সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৯
Jannatul Firdaus Mithila
সন্ধ্যায় বাড়ির সকলে একসঙ্গে গোল হয়ে বসে আছে ড্রয়িং রুমে যেনো বিশেষ কোন বিষয়ে কিছু একটা আলাপ হচ্ছে। কারো কারো মাঝে চলছে টানটান উত্তেজনা। অবশ্য বাড়ির ছোটোরা কেউই এই মুহূর্তে এখানে নেই।অরিনের ফুপিরা আজকে এহসান বাড়িতেই থাকবেন।মূলত তারা রয়েছেন রৌদ্রর সাথে দেখা করবার জন্যে,কেননা ছেলেটাকে আসার পর তো একবারও দেখতে পারলেন না তারা।তাছাড়া আরও একটি বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত বাড়ির পুরুষদের এবং গৃহিনীদের সাথে রাফিদ সাহেবের।কথাবার্তার এক পর্যায়ে রাফিদ সাহেব বলেন,
— বড় ভাইজান, আপনি দেখে নিয়েন আমাদের সোহা মামুনিই এ বাড়ির বউ হিসেবে একদম পারফেক্ট হবে। আর তাছাড়া আপনি ও তো ওকে ছোট থেকেই চেনেন তাই না?
স্বামীর মুখে এমন কথা শোনামাত্রই চোখ মুখ কুচকে ফেলে অন্যদিকে তাকান মেহরিন বেগম। তিনি আর যাইহোক ওমন উড়নচণ্ডী, আধুনিকমনা মেয়ে কিছুতেই তার রোদের বউ হিসেবে আনতে চাননা।নেহাৎ স্বামীর মুখের ওপর কিছু বলতে পারছেন না তিনি,এদিকে রাফিদ সাহেবের মুখে সোহার নাম শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে আসছে বাড়ির মহিলাদের। সোহা রাফিদ সাহেবের বড় ভাইয়ের মেয়ে। আত্মীয় হওয়ার সুবাদে বেশ কয়েকবার এ বাড়িতে আসা হয়েছে তাদের, কিন্তু যতবারই ঐ সোহা মেয়ে টা এ বাড়িতে এসেছে ঠিক ততোবারই সে অনিকের পেছনে মৌমাছির মতো ঘুরঘুর করেছে।অনিকও এই মেয়ের এমন ব্যাবহারে প্রচুর বিরক্ত হতো,কিন্তু সোহাও যেনো নাছোড়বান্দা। অবশেষে অনিক একবার বেশ অতিষ্ঠ হয়ে সোহাকে সামনাসামনি বলেছিলো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— দেখো সোহা, ছেলেরা আর যাইহোক কোন গায়ে পড়া মেয়ে পছন্দ করে না।তোমাদের মতো মেয়েদের সাথে হয়তো ছেলেরা মিশবে, প্রেম করবে বাট বিশ্বাস করো তোমাদের মতো মানুষদের ওয়াইফ করতে ১০বার ভাববে ছেলেরা।আর রইলো বাকি আমার কথা,শোনো সোহা আমি তোমার প্রতি বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্টেড নই।প্লিজ আর আমার পিছু ঘুরবে না।
সেদিন সোহা বেশ অপমানিত বোধ করেছিলো অনিকের কথায়,একপ্রকার কাঁদতে কাদতে চলে গিয়েছিলো এ বাড়ি থেকে, আর আসেনি।সোহার এমন চলে যাওয়া নিয়ে অনিকের বড় মা জিজ্ঞেস করলে অনিক অবশ্য সবাই কে সোহার নাছোড়বান্দা আচরণের কথা জানিয়ে দিয়েছিলো।এ বিষয়ে মেহরিন বেগম জানলেও আর কাউকে জানাননি তিনি,পাছে না আবার সংসারে অশান্তি হয় ভেবে।কিন্তু আজকে সকলেই যেমন বিরক্ত তেমনি অবাক,কাল পর্যন্ত যে মেয়ে অনিকের পিছনে লেগে ছিলো তার জন্যই আজকে রৌদ্রর কথা বলছে রাফিদ সাহেব।
জুবাইদা বেগম আর রাফিয়া বেগম তো একে অপরের দিকে চোখাচোখি করছে।মাইমুনা বেগম তো বিরক্তিতে মুখ কুচকে সরে পড়েছে এখান থেকে,না জানি কখন আবার তিনি বিরক্ত হয়ে কোন কথা বলে দেন।এ বাড়িতে আবার তার ধৈর্য সীমা কিছুটা কম।অন্যায় বা ভুল কিছু দেখলেই তার জিহবা আপনা-আপনি চলে মনে হয়।সেখানে তাদের রৌদ্রর মতো হিরের টুকরোর জন্য ওমন ফালতু মেয়ের কথা শুনলে তো তার জিহবা এই বুঝি লাগাম ছাড়ালো।তায়েফ সাহেব বউয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, তিনি তো বেশ ভালোভাবেই অবগত নিজের স্ত্রীর স্বভাব চরিত্রে।রাইসা বেগম তো বহু আগেই কাজের ছুতো দিয়ে এখান থেকে চলে গিয়েছেন।
কবির সাহেব এখনো মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন,তাকে কিছু বলতে না দেখে রাফিদ সাহেব আবারও বললেন,
— তাছাড়া ভাইজান আমাদের সোহা মামুনিও নাকি রৌদ্র কে অনেক আগে থেকেই মনে মনে পছন্দ করে। এইতো কিছুদিন আগে ওর জন্য কত ভালো ঘর থেকে একটি সম্বন্ধ আসলো কিন্তু সোহা না করে দিয়েছে, ওকে কারণ জিজ্ঞেস করলে বললো ও নাকি রৌদ্র কে পছন্দ করে। তাই বলছিলাম আর কি….
এবার যেনো সকলেই রাফিদ সাহেবের কথায় নড়েচড়ে বসলেন। রাফিয়া বেগম তো যেনো আকাশ থেকে পড়লেন এই কথা শোনামাত্র, জুবাইদা বেগম তো মনে মনে একশো গালাগাল দিচ্ছে সোহাকে।ভাবা যায় কিছুদিন আগেও যে মেয়ে তাদের অনিকের পিছনে লেগে ছিলো আজ সে বলছে সে রৌদ্র কে পছন্দ করে। জুবাইদা বেগম মনে মনে ভাবলেন, “আমার এতটাও খারাপ দিন আসে নি যে ওমন উড়নচণ্ডী কে নিজের ছেলের বউ করে আনবো”
কবির সাহেব একপলক তাকালেন স্ত্রীর দিকে,দেখলেন জুবাইদা বেগম তার দিকেই কটমট করে তাকিয়ে আছেন। কবির সাহেব কিছুটা নিশ্বাস নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালেন,
— আসলে রাফিদ, বিয়ে-সাদি তো আর মুখের কথা না, এটা দুটো মানুষের সারাজীবনের সিদ্ধান্ত। তাই বলছিলাম রৌদ্র আসুক, তাকে আগে জিজ্ঞেস করি তার কি মতামত তারপর নাহয় তোমাদের আমি এই বিষয়ে জানাবো।
— বলছিলাম কি ভাইজান আপনি বললেই তো রৌদ্র রাজি হব…..
কথা শেষ করতে পারলেন না রাফিদ সাহেব তার আগেই কবির সাহেব আগের ন্যায় গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— না রাফিদ।ছেলে আমার প্রাপ্তবয়স্ক। ওর নিজের ও পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে,আর তাছাড়া আমি আমার ছেলের ওপর কোন ধরনের মতামত চাপিয়ে দিতে চাচ্ছি না।এখন এসব কথা থাক।
বলেই তিনি ড্রয়িং রুম ত্যাগ করলেন।একে একে সকলেই উঠে চলে গেলেন।রাফিদ সাহেব এখনো কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন। মনে মনে ভাবছেন, “রৌদ্র কি আদৌ রাজি হবে? আর যদি রাজি নাহয় তাহলে বড়দা কে কি জবাব দেবো? তিনি তো কতো আশা নিয়ে বসে আছেন এ বাড়িতে মেয়েকে বিয়ে দিবে।আর আশা থাকবে নাই বা কেনো,এ বাড়ির ছেলেদের যশ,খ্যাতি,সৌন্দর্য কোন কিছুরই যে কমতি নেই।”
এমন টা নয় যে রাফিদ সাহেব জানেন না সোহার ব্যাবহারের বিষয়ে,এ নিয়ে তিনি বহুবার তার বড়দাকে বলেছেন মেয়েকে শাসনে রাখতে কিন্তু তার বড়দা বরাবরই এক কথা বলেছেন,
“এ বয়সে এমন একটু আধটু করেই,ও আর এমন কি!”
অগত্যা সেসব ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন রাফিদ সাহেব।তিনি বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ। নেহাৎ বড়ভাইকে সম্মান করেন বিধায় তার হয়ে এই সম্বন্ধের কথা বলেছেন। এখন যদি রৌদ্র রাজি নাহয় তাতে তারই বা কি করার আছে। মেহরিন বেগম স্বামীর চিন্তিত মুখ দেখে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে তার ভেতরকার পরিস্থিতি, তাই তিনি স্বামীর কাঁধে আলতো করে হাত রাখেন।রাফিদ সাহেব স্ত্রীর হাত নিজেও সযত্নে চেপে ধরেন।
রাত ৯:৩০। রৌদ্র বেশকিছুক্ষণ আগে বাড়িতে ফিরেছে।ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে বসে ফুপিকে স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছে সে।মেহরিন বেগম রৌদ্র কে দেখা মাত্রই সাড়া মুখে একে একে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে বুকে জড়িয়ে নেন আর কাঁদতে থাকেন।রৌদ্র চুপচাপ তাকে জড়িয়ে ধরে রেখে স্বান্তনা দিচ্ছে।
অরিন নিজের পড়া শেষ করে ফুপিকে খুজতে গিয়ে নিচে এসে এই দৃশ্য দেখে থমকে দাড়ায়।তার ফুপিটা বড় আবেগি,বিষয় টা এমন যেন পান থেকে চুন খসলেই কেঁদে দিবেন।তার ওপর তার রোদ ভাই কতবছর পর এলেন,আজ তো বোধহয় তার ফুপিমণি সারারাত রোদ ভাই কে বুকে নিয়ে কেঁদেই পার করবে।এসব ভেবে অজান্তেই অরিনের মুখ ফুঁড়ে হাসি বের হয়ে আসে।অরিনের হাসি দেখে রৌদ্র ভ্রুকুটি করে তাকায় তার দিকে।রোদ কে নিজের দিকে এভাবে তাকাতে দেখে অরিনও সহসা হাসি থামিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।মেহরিন বেগম বেশকিছুক্ষন পর কান্না থামিয়ে নাক টানতে থাকে।
রাইসা বেগম রান্না ঘর থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে বলতে লাগলো,
— ও মেহরিন গো। কান্না থামিয়েছো তবে? আমিতো ভাবলাম আজ না আবার সারারাত পার করো কাঁদতে কাঁদতে।
ছোট ভাবির মুখে এমন কথা শুনে হালকা লজ্জা পান মেহরিন বেগম। তিনি নাক টেনে কিছু বলবেন তার আগেই জুবাইদা বেগম সেখানে উপস্থিত হয়ে বলতে থাকেন,
— আহ থাক না ছোটো, কেনো জালাচ্ছিস মেহুকে।মেয়েটা কতদিন পরে দেখলো রোদ কে।একটুতো কাদবেই তাইনা।
— শুধু একটু কাঁদলে তো ঠিকই ছিলো বড়বু, কিন্তু আমাদের মেহুতো কাঁদতে কাঁদতে চেহারা ফুলিয়ে ফেলেছে। ইশ কি অবস্থা করেছো মুখটার।চলো চলো রুমে গিয়ে মুখ ধুবে।
মেহরিন বেগমের হাত টেনে বলতে লাগলেন মাইমুনা বেগম।
— আহা! তোমরাও না।খালি আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করো।হুহ।
মেকি রাগ দেখিয়ে বললেন মেহরিন বেগম।
— আহাগো,ননদীনী আমার রাগ করেছে।আচ্ছা আচ্ছা আর বলবো না ওকে! এবার নাহয় তুই রুমে গিয়ে ফ্রেশ হ।কেঁদেকেটে তো একাকার অবস্থা করেছিস।
শাড়ির আঁচল দিয়ে আলতো করে মুখ মুছে দিয়ে বলতে থাকেন রাফিয়া বেগম।মেহরিন বেগমও হাসতে থাকেন তাদের এমন আদর যত্নে। তার ভাবি গুলো সত্যি তার মায়ের মতো।এই যে তার মা গত হয়েছে কতগুলো বছর আগে কিন্তু এখনো মেহরিন বেগম তার ভাবিদের আদর,শাসনে তার মাকে খুজে পায়।
মেহরিন বেগম রোদ কে ছেড়ে নিজের রুমে চলে যান।অরিন এতক্ষণ তার মা-চাচীদের কান্ড দেখছিলো,কি সুন্দর মিল প্রতিটি মানুষের মধ্যে। সে নিজেও যতো দেখে ততই মুগ্ধ হয়।
অরিনকে এভাবে মিটিমিটি হাসতে দেখে রাইসা বেগম তার কাছে গিয়ে বলে উঠে,
— কিরে অরি,এভাবে একা একা দাড়িয়ে হাসছিস যে!
— না ছোটোমা তেমন কিছু না এমনি,
— ও আচ্ছা। তোর কি পড়া শেষ মা?
— জি ছোটো মা।
— আচ্ছা। বলেই তিনি চলে গেলেন জা’দের সাথে টেবিল সেট করতে ডিনারের জন্য। এদিকে ড্রয়িং রুমে শুধু সে আর রৌদ্র উপস্থিত। অরিন একবার ভাবলো চলে যাবে কিন্তু একটু পর তো খাওয়ার জন্য নামতেই হবে ভেবে আর গেলো না।রৌদ্র বেশকিছুক্ষন নিরবতা ভেঙে বলে উঠে,
— অরি কাল থেকে তোকে আমিই কোচিং-এ ড্রপ করবো আর আসার সময় বাড়ির গাড়ি করে আসবি।
— কিন্তু,,,
— কোন কিন্তু না, যা বলেছি তার বিন্দুমাত্রও যেনো নড়চড় না হয়। গট ইট!
অরিন আর কি বলবে, ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ঘাড় কাত করে সে।
রাতের খাবার শেষ করে রুহি ছাদে এসেছে । তাদের ছাদে বসার জন্য অবশ্য একটি বড় দোলনা লাগানো হয়েছে। রুহি সেখানে বসেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর আকাশটা! চারিদিকে মিটিমিটি তারা জলছে আর তার পাশে একটি বাঁকা চাঁদ নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছে। এইতো সে কিছুক্ষণ পর পর মেঘের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে আবারও টুপ করে উকি দিচ্ছে। কেনো জানি রুহির কাছে দৃশ্যটা অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ঠেকছে।এরই মাঝে তার ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠে। রুহি তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় চ-শব্দ করে ফোন টি সামনে ধরে, দেখতে পায় একটি আননোন নাম্বার। রুহি ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতেই ফোন টি কেটে যায়।রুহিও আর তেমন পাত্তা না দিয়ে নিজের আকাশ দেখায় মনোযোগী হয় কিন্তু আবারও ফোন বেজে উঠে এবার রুহি রিসিভ করে বেশ কর্কশ গলায় বলে উঠে,
— হ্যালো!
—ওপাশ নিশ্চুপ….
—কি হলো, এতো রাতে কল দিয়ে আবার কথা বলছেন না কেনো?
— এবারও চুপ।
— আশ্চর্য! কথা যদি না-ই বা বলার থাকে তাহলে ফোন ধরে নিশ্চুপ হয়ে আছেন কেনো? এসব কেমন ফাজলামো শুনি।
এবার বেশ নরম স্বরে কেউ একজন বলে উঠে,
— রুহি।
কন্ঠটি পেতেই রুহির বুকটা ধ্বক করে উঠে। এই স্বর যে তার বড্ড চেনা।এই কন্ঠ যে তাকে এলোমেলো করে দেওয়ার একমাত্র অস্ত্র। রুহি বেশকিছুক্ষন নিরবতা পালন করে বলে উঠে,
— র-রেহান ভ-ভাই।
— হুশ্ কোন ভাই না। শুধু রেহান বলবা ওকে।
— কেনো? এতদিন তো রেহান ভাই হিসেবেই জেনে আসছি আজ হঠাৎ শুধু রেহান বলতে বলার কারন টা কি?
— আমার ইচ্ছে তাই।
— আপনার ইচ্ছে হলেই কি আমায় মানতে হবে?
— কেনো তুমি মানবে না বুঝি?
হঠাৎ করেই থমকে যায় রুহি।ঠিকই তো সে কি আর নিজ ইচ্ছানুযায়ী তাকে ভাই ডাকে নাকি।তারতো বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করে না এই মানুষটাকে ভাই ডাকতে।আর রইলো বাকি তার কথা অমান্য করার, এ সাধ্য কি আর এই শ্যামাঙ্গীনির আছে!.
অরিনকে চুপ থাকতে দেখে রেহান বলে উঠে,
— কি ম্যাডাম।চুপ করে গেলেন যে! আমার কথা মানতে কি খুব কষ্ট হবে আপনার?
— এই কথা বাদ দিয়ে কেনো কল দিলেন সেটা বলুন।
— কেনো কল দিলাম বলে কি রাগ করলে?
— এত রাতে একটা মেয়েকে কল দিয়েছেন,তারওপর তাকেই জিজ্ঞেস করছেন সে রাগ করলো কি না? বেশ তো!
রুহির কথা শুনে ঠোঁট কামড়ে হাসে রেহান। মেয়েটা বেশ ভালোই কথা জানে।শুধু সে সামনে থাকলে তার মুখে কোন কথা আসে না।তাইতো রেহান তাকে একটু জালানোর জন্য বলে উঠে,
— মেডামের মুখে তো আজ বেশ ভালোই কথা শুনছি,তা আমি সামনে থাকলে ওতো কাচুমাচু করেন কেন?
রেহানের এমন কথায় মুচকি হাসে রুহি।অতপর বলে উঠে,
— মোটেও না, আমি একদম কাচুমাচু করিনা,আপনি বড় তাই আপনাকে সম্মান দেখিয়ে মাথা নিচু করে থাকি,এই আর কি!
— ও বাবা! তাই নাকি।
— হুম।
— আচ্ছা রুহি একটা কথা জিজ্ঞেস করলে কি তুমি খুব রাগ করবে?
— কি এমন কথা শুনি।
— আ-আসলে, মা-মানে,
— এতো আমতা আমতা করছেন কেনো? কি বলবেন বলুন।
— তুমি কি কাওকে ভালোবাসো রুহি?
কথাটা কানে আসা মাত্রই থমকে যায় রুহি।কি উত্তর দিবে ও? এই মানুষ টা ওর সামনে আসলেই নিজেকে কেমন এলোমেলো লাগে তার,মনের মধ্যে খেলে যায় হাজারো প্রজাপতি। অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে তার।তার জিবনে এমন অনুভূতি শুধুমাত্র এই মানুষ টা সামনে আসলেই হয়।আচ্ছা তাহলে কি সে সত্যিই রেহানকে…. ভাবতে ভাবতে মুচকি হাসে রুহি।অতঃপর বলে উঠে,
— আমি কাওকে ভালোবাসি কি না তা জেনে আপনি কি করবেন?
— না,আ’আসলে এমনিই।
— ওহ বুঝলাম। আচ্ছা আপনি কি কাউকে পছন্দ করেন?
রেহান হয়তো রুহির এমন কথারই অপেক্ষায় ছিলো।মোবাইলটা কানে ধরে রেখেই বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রেহান।চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে এক ছোট্ট শ্যামবতীর প্রতিচ্ছবি। শ্যামবতীর ঘর্মাক্ত মুখ,হরিনি চোখ,মাথায় দুই বিনুনি গাঁথা, পড়নে ঘর্মাক্ত স্কুল ড্রেস। কি ছিলো সেই ছোট্ট মেয়েটার মাঝে! যার জন্য রেহানের হৃদয়টা কেমন থমকে গিয়েছিলো সেদিন ।কেনো সে ঐ মায়াবতীকে একনজর না দেখলে টিকে থাকতে পারেনা এতগুলো বছর পরেও।আচ্ছা এই মেয়েটা কি সর্বনাশী না? এই যে রেহানের হৃদয়ে এতগুলো বছর অবস্থান করে তাকে জালিয়ে পুড়িয়ে মারছে। এখনও তো এই দহন বন্ধ হচ্ছে না। এই দহন যে যেই সেই দহন নয়,এ যে হৃদয়ের দহন,এটা কেবল সেই শ্যামবতীর আরন্যেই বন্ধ হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেহান,ওপাশে রুহি কান পেতে শোনে সেই নিশ্বাস।
দুপাশের নিরবতা ভাঙে রেহানের মনোমুগ্ধকর কন্ঠে,
— জানো রুহি,আমিই না এক সর্বনাশী কে ভিষণ ভালোবাসি।শুধু ভালোবাসা না আমি যে তার মায়ায় আটকে গিয়েছি।
রেহানের মুখে কাউকে ভালোবাসে শুনে রুহির বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠে, ও কি ঠিক শুনলো? রেহান সত্যিই কাউকে ভালোবাসে? তাহলে ও যে ভেবেছিলাে রেহানও ওকে…..আচমকাই রুহি থেমে থেমে প্রশ্ন করে উঠে,
—ক-কে সে?
— আছে কোন এক সর্বনাশী।
— সর্বনাশী মানে?
— এই যেমন ধরো সে আমাকে তার ভালোবাসার দহনে জালিয়ে পুড়িয়ে মারছে এটা কি আমার সর্বনাশ নয়? তাই সে আমার সর্বনাশী।
রুহি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। ওড়নায় মুখ গুজে কাঁদতে লাগলো যাতে ওপাশে তার আওয়াজ রেহান শুনতে না পায়।কি হলো ওর? এত কাঁদছে কেনো রুহি? ভালোবাসা হওয়ার আগেই সেটা ভেঙে গেলে কি সত্যিই এতো কষ্ট হয়?
রুহিকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে রেহান ফের বলে ওঠে,
— তুমি বারবার নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছো কেনো রুহি? কিছু তো বলো।
নিজের কান্না বহুকষ্টে থামিয়ে ধরা গলায় রুহি বলে উঠে,
— আমার ভালো লাগছে না রেহান ভাই। ফোন রাখছি আমি।
— এই রুহি, হঠাৎ কি হলো তোমার, তোমার কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো?
— না কিছু হয়নি আ’ম ওকে।রাখছি।
বলেই রেহানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খট করে ফোন কেটে দেয় রুহি।ফোন কেটেই সেটিকে ছুড়ে মারে ছাদের মেঝেতে। উফফ বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে তার বুকে,অসহ্য রকমের যন্ত্রণা। চোখ বারবার মুছেও কাজ হচ্ছে না সেখান থেকে আবারও গড়িয়ে পড়ছে পানি। অগত্যা ছাদ থেকে নেমে পড়ে সে।একছুটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকিয়ে সেখানেই ধপ করে বসে পড়ে রুহি।কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার।ইচ্ছে করছে সব কিছু ধ্বংস করে দিতে। একটা সময় কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই শুয়ে পড়ে সে।
এদিকে রেহানের বুকটা কেমন অস্থির লাগছে।
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৮
– হঠাৎ করে কি হলো রুহির, মেয়েটা কি তখন কাঁদছিলো? না কাঁদলে কন্ঠ টা এমন শোনালো কেন?হুট করেই ফোনটা কেটে দিয়ে এখন আবার সুইচড অফ করে রেখেছে। অস্থিরতায় নিজের চুল নিজেই খামচে ধরে রেহান,অতপর বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
– কেনো এমন জালাচ্ছো শ্যামবতী,আমাকে জালাতে তোমার এত সুখ! মনে রেখো শ্যামবতী! আমার এ হৃদয়ে এতগুলো বছর ধরে যে দহন তুমি চালিয়েছো,সেই দহনের অনলে তোমাকেও আমি পোড়াবো।ভিষণ রকমের পোড়াবো।জাস্ট বি রেডি কলিজা🖤।