন।কি থেকে কি হচ্ছে এখনও তার বোধগম্য হচ্ছে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে আছে সে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার চোয়াল আকড়ে ধরলো রৌদ্রর শক্ত হাতের আঙুল। ব্যাথায় চোখ মুখ কুচকে আসে অরিনের। পরপরই রৌদ্রের কটমটিয়ে বলা কথাগুলো কানে আসে তার,” অন্যের থেকে কিছু নিতে হবে কেনো তোর, কিছু লাগলে আমাকে বলতে পারিসনি,, আবার রাস্তায় অন্য ছেলের সামনে দাড়িয়ে ছিলি কোন সাহসে অরি।এত বড় হয়ে গেছিস তুই হ্যা,,কথা বল”
জোরে ধমক দিয়ে বলতে থাকে রোদ্র।এদিকে গালের ব্যাথায় হালকা গোঙানি দেয় অরিন।চোয়াল থেকে রৌদ্রর হাত সরাতে চেয়েও লাভের লাভ কিছুই হলো না পরে ব্যাথায় আর টিকতে না পেরে চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরতে থাকে অরিনের। অরিনের চোখের অশ্রু দেখে এতক্ষণে হুঁশে ফিরে রৌদ্র। অগত্যা নিজের হাত সরিয়ে নেয় অরিনের চোয়াল থেকে।ইতোমধ্যেই রৌদ্রের দানবীয় হাতের থাবায় অরিনের নরম তুলতুলে গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সে দিকে চেয়ে রৌদ্রর চোখে মুখে কাতরতা নেমে আসে।অরিন তখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। অরিনের কান্না দেখেই রৌদ্রর বুকটা ধ্বক করে উঠে। সে তারাতাড়ি অরিনের মুখটা নিজের দু’হাতের আজলায় নরমভাবে উপর করে তোলে। অরিনের কান্নারত মুখটির পানে চেয়ে কন্ঠে একরাশ কাতরতা ঢেলে উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে থাকে,
“সরি,সরি জান বাচ্চাটা। একদম সরি।প্লিজ তুই কান্না করিস না।অরি দেখ একবার আমায়,প্লিজ বাচ্চা একবার তাকা আমার দিকে,এই এই দেখ আমি কানে ধরছি, ” কানে হাত দিয়ে আবারও বলে উঠে রৌদ্র,
“আর কখনো তোকে আঘাত করবো না প্রমিস জানবাচ্চা।আর বকবো ও না তবুও প্লিজ তুই কান্না করিস না। আমার সত্যি কষ্ট হচ্ছে অরি,, তোর কান্না আমার সহ্য হয় না। প্লিজ থাম না জানবাচ্চা।এবারের মতো ক্ষমা করে দে প্লিজ।”
ওর এমন কান্ড দেখে অরিন নিজের কান্না রেখে ফ্যালফ্যাল করে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে থাকে।রৌদ্রর হাত এখনো তার কান ধরে আছে। এমন এক বড় ছেলে হয়ে এমন এক ছোট মেয়ের সামনে কান ধরে দাড়িয়ে আছে দেখে রাস্তায় থাকা দু একজন মানুষ বেশ কৌতুকের সাথে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তবুও এতে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই রৌদ্রর। তার চোখে মুখে এখনও আগের ন্যায় কাতরতা। অরিন কিছুক্ষণ রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আচমকাই হো হো করে হেসে উঠে। ওর এমন হাসি দেখে যেনো মাত্রই রৌদ্র কলিজায় পানি আসলো। অগত্যা নিজেকে ধাতস্থ করে স্বাভাবিক করে নেয় সে আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই হৃদয় থমকে দেওয়া হাসিটির পানে। অরিনকে এভাবে হাসতে দেখে রৌদ্রের মুখেও একটা মুচকি হাসি ফুটে ওঠে। আর মনে মনে ভাবতে থাকে,”তোর এই হাসির জন্য আমি সারাজীবন হাসির পাত্র হতে রাজি সানশাইন”।
বেশকিছুক্ষন পর অরিন হাসি থামিয়ে বলে উঠে “রোদ ভাই আপনি এত বড় হয়েও কান ধরেছেন লোকে দেখলে কি বলবে? ”
“সেটা তোর ভাবতে হবে না, আয় আমার সাথে ” বলেই অরিনকে নিয়ে একটি দোকানে ঢুকে রৌদ্র। দোকান থেকে দুই বক্স চকলেট আর এক বক্স কোন আইসক্রিম নেয় সে।পেমেন্ট করে অনিককে কল করে বলে দেয় অরিনকে সে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে।
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২
এদিকে চকলেট আর আইসক্রিম গুলো অরিনের হাতে দিয়ে রৌদ্র বলে, ” অরি এই এক বক্স চকলেট পুরোটা তোর আর বাকি এক বক্স বাকি বাচ্চাদের দিস,আর তোর যদি কাওকে দিতে ইচ্ছে না করে তাহলে পুরোটাই নিজে খেয়ে নিস।আর আইসক্রিম আপাতত একটা খা এখন।বাকিগুলো বাড়িতে বাচ্চাদের দিবি।ভুলেও বেশি আইসক্রিম খাবি না তুই নাহলে তোর ঠান্ডা লাগবে। সর্বোচ্চ দুটো এর বেশি না ওকে।”
“আচ্ছা ” একটা আইসক্রিম মুখে পুরতে পুরতে বলে অরিন।