সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২২

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২২
Jannatul Firdaus Mithila

~শালা কু******চ্চা। কথা বলবি নাকি এক্ষুনি জবাই করবো সব-কয়টাকে।একদম জবাই করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসবো।
উপস্থিত সকলে আবারও ভয়ে সিটিয়ে যায়।পরপর শুকনো ঢোক গিলে। রৌদ্র এবার মেজাজ হারিয়ে বসা ছেড়ে উঠে দাড়ায়। হাতে তার এখনো রক্তে রঞ্জিত ধারালো ছুরিটি।রৌদ্র ছুড়িটির অপর পাশ দাত দিয়ে কামড়ে ধরে দু’হাতে শার্টের হাতা গুটিয়ে এগিয়ে আসে লোকগুলোর সন্নিকটে। অতপর কোন কথা না বলে সামনে থাকা তিনজনের মধ্য থেকে একজনের পেট বরাবর সজোরে লাথি বসিয়ে দেয়।

লোকটি তৎক্ষনাৎ আক্রমণে সামলে উঠতে না পেরে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। ব্যাথায় উবু হয়ে পেট আঁকড়ে ককিয়ে উঠে। রৌদ্র থামলো না।পাশের জনের নাক বরাবর একনাগাড়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে পাঞ্চ মারতে থাকে। লোকটির নাক ফেটে যাচ্ছে তা-ই অবস্থা! লোহু গড়িয়ে পড়ছে অবলীলায়! লোকটি ব্যাথায় ছটফটিয়ে উঠে হাত-পা ছুড়তে থাকে কিন্তু এতে রৌদ্র থামলে তো! রৌদ্র বুঝি এ মুহুর্তে লোক গুলোর ওপর নিজের সকল আক্রোশ মেটাতে ব্যস্ত! বেশকিছুক্ষন বাদে মার খেতে থাকা লোকটি যখন জ্ঞান হারালো তখন রৌদ্র তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটি ঝাড়া দেয়।ঝাড়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাত বেয়ে ঝড়তে থাকে রক্ত! লোকটার গায়ের রক্ত। রৌদ্র কয়েকপল তাকিয়ে রইলো নিজের হাতে লেগে থাকা তাজা লাল ক্ষারীয় তরলটির দিকে।বন্ধ কামরাটিতে এক ছটাক আলো নেই কোথাও। রৌদ্র তার অনুসারীকে দৃঢ় গলায় বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

~~শাহজাহান লাইট দে!
শাহজাহান বুঝি বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চললো আদেশটি পালন করতে।মুহুর্তের মাঝে বিদঘুটে অন্ধকার কামরাটিতে ছড়িয়ে পড়ে আলোর রশ্মি।
রৌদ্র এবার দৃষ্টি ঘোরায় সকলের দিকে।একে একে পরখ করতে থাকে নিজ হাতে শাস্তি দেওয়া লোকগুলিকে। সবাইকে কি শাস্তি দেওয়া শেষ? নাতো! এখনোতো একজন বাকি! রৌদ্র এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অদূরে দাড়িয়ে কাঁপতে থাকা লোকটার দিকে তাকায়। লোকটার চোখেমুখে ভয়ের তীব্র আভাস! এক চোখ উপড়ে ফেলা তার।ইশশ কি ভয়ানক দেখতে লাগছে তাকে! এ মুহুর্তে যেকেউ লোকটিকে একবার দেখলে জ্ঞান হারাবে নিশ্চিত। রৌদ্র তার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত হাসে।হাতের ছুড়িটি প্রফেশনাল কায়দায় হাত দিয়ে ঘোরাচ্ছে অনবরত। রৌদ্র কয়েক কদম সামনে এগোতেই পা থামিয়ে নেয়।
লোকটি রৌদ্রের এগিয়ে আসা দেখে ভয়ে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না।অতপর অতিরিক্ত ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে একাকার অবস্থা তার! রৌদ্র তার দিকে তাকিয়ে নাক সিটকে বলে ওঠে,

~~ শালা! এখন তোর এই বা** পরিষ্কার করবো কে?
রৌদ্র আবারও তার দিকে এগিয়ে যায়। লোকটার একদম কাছাকাছি চলে এসে বাঁকা হাসে।লোকটার চুলগুলো পেছন থেকে সজোরে টেনে ধরে হিসহিসিয়ে বলে,
~~ যমের মতো ভয় পাস,অথচ এই যমের কলিজা নিয়ে ঠিকই তো টানাটানি করছিলি।তখন একবারও ভয় লাগেনি?
লোকটা কি উত্তর দেবে? তার যে এই মুহুর্তে কাঁপা কাঁপি অবস্থা। বহুকষ্টে থেমে থেমে বললো,
~ভাই বিশ্বাস করেন, খোদার কসম আমরা জানতাম না আমরা কারে তুলতাছি।আমগোরে শুধু কইছিলো তুলতে আমরা হেই মোতাবেক তুলছি।ভাই আল্লাহর দোহাই লাগে এই বারের মতো ছাইড়া দেন। কথা দিতাছি জিবনে আর কোনদিন কোন মাইয়ার দিকে ফিরাও তাকামু না।দরকার হয় জীবনে বিয়াই করমু না।

লোকটার এতো আকুতি -মিনতিতেও কি কিছু যায় আসছে রৌদ্রের? তার মুখাবয়ব দেখে তো তা মনে হচ্ছে না! এই যে এখনো কেমন চোয়াল শক্ত করে রক্তবর্ণ চক্ষুদ্বয় নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রৌদ্র লোকটার চুলগুলো হাতের মুঠোয় রেখে অন্যহাতে ধীরে ধীরে ছুড়িটি লোকটার গলার ওপর রাখে। লোকটা ভয়ে নিশ্বাস ফেলতে ভুলে যায়। কোনরকম দুহাত জড়িয়ে ধরে রৌদ্রের হাতটা।পরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

~ভাই মাইরেন না ভাই!
লোকটির হাতদুটো রৌদ্রের ডান হাতের ওপর থাকা কালো wrist ব্যান্ডটির ওপর। সেটা দেখে রৌদ্র সঙ্গে সঙ্গে চেচিয়ে উঠে বিকট শব্দে,
~কু*****চ্চা হাত সরা এটার ওপর থেকে। এটা যদি একটুও নষ্ট হয় আই সয়্যার আমি তোকে এক্ষুনি মেরে ফেলবো।হাত সরা বাস্টার্ড!
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে হাতদুটো সরিয়ে নেয়। রৌদ্র সেদিকে চেয়ে শান্ত হয় কিছুটা। অতপর লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে সটান হয়ে দাড়ায়। উচ্চকণ্ঠে হাঁক ছেড়ে উঠে,

~ শাহজাহান ইনজেকশন টা নিয়ে আয়!
শাহজাহান সাথে সাথে ব্যাগ থেকে একটা ইনজেকশন বের করে রৌদ্রের বাড়িয়ে রাখা হাতে দেয়। রৌদ্র সেটি নিয়ে এগিয়ে যায় সকলের দিকে।একে একে মাটিতে লুটিয়ে থাকা সিহাব থেকে শুরু করে বাকি সকলের ঘাড়ে পুশ করে দেয় ইনজেকশনটি। শেষমেষ জেগে থাকা লোকটির সন্নিকটে আসে। ফ্লোরে এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। অতপর একইভাবে লোকটার ঘাড়ে পুশ করে ইনজেকশনটি। লোকটা রৌদ্রের কাজে কোনরুপ বাঁধা দেয় না। বাঁধা দিয়ে থোড়াই না মার খেতে চাইবে! রৌদ্রের ইনজেকশন পুশ করবার মিনিট খানেকপর লোকটার শরীর মৃদু ঝাকিয়ে ওঠে। লোকটার এক বিশেষ অঙ্গ বুঝি অবশ হয়ে আসছে। সে সঙ্গে সঙ্গে চেপে ধরে সেখানটায়। রৌদ্র এখনো লোকটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা অবস্থায়। লোকটার ছটফটানোতে বাঁকা হাসলো রৌদ্র। লোকটা এক অস্ফুট ব্যাথায় রৌদ্রের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। রৌদ্র সেদিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মুখ নিয়ে আসে লোকটার কান বরাবর। ফিসফিসিয়ে বলে,

~যেটা ভাবছিস সেটাই।আর কোনদিন দাড়াবে না!
লোকটা রৌদ্রের কথা শোনামাত্র ঘর কাপিয়ে চিৎকার করে ছটফট করতে থাকে। রৌদ্র সেদিকে ভ্রুক্ষেপহীন তাকিয়ে উঠে দাড়ায়। বিরক্ত হয়ে এক বিকট ধমকে বলে,
~এই শালা থাম!
লোকটা কি আর এতোকিছু বুঝছে! তার যে সব শেষ। এই কষ্ট এখন কি করে ভুলবে সে। রৌদ্রের এবার মেজাজ বিগড়ে যায়। কষিয়ে এক থাপ্পড় বসায় লোকটির গালে। তৎক্ষনাৎ চিৎকার থামিয়ে ফুপাতে থাকে লোকটি।রৌদ্র সেদিকে চেয়ে কটমট করে বললো,

~ যেই পুরুষত্বের দোহাইয়ে আমার সানশাইনের দিকে কুনজর দিয়েছিলি,সেই পুরুষত্ব আমি দ্বিতীয়বার অক্ষত রাখবো তুই ভাবলি কি করে? আর সবচেয়ে বড় কথা এখান থেকে প্রানে বেঁচে ফিরে তোরা দ্বিতীয়বার কোন মেয়ের ক্ষতি করবিনা তার কি গ্যারান্টি আছে! তাই এমনটা করা। না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশি!!
রৌদ্রের কথায় এমন এক পরিস্থিতিতেও শাহাজাহান নিঃশব্দে মিটমিটিয়ে হাসতে থাকে। আর কেও বুঝুক বা-না বুঝুক সে-তো বোঝে,তার বস যে এক উম্মাদ প্রেমিক!

রাত ১২:১০🌼
রৌদ্রের বাড়িতে ফিরতে প্রায় অনেকটা রাত হয়।সে ভেবেই নিয়েছে এতক্ষণে সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। অবশ্য এটা রৌদ্রের জন্যই ভালো হয়েছে। কেননা এত রাত করে বাড়ি ফেরার দরুন কেও দেখলে অবশ্যই দুয়েকটা প্রশ্ন করবে বৈকি!
রৌদ্র বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে বাড়িতে ঢুকে। ড্রয়িং রুমের লাইট বন্ধ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।পরে নিঃশব্দে হাঁটা ধরে সিঁড়ির দিকে। যেই না সিঁড়িতে একপা রাখবে ওমনি পেছন থেকে ভেসে আসে এক গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ!

~দাড়াও! এতো রাত অবধি কোথায় ছিলে?
বাবার কন্ঠ পেয়ে পাদু’টো থমকে দাড়ায় রৌদ্রের। সাথে সাথে পেছন ফিরে দেখতে পায় তার বাবাকে,যিনি এখন অন্ধকার ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন। রৌদ্র ভ্রুকুটি করে তাকায় সেদিকে। গম্ভীর গলায় বলে,
~তুমি এতো রাতে এখানে বসে যে! শরীর খারাপ লাগছে?
কবির সাহেব বসা ছেড়ে উঠে দাড়ান। হাত বাড়িয়ে ক্ষুদ্র ল্যাম্প লাইটটা জালিয়ে দেন। এতে সম্পূর্ণ ড্রয়িং রুম আলোয় আচ্ছাদিত নাহলেও কিছুটা অন্ধকার মুক্ত হয়। কবির সাহেব কোমরের পেছনে দুহাত বেঁধে গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসেন ছেলের দিকে। সামনা-সামনি এসে আগের ন্যায় গম্ভীর গলায় শুধালেন,
~ আমি যেই প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর কিন্তু এখনো পাইনি!
রৌদ্র মোটেও ভড়কায় না। মুখভঙ্গি একেবারে স্বাভাবিক রেখে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেয়,

~ কোথায় আর থাকবো, হসপিটালে ছিলাম।
কবির সাহেব কি আদৌও বিশ্বাস করলেন ছেলের কথা! কই তার মুখভঙ্গি দেখেতো তা বুঝবার জো নেই! তিনি আবারও বললেন,
~ সত্যি বলছো?
রৌদ্রের ভ্রু জোড়া আবারও কুচকে আসে। গলায় খানিকটা পরিবর্তন এনে বললো,
~ তোমার হঠাৎ মিথ্যা মনে হবার কারনটা কি জানতে পারি?
কবির সাহেব মৃদু মাথা ঝাঁকালেন। চোখের হাই পাওয়ারের চশমাটি খুলে হাতে নিলেন। চোখ তুলে ছেলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে বললেন,

~ তোমার হসপিটালের রিসেপশনিস্ট বললো তুমি নাকি হসপিটাল থেকে আরও তিনঘন্টা আগেই বের হয়েছো!
রৌদ্র এবার খানিকটা চমকায়। অথচ বাহির থেকে একদম স্বাভাবিক। সে এবার হালকা মেজাজ দেখায়,
~ বাবা আমি কি এখন নিজ ইচ্ছানুযায়ী কোথাও যেতেও পারবো না!
কবির সাহেবের মুখভঙ্গি আগের ন্যায়।তিনি এবার নিরেট কন্ঠে বললেন,
~ হুম পারবে অবশ্যই পারবে কিন্তু সেটা হতে হবে সকলের জন্য মঙ্গলজনক।
থামলেন তিনি। ছেলের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘুরে দাড়ান অন্যদিকে। অতপর ব্যগ্র কন্ঠে বলেন,
~ যাও ঘরে যাও।রেস্ট নাও।

বলেই তিনি হনহনিয়ে চলে গেলেন নিজের কামরায়। অন্যদিকে রৌদ্র এখনো একই ভঙ্গিতে দাড়িয়ে সেখানটায়।মনে মনে হিসাব মেলাচ্ছে কিছুর। পরে নিজের ভাবনার ইতি টেনে চলে আসে নিজের রুমে। রুমে প্রবেশ করে হাতে থাকা এপ্রনটি ছুড়ে ফেলে খাটের ওপর। আজকে মাথাটা বেশ ধরেছে ওর। তার ওপর শরীরটাও বেশ ক্লান্ত! হয়তো একটা লম্বা শাওয়ার নিলে কিছুটা স্বস্তি মিলবে ওর। যেই ভাবা সেই কাজ! রৌদ্র আর কিছু না ভেবে কাবার্ড থেকে টাওয়েল আর ট্রাউজার নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে।

প্রায় বিশ মিনিটের লম্বা শাওয়ার শেষ করে বেরিয়ে আসে রৌদ্র। গলায় টাওয়াল পেঁচিয়ে একহাত দিয়ে চুলগুলো মুছছে কোনরকম। পেটানো গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি এখনো নিজের ছাপ বজায় রেখেছে। রৌদ্র খাটের সামনে এসে ভেজা টাওয়েলটা খাটেই ছুড়ে ফেলে। অতপর চুলগুলো হাত দিয়ে ঝেড়ে এসে দাড়ায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে। রৌদ্র গায়ে বডি লোশন লাগাতে থাকে।ঠিক তখনি তার কানদুটো সজাগ হয়।হালকা ভিড়িয়ে রাখা দরজার ওপাশ থেকে কারোর পায়েলের রিনিঝিনি শব্দ বেশ শুনতে পাচ্ছে ও। রৌদ্রের কপালে দুয়েকটা ভাজ পড়ে। দেওয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে রাতের অবস্থান। রাত ১২:৩০। রৌদ্র হাত থেকে বডি লোশনটা নামিয়ে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। আবারও কান সজাগ করে দাড়ায় ও।তখনি ভেসে আসে পায়েলের রিনিঝিনি শব্দ। রৌদ্র কিছু না বলে ফট করে দরজার পাশ দিয়ে ওপাশে দাড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটির হাত চেপে ধরে। অতপর কোনরূপ কালবিলম্ব না করে টেনে নিয়ে আসে ঘরের ভেতর। ব্যাক্তিটিকে নিজের সামনে এনে চক্ষুদ্বয় ছোটো ছোট করে প্রশ্ন করে বললো,

~ তুই! এতোরাতে আমার ঘরের সামনে কি করছিস?
ব্যাক্তিটি আর কেও না অরিন। হঠাৎ তাকে এভাবে টেনে ধরায় ভড়কে যায় মেয়েটি।যার রেশ এখনো তার চোখেমুখে লেপ্টে আছে যেন! অরিন একহাত বুকে চেপে ধরে হাঁপাচ্ছে। আর রৌদ্র সেদিকে ঘোর লাগা নেত্রে তাকিয়ে দেখছে।
বেশকিছুক্ষন পর অরিন কিছুটা স্বাভাবিক হয়। মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
~ ইয়ে মানে,রোদ ভাই!
রৌদ্র নিশ্চুপ। যেন এই মুহুর্তে অরিনের কোন কথাই তার কানে যাচ্ছে না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরিনের স্নিগ্ধ ফোলা ফোলা মুখশ্রীটির দিকে।
অরিন থেমে থেমে আবারও বললো,

~আসলে আপনিতো রাতে খাননি, আর বাহির থেকেও খেয়ে আসেননা তাই ভাবলাম আমিই খাবারটা নিয়ে আসি আপনার জন্য।
রৌদ্রের এবার হুশ ফিরে অরিনের কথায়। মনে মনে ভিষণরকমের চমকায় ও। যেই অরিন ওর সামনে ঠিকমতো দাড়াতেই লজ্জা পায় সেই কি-না এতোরাতে নিজ থেকে ওর জন্য খাবার নিয়ে এসেছে! রৌদ্র নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের।মনে মনে বুঝতে চেষ্টা করছে অরিনের আসল উদ্দেশ্য। মেয়েটার হাবভাবে যথেষ্ট অবাক হচ্ছে রৌদ্র। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারন আছে বৈকি!
রৌদ্র এবার নিরবতা ভেঙে নিজ থেকে বলে ওঠে,
~ খাবার নিয়ে যা অরিন।আমি নিজ হাতে খেতে পারবো না।
অরিন কিছুটা বিচলিত হয়।বিচলিত গলায় জিজ্ঞেস করে,
~ কেন রোদ ভাই! কি হয়েছে আপনার?

রৌদ্র তার ডানহাতটা অরিনের সামনে এগিয়ে ধরে। অরিন সেদিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে।রৌদ্রের ডানহাতটা মাঝ বরাবর কেটে গিয়েছে। রক্ত প্রায় শুকিয়ে গেছে। অরিন তার হাতে থাকা খাবারের প্লেটটা টি-টেবিলের ওপর রেখে রৌদ্রের হাতটা টেনে ধরে নিজের হাতদুটোর মাঝে। রৌদ্র আবারও অবাক হয় কিন্তু হাতটা মোটেও সরিয়ে নেয় না সেখান থেকে। সে বেশ বুঝতে পারছে অরিন চিন্তায় পড়ে তার হাতটা ধরেছে। তা নাহলে অন্য সময় এমনটা হলে লজ্জায় মেয়ে চোখ তুলে তাকাতে পারতো না !
অরিন রৌদ্রের হাতটা ধরে বিচলিত হয়ে বলতে থাকে,

~ কিভাবে কাটলেন এতোটা?
রৌদ্র অরিনের এমন কথায় মুচকি হাসলো। শান্ত গলায় জবাব দিলো,
~ ঠিক জানিনা কিভাবে কাটলো।শুধু বাসায় এসে দেখলাম কেটে গেছে।
অরিন রৌদ্রের দিকে না তাকিয়েই বললো,
~ এতোটা কেটে গেলো আর আপনি বলছেন আপনি টেরই পাননি।এতোটা বেখেয়ালি আপনি রোদ ভাই!
দেখি আসুনতো ঔষধ লাগিয়েদি।

বলেই অরিন রৌদ্রের হাতটা ছেড়ে দিয়ে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে যায়। অতপর ফিরে আসে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে। রৌদ্র খুশিমনে অরিনের কাজকর্ম উপভোগ করছে সবটা।পরে রৌদ্রের হাত ধরে খাটে বসিয়ে দিয়ে অরিন নিজেও বসে পড়ে তার সামনা-সামনি। রৌদ্রের ব্যাথাপ্রাপ্ত হাতটি নিজের হাতের ওপর নিয়ে কোমল গলায় বললো,
~ আপনি আমায় বলে দিন কিভাবে কি করতে হবে আমি ঠিক সেভাবেই ঔষধ লাগিয়ে দেবো কেমন!
রৌদ্র বুঝি অরিনকে কাছ থেকে দেখবার চান্স মিস করে!

সে-তো মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে তার সানশাইনের দিকে। অরিন রৌদ্রের কোন জবাব না পেয়ে তার দিকে তাকায়। রৌদ্রকে এভাবে নিজের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুহুর্তেই মুখের আদলে রাজ্যের লজ্জা এসে ভিড় জমায় তার। হালকা ফাঁকা ঢোক গিলে মুখের ওপর এসে উড়াউড়ি করা ছোটো ছোট অবাধ্য চুলগুলো আঙুলের সাহায্যে কানের পিঠে গুজে দেয় ও। এদিকে অরিনের করা প্রতিটি স্টেপ রৌদ্রের মনে এক উথাল-পাথাল ঢেও বয়ে দিচ্ছে। রৌদ্র পরপর শুকনো ঢোক গিলে। হঠাৎ নিজেকে এতো তৃষ্ণার্ত মনে হচ্ছে কেন তার! গলায় বুঝি খরা দেখা দিলো! বুকের ভেতর থাকা হৃদয়টাও কেমন ছন্দহীন গতিতে লাফিয়ে যাচ্ছে! আচ্ছা কি চাইছে এই অঙ্গটা? এ মুহুর্তে কি শরীর থেকে ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে নাকি! রৌদ্র নিজের অজান্তেই হাত রাখে তার বুকের বা পাশে। অরিন সেদিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,

~ রোদ ভাই! কি হলো আপনার? শরীর খারাপ লাগছে?
রৌদ্রের এতক্ষণে হুশ ফিরে। বুঝতে পারে নিজের মনের মধ্যে হওয়া উচাটন অবস্থা। রৌদ্র স্বাভাবিক গলায় বললো,
~ হু, না! ঠিক আছি।আচ্ছা আমি বলে দিচ্ছি কিভাবে ব্যান্ডেজ করতে হবে তুই সেভাবেই কর।
অরিন চমৎকার হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়।হাসির তালে গাল দুটোতে বিদ্যমান হয় বরাবরের ন্যায় দুটো গর্ত। রৌদ্রের সেদিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে ইচ্ছে করলো ঠাটিয়ে দুটো চুমু খেতে। কিন্তু এ যে এখন অসম্ভব! তাইতো রৌদ্র অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে তাকাতে চাইলো কিন্তু বেহায়া চোখদুটো সেকথা মানলে তো! তারা যে বরাবরই অরিনের ওপর ন্যাস্ত হতে ব্যস্ত! এই মুহুর্তে রৌদ্রের ইচ্ছে করছে অরিনকে দুটো কটু কথা শুনিয়ে দিতে। কি দরকার ছিলো ওর এখানে আসার।আর আসলোই যখন সাথে সাথে চলে গেলো না কেন? রৌদ্রের তো সাহসে কুলোয় না ওকে চলে যেতে বলতে।উফফ কি এক মহা ঝামেলা! রৌদ্র এবার ফোস করে নিশ্বাস ফেলে অরিনকে দিকনির্দেশনা দিতে থাকে।

অরিন ব্যান্ডেজ শেষ করে রাজ্য জয় করার ন্যায় বিজয়ী হাসলো। রৌদ্রের হাতটা উল্টে পাল্টে দেখিয়ে বললো,
~রোদ ভাই দেখুন। আমি ঠিকঠাক মতো ব্যান্ডেজ লাগাতে পেরেছি।
রৌদ্র তার হৃদয়হরনীর আপ্লূত কন্ঠে নিজেও মুচকি হাসলো। ধীমী স্বরে উত্তর দিলো,
~ হুম।
অরিন এবার কিছুটা মন খারাপ করে বলল,
~তাহলে এবার আপনি খাবেন কি করে? আপনার হাতেতো ব্যান্ডেজ লাগানো।
রৌদ্রের মনে এক অদ্ভুত প্রস্তাব এসে হানা দেয় কিন্তু সে যে এও জানে সেটি অরিনের সামনে উপস্থাপন করার সময় হয়নি এখনো! তাই রৌদ্র এবার হামি দিয়ে বলে ওঠে,
~ নিয়ে যা অরি। আমি এখন খাবোনা।
অরিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভাবলো। পরক্ষণেই কিছু মনে পরবার ন্যায় বলে উঠলো,
~ রোদ ভাই একটা কথা বলি?
রৌদ্র জবাব না দিয়ে তার দিকে দৃষ্টি তাক করে। যার অর্থ — বল!
অরিন এ পর্যায়ে কিছুটা ইতস্তত করে। মনের মাঝে দানা বেঁধে ওঠে হাজারো অসস্তি। আমতা আমতা করে বললো অবশেষে,

~ইয়ে, আপনি কিছু মনে না করলে আমি খাইয়ে দি?
রৌদ্র এবার যারপরনাই অবাক হয় যা তার মুখমণ্ডল দেখে স্পষ্ট অনুমান করা সম্ভব। রৌদ্রকে এভাবে অবাক হতে দেখে অরিন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো,
~ দিবো কি?
রৌদ্রকে আর পায় কে! কিছুক্ষণ আগেও মনের ভেতর উঠে আসা অদ্ভুত প্রস্তাবখানা যেখানে সে নিজ হাতে দূরে ঠেলে দিচ্ছিলো সেখানে এখন অরিন নিজ থেকেই তা করতে চাচ্ছে। এ তো রৌদ্রের কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! রৌদ্র নিজের মুখাবয়বে মেকি গাম্ভীর্যের ছাপ এনে বললো,
~ তুই শিওর?
অরিন এ পর্যায়ে মাথানিচু করে নেয়। আলতো কন্ঠে জবাব দেয়,
~ হুম।

অরিনের জবাব পেয়ে রৌদ্র মৃদু হাসলো।বুকে তার বয়ে গেলো এক অন্যরকম ভালো লাগার স্রোত। সে নিজে উঠে গিয়ে টেবিল থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে এসে ধরিয়ে দেয় অরিনের হাতে। তারাহুরো দেখিয়ে বলে,
~ শুরু কর! খুব খিদে পেয়েছে।
অরিন হা করে তাকায় রৌদ্রের দিকে। পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে লোকমা তুলে ধরে রৌদ্রের দিকে। রৌদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে অরিনের হাতের দিকে। অরিন রৌদ্রের সাড়া না পেয়ে বলে ওঠে,
~ কি হলো! হা করুন।

রৌদ্র বুঝি সৎবিৎ ফিরে পায়।কি হচ্ছে ওর! একটু পরপর এভাবে নিজেকে ঘোরের মধ্যে ফেলছে কেনো ও? রৌদ্র ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে। পরে মুখ বাড়িয়ে হা করে মুখে তুলে নেয় অরিনের এগিয়ে দেয়া লোকমা টি। রৌদ্র তৎক্ষনাৎ আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়। উপভোগ করে তার মুখে স্পর্শ করা তার হৃদয়হরনীর কোমল আঙুলের স্পর্শ! এই অনুভুতি শুধু যে রৌদ্রের হচ্ছে এমনটা কিন্তু নয়! অরিনের মনেও যে এক অদ্ভুত ঝড় বইছে রৌদ্রের প্রতিটি স্পর্শে। বারংবার কেঁপে ওঠছে ছোট্ট দেহখানা যতবার তার আঙুল স্পর্শ করছে তার রোদ ভাইয়ের অধর যুগল। এ এক অদ্ভুত বেসামাল পরিস্থিতি।অরিনের ইচ্ছে করছে ছুটে রৌদ্রের চোখের সামনে থেকে আড়াল হতে অথচ শরীর যেন এখানেই কোথাও আটকে গেছে ওর! নিজের দেহের নিজের ওপর এ কেমন বিশ্বাসঘাতকতা! অরিন নিজের ওপর বিরক্ত। তবুও আর কি করার! মানুষটাকে কি আর না খাইয়ে রাখবে না কি? তাইতো মনের মধ্যে অদেখা এই যন্ত্রণা সইয়েও সে বারবার খাবার তুলে দিচ্ছে রৌদ্রের মুখে।
প্রায় মিনিট দশেক পর অরিন পুরো প্লেটের খাবার শেষ করে। রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় বলে,

~ আরেকটু খাবার দিবো রোদ ভাই?
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলে ওঠে,
~ নাহ! আর প্রয়োজন নেই।
অথচ মনে মনে বলে,” তুই এতো ভালো করে খাওয়ালে আমি আরো দশ প্লেট খেতে পারবো সানশাইন ”
অরিন রৌদ্রের কথায় মৃদু হাসলো।প্লেট নিয়ে উঠে পড়তে নিলে রৌদ্র তার ডানহাত পেছন থেকে আকড়ে ধরে।অরিনের পাদু’টো থমকে দাড়ায় তৎক্ষনাৎ। পেছনে ফিরে তাকায় অরিন।রৌদ্র অরিনের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত আবেদন করে বসে,
~ তুই কিছু মনে না করলে, আমার মাথাটা একটু টিপে দিয়ে যাবি? আসলে আজকে বেশি খাটুনি গিয়েছেতো তাই মাথাটা ধরেছে।

রৌদ্রের করা এমন আকুল আবেদন উপেক্ষা করার সামর্থ্য কি আদৌও আছে অরিনের! সে মৃদু হেসে মাথা কাত করে। রৌদ্র তার হাতটি ছেড়ে দেয়।অরিন ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে রৌদ্রের কাছাকাছি দাড়ায়। রৌদ্র তাকে দেখে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ে।অরিন সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। মনে মনে ভাবে হয়তো সে তার উত্তর পেয়ে গেছে! অরিন রৌদ্রের মাথার কাছে বসে।নিজের মোমের ন্যায় কোমল হাতগুলো দিয়ে আস্তে করে ছুয়ে দেয় রৌদ্রের কপাল।তৎক্ষনাৎ সারা শরীরে কাটা দিয়ে ওঠে রৌদ্রের। এই স্পর্শ! এই অনুভূতি! তার পাশে থাকা মানুষটা! সবটাই যে তার মনে এক নিষিদ্ধ ইচ্ছার জাগরণ তুলছে। রৌদ্র নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।কিন্তু যতবার অরিনের স্পর্শ পাচ্ছে ততবারই সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। না,না, আর বেশিক্ষণ এভাবে চলতে থাকলে সে ঠিক নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাবে! রৌদ্র হঠাৎই তার চোখদুটো খুলে দেয়। অরিনের দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

~ অরি! এখান থেকে চলে যা।
অরিন ভড়কায়।তার হাতগুলো থেমে যায় সেখানেই। সে ভড়কে যাওয়া কন্ঠে বলে ওঠে,
~ কি হয়েছে রোদ ভাই?
রৌদ্র এবার আগের চেয়ে দ্বিগুণ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
~ যেতে বলেছি প্রশ্ন করতে নয়!
অরিন অবাক চোখে তাকিয়ে রয় রৌদ্রের দিকে।কিছু বলতে যাবে তার আগে আবারও কানে আসে রৌদ্রের রাগান্বিত কন্ঠ,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২১

~ আই সেইড লিভ নাউ!
অরিন সাথে সাথে উঠে দাড়ায়। এই মুহুর্তে রাগ হচ্ছে তার প্রচুর। কিছুক্ষণ আগেও তো রোদ ভাই ঠিক ছিলেন। কত নরমভাবে কথা বলছিলেন আর এখন!
অরিন কিছু না বলে সেখান থেকে দুকদম আগাতেই পেছন থেকে ভেসে আসে এক শিহরন জাগানো শীতল কন্ঠ,
~ অরি! একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের কক্ষে রাত-বিরেতে আসাটা রিস্ক!

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here