সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৩

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৩
Jannatul Firdaus Mithila

“ আটকাস না অরি! নাহলে এখন যা হবে, তা না তোর জন্য ভালো হবে আর না আমার জন্য! ”
তৎক্ষনাৎ কেঁপে ওঠে রৌদ্রের হাতটা ছেড়ে দেয় অরিন।কি ছিলো কথাটায়? কি এমন ছিলো,যা কি-না ভেতর থেকে কাপিয়ে তুললো মেয়েটাকে! মুহুর্তেই মনে হলো, এক শীতল স্রোত নেমে গেলো তার শীরদাড়া বেয়ে। মেয়েটা আরেকটু গুটিয়ে নেয় নিজেকে।

ওদিকে তার এমন আটকানোতে থমকে দাঁড়ায় রৌদ্র। অরিনের হাতের আলতো টান, সেই পরিচিত স্পর্শ, তার সম্পূর্ন শরীরজুড়ে এক অজানা শিহরণ তুলে দেয়। যেই শিহরণে আপাতত প্রেমের উপস্থিতি নেই, আছে শুধু ভয়, দ্বিধা,কোন কিছুকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আর একরাশ অপরাধবোধ। রৌদ্র ঠোঁট গোল করে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার কি এক আপ্রাণ চেষ্টা ছেলেটার! ইতোমধ্যেই তার সম্পূর্ণ দেহ ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা! ছেলেটা বহুকষ্টে ধীরে ধীরে পেছনে ঘোরে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চোখ পড়ে বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকা স্নিগ্ধ মেয়েটার পানে।যাকে কি-না এ মুহুর্তে তার কাছে এক সদ্য পরিস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় ঠেকছে।রৌদ্র নিজের খেই হারায়। ঘোরলাগা নয়নে তাকিয়ে থেকে ধীরগতিতে এগিয়ে আসে মেয়েটার দিকে। রৌদ্রকে এভাবে নিজের কাছে আসতে দেখে শুষ্ক ঢোক গিলে অরিন।ভীত চোখে তাকিয়ে থাকে রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র প্রায় বেশ খানিকটা দুরত্ব ঘুচিয়ে দাড়ায়। অনিমেষ চোখে পরোখ করে মেয়েটাকে।মেয়েটার চোখে একরাশ কথা জমে আছে,হয়তো বলার জন্য ভাষা খুজে পায়নি। কপালের সামনের চুলগুলো এলোমেলো, ঠোঁটদুটো কেমন তিরতির করে কাঁপছে! মেয়েটার এহেন সৌন্দর্য যেন বারবার পাগল করে দিচ্ছে ছেলেটাকে। রৌদ্র এবার কেমন ঘোরলাগা কন্ঠে বললো,

“ অরি! কেন আটকালি আমায়?”
চট করে চোখ তুলে তাকায় মেয়েটা।রৌদ্রের চোখে চোখ পড়তেই থমকে যায় সে। আশ্চর্য! এ কোন দৃষ্টি লোকটার চোখে? এমন দৃষ্টিতো সে আগে কোনদিন দেখেনি! তাহলে আজ হঠাৎ এই দৃষ্টি কেন? কি আছে এই দৃষ্টিতে, যা তাকে এতোটা টানছে? অরিন শতো চেষ্টা চালিয়েও নিজের দৃষ্টি সরাতে পারলোনা সেই ঘোরলাগা চক্ষুদ্বয় হতে। ভাব এমন, কেও বুঝি মেয়েটাকে হুকুম করেছে— চোখ সরালেই বিপদ! অরিন অধর জোড়া জিভ দিয়ে খানিকটা ভিজিয়ে নেয়। ওদিকে তার এহেন কান্ডে তৎক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে নেয় রৌদ্র। মুখ ফুটে বলে ওঠে,

“ উফফ!”
অরিন ভড়কে যায়। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে রৌদ্রের দিকে। কিছুক্ষণ পর রৌদ্র চোখ মেলে। অস্থির গলায় বলে,
“ তোর যদি ইচ্ছে হয় তাহলে আমায় মেরে ফেল।তবুও এমনটা করিস না।”
অরিন আঁতকে ওঠে। চোখদুটো বড়সড় করে বলে ওঠে,
“ মানে! কি বলছেন এসব?”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো না। একদৃষ্টিতে মেয়েটার ফর্সা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“ আমার ভয় করছে অরি!”
বিচলিত হলো মেয়েটা। গলায় একরাশ চিন্তার ছাপ ফেলে বললো,
“ ভয়? কিসের ভয়?”
রৌদ্র কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,
“ তোর সামনে থাকার ভয়!”
এহেন কথায় বেশ অবাক হলো অরিন।মেয়েটা কেমন অবাক হয়ে বললো,
“ মানে?”

রৌদ্র এবার আরেকটু এগিয়ে আসে। অরিনের দিকে হালকা ঝুঁকে এসে ভারিক্কি গলায় বলে,
“ অরি!নিঃসন্দেহে তুই একটা জ্বলন্ত আগুন। তুই নিজেও জানিসনা তুই ঠিক কতটা ভয়ংকর উত্তাপ দিস।যদি তুই জানতি,তাহলে আজ আমায় আটকানোর ভুলটা মোটেও করতিস না। এতো পোড়াস কেন আমায়? কি লাভ আমায় আঙ্গার বানিয়ে? যদি বলি, এতে তোরই ক্ষতি!”
থামলো রৌদ্র। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে।খেয়াল করলো, মেয়েটার সর্বাঙ্গ কেমন কাপছে। রৌদ্র বাঁকা হাসে। মেয়েটার মনোভাব বেশ আচঁ করতে পারছে সে। রৌদ্র এবার অদ্ভুত শান্ত অথচ নিরেট কন্ঠে বললো,
“ এতো কাঁপতে হবে না সোনা! এবার নাহয় ঘুমিয়ে পড়।গুড নাইট এন্ড সুইট ড্রিমস। ”

বলেই সোজা হয়ে দাড়িয়ে পড়ে রৌদ্র। তারপর আর কিছু না বলে গটগট পায়ে প্রস্থান ঘটায় রুম থেকে। এদিকে বিছানায় বসে এখনো কেঁপে যাচ্ছে মেয়েটা। কি হচ্ছে তার সাথে! মানুষটার কথাগুলো আজ কেমন অন্যরকম ঠেকলো তার কাছে।কি ছিলো সেই কন্ঠে? কেন এমন বললো সে?

রৌদ্র ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে সামলাতে চেষ্টা করে নিজেকে। কি একটা অবস্থা! এ কেমন তান্ডব শুরু হলো বুকটায়? ছেলেটা কি আর বাঁচবে না? নাহলে তার কেন নিশ্বাস আটকে আসছে বারংবার। রৌদ্র মাথানিচু করে দাড়িয়ে রয়।খানিকক্ষণ বাদে নিজের ডানহাতটা সামনে এনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেলো,তখনকার সেই স্পর্শ! এই আঙুল গুলো… হ্যা এই আঙুল গুলো কিছুক্ষণ আগে প্রথমবারের মতো এতোটা কাছ থেকে ছুয়ে দিয়েছিলো তার সানশাইন কে। রৌদ্র চোখ বন্ধ করে নেয়। ঠোঁট ঠোঁটে চেপে রাখে কিছুক্ষণ। তারপর বিরবির করে বলতে থাকে,
“ হুটহাট কেন আমায় এমন পাগল করিস সানশাইন! এতে যে নিজেকে সামলাতে ব্যপক কষ্ট হয় আমার। তুই কেন বুঝিস না এসব?”

পরদিন সকালবেলা 🌸
রান্নাঘরের পরিবেশ বেশ জমজমাট। চলছে নানানরকম ব্যান্জনের রন্ধন। রাফিয়া বেগম ব্যস্ত হাতে খুন্তি নাড়ছেন তরকারির পাতিলে।অন্যদিকে রাইসা বেগম আর বৃদ্ধ আমেনা বেগম কাটাকুটিতে নিবদ্ধ। মাইমুনা বেগম টেবিল সেট করছেন। আর এদিকে জুবাইদা বেগম রুটি সেকছেন। এহেন ব্যস্ততার মধ্যে হঠাৎই রাফিয়া বেগম খেয়াল করলেন, জুবাইদা বেগম কেমন অন্যমনস্ক হয়ে দাড়িয়ে আছেন চুলোর সামনে। ওদিকে রুটির একপাশ পুড়ে যে গন্ধ বেরোচ্ছে তার দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই মানুষটার। রাফিয়া বেগম তড়িঘড়ি করে চুলোর জ্বালটা নিভিয়ে দিলেন। জুবাইদা বেগমকে হালকা হাতে ধাক্কা দিয়ে বললেন,

“ এই জবা! কি হয়েছে? ”
হঠাৎ ডাকে একপ্রকার চমকে ওঠে মানুষটা। চোখ পড়ে পোড়া রুটিটার ওপর। তিনি তাড়াহুড়ো করে হাত দিয়েই সেটা উল্টাতে যান।কিন্তু গরম হওয়ায় তৎক্ষনাৎ হাতটা খানিকটা পুড়ে যায়। মানুষটা উহঃ নামক ব্যাথাতুর শব্দ করে নিজের পুড়ে যাওয়া হাতটা অন্যহাতে চেপে ধরে। এদিকে তার এহেন কান্ডে হতবুদ্ধির ন্যায় দাড়িয়ে রইলেন রাফিয়া বেগম। চোখের পলকে এতকিছু হয়ে যাওয়ায় মানুষটা কেমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলেন। কিন্তু যখনই জুবাইদা বেগমের ব্যাথাতুর ধ্বনি তার কর্ণকুহরে পৌঁছায় তখনি তিনি নিজের সম্বিৎ ফিরে পায়। বিচলিত হয়ে জুবাইদা বেগমের হাতটা টেনে নিয়ে বেসিন থেকে পানি ছেড়ে তার নিচে ধরে রাখেন। জুবাইদা বেগম চুপ করে রইলেন।চোখেমুখে তার ব্যাথার বদলে এক অন্যরকম চিন্তার ছাপ। রাফিয়া বেগম রাইসা বেগমের উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে বললেন,

“ ছোট! তারাতাড়ি বরফ নিয়ে আয় তো!”
রাইসা বেগম হেসেখেলে সবজি কুটছিলেন। হঠাৎ রাফিয়া বেগমের এহেন কথায় তড়িঘড়ি করে বরফ নিয়ে এসে চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“ সে কি বড়বু! তোমার হাতটা ওমন পুড়লো কিভাবে? ”
জুবাইদা বেগম নিচু গলায় বললেন,
“ ঐ আরকি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে গরম তাওয়ায় লেগে গিয়েছে। এ তেমন কিছু না।ঠিক হয়ে যাবে।”
রাইসা বেগম কথাটায় বিশ্বাস করলেও পাশে থাকা রাফিয়া বেগমের মুখভঙ্গিতে স্পষ্ট অবিশ্বাসের ছাপ। তিনি মুখাবয়ব যথেষ্ট গম্ভীর রেখে বললেন,

“ রুমে চল তোকে বার্ন ক্রিম লাগিয়ে দিচ্ছি। ”
পরক্ষণেই রাইসা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ ছোট! তুই একটু এদিকটা দেখতে পারবি?আমরা এক্ষুনি আসছি।”
“ হ্যা,হ্যা মেজোবু।তুমি যাও।আমি দেখছি এদিকটায়। ”
মনমতো জবাব পেয়ে মৃদু হাসলো রাফিয়া বেগম। জুবাইদা বেগমের হাতটা টেনে তাকে নিয়ে চলে গেলেন নিজের রুমের দিকে।
ঘরে এসে জুবাইদা বেগমকে বিছানায় বসিয়ে কাবার্ড থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে আসেন রাফিয়া বেগম। জুবাইদা বেগমের মুখোমুখি বসে, পুড়ে যাওয়া হাতটায় আলতো হাতে ক্রিম লাগিয়ে দিতে থাকলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই তিনি বলে ওঠেন,

“ কি হয়েছে তোর?”
জুবাইদা বেগম এবারও চুপ রইলেন। তা দেখে মাথা তুলে তাকালেন রাফিয়া বেগম। আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
“ তুই কি এখন আমাকেও বলবি না?”
মুখ তুলে চাইলেন জুবাইদা বেগম। পরক্ষণেই বললেন,
“ রাফু! আমার মনে হচ্ছে আমি কোথাও ভুল করছি!”
ভ্রু গোটায় রাফিয়া বেগম। বলেন,
“ মানে?”
জুবাইদা বেগম একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। বলতে লাগলেন,

“ সেদিন শিশিরের কথাটা শুনে আমি ধরেই নিয়েছিলাম, রোদও তাকে পছন্দ করে। এমনকি এ বিষয়ে আমি রোদের বাবার সাথেও কথা বলেছি জানিস। কিন্তু রোদের বাবার সেদিনের কথাগুলো আমায় আজও ভাবায়। আসলেই কি আমি একটু তাড়াহুড়ো করে ফেললাম বিষয়টায়?”
রাফিয়া বেগম এতক্ষণে বুঝলো সবটা। তিনি আলতো হেসে জুবাইদা বেগমের হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বললেন,
“ জবা! আমি যদি বলি,বড় ভাইজানের কথাগুলোই ঠিক! কেননা কোন কিছুই একপক্ষেরটা শুনে বিচার করতে নেই।এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।তাই বলি কি,আপাতত বিয়েটা নাহয় ভালোয় ভালোয় মিটে যাক।তারপর তুই গিয়ে রোদের সাথে কথা বলিস এ বিষয়ে।ঠিক আছে? ”
জুবাইদা বেগম আলতো করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন।

উঠোনের একপাশে চেয়ার সেট করতে ব্যস্ত অনিক।ছেলেটার ফর্সা মুখখানা ইতোমধ্যেই রোদের তোপে লাল টুকটুক হয়ে ওঠেছে। কপাল বেয়ে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে ঘাম।মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পিছন দিকে ঠেলে রাখা। ছেলেটা যখন কাজের মধ্যে ডুবে, তখনি তার কানে আসে আসিফের কন্ঠস্বর!
“ এই অনিক! এদিকে আয় তো।”
অনিক একবার সেদিকে তাকায়।তারপর পাশে দাড়ানো দু’জন ডেকোরেশন এর লোককে বলে,
“ আমি ওদিকে আছি।আপনাদের কিছু লাগলে আমায় জানাবেন।আর এদিকটায় আগে ঠিকঠাক করে তারপর অন্যপাশে যাবেন। ওকে? ”

অনিকের কথায় মাথা কাত করলো লোক দুটো। অনিকও সেদিকে তাকিয়ে চলে যায় পুকুর ঘাটের দিকে। আসিফের পাশ কাটিয়ে পুকুরে নেমে কিছুক্ষণ হাতে-পায়ে,মুখে পানি দিলো ছেলেটা।তারপর পানি দিয়ে চুলগুলোকে সেট করে ওপরে ওঠে এসে আসিফের পাশ ঘেঁষে বসে পড়ে। জিজ্ঞেস করে,
“ কি বলবা বলো!”
আসিফ গালভরা হাসি দিয়ে বললো,
“ আরে বলবো,বলবো! তার আগে তুই আম মাখা খা।”
বলেই ছেলেটা বাটিভর্তি কাঁচা আম মাখা অনিকের সামনে এগিয়ে দিলো। অনিকও প্রতিত্তোরবিহীন সেখান থেকে আম নিয়ে খেতে শুরু করে। খেতে খেতে বলে,
“ হুম,খেলাম।এবার তো বলো!”

আসিফ এবার আশপাশ পরোখ করে দেখলো একবার। তেমন কাওকে চোখে না পড়ায়, ছেলেটা একদম নিচু গলায় বললো,
“ তোরা তো দেখি তলে তলে টেম্পু চালাস, আর আমরা বললেই হরতাল!”
অনিক ভ্রুকুটি করে তাকায় আসিফের পানে।কথাটা তেমন বোধগম্য না হওয়ায় সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ে,
“ মানে? এ আবার কেমন কথা? ”
আসিফ এবার দাত কটমট করে বলে ওঠে,
“ এই একদম ভাব নিবি না বলে দিলাম।আমি জানি,তুই সবটাই আগে থেকে জানতিস! ”
“ কি জানার কথা বলছো? শুরু শুধু ভনিতা না করে সোজাসাপটা বললেই পারো!”
অনিকের বলা স্পষ্ট কথায় খামখেয়ালি ছাড়লো আসিফ।বললো,
“ আমাদের রোদ নাকি কাকে ভালোবাসে! এমনকি বাড়ির মানুষজনও নাকি জানে বিষয়টা।এবার তুই বল, তুই জানতি না কথাটা?”
অনিক এবার যারপরনাই অবাক হলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ রোদ ভাই যে ভালোবাসে তা আমি জানি।কিন্তু বাড়ির মানুষ ব্যাপারটা কবে জানলো?”
আসিফ ভ্রুকুচকায়।অনিকের মাথায় হালকা হাতে চাটি দিয়ে বললো,
“ সেটা আমি কিভাবে বলবো কবে জানলো? আমি নিজেই তো কিছুক্ষণ আগে শুনলাম কথাটা।তোর ছোট চাচি বললো,রুহির বিয়ের পরপরই নাকি কাবিন সেড়ে ফেলবেন রোদের।”
অনিক যেন আকাশ থেকে পড়লো কথাটা শুনে।ছেলেটা কেমন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আসিফের দিকে।কন্ঠে একরাশ অবাকের ছাপ ফুটিয়ে বললো,
“ কি বলছো? এত সহজে মেনে নিয়েছে সবাই? ”

“ আশ্চর্য! এখানে না মানার কি আছে? যেখানে ছেলে মেয়েকে পছন্দ করে। মেয়েও ছেলেকে পছন্দ করে সেখানে না মানার তো প্রশ্নই উঠে না।আর তাছাড়া একটা কথা শুনিসনি? মিয়া বিবি রাজি তো কেয়া কারেগা কাজি!”
অনিক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। মাথাটা কেমন ভো ভো করছে ছেলেটার। সে এবার বসা ছেড়ে উঠে দাড়ায়। তারপর একদৌড়ে চলে যায় বাড়ির ভেতরে। এদিকে তার এমন হুট করে চলে যাওয়ায় হতভম্ব হয়ে বসে রইলো আসিফ। পেছন থেকে হাঁক ছেড়ে বললো,
“ কিরে! এমন দৌড়ে কই যাচ্ছিস?”
অনিক শুনলো কি-না কে জানে।সে তো একছুটে জায়গা ত্যাগ করেছে বহু আগে।

“আম্মু!রোদ ভাই কাকে ভালোবাসে তা কি তুমি জানো?”
হাতে বিছানা ঝাড়ু নিয়ে বিছানা ঝাড়ছিলেন রাফিয়া বেগম। এরইমধ্যে ছেলের এহেন কথা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র মুচকি হাসলেন তিনি। হাতের কাজ বহাল রেখে বললেন,
„ বা_রে! জানবো না কেন? বেশ জানি কাকে ভালোবাসে। ”
অনিক এবার স্তম্ভিত নয়নে তাকিয়ে রইলো মায়ের
দিকে।জিজ্ঞেস করলো,
“ এতে পরিবারের কোন আপত্তি নেই?”
এপর্যায়ে কর্মরত হাতদুটো থামালেন রাফিয়া বেগম। ছেলের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ এখানে পরিবারের অমতের কথা আসছে কেন? যেহেতু আমাদের রোদ তাকে ভালোবাসে, সেহেতু মেনে নেওয়াটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার।”

মায়ের কথায় তবুও শান্ত হতে পারলোনা ছেলেটা।সে এগিয়ে এসে মায়ের হাত থেকে ঝাড়ুটা ফেলে দিয়ে মা’কে নিজের দিকে ঘুরায়। কোনরূপ ভনিতা ছাড়া জানতে চায়,
“ মেয়েটা কে আম্মু? ”
রাফিয়া বেগম মুচকি হাসলেন। বললেন,
“ কে আবার? আমাদের শিশির! ”
তৎক্ষনাৎ থমকে গেলো ছেলেটা।বুকটায় কেমন হুট করে কিছু একটা বিস্ফোরণ ঘটলো মনে হচ্ছে! ছেলেটা হতবাক হয়ে পেছনে সরে আসে দু-কদম। গলার স্বর বুঝি আর বেরোচ্ছো না।আটকে গেছে কোথাও।ক্ষনে ক্ষনে কানে বাজছে শুধু একটি নাম— শিশির!
রাফিয়া বেগম উদ্বিগ্ন হলেন ছেলের এহেন অবস্থা দেখে। তিনি চটজলদি এগিয়ে এসে ছেলের গালে হাত রেখে বললেন,

“ কি হয়েছে বাবা! এমন করছিস কেন তুই? অনিক! অনিক!”
নাহ, জবাব দিচ্ছে না ছেলেটা। সে কেমন ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে মায়ের পানে। বারেবারে ফাঁকা ঢোক গিলছে সে। প্রায় মিনিট খানেক পর অনিক নিচু গলায় বললো,
“ কতদিন যাবত তারা একে-অপরকে ভালোবাসে?”
রাফিয়া বেগম স্বাভাবিক স্বরেই উত্তর দিলেন,
“ অনেক আগে থেকেই। রোদ বিদেশে পড়তে যাবার পর থেকেই নাকি তারা একে-অপরকে পছন্দ করে। ”
তৎক্ষনাৎ চোখ তুলে তাকায় অনিক।চোখদুটো তার ইতোমধ্যেই লাল হয়ে এসেছে। বোঝা যাচ্ছে না, এই রক্তবর্ণ দৃষ্টির কারন। রাফিয়া বেগম ভড়কে গেলেন ছেলের এমন দৃষ্টি দেখে। তিনি বিচলিত হয়ে বললেন,

“ অনিক! কি হয়েছে তোর? তোর চোখদুটো এমন লাল হয়ে এসেছে কেন?”
অনিক মৌন রইলো। দৃঢ় চোয়ালটা আরও কিছুটা শক্ত করে সময় নিয়ে বললো,
“ কিছুনা আম্মু! ”
বলেই সে ঘর ছেড়ে বেরোতে যাবে ওমনি রাফিয়া বেগম পেছন থেকে বলে ওঠে,
“ কোথায় যাচ্ছিস বাবা?”
অনিক থামলো।পেছনে না ফিরেই গম্ভীর গলায় বললো,
“ একজনের সাথে একটা হিসাব-নিকাশ বাকি পড়ে আছে আম্মু।সেটাই করতে যাচ্ছি। ”
কথাটা শেষ করে প্রস্থান নেয় ছেলেটা।পেছন থেকে রাফিয়া বেগম চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগলেন,
“ ছেলেটা হঠাৎ এমন করলো কেন?”

“ আপনাকে তো আগে থেকেই জানিয়েছিলাম বিষয়টা ড.। তারপরও আপনি কেন এমনটা করলেন বুঝলাম না। আর তাছাড়া আমিতো এখন ঢাকা নেই।তাই চাইলেও যখন -তখন কোন কেস হ্যান্ডেল করতে পারবোনা।এন্ড ইউ গায়েস নো দেট ভেরি ওয়েল।”
হসপিটালের কিছু জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ করছে রৌদ্র। প্রায় বেশ কিছুক্ষন পর কথা শেষ করে ফোনে কিছু একটা টাইপ করতে থাকে ছেলেটা। ঠিক তখনি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে শিশির। ঘরের দরজাটা আলতো হাতে খানিকটা ভিড়িয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে রৌদ্রের পেছনে। তারপর কালবিলম্বহীন ফট করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রৌদ্রকে। হঠাৎ আক্রমনে থমকে যায় রৌদ্র।

তাল সামলাতে না পেরে হাত থেকে খসে পড়ে ফোনটা। ওদিকে ঠিক এমন সময় অনিকও ঘরে ঢুকে। চোখের সামনে এহেন দৃশ্য দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে ছেলেটার।সে তৎক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে দাত কিড়মিড় করতে থাকে। পরক্ষণেই কোনরূপ টু শব্দ না করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে আলগোছে। বাইরে এসেই হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে ছেলেটা।রাগে, কষ্টে শরীর কাপছে তার। বুকের ভেতর চলছে অসহ্য তান্ডব। সেই তান্ডবে বেজে বেজে শুধু একটা কথাই উঠে আসছে, ——— কেন করলো রোদ ভাই এমন? কেন তার বনুকে কষ্ট দিলো সে? কেন অন্য একজনকে ভালোবেসে এতদিন মিথ্যা অভিনয় করে গেলো?
অনিক ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ফেলে ঘাড়ে হাত রেখে ম্যাসাজ করতে করতে বিড়বিড়িয়ে বললো,
“ এর শোধ আমি তুলবই ইফতেখার এহসান রৌদ্র। আমার বোনের অনুভুতির সাথে খেলা করার কঠিন শোধ আমি তুলবো।এন্ড দিস ইজ মাই প্রমিজ। ”

এদিকে হঠাৎ করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরায় চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রৌদ্রের।ছেলেটার মুখে নেমে আসে কাঠিন্যের ছাপ।তখনি পেছন থেকে আদুরে কন্ঠে মেয়েটা বলে ওঠে,
“ সরি! সরি! এক্সট্রিমলি সরি। আমি জানি তুই আমার ওপর রেগে আছিস।কেন রেগেছিস তাতো জানিনা।কিন্তু তবুও আমি সরি।”
পেছনের মানুষটা কে তা বোধগম্য হতেই আরেকদফা মেজাজ হারায় ছেলেটা।সে তৎক্ষনাৎ নিজের বুকের ওপর থেকে মেয়েটার হাতদুটো ছিটকে নামিয়ে দেয়। তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে সশব্দে চড় বসিয়ে দেয় মেয়েটার গালে। হঠাৎ এমন আক্রমণে তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে গিয়ে ছিটকে পড়ে শিশির। মেয়েটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ব্যাথাতুর শব্দ করে ওঠে। খানিকক্ষণ বাদে গালে হাত রেখে অবাক চোখে তাকায় রৌদ্রের পানে।দেখতে পায়,অদূরেই দাড়িয়ে রৌদ্র কেমন রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। ছেলেটার মুষ্টিবদ্ধ হাতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে হাতের রগ গুলো।চোখ হয়ে ওঠেছে রক্তবর্ণ। মেয়েটা ভড়কায়।এই প্রথম
রৌদ্রের এহেন রুপ সামনে আসলো তার।সে আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই রৌদ্র এসে তার চুলগুলোকে পেছন থেকে মুঠোবন্দি করে নেয়। মেয়েটা ব্যাথায় আরেকবার ককিয়ে ওঠে।অথচ সেদিকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা নেই ছেলেটার। সে রাগে হিসহিসিয়ে বলতে থাকে,

“ তোর সাহস কি করে হয় আমায় স্পর্শ করতে? আমায় স্পর্শ করার অধিকার শুধু একজনেরই।তুই কেন তার অধিকারে হাত দিতে এলি?”
কথাটা শুনে অবাক হয় শিশির। মেয়েটা কেমন আমতা আমতা করে বললো,
“ মানে? তুই এমন করে বলছিস কেন রোদ? এই তুই না আমায় ভালোবাসিস! তাহলে…..”
কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই তার চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে রৌদ্র। মেয়েটা এবার সহ্য করতে না পেরে শব্দ করে কেঁদে ওঠে। অথচ সেদিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে রৌদ্র বলে ওঠে,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১২

“ কি বললি? আমি তোকে ভালোবাসি মানে? এই মুখে আরেকবার এই কথাটা উচ্চারণ কর শিশির, আমি ভুলে যাবো তুই আমার পরিচিত কেও।”
বলেই মেয়েটার চোয়াল ছেড়ে দেয় রৌদ্র। অতপর আবারও রাগে গজরাতে গজরাতে বললো,
“ যেখানে আমার দেহ,প্রান,মন সবটাই একজনের দখলে।সেখানে তুই কিভাবে বলিস তোকে আমি ভালোবাসি? ”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here