সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২০

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২০
Jannatul Firdaus Mithila

বর্তমান 🌸
একনাগাড়ে স্মৃতিচয়ন শেষে থামলো রৌদ্র। গলার স্বরও কেমন ধরে এসেছে ছেলেটার। চোখদুটোতেও যেন রক্তাভ আভা ছড়িয়ে পড়েছে নিমিষেই।রৌদ্র খেয়াল করলো সে জানালার সামনে দাড়ানো। অতীতের কথাগুলো বলতে বলতে কখন যে এখানে চলে এসেছে, টেরই পায়নি ছেলেটা! রৌদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বুকের কাছে দুহাত ভাজ করে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে, অদূরের আকাশে একাই রাজত্ব করতে থাকা চাঁদের দিকে ছলছল চোখজোড়া নিবদ্ধ করে।পরক্ষণেই কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই হুট করে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে অরিন। রৌদ্র থমকে যায়! তৎক্ষনাৎ শরীরের রক্তপ্রবাহ যেন বেড়ে গেলো দ্বিগুণ। বুকের কাছে ভাজ করে রাখা পেশিবহুল হাতদুটো ঢিলে হয়ে আসে মুহূর্তেই। বুকের খাঁচায় আটকানো হৃদয়টাও যেন নৃত্য তুলতে ব্যস্ত!

ছেলেটা পরপর ফাঁকা ঢোক গিলে। ইশশ্ গলাটায় বুঝি খরা নেমে এলো তার! অথচ কিছুক্ষন আগের ঝড় তোলা বৃষ্টির প্রকোপে পরিবেশ কিন্তু যথেষ্ট ঠান্ডা, শীতল! রৌদ্র ধীরে ধীরে অরিনের হাতটা নিজের বুকের কাছ থেকে সরিয়ে নিজেও পিছনে ফিরে তাকায়। দেখতে পায়, মেয়েটার ভেজা চোখ-মুখ। হয়তো অতীতের কথাগুলো শুনে কান্না করেছে বেশ! কান্নার তোড়ে কপোলগুলোয় যেন এক ঐশ্বরিক সৌন্দর্য এসে ভর করেছে। সরু নাকটাও কেমন লাল টুকটুক হয়ে গেছে। আখিঁদ্বয়ের কোটরে এখনও চিকচিক করছে জলকণা। রৌদ্র মুগ্ধ চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়তক্ষন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তখনি অরিন মুখ খোলে।রৌদ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় থেমে থেমে বলে,
“ কেন এমনটা হলো ডাক্তার সাহেব! কেন হলো আমাদের ভালোবাসা নিষিদ্ধ? ডাক্তার সাহেব! এবার কি হবে তাহলে? আমাদের ভালোবাসাও কি অসমাপ্ত থাকবে? কোনদিনও কি মানবে না আমাদের পরিবার? ডাক্তার সাহেব! আমি যে আপনাকে ছাড়া বাঁচবো না। সত্যিই মরে যাবো আ…”
কথাটা সম্পূর্ণ হবার আগেই তাকে থামিয়ে দেয় রৌদ্র। মেয়েটার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে সে। পরক্ষণেই বলতে থাকে,

“ হুঁশশ! এ কথা আর কোনদিন মুখে আনবি না সানশাইন! আমি থাকতে তোর কিচ্ছুটি হতে দিবো না। আমাদের ভালোবাসা অবশ্যই পূর্নতা পাবে। তুই শুধু আমার পাশে থাকবি,যেকোনো সময়,যেকোনো পরিস্থিতিতে আমার সঙ্গে থাকবি।পারবি তো? দেখিস বাকিটা আমি সামলে নিবো।এতোটুকু বিশ্বাস করিস তো আমায়?
অরিন ঠোঁটের ওপর থেকে রৌদ্রের আঙুলগুলো সরায়।বাধ্যদের মতো পরপর মাথা ঝাকিয়ে বললো,
“ নিজের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করি আপনাকে ডাক্তার সাহেব! আমি বিশ্বাস করি আপনি পারবেন। ”
রৌদ্র এবার বিজয়ী হাসলো।অরিনের ললাট বরাবর ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো সযত্নে। অরিনও আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।রৌদ্র বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ঠোঁট সরায়।অরিনের বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো ছেলেটা।অতঃপর দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে বলে ওঠে,

“ এভাবে হুটহাট আমার এতোটা কাছে আসিস না সানশাইন! ”
চট করে চোখদুটো খুলে ফেলে অরিন।সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ে,
“ কেন? আসলে কি হবে শুনি?”
রৌদ্র এবার বাঁকা হাসলো। ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে।রৌদ্রের এহেন মুখভঙ্গিতে ভড়কায় অরিন। সন্দিগ্ধ কন্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে,
“ কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

রৌদ্র নিজের মুখভঙ্গি অপরিবর্তিত রেখে মুখ নিয়ে আসে অরিনের কান বরাবর। তা দেখে অরিন এক কদম পেছাতে গেলে রৌদ্র তার কোমর চেপে ধরে তাকে আরেকটু কাছে নিয়ে আসে।এহেন কান্ডে অরিন বুঝি হতবুদ্ধির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো কিয়তক্ষন। মুহুর্ত ব্যয়ে নিজের ঘাড় বরাবর টের পেলো রৌদ্রের উষ্ণ নিশ্বাসের আছড়ে পড়া।মেয়েটা তৎক্ষনাৎ কেঁপে ওঠে খানিকটা। মুহুর্তেই বুঝি শীরদাড়া বেয়ে বয়ে গেলো এক শীতল স্রোত! পাদু’টো যেন আসাড় হয়ে আসার যোগাড়। রৌদ্র এবার করে বসলো আরেক কাজ! বলা-কওয়া নেই, মেয়েটার ঘাড় বরাবর টুপ করে চুমু খেয়ে বসে আলগোছে! অরিন যেন এতেই শেষ! ক্ষনিকেই মেয়েটার শরীরে ধরে যায় রাজ্যের কাঁপন। টলমল পায়ে যেই না পড়তে যাবে ওমনি তাকে বাহুডোরে চেপে ধরে রৌদ্র। তারপর কালবিলম্বহীন মেয়েটাকে পাঁজাকোলে তুলে নেয় সে। অরিন সাথে সাথে চোখমুখ কুচকে ফেলে।হঠাৎ এমন হওয়ায় তাল সামলাতে না পেরে,

অরিন রৌদ্রের ঘাড় আর গলার কাছের শার্টের অংশ খামচে ধরে। রৌদ্র এবারেও বাঁকা হাসলো। আলতো হাতে মেয়েটাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো।তারপর মেয়েটার ওপর খানিকটা ঝুঁকে থেকে হাস্কি স্বরে বললো,
“ এভাবে খামচি দিয়ে আমায় কন্ট্রোললেস করিস না সানশাইন। যেখানে তোকে দেখলেই নিজেকে এলোমেলো লাগে,সেখানে তুই এতোটা কাছে এলে কিভাবে সামলাই বলতো নিজেকে? বলাতো যায় না, কখন না জানি বোধ হারিয়ে কি করে বসি! ”
অরিন ফট করে উঠে রৌদ্রের মুখ চেপে ধরে। অনুনয় করে বলতে থাকে,
“ চুপ করুন ডাক্তার সাহেব! আর এসব বলবেন না প্লিজ!”

মেয়েটার এমন কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলা কথাগুলো যেন বেশ উপভোগ করলো রৌদ্র।মুখের ওপর হতে মেয়েটার হাতটাকে আলতো হাতে সরিয়ে নিলো।তারপর সেই হাতের উল্টোপিঠে একটা গভীর চুমু একে দিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বললো,
“ এটুকুতেই তোর এই হাল সানশাইন? তাহলে যখন আমি কন্ট্রোল হারিয়ে ফলবো, তখন কি কি করবি সানশাইন? ”
অরিন এবার অতিষ্ঠ হলো।লজ্জায় কুন্ঠা যাওয়ার পথে মেয়েটা! কোনরকমে কানে দুহাত চেপে ধরে কপট রাগী ভাব নিয়ে বললো,

“ থামুন! প্লিজ থামুন ডাক্তার সাহেব! এতোটা ঠোঁটকাটা কবে হলেন আপনি? ”
রৌদ্র হো হো করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় ছেলেটা।আর অরিন? নিজের একরাশ লজ্জাগুলোকে একপ্রকার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আবারও বেহায়ার মতো হা করে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের সেই মনোমুগ্ধকর হাসির পানে। হাসার একপর্যায়ে রৌদ্রের চোখ পড়লো অরিনের ওপর। তক্ষুনি নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অরিন।মাথানিচু করে বসে রইলো বিছানায়। রৌদ্র শোয়া ছেড়ে উঠে দাড়ায়। পড়নের শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বললো,

“ ঘুমিয়ে পড় সানশাইন! রাত তো অনেক হলো!”
অরিনও মাথানিচু করে সম্মতি জানায় রৌদ্রের কথায়। রৌদ্র একপলক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো দরজার নিকট।পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে পাদু’টো থামিয়ে দেয় ছেলেটা।পেছনে না ফিরেই অরিনের উদ্দেশ্যে বললো,
“ নিজেকে ধীরে ধীরে তৈরি করে নে সানশাইন! কেননা আমি যেদিন নিজের কন্ট্রোল হারাবো, সেদিন তোকে একচুলও ছাড় দিবোনা।সো কিপ প্রিপেয়ারিং ইউরসেলফ! ”

কথাটা শেষ করে আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না রৌদ্র। দরজাটা খুলে গটগট পায়ে প্রস্থান ঘটায় অরিনের রুম থেকে।এদিকে তার বলে যাওয়া কথায়, অরিনটা যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে সে খবর কি আছে ছেলেটার? নাহ নেই তো! অরিন প্রথমে কথাটার ভাবার্থ বুঝতে না পারলেও কিয়তকাল বাদে সবটাই বোধগম্য হয় মেয়েটার।তখনি মেয়েটার মুখে যেন রাজ্যের লজ্জা এসে ভিড় জমিয়েছে। গালদুটোয় ছেয়ে গেছে রক্তাভ আভা! অরিন তৎক্ষনাৎ বালিশে মুখ লুকিয়ে ফেলে। ইশশ্! এই মুখ এখন কিভাবে দেখাবে সে? এতোটা লজ্জা কিভাবে দিলো মানুষটা? কিভাবে এমন বেফাঁস কথাবার্তা বলে গেলো এতোটা অবলীলায়? সত্যিই কি তাহলে মানুষ প্রেমে পড়লে নির্লজ্জ হয়ে যায়? এই যে এর বাস্তব প্রমাণটা যেন সাক্ষাৎ তার ডাক্তার সাহেব!

সকাল সকাল হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠেছে এহসান বাড়ি! এদিক -ওদিক যেন কাজের ছড়াছড়ি। জুবাইদা বেগম আর রাফিয়া বেগম মাত্রই তৈরি হয়ে নামলেন নিচে। তাদেরকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে আসেন রাইসা বেগম ও মাইমুনা বেগম। সেই কখন থেকে বড় জা’য়েদের জন্য বসে ছিলেন দুজন। যাক অবশেষে তাদের অপেক্ষা শেষ হলো তবে!
বাড়ির মেয়েগুলো সাজগোজে ভিষণ ব্যস্ত! রুহিকে তার রুমে পার্লারের মেয়েগুলো সাজাচ্ছে। আহিরা,মাহিরাও সেদিকেই বসে বসে টুকটাক সেজে যাচ্ছে। এদিকে শিশির মেয়েটার চেহারায় বিন্দুমাত্র হাসির ঝলক নেই।চোখ-মুখে কেমন বিষাদের ছাপ! অথচ কাল অবধি মেয়েটার মুখ থেকে যেন হাসি সরছিলোই না! কুহেলী অবশ্য বেশ খেয়াল করেছে বিষয়টা।শিশিরের এমন মন খারাপ দেখে তার বুঝি বেশ খুশি খুশি লাগছে। সে-তো এই খুশিতে গদগদ হয়ে সেজেগুজে যাচ্ছে আপনমনে।

অরিন রেডি হবার জন্য নিজের রুমের দিকেই যাচ্ছিলো।মেয়েটা আবার এতক্ষণ রুহির রুমেই ছিলো।তার আবার চুল সেট করার ভালো অভ্যেস আছে কি-না! এজন্যই তো তার কাছে রুহির বেশ বড়সড় আবদার ছিলো —-❝ আমার চুলটা কিন্তু তোকেই সেট করে দিতে হবে অরি! পার্লারের মেয়েরা হেয়ার স্প্রে দিলে চুলগুলো আমার একদম ড্যামেজ হয়ে যাবে।❞
অগত্যা রুহির এমন আবদারে আর না করতে পারেনি অরিন।তাইতো এতক্ষণে ছাড়া পেলো মেয়েটা।অরিন ব্যস্ত পায়ে হাঁটছিলো তখনি পেছন থেকে ভেসে আসে রৌদ্রের ডাক!

“ অরি!”
পাদু’টো থমকে দাঁড়ায় অরিনের। রৌদ্রের ডাক কর্নপাত হতেই যেন বুকের মাঝে এক শীতল ঢেউ খেলে গেলো মেয়েটার।অরিন ধীরে ধীরে পেছনে তাকায়।তাকে দেখে রৌদ্র মৃদু হেসে এগিয়ে আসে। অরিনের থেকে সামান্য কিছুটা দুরত্ব রেখে বলে,
“ কই ছিলি সারাদিন? একটু তো সামনেও আসতে পারিস তাই না?”
অরিন ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা।তবুও কোনমতে মিনমিনে স্বরে বললো,
“ আসলে রুহিপুর চুল সেট করছিলাম! ”
রৌদ্র স্পষ্ট শুনলো মেয়েটার কথা। হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ হুম বুঝলাম! ”

অরিন আর কিছু বললো না।দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করে। রৌদ্র একবার আড়চোখে আশেপাশে পরোখ করে নিলো।অদূরেই অরিনের ঠিক পেছনে দুজন লোককে কাজ করতে দেখে রৌদ্র আরেকটু এগিয়ে আসে অরিনের নিকট।মেয়েটার গালের ওপর পড়া অবাধ্য চুলগুলো আলগোছে কানের পিঠে গুজে দিতে দিতে মৃদু স্বরে বললো,
“ বেশি সাজবার দরকার নেই সানশাইন! আমাদের বিয়ে হলে নাহয় বেশি করে সাজিস।আমি তখন মন ভরে দেখবো তোকে, কিন্তু প্লিজ আজকে বেশি সাজিস না! ”
অরিন যেন আবারও লজ্জায় হাসফাস করতে লাগলো।চোখদুটো এলোমেলো দৃষ্টি ফেলতে ব্যস্ত চারপাশে। রৌদ্র দেখলো সবটা। গলা খানিকটা উঁচু করে, অরিনের পেছনে কর্মরত লোকগুলোর উদ্দেশ্যে বললো,

“ এই যে! দেখুন তো ঐদিকটায় কেমন ফুলগুলো ছুটে পড়েছে! একটু ঠিক করে দিনতো!”
অগত্যা এহেন কথায় লোকগুলো পেছনে ফিরলো। খুঁজতে লাগলো রৌদ্রের বলা কাজটা।রৌদ্রও বুঝি এই সুযোগটাই চাচ্ছিলো।সে সুযোগ বুঝে টুপ করে চুমু খেয়ে বসে অরিনের মসৃণ গালে।তৎক্ষনাৎ কাজ সেরে সেখান থেকে গটগট পায়ে চলে আসে ছেলেটা।সামনে হাটতে হাটতেই একবার পেছনে তাকিয়ে অরিনের উদ্দেশ্যে বললো,
“ ঘরে যা জানবাচ্চা! ”
কথাটা শেষ করে পরক্ষণেই আবারও সোজা হয়ে হেঁটে আসে লোকগুলোর দিকে।বলতে থাকে,
“ আরে! বুঝেন নাই ব্যাপারটা? দেখি সরুন আমি খুঁজে দিচ্ছি! ”

এদিকে অরিন যেন এখনও হতবিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটা কেমন গালে হাত দিয়ে রেখেছে। হয়তো বুঝতে চাইছে,কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা কি আদৌও সত্যি কি-না? মেয়েটা যখন নিজের এহেন ভাবনায় মশগুল তখনি সেখানে উপস্থিত হয় কুহেলী। অরিনকে এভাবে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুকুটি করে কুহেলি।জিজ্ঞেস করে,
“ কি হয়েছে তোর গালে? এভাবে হাত দিয়ে রেখেছিস কেন?”
কথাটা শোনামাত্র সম্বিৎ ফিরে পায় অরিন।চমকে ওঠে হাতটা তৎনগদ সরিয়ে ফেলে গাল থেকে।তারপর কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“ হু? কিছু বললে?”
কুহেলি এবার মুখ বাকায়। ঠেস দিয়ে বললো,
“ হু বলেছি।কিন্তু তুই তা শুনলে তো! যাইহোক যা রেডি হতে যা।বরপক্ষ এই এলো বলে।”
অরিন মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। তারপর ছুটে চলে যায় নিজের রুমে। উফফ্! এই ডাক্তার সাহেবের হুটহাট কর্মকান্ডে মেয়েটার যে একেবারেই নাস্তানাবুদ অবস্থা!

পড়নে সাদা পান্জাবি দুভাইয়ের, ব্যস্ততা আর কাজ যেন থামছেই না! কবির সাহেব ব্যস্ত হয়ে সাব্বির সাহেবের সাথে খাবার রান্নার দিকটা সামলাচ্ছেন।বাবুর্চিরা রাঁধছেন আর তারা দুজন সেগুলোই তদারকি করছেন।তায়েফ সাহেব আর তাশরিক সাহেব,সাথে আরও দুজন ডেকোরেটরের লোক মিলে বসার প্যান্ডেলের দিকে সবটা শেষবারের মতো ঠিকঠাক করছেন।বিয়ে বাড়ি কি-না! শত ঠিকঠাকের পরেও যেন মনে হচ্ছে, কিছু একটা রয়েই গেলো!
অনিক,রৌদ্র, আসিফ মিলে একবার প্যান্ডেলের দিকে,তো একবার ঘরের দিকে দৌড়াদৌড়ি করছে। হাতে যেন একটা মুহূর্তের জন্যও ফুরসত নেই ছেলেগুলোর! অনিক ছেলেটা কিছুক্ষণের জন্য বসলো একটা চেয়ারে। সকাল থেকে যা ছুটোছুটিই না হচ্ছে! এখন একটু না জিরোলেই নয়! ছেলেটার ফর্সা নাদুসনুদুস চেহারাটা কেমন লাল হয়ে উঠেছে। আর হবে না-ই বা কেন? রোদের যা প্রখরতা! কে বলবে কাল ওমন ঝড়-তুফান হয়েছে!

বুঝবার যে একেবারেই জো নেই। ছেলেটার পড়নের গাঢ় নীল রঙা ভারি কাজের পাঞ্জাবিটাও যেন ইতোমধ্যে ভিজে নিয়ে একাকার অবস্থা! ফর্সা শরীরে গাঢ় নীল রঙা পাঞ্জাবিটা যেন বেশ ফুটে উঠেছে অনিকের ওপর।ছেলেটা একটু পরপর ডেকোরেটরের লোকগুলোর সাথে কেমন হেসে হেসে কথা বলছে।এতে যেন ছেলেটাকে আরও খানিকটা নজরকাড়া লাগছে।তারওপর তার থুতনির মাঝে গর্তটাতো আছেই সোনায় সোহাগা হিসেবে। আশেপাশে আত্মীয়দের মধ্যে বেশ কয়েকটা মেয়ে ঘুরে ঘুরে অনিককেই দেখছে।কেও কেও নিজেকে এতো সুন্দর করে উপস্থাপন করেছে যা বলার বাহিরে!উদ্দেশ্য বুঝি, অনিক ছেলেটার একটুখানি নজরে আসার। কিন্তু অনিক সাহেব সেদিকে তাকালে তো! তিনি তো মজে আছেন অন্য কারো মুগ্ধতায়। আবদ্ধ হয়ে আছেন অন্য একটা মানুষের মায়ায়। এতোকিছুর পরেও কি তার এ-সবে পাত্তা থাকে?

আসিফ হাতে টিস্যুর প্যাকেটগুলো নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে উঠোনের দিকে।ঠিক তখনি তারাহুরো করতে গিয়ে বেখেয়ালিবশত তার ধাক্কা লাগে সামনে থেকে আসা মানুষটার সাথে। তৎক্ষনাৎ আসিফের হাত থেকে টিস্যুর প্যাকেটগুলো পড়ে যায়। ছেলেটা যেন এতে ভারি বিরক্ত হলো। বিরক্তিতে মুখে চ-কারন্ত শব্দ তুলে সামনে তাকাতেই তার চোখ দুটো যেন আটকে গেলো। সম্মুখেই জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে সোহেলী। মেয়েটার পড়নের গোলাপি রঙা সিম্পল কাজের লেহেঙ্গাটা একহাত দিয়ে ধরে রাখা।মুখে হালকা প্রসাধনীর ছাপ।গলায়, কানে সিম্পল অর্নামেন্টস।এতেই যেন মেয়েটার ওপর থেকে চোখ সরানো দায়! আসিফ একটা শুকনো ঢোক গিললো। কে বলবে তার সামনে দাড়ানো মেয়েটা,বয়সে তার এতো ছোট! আজকে যে মেয়েটাকে একেবারেই পূর্ণ রমনীর ন্যায় লাগছে।আসিফ খানিকটা এগিয়ে আসে। চোখেমুখে কেমন মুগ্ধতা লেপ্টে আছে ছেলেটার। সোহেলী আসিফের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। নাহ! মানুষটার ওপর বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না! সোহেলী মাথা নিচু রেখে জিজ্ঞেস করে,

“ আপনি কি ব্যাথা পেয়েছেন? ”
আসিফ কি শুনলো কে জানে! ছেলেটা কেমন ঘোর লাগা কন্ঠে বললো,
“ হু,ভিষণ ব্যাথা করছে।”
কথাটা শুনে আঁতকে ওঠে সোহেলী। তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করে,
“ কোথায় লেগেছে আপনার? কই দেখি? ইশশ্ সরি হ্যা, আমি একদম খেয়াল করিনি আপনাকে। কই দেখান কোথায় ব্যাথা পেলেন।”
আসিফ এগিয়ে এসে সোহেলীর একহাত চেপে ধরে সেটা নিজের বুক বরাবর রাখে।তারপর এক অদ্ভুত মোহনীয় কন্ঠে বলে,
“ এদিকটায় ব্যাথা হচ্ছে খুব! সারিয়ে দিতে পারবি? ”
সোহেলী ভড়কে যায় এহেন কথায়। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“ কি বলছেন এসব? আপনি কি ঠিক আছেন?”
আসিফ কেমন সঙ্গে সঙ্গে উওর দিয়ে ওঠে,

“ উহুম! একদম ঠিক নেই।এতক্ষন সবটা ঠিকঠাক থাকলেও,এখন মনে হচ্ছে কিচ্ছু ঠিক নেই। কি করলি সোহেলী? হুট করে কেন এরম ভাবে পাগল করলি আমায়? কেন ফাটল ধরাতে এলি এতোদিনের ধৈর্যে? এবার নিজেকে কিভাবে সামলাই বলতো? ”
সোহেলীর যেন আজকে অবাক হওয়ার দিন। মেয়েটার চোখদুটো বুঝি বেরিয়ে আসার উপক্রম। কোনমতে তার কন্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে,
“ কি বলছেন এসব আসিফ ভাই?”
আসিফ এবার নিজেদের মাঝের দুরত্বটা আরেকটু ঘুচিয়ে নেয়।ছেলেটা কেমন অস্থির গলায় শুধায়,
“ চুপ!ভাই ডাকবিনা একদম।আর কয়দিন পর বর হবো তোর। এখন থেকেই হেগো, ও গো বলে ডাকার অভ্যাস কর!”

সোহেলী বুঝি নিজের কান কেও বিশ্বাস করতে পারছে না। কি শুনলো ও? সত্যিই কি আসিফ ভাই এগুলোই বলছেন? এতো সহজে সে তার প্রিয় মানুষটাকে পেয়ে গেলো? সোহেলী সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,
“ আপনি সত্যি বলছেন? আমি ভুল শুনলাম নাতো?”
আসিফ মুচকি হাসলো। মেয়েটার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
“ নাহ! কিছুই ভুল শুনিসনি। এতোদিন তুই ছোট আছিস বলে নিজেকে সামলে রেখেছিলাম কিন্তু আজকে বুঝি সেই ধৈর্যের বাঁধটা তুই নিজেই ভেঙে দিলি রে! এবার তো এই অস্থির মানুষটাকে তোর সামলাতেই হবে!”

দোতলার সরু বারান্দায় হাঁটছে রৌদ্র। হাতে একঝাঁক কাজ থাকা স্বত্বেও ছেলেটা এখানে এসে হাঁটছে।উঁহু! হাটছে বললে ভুল হবে,ছেলেটার ব্যস্ত চোখ যেন হন্যে হয়ে খুঁজছে প্রিয় মানুষটাকে।সেই কখন থেকে রেডি হয়ে নিচে বসেছিলো মেয়েটার জন্য, কিন্তু মেয়েটার বুঝি আসবার নামগন্ধও নেই! ছেলেটা বুঝি আজকে সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। পড়নের গাঢ় খয়েরী রঙের কারুকাজ করা পাঞ্জাবিটা বেশ মানিয়েছে তাকে।গলার কাছের দুটো বোতাম বরাবরের মতো খুলে রাখা।ছেলেটাকে দেখে মনেই হচ্ছে,

পাঞ্জাবিটা বুঝি একমাত্র তার জন্যই তৈরি। মাথার চুলগুলো পাইক করে রাখা।হাতের প্রায় অনেকটা হাতা ওপরের দিকে উঠানো। রৌদ্র যখন হাঁটছিলো তখনি তার পকেটে কর্কশ শব্দ তুলে ফোনটা বেজে ওঠে। রৌদ্র বিরক্ত ভঙ্গিতে তুলে নিলো ফোনটা।কোনরকমে কলটা রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে কথা বলতে লাগলো। তখনি অদূরে নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ তুলে কারো হেঁটে আসার আওয়াজ হয়।রৌদ্র ভাবলেশহীন ভাবে একবার সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে যেইনা চোখ ফেরাবে ওমনি বেচারার চোখদুটো যেন সেদিকেই আটকে গেলো। হাতের মোবাইলটা অবহেলায় পড়ে গেলো মাটিতে। হার্টের কয়েকটা বিট যেন ক্ষনিকেই মিস হয়ে গেলো তার! মুগ্ধ কন্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে,

“ মাশাআল্লাহ!”
অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা অরিন বেশ শুনলো কথাটা। মেয়েটা লাজুক হাসলো।পড়নের বোটল গ্রিন কালারের কারুকার্যে সজ্জিত লেহেঙ্গাটি যেন ফুটে উঠেছে মেয়েটার গায়ে। মাথার ওপর সেম কালারের হিজাব বাঁধা। মুখে তেমন কোন প্রসাধনীর ছাপ নেই।আছে শুধু হালকা খয়েরী রঙের লিপস্টিক, চোখে চিকন করে টানা কাজল,তারওপরে ক্যাট- আইলাইনার (যারা জানেন না গুগল করে নিয়েন)।ব্যস! এটুকুতেই মেয়েটা যেন সাক্ষাৎ একটা বার্বিডল! রৌদ্র পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরিনের পানে।অরিন এবার ধীর পায়ে লেহেঙ্গা ধরে এগিয়ে আসে। রৌদ্রের থেকে কিছুটা দুরত্ব রেখে মুচকি হাসলো মেয়েটা। তখনি স্পষ্ট চক্ষুগোচর হয় মেয়েটার গালের গর্তদুটো। রৌদ্রের বুঝি এবার জান যায় যায় অবস্থা! ছেলেটা তৎক্ষনাৎ হাসফাস করতে লাগলো। তা দেখে অরিন চমকায়।চকিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“ কি হয়েছে আপনার? ”
রৌদ্র অরিনের দিকে আবারও দৃষ্টিপাত করে। মুখে দুষ্টুমির আভাস টেনে বললো,
“ এতোটা সুন্দর লাগতে নেই সানশাইন! আমার মতো দূর্বল মানুষ যে অসুস্থ হয়ে পড়বে তোকে দেখে! এই যেমনটা আমি হলাম!”
রৌদ্রের এহেন কথায় লজ্জায় পড়লো মেয়েটা। আহারে! বেচারি কাল থেকে শুধু লজ্জাই পাচ্ছে! আর রৌদ্র! সেও তো চুল পরিমাণ সুযোগ ছাড় দিচ্ছে না মেয়েটাকে লজ্জা দেবার।অরিন মাথানিচু করে দাড়িয়ে রইলো।মুখটায় বুঝি নির্ঘাত এতক্ষণে লজ্জালু আভা ছড়িয়ে পড়েছে। রৌদ্র এগিয়ে আসে কিছুটা, অরিনের থুতনিতে দু আঙুল ঠেকিয়ে মুখটা উঁচু করে তুলে।তারপর মেয়েটার চোখের নিচ থেকে খানিকটা কাজল নিজের আঙুলে উঠিয়ে সেটাকে আলগোছে মেয়েটার ডানহাতের অনামিকায় লাগিয়ে দেয়। পরক্ষণেই ঘোরলাগা নয়নে তাকিয়ে থেকে বললো,
“ আমার সানশাইনের ওপর আমি ব্যাতিত আর কারোর নজর না লাগুক! সকল কালদৃষ্টি তোকে ছোঁয়ার আগে আমাকে অতিক্রম করুক!”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৯

অরিন মুগ্ধ হয়ে শুনলো তার প্রেমিক পুরুষের কথা।আজ কেন জানি নিজেকে তার বড্ড ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে! মনে হচ্ছে, বড় ভাগ্য করে পেয়েছে সে মানুষটাকে। রৌদ্র অরিনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে।তৎক্ষনাৎ মেয়েটা মুখ নামিয়ে ফেলে। ইশশ্ আবারও লজ্জা! রৌদ্র এবার মেয়েটার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে থাকে,
“ আমার সামনে এতোটা লজ্জা পাস না সানশাইন! কেননা,তোর ওমন লজ্জা মাখা মুখ দেখলে নিজেকে আটকে রাখা দায় হয়ে পড়ে আমার জন্য। বারেবারে ইচ্ছে হয়,তোর সব লজ্জা ভেঙে দিতে। তাই প্লিজ আমায় এতোটা পাগল করিস না!”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here