সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৩

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৩
Jannatul Firdaus Mithila

~ অরি! একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের কক্ষে রাত-বিরেতে আসাটা রিস্ক!
কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র থমকে যায় অরিন।পাদু’টো বুঝি কোন এক অদৃশ্য বেড়াজালে বন্দী হয়ে পড়েছে। বুকের মাঝে বয়ে যাচ্ছে এক অসহ্য কাঁপন। অরিন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
~ মানে!

রৌদ্র মুচকি হাসে। বিছানা ছেড়ে ধীর গতিতে এগিয়ে আসে অরিনের দিকে। ক্ষনিকের মাঝে রৌদ্র অরিনের পেছনে এসে দাড়ায়। তার শরীর আর অরিনের পিঠের মাঝে দুরত্ব একেবারেই সামান্য।অরিন উপলব্ধি করছে তার পিঠে আছড়ে পড়ছে রৌদ্রের গরম নিশ্বাস। রৌদ্রের উপস্থিতি নিজের এতোটা কাছে পেয়ে অরিনের সর্বাঙ্গ কেপে ওঠে। মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে যায় এক শীতল স্রোত। কাঁপা কাঁপা হাতদুটো খপ করে মুচড়ে ধরে জামার একাংশ। অন্যদিকে রৌদ্র এক অনিমেষ ঘোরলাগা নয়নে তাকিয়ে আছে তার মনোহরোনির দিকে। নিজেকে মনে মনে হাজারবার আটকাতে চেয়েও যেন আটকাতে পারছে না সে! মনের মধ্যে বারংবার হানা দিচ্ছে এক নিষিদ্ধ চাওয়া।বারেবার তার ইচ্ছে করছে অরিনকে একটু ছুয়ে দিতে। গভীরভাবে ছুয়ে দিতে। এই মুহুর্তে রৌদ্রের নিমিষেই পারিবারিক সকল নিষেধাজ্ঞা, সম্পর্কের সকল বেরি বাঁধ ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। রৌদ্র ঘোরলাগা চোখে অরিনের ফর্সা মসৃণ ঘাড়ে তাকিয়ে আছে। সেখানে শোভাবর্ধনকারী হিসেবে জ্বলজ্বল করছে এক কালো কুচকুচে তিল।রৌদ্রের না জানি কি হলো! সে কোনরূপ কালবিলম্ব না করে আলতো হাতে ছুয়ে দেয় অরিনের ঘাড়ে থাকা কুচকুচে কালো তিলটি।অরিন তৎক্ষনাৎ কেঁপে ওঠে। মূর্ছা যায় এক অমীমাংসিত লজ্জায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রৌদ্রের বুঝি এতোটুকুতে মন ভরলো না।সে এবার করে বসলো আরেক অবিশ্বাস্য ঘটনা। অরিনের কনুই ধরে একটানে তাকে দেয়াল ঘেঁষে দাড় করিয়ে দেয়।ঘটনার আকস্মিকতায় অরিন ভড়কে যায়। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র তার একহাত রাখে অরিনের পাশ ঘেঁষে দেয়ালের ওপর। ভাব এমন, অরিনকে বুঝি আটকে ফেলবে নিজের চক্ষু সম্মুখে। অরিন এখনো একই ভঙ্গিতে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে। আর রৌদ্র! তার কি হলো আজ! সে কি ভুলে যাচ্ছে এই নিষিদ্ধ কাজের পরিনাম? সে কি হেরে যাচ্ছে নিজের কাছে করা বেনামি ওয়াদার কাছে? সে কি আবারও ডুবে যাচ্ছে অরিনের প্রেমের অতল গহ্বরে!

রৌদ্রের মস্তিষ্ক বুঝি থমকে গেছে এক জায়গায়। কোনরকম ভালো, খারাপ কিছুই যেন এ মুহুর্তে তার মনের মধ্যে প্রশ্ন তুলছে না।সে বুঝি হারিয়ে যাচ্ছে অরিনের মায়াবী মুখের আদলটিতে! রৌদ্র ধীরে ধীরে তার শীতল হাতটি অরিনের গালে স্পর্শ করায়। অরিন সেই শীতল স্পর্শ সহ্য করতে না পেরে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে। চোখদুটো কুচকে বন্ধ করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে।

অরিনের এমন অবস্থা দেখে রৌদ্রের যেন নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পড়েছে। সে নিজের মনের মধ্যে ওঠা নিষিদ্ধ চাওয়া গুলোকে দমাতে তৎক্ষনাৎ নিজের হাতে কামড় বসায়। ব্যাথায় চোখমুখ কুচকে আসে তার।ক্ষনকাল বাদে রৌদ্র কিছুটা স্বাভাবিক হয়। হাত সরিয়ে নেয় অরিনের পাশ হতে। আর অরিন! সে-তো এখনো চোখ কুচকে বন্ধ করে রেখেছে। চোখ খোলা থাকলে হয়তো দেখতে পারতো এক পাগল প্রেমিক পুরুষের নিজেকে দমানোর কতরুপ চেষ্টা!
রৌদ্র শান্ত চোখে সেদিকে একপলক তাকায়। পরে দৃষ্টি অন্যদিকে তাক করে রাশভারী কন্ঠে বলে,
~ অরি! পুরুষ মানুষ হচ্ছে শুকনো কাঠের ন্যায় আর নারী হচ্ছে জলন্ত আগুনের শিখা। তাই নারীর সংস্পর্শে আসলে পুরুষের ছাই হওয়া অনিবার্য!

অরিন চট করে চোখ খোলে। রৌদ্রকে আবিষ্কার করে নিজের অনেকটা দূরে। তার সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক জুড়ে এখনো ঘোরপাক খাচ্ছে রৌদ্রের বলা কথাগুলো। একে একে দুই মিলিয়ে যখন সবটা তার বোধগম্য হলো তখনই তার মুখের আদলে এসে হানা দিলো রাজ্যের লজ্জা আর অস্বস্তি। ফলস্বরূপ তার নাকের ডগা আর গালদুটোতে ছেয়ে যায় রক্তিম আভা। রৌদ্র একবার সেদিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘোরায়। এ মেয়ের দিকে আরেকবার তাকালে রৌদ্রের যে নিজেকে হারিয়ে ফেলা সুনিশ্চিত। রৌদ্রের দৃঢ় চোয়াল আরও খানিকটা দৃঢ় হয়ে ওঠে। সে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

~ অরি! রুমে যা।
অরিন বুঝি এ কথাটারই অপেক্ষায় ছিলো। সে মাথানিচু করে একছুট লাগায় নিজের রুমের উদ্দেশ্যে। ছুটে এসে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় অরিন।সেখানেই দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে হাঁপাতে থাকে অনবরত। মুখে রক্তিম আভা আর মনে কোন এক অজানা তৃপ্তি পেয়ে যাওয়ায় অবাধ সুখ! অরিনের মনে হচ্ছে, আজ আবার অতিরিক্ত সুখ সহ্য করতে না পেরে ওর মরন না হয়ে যায়! না,না,ওর তো এখন মরলে হবে না। ভালোবাসার মানুষটার সাথে এখনো যে বাঁচতে হবে বহুদিন! একসঙ্গে পারি দিতে হবে বহু পথ। অরিনের আজ নিজেকে বড্ড ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। সত্যি কি তাহলে তার অনুমানই সঠিক ছিলো? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তার আর দেরি করা চলবে না।খুব শীঘ্রই মনের কথা জাহির করতে হবে তার।

রৌদ্র কাউচে হেলান দিয়ে কপালে আঙুল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। তার এ মুহুর্তে বিরাট টেনশন হচ্ছে। না জানি তখনকার করা নিজের অনিয়ন্ত্রিত ব্যাবহারে অরিন কি না কি মনে করলো আবার।
তৎক্ষনাৎ রৌদ্রের মাথায় এক অন্য চিন্তা এসে হানা দেয়। সে ভাবে, “অরিনকি আমায় ভুল বুঝলো?”
রৌদ্র এবার সটান হয়ে বসে।হাত দিয়ে চুলগুলো খামচে ধরে বিড়বিড়িয়ে বলে,
~ উফফ! এতো কন্ট্রোললেস কি করে হলাম আমি! এবার কি করে সামাল দিবো সবটা।

পরেরদিন সকালবেলা 🌼
ডাইনিং টেবিল জুড়ে খাবারের সমারোহ। বাড়ির সকলে ইতোমধ্যে একসাথে হয়েছেন ব্রেকফাস্ট করতে। শুধুমাত্র রৌদ্র বাদে। খাবার খেতে খেতে প্রত্যেকে টুকটাক কথা বলছে অথচ কবির সাহেব একেবারেই নিশ্চুপ। তিনি আঙুল দিয়ে অন্য মনস্ক হয়ে রুটি ছিঁড়ছেন শুধু। মুখে তুলবার নাম নেই। সাব্বির সাহেব খাবারের একফাঁকে বড় ভাইয়ের দিকে তাকান। কবির সাহেবকে খাবারের দিকে অন্যমনস্ক থাকতে দেখে সাব্বির সাহেব ভ্রু কুচকিয়ে বলে,
~ ভাইজান!

হঠাৎ ডাকে একপ্রকার হকচকিয়ে ওঠেন কবির সাহেব। তিনি এদিক-ওদিক একবার চোখ বুলায়। সকলেই নিজেদের মাঝে ব্যস্ত। কবির সাহেব কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। সাব্বির সাহেবের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠেই বললেন,
~ হু।বল কিছু বলবি?
সাব্বির সাহেবের গুটানো ভ্রু আরো কিছুটা গুটিয়ে যায় কবির সাহেবের এমন হাবভাবে। তিনি কন্ঠে স্বাভাবিকতা রেখে জিজ্ঞেস করে,
~ কি হয়েছে তোমার?তোমাকে এমন অন্যমনস্ক লাগছে যে!
কবির সাহেব বুঝতে পারলেন ভাই তার অনেকক্ষণ যাবত হয়তো তাকে পরোক্ষ করে যাচ্ছে। তিনি প্রসঙ্গ এড়াতে কিছুটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন,

~ নাহ তেমন কিছু না। আসলে নতুন ডিলটা নিয়েই একটু চিন্তা করছিলাম আরকি!
সাব্বির সাহেবের কেমন যেন বিশ্বাস হলো না তার বড় ভাইজানের কথা। তবুও তিনি মুখে কিছু বললেন না। মাথা ঝাকিয়ে আবারও মনোযোগ দিলেন খাবারে।
তাদের খাবারের মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় রৌদ্র। একেবারে হসপিটালের জন্য রেডি হয়ে তারপর এসেছে। শ্যামবরন পুরুষটির দৃঢ় চোয়ালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, বিড়াল চোখে বরাবরের মতো খয়েরী ফ্রেমের চশমা আঁটানো। পড়নে অফ হোয়াইট শার্ট, ব্ল্যাক প্যান্ট। হাতে সিলভার কালার ওয়াচ আর বুকের সামনের দুটো বোতাম খোলা। রৌদ্র চেয়ার টেনে বসে পড়ে।

তার বরাবর সামনের চেয়ারে বসে তাকে পা থেকে মাথা অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত অরিন। ঠিক সেই মুহুর্তে রৌদ্রও তার দিকে তাকায়। ফলে চোখাচোখি হয় দুজনার। অরিন আজ আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের দৃষ্টি সরায় না। সে রৌদ্রের তাকানো দেখে মুচকি হেসে নিজের দৃষ্টি সরায়। এদিকে রৌদ্র অরিনের এহেন কার্যক্রমে ভ্রুকুচকায়। মনে মনে উত্তর খোঁজে অরিনের এমন কান্ডের কারন।কিন্তু উত্তর বরাবরই শূন্য! পরে নিজের দৃষ্টি অরিনের ওপর থেকে সরিয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দেয় রৌদ্র।
খাবারের মাঝে বরাবরের মতো আজও রৌদ্র দুএকবার অরিনের দিকে আড়চোখে তাকায়, তখনই চোখাচোখি হয় অরিনের সাথে। তার মানে কি অরিনও তার দিকে তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ? রৌদ্রের এবার বেশ চিন্তা হয়। ভাবতে থাকে পরবর্তী আগাম ঘটনা সম্পর্কে!

দুপুর ২ টা🎀
রৌদ্র তার কেবিনে বসে দুয়েকটা পেশেন্টের ফাইল ঘাঁটছে। তখনি কেও একজন হন্তদন্ত পায়ে প্রবেশ করে তার কেবিনে। রৌদ্র হাতে থাকা ফাইলগুলো থেকে একপলক নজর সরিয়ে দৃষ্টিপাত করে সামনে থাকা ব্যাক্তিটির দিকে। পরক্ষনেই ভ্রুক্ষেপহীনভাবে আবারও দৃষ্টি আনে ফাইলগুলোর দিকে।
রৌদ্রের এহেন ভ্রুক্ষেপহীন আচরণে দাত কটমট করে রেহান।রৌদ্রের টেবিলের ওপর সশব্দে থাবা বসিয়ে মেকি রাগ দেখিয়ে বললো,
~ শালা! আমাকে কি তোর মানুষ বলে মনেহয় না রে?
রৌদ্র ফাইলগুলোর আড়ালে মুচকি হাসলো। কিয়ৎকাল বাদেই আবারও তা মিলিয়ে গেলো অজানায়। রৌদ্র এবার হাতের ফাইলগুলো টেবিলের ওপর রাখে। চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে বলে,

~ ডুড! ইউর ওয়ার্ডস নিড আ কারেকশন। আ’ম ইউর সম্বন্ধি নট শালা!
বলেই ভাব দেখিয়ে দুহাত পকেটে গুজে সটান হয়ে দাড়ায় রৌদ্র। এদিকে রৌদ্রের কথায় দাত কিড়মিড়িয়ে এগিয়ে আসে রেহান।রৌদ্রের মুখোমুখি দাড়িয়ে শক্ত গলায় বললো,
~ রাখ তোর শালা/ সম্বন্ধি! আগে তুই বল কালকে তুই ঠিক কি কি করেছিস? আমি কিছুক্ষণ আগে সরকারি হসপিটালে লোকগুলিকে দেখে আসলাম।মাই গড! কি অবস্থা করেছিস ওদের!
এ পর্যায়ে থামে রেহান। আবারও কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
~ এই ওয়েট আ সেকেন্ড! ডাক্তাররা বললো ওদের নাকি ঐটা আর চলবে না। আচ্ছা সবগুলোর একসাথে একই সমস্যা হলো কি করে? এ বিষয়ে তুই তো কিছু করিসনি?
রৌদ্র রেহানের কথায় ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাড়িয়ে। যেন রেহান এই মুহুর্তে তেমন কোনো জরুরি কথাই বলছে না! রেহান আবারও খানিকটা রাগ দেখিয়ে বলে,

~ কিরে! আ’ম আস্কিং ইউ সামথিং। উওর দে।
রৌদ্র এবার মুখ খুলে। দৃঢ় চোয়াল শক্ত করে জবাব দেয়,
~ হ্যা আমিই করেছি।সো হোয়াট!
রেহান বুঝি আকাশ থেকে পড়লো।বিস্ফোরক নেত্রে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে। কন্ঠে অবাকের রেশ ধরে বললো,
~ সিরিয়াসলি বাডি! সবগুলোর ঐটা একেবারে অকেজো করে দিলি? একটুতো রহম করতে পারতি!
রৌদ্র আগের ন্যায় বললো,
~ যারা আমার সানশাইনের দিকে হাত বাড়াবে তাদের যে এমন হালটাই হবে!
বলেই সে রেহানের কাছে গিয়ে তার পিঠ চাপড়ে বললো,
~ তাদের কথা বাদ দে।চল একসঙ্গে লাঞ্চ করা যাক!
রেহান রৌদ্রের ভাবলেশহীন কথাবার্তায় বুঝতে পারে — একে কিছু বলা আর পাথরে নিজের মাথা ঠুকানো একই বিষয়। তাইতো রেহান নিজেকে স্বাভাবিক করে সম্মতি জানায় রৌদ্রের কথায়।অতপর দুজন মিলে চলে যায় ক্যান্টিনে।

রৌদ্র আর রেহান নিজেদের পছন্দসই খাবার অর্ডার করে টুকটাক এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে থাকে। ঠিক তখনি রৌদ্রের ফোন বেজে ওঠে। রৌদ্র কথা বলার মাঝে অত গুরুত্ব দেয় না।কিন্তু পরপর দুটো কল আসায় বাধ্য হয়ে কথা থামিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে সামনে ধরে রৌদ্র। তৎক্ষনাৎ ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বার দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে আসে তার। বেখেয়ালি বশত টেবিলের ওপর ঠেকিয়ে রাখা হাতটি সাইড থেকে পড়ে যায়। রেহান রৌদ্রের এমন হাবভাবে বেকুব বনে যায়। রৌদ্রের মুখের সামনে চুটকি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে,
~ হেই! কি হলো তোর? কতক্ষণ যাবত কলটা বাজছে। ধরছিস না কেন? কে কল দিয়েছে!
রৌদ্রের কানে কি কথাটা আদৌও পৌছুতে পেরেছে? সে এখনও অবাক লোচনে তাকিয়ে ফোনের স্ক্রিনে।
রেহান এবার মেজাজ হারালো।খেঁকিয়ে ওঠে জিজ্ঞেস করলো,

~ কে কল দিয়েছে বলবি তো!
প্রতিত্তোরে রৌদ্র এবারও নিশ্চুপ। রেহান আর কিছু জিজ্ঞেস না করে বিড়বিড়িয়ে সামনে থাকা পানির বোতলে চুমুক লাগায়। সেই মুহুর্তে রৌদ্র হঠাৎ বিড়বিড়িয়ে বললো,
~ সানশাইন!
সাথে সাথে মুখ থেকে সব পানি ছিটকে ফেলে রেহান। আকস্মিকতায় পানি ওঠে যায় নাকেমুখে! কাশতে থাকে অনবরত।
এদিকে রেহানের মুখ থেকে ছিটকে ফেলা পানি সব গিয়ে পড়ে রৌদ্রের গায়ে। তৎক্ষনাৎ রৌদ্র অবাকের রেশ কাটিয়ে দ্বিগুণ ক্রোধ নিয়ে তাকায় রেহানের দিকে। কটমট করে বলে,
~ ইডিয়ট কি করলি এটা!

রেহানের কি আর সেদিকে হুঁশ আছে? বেচারা রৌদ্রের কথায় এতটাই শক খেয়েছে যে, এখন নাকেমুখে উঠে যাচ্ছে তা-ই অবস্থা! রৌদ্র রেহানের অবস্থা অবলোকন করে আর কিছু বললো না।বিরক্তির সাথে মুখে “চ”- কারান্ত শব্দ করে গা থেকে পানি ঝাড়বার বৃথা চেষ্টা চালায়। এতোকিছুর মাঝে রৌদ্র প্রায় ভুলেই বসেছিলো যে কেও একজন তাকে অনবরত কল দিয়ে যাচ্ছে। রৌদ্রের হঠাৎ খেয়াল হয় ফোনের কথা।সাথে সাথে সে কল ব্যাক করে নাম্বারটিতে। যতবার রিং হচ্ছে ঠিক ততবার রৌদ্রের হার্টবিটও ফার্স্ট হচ্ছে। মনে মনে বারংবার হানা দিচ্ছে অহেতুক কিছু দুশ্চিন্তা। বরাবরই সে চিন্তা একজনকে ঘিরেই, ভাবছে— ও ঠিক আছে তো! কোন বিপদ হলো না তো?
একবার -দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোনটি রিসিভ হলো। রৌদ্র এখনও চোখ বন্ধ করে ফোনটি কানে ঠেকিয়ে রেখেছে। ওপাশ হতে কোন শব্দ না আসায় রৌদ্র এবার চোখ মেলে, গম্ভীর গলায় শুধায়,

~ অরি?
ওপাশ থেকে কি কেও হাসলো? কিন্তু কই আওয়াজতো আসলো না! তবে কি সে নিঃশব্দে হাসছে? রৌদ্র বিষয়টা বুঝতে পেরে মুচকি হাসে। ক্ষনকাল বাদে আবারও বলে,
~ অরি?
ওপাশ থেকে এবার শব্দ আসলো তবে ধীমী স্বরে,
~ জ্বি!
রৌদ্র আবারও গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,
~ এসময় কল দিলি,সব ঠিক আছে?
অরিন এবার নিশ্চুপ! সাহস করে কল তো দিয়ে দিলো কিন্তু এবার বলবে টা কি? অরিন এবার নিজের ওপর বিরক্ত হয়।রোজ তো একা একা রোদ ভাই কে কল্পনা করে শত শত কথা বলে তাহলে আজ কেন বলতে পারছে না কিছুই! কেন এমন লাগছে তার!

অরিন এবার ঘর ছেড়ে বারান্দায় যায়।দূর আকাশে দৃষ্টি রেখে গভীর শ্বাস ফেলে।অন্যদিকে সেই নিশ্বাসের শব্দ কর্ণগোচর হতেই কােন একজনের হৃদয়ে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে তার খবর কি রাখে অষ্টাদশী?
অরিন মনে অজস্র সাহস সঞ্চার করে আমতা আমতা করে বললো,
~ ইয়ে মানে, আপনি কি লাঞ্চ করেছেন রোদ ভাই?
রৌদ্র থমকায়।অবিশ্বাস্য চোখে একবার ফোনটিকে সামনে এনে দেখে এটা আদৌও কি অরিনের নাম্বার কি না! হ্যা ঠিকই তো আছে সবটা।এটাতো অরিনের নাম্বার-ই। রৌদ্র কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
~ অরি আর ইউ ওকে?
অরিন রৌদ্রের এহেন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সহসা তার হাসি হাসি মুখটা থেমে যায়। সে হতভম্ব গলায় বলে ওঠে,

~ মানে! আমিতো সুস্থই।
রৌদ্র এবার হাফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু তখনই কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে ভ্রু-গোটায়। মনে মনে বিচলিত হয়ে পড়ে এক আগাম অশনি সংকেতের আগমনে!
রৌদ্রকে চুপ থাকতে দেখে অরিন আবারও বলে,
~ রোদ ভাই! লাঞ্চ করেছেন?
রৌদ্র অরিনের ডাকে সৎবিৎ ফিরে পায়।নিজেকে স্বাভাবিক করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
~ নাহ এখনো করিনি।
অরিন তখন বিচলিত হয়ে পড়ে। কন্ঠে তার একরাশ অধিকারবোধ।
~কেন? এখনও খাননি কেন? বেলা কয়টা বাজে দেখেছেন একবারও। এরম করলে তো শরীর খারাপ করবে বুঝেন না আপনি। ডাক্তার হয়েও শরীরের প্রতি এতো অবহেলা!
রৌদ্র যেমন চিন্তিত তেমনি মনে মনে তার এক অদ্ভুত তৃপ্তি। এই যে তার সানশাইন এখন কি সুন্দর তার ওপর অভিমান করছে, ফোন দিয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছে। এগুলো সবই যে রৌদ্রের কল্পনা ছিলো কিন্তু আজ যে তা বাস্তবে পরিণত হলো।

রৌদ্র এক মুহূর্তের জন্য নিজের সব দুশ্চিন্তা ভুলে গেলো। অরিনকে আরেকটু বাজিয়ে দেখবার লক্ষ্যে বললো,
~ আমি খাইনি বলে হঠাৎ তোর এতো দুশ্চিন্তা হচ্ছে কেন? কাহিনি কি?
হঠাৎ এমন কথায় অপ্রস্তুত হয় অরিন।মনে মনে মানানসই উওর খোঁজে কিন্তু উওর আর মেলে না।
অরিন কিছুটা ইতস্তত হয়ে বলতে থাকে,
~ নাহ তেমন কিছু না। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম আরকি!
রৌদ্র অরিনের ইতস্ততা বেশ বুঝতে পারে। নিঃশব্দে হেসে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। অতপর আবারও এক ঘোর লাগা কন্ঠে বলে ওঠে,

~ কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানাই থাক!
রৌদ্র কিছুটা দম নেয়।পরে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
~ মিস: আমি খাবার খেয়ে নিচ্ছি! আপনি নিজের খেয়াল রাখবেন। আর হ্যা, আপনার জন্য কিছু আনতে হবে কি? আসার সময় নাহয় নিয়ে আসলাম!
অরিন বুঝি খুশিতে আটখানা! খুশির চোটে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। মানুষটা এত সুন্দর করে কথা বলে! ইচ্ছে করে সারাদিন শুধু মনোযোগ দিয়ে তার কথাই শুনতে। অরিন মৃদু হেসে ধীর স্বরে বলে,
~ কিচ্ছু লাগবে না। আপনি সাবধানে আসবেন। রাখছি!

বলেই আর একমুহূর্ত দেরি না করে ফোন কেটে দেয় অরিন। মনে মনে নিজেকে বাহবা দিতেও ভুললাে না সে।ভাবা যায়! ঠিক কতটা সাহস সঞ্চার করে কথাগুলো বলেছে ও।
অন্যদিকে রৌদ্র ফোনটি কান থেকে নামিয়ে বুকে চেপে ধরে। মুখ ফুঁড়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে,
~হায়! মে মারযাবা!
রেহান শান্ত চোখে পরক্ষণ করে রৌদ্রের কান্ড।মুচকি হেসে স্বাভাবিক গলায় বললো,
~ ভাই! এটুকুতেই এ হাল? তাহলে বাকিটা সামলাবি কিভাবে?
রৌদ্রের কি আর রেহানের সে কথায় পাত্তা দেবার মতো সময় আছে! সে-তো ব্যস্ত নিজের ভাবনায়।
বেশকিছুক্ষন পর রৌদ্র ফোনটি বুক থেকে উঠিয়ে সামনে ধরে। অতপর বলে,
~ পরিশেষে তুমি প্রেমে পড়লে তবে!

~ মা! আমিতো তোমায় অন্য কারোর কথা জিজ্ঞেস করছি না বলো! আমি শুধু সে মানুষগুলোর কথা জিজ্ঞেস করছি যাদের জন্য তুমি রোজ কাঁদো। কেন প্রতিবার কথাগুলো এড়িয়ে যাও মা? কেন?
মেয়ের কথায় বরাবরের মতো নিরবতা পালন করেন আমরিন বেগম। কি জবাব দেবে মেয়ের কথায় তিনি? আছে কি কোন উওর? থাকলেও বা কি! তিনি কি আর বলতে পারবেন সবটা!
ইকরার মেজাজ বিগড়ে যায়। সে কাঠকাঠ গলায় আবারও মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,
~বলবে না তো! ঠিক আছে বলতে হবে না।আমায় কেন বলবে? আমি কে!
আমরিন বেগম মেয়ের কথায় মুহুর্তে রনমূর্তি ধারণ করে। শক্ত গলায় বলেন,
~ কিসব বলছো তুমি! কিছু বলছি না বিধায় যা নয় তাই বলবে? মায়ের সঙ্গে এরূপ ব্যাবহার করবে তুমি?
ইকরা নিজের ভুল বুঝতে পারে। সে ছুটে এসে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মায়ের বুকে নাক ঘষে কাঁদো কাঁদো হয়ে অপরাধী স্বরে বললো,

~ সরি মা! বিশ্বাস করো তোমায় কষ্ট দেবার জন্য আমি এসব বলতে চাইনি। আমি,আমি যে তোমার চোখের পানি আর সহ্য করতে পারি না মা! আর পারি না!
ইকরার কথায় আমরিন বেগমের বুকটা কেঁপে ওঠে। চোখে এসে ভিড় জমায় অশ্রুকনারা। ছলছল চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখের বারিকণাগুলো লুকানোর বৃথা চেষ্টা চালান তিনি। কিন্তু ফলাফল বরাবরই শূন্য! চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু ফোটা নোনতা জল। আমরিন বেগম তার কাঁপা কাঁপা হাতটি মেয়ের মাথায় রাখলেন। ধরে আসা গলায় বললেন,

~ অতীত বড্ড খারাপ রে মা! সেটা যত আড়ালে থাকে ততই মঙ্গল।
ইকরা মায়ের কথায় ভিন্ন এক গভীরতার সন্ধান পায়। চট করে সে মায়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়। মায়ের দিকে তাকিয়ে এবার কিছুটা সাহস সঞ্চার করে আমতা আমতা করে বললো,
~ আম্মু লাস্ট একটা প্রশ্ন করি?
আমরিন বেগম মেয়ের কথায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। সেদিকে তাকিয়ে ইকরা আবারও বলে ওঠে,
~ ঐদিন হসপিটালে যে ডক্টরের সাথে কথা হয়েছিল সে সম্পর্কে আমার কি হয়?
আমরিন বেগম থমকে গেলেন।তিনিতো সেদিনের ঘটনাটি একেবারে ভুলেই বসেছিলেন। নেহাৎ রৌদ্রের বিষয়ে তিনি,ইফতি এবং তার স্বামী জানেন কিন্তু ইকরা! সে-তো এ বিষয়ে কিছুই জানে না। জানে না সেই ভয়ংকর অতীতের স্মৃতি!
ইকরা মায়ের ওমন ভাবনায় পড়ে যাওয়া দেখে, মায়ের হাতে আলতো ঝাঁকি দিয়ে বলে,

~ বললে না! সেদিন সেই ডক্টর তোমায় ক্ষনে ক্ষনে কেন ফুপু বলছিলো? ওনি কি সত্যি আমাদের আত্মীয় কেও?
আমরিন বেগম এবার মুখ খুললেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
~ হুম, ও আমাদের আত্মীয়।
~ আত্মীয়? কিন্তু কেমন আত্মীয়? আমার জানামতে আমার কোন মামা কিংবা খালা নেই।ইভেন চাচা ফুপ্পিওতো নেই তাই-না?
আমরিন বেগমের বুকে আবারও এক কাঁপন ছড়িয়ে পড়ে। তিনি দুরুদুরু বুকে এদিক ওদিক তাকায়। হয়তো উওর খুঁজছেন কোনো!
ইকরা মায়ের হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করে। ভ্রুকুটি করে আবারও জিজ্ঞেস করে,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২২

~ বললে না যে! ওনি আমাদের কেমন আত্মীয়? কে হয় তিনি আমাদের? কি সম্পর্ক আমাদের সাথে তার! ওনি কি সত্যি আমাদের আপন কেও?
আমরিন বেগম মেয়ের কথায় অতিষ্ঠ হয়ে একপ্রকার চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,রদ,
~ হ্যা হ্যা। ও আমার আপন! আমার আপন বড় ভাইয়ের ছেলে। ইফতেখার এহসান রৌদ্র। আর আমি, আমি হচ্ছি ওর বড় ফুপু আমরিন এহসান আখি।
ইকরা মায়ের কথায় হতবাক হয়ে যায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
~ এহসান পরিবার আমাদের আত্মীয়!

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here