সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৭
Jannatul Firdaus Mithila
চারিদিকে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দূর আকাশের চাঁদটিও যেনো একটু পর পর মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে। এত এত নিস্তব্ধতার মাঝেও একটি মানুষের বুকের ভেতর উথাল পাথাল ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। রৌদ্রর পরোক্ষভাবে ফেসবুকে কারোর জন্য এমন অনুরক্তি প্রকাশ যে কিছুতেই অরিন মানতে পারছে না,ক্ষনে ক্ষনেই তার মনে হচ্ছে এই বুঝি তার নিশ্বাস টা আটকে আসছে।খালি মনে হচ্ছে,
“কেনো করলো এমন রোদ ভাই? তিনি সত্যিই অন্য কাউকে ভালোবাসেন? এমনটা হলে সে কি করে বাঁচবে? রোদ ভাই যে তার জীবনের প্রথম আবেগ,তাকে কি করে এতো সহজে ভুলবে সে।”
আবার পরক্ষণেই অরিন ভাবছে,
“রোদ ভাই তো আমায় কখনো বলেই নি যে সে আমায় ভালোবাসে।তাহলে আমি কেনো শুধু শুধু তার কেয়ারগুলো দেখে সেগুলো কে ভালোবাসা ভাবতে গেলাম? না এখানে তো রোদ ভাইয়ের কোন দোষ নেই। দোষ তো আমারই।” ভবতে ভাবতেই অরিন বিছানা ছেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নায় নিজেকে দেখে বলতে থাকে অরিন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— নাহ অরিন।এভাবে ভেঙে পড়ার কোন মানে নেই।রোদ ভাই কখনোই তোকে কাজিনের চেয়ে বেশি কিছু ভাবেনি।প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব পছন্দ থাকতে পারে, জোর করে আর যাইহোক কখনো ভালোবাসা সম্ভব না। এখন থেকে নিজেকে শক্ত কর অরিন।স্বাভাবিক হ।
বলেই ওয়াশরুম চলে যায় সে।বেশ কিছুক্ষন শাওয়ার নিয়ে তারপর বের হয় অরিন,অনেকক্ষণ মাথায় পানি দেওয়ার দরুন মাথা ভার হয়ে আছে তার।তাই তড়িঘড়ি করে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে।অল্প সময়ের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় অরিন।
সকালের মিষ্টি রোদ্দুর জানালার পর্দা ভেদ করে রুমে এসে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। পাখিরা বারান্দার পাশের শিউলী ফুলের ডালগুলোতে বসে মনের সুখে গান গেয়ে যাচ্ছে। এদিকে এদের এমন কর্মকাণ্ডে ঘুম হালকা হয়ে আসে রৌদ্রর।কিছুক্ষন বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে বসে সে। আজ দিনটি শুক্রবার। দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় সকাল ৯ টা বাজে,এত সকাল হওয়া সত্ত্বেও যেনো ঘুম ছুটছে না তার,অতঃপর আড়মোড়া ভেঙে চলে আসে বারান্দায়। বারান্দায় দাঁড়াতেই আগে চোখ যায় পাশের বারান্দা টিতে যেখানে আপাতত খালি স্ট্যান্ড দোলনা টি দাড়িয়ে। বারান্দার বাহিরে তাকিয়ে কিছুক্ষণ হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে রৌদ্র, এক্সারসাইজ শেষে রুমে এসে কিছুক্ষণ পুশআপ দেয় সে।তারপর চলে যায় ওয়াশরুমে।একদম ফ্রেশ হয়ে তারপর নিচে নামে সে।ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হতেই দেখতে পায় বাড়ির বড়রা সোফায় বসে টিভি দেখছেন, হয়তো নাস্তা শেষ করে বসে আছেন কেননা এতো বেলা অবধি কি আর কেউ না খেয়ে থাকবে? রৌদ্র কিছুক্ষন তাদের দিকে তাকিয়ে তারপর চলে যায় ডাইনিং রুমে। ছেলেকে টেবিলে বসতে দেখে জুবাইদা বেগম এবং রাইসা বেগম তড়িঘড়ি করে ছুটে আসেন সার্ভ করতে। রৌদ্র প্লেটে খাবার নিয়ে মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে,
— তোমরা সকলে খেয়েছো?
— হ্যা বাবা আমরা খেয়েছি শুধু তোরা তিনজনই বাকি আছিস।
— তিনজন বলতে?ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে রৌদ্র।
— তুই,অনিক আর অরিন।অনিকতো শুক্রবারে একটু দেরি করে উঠে সারাটা সপ্তাহ বেচারা অফিসের চক্করে ভালোমতো ঘুমুতে পারে কই বল।আর অরিনের যে কি হলো? ও তো কখনো এতটা দেরি করে না।
মায়ের কথা শুনেই রৌদ্রর হাত থেমে যায়। ভাবতে থাকে,
“কি হলো মেয়েটার, এখনো খেতে আসলো না কেনো? ”
রৌদ্রর ভাবনার মাঝেই রাফিয়া বেগম হাজির।এসেই মেয়ের নামে একবস্তা অভিযোগ খুলে বসেন।বলতে থাকেন,
— ওর কথা বলে আর কি হবে জবা,মেয়েটা দিন দিন যা বাদর হচ্ছে না! এই দেখ না আর কদিন পর এডমিশন টেস্ট আর এই মেয়ে বেলা ১০ টা অবধি নাক ডেকে ঘুমায়।উহঃ এই মেয়েকে নিয়ে না আমি জাস্ট পারিনা।তুই রৌদ্র কে দেখ আমি গিয়ে ডেকে উঠাই নবাব নন্দীনীকে।
বলেই রাফিয়া বেগম রাগে গজগজ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাবে এমন সময় সিড়ি দিয়ে নেমে আসেন সাব্বির সাহেব। স্ত্রীর মুখাবয়ব দেখে বেশ বুঝতে পারছেন তিনি স্ত্রী যে এখন ক্ষুব্ধ বাঘিনী হয়ে আছেন, তাই তিনি বেশি না ঘেটে শুধু জিজ্ঞেস করলেন,
— কি হয়েছে রাফু,সকাল সকাল এত রেগে আছো যে?
স্বামীর মুখে এমন কথা শোনামাত্রই যেনো আগুনে ঘি পড়ার মতো কাজ হলো,রাফিয়া বেগম স্বামীকে মুখ ঝামটি দিয়ে বলে উঠেন,
— হ্যা হ্যা, আপনি তো হচ্ছেন নবাব সাহেব। বেলা ১০ টাও তো আপনার কাছে সকালই মনে হবে। আপনি যেমন নবাব আপনার মেয়েও হয়েছে আপনার মতোই নবাব নন্দিনী,বেলা ১০ টা অবধি পড়ে পড়ে ঘুমানোই যেনো তার কাজ।বলি মেয়েকে কি একটু শাসন করলে তোমার খুব ক্ষতি হবে হ্যা? আর কটাদিন পর যে পরিক্ষা সে খবর কি আর তার আছে? যত জ্বালা সব আমার।
বউয়ের মুখের এমন ঝামটি মারা কথায় বেচারা সাব্বির সাহেবের হাসি হাসি মুখটা যেনো চুপসে এট্টুখানি হয়ে এসেছে। এদিকে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত তার ছোট দু’ভাই মুখ টিপে টিপে হাসছে, কবির সাহেব তো টিভির দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসেই যাচ্ছেন। এ বাড়ির সকলেই জানেন বাড়ির বড় দুই বউ একবার রেগে গেলে তাদের ঘাটতে নেই, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কিন্তু এই ভুলটাই যেনো সাব্বির সাহেব করে বসলেন। সাব্বির সাহেব বউয়ের রাগান্বিত মুখটি দেখে কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলে উঠেন,
— বলছি কি রাফু,এতো রাগ করতে নেই।রাগ করলে তোমার স্কিন তো অল্প বয়সেই কুচকে আসবে। প্রেসার বাড়তি হয়ে আসবে তাই বলি কি একটু শান্ত হও।
স্বামীর মুখে এমন আহ্লাদী কথায় লাভের লাভ তো কিছু হলোই না উল্টো রাফিয়া বেগম স্বামীর দিকে কটমট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে উপরে উঠে গেলেন।এদিকে স্ত্রীর প্রস্থানে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি।নিচে নেমে এসে বড় ভাইয়ের পাশে বসে বসে পড়েন।এদিকে এখনও তার ভাইয়েরা মুখ টিপে হেসেই যাচ্ছেন। সাব্বির সাহেব কিছুক্ষণ তাদের দিকে ভ্রু কুচকে থেকে বলে উঠেন,
— এমন ভাব করছো যে তোমরা বুঝি কোনদিন বউয়ের মুখ ঝামটি খাও নি, হুহ।
এমন কথা শোনামাত্র ওমনি সকলের হাসি গায়েব।সকলেই যেনো কিছুটা থতমত খেলেন কেননা এমন কেউই তো বাদ নেই যে কিনা বউয়ের মুখ ঝামটি না খায় হোকনা সে কোন বড় ব্যাবসায়ি কিংবা কোন বড় পুলিশ কর্মকর্তা অথবা কোন প্রফেসর।
রাফিয়া বেগম বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পরও যখন অরিন গেট খুললেন না তখন তিনি কিছুটা চিন্তিত হলেন।তারাতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে অরিনের রুমের ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে এসে লক খুলে রুমে প্রবেশ করেন ।রুমে এসেই কিছুটা অবাক হলেন,অরিন নাক মুখ পর্যন্ত ঢেকে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে তাও আবার এত গরমে।এসিও তো অফ করে রাখা।তিনি আর দেরি না করে মেয়ের মুখের ওপর থেকে কম্বল সরিয়ে কপালে হাত রাখলেন, কপালে হাত রাখতেই হাত ছিটকিয়ে সরিয়ে নিলেন তিনি।অরিনের কপাল যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মেয়ের এমন হঠাৎ জ্বরে দিশেহারা হয়ে পড়লেন তিনি।বেশকিছুক্ষন মেয়ের মুখে হালকা চাপড় দিয়ে ডাকলেন রাফিয়া বেগম কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলোনা। তিনি বুঝলেন অতিরিক্ত জ্বরে মেয়েটা সেন্সলেস হয়ে আছে। ছোটবেলা থেকেই যে মেয়েটা একটু জ্বরেই কাবু হয়ে যায়। রাফিয়া বেগম আর কোন উপায়ন্তর না পেয়ে দৌড়ে নিচে নেমে আসেন। রৌদ্র এখনও টেবিলে বসে নাস্তা করছিলো, রাফিয়া বেগম ছুটে এসে রৌদ্র কে বললেন,
— বাবা অরিনটার হঠাৎ কাপিয়ে জ্বর উঠেছে রে।একটু আয় না দেখবি ওকে।তুই তো জানিস ওর আবার জ্বর সয় না।
— সে কি রে,হঠাৎ জ্বর আসলো কেনো? রাফিয়া বেগমের কথা শোনামাত্রই বলে উঠেন জুবাইদা বেগম।
— জানিনা তো জবা। হঠাৎ কি এমন হলো।
অত্যন্ত চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠেন রাফিয়া বেগম।
এদিকে অরিনের জ্বর হয়েছে শোনামাত্রই খাবার রেখে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এক দৌড়ে অরিনের রুমে ছুটে আসে রৌদ্র। রৌদ্রর ছুটে যাওয়া দেখে বাড়ির কর্তারাও অবাক হয়ে যায়, রাফিয়া বেগম কে দেখতেই তারা কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন অরিনের হঠাৎ কাপিয়ে জ্বর উঠেছে। এবার যেনো সকলেই চিন্তিত হয়ে ছুটলেন অরিনের রুমে।
রৌদ্র অরিনের কাছে এসেই ওর কপালে হাত রাখে,সাথে সাথেই হাত সরিয়ে নেয়।অরিনের শরীর যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। রৌদ্র ভেবে পাচ্ছে না কাল রাতও তো মেয়ে টা কে সুস্থ সবল দেখে গেলো,তাহলে সকাল হতে না হতেই এতটা জ্বর কিভাবে আসলো।রৌদ্র তড়িঘড়ি করে ঔষধ আনতে ফার্মেসীতে চলে যায় আর যাওয়ার আগে তার মেজো মা কে বলে যায়,
— মেজো মা তুমি অরির গা টা স্পঞ্জ করে দাও। আমি ঔষধ নিয়ে আসছি কেমন।
— আচ্ছা বাবা। বলেই রাফিয়া বেগম চলে গেলেন ওয়াশরুমে। সাব্বির সাহেব সহ বাড়ির সকলেই এতক্ষণ এখানে থাকলেও অরিনকে স্পন্জ করানো হবে বলে বাহিরে চলে যান,এরইমধ্যে অনিক হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢোকে,রুমে এসেই অরিনকে একহাতে কিছুটা উঁচিয়ে তুলে কপালে হাত রাখে। রাফিয়া বেগম কে দেখতেই প্রশ্ন করে,
— ওর হঠাৎ এতটা জ্বর কি করে এলো মা?
— কি করে বলবো অনিক।কাল রাতেও তো সুস্থ ছিলো মেয়ে আমার। হঠাৎ করেই কেনো,
আর বলতে পারলেন না তিনি, আচল দিয়ে চোখ মুছছেন তিনি, ইতোমধ্যেই চোখ ভিজে উঠেছে তার।অনিক মাকে আশ্বস্ত করে বলে উঠে,
— অরি সুস্থ হয়ে যাবে মা। তুমি চিন্তা করো না। তুমি ওকে স্পন্জ করিয়ে দাও।আর কি কি ঔষধ আনতে হবে বলো আমি নিয়ে আসছি।
— রোদ তো অনেক আগেই চলে গেছে ঔষধ আনতে। তুই এখন বাহিরে যা।
— ওহ আচ্ছা।
বলেই বোনকে রেখে বাহিরে চলে যায় অনিক।রাফিয়া বেগমও নিজের কাজ করতে লাগলেন।
প্রায় আধঘন্টা পর রৌদ্র ঔষধ আর কিছু ফলমূল নিয়ে বাড়িতে আসে।ফলগুলো ছোট মার হাতে দিয়ে ঔষধগুলো নিয়ে সে অরিনের রুমে চলে আসে।রাফিয়া বেগম মেয়ের মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছেন। অরিনের জ্ঞান ফিরেছে এইতো কিছুক্ষণ হলো মাত্র,কিন্তু জ্বরের তোপে চোখ খোলা যেন দায় হয়ে পড়েছে। তাই চুপটি করে মায়ের কোলে শুয়ে আছে অরিন।এদিকে রৌদ্র অরিনের বিছানার কাছে এসে তার মেজো মা কে বলে উঠে,
— মেজো মা,অরির জন্য খাবার নিয়ে এসো।ওকে ঔষধ খাওয়াতে হবে।
— ওহ হ্যা হ্যা বাবা, এক্ষুনি যাচ্ছি। বলেই অরিনের মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে বালিশে রাখলেন তিনি।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালো আলতো করে একটা চুমু খেয়ে রুম ছাড়লেন রাফিয়া বেগম।
অন্যদিকে অরিন চোখ খুলতে না পারলেও ঠিকই রৌদ্রর গলা শুনতে পেয়েছে তাইতো কেমন শক্ত হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। রৌদ্র কিছুক্ষণ অরিনের দিকে চেয়ে থেকে তার মাথার পাশে গিয়ে বসে।অরিনের মাথায় জলপট্টি দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।অরিন সবটা অনুভব করেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। রৌদ্র এবার মুখ খুলে,
— অরিন, এই অরিন।চোখটা একটু খোল না জানবাচ্চা।
এই যে এই ডাকটা,কি ছিলেো এই ডাকটায়? এতটা কাতর গলায় কেনো ডাকছে তাকে তার রোদ ভাই? সে কি জানে তার এই ডাকটায় অরিনের ভেতরের অবচেতন মন কেমন উথাল-পাতাল করে উঠে? নাহ তো সে কি করে জানবে? যার মনে অন্য নারীর বসবাস, সে কি করে বুঝবে অরিনের ভালোবাসার আভাস? অরিন এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার চোখ থেকে গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়লো।অরিনের চোখের পানি দেখে রৌদ্রর যেনো দম আটকে আসার উপক্রম। অত্যন্ত ব্যস্ত কন্ঠে সে বলে উঠে,
— এই অরিন কি হয়েছে তোর? তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল আমায়? এই জানবাচ্চা একটাবার বল আমায়। প্লিজ তুই কাদিস না। এই চোখ মেল না অরি।
অরিনের বেশ ইচ্ছে করলো চিৎকার দিয়ে বলতে,
—“হ্যা হ্যা রোদ ভাই কষ্ট হচ্ছে, ভিষণ কষ্ট হচ্ছে, এই যে, এই বুকের বা পাশটায় ভিষন কষ্ট হচ্ছে ”
কিন্তু বলতে পারলো না অরিন।তার কেমন যেনো গলা ধরে আসছে। বহু কষ্টে অরিন আস্তে আস্তে চোখ দুটো মেলে, দেখতে পায় তার মাথার পাশেই রৌদ্রর চিন্তিত মুখখানা। অরিনকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে রৌদ্র কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠে,
— কি করেছিস কাল রাতে? তুই কি রাতে গোসল করেছিলি? সত্যি করে বলতো অরি?
অরিন কিছু না বলে স্রেফ তাকিয়ে রইলো। এরইমধ্যে রাফিয়া বেগম আর মাইমুনা বেগম খাবার আর ফলমূল নিয়ে রুমে চলে আসেন।তাদের আসতে দেখে রৌদ্র চুপ করে যায়।রাফিয়া বেগম মেয়েকে চোখ মেলতে দেখে খাবার টেবিলে রেখে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে উঠিয়ে বসান।অত্যন্ত নরম স্বরে বলেন,
— অরি মা আমার।ওঠ মা, খাবারটা লক্ষ্মী মেয়ের মতো ফিনিস করে ফেলতো মা।
খাবার দেখেই নাকমুখ কুচকে ফেলে অরিন,অনিহা নিয়ে বলে উঠে,
— আম্মু আমার কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না কেমন বমিবমি ভাব হচ্ছে। আবার মাথাটাও দাড় করিয়ে রাখতে পারছি না।প্লিজ আমাকে এসব দিয়ো না।
— না মা। এটা বললে তো হবে না। খাবার তো খেতেই হবে।
— না না খাবো না।
অরিনের খাবার না খেতে চাওয়ায় মুহূর্তেই মেজাজ চটে যায় রৌদ্রর, দাত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠে,
— এই কি খাবি না হ্যা? তোকে জিজ্ঞেস করছে তুই খাবি কি না? তোকে বলা হয়েছে খেতে ব্যস খাবি।আর একবার না করে দেখ, ঠাটিয়ে একটা চড় মেরে গাল লাল করে দেবো।
রৌদ্রর এমন শাসনে মনে মনে খুশিই হলেন রাফিয়া বেগম। যাক কেউ তো অন্তত এই বাদরকে একটু শাসন করবে এই ভেবে। এদিকে রৌদ্রর এমন ধমকে ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকিয়ে আছে অরিন। ভাবছে,
“কিছুক্ষণ আগেও কি সুন্দর করে কথা বলছিলো আর এখন কেমন ধমক দিচ্ছে। লোকটা তো পুরাই গিরগিটি, ক্ষনে ক্ষনে রং বদলায় ”
রৌদ্র এবার তার সেজো মা কে বলে উঠে,
— সেজো মা, ওকে খাইয়ে দাও। আমি দেখছি ও কি করে না খায়।বলেই অরিনের মুখোমুখি দাঁড়ায় সে।মাইমুনা বেগম ও রৌদ্রর কথামতো অরিনের মুখের সামনে খাবার তুলে ধরে কিন্তু অরিন মুখ খুলে না।ব্যস এইটুকু দৃশ্যই যেনো যথেষ্ট ছিলো রৌদ্রকে ভয়ংকর ভাবে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য। রাগে নিমিষেই উজ্জ্বল ফর্সা মুখটা লাল হয়ে ওঠে। চোয়াল শক্ত করে সে একটানে খাবার প্লেট টা নিজের হাতে তুলে নেয়।নিজেই অরিনের চোয়ালে চেপে ধরে মুখ খুলে খাইয়ে দিতে থাকে।এদিকে অরিন প্রথমে কিছুটা থতমত খেয়ে যায় হঠাৎ আক্রমণে।যখনই মুখটা সরাতে যাবে ওমনি দেখতে পায় রৌদ্র তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে, বিড়াল চোখ দুটি যেনো লাল হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যেই।অরিন হালকা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে সবটা খাবার শেষ করে।অরিনকে খাইয়ে দিয়ে রৌদ্র নিজেই ঔষধ গুলো খাইয়ে দেয়।এদিকে ওদের এমন কান্ড দেখে উপস্থিত দুই জা মিটমিটিয়ে হাসছে।রৌদ্র নিজের কাজ শেষ করে অরিনকে রেস্ট নিতে বলে নিজের রুমে চলে যায়।অরিনও আর কিছু না বলে চুপচাপ রেস্ট নিতে থাকে।রাফিয়া বেগম রৌদ্রর চলে যাওয়ার পরই বলতে লাগলো,
— যাক এবার অন্তত কেও তো তোকে সোজা করতে পারবে ভেবেই শান্তি লাগছে।
মায়ের এমন কথা শুনে মনে মনে অরিন বলতে থাকে,
“সোজা না ছাই,আমার কষ্ট বাড়াতে জনাবের জন্য পায়তারা ”
কিন্তু মুখে কিছুই বললো না সে।রাফিয়া বেগম আর মাইমুনা বেগম নিচে গিয়ে সকলকে বলেন যে অরিনকে ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে এখন রেস্ট নিচ্ছে। সাব্বির সাহেব ও আর ডিস্টার্ব করেনি ভাবছে,
“রেস্ট নিচ্ছে নাহয় নিক পরে দেখা করবে”
সন্ধ্যার দিকে, অরিনের রুমে এখন বলতে গেলে ছোট খাটো একটা মিটিং বসে গেছে।মিটিংয়ে উপস্থিত বাড়ির সকল ছোট সদস্যরা, অনিকও আছে বৈকি শুধু রৌদ্র বাদে।সে বিকেলে কিছু পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চলে গেছে।এদিকে অরিনের রুমের মিটিংয়ের মেইন টপিক হচ্ছে,
” অরিন গতকাল রাতে কি এমন করেছে যে আজ তার এত জ্বর এলো?”
অরিন তখন থেকে বলেই যাচ্ছে,
— আরে বিশ্বাস করো তোমরা,আমি কিচ্ছুটি করিনি।এমনেই জ্বর আসতে পারে না?
— ইম্পসিবল। তোর কথা একদম বিশ্বাস করার মতো না। সত্যি করে বল অরি কি হয়েছিলো তোর।
রুহি বেশ দাপট খাটিয়ে বলে উঠে।
— আসলে সত্যি,
— বনু দেখ আমি জানি তুই মিথ্যা বলছিস।সত্যি টা বল আমি কিচ্ছু বলবো না।এমনিতেই আম্মু তোর ওপর ভিষণ চটে আছে। তুই একটু সুস্থ হলেই শুরু করবেন গাওয়া।এর চেয়ে বরং তুই সত্যি টা স্বীকার করলে আমি আম্মু কে মেনেজ করতে পারি।বিজ্ঞের মতো করে বলতে থাকে অনিক।
— আসলে ভাইয়া,হয়েছে কি,আমার না কাল রাতে এএকটু গরম লেগেছিল তাই।আমতা আমতা করে বলতে থাকে অরিন।
— তাই বলে তুই রাতে গোসল করেছিলিস? রুহি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
— হুম। মাথা নিচু করে ছোট্ট করে উত্তর দেয় অরিন।
— বলেছিলাম না অরি আপু নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কান্ড ঘটিয়েছে বলেই এমনটা হয়েছে। দেখলে এবার মিললে তো আমাদের কথা।
একসাথে বলে উঠে আহি ও মাহি।
— মাই গড। তুই জানিস বনু তুই একটু বেশি পানিতে ভিজলেই জ্বর আসবে তারপর ও এমনটা করতে গেলি কেনো হ্যা? জানিসই তো কদিন পরেই এডমিশন টেস্ট। এসব অসুস্থতার জন্য তো তোর নিজেরই স্বপ্ন বৃথা যাবে।কপট রাগ দেখিয়ে বলতে থাকে অনিক।
— সরি ভাইয়া আর করবো না। মাথা নিচু রেখেই জবাব দেয় অরিন।
— ওকে মনে যাতে থাকে।
বলেই সকলে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে নিজেদের ঘরে চলে যায়। রাতে রৌদ্র ১০ টার দিকে বাড়িতে ফিরে। তার মা তাকে খাবারের কথা বলতেই সে বলে,
— সরি মা,আজ বন্ধুরা না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়ছিলো না তাই তাদের সাথেই খেয়ে আসছি।
জুবাইদা বেগম ছেলেকে আর কিছু বললেন না।রৌদ্র সিড়ি বেয়ে উপরে চলে যেতেই কি মনে করে আবারও মায়ের দিকে ফিরে তাকায়,অতপর কিছুটা ধীমে আওয়াজে জিজ্ঞেস করে,
— মা অরিনের কি অবস্থা এখন? জ্বর কি ছেড়েছে?
— হ্যা বাপ কিছুটা কমেছে বাট মেয়েটার বুঝি মুখে অরুচি হয়েছে। এই দেখ না রাফু রাতে প্রায় ১ ঘন্টা খাবার প্লেট নিয়ে বসেছিলো ওর কাছে কিন্তু কিছুতেই মেয়েটা খেলো না।এমনকি আমি,সেজো,ছোটো ও অনেক চেষ্টা করেছি খাওয়ানোর কিন্তু পারলাম না তো।
কিছুটা হতাশ হয়ে বললেন জুবাইদা বেগম।
— ওহ,আচ্ছা একটা প্লেটে ওর খাবার বেড়ে দাও। কি করে না খায় আমিও দেখবো।দুদিন পর এক্সাম, আর ওনা খেয়ে আরও অসুস্থ হচ্ছে। বেয়াদব একটা।
ছেলের কথা শুনে জুবাইদা বেগম তারাতাড়ি একটা প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন।রৌদ্র প্লেট নিয়ে সোজা অরিনের রুমে যায়।রৌদ্র অরিনের রুমে ঢুকেই মেজাজ টা আর শান্ত রাখতে পারে না।অরিন শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে অথচ খাবার খেলো না।রৌদ্র খাবারের প্লেটটা সজোরে টেবিলের ওপর রাখে, প্লেটের আওয়াজে হকচকিয়ে যায় অরিন,ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে রইলো সে।রৌদ্র অরিনের তাকানো দেখে চোয়াল শক্ত করে বলে উঠে,
— তুই রাতে খাসনি কেনো অরি? না খেয়ে কি করতে চাস তুই? তুই কি পরিক্ষা দিতে চাস না? যদি না চাস তাহলে বল এক্ষুনি মেজো মা, মেজো বাবা কে বলি তোর বিয়ে দেখতে।এমন অকর্মণ্য মেয়ে ঘরে পেলে পুষে কি লাভ বল?
— এ মা, ছিঃ ছিঃ কি বলছেন এসব রোদ ভাই, কে বললো আমি পড়তে চাই না।আমি সত্যিই পড়তে চাই।আসলে খেতে ইচ্ছে করছিলো না তাই,
মাথা নিচু করে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে উঠে অরিন।
অরিনের এমন কথা শুনে বহু কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে রৌদ্র, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে,অতপর নিজেই হাত ধুয়ে খাবার মেখে অরিনের মুখের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে,
— দেখি আর বাচ্চাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে হবে না,হা কর।
— আমি, আসলে,,ইচ্ছে..
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৬
— আর একটা কথা বললে আই সয়্যার অরি,থাপড়িয়ে তোর গাল ফাটিয়ে দিবো।আই রিপিট একদম ফাটিয়ে ফেলবো।কটমট করে বলে উঠে রোদ।
রৌদ্রর এমন হুমকিতে হালকা ঢোক গিলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেতে থাকে অরিন। খাবারের একটা পর্যায়ে মনে মনে বলতে থাকে,
— ইশশ সারাটাজিবন যদি আপনি এভাবেই আমাকে খাইয়ে দিতেন, আপনার হাতে খেতে পারার জন্য হলেও আমি বারবার এমন অসুস্থ হতে চাই।