সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১১

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১১
Jannatul Firdaus Mithila

“ এই পানি দে…”
একপ্রকার হাঁপিয়ে ওঠে কথাটা বললো রৌদ্র। স্টেজের ওপর থেকে হেসে-খেলে নেমে আসে ছেলেটা।চোখে এখনো বরাবরের মতো কালো চশমা আঁটা।একহাতে লুঙ্গি উঁচিয়ে হি হি করে হাসছে ছেলেটা। নাচার দরুন শরীর প্রায় ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা! দূর থেকে আশেপাশের মেয়েরা যেন তাকে নিয়ে একপ্রকার কানাঘুঁষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেও কেও তো নিজের দৃষ্টিই ফেরাতে পারছেনা এই দুই সুদর্শনের ওপর থেকে। রৌদ্রের চৌকস উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটায় ঘামের বিন্দু গুলো রঙিন বাতির আলোতে কেমন চিকচিক করছে। শুধু যে তাকেই আশেপাশের মেয়েরা চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে এমন না। রৌদ্রের পাশে থাকা অনিক বেচারাও যে ইতোমধ্যেই বহুজনের নজরে পড়েছে। ছেলেটার গোলগাল ফর্সা মুখটা ঘামে ভিজে লাল হয়ে আসার উপক্রম। চোখ থেকে চশমা খুলে সেটা ঝুলিয়ে রেখেছে গলার কাছে। ছেলেটার থুতনিতে ভাজ পড়া, তারওপর গালভরা হাসি যেন এ মুহুর্তে তাকে বড্ড প্রানবন্ত করে তুলেছে। অনিক, রৌদ্র একসাথে লুঙ্গি উঁচিয়ে হেঁটে আসে সামনের দিকে। ঠিক তখনি তাশরিক সাহেব এসে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে দু’জনকে। অতপর উল্লাসীত কন্ঠে বলে ওঠে,

“ আহ! আমার দুই বাপজান তো এক্কেবারে ফাটিয়ে দিয়েছো। খুব ভালো হয়েছে তোমাদের নাচটা।”
কথাগুলো বলে তাদেরকে ছেড়ে দিলেন তাশরিক সাহেব। হাসি হাসি মুখে কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলেন কিছু একটা। তারপর ভাবনা শেষে সন্দীহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“ কিন্তু তোরা এতো সুন্দর নাচ শিখলি কবে? ”
এহেন কথায় মুখ টিপে হাসতে লাগলো অনিক। রৌদ্রও একবার মুচকি হাসলো। পরক্ষণেই রাশভারী গলায় বললো,
“ বহু আগে থেকেই এটার প্র্যাকটিস করছিলাম চাচ্চু। সারপ্রাইজ দিবো বলে কাওকে জানাইনি।”
তাশরিক সাহেব আবারও হাসলেন। মাথা ঝাকিয়ে দুজনের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“ বাপজান আমার! তোদের দু’জনকে দেখেতো মনে হচ্ছে আমি আমার যৌবনের দিনগুলোকে আবারও দেখে ফেললাম। আমিও কিন্তু তোদের মতো এমনই নাচতাম। ”
পরক্ষণেই একবার আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে আরেকটু সতর্ক হয়ে নিচু গলায় বললেন,
“ বন্ধু-বান্ধবদের বিয়েতে আরকি! কিন্তু বড় ভাইজানেরা এসব জানেনা।”
বলেই আবারও হাসতে লাগলেন তাশরিক সাহেব। তাকে দেখে রৌদ্র আর অনিকও হেসে ওঠে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ ভাইয়া! তোমরা দুজন এত্তো সুন্দর নাচতে পারো! আমারতো এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না, আমি সত্যি তোমাদের নাচতে দেখেছি। ”
রুহিন এমন আপ্লূত কথায় মুচকি হাসলো রৌদ্র। বোনের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে তাকে সযত্নে বুকে টেনে জিজ্ঞেস করে,
“ কেমন লাগলো সারপ্রাইজটা?”
রুহি ভাইয়ের বুকে মাথা রেখেই খিলখিল করে হাসছে। গলায় একরাশ মুগ্ধতা এনে ফটফট কন্ঠে বললো,
“ জাস্ট ফ্যাব্! সত্যি তুমি আর অনি ভাইয়া ফাটিয়ে দিয়েছো একদম। ”
“ এই, শুধু কি রোদ আর অনিকই নেচেছে নাকি? আমি আর রামিমও তো নেচেছি।কই আমাদের কথাতো বললি না। হুহ্!”
পেছন থেকে আসিফের মেকি অভিমানী কন্ঠ কানে আসতেই জিভ কাটে রুহি।ভাইয়ের বুক থেকে সরে এসে আসিফের দিকে তাকায় মেয়েটা। মুখে একটা মিষ্টি হাসি টেনে আসিফের একহাত জড়িয়ে ধরে নিজেকে শুধরে নেবার ন্যায় বললো,

“ আরে! আমি তোমাদের কথাও বলতাম।কিন্তু তার আগেই তুমি কথাটা বললে বিধায় আর বলা হলোনা।”
আসিফ রুহির অলক্ষ্যে হাসলো। তৎক্ষনাৎ মুখে আবারও মেকি অভিমানী ছাপ বজায় রেখে বললো,
“ থাক থাক! আর ঐ মিষ্টি কথা বলে ঘুষ দিতে হবে না। ঐদুটো বাদর আগে থেকেই প্ল্যানিং করে প্র্যাকটিস করে রেখেছিলো আর আমায় কিনা বললো দুদিন আগে! তো এই দুদিনে কি আর এরচেয়ে ভালো নাচা সম্ভব বল?”
রুহি তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়ালো।আসিফের কথায় সায় দিয়ে তার পক্ষ টেনে বললো,
“ হ্যা তাইতো! তুমি মাত্র দুদিনে এতো ভালো কভার করতে পেরোছে,তাহলে ভাবো একবার।তুমি যদি আরও আগে থেকে প্র্যাকটিস করতে তাহলে নির্ঘাত ওদের চেয়ে ভালো করতে।”
“ এক্স্যাক্টলি! আমিও তো ঐটাই বলি।”
রুহি আর আসিফের এহেন কথোপকথনে উপস্থিত বাকিরা ঠোঁট টিপে হাসছে। এ মুহুর্তে তারা মুখ খোলা মানেই ব্যাপারটা আরেকটু ঘেটে যাওয়া। কি দরকার বেচারা আসিফকে আরেকটু ঘাটার?

“ এতো ভালো নাচ শিখলি কবে তোরা? আমিতো একটা মুহূর্তের জন্যও নিজের দৃষ্টি ফেরাতে পারলাম না তোদের ওপর থেকে। ”
মেহরিন বেগমের কথায় মুচকি হাসলো রৌদ্র। সে মুখ খুলবে তার আগেই পাশ থেকে অনিক ছটফট কন্ঠে বলে,
“ ওটাতো একটা ছোট -খাটো সারপ্রাইজ ছিলো ফুপ্পি। এটুকুতেই এতোটা অবাক হলে চলবে? সামনে তো আরও আছে। ”
মেহরিন বেগম অবাক হলেন।তিনি কিছু বলবেন তার আগেই পাশ থেকে রাইসা বেগম বলে ওঠেন,
“ বাহ! এতক্ষণে না একটা বিয়ে বাড়ির ফিল আসছে। তা আর কি কি সারপ্রাইজ বাকি আছে তোমাদের? ”
“ তা সময় আসলেই দেখতে পারবে ছোটমা।এখন আপাতত সেটা সারপ্রাইজই থাক।”
রৌদ্রের কথায় আলতো হাসলেন রাইসা বেগম। তারা সবাই আরও কিছু কথা বলছিলো, তখনি রাফিয়া বেগম সেখানে উপস্থিত হন।হাতে তার জুসের ট্রে।তিনি ট্রে -টা অনিক আর রৌদ্রের সামনে এগিয়ে বললেন,
“ একটু জুস খেয়ে নেও আব্বু। শরীরটা তো একেবারে ঘেমে গেছে। ”

অনিক তো রাফিয়া বেগমের কথা শেষ করবার আগেই গ্লাস তুলে গটগট করে গিলে ফেলে সবটা।উপস্থিত সবাই তার এমন কান্ডে আরেকদফা হেসে ওঠেন। কিয়তক্ষনা বাদে রৌদ্র একটা গ্লাস উঠিয়ে বললো,
“ মেজো মা! আসিফ ভাইয়া আর রামিমকেও দিতে হবে।”
“ ও নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। আমি দিয়ে এসেছি ওদের।”
পেছন থেকে মায়ের কন্ঠ কানে আসতেই ফিরে তাকালো রৌদ্র। জুবাইদা বেগম মৃদু হেসে এগিয়ে আসেন ছেলের কাছে। ছেলেকে একটু নিচু করে তার কপালে একটা ছোট্ট চুমু বসিয়ে দেন সন্তপর্ণে। তারপর ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে বলেন,
“ আমার ছেলেগুলোতো দেখছি সবকিছুতেই অলরাউন্ডার! ”
মায়ের কথায় আলতো হাসলো ছেলেটা। মা’কে নিজের বাহুডোরে আগলে নিয়ে বললো,
“ দেখতে হবে না, ছেলেটা কার?”
রৌদ্রের এমন কথায় উপস্থিত সবাই একসাথে সায় দিয়ে ওঠে। এরই মাঝে অনিক মেকি গাল ফুলিয়ে নাক টেনে বললো,

“ শুধু রোদ ভাইকেই চুমু? আর আমাকে একটাও না তাই-না? ”
জুবাইদা বেগম ফিক করে হেসে দিলেন ছেলেটার কথায়।রৌদ্রকে ছেড়ে দিয়ে অনিকের কাছে গিয়ে, ছেলেটার কানটা হালকা টেনে দিয়ে বললেন,
“ ইশশ্! তোমায় কি আদর না করে থাকা যায় আব্বা? ”
বলেই তিনি কান ছেড়ে দিয়ে সযত্নে চুমু খেলেন অনিকের কপালে। পরপর দুটো চুমু খেয়ে বললেন,
“ খুব ভালো নেচেছো আব্বা! ”
“ তোমার পছন্দ হয়েছে বড়মা?”
“ পছন্দ বৈকি! খুব পছন্দ হয়েছে। ”

“ এই মেয়ে শোনো!”
অচেনা কারো ডাকে পেছনে ফিরে অরিন।পেছনে তাকাতেই দেখতে পেলো রাইসা বেগমের বড় ভাইয়ের ছেলে রামিমকে।রামিম একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে এগিয়ে আসে অরিনের কাছে। প্রায় অনেকটা কাছাকাছি এসে বলে,
“ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। ”
হুট করে এমন প্রশংসা শুনে অন্য কারোর খুশি হওয়া থাকলেও অরিন যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হলো।সে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,
“ জি ধন্যবাদ। আপনাকেও যথেষ্ট সুন্দর লাগছে। ”
অরিনের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে রামিমের যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাবার ন্যায় অবস্থা। সে আবারও চমৎকার হেসে বললো,

“ হ্যা তা আমি জানি। আচ্ছা ওসব বাদ দাও।আগে বলো, আজকে আমাদের নাচ কেমন লাগলো তোমার? ”
অরিন থমকালো।তৎক্ষনাৎ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখনকার করা রৌদ্রের নাচ। মেয়েটা অন্য কারো নাচ দেখলে না বলবে কেমন হয়েছে! সে-তো শুরু থেকেই তার রোদ ভাইয়ের দিকে অনিমেষ চোখে তাকিয়ে ছিলো।কতবার যে চেয়েছিলো নিজের চোখটাকে সরাতে কিন্তু বেহায়া চোখদুটো সে কথা মানলে তো! অরিনকে এমন নিজের ভাবনায় বিভোর থাকতে দেখে তার সামনে তুড়ি বাজালো রামিম। সাথে সাথে চমকে উঠে অরিন।খানিকক্ষণ হাসফাস করতে থাকে মেয়েটা।পরমূহুর্তে রামিমকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান ঘটায় অরিন।
অন্যদিকে তার এহেন ব্যাবহারে পুরোদস্তুর অবাক হলো ছেলেটা।মনে মনে ভাবছে, এটা কি হলো?
আড়ালে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সবটাই পরোখ করছিলো রৌদ্র। ইশশ্ বিয়ে বাড়ি নাহলে আজকে যে রামিমের কি হতো!

“ এই রোদ দাড়া!”
চলতি পাগুলো হঠাৎ ডাকে থেমে যায় রৌদ্রের। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় শিশির হন্তদন্ত হয়ে হয়ে তার দিকেই ছুটে আসছে।রৌদ্র সটানভাবে দাড়িয়ে রইলো নিজ জায়গাতে। কিয়তক্ষন বাদেই শিশির তার সামনে এসে হাঁপাতে থাকে। ছুটে আসার দরুন মেয়েটা হাঁপিয়ে উঠেছে কেমন।রৌদ্র কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে রইলো ভ্রুকুটি করে। অতপর মিনিট খানেক পর রাশভারী গলায় বলে ওঠে,
“ কি সমস্যা? এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন?”
শিশির তৎক্ষনাৎ উওর দিতে পারলো না।আর পারবেই বা কিভাবে? মেয়েটা তো হাঁপিয়েই কুল পাচ্ছে না। শিশিরকে চুপ করে থাকতে দেখে রৌদ্র আবারও তাড়া দিয়ে বলতে থাকে,

“ কিরে? কিছু বলবি? না-কি আমি চলে যাবো? আমার একটা কাজ আছে। যেতে হবে ইমিজিয়েটলি। ”
রৌদ্রের এমন ব্যাবহারে খানিকটা অবাক হলো শিশির। মেয়েটা তার সামনে এমন হাঁপাচ্ছে অথচ সে কি-না নিজের ব্যাস্ততা দেখাচ্ছে তাকে। কোথায় সে আরও সফট হয়ে কথা বলবে তা-না করে সে এমন বিহেভ করছে? বিষয়টা ভাবতে ভাবতেই শিশিরের মনঃক্ষুণ্ন হলো।মেয়েটার চোখদুটোর কোটর ভরে আসলো মুহুর্তেই। সে ছলছল চোখজোড়া আড়াল করে মাথানিচু করে দাড়িয়ে রইলো রৌদ্রের সামনে। অন্যদিকে এখন রৌদ্রের মন মেজাজের যা অবস্থা! তাতে করে এ মুহুর্তে তার কাছে অন্যকারো অতি মিষ্টি কথাও যেন ভিষণ তেতো ঠেকছে।এ মুহুর্তে ছেলেটা শিশিরের কান্ডে যথেষ্ট বিরক্ত হলো। বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে ফেলে একপ্রকার খেঁকিয়ে ওঠে সে,
“ এই! তুই কিছু না বললে আমি আটকালি কেন? তোর কাছে কি মনে হয়, আমার কাছে অঢেল ফুরসত পড়ে থাকে? শুনে রাখ শিশির! আমার কাছে নষ্ট করবার মতো একদম সময় নেই। আর ভুলেও কখনো এমন করে আমার সময় নষ্ট করবিনা।”

শক্ত কথাগুলো শেষ করে রৌদ্র তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে প্রস্থান ঘটায়। অন্যদিকে তার চলে যাওয়ার পানে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো শিশির। মেয়েটার বুকটায় কেমন হঠাৎ করেই ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো। এতোগুলা বছরে একবারের জন্যও রোদ তার সাথে এতোটা শক্ত ভাষায় কথা বলেনি।তাহলে আজ হঠাৎ কি হলো ছেলেটার? সত্যিই কি ও রোদের সময় নষ্ট করে? ওর সাথে কথা বলাও কি রোদের জন্য সময় নষ্ট? আচ্ছা রোদ না ওকে ভালোবাসে? তাহলে ওর ছলছল চোখ দেখেও কেন থমকালো না রোদ? কেন ওর কন্ঠ নরম হলোনা? আচ্ছা! রোদ সত্যি ওকে ভালোবাসেতো?

“ আরে! আপনাকে কতবার বললাম আমি ওই আইসক্রিমটাই নিবো!”
“ আরে আফা! দোকানে ঐডা এক পিসই আছিল।এহনতো ঐডা শহুরে ভাইজান নিয়া গেলো।আমি আফনেরে এহন কইত্তে দেই কনতো?”
দোকানীর কথায় আরেকদফা খেঁকিয়ে উঠলো ফারিন। চোখেমুখে স্পষ্ট রাগ ফুটিয়ে বলতে লাগলো,
“ আপনিতো আচ্ছা লোক! আমি প্রথমে এসে ঐ আইসক্রিমটার দাম দিলাম আর আপনি কি-না আমার কেনা আইসক্রিম আমায় না দিয়ে অন্য একজনকে দিয়ে দিলেন? এটা কেমন নীতি? ”
ফারিনের কথায় দোকানী চুপ করে গেলো।মুহুর্তেই লোকটার চোখ-মুখে ফুটে ওঠে অপরাধী ছাপ! তিনি খানিকক্ষণ আমতা আমতা করে বললেন,

“ আফা ছরি! আসলে দোকানডাত এত্তো ভিড় আছিল যে আমি ভুলে আফনেরটা আরেকজনেরে দিয়া লাইছি।। আমি এহন কি করমু কন?”
লোকটার ভুলস্বীকার করা দেখে থামলো ফারিন। কিছুক্ষণ রাগে গজগজ করতে করতে পাশে থাকা মেয়েটার হাত ধরে হাঁটা শুরু করে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে। অন্যদিকে দোকানী আফসোসের চোখে তাকিয়ে দেখলো তাদের চলে যাওয়া।ঠিক তখনি তার সামনে একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দেয় একজন,
“ নিন আইসক্রিমের টাকাটা রাখুন। ”
অনিকের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলো দোকানী। অনিকের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,
“ আফনেরে আইসক্রিমডা দিছিলাম? ”
অনিক ভ্রু-কুচকালো। বললো,
“ হ্যা তো?”
দোকানী এবার নিজের ভুলগুলো আবারও বলতে শুরু করে,
“ আর কইয়েন না ভাই! আরেকটু আগে দুইজন আফা আইছিলো,তারা আফনের খাওয়া আইসক্রিমডার দাম আগেই দিয়া ফেলাইছিল।তহনি আপনিও ঐ আইসক্রিমডাই চাইছিলেন। আর আমার দোকানে ভীড় বেশি থাকায় আমিও আর খেয়াল করি নাই আমি কারে দিতাছি।”

অনিক লোকটার কথায় অবাক হলো।মনে মনে তারও কোথাও অপরাধবোধ অনুভব হচ্ছে। সে দোকানিকে বললো,
“ আচ্ছা মেয়েগুলো কোনদিকে গিয়েছে? ”
“ ঐতো ঐদিকে”
দোকানীর কথা মোতাবেক অনিকও ছুট লাগায় সেদিকে। তাকে এমন ছুটতে দেখে অদূরে দাড়িয়ে থাকা রৌদ্র কিছুটা অবাক হলো।পরক্ষণে সেও পিছু নিলো অনিকের।
বেশ কিছুটা পথ সামনে এগোতেই মেয়ে দুটোর দেখা পায় অনিক। সে পেছন থেকে ডাক ছুড়লো তাদের উদ্দেশ্যে,
“ এই যে মিস! শুনছেন? একটু দাড়ান প্লিজ!”
হঠাৎ কোন আগন্তুকের ডাকে থমকায় মেয়ে দুটো। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে পেছনে ফিরলো ফারিন।তৎক্ষনাৎ তার হাতদুটো চেপে ধরে পাশের মেয়েটা। ফারিন তার পাশে থাকা মেয়েটার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় মেয়েটার ভীতসন্ত্রস্ত চাহনি। ফারিন চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো মেয়েটাকে। পরক্ষণেই আবার পেছনে ফিরে অনিকের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলে,

“ কি হয়েছে? ওভাবে ডাকছেন কেন?”
অনিক এগিয়ে আসে।চোখেমুখে খানিকটা লজ্জিত ভাব ফুটিয়ে তুলে বলে,
“ আসলে তখন আপনাদের আইসক্রিমটা আমিই খেয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন আমি একদমই জানতাম না বিষয়টা।”
ফারিন এতক্ষণে বুঝলো ব্যাপারটা।কপাল হতে বিরক্তির ভাব সরিয়ে আগের ন্যায় বললো,
“ ওহ! বুঝলাম। যাইহোক আর কিছু?”
মেয়েটার ওমন সোজাসাপ্টা কথায় ভড়কালো অনিক।ছেলেটা কিছুক্ষণ থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলতে লাগলো,
“ না,আর কিছু না। ”
অনিকের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আবারও হাঁটা শুরু করে মেয়ে দুটো। কিছুটা পথ এগোতেই সামনে থেকে আসা একটা অটোরিকশা হুট করে ফারিনের পাশের মেয়েটার পায়ের ওপর উঠিয়ে দেয়। মেয়েটা তৎক্ষনাৎ ব্যাথাতুর শব্দ করে ধপ করে বসে পড়ে মাটির রাস্তাটায়। এতক্ষণ পেছন থেকে তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো অনিক।যে-ই না পুরো ঘটনা তার বোধগম্য হলো,তখনি সে তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে তাদের কাছে। ব্যাথা পাওয়া মেয়েটা মাথানিচু করে বসে ছিলো মাটিতে। অনিক সেদিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,

“ মিস! আপনি খুব বেশি ব্যাথা পেয়েছেন? ”
তার ওমন উদ্ভট কথায় বিরক্ত হলো ফারিন।খেঁকিয়ে ওঠে বলতে লাগলো,
“ আশ্চর্য! আপনি কি বোকা? একটা মানুষের পায়ের ওপর রিকশার চাপ লেগেছে আর আপনি কি-না তাকেই জিজ্ঞেস করছেন সে ব্যাথা পেলো কি-না? ”
ফারিনের কথায় থতমত খেয়ে যায় অনিক।বেচারা আবারও লজ্জিত হলো নিজের বোকামিতে। ফারিন এবার অনিকের থেকে নজর সরিয়ে রিকশা ওয়ালার দিকে রাখলো। পরক্ষণে মুখাবয়ব আরও কিছুটা শক্ত করে গলায় ঝাঁঝ এনে বললো,

“ ওই মিয়া ওই! নিচে নামেন। এক্ষুনি নিচে নামেন কইতাছি। ”
রিকশা ওয়ালা ভড়কে যায় ফারিনের কথায়।লোকটা হালকা ফাঁকা ঢোক গিলে রিকশা ছেড়ে নিচে নামে। নিজের দোষ থাকা স্বত্তেও তা একপ্রকার উপেক্ষা করে বলতে থাকে,
“ দেহেন আফা! আমার কোন দোষ নাই। হেইতিই হুট কইরা আমার রিকশার পায়ার সামনে আয়া পড়ছে। এহন এনে আমার কি দোষ বলেন? ”
লোকটার কথায় আরেকদফা মেজাজ বিগড়ে যায় ফারিনের।সে বেশ কিছুক্ষন তর্ক করতে থাকে লোকটার সঙ্গে। পরক্ষণেই আর কুলোতে না পেরে বলে ওঠে,
“ ওই আপনি চিনেন আমি কেডা? আমি হইছি এই এলাকার মেম্বরের মাইয়া। তুরাগ মজুমদারের একমাত্র মেয়ে মাহেলা ফারিন।আর শুধু এটাই না, আমার নানা কে জানেন? আব্দুল মান্নান এহসান। এইবার বুঝ রাইখা কথা কইয়েন।”

সামনে থাকা রিকশা ওয়ালা তৎক্ষনাৎ চমকে উঠে ফারিনের কথায়। লোকটা ভয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে আমতা আমতা করতে থাকে।
“ হাছা? আফনে মেম্বরের মাইয়া?”
“ ওই মিয়া! হাছা মানে? আফনে কি আমার বেয়াই লাগেন নাকি যে আপনের লগে মিছা কতা কইয়া মশকরা করতে অইবো! ”
এহেন কথায় রিকশা ওয়ালার মুখটা তৎক্ষনাৎ চুপসে যায়।সে নিজের ভুল স্বীকার করে ফারিনের কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে অনবরত।
অন্যদিকে পেছনে দাড়িয়ে থাকা অনিক হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে। বারবার তার মনে হচ্ছে, কানটা বুঝি মাত্রই ভুল শুনলো।আসলেই কি ও যা ভাবছে, তাই সত্যি? মেয়েটা সত্যিই এহসান বাড়ির? নিজের ভাবনার একপর্যায়ে অনিকের খেয়াল হলো মাটিতে উবু হয়ে গোঙাতে থাকা মেয়েটাকে।অনিক তার সামনে একহাটু গেড়ে বসে পড়ে। নিজের একহাত বাড়িয়ে মেয়েটার সামনে এগিয়ে ধরে বললো,
“ মিস! আমার হাতটা ধরে ওঠার চেষ্টা করুন।”

তৎক্ষনাৎ মাথা উঁচিয়ে তুললো মেয়েটা।যা দেখে থমকে গেলো অনিক।হুট করেই গায়ে যেন তার এক অদ্ভুত শিরশিরানি বয়ে গেলো।ছেলেটা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার পানে। হয়তো চোখদুটো তার সত্যি বিশ্বাস করতে পারছে না মেয়েটাকে। অনিক ফাঁকা ঢোক গিললো। চোখের পাতাও বুঝি থমকে গেছে ছেলেটার।ঠিক তখনি পেছন থেকে ভেসে আসে ফারিনের তেজঃপূর্ণ কন্ঠ!
“ এ-ই যে সরেন সামনে থেকে। এই ইকরা আয় তো,আমার হাতটা ধরে একটু কষ্ট করে রিকশাটায় উঠে বস।উনি যেহেতু তোর ক্ষতি করছে,সেহেতু উনার রিকশাতেই বাড়ি অবধি যাবো।চল!”
ফারিনের কথায় ইকরা সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লো।ফারিনের বাড়িয়ে রাখা হাতটা আঁকড়ে ধরে বহুকষ্টে উঠে দাড়ায় মেয়েটা।তারপর কোনরকমে হেঁচড়ে হেঁচড়ে চলে যায় রিকশা অবধি। রিকশায় উঠে পড়তেই রিকশাটা ছুটে চলে ধীর গতিতে। অন্যদিকে অনিক বেচারা এখনো আগের ন্যায় বসে আছে মাটিতে। সে কিয়তক্ষন বাদেই উঠে দাড়িয়ে হতভম্বের ন্যায় বিড়বিড়িয়ে বললো,

“ মায়াবিনী! ”
ঠিক তখনি কাঁধে কারোর শীতল স্পর্শ পেতেই চমকে উঠে অনিক।তৎক্ষনাৎ পাশে তাকাতেই দেখতে পায় রৌদ্রকে।অনিক কিছুক্ষণ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই বলে উঠে,
“ ভাইয়া! ওই মেয়েটা!”
“ হুম। ইকরা।সায়্যেদা জান্নাত ইকরা।আমাদের বড় ফুপ্পির মেয়ে।”
আরেকদফা অবাক হলো অনিক।অবাকের জেরে এক-কদম পিছিয়ে যায় ছেলেটা। হতবাক হয়ে বললো,
“ মায়াবিনী বড় ফুপ্পির মেয়ে?”
রৌদ্রের মুখভঙ্গি একবারেই নিরুত্তাপ। সে কোনরূপ ভনিতা ছাড়াই উত্তর দেয়,
“ হ্যা।”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১০

অনিক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।মাথানিচু করে দাড়িয়ে রইলো নিজ জায়গাতে। তা দেখে এগিয়ে আসে রৌদ্র। অনিকের কাঁধে আলতো হাত রেখে বলে,
“ ইকরা বড় ফুপ্পির মেয়ে বলে কি তুই পিছিয়ে যাবি?”
তড়িৎ গতিতে মাথা তুললো অনিক।গলায় যথেষ্ট দৃঢ়তা এনে বলে ওঠে,
“ যাকে একবার এই মনের মনিকোঠায় বসিয়েছি তাকে এতো সহজে কিভাবে ছাড়ি বলোতো? এটা যে সম্পূর্ণ অসম্ভব

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here