সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৯
Jannatul Firdaus Mithila
ঠাসসস্ —- শাহানুরের কথাটা শেষ হবার আগেই তার গালে সশব্দে চড় পড়ে।শাহানুর সহ উপস্থিত সকলেই এতে খানিকটা ভড়কে যায়। কয়েক জোড়া হতভম্ব চোখ মুহুর্তেই এসে পড়ে খুশবু বেগমের ওপর। মানুষটা কেমন রাগে থরথর করে কাপছে। চেহারায় দেখা মিলেছে স্পষ্ট রাগের আভাস! তিনি এগিয়ে এসে খপ করে চেপে ধরে শাহানুরের কলার।তারপর আবারও দুগালে সশব্দে চড় বসান ছেলেটার।শাহানুরের হলদেটে ফর্সা মুখখানা চড়ের তোপে ইতোমধ্যেই লালচে হয়ে ওঠেছে। খুশবু বেগম চেচিয়ে উঠে বলতে লাগলেন,
“ কেন করলি তুই এমনটা? কেন করলি ঐ কালসাপের মাইয়ারে বিয়া? কেন আমার ঘরে আমার শত্রুর মাইয়ারে বিয়া কইরা তুললি? কেন করলি জবাব দে!”
কথাটা বলতে গিয়ে বেশ কয়েকবার থামলেন খুশবু বেগম। হয়তো রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন তিনি। খুশবু বেগম ছেলেকে মারতে আরেকবার হাত তুলবেন তার আগেই তার হাতটা চেপে ধরে মান্নান সাহেব। স্ত্রীর দিকে অগ্নীদৃষ্টিতে তাকিয়ে দাত কটমট করে বললেন,
“ আরেকবার আমার পোলার গায়ে হাত দিবানা আরিফের মা। ও কোন খুন করে নাই যে ওরে এমনে মারতে হইবো।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
কথাটা শেষ করেই স্ত্রীর হাতটা ছিটকে দূরে সরিয়ে ফেলেন তিনি। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ কেন করলি এমন বাপ? কেন শুধু শুধু নিইভা যাওয়া আগুনডা আবারও জ্বালাইলি?”
এতোকিছুর মাঝে এখনও হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছেন পৌঢ়া ফজিলাতুন্নেছা বেগম। তিনি হয়তো স্তব্ধ হয়ে গেছেন বিষয়টা দেখে। এদিকে এতক্ষণ বহুকষ্টে নিজেকে কোনমতে সামলে রাখছিলেন কবির সাহেব, কিন্তু নাহ! এবার যেন তার ধৈর্য্যও বাঁধ ভাঙলো।তিনি হনহনিয়ে এগিয়ে আসেন শাহানুরের সামনে।হাত বাড়িয়ে শাহানুরের পেছনে গুটিসুটি মেরে দাড়িয়ে থাকা আমরিনকে একটানে বের করে আনেন তিনি।অতপর মেয়েটাকে সামনে এনে যে-ই না থাপ্পড় মারতে যাবে ওমনি তার হাতটা ধরে ফেলে শাহনুর। শান্ত অথচ নিরেট কন্ঠে বলে ওঠে,
“ যত মারার আমাকে মারো ভাইজান, আমি মুখ বুজে সবটা মাথা পেতে নিবো কিন্তু তবুও ওর গায়ে হাত দিবানা। আমি এটা সহ্য করতে পারবোনা। ”
শাহানুরের হাত থেকে ঝটকা মেরে নিজের হাতটা সরিয়ে ফেলে কবির সাহেব। দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
“ তুই আমাকে ভাইজান ডাকবি না! এই তোরে না আমি বিশ্বাস করছিলাম? এই দিলি আমার বিশ্বাসের প্রতিদান? ”
শাহানুর মাথানিচু করে দাড়িয়ে রইলো।একহাত তার এখনো আমরিনের হাতটা চেপে ধরে আছে। অবস্থা বেগতিক দেখে সাব্বির সাহেব এগিয়ে আসেন।বড় ভাইকে শান্ত করতে বলেন,
“ ভাইজান! একটু শান্ত হও।আমরা নাহয় বসে বিষয়টা সলভ করি!”
তখনি পেছন থেকে আরেকবার তেড়ে আসেন খুশবু বেগম। কর্কশ গলায় বলতে লাগলেন,
“ ঐ কি কস তুই? কি মিটাবি বইয়া? তোরা কি ভাবছোস, তোরা এমন নাটক কইরা নিজের বইনেরে আমার পোলার ঘাড়ে গছাইয়া দিবি আর আমি ঐডা চুপচাপ বইয়া দেখমু? কোনদিন না।তোগো মতো কালসাপের বাচ্চাগো আমি কোনদিন আমার সংসারে ঠাঁই দিমুনা।”
তড়িৎ পেছনে ফিরেন কবির সাহেব। শান্ত মানুষটার শান্ত দৃষ্টিতে আজ যেন আমূল পরিবর্তন এসেছে। চোখদুটো হয়ে ওঠেছে অগ্নিমূর্তি।দৃঢ় চোয়াল আরও কিছুটা শক্ত হয়ে এসেছে তার। হাতদুটো হয়ে গেছে মুষ্টিবদ্ধ। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বললেন,
“ মুখ সামলে কথা বলুন চাচী।নাহলে আমি আজ সম্পর্কের বাঁধন ভুলে যেতে বাধ্য হবো। ”
কথাটা বলার সাথে সাথেই হাওয়ার বেগে ছুটে এসে কবির সাহেবের মুখ বরাবর ঘুষি মেরে বসেন আরিফ সাহেব। হঠাৎ এমন হওয়ায় তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যান কবির সাহেব। তিনি পড়ে যেতেই পাশ থেকে সাব্বির সাহেব, আমরিন,শাহানুর চিৎকার দিয়ে ওঠে,
“ ভাইজান! ”
আরিফ সাহেব থামলেন না। তিনি ছুটে এসে কবির সাহেবের কলার চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলতে লাগলেন,
“তোর এতোবড় সাহস আইলো কইত্তে? তুই আমার মা’রে এসব কস! ”
সাব্বির দৌড়িয়ে এলেন ভাইকে ছাড়াতে। পাশ থেকে শাহানুর আর আমরিনও এগিয়ে এলেন।তখনি বাড়ির কেঁচি গেইট দিয়ে প্রবেশ করে তায়েফ আর তাশরিক। বাড়িতে ঢুকেই তারা হতভম্ব হয়ে যায়।কিয়তক্ষন সামনে তাকিয়ে হাত থেকে বাজারপত্র সব ছুড়ে ফেলে একপ্রকার দৌড়ে চলে আসেন বড় ভাইকে ছাড়াতে। আরিফ সাহেবের কোমর চেপে ধরে তাকে একটানে কবির সাহেব থেকে ছাড়িয়ে আনেন তারা।পরক্ষণেই তায়েফ নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে চেপে ধরে আরিফ সাহেবের কলার।চেচিয়ে ওঠে বলতে লাগলেন,
“ আমার বড় ভাইজানের গায়ে হাত দেস কোন
সাহসে তুই? কে দিসে তোরে এতো সাহস? তুই বয়সে বড় দেখে যা নয় তাই করবি?”
এবার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তায়েফ আর আরিফকে ছাড়াতে। এরইমধ্যে খুশবু বেগম ছুটে আসেন ফজিলাতুন্নেছা বেগমের কাছে।রাগে ক্ষোভে বলতে লাগলেন অকথ্য ভাষায়,
“ মা*গি নিজে যেমন, মাইয়াডারে বানাইছোস এমন। বলি তোর কি লাজ নাইরে? তুই,তোর জামাই আমাগো এতো ক্ষতি কইরাও কি শান্তি পাসনাই,যে এহন মাইয়া লেলাইয়া দিছস আমার পোলার পিছে।তোগো কি লজ্জা সরম নাইরে? জামাই খাইয়াও কি লাজ হয়নাই তোর।তোর যায়গায় আমি হইলে ডুইব্বা মরতাম মা*গী।”
খুশবু বেগমের এমন উদ্ভট অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ দেখে এগিয়ে আসেন রাফিয়া বেগম। শক্ত গলায় বলেন,
“ মুখ সামলে কথা বলুন কাকীমা। আম্মা কিংবা আমরা কেউই জানতাম না ওদের প্রেমের বিষয়ে।জানলে হয়তো আগেই ওদের না করে দিতাম আমরা।”
মুখ ভেংচি কাটেন খুশবু বেগম। মুখ ঝামটি মেরে বলে ওঠেন,
“ হইছে হইছে আর শাশুড়ীর হইয়া গুন গাইতে হইবো না।ঐ মা*গী আস্ত একটা কালসাপ। কালসাপের পেটে ধরছেও কালসাপ। আইজকা সবডিরে কাইট্টা গাঙ্গে ভাসামু।”
খুশবু বেগম কথাটা শেষ করবার সাথে সাথে ওদিকে ধপ করে মাটিতে পড়ে যান ফজিলাতুন্নেছা বেগম। চোখদুটো তৎক্ষনাৎ বন্ধ হয়ে আসে পৌঢ়ার।রাফিয়া বেগম হকচকান। জুবাইদা বেগম তড়িঘড়ি চিৎকার দিয়ে ওঠেন,
“ রোদের আব্বু! তারাতাড়ি এদিকে আসো,আম্মা জানি কেমন করছে।”
থমকান সবাই।ইতোমধ্যে চলা বিশাল হট্টগোল যেন নিমিষেই বন্ধ হয়ে যায়। কবির সাহেব সহ তার বাকি তিন ভাই ছুটে আসেন তাদের মায়ের নিকট।মায়ের মাথাটাকে কোলে তুলে কবির সাহেব বললেন,
“ আম্মা! ও আম্মা! কি হইছে তোমার? চোখ বন্ধ করলা কেন আম্মা? আম্মা, আম্মাগো চোখ খুলো আম্মা! ”
কথাটা বলতে গিয়ে একফোঁটা অশ্রু টুপ করে গড়িয়ে পড়ে কবিরের চোখ হতে।তিনি সঙ্গে সঙ্গে চেচিয়ে উঠেন,
“ সাব্বির! তাড়াতাড়ি ভ্যান ডাক ভাই! আম্মারে হাসপাতালে নিতে হবে।”
সাব্বির সাহেব একপ্রকার ছুটে গেলেন ভ্যান খুজতে। এদিকে তাশরিক সাহেব আগুন চোখে তাকায় ঐ বাড়ির সদস্যদের দিকে।পরক্ষণেই ছুটে যায় রসুইঘরে।হাতে একটা জ্বলন্ত লাকড়ির টুকরো নিয়ে বেরিয়ে আসে সে।যে-ইনা ও বাড়ির মানুষদের দিকে এগোতে যাবে তার আগেই তাকে জড়িয়ে ধরে আটকে ফেলে তায়েফ।তাশরিক রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে ওঠে,
“ ভাইজান ছাড়ো বলছি! আজকে এদের একদিন কিংবা আমার একদিন। ”
তায়েফ ছাড়লেন না ছোট ভাইকে।উল্টো বোঝাতে লাগলেন বুঝদারদের মতো,
“ ভাই! আল্লাহর দিকে তাকা আর মাটির দিকে তাকা।একটু ধৈর্য্য ধর ভাই।এ মুহূর্তে আম্মারে সুস্থ করতে হবে।একটু সামলা নিজেরে ভাই।”
তাশরিক হয়তো বুঝলো কিছুটা।তায়েফের বুকে থেকেই হাত থেকে জ্বলন্ত কাঠটা ছিটকে দূরে ফেলে দিলেন।তারপর আরিফ আর খুশবু বেগমের দিকে তাকিয়ে সর্তক বানী ছুড়ে বললেন,
“ আমার আম্মার যদি কিছু হয় মাঙ্গের* পো, তোরে আমি জ্যান্ত মাটিতে পুতে ফেলবো। মনে রাখিস!”
সদর হাসপাতাল।তড়িঘড়ি করে ভ্যান থেকে ফজিলাতুন্নেছা বেগমকে কোলে তুলে নামালেন কবির সাহেব। মা’কে কোলে নিয়েই চলে আসেন হাসপাতালের ভেতরে। পেছন পেছন তার তিন ভাইও ছুটে আসেন। সাব্বির সাহেব এগিয়ে এসে ডাকতে লাগলেন,
“ ডাক্তার কই? নার্স! এদিকে আসেন তারাতাড়ি। ”
তৎক্ষনাৎ দু’জন ওয়ার্ড বয় এগিয়ে আসেন স্ট্রেচার নিয়ে।রোগীকে স্ট্রেচারে করে ধীরে ধীরে নিয়ে গেলেন কেবিনে। কবির সাহেবরাও ছুটে গেলেন সেদিক কিন্তু কেবিনের সামনে যেতেই তাদের আটকে দিলেন ডাক্তার। বললেন,
“ এখানে দাড়িয়েই অপেক্ষা করুন।”
অগত্যা সেখানে দাড়িয়েই অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন তারা।
টানা দু’ঘন্টা পর ডাক্তার বেরিয়ে আসেন কেবিন থেকে।এতক্ষণ যাবত প্রহর গুনতে থাকা ছেলেগুলো কেমন উৎসুক দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে আসে ডাক্তারের নিকট।কবির সাহেব অধৈর্য্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,
“ আম্মা কেমন আছে ডাক্তার? আমার আম্মা সুস্থ আছে তো?”
জবাবে ডাক্তার মৌন রইলো। হয়তো ভেতরে ভেতরে উপযুক্ত কথা সাজাতে ব্যস্ত তিনি। উপস্থিত সকলে এবার চিন্তায় পড়লো।তাদের মধ্যে থেকে সাব্বির সাহেব ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“ আম্মার কি হয়েছে ডাক্তার? ”
ডাক্তার এবার মুখ থেকে মাস্ক সরালেন। মুখটায় আধার নামিয়ে বললেন,
“ আপনার আম্মা ব্রেইন স্ট্রোক করেছে। মস্তিষ্কে ইতোমধ্যেই রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গিয়েছে। কখন কি হয়ে যায় আমরা ঠিক বলতে পারছিনা।”
সহসা থমকে যায় সকলে।গলা হয়ে আসে বাকরূদ্ধ। কবির সাহেব খানিকটা কেঁপে ওঠে পিছিয়ে যায় দু-কদম। তাকে তৎক্ষনাৎ আগলে ধরে তার তিনভাই। এমন একটা পরিস্থিতি দেখে ডাক্তারের মনটাও যেন হু হু করে উঠলো।তিনি চোখদুটো হালকা মুছে নিয়ে বললেন,
“ আপনারা চাইলে রোগীর সাথে শেষবারের মতো দেখা করে নিতে পারেন।বলা যায় না কখন কি হয়ে যায়। ”
বলেই তিনি তৎনগদ সেখান থেকে প্রস্থান ঘটান।এদিকে কবির সাহেব এবং তার তিন ভাইয়ের অবস্থা বুঝি একেবারেই ভেঙে পড়ার মতো।তারা সকলেই একসাথে কেবিনে ঢুকে। ভেতরে ঢুকতেই তাদের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। বিছানায় নির্জীব হয়ে পড়ে থাকা মানুষটার মুখে অক্সিজেন মাস্ক। চোখদুটো বন্ধ করে রাখা।হাতে ক্যানোলা লাগানো।ইশশ্ মায়ের এমন দুরস্ত অবস্থা একেবারেই চোখে দেখা দায়! কবির সাহেব একটু একটু করে এগিয়ে এলেন।মায়ের বিছানার পাশে টুলে বসে আলতো হাত মায়ের মাথার ওপর রাখে।তখনি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় পৌঢ়া। চোখের সামনে ছেলেদের দেখতে পেয়ে মৃদু হাসলেন ভেজা চোখে। তাশরিক বুঝি আর ধরে রাখতে পারলো না নিজেকে।ফট করে এসে জড়িয়ে ধরে মা’কে। মায়ের বুকের ওপর মাথা রেখে হু হু করে কাঁদতে থাকে ছেলেটা।বলতে থাকে,
“ আম্মা! আমাদের ছেড়ে যেয়ো না আম্মা! তুমি ছাড়া আমাদের আর কে আছে আম্মা? তুমি ছাড়া আমাকে আর কে শাসন করবে আম্মা? কে আদর করে ভাত খাইয়ে দেবে আমায়? আম্মা! আম্মাগো আমাদের ছেড়ে যেয়ো না আম্মা। আম্মা, ও আম্মা! আল্লাহরে বলো মা তোমার পরিবর্তে আল্লাহ যাতে আমাকে উঠায় নেয়।তারপরও তুমি আমাদের মাঝে থাকো আম্মা! ”
ছেলের এমন বাচ্চাদের মতো কেঁদে কেঁদে বলা কথাগুলোয় না চাইতেও হেসে ওঠেন পৌঢ়া।হাত বাড়িয়ে মুখ থেকে মাস্কটা সরিয়ে ছেলেকে কাছে ডাকলেন তিনি।তাশরিকও বুক হতে উঠে মায়ের মুখের কাছে আসে।বৃদ্ধা ছেলের মুখটা হাতের আঁজলায় নিয়ে ছেলের কপাল বরাবর ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। বলে ওঠে,
“ আল্লাহ তোদের আরও বেশি নেক হায়াত দেক বাবা। তোরা যেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারিস।”
থামলেন বৃদ্ধা।চোখের ইশারায় অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাব্বির আর তায়েফকে কাছে ডাকলেন। তারাও বুঝি কালবিলম্বহীন এগিয়ে এলো মায়ের নিকট।পৌঢ়া দু-ছেলেকে মন ভরে আদর করলেন। গালে-কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলেন সযত্নে। মিহি হেসে বললেন,
“ আব্বা! তোমরা অনেক বড় হইয়ো কেমন? ”
ছেলে দুটো বুঝি আর কান্না আটকে রাখতে পারলোনা।হুট করে মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,
“ আম্মা! থেকে যাও আম্মা! আব্বারে হারাইছি এখন তোমারে হারানোর ক্ষমতা আর নাই আম্মা। ”
পৌঢ়া কষ্টের হাসি টানলেন মুখে। বললেন,
“ সবটাই আল্লাহর ইচ্ছা আব্বা! তিনি কখন কারে ডাক দেয় তা-কি আর কেও কইবার পারে?”
তিনি ছেলে দু’জনকে ছেড়ে দিলেন।পরিশেষে বড় ছেলেকে নিজের কাছে ডাকলেন। কবির সাহেবও এগিয়ে এলেন লালচোখে।আহ! বড় হওয়ায় হয়তো কান্নাগুলোও স্বাধীনতা পায়নি ঝরে পড়ার।তাইতো কেমন আটঘাট বেধে আটকে আছে চোখের কোটরে। কবির সাহেব মৃদু নাক টানলেন। মায়ের ললাটে গাঢ় একটা চুম্বন একে দিলেন সযত্নে। পৌঢ়া এবার ছেলেকে বুকে চেপে ধরেন।বড় বড় নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন,
“ আমারে মাফ কইরা দিও আব্বা! আমার আর তোমার আব্বার কারণে আইজ তোমাগো এতো কথা শুনতে হইলো।আব্বা গো! আল্লাহ তোমারে বড় ছেলে হিসেবে না, আল্লাহ তোমারে একটা বটগাছ হিসাবে আমার সংসারে পাঠাইছে।আব্বা, বটগাছ কি করে জানোইতো! বটগাছ সবাইরে আগলায় রাখে নিজের ছায়ায়।আব্বা তুমিও তোমার ভাই-বোনেরে আগলায় রাখবা সবসময়। আজকে আমারে কথা দেও আব্বা, আমার বাড়ির একটা ইটও যেন কোনদিন আলাদা নাহয়।”
কবির সাহেব মায়ের বুকে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে যাচ্ছেন। মায়ের শেষ কথাটায় নাক টেনে বললেন,
“ কথা দিচ্ছি আম্মা! তাই হবে।”
পৌঢ়া ব্যাথিত হাসলেন।হঠাৎ করে তার নিঃশ্বাসের উঠানামার গতি মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেলো।উপস্থিত সকলেই হকচকিয়ে ওঠেন।তাশরিক ছুটে গেলেন ডাক্তারকে আনতে।কবির সাহেব বারবার মা’কে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন,
“ আম্মা! ও আম্মা, কই কষ্ট হচ্ছে তোমার আম্মা?”
পৌঢ়া হাঁপাচ্ছেন।কোনরকমে মাথায় হাত চেপে বললেন,
“ আব্বা! এহানে কষ্ট হইতাসে আব্বা! আব্বা আমি সইতে পারতাসি না আব্বা, আমার মাথাডা বুঝি ফাইট্টা যাইতাছে আব্বা, বাপরে, আমার মাথাডা ভাইঙ্গা ফালারে বাপ! আমার আর সহ্য হইতাসে না।”
সাব্বির আর তায়েফ মায়ের পায়ের কাছে দাড়িয়ে হু হু করে কেঁদে যাচ্ছেন। এদিকে কবির সাহেবের বুঝি নিজেকে কেমন পাগল পাগল ঠেকছে।মায়ের এহেন কষ্ট কি আর চোখে দেখা যায়? তখনি ডাক্তার এলেন।রোগীর অবস্থা সিরিয়াস দেখে খানিকটা পরিক্ষা করে ফোস করে নিশ্বাস ফেলে বললেন,
“ আপনি কালেমা পড়ুন।”
ব্যস! কথাটা শোনামাত্রই যেন কান্নার হিড়িক পড়ে যায় রুমটিতে।কবির সাহেব বাদে বাকিরা হাউমাউ করে কাঁদছেন বুক ফাটিয়ে। কবির সাহেব স্থির দাঁড়িয়ে। মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বললেন,
“ আম্মা! আমার সাথে বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ! ”
পৌঢ়াও বুঝি বুঝে গেলেন সময় ফুঁড়িয়ে এসেছে তার।তিনি বড় বড় নিশ্বাস ফেলে ছেলের সঙ্গে থেমে থেমে বললেন,
“ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ! ”
তারপর? তারপর পরপর দুটো ঝাঁকুনি এলো পৌঢ়ার শরীরে।অতপর সেকেন্ডের ব্যাবধানে দেহ একেবারে নিশ্চল হয়ে আসে বৃদ্ধার।চোখ দুটো বড় বড় করে খুলে রাখা।নিশ্বাসের উঠানামা একদম স্থির হয়ে গেলো।এবার বুঝি কবির সাহেবের চোখ বেয়ে টুপ করে দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। তিনি এগিয়ে এসে সন্তপর্ণে মায়ের খোলা চোখদুটো বন্ধ করে দিলেন। গলাটা একদম ব্যাথা হয়ে আসছে তার।ভাব এমন,কেও বুঝি সজোরে গলা চেপে ধরে রেখেছে তার। কবির সাহেব এবার মুখের আদল শক্ত করেন।গমগমে স্বরে বললেন,
“ বাড়ির সবাইকে বল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে।আম্মার দাফন ঢাকাতেই হবে।”
বিকাল সাড়ে চারটে🌸
এহসান ভিলার সামনে মানুষের ঢল।সবাই এসেছেন পৌঢ়ার দাফনে শরীক হতে।বাড়ির ভেতরের অবস্থা বেজায় করুন।জুবাইদা বেগম তো ক্ষনে ক্ষনে জ্ঞান হারাচ্ছেন।তাকেই একটু পরপর সামলাচ্ছেন রাফিয়া বেগম। কিশোরী মেহরিনও বুঝি এখন তারই ভরসায় কেঁদে যাচ্ছে।
আমেনা বেগম আর আবুল মিয়া এটাসেটা এগিয়ে দিচ্ছেন। তখনি বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে উপস্থিত হয় আমরিন আর শাহানুর। তারা যেইনা বাড়ির ভেতরে এক-কদম রাখতে যাবে ওমনি কারও গম্ভীর কণ্ঠে থমকে দাঁড়ায় তারা।
“ দাঁড়াও! আর একপা ও ভেতরে ঢুকাবার দুঃসাহস করবে না।”
অগত্যা থমকে গিয়ে ফোলা ফোলা চোখে তাকিয়ে রইলো আমরিন।ভেঙে যাওয়া কন্ঠে কোনরকমে বলে,
“ ভাইজান! আমি আম্মাকে দেখবো না?”
এগিয়ে আসেন কবির সাহেব। শক্ত গলায় বললেন,
“ কার আম্মা? আমার জানামতে আমার আম্মার সব সন্তান তাকে দেখে ফেলেছে। আর তো কেও বাকি নেই!”
“ কিন্তু ভাইজান! আমিতো আম্মাকে এখনো দেখিনি!”
সহসা এবার মুখাবয়ব পরিবর্তিত হলো কবির সাহেবের। চোখমুখে ফুটে উঠেছে আক্রোশের ছাপ।কাঠকাঠ কন্ঠে জবাব দিলেন,
“ কারণ তুমি আমাদের কেও না! আমাদের আমরিন নামের যেই বোন ছিলো সে গতকালই মারা গেছে। ”
কেঁপে ওঠে আমরিন।এক কদম পিছিয়ে যায় সে।তৎক্ষনাৎ তাকে আগলে ধরে শাহানুর। মেয়েটা এখনো হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে বড় ভাইয়ের দিকে। ধরে আসা গলায় বহুকষ্টে বললো,
“ ভাইজান! ”
এ পর্যায়ে হুংকার দিয়ে ওঠে কবির সাহেব। তার হুংকারে কেঁপে ওঠে এহসান বাড়ির প্রতিটি কোণা।তিনি বলে ওঠেন,
“ খবরদার ঐ মুখে আমায় ভাইজান ডেকেছো তো! আমায় ভাইজান ডাকার অধিকার শুধুমাত্র আমার ভাই-বোনের।অন্যকারো না।”
আমরিন এবার ফট করে কবির সাহেবের পাদু’টো জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আহাজারি করে বলে ওঠে,
“ ভাইজান! আল্লাহর দোহায় লাগে এমনটা বলোনা।ভাইজান শেষবারের মতো অন্তত মা’কে একটাবার দেখতে দাও।”
সঙ্গে সঙ্গে নিজের পাদু’টো ছাড়িয়ে নিলেন কবির সাহেব। মুখভঙ্গি অপরিবর্তিত রেখে বললেন,
“ সরে যাও আমার দুচোখের সামনে থেকে। মনে রেখো আজকের পর থেকে এই এহসান বাড়ি এবং এহসান বাড়ির প্রতিটি সদস্যদের সাথে তোমার যোগাযোগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ”
“ ভাইজান! দয়া করো।শেষবারের মতো এক নজর মাকে দেখতে দাও।”
নাহ! গললেন না কবির সাহেব। তিনি কেমন সটান হয়ে দাড়িয়ে আছেন নিজ জায়গায়। আমরিন এবার উঠে দাড়ায়। ভেজা চোখদুটো ওড়নার কোণায় মুছে নিয়ে বললো,
“ ভাইজান! ভালোবেসে বিয়ে করাটা কি অপরাধ? নাকি ওকে বিয়ে করেছি বলে আমার অপরাধ? ভাইজান! এমনও তো হতে পারে ভবিষ্যতে এমনটা এহসান বাড়িতেও হলো।যদি তোমার কোন সন্তানও একই কাজ করে তখন? তখনও কি এমনটাই করবে? তাকেও কি আমার মতো দূরদূর করে তাড়িয়ে দেবে?”
জ্বলে ওঠেন কবির সাহেব। ফট করে কর্কশ গলায় বললেন,
মনে রাখিস, যদি কোনদিন এই এহসান পরিবারের কোন সদস্য তোর মতো ভুল করে বা করার চেষ্টাও করে তাহলে আমি কবির এহসান আজ সকলের সামনে কথা দিলাম তার সাথে এই পরিবারের সকল সম্পর্ক সেখানে, সেই মুহুর্তেই শেষ হবে এবং এই এহসান বাড়ির দরজা তার জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। ”
চমকে ওঠেন সকলে।অসংখ্য অবাক চোখ ইতোমধ্যেই এসে পড়ে কবির সাহেবের ওপর।কেননা সবাই কমবেশি জানেন,কবির সাহেবের মুখের এককথাই তার শেষ কথা।এ পর্যায়ে আবারও বললেন কবির সাহেব,
“ আর একটা কথা সবাই কান খুলে শুনে রাখো,এই পরিবারের কেউ যদি ওর সাথে কোন প্রকারের যোগাযোগ করে কিংবা রাখার চেষ্টা করে সে আমার মরা মুখ দেখবে।এটাই আমার, এ-ই কবির এহসানের ওয়াদা এবং শেষ কথা!”
কেঁপে ওঠে সকলে।ভয়ার্ত ঢোক গিলে প্রত্যেকে।আমরিন এগিয়ে আসে। ভাইজানের পাদু’টো আকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
” না ভাইজান। আল্লাহর দোহাই লাগে ও কথা মুখেও এনো না।তোমরা ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই।মা-বাবার পরে তোমরাই যে আমার সব।আমাকে শেষবারের মতো মাফ করে দাও ভাইজান মাফ করে দাও। ”
পা থেকে হাতদুটো ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন কবির এহসান।
“চলে যা এখান থেকে। আর কোনোদিনও এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়াবার দুঃসাহস ও করবি না ”
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৮
“ভাইজান আমার কথা টা শোনো,ভাইজান,, ভাইজান,, ” চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে আমরিন।কিন্তু নাহ! সে চিৎকারে থামলো না কবির এহসান। মনে গেঁথে গেলো এক ভিন্ন অভিশাপ। চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ হলো এ বাড়ির সন্তানদের মাঝে ভালোবাসা জনিত সম্পর্ক! কিন্তু বিধির লিখন যে অন্য কিছু চায়।