সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১০

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১০
Jannatul Firdaus Mithila

সকাল সকাল রান্নার বেশ তোড়জোড় চালাচ্ছেন বাড়ির গৃহিণীরা, সঙ্গে যোগ দিয়েছেন মেহরিন বেগম ও।তাকে অবশ্য বেশ কয়েকবার বারন করেছে তারা কিন্তু সেও নাছোড়বান্দা তাই তাকে আর কেও বারন করেনি। তাদের সকলের হাতের কাজ শেষ হতেই দেখেন বাড়ির সকলে টেবিলে উপস্থিত হচ্ছেন।অনিক সিঁড়ি দিয়ে নামছে, বরাবরের মতো ফরমাল গেটআপে । ধূসর রংয়ের একটি শার্ট পড়নে তার,কালো ফরমাল প্যান্ট,হাতে Black wrist brand Watch. গলায় ব্ল্যাক টাই। ফর্সা ছেলেটাকে এই গেটআপে যেনো বেশ নজরকাড়া লাগছে।রাফিয়া বেগম দূর থেকেই ছেলেকে খেয়াল করে মনে মনে মাশাআল্লাহ বললেন। অনিক গিয়ে তায়েফ সাহেবের পাশে বসে পড়ে। তার কিছুক্ষণ পরই উপস্থিত হয় রৌদ্র। হাতে এপ্রোন,স্ট্যাথোস্কোপ, পড়নে হোয়াইট শার্ট, ব্ল্যাক পেন্ট,হাতে Silver wrist brand watch, বরাবরের মতো বুকের সামনের দুটো বোতাম খোলা,চুল পাইক করে রাখা,আর হৃদয় থমকে দেওয়া বিড়াল চোখগুলো আজও ব্রাউন কালার চিকন ফ্রেমের চশমার আড়ালে ঢাকা।রৌদ্র এসে সাব্বির সাহেবের পাশে বসে।এতক্ষণ কবির সাহেব বাড়ির দু ছেলেকে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। তিনি ওদের যতবার দেখেন ততবারই মুগ্ধ হন।মনে মনে অবশ্য মাশাআল্লাহ বলতে ভুললেন না। রাফিদ সাহেবও যোগ দিয়েছেন বাড়ির পুরুষদের সাথে। সাব্বির সাহেব কিছুটা আস্তে রৌদ্র কে জিজ্ঞেস করে,

— আজ এতো সকালে বের হচ্ছো যে! তোমার ডিউটি না ১০ টা থেকে?
— হুম মেজো আব্বু,একচুয়ালি ইমার্জেন্সি একটা অপারেশন চলে আসছে তাই সকাল সকাল যেতে হবে।
রৌদ্র তার চিরচেনা গম্ভীর কণ্ঠে বলতে লাগলো ।
— ও আচ্ছা।
বলেই খাবারে মনোযোগ দিলেন সাব্বির সাহেব।
তারা সকলে খাবার খাচ্ছিলো এমন সময় তাড়াহুড়ো করে সেখানে উপস্থিত হয় অরিন।অরিনকে দেখে সকলেই বেশ অবাক হয়।কেননা অরিনের কোচিং ১০ টায়।আর এখন সবে মাত্র ৮:২০। সকলেই যখন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার পানে ঠিক তখনই রাফিয়া বেগম মেয়েকে জিজ্ঞেস করে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— অরি এতো সকালে রেডি হয়ে আসলি যে!
— আসলে আম্মু আজকে টেস্ট আছে। সরি তোমায় কালকে বলতে ভুলে গেছি।
— ও আচ্ছা। আয় বস খেতে।
অরিন মাথা ঝাকিয়ে বসার জায়গা খুঁজতেই খেয়াল করে রৌদ্রর পাশের চেয়ারটাই খালি।অরিন কিছুক্ষণ দোনোমোনো করছিলো বসবে কি বসবে না ভেবে তখনই জুবাইদা বেগম তাকে টেনে রৌদ্রর পাশে বসিয়ে দিয়ে প্লেটে খাবার তুলে দেন।অরিনও আর কি করবে, খাবার খেতে থাকে।এরই মাঝে রাফিদ সাহেব কি একটা মনে করিয়ে দেবার মতো কবির সাহেব কে বললেন,

— ভাইজান ঐ কথাটা….
কবির সাহেব হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে থমকে রইলেন কিছুক্ষণ। তার মাথা থেকে একদমই বিষয় টা চলে গিয়েছিলো,তিনি হালকা গলা পরিষ্কার করার ন্যায় কেশে উঠেন,অতঃপর বেশ গম্ভীর কণ্ঠে রৌদ্র কে বললেন,
— রোদ তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিলো।
— হুম বলো। খেতে খেতে উত্তর দিলো রৌদ্র।
— সোহাকে তোমার কেমন লাগে?
আচমকা এমন কথায় হাত থেমে যায় রৌদ্রর।অরিন বেচারির এমন কথা শোনামাত্রই নাকে মুখে উঠে যায়।সে একাধারে কাশতে থাকে।মাইমুনা বেগম তড়িঘড়ি করে পানি দেন অরিনকে,অরিনও ঢকঢক করে গিলে নেয় পুরো গ্লাসের পানি।অনিক অরিনের এমন অবস্থা দেখে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

— বনু আর ইউ ওকে? কতবার বলেছি খাওয়ার সময় অন্য কোথাও মনোযোগ দিতে না।
বলেই বোনের সামনে এসে মাথায় হাত বুলায় সে।অরিন নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ওঠে,
— আ’ম ফাইন ভাইয়ু,চাপ নিস না।
— শিউর?
— হু।ছোট করে উওর দেয় অরিন। এই মুহূর্তে অরিনের ইচ্ছে করছে ছুটে পালিয়ে যেতে কোথাও। কেনো সবসময় এসব কথা তার সামনেই ওঠে? এই মানুষ টাকেই কেনো সে তার অষ্টাদশী অবচেতন মনে জায়গা দিলো? এই মানুষ টা যে তার স্বপ্নেও হবে না। তবুও তার বেহায়া মনটা তা মানতে নারাজ।গলা ধরে আসছে অরিনের, খাবার গিলতেও যেনো রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে।
এতক্ষণ সকলে অরিনের জন্য ব্যস্ত হলেও এখন সকলে নিজেদের খাবার রেখে রৌদ্রর কথা শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে তার দিকেই চেয়ে আছে। রৌদ্র এবার নিরবতা ভেঙে বলে ওঠে,

— কোন সোহা?
— রাফিদের বড় ভাইয়ের মেয়ে। সোহা সিকদার।
— ওওহ। সরি আব্বু ঐ মেয়ের চরিত্র ভালো না।আর ওকে আমি পছন্দ তো দূর সহ্যই করতে পারি না।আশা করছি ওকে নিয়ে আর কখনো আমার সামনে কিছু বলবে না।
রৌদ্রর মুখে এমন কথা শুনে বেশ লজ্জিত হন রাফিদ সাহেব, সহসাই তার হাসি মুখটা চুপসে যায়।বাড়ির সকলেই যেনো রৌদ্রর কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।কেননা সোহাকে তাদের কারোরই তেমন পছন্দ নয়।রৌদ্র খাওয়া শেষ করে ওঠে যাবে তার আগে অরিনকে বলে যায়,
— খাওয়া শেষ করে তারাতাড়ি আয়,আমি বাইরে ওয়েট করছি।
রৌদ্রর কথা শুনে বাড়ির কেওই তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি কেননা অরিনের কোচিং রৌদ্রর হসপিটালের রাস্তাতেই পড়ে।অরিন রৌদ্রর কথায় চুপচাপ ঘাড় কাত করে সায় জানায়।অতঃপর নিজের খাওয়া শেষ করে বিদায় নিয়ে চলে যায় বাড়ির গেটের সামনে। গেটের সামনে আসতেই রৌদ্র তার সামনে গাড়ি থামায়।অরিন আজ বাধ্য মেয়ের মতো গাড়িতে ওঠে পড়ে।গাড়ি চলতে শুরু করে, দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা। রৌদ্র হঠাৎ নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে,

— তোকে কাল বলেছিলাম না যে গাড়ি যাবে,তাহলে তুই তারপর ও কেনো ধেইধেই করে রাস্তায় নেমে হাঁটছিলি?
অরিন রৌদ্রর এমন কথায় বেশ চমকে উঠে,
-আচ্ছা রোদ ভাই কি করে জানলো আমি কালকে গাড়ি আসতে লেট করায় রাস্তায় হাঁটছিলাম?
ভেবেই অরিন পরপর কয়েকটা ঢোক গিলে বলতে থাকে,
—আ-আসলে র-রোদ ভাই এ-এমনি এ-একটু…
— ঠিক করে কথা বল ইডিয়ট। এমন তোতলাচ্ছিস কেন তুই? আর খুব বেড়েছিস তাই না,ঠাটিয়ে যখন দুটো লাগাবো না একেবারে সকল পাকামো বের হয়ে যাবে, ষ্টুপিড।
দাতে দাত চেপে বলে উঠে রৌদ্র।
অরিনও চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। কি বলবে সে? রোদ ভাই শুধু ধমকই দেন।এটা করলে ধমক,ওটা করলে ধমক না জানি কোন দিন আবার তাকে তার নিশ্বাস নেওয়াতেও ধমক দিয়ে ওঠে।
রৌদ্রও আর বেশিকিছু বললো না।অরিনের কোচিং-এর সামনে তাকে নামিয়ে সে দাড়িয়ে থাকে সেখানে যতক্ষণনা অরিন ভেতরে ঢুকে ততক্ষণ।অরিন ঢুকতেই সেও চলে যায় নিজ গন্তব্যে।

আজ রুহির ঘুম থেকে উঠতে বেশ লেট হয়। ঘুমঘুম চোখে নিজের দিকে তাকাতেই নিজেকে মেঝেতে আবিষ্কার করে। বুঝতে পারে রাতে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই শুয়ে পড়েছিলো সে।তাই কোনরকম ওঠে ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটির জন্য রেডি হয়ে তড়িঘড়ি করে নিচে নামে রুহি।রুহিকে ওমন হন্তদন্ত হয়ে নামতে দেখে মেহরিন বেগম এগিয়ে এসে সস্নেহে জিগ্যেস করলেন,
— কি হয়েছে রুহি,ওমন তাড়াহুড়ো করছিস কেনো মা?
— আসলে ফুপিমণি বেশ লেট হয়ে গেছে আজ।নিশ্চিত একটা ক্লাস মিস যাবে। তাই..
— ওহ আচ্ছা বুঝলাম।

বলেই তিনি পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।রুহিও গিয়ে খাবার খেয়ে নেয়,খাবার শেষ করেই বাড়ি থেকে বের হয় সে।আজ আর বাড়িতে কোন গাড়ি নেই, লাস্ট যেটা ছিলো ওটাও হয়তো আহি,মাহি কে পৌঁছে দিতে গেছে। অগত্যা এসব ভাবতে ভাবতেই রাস্তা ধরে হাটা শুরু করে রুহি।এখান থেকে সামনে গেলেই হয়তো কোন রিকশা পেয়ে যাবে।এমন সময় হুট করেই তার সামনে এসে দাড়ায় একটি কালো রঙের গাড়ি।রুহি কিছুটা ভড়কে যায়। ভ্রু কুচকে কিছু বলতেই যাবে তার আগেই গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে রেহান।রেহানকে দেখামাত্রই মুখে অন্ধকার নামে অরিনের। বুকে এসে ভর করে একরাশ কালো মেঘ।মনে পড়ে যায় কাল রাতে রেহানের বলা কিছু তিক্ত কথা।আচ্ছা রেহান তো তাকে কিছু স্বাভাবিক কথাই বলেছিলো তবুও তার কাছে কেনো ওসব এতোটা তিক্ত লাগলো? হয়তো প্রিয় মানুষের মুখে অন্য কারো কথা শুনলে সেগুলো শুধু তিক্ত নয়,বিষাক্ত ও লাগে।

রুহিকে অন্য কোন ভাবনায় মগ্ন থাকতে দেখে রেহান তার সামনে তুড়ি বাজায়,আচমকাই রুহির ধ্যান ভাঙে।চোখ তুলে তাকায় তার সামনে দাড়িয়ে থাকা নজরকাড়া পুরুষটির দিকে।ব্ল্যাক শার্ট,সাথে ব্রাউন গ্যাবাইডিন প্যান্ট,হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ। শার্টের হাতা কিছুটা গুটানো থাকায় হাতের পশমগুলো রোদের আলোয় চিকচিক করছে। রাস্তায় রোদের নিচে দাড়িয়ে থাকার দরুন মুখ লাল হয়ে গেছে। তবুও মানুষটা কেমন ভ্রুক্ষেপহীনভাবে পকেটে হাতগুজে দাড়িয়ে আছে তার সামনে।আচ্ছা এই সুন্দর পুরুষ টা তার কেনো হলো না? সে কি এতই খারাপ দেখতে? এই মানুষ টার হৃদয়ে সত্যিই সে নয় অন্য কারো বসবাস! ভাবতেই রুহির চোখের কোনে পানি এসে ভিড় জমায়।রুহি তারাতাড়ি অন্যদিকে ফিরে, সে চায় না এই মানুষটার সামনে নিজের দূর্বলতা কে তুলে ধরতে। যেই মানুষ টা তার হবে না তাকে দূর্বলতা দেখিয়েইবা কি লাভ?
রুহিকে এমন অন্যদিকে ফিরে থাকতে দেখে রেহান ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকায়,বলে ওঠে,

— ঐ দিকে কি দেখো মেয়ে? আমিতো এই দিকে।
— মানে?
— না,মানে হচ্ছে গিয়ে আমি তোমার সামনে দাড়ানো তবুও তুমি অন্যদিকে ফিরে আছো তাই বললাম আর কি! তা আমায় কি কোন কারনে ইগনোর করছো?
— ন-না ই-ইগনোর ক-করতে য-যাবো কেন।
— রিলেক্স, কুল।এতটা হাইপার হতে হবে না। আমি জাস্ট মজা করছিলাম।তা এখানেই রোদের মাঝে দাড়িয়ে থাকবে নাকি, চলো তোমায় ভার্সিটি নামিয়ে দিই।
— নো থ্যাংকস।আমি নিজেই যেতে পারবো।
— আরে এখানে এত ফর্মালিটি করার কি আছে? আমি তোমাকে ছেড়ে দিলে কি খুব খারাপ হবে নাকি?
— যাকে আদৌ কখনো ধরে রাখতে পারলাম না তার ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নে ওতোটা খারাপ লাগারও কথা না।
বলেই রুহি রেহানের থেকে কিছুটা দূরে এসে রিকশায় উঠে চলে যায়। একবার ও পেছন ফিরে তাকায় না রুহি।তাকালে হয়তো দেখতে পারতো,কেউ একজন তার কথায় হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে তার চলে যাওয়ার পানে।

বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। অরিন, আহি, মাহি, পুতুল রাতুল আর রিমি মিলে নুডলস খাচ্ছে ড্রয়িং রুমে বসে।রুহিকে বেশ কয়েকবার ডাকা হয়েছে কিন্তু সে বারবার বলেছে তার নাকি মাথা ব্যাথা করছে তাই যেনো ডিস্টার্ব না করে।
অরিন নুডলস বরাবরই কম ঝাল দিয়ে খায়।কিন্তু আজ ওর সামনে রাতুল আর পুতুল বাজি ধরে ঝাল খাচ্ছে। তাদের এমন ঝাল খেতে দেখে অগত্যা অরিনেরও এক অদ্ভুত ইচ্ছে হলো, সেও ঝাল খাবে।তাই সে রাতুলের বাটি থেকে গপাগপ চামচ দিয়ে নুডলস খেতে থাকে। প্রথম দিকে ভালো লাগলেও একটা সময় অরিনের চোখ,নাক দিয়ে পানি পড়া শুরু করে। বেচারি ঝালের চোটে এখন প্রায় চিৎকার দিয়ে লাফাতে শুরু করেছে।এমন সময় বাড়িতে ঢুকে রৌদ্র। বাড়িতে ঢুকেই অরিনের এমন লাফানো দেখে বেশ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে কিয়ৎকাল। পরক্ষণেই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে দৌড়ে চলে যায় অরিনের কাছে।অরিনের কাছে এসেই তার হাতটা ধরে নিজের দিকে ফিরায় রৌদ্র,ব্যাতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

— কি হয়েছে অরি এমন লাফাচ্ছিস কেনো? আর তোর চোখ মুখ এত লাল কেনো?
অরিন কি বলবে? বেচারি ঝালের চোটে রীতিমতো হেচকি তুলছে আর কাঁদছে। এতক্ষণে অরিনের চিৎকারে রাফিয়া বেগম ছুটে আসেন রুম থেকে। এসেই সবটা খেয়াল করে বুঝতে পারেন, অরিনের ঝাল লেগেছে। তিনি রান্নাঘরে ছুটে যান মেয়ের জন্য মিষ্টি আনতে। এদিকে রৌদ্র এখনও অরিনের হাতটা ধরে দাড়িয়ে আছে। পাশে থাকা জগ থেকে পানি ঢেলে এগিয়ে ধরে অরিনের মুখের সামনে, অরিনও হেচকি তুলতে তুলতে খেয়ে নেয় সবটা।তবুও যেনো ঝাল কমার নাম নেই।ততক্ষণে রাফিয়া বেগম ও মিষ্টি নিয়ে এসে মেয়ের মুখের সামনে ধরেন। অরিনও গপাগপ খেয়ে নেয়।রাফিয়া বেগম এখন বেশ চটে গিয়ে মেয়ে কে বকতে শুরু করেন,
— এত বড় মেয়ে হয়ে এখনও নিজের ভালোটা বুঝিস না, জানিস ঝাল খেতে পারিস না তারপর ও কেনো ধেইধেই করে খেতে গেলি? মনটা চাচ্ছে তো তোকে…
বলেই থাপ্পড় দিতে যাবেন এমন সময় রৌদ্র তার হাতটা খপ করে ধরে নেয়। রাফিয়া বেগম তবুও শান্ত হতে পারলেন না,ইচ্ছেমতো কথা শোনাতে লাগলেন অরিনকে। অরিনও মাথানিচু করে কেদেই যাচ্ছে। রৌদ্র এবার গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,

— মেজো মা, এবারের মতো ওকে ছেড়ে দাও।নেক্সট টাইম এমন কিছু করলে সেটা আমি দেখবো।এবার তুমি থামো।
বলেই অরিনকে নিয়ে সেখান থেকে সরে আসে রৌদ্র। অরিনের হাত ধরেই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিজের রুমে নিয়ে আসে তাকে।রুমে ঢুকেই হাতে থাকা এপ্রোনটা ছুড়ে ফেলে বিছানায়, অরিনের হাত ছেড়ে তার দিকে নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিয়ৎক্ষন,অতপর অরিনের মাথায় হাত রেখে বেশ নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে রৌদ্র,
— খুব কষ্ট হচ্ছে?
অরিনের কান্নার কারনে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না,শুধু মাথা উপর নিচ ঝাকায়।

রৌদ্র সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটি নিশ্নাস ফেলে, তারপর চলে যায় নিজের আলমারির কাছে, কিছু একটা বের করে নিয়ে আবারও অরিনের সামনে এসে তাকে হাত ধরে বিছানায় বসায়।অরিনও বাধ্য মেয়ের মতো মাথানিচু করে বসে,এখনো সে ফুপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। রৌদ্র হাঁটু গেড়ে বসে অরিনের সামনে, খানিকক্ষন তাকিয়ে থাকে তার হৃদয়হরনীর দিকে।কেনো জানি অরিনের চোখের পানিগুলো তীরের মতো বিঁধছে রৌদ্রর বুকে।সেও তো চেয়েছিলো ওকে আচ্ছা করে বকে দিতে, কেনো যেটা খেতে পারেনা সেটাই খেতে গেলো? কিন্তু তা আর হলো কই? এই মেয়ের চোখের পানি যে রৌদ্রর সকল রাগ এক নিমিষেই ধূলিসাৎ করে দিতে সক্ষম। রৌদ্র অরিনের কান্না আর সহ্য করতে না পেরে মৃদু ধমক দিয়ে ওঠে,

— চুপ করবি তুই! আর কত কাঁদবি বল? ঝাল খেলি তুই,বকা খেলি নিজের দোষে তার ওপর আবার কাঁদছিস ও তুই,এখনি কান্না থামা নইলে মেজো মা যেই মারটা দিতে পারেনি সেটা আমি দিবো।
অরিন এমন ধমক শুনে বহু কষ্টে কান্না থামায়।অরিনকে থামতে দেখে হালকা মুচকি হাসে রোদ। হাত বাড়িয়ে আলমারি থেকে বের করে আনা কয়েকটা চকলেট অরিনের হাতে দেয়।অতপর কপট রাগ দেখিয়ে বলতে থাকে,
— সবগুলো শেষ করবি এখন।
অরিন কান্না থামিয়ে একবার চকলেট গুলোর দিকে তো আরেকবার রৌদ্রর দিকে তাকায়।চকলেট যে তার ভিষণ প্রিয়। তারপর আর কি,নাক টানতে টানতে একটা চকলেট মুখে পুরে নেয় সে।
অরিনের এমন কান্ডে ঠোঁট কামড়ে হাসে রৌদ্র। সে খুব ভালো করেই জানে এই মেয়ের সামনে একবার চকলেট দিলে তার কান্না ছুটতে বেশি একটা দেরি হবে না। রৌদ্র মনে মনে বলতে থাকে,
“বাচ্চা একটা!হুম বাচ্চাই তো, আমার জানবাচ্চা”

রুহি নিজের রুমের বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। এতক্ষণ নিজের এক ফ্রেন্ডের সাথে ফোনে কথা বলছিলো সে।কথা বলার মাঝেই সে খেয়াল করেছিলো রেহান বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে। রুহি দেখেও সবটা না দেখার ভান করে ফ্রেন্ডের সাথেই কথা বলতে থাকে। পরে নিজের কথা শেষ হওয়া মাত্রই ফোন সুইচড অফ করে রাখে।তার মোটেও ইচ্ছে করছে না রেহানের সাথে কথা বলতে। এমন সময় রুহির দরজায় টোকা পড়ে, রুহি আওয়াজ পাওয়া মাত্রই রুমে আসে।দরজা খুলেই দেখতে পায় তার বাবাকে।রুহি আচমকা কবির সাহেব কে দেখে কিছুটা ভড়কে যায়। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বাবাকে ভিতরে আসতে দেয়।কবির সাহেব গম্ভীর মুখেই ভেতরে প্রবেশ করে তার পিছু প্রবেশ করে জুবাইদা বেগম ও রাফিয়া বেগম। রুহি সকলকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয় কেননা তার বাবা সচরাচর ছেলেমেয়েদের রুমে আসেন না বিশেষ কোন দরকার ছাড়া।রুহি তার মেজো মাকে চোখ দিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে। রাফিয়া বেগম মিষ্টি হাসেন কিছুটা।কবির সাহেব কিছুটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে লাগলেন,

— রুহি তোমার সাথে একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি।
— জি আব্বু বলো কি বলবে।
— দেখো মা,মেয়েরা হচ্ছে পরের ঘরের আমানত। আজ নয়তো কাল তাদের বিয়ে দিতেই হয়।তাই আমি তোমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছি।আমার কাছে অবশ্য একজন ভালো পাত্র আছে।তা বলছিলাম কি,তোমার কি কাওকে পছন্দ? দেখো যদি থাকে তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পারো।
বাবার মুখে এমন কথা শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে রুহির।

— কি করে বলি তোমায় আব্বু যাকে আমার পছন্দ সে যে আমায় নয় বরং অন্য কাওকে পছন্দ করে।
মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে বলা হয় না রুহির। অতঃপর নিজের চলে আসা কান্না গুলো গিলে নিয়ে বলে ওঠে,
— ন-না আব্বু আ-আমার কাওকে পছন্দ না।তোমার যাকে ভালো লাগবে আমি তাকেই বিয়ে করবো।
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কবির সাহেব। জুবাইদা বেগম এগিয়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। মনে মনে ভাবলেন,
“আমার সন্তানদের যে আমি মানুষের মতো মানুষ করতে পেরেছি খোদা”। রাফিয়া বেগম ও রুহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।রুহিকে বুক থেকে আলগা করতেই জুবাইদা বেগম দেখলেন রুহির চোখে পানি। অতঃপর তিনি হালকা হেসে মেয়ের চোখ মুছে দিয়ে বলতে থাকে,
— ওরে মেয়ে তোকে কি আমি আজই বিয়ে দিচ্ছি নাকি যে তুই এখনি কাঁদছিস। কাঁদিস না বোকা।
রুহি কিছু বলে না।সে কি করে বোঝাবে কাওকে যে তার হৃদয়ে এই মুহুর্তে কেমন ঝড় বইছে।এ ঝড় যে কাওকে না পাওয়ার ঝড়,চিরতরে তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়।

পরদিন সকাল, আজকে মেহরিন বেগমরা চলে যাবেন। তাই সকলে একসাথে সকালের নাস্তা খেতে বসেছে। ছোটদের মাঝে শুধু পুতুল নেই।সে এত সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না।বাদ বাকি সবাই আছে। খাওয়ার মাঝে হঠাৎ কবির সাহেব সকলকে বলেন,
— আমাদের রুহির জন্য আমি একটা সম্বন্ধ দেখেছি।ছেলে ইন্জিনিয়ার।বাবা রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার।বেশ আত্মমর্যাদাসম্পূর্ন পরিবার।ছেলেকে আমি দেখেছি, ভালোই মনে হলো।এখন তোরা কি বলিস?
বলেই ছোট ভাইদের এবং বাড়ির দুই ছেলের দিকে তাকালেন তিনি। কবির সাহেবের ভাইয়েরা একই কথা বললেন,
— ভাইজান আপনি যা ভালো মনে করেন।
কবির সাহেব মৃদু মাথা ঝাঁকালেন। কবির সাহেব এবার অনিক আর রৌদ্র কে বললেন,

— তোমরা কি বলো?
—বড় আব্বু আপনি যেটা ভালো মনে করেন সেটাই করুন।আশা করি এটাই বেস্ট হবে। বলেই অনিক আবারও খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
এতক্ষণে রৌদ্র ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করলো,
— রুহির কি মতামত?
— ও বলেছে ও রাজি আমার মতামতে। কবির সাহেব বললেন।
— রুহি এমনটা বলেছে?
— হুম
— ঠিক আছে তাহলে।আমারও কোন আপত্তি নেই।
বলেই খাবার খেতে লাগলো রৌদ্র।

এদিকে বাড়ির সকলের এসব কথা শুনে চোখ বড় বড় করে রুহির দিকে তাকিয়ে আছে, অরিন,আহি,মাহি।এখানে বড়রা উপস্থিত আছে বিধায় তারা তিনজন এখনো নিজেদের আটকে রেখেছে নাহলে এতক্ষণে তারা খুশিতে লাফাতে শুরু করে দিতো।অরিনতো না পেরে রুহিকে জড়িয়ে ধরেছে।তাদের দেখে আহি মাহিও ওপর দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে,তারা তিনজনই উচ্ছাসের সঙ্গে বলে উঠে,
“কংগ্রেস ”
রুহি তাদের থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
— এখনো কিছু ফাইনাল হয়নি।এখনি কিসের কংগ্রেস।
— তাতে কি আজ নাহোক কাল তো হবে।তাই এডভান্সে বলে দিলাম।বলেই একটা লম্বা হাসি দেয় অরিন।হাসি দিতেই তার গালে সদৃশ হয় সেই চিরচেনা আদুরে টোল দুটি।
বাড়ির সকলে এদের এমন কর্মকাণ্ড দেখে মিটমিট করে হাসছে। রৌদ্র একবার আড়চোখে সেই টোলপড়া হাসির দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।এই হাসির দিকে বেশিক্ষণ তাকালে নিজেকে সামলানো বড় দায়।

দুপুর ১২:৩০.
রেহান অফিসে নিজের কেবিনে কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ডকুমেন্টস চেক করছে,এমন সময় বিকট শব্দে তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের দিকে তাকাতেই তার মুখে আনমনে একটা আদ্র হাসি চলে আসে। মনে মনে ভাবে,
— বউয়ের ২ দিন ধরে খোঁজ নাই কিন্তু শালা আমার ঠিকই খোঁজ নেয়।
ফোন রিসিভ করে কানে ধরা মাত্রই ওপাশ থেকে ভেসে আসে কারো হাসি হাসি কন্ঠ।
— কেমন আছিস রেহান।
— হুম ভালো।তা কেমনে কেমনে রৌদ্র সাহেব আমায় কল দিলো।তা ভুলে টুলে কল চলে আসলো নাকি?
— হা হা! আজ তুই যতই ফাউল কথা বলিস না কেনো আমি একটুও রাগ করবো না।বিকজ টুডে আ’ম ভেরি হেপি।
— তাই নাকি রে,তা আমাকেও একটু বল কি এমন নিউজটা যার জন্য ইফতেখার এহসান রৌদ্র এত খুশি।
— হুহু বলবো কিন্তু এভাবে ফোনে না। তুই আমার হসপিটালে চলে আয়। আজ একসাথে লাঞ্চ করবো।তুই আসতে পারবি?

— আব্বার জিগায়? আমার জানে জিগার আইতে কইছে আর আমি আমু না।
— আবার শুরু করলি তোর ঢাকাইয়া ভাষা?
— ওপস সরি।আচ্ছা আমি আধঘন্টার মধ্যে আসছি ওকে।বায়।
— হুম আয়।
বলেই ফোন কেটে দেয় রৌদ্র।
ঠিক আধঘন্টা পর রেহান চলে আসে রৌদ্রর হসপিটালে।রৌদ্র তার কেবিনেই বসে আছে। রেহান কেবিনে ঢুকেই তার চিরচেনা দাত বের করা হাসিটি দেয়।রৌদ্রও তাকে দেখে মুচকি হাসে। রেহান এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
— তা ডাক্তার মশাই কি এমন গুড নিউজ শুনি যার জন্য আপনি এত খুশি।
— হু হু বলবো তার আগে নে মিষ্টি খা।বলেই একটা মিষ্টি রেহানকে খাইয়ে দেয় রৌদ্র। রেহানও মনের সুখে খেতে থাকে মিষ্টিগুলো।অতঃপর দুটো মিষ্টি খেয়ে রেহান আবারও বলে ওঠে,
— এবার তো বল ভাই।
— ওহ হ্যা শোন আমার বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে।
— ওহ তাই নাকি কংগ্রাচুলেশ…… এই ওয়েট ওয়েট কি বললি তুই? আবার বলতো। আমার মনে হচ্ছে আমি কিছু ভুল শুনলাম বোধহয়।

— বলেছি আমার বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে।
— মানে? তুই কি সামহাও রুহির কথা বলছিস?
— তা নয়তো কার কথা বলবো ডাফার।আমার কি রুহি ছাড়া আর কোন বিবাহ উপযুক্ত বোন আছে নাকি?
— ত-তু-ই ফ-ফান ক-করছিস নাতো রোদ?
— তুই কি আমার বেয়াই লাগিস নাকি যে তোর সাথে আমি ফান করবো?
— দেখ রৌদ্র। দিস ইজ ইম্পসিবল রুহির অন্য কারো সাথে বিয়ে হতে পারে না।
— মানে কি বলতে চাইছিস? এখানে ইম্পসিবলের কি আছে।
— আছে অনেক কিছুই আছে। প্লিজ রৌদ্র এই বিয়ে টা হতে দিস না এটা আটকা প্লিজ।
— আরে আজব তুই বিয়ে আটকাতে চাচ্ছিস কেনো? কি সমস্যা তোর।

— বিকজ আই লাভ হার।আই লাভ হার মোর দেন মাই লাইফ।আজকে কালকে থেকে নয় বরং ৯ বছর আগে থেকেই আমি রুহিকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি দোস্ত। চিৎকার দিয়ে কথাগুলো বলে ওঠে রেহান।
আচমকাই একটা বড়সড় ঘুষি তার মুখ বরাবর পড়ে। রেহান আচমকা আক্রমণে তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে অবাক চোখে তাকায় রৌদ্রর দিকে যে কিনা তার দিকেই চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে। রেহান হালকা ঢোক গিলে উঠে দাড়ায়।রৌদ্র তাকে আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই রেহান রৌদ্রর পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে, রৌদ্র রেহানের এমন আচরণে ভড়কে যায়। রেহান কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,

— ভাই মার যত ইচ্ছা মার। আমি কিচ্ছু বলবো না কিন্তু তবুও রুহিকে আমায় দিয়ে দে।বিশ্বাস কর ভাই আমি রুহিকে নিজের চাইতেও বেশি ভালো রাখবো, ওর বিন্দুমাত্র কষ্ট হতে দিবো না।প্লিজ ভাই আমার ওপর একটু ভরসা করে দেখ ভাই।একটু!
রৌদ্র রেহানের দিকে ঝুঁকে তার বাহু শক্ত করে ধরে দাড় করায়।রৌদ্র তাকিয়ে দেখে ছেলেটা কেমন মেয়েদের মতো কাঁদছে,ফর্সা হওয়ার দরুন একটু কাঁদতেই লাল হয়ে গেছে চেহারাটা।রৌদ্র বহু কষ্টে নিজের হাসি আটকিয়ে রেহানের কাঁধে হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বলতে থাকে,

— এত ভালোবাসিস তাহলে এতদিন স্বীকার করলি না কেন ডাফার।আর তুই ভেবেছিস আমি জানি না তুই রুহিকে পছন্দ করিস?
রেহান এ কথা শুনে অবাক চোখে রৌদ্রর দিকে তাকায়,কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠে,
— তুই জানতিস আমি ওকে পছন্দ করি।
— হুম জানতাম।আমার বোনের জন্য কোন একটা ছেলের চোখে একরাশ মুগ্ধতা আর ভালোবাসা সেটা কিভাবে ভাই হয়ে আমার চোখের আড়াল হবে বোকা।আমি বহু আগে থেকেই জানতাম তুই ওকে পছন্দ করিস।কিন্তু তুই কি রুহিকে বলেছিস এসব?
—না। আসলে আমি ভেবেছিলাম তুই জানলে না জানি কিভাবে রিয়েক্ট করিস এ বিষয়ে তাই আরকি এতদিন আগায়নি।
মাথা নিচু করে জবাব দেয় রেহান।

— হুম বেশ ভালো করেছিস।শুনলাম রুহি নাকি নিজেই এ বিয়েতে মত দিয়েছে। সরি দোস্ত রুহি যদি তোকে ভালো না বাসে তাহলে আমি তোর ব্যাপারটা ভাবতে পারছি না।শত হলেও বোনের মতের ওপরে আমি রৌদ্র জোর করবো না। বলেই গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বসে পড়ে নিজের চেয়ারে।
এদিকে রেহান হতবুদ্ধির ন্যায় দাড়িয়ে আছে এখনও।
-কি বললো ও? রুহি নিজেই এ বিয়েতে মত দিয়েছে। কতবড় সাহস ওর।আজ এর হ্যাস্তন্যাস্ত করেই ছাড়বো।ভেবেই কেবিন ছাড়তে উদ্যত হয় রেহান।যাওয়ার আগে পেছনে না তাকিয়েই রৌদ্র কে বলে,
— কাল আমি ফেমিলি নিয়ে তোদের বাড়ি আসবো। সবটা সামলে নিস।
বলেই গটগট পায়ে বের হয়ে যায় কেবিন থেকে।এদিকে রৌদ্র এখনো মিটমিট করে হাসছে। সে খুব ভালো করেই জানে রুহিও রেহানকে ভিষণ পছন্দ করে, হয়তো কিছু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে ওদের মাঝে সেটা নাহয় ওরাই মিটিয়ে নিক।পরিশেষে মন শুধু একটা কথাই বলছে,
“রেহান ইজ আ পারফেক্ট গায় ফর রুহি” (Rehan is a perfect guy for Ruhi)

রেহান খুব জোরে গাড়ি ব্রেক করে রুহির ভার্সিটির সামনে। রুহিকে বেশ কয়েকবার কল দেওয়ার পরও সে ফোন তুলেনি,এসবে রেহানের মেজাজ এখন তুঙ্গে। খুব কষ্টে নিজেকে সংবরণ করছে সে।ভার্সিটির সামনে আসতেই দারোয়ান তাকে আটকায় কেননা মহিলা কলেজে তো পুরুষ ঢোকা নিষেধ। রেহান বেশ কয়েকবার তাকে বলেছে একটু দেখা করে চলে আসবে তবুও দারোয়ান মানতে নারাজ। রেহান এবার দাত কিড়মিড়িয়ে ঘাড়ে হাত বোলায়।হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে এই ভার্সিটির একজন প্রফেসর তার পূর্বপরিচিত,তাই তাকেই কল করে রেহান।
প্রায় ১৫ মিনিট পর একজন মধ্যবয়স্ক লোক এসে উপস্থিত হন গেটের সামনে।তিনি আসতেই দারোয়ান তাকে সালাম দিয়ে গেট খুলে দেন।লোকটি রেহানের সাথে কুশল বিনিময় করে তাকে ভিতরে ঢুকতে দেন।লোকটির সাহায্যেই রেহান পৌঁছে যায় রুহির ক্যাম্পাসে।ক্যাম্পাসের করিডরে যেতেই সে দেখতে পায় রুহি কিছুটা উদাস ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে করিডরের শেষ মাথায়।রেহান রুহির কাছে গিয়েই তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় একটি খালি ক্লাসরুমে। এদিকে আচানক এমন হাত টানায় ভড়কে যায় রুহি।ভ্রু কুচকে হাত ধরে রাখা মানুষটির দিকে তাকাতেই দেখে রেহান রক্তলাল চোখ নিয়ে তার দিকেই চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে।রেহানের এমন তাকানোতে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় রুহি।মানুষটা কে এতটা রেগে থাকতে কখনো দেখেনি সে।রুহি কিছু বলতে যাবে তার আগেই রেহান খেঁকিয়ে বলতে থাকে,

— এই মেয়ে এই,তুমি নাকি নিজের ইচ্ছেতে বিয়েতে মত দিয়েছো? এতবড় সাহস তোমার?
রেহানের এমন প্রশ্ন শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে রুহি।
— আচ্ছা লোকটা কি করে জানলো তার বিয়ে তে মত দেওয়ার কথা?
রুহিকে চুপ থাকতে দেখে আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না রেহান,শক্ত করে দুবাহু চেপে ধরে রুহির, কটমট করে বলতে থাকে,
— চুপ করে আছো কেনো তুমি? মুখে কথা নাই এখন।আমাকে পাগল না করলে শান্তি হয়না তোমার তাই না?
রুহিও যেনো নিজের জমিয়ে রাখা রাগ আর আটকে রাখতে পারলো না,রেহানের দুহাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে কঠোর গলায় বলতে থাকে,

— আপনাকে এসব জবাব দিতে হবে কেন? আমি কাকে বিয়ে করবো নাকি করবোনা সেটার আমার ব্যাক্তিগত বিষয়, আপনি কে জিজ্ঞেস…..
আর শেষ করতে পারলো না রুহি।তার আগেই রেহান তার অধরে নিজের অধর মিশিয়ে দিয়েছে। রুহি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে সেদিকে,রেহানের যেনো সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই,সে তো চোখ বন্ধ করে নিজের প্রেয়সীর ঠোঁটের ভাজে ব্যাস্ত।রেহান যেনো কোন তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় যে কিনা বহুদিন পর নিজের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত।বেশকিছুক্ষন পর রুহির অধর ছাড়ে রেহান।কপালে কপাল ঠেকিয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিতে থাকে দু’জনে।দুজনের মাঝে এখন পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ রেহান হাস্কি স্বরে বলে ওঠে,
—এখন বলো আমি কে তোমার? যদি এখনও না বলতে পারো তাহলে নিজের হৃদয়কে জিজ্ঞেস করো আমি কে তাহলেই উত্তর পেয়ে যাবে।
রুহি রেহানের কথা শোনামাত্রই তাকে ঝটকা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়,অতঃপর কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে,

— আপনি, আপনি না বলেছিলেন আপনি অন্য একজনকে ভালোবাসেন।তাহলে এখন আমার সাথে এমন করলেন কেন?
রুহির এই কথায় মেজাজ বিগড়ে যায় রেহানের, কাটকাট গলায় বলে ওঠে,
— ওরে আহাম্মক এতকিছুর পরও এই কথা বলছো তুমি? ওরে খোদা কোন আহাম্মককে ভালোবাসলাম আমি।শোনো মেয়ে আমি এতটাও নির্লজ্জ না যে একজনকে ভালোবেসে অন্য একজনকে ছুয়ে দিবো।আমার হৃদ মাঝারে এতগুলো বছর ধরে যাকে আমি সযত্নে আগলে রেখেছি আজ আমি তাকেই ছুয়েছি। বুঝলে?
— তাহলে কি সেদিন ফোনে আমার কথাই বলেছিলেন আপনি?
— অবশ্যই সর্বনাশী।
রেহানের কথা শেষ হতেই হুহু করে কেঁদে ওঠে রুহি।এ কয়টাদিন না জানি কতকিছু ভেবে বসেছিলো সে।অথচ এই মানুষ টা নাকি তাকেই ভালোবাসে।
রুহিকে এমন কাঁদতে দেখে একটানে নিজের কাছে নিয়ে আসে রেহান।আলতো হাতে কোমর জড়িয়ে চোখ মুছে দেয় তার শ্যামবতী সর্বনাশীর।অতঃপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলতে থাকে,

— শ্যামবতী তুমি যদি এখনি কান্না না থামাও তাহলে আই সয়্যার আমি এক্ষুনি তোমাকে কামড়ে খেয়ে ফেলবো।তুমি নিজেও জানো না এই মুহুর্তে তোমায় ঠিক কতটা হট লাগছে।
আচমকা রেহানের এমন লাগামহীন কথায় দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম রুহির। রেহানের কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মোড়ামুড়ি করেও একচুল সরতে পারলো না সে,পারবেই বা কি করে? রেহানের মতো একজন বলিষ্ঠবান তার মতো এমন চুনোপুঁটিকে ধরে রাখলে আদৌও কি তা থেকে ছাড়া পাওয়া সম্ভব?
অবশেষে হাল ছাড়ে রুহি।কপট রাগ দেখিয়ে বলতে থাকে,
— ছিহ কিসব কথাবার্তা! ছাড়ুন আমায়।আমি মোটেও এমন লাগামহীন কথা বলা মানুষকে বিয়ে করবো না।
রুহির এমন কথায় কোমরে রাখা হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় করে রেহান,অতঃপর দুষ্ট হেসে বলে উঠে,
— আরেকবার বলো শুধু যে বিয়ে করবে না,আই সয়্যার এক্ষুনি তোমায় কোলে করে কাজি অফিস নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলবো প্লাস বাসরও সেড়ে ফেলবো।আমার কিন্তু অলরেডি মুড চলে আসছে। বাই দা ওয়ে, দা টেস্ট ওয়াজ ঠু গুড(By the way, the taste was too good)
বলেই ঠোঁট কামড়ে ধরে রেহান।
এদিকে রেহানের এমন কথায় চোখ মুখ কুচকে অন্যদিকে ফিরে রুহি বলে উঠে,

— নির্লজ্জ একটা।
— অভ্যাস করে নাও কলিজা।
— অসভ্য!
— তোমারই তো।
— উফফ।
— উফফ!
— কি শুরু করলেন আপনি? ছাড়ুন আমায়।
— আচ্ছা ছাড়বো বাট এক শর্তে।
— কি?
— কালকে তোমার বাড়ি যাবো ফেমিলি নিয়ে। তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে এক কথায় হ্যা বলবে।ওকে?
— কেনো হ্যা বলবো কেন? যদি না বলি?
— তাহলে কালকে সেখানেই সবার সামনে থেকে আপনাকে কোলে তুলে নিয়ে আসবো। তারপর বিয়ে করবো আর তারপর…. ইউ নো না…
বলেই চোখ টিপে রেহান।
রুহি রেহানের এমন সব উদ্ভট কথা শুনে আচমকাই বলে বসে,

— আপনি এতটা নির্লজ্জ? কই আগে তো বুঝি নি?
— মেডাম সকল পুরুষই তার শখের নারীর কাছে নির্লজ্জ। আর তাছাড়া আমি এখনো যথেষ্ট ডিসেন্ট, আগে বিয়ে টা হোক তারপর নাহয় নির্লজ্জ কাকে বলে,কত প্রকার ও কি কি তা প্র্যাক্টিকালি বুঝাবো কেমন!
— আল্লাহ! আপনার সাথে কথা বলাই বেকার ধূর।
কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে রুহি।
রেহান রুহির এমন কান্ডে হো হো করে হেসে উঠে, রুহির হাতটি শক্ত করে ধরে সেখান থেকে চলে আসে। ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার সময় রেহানের পরিচিত প্রফেসরটি রেহান আর রুহিকে দেখে জিজ্ঞেস করেন,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৯

— রেহান ও কে?
— মাই ওয়াইফ।
— ওহ গুড।
বলেই তিনি চলে যান।অন্যদিকে রেহানের মুখে এমন সম্মোধন শুনে রুহির বুকে হাজারো ভালো লাগায় ছেয়ে যায়।

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here