সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৪
Jannatul Firdaus Mithila
~ এহসান পরিবার আমাদের আত্মীয়!
মেয়ের অবাক কন্ঠে কোনরুপ প্রতিক্রিয়া দেখাননা আমরিন বেগম।সে-তো অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখের জল ফেলতে ব্যস্ত!
খানিক সময় পেরিয়ে যাবার পর ইকরা নিজের হতভম্বতা কাটিয়ে স্বাভাবিক হয়। ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভাবে সে। হুট করে কিছু মনে পড়ার ন্যায় মায়ের দিকে তাকায়। তারপর আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,
~ তাহলে আমার ভার্সিটির একাউন্টিং প্রফেসর জনাব তাশরিক এহসান আমার…
~মামা! ছোট মামা।
ইকরার কথা শেষ হবার আগে পেছন থেকে ভেসে আসে এক গম্ভীর কণ্ঠ।
ইকরা সেদিকে তাকায়।দেখতে পায় বাড়ির দরজার সামনে পকেটে দুহাত গুজে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে ইফতি। ইফতি বোনের দিকে তাকায়। এক ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে আসে ধীর পায়ে। ইকরার সামনা-সামনি এসে তার কাঁধে জড়িয়ে আগলে নেয় নিজের বুকের পাশে।ইকরা, সে-তো এখনো হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। ইফতি বোনের হতবিহ্বলতা কাটাতে এবার নিরবতা ভাঙে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
~ বাবুন! এহসান পরিবার আমাদের বড্ড কাছের মানুষরে! সে বাড়ির প্রতিটি মানুষ আমাদের আপনজন। এমনকি শুধু তাদের পদবি এহসান নয়, আমাদের পদবিও এহসান।
এপর্যায়ে ইকরা একেবারে বাকশূন্য হয়ে পড়ে। চোখ বড়সড় করে তাকিয়ে রইলো ভাইয়ের দিকে।মনে মনে ভাবছে, ” আমরাও এহসান বংশ!”
ইকরার ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট অবাকের রেশ। ইফতি সবটা বোঝে। অতপর মায়ের দিকে নজর ঘুরিয়ে দেখে, তার মা শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজে কেঁদে যাচ্ছে। ইফতির বুকটা আবারও ভার হয়ে আসে মায়ের ক্রন্দন দেখে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে এক গভীর নিশ্বাস টেনে বললো,
~ আমাদের বাবার নাম জনাব শাহানুর এহসান। সন অফ আব্দুল মান্নান এহসান।
ইকরা এবার নিজের হতবিহব্বলতা কাটিয়ে বিচলিত হয়ে বলে বসে,
~ তারমানে, এহসান পরিবার শুধু আমার নানাবাড়ি নয় দাদাবাড়ীও!
~ ভাইজান, আসবো?
তাপনিয়ন্ত্রিত হিমশীতল কক্ষে, নিজের বরাদ্দকৃত ডেস্কে বসে অফিসের কিছু জরুরি ফাইল ঘাটছিলেন কবির সাহেব। ছোট ভাইয়ের ডাকে কাজের মাঝে মনোযোগে ব্যঘাত ঘটায় রুষ্ট হওয়ার বদলে খুশি হলেন বরং। মুখের আদলে লম্বা একটা হাসি টানেন তিনি।
~ আরে আয় ভেতরে। কতবার বলেছি এভাবে অনুমতি নিতে না!
ভাইয়ের মুখে এরুপ কথা শুনে মুচকি হাসলো সাব্বির সাহেব। কেবিনে প্রবেশ করে ভাইয়ের মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসে পড়েন আরামসে! অতপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে উৎসুক গলায় বলেন,
~ ভাইজান, রেহানের বাবা কল দিয়েছে। বললো, আগামীকাল তো শুক্রবার। তোমার কথামতো কালকে তারা আসবে বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে।
কবির সাহেব এ কথা শুনে মুখভঙ্গি কিছুটা গম্ভীর করলেন। সাব্বির সাহেব বুঝি ভাইয়ের মনের অবস্থা আচ করতে পারলেন। ভাইয়ের এগিয়ে রাখা হাতের ওপর নিজের হাত রেখে বললেন,
~ ভাইজান! রুহির জন্য মন খারাপ লাগছে?
কবির সাহেব নিশ্চুপ! হয়তো মনের কথা ভাইয়ের মুখে শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তিনি মাথানিচু করে বসে রইলেন একইভাবে।
সাব্বির সাহেব এবার শতভাগ নিশ্চিত হলেন ভাইয়ের ব্যাপারে।তিনি দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন,
~ ভাইজান, মেয়ে সন্তানগুলো না এমনি হয়! তারা জন্মের পর থেকে কলিজার কাছাকাছি থাকে। মায়ের মতো ভালোবাসে। আদর্শের মতো সম্মান করে। অতপর তারা বড় হবার পর কোন দায়িত্ববান পুরুষ এসে এক নিমিষে তাদের আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যায়। আসলে ভাইজান, এখানে আমাদের করারই বা কি আছে বলোতো! এ যে ভাগ্যের লিখন প্রতিটি মেয়ের। একদিন না একদিন তাদেরতো আমাদের ছেড়ে নিজের বাড়িতে যেতেই হবে।
কবির সাহেব কি শুনলেন সবটা? হুম হয়তো শুনলেন। এই যে তার আঁখি দ্বয় কেমন চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আরেকটু হলে চোখের কোটর ছাড়িয়ে দু’ফোটা বারিকনা গড়িয়ে পড়বে অবলীলায়! তিনি নিজেকে সামলানোর ন্যায় চোখ দুটি বন্ধ করে নিলেন। তখনি তার কল্পনার মানসপটে ভেসে ওঠে রুহির জন্মানোর মূহুর্তটা।
— সেদিন ছিলো মারাত্মক বর্ষার দিন।রাত তখন ৯টা বেজে ২০ মিনিট। কবির সাহেব আর সাব্বির সাহেব ভারি বর্ষনের তোড়ে অফিস ছেড়ে আসতে পারছিলেন না কোনমতেই। টিভিতে তখন দেখাচ্ছিলো,চারিদিকে কেমন পানিতে থৈথৈ করা অবস্থা! রাস্তায় পানি জমার ফলে হয়েছে তীব্র যানযট। জুবাইদা বেগম এতক্ষণ ড্রয়িং রুমে বসে এসবই দেখছিলো। কাল থেকে মনটা কেমন আনচান করছে তার। এ মুহুর্তে বাড়িতে তিনি আর রাফিয়া বেগম। অনিক আর রৌদ্র সেই বিকেলের দিকে তাদের এক বন্ধুর জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানে গিয়েছে। এইতো কিছুক্ষণ আগে ফোন করে জানালো, এই ভারি বৃষ্টিপাতে বের হওয়াও মুশকিল।রাফিয়া বেগম আর জুবাইদা বেগমও তাদের নিষেধ করে দিলেন এই বৃষ্টি মাথায় করে ফিরতে। তায়েফ সাহেব এখনো পুলিশ স্টেশনে। আর তাশরিক সাহেব গিয়েছেন বন্ধুদের সাথে ট্যুরে।
ড্রয়িং রুমে এসব ভেবে জুবাইদা বেগম যখন অস্থিরতায় হাসফাস করছিলেন তখনই তার সামনে এক কাপ আদা চা এগিয়ে দেয় রাফিয়া বেগম। জুবাইদা বেগম চোখের সামনে চা পেয়ে খানিকটা স্বস্তি পেলেন যেন!হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটি নিয়ে উজ্জ্বল চোখে তাকালেন রাফিয়া বেগমের দিকে।রাফিয়া বেগম তার তাকানো দেখে মুচকি হাসলেন। অতপর চোখ দিয়ে ইশারায় বোঝালেন পান করতে!
প্রায় মিনিট বিশেক দুই বান্ধবীর মাঝে এটা-সেটা নিয়ে আলাপ চললো। ঠিক তখনই এক বিকট শব্দ কানে এসে ঠেকলো দুজনার আর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির লোডশেডিং হলো। রাফিয়া বেগম বুঝলেন হয়তো পাশেই কোথাও ট্রান্সমিটার ব্রাস্ট হয়েছে। তিনি এবার কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন।একে-তো জুবাইদা বেগমের লাস্ট ট্রাইমেস্টার চলছে,যেকোনো সময় কিছু একটা ঘটতে পারে তারওপর এখন বাড়িতে একা তারা। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে এই মুহুর্তে বিদ্যুৎও চলে গেলো। রাফিয়া বেগম মনে মনে আল্লাহকে ডাকলেন। পাশ থেকে ফোনটি খুঁজে টর্চ অন করে জুবাইদা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ জবা, বোন আমার! তুই একটু বস এখানে আমি জেনারেটর টা চালু হচ্ছে না কেন দেখে আসছি।
জুবাইদা বেগম রাফিয়া বেগমের কথা শেষ হবার আগে তার হাতটি খপ করে ধরে ফেললেন। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন,
~ যাস না রাফু! আমার ভয় হচ্ছে!
রাফিয়া বেগমের বুকটা কেঁপে ওঠে তৎক্ষনাৎ। তিনি জুবাইদা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো করে বললেন,
~ বোন একটু থাক এখানে। আমি এই যাবো আর আসবো!
জুবাইদা বেগম অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। রাফিয়া বেগম তার সম্মতি পেয়ে অন্ধকারে সাবধানে এগিয়ে গেলেন জেনেরেটরের সুইচের কাছে। সেখানে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার সুইচ টিপেও কোন কুল করতে পারলেন না। বুঝলেন হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে। মনে মনে তিনি ইচ্ছেমতো ঝাড়লেন স্বামীকে। কয়েকদিন আগেও এরম সমস্যা হয়েছিল পরে তিনি জানিয়েছিল সবটা কিন্তু কাজের চাপে সাব্বির সাহেব হয়তো সবটাই ভুলেছেন। রাফিয়া বেগম ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন ধীর পায়ে। উদ্দেশ্য মোম নিয়ে আসার, অন্তত এই অন্ধকারটা নাহয় মোমের আলোয় কাটুক। ট্রান্সমিটার জ্বলে গিয়েছে না জানি কখন কারেন্ট আসে!
অন্যদিকে জুবাইদা বেগম ক্ষনে ক্ষনে শুকনো ঢোক গিলছে। আজ হঠাৎ তার এমন ভয় করছে কেন? কই তিনি তো এমন ভীতু না! ভয় দূর করতে এটা-সেটা নিয়ে ভাবতেও ভুললেন না তিনি।কিন্তু ভয়কে কোনরূপ দূর করতে না পেরে হাঁক ছাড়লেন জোরে,
~ রাফু কই তুই? এদিকে আয় না তারাতাড়ি।
রান্নাঘরে মোম খুজতে খুজতে জুবাইদা বেগমের কন্ঠ কর্ণগোচর হয় রাফিয়া বেগমের। তিনি ব্যস্ত গলায় বললো,
~ এই তো জবা হয়ে গেছে আসছি আমি!
বলতে বলতে তার হাতে আসে মোমের প্যাকেটটি। রাফিয়া বেগম হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।একটি মোম ধরিয়ে হাটা ধরেন ড্রয়িং রুমের উদ্দেশ্যে।
জুবাইদা বেগম যখন অস্থিরতায় কুপোকাত তখন তার কানে আসে ফোনের রিংটোন। তিনি মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন।ভাবলেন হয়তো কবির সাহেব ফোন করেছেন। তিনি আর সাত-পাঁচ না ভেবে উঠে দাঁড়ালেন। রাফিয়া বেগমের ফোনের টর্চের ক্ষীণ আলোয় এগিয়ে গেলেন রুমের দিকে। রুমে এসে বিছানার পাশ হাতরিয়ে ফোনটি খুজে পেলেন তিনি। ফোনটি হাতে নিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলেন। এতটুকু কাজেই যেন মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। ফোনটি সামনে ধরে স্ক্রিনের দিকে ভেসে ওঠা নাম্বারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে ধরলেন।
ওপাশ থেকে ভেসে আসে তার চিরচেনা পুরুষের গম্ভীর গলা,
~ জবা! তুমি ঠিক আছো? বাড়িতে কি কেও ফেরেনি এখনো?
জুবাইদা বেগম স্বামীর কন্ঠে স্পষ্ট চিন্তার রেশ পেলেন।তিনি মৃদু হেসে বললেন,
~ উহু! কেও ফেরেনি।বাড়িতে কেবল আমি আর রাফুই আছি।আর জানো! বাড়িতে কারেন্টও চলে গিয়েছে। কতবার করে বলেছিলাম জেনারেটরটা ঠিক করতে, কিন্তু তোমরা ভাইয়েরা শুনলেতো!
জুবাইদা বেগমের কথায় আরো বিচলিত হয়ে পড়লেন কবির সাহেব। কপালে দৃশ্যমান হয় দু-তিনটি চিন্তার ভাঁজ! জানালার কাচ গলিয়ে বাহিরে দৃষ্টিপাত করে বললেন,
~ জবা, তুমি সাবধানে থেকো। দয়া করে অন্ধকারে এদিক সেদিক হেঁটো না।
জুবাইদা বেগম স্বামীর কথায় মুচকি হাসলেন।বারন করা স্বত্বেও তিনি বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন।কেন জানি তার এই মুহুর্তে বৃষ্টির পানি ছুঁতে বড্ড ইচ্ছে করছে। তাই যে ভাবা সেই কাজ! এগিয়ে গেলেন বারান্দার দিকে।অথচ একবারও ভাবলেন না এর ভয়ংকর পরিনতি সম্পর্কে।
জুবাইদা বেগম হাসি হাসি কন্ঠে বলতে লাগলেন,
~ আরে তুমি শুধু শুধুই চিন্তা করছো। আমার কিছু আআআআ
এক বিকট চিৎকারে ধপ করে উপুর হয়ে পড়ে যান জুবাইদা বেগম। বারান্দা বাহির থেকে আসা পানির ছিটায় ভরপুর। সেখানে একপা এগোতেই পা পিছলে পড়ে যান তিনি।
স্ত্রীর এমন চিৎকারে দেহ থেকে আত্মা বের হয়ে যাবার উপক্রম কবির সাহেবের। একমিনিটের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। তৎক্ষনাৎ সৎবিৎ ফিরে পেয়ে দ্বিগুণ বিচলিত কন্ঠে বলতে লাগলো,
~ জবা! জবা! কি হয়েছে তোমার? এটা কিসের আওয়াজ ছিলো? হ্যালো, হ্যালো! কথা বলছো না কেন? হ্যালো…….
অন্যদিকে জুবাইদা বেগমের চিৎকারে হম্বিতম্বি করে অন্ধকারে ছুটে আসে রাফিয়া বেগম। দৌড়ে আসতে গিয়ে টেবিলের হ্যান্ডেলে পা লেগে গিয়ে উল্টে পড়েন তিনিও। তবুও নিজের ব্যাথাকে দূরছাই করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলে আসেন জুবাইদা বেগমের দিকে। জুবাইদা বেগমকে এভাবে পড়ে গিয়ে কাতরাতে দেখে কেঁপে ওঠেন তিনি। ব্যস্ত হাতে জুবাইদা বেগমকে সোজা করে তার গালে আলতো হাত রেখে বলতে লাগলেন,
~ জবা, জবা, ব্যাথা হচ্ছে খুব? বোন আমার খুব কষ্ট হচ্ছে?
জুবাইদা বেগমের ওতো শতো বোঝবার বা শুনবার অবস্থা আছে? তিনি তো ব্যাথায় কাতরাতে লাগলেন।
~ ওমাহহহ! মরে যাচ্ছি রাফু।উহহঃ বড্ড কষ্ট হচ্ছে পেটে। আল্লাহ!
রাফিয়া বেগম কি করবেন বুঝতে পারছেন না।তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে ফোনটি ফ্লোরে পড়ে থাকা অবস্থায় পেলেন।তৎক্ষনাৎ সেটি হাতে নিয়ে কল লাগালেন কবির সাহেবের নাম্বারে। কিন্তু একি! কল ঢুকছে না কেন? রাফিয়া বেগম একবার দুবার পরপর কয়েকবার চেষ্টা লাগালেন কিন্তু ফলাফল বরাবরই শূন্য! পরে তিনি ফোনটি খেয়াল করে দেখলেন নেটওয়ার্ক নেই। এ – পর্যায়ে তারও পাগলপ্রায় অবস্থা! কি করবেন এখন তিনি! রাফিয়া বেগম জুবাইদা বেগমের গালে হালকা চাপড় দিয়ে বললেন,
~ বোন একটু ধৈর্য ধর! একটু! আমি দেখছি তোকে।
বলেই তিনি ফোনের টর্চ ধরিয়ে জুবাইদা বেগমের দিকে তাক করলেন। সাথে সাথে আঁতকে ওঠেন তিনি।আঁতকে ওঠার দরুন ফোনটি হাত থেকে পড়ে যায়। জুবাইদা বেগমের রক্তে সারা ফ্লোর রঞ্জিত। রাফিয়া বেগম বুঝলেন, “এখন যে করেও হোক জবাকে হসপিটালে নিতেই হবে। নাহলে ওর কোন বড়সড় ক্ষতি হতে পারে। ”
রাফিয়া বেগম তৎক্ষনাৎ ছুটে গেলেন বাড়ির বাহিরে। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার তিনি। তবুও সেদিকে কোনরুপ ভ্রুক্ষেপ না করে রাস্তায় নেমে পড়লেন গাড়ি খোজার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বহু খোঁজেপ কোথাও একটি গাড়িও পাননা। রাফিয়া বেগম সেখানেই চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠেন। আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
~ আল্লাহ সহায় হও! আমার বোনটাকে বাঁচাও! আজ ওর কিছু হয়ে গেলে যে নিজেকে কোনদিন মাফ করতে পারবো না আমি।
বলেই দু’হাতে মুখ ঢেকে আবারও কাঁদতে লাগলেন। ঠিক তখনই তার পেছন থেকে হর্ন বাজানোর শব্দ আসে। তিনি সাথে সাথে পেছনে তাকায়।দ্রুত হাতে থামায় সিএনজিটিকে। কিন্তু আফসোস সিএনজিটি পুরোটাই ফুল। রাফিয়া বেগম সেদিকে চেয়ে আশাহত হলেন।নিজেকে সামলাতে না পেরে আবারও ফুপাতে লাগলেন।
অন্যদিকে সিএনজি চালকসহ সকল যাত্রীরা রাফিয়া বেগমের অবস্থা দেখে ভড়কে যায়। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে ওঠে,
~ আরে আরে, কি করছেন! এভাবে কাঁদছেন কেন?
রাফিয়া বেগম নিজের কান্না থামিয়ে হাতজোড় করে বলে ওঠে,
~ ভাই, আল্লাহর ওয়াস্তে আমার বোনটাকে বাঁচান।ও প্রেগনেন্ট।ওকে ইমারজেন্সি হসপিটালে নিতে হবে। নাহলে ওর অথবা ওর বাচ্চার খুব ক্ষতি হতে পারে।
লোকগুলো তার কথা শোনামাত্র তৎক্ষনাৎ গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।তারপর চিন্তিত হয়ে বলতে থাকে,
~ আপা আপনি তারাতাড়ি রোগীকে নিয়ে হসপিটাল যান।আমাদের ওতো তাড়া নেই।আমরা পড়ে অন্য সিএনজি দিয়ে চলে যাবো আমাদের গন্তব্যস্থলে।
বলেই লোকগুলো পাশ দিয়ে চলে যাবে ওমন সময় রাফিয়া বেগম তাদের থামায়।
~ ভাই আরেকটু উপকার করুন।আমার বোনটাকে একটু গাড়ি অবধি নিয়ে আসতে সাহায্য করুন।
লোকগুলো তার এক কথায় সায় দেয়।রাফিয়া বেগমের সাথে চলে আসে বাড়ির ভেতরে। অতঃপর ফ্লোরে পড়ে গোঙাতে থাকা জুবাইদা বেগমকে ধরাধরি করে নিয়ে যায় সিএনজির কাছে।রাফিয়া বেগমও তাদের সাথে সাথে চলে।
জুবাইদা বেগমকে সিএনজিতে বসিয়ে লোকগুলো তাড়া দেয় হসপিটালে নিয়ে যেতে।সিএনজি ড্রাইভারও সে মোতাবেক গাড়ি ছোটায়।কিন্তু কিছুদূর এগোতেই গাড়ি থামাতে হয় তার।
গাড়ি থামানো দেখে রাফিয়া বেগম বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে,
~ ভাই গাড়ি থামালেন যে!
~ আফা! সামনে জ্যাম। কেমনে কি করি এহন কনতো!
রাফিয়া বেগম তৎক্ষনাৎ গাড়ির বাইরে তাকালেন। সত্যি, চারিদিকে যানজট। রাফিয়া বেগম মনে মনে আল্লাহকে ডাকলেন। তারপর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সিএনজি থেকে। রাফিয়া বেগমের সারা শরীর ভিজে জবুথবু অবস্থা! তবুও তিনি সেদিকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে সামনে এগিয়ে গেলেন।
দুয়েকটা গাড়ির সামনে গিয়ে তিনি ট্রাফিক পুলিশকে অনুরোধ করতে থাকেন তাদের সিএনজিটিকে যাওয়ার রাস্তা করে দিতে। পুলিশ প্রথমে কিছু না বললেও রাফিয়া বেগমের মুখে সবটা শোনার পর তড়িঘড়ি করে রাস্তা ফাঁকা করে দেন।অতপর রাফিয়া বেগম পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে ফিরে আসে সিএনজির কাছে। সিএনজিটিও রাস্তা ফাঁকা পেয়ে আর একমুহূর্ত কালবিলম্ব না করে ছুটে চলে হসপিটালের দিকে।
প্রায় মিনিট দশেক পর সিএনজিটি একটি প্রাইভেট হসপিটালের সামনে থামে।রাফিয়া বেগম সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে আসে। ভেজা জবুথবু শরীরে খালি পায়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে দৌড় লাগায় হসপিটালের ভেতর। তারপর চিৎকার দিয়ে হাঁক ছাড়ে,
~ ডাক্তার! নার্স! সামবাডি প্লিজ হেল্প!
রাফিয়া বেগমের চিৎকারে দুজন ওয়ার্ড বয় ছুটে আসেন। তাদেরকে দেখে রাফিয়া বেগম সবটা খুলে বললেন। সবটা শুনে ওয়ার্ড বয় দুজনেই একটি স্ট্রেচার নিয়ে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে। অতপর অতি সাবধানতার সহিত জুবাইদা বেগমকে ধরাধরি করে বের করলেন। জুবাইদা বেগম অতিরিক্ত ব্যথায় সে কবেই জ্ঞান হারিয়েছে! তার কি আর দিন-দুনিয়ার খেয়াল আছে এ মুহুর্তে! রাফিয়া বেগম স্ট্রেচারের সাথে সাথে হাটতে লাগলেন আর আলতো হাতে জুবাইদা বেগমের গালে চাপড় দিচ্ছেন। কিন্তু নাহ! জুবাইদা বেগম একেবারেই সেন্সলেস।
প্রায় মিনিট দশেক হলো, জুবাইদা বেগমকে কেবিনে নিয়ে যাওয়ার।করিডরে বসে কেবিনের দরজার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাফিয়া বেগম। বাহিরে এখনো তুমুল বৃষ্টি! রাফিয়া বেগমের হাতপা ইতোমধ্যেই ঠান্ডা হয়ে আসছে। সেই কখন থেকে এই ভেজা শরীরে এসি নিয়ন্ত্রিত করিডরে বসে আছেন তিনি। রাফিয়া বেগমের ঠোঁট কাঁপছে। তিনি হাত বাড়িয়ে পড়ে থাকা আঁচলটি গায়ে পেচিয়ে নিলেন।উদ্দেশ্য হালকা শীত নিবারনের প্রচেষ্টা! কিন্তু এতে কি আর হয়! তার শরীর যে এই মুহুর্তে রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। রাফিয়া বেগমের হঠাৎ কিছু মনে পড়লো।তিনি আঁচলটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে দাড়িয়ে পড়লেন বসা ছেড়ে। যেই না রিসেপশনের দিকে এক-কদম বাড়াবে ওমনি পেছন থেকে একজনের রাশভারী কন্ঠ কানে আসে,
~ শুনুন!
রাফিয়া বেগম থমকায়।তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরেন তিনি।দেখতে পায় মুখে মাস্ক,গায়ে এপ্রন জড়ানো ডাক্তারকে। রাফিয়া বেগম খোঁড়ানো পায়ে ডাক্তারের দিকে এগিয়ে আসেন। বিচলিত হয়ে বলতে লাগলেন,
~ ডাক্তার জবা ঠিক আছে তো? ওর কোন ক্ষতি হয়নি তো!
এ প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার মৌন থাকেন।এতে যেন রাফিয়া বেগমের বুক মোচড়ে ওঠে। তিনি শুষ্ক ঢোক গিলেন।
~ ডাক্তার কিছু বলছেন না যে!
ডাক্তার এবার মুখের মাস্ক সরালেন। অভিপ্রায় গলায় বললেন,
~ আসলে রোগীর অনেক বেশি ব্লাড লস হয়েছে। আর পড়ে যাওয়ার দরুন বাচ্চার পজিশনও উল্টে গিয়েছে। এই মুহুর্তে রোগীকে বাঁচাতে হলে ইমারজেন্সি সিজার করাতে হবে। কিন্তু একটাই সমস্যা…
রাফিয়া বেগম কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন,
~ কি সমস্যা?
~ আসলে রোগীর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য ইমারজেন্সি তাকে রক্ত দেওয়া প্রয়োজন কিন্তু সমস্যা হচ্ছে গিয়ে রোগীর রক্তের গ্রুপ B+ আর এই মুহুর্তে আমাদের এই হসপিটালের ব্লাড ব্যাংকে B+ রক্ত নেই। তাই….
~ কোন সমস্যা না ডাক্তার। আপনি আমার থেকে নিন।আমার ব্লাড গ্রুপ O- আর আমি পুরোপুরি সুস্থ। প্লিজ যত রক্ত প্রয়োজন আমার থেকে নিন তবুও ওকে সুস্থ করে তুলুন।
ডাক্তার রাফিয়া বেগমের কথা শুনে কালবিলম্ব না করে তাকে নার্স দিয়ে পাঠিয়ে দেয় অন্য একটি রুমে ব্লাড দিতে। রাফিয়া বেগমও নার্সের পিছুপিছু আসে।
প্রায় দু’ঘন্টা পর🍁
কবির সাহেব আর সাব্বির সাহেব একপ্রকার ছুটে আসেন হসপিটালে।এইতো প্রায় ঘন্টা খানেক আগে রাফিয়া বেগম রিসিপশনের ফোন দ্বারা কল দিয়ে সবটা জানিয়েছে তাদের। কবির সাহেবের অফিস থেকে হসপিটালের দুরত্ব কেবল মাত্র ২০ মিনিটের হলেও যানজটের কারনে আজ ১ ঘন্টা লেগেছে। কবির সাহেব ও সাব্বির সাহেব ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে আসেন করিডরের বেঞ্চিতে বসে থাকা রাফিয়া বেগমের নিকট। সাব্বির সাহেব নিজ স্ত্রীর এমন ফ্যাকাশে মুখখানা দেখে অস্থির হয়ে ওঠেন।স্ত্রীর কাধে আলতো হাত রাখতেই খনিকের মাঝে তা ছিটকিয়ে সরিয়ে নেন তিনি।উপলব্ধি করেন স্ত্রীর গায়ের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা।
রাফিয়া বেগম কাঁধে কারো শীতল স্পর্শ পেয়ে মাথা উচু করেন।শুষ্ক ফ্যাকাশে চোখ-মুখ নিয়ে স্বামীর দিকে তাকান তিনি। মুহুর্তেই এতক্ষণের জমিয়ে রাখা দলা পাকানো কান্নাটুকু হুরহুর করে বের করে দেন তিনি। হু হু করে কেঁদে ওঠেন ধীর স্বরে।সাব্বির সাহেব প্রিয়তমা স্ত্রীর কান্না সহ্য করতে পারলেন না ঠিক। তিনি রাফিয়া বেগমের পাশে বসে তার কান্নারত মুখটি সযত্নে নিজের বুকের বা পাশে লুকিয়ে নেন।বাহুডোরে আগলে ধরেন স্ত্রীকে। রাফিয়া বেগমও বুঝি এতক্ষণে একটি ভরসার স্থান পেলো। কান্নারত অবস্থায় স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে ভেঙে ভেঙে বলতে লাগলেন সবটা।
রাফিয়া বেগমের মুখে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে উপস্থিত কবির সাহেব ও সাব্বির সাহেব দুজনেরই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে তৎক্ষনাৎ। কবির সাহেব আরও খানিকটা বিচলিত হলেন প্রানপ্রিয় স্ত্রীর জন্য। মনে মনে আল্লাহর কাছে আরজি জানাচ্ছেন প্রিয়তমা এবং অনাগত সন্তানের সুস্থতার জন্য।
ঠিক তখনি অপারেশন রুম থেকে ভেসে আসে বাচ্চার ক্রন্দন ধ্বনি। সঙ্গে সঙ্গে বাহিরে উপস্থিত তিনজনেই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে। কবির সাহেব ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যান অপারেশন কেবিনের বন্ধ দরজার সামনে। মনটা কেমন আকুপাকু করছে স্ত্রী -সন্তানের খোঁজ জানার জন্য।
বেশকিছুক্ষন পরে একজন নার্স নবজাতককে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। কবির সাহেবকে ওমন দরজার সামনে দাড়ানো দেখে কিছুটা ভড়কে যান তিনি। কবির সাহেবের ব্যাপারটা বোধগম্য হলো। তিনি আমতা আমতা করে কিছুটা সরে এসে আকুল গলায় বললেন,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৩
~ আমার বউ কেমন আছে?
নার্স কিছুটা মুচকি হাসলো। মুখে হাসির রেশ ধরে বললো,
~ আলহামদুলিল্লাহ মেয়ে এবং মেয়ের মা দুজনেই সুস্থ। এই নিন আপনার বাচ্চাকে।
বলেই তিনি নবজাতককে এগিয়ে দিলেন কবির সাহেবের দিকে।কবির সাহেব একপলক তোয়ালে জড়ানো ছোট্ট দেহখানার নবজাতকটির দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে কোলে তুলে নিলেন। অতপর ছোট্ট নবজাতকের মুখের আদলের দিকে তাকিয়ে রইলেন অপলক। প্রায় কিছুক্ষণ পর হালকা নাক টানার শব্দ আসে কবির সাহেবের দিক থেকে।আচ্ছা কবির সাহেব কি কাঁদছেন? হয়তো পুরুষ মানুষ বলে আড়ালে রেখেছেন বারিকনা গুলো। কবির সাহেব এবার বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলেন,
~ আমার মা!!