সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২৪

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২৪
Jannatul Firdaus Mithila

“ হাসি থামা না জানবাচ্চা! তোর গালের গর্তদুটো যে আমায় ভিষণ টানছে! ”
হাসির মাঝে রৌদ্রের এহেন কথায় চট করে হাসি মুখটা থমথমে হয়ে আসে অরিনের। চোখদুটো হয়ে আসে সরু! সে তৎক্ষনাৎ বিছানা ছেড়ে উঠতে নিলে আবারও তার হাতের কনুই চেপে বিছানায় শুইয়ে দেয় রৌদ্র। পরক্ষণে নিজেও বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে, মেয়েটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অরিন কপট রাগ দেখায়।মেকি গাল ফুলিয়ে বলে,

“ আপনি একটা যা-তা ডাক্তার সাহেব! খালি আমায় লজ্জা দেবার পায়তারা খোঁজেন সবসময়!”
প্রেয়সীর এমন গাল ফুলানো কথাবার্তায় মুচকি হাসে রৌদ্র। অরিনের কাছে আরেকটু এগিয়ে আসতে নিয়ে আবারও কি একটা মনে করে পিছিয়ে গেলো সে।অরিন সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে। কিছু বলবে তার পূর্বেই রৌদ্র বলে,
“ তোকে ভালোবাসি সানশাইন! তোর সব মান-অভিমান, লজ্জা সবটাকে ভালোবাসি।তুই আমার মন বাগানে ফুটে ওঠা একমাত্র পবিত্র ফুল। তোকে কিভাবে বিয়ের আগেই গভীরভাবে ছুয়ে দিয়ে অপবিত্র করি বলতো? এটা যে আমার দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু আমার এই হৃদয়টা না, একদমই কথা শোনেনা জানিস! তুই যতবার আমার সামনে আসিস, ঠিক ততবার তোকে গভীরভাবে ছুয়ে দেয়ার ইচ্ছে জাগে এ মনে। খুব কষ্ট হয় নিজেকে সামলাতে সানশাইন! খুব কষ্ট হয়! ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চোখেমুখে একরাশ মায়া টেনে কথাগুলো বলে থামলো রৌদ্র। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শোয়া ছেড়ে উঠে বসে। অরিন এতক্ষণ তীব্র মনোযোগ দিয়ে রৌদ্রের কথাগুলো শুনছিলো।কথাগুলো শুনতে শুনতে বেচারির চোখদুটোর কোটর কখন যে ভরে ওঠেছে টেরই পায়নি সে। রৌদ্র খাটের ওপর দু’হাতের ভর রেখে মাথানিচু করে বললো,
“ ঘরে যা জানবাচ্চা!আরেকটা কথা, এমন হুটহাট আমার ঘরে আসিস না সানশাইন।আর বিশেষ করে রাতে!”
অরিন ধীরে ধীরে উঠে বসে। আলতো করে গায়ের ওড়নাটা মাথায় টেনে উঠে দাড়ায়। তারপর রৌদ্রের দিকে না তাকিয়ে ক্ষুদ্র এক নিশ্বাস ফেলে বলে,
“ ঠিক আছে! তাই হবে। ”
অরিন ধীর পায়ে চলে যায় রুম ছেড়ে। তার প্রস্থানের পরপরই রৌদ্র মাথা তুলে।ইশশ্ আর খানিকটা আগে মাথাটা তুললেই হয়তো তার এমন রক্তবর্ণ আঁখিদ্বয় স্পষ্ট চক্ষুগোচর হতো অরিনের। যাকগে! একদিক থেকে ভালোই হয়েছে বটে।কেননা ছেলেটার এমন দৃষ্টি দেখলে মেয়েটাও যে ছটফটিয়ে উঠতো মুহুর্তেই!

পূব আকাশে ঝলমলে সূর্যের তেজে ইতোমধ্যেই উত্তপ্ত ধরণী। অথচ সময়টা কিন্তু সকালের! বাড়ির গৃহিনীরা সবাই কেমন মনমরা হয়ে এটা-সেটা করে যাচ্ছে। জুবাইদা বেগম আধার মুখে তরকারির পাতিলে খুন্তি নাড়ছেন। রাফিয়া বেগম শশীর সাথে টেবিল গোছাতে ব্যস্ত! অন্যদিকে রাইসা বেগম মাইমুনা বেগমের সাথে রুটি বেলছেন।কাজের ফাঁকে ফাঁকে রাইসা বেগমের টুকটাক কথাবার্তা কিন্তু চলছেই! এই মানুষটা আবার বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারেননা। যদিও এটা তার বিশেষ একটা গুণ! পাশ থেকে মেহনুর এহসান কি যেন একটা খুঁটোখুটি করছেন। তখনি আমেনা বেগম রসুইঘরে ঢোকেন। পানখাওয়া লালচে দাঁতগুলো দিয়ে খানিকটা হেসে বললেন,

“ বড় বউ! একখান কথা কইতে আইছিলাম!”
জুবাইদা বেগম হাতের কাজে খানিকটা অব্যাহতি দিয়ে পেছনে তাকান।আমেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন,
“ জ্বি চাচি,বলুন কি বলবেন? ”
পৌঢ়া কিছুক্ষণ সংকোচ করলেন। তা দেখে জুবাইদা বেগম ফের বললেন,
“ বলুন চাচী! ”
আমেনা বেগম এবার ছলছল চোখজোড়া নিবদ্ধ করলেন জুবাইদা বেগমের দিকে। বলতে লাগলেন,

“ বউ! তোমরা তো আইজকাই যাইবাগা। তাই আমি কইতাছিলাম কি, একবার যদি ঐবাড়িত গিয়া তোমার চাচী-শাশুড়িরে দেইখা আইতা তাইলে বহুত ভালা হইতো। বেডির অবস্থা বেশি একটা ভালা না।বিছানা লইয়া লাইছে হেই কবে। তোমরা আইছো হুনছে পর থেইক্কাই তোমাগোরে একপলক দেখতে চাইছে। যদি তোমরা একটুখানি শেষ দেখা দেইখা আইতা হেতিরে তাইলে ভালা হইবো। শত হইলেও বেডিরে তো বেডির করা পাপে ধরছে।”
শেষ কথাটা শুনে খানিকটা আঁতকে ওঠেন রাফিয়া বেগম। টেবিল গুছিয়ে এসে সেই কখন থেকে আমেনা বেগমের পেছনে দাড়িয়ে চুপচাপ সবটা শুনছিলেন তিনি।কিন্তু শেষ কথাটায় বড্ড কষ্ট লাগলো তার।তিনি আহত গলায় বলেন,
“ নাহ চাচী।ওভাবে বলবেন না।আল্লাহ এভাবে কাওকে তার পাপের শাস্তি না দিক।মানুষটা যেমনই হোক, আল্লাহ যেন তাকে শেফা দান করে।”

আমেনা বেগম হালকা মাথা দুলালেন।মলিন হওয়া শাড়ির আচলে চোখ দুটো মুছে নিয়ে বললেন,
“ শুধুই কি বলিগো বউ! হেইতি যেই কিচ্ছা -কাহিনি করছে তোমার শাশুড়ির লগে, তার লাইগা হইলেও হের এহন বেজায় আপসুস হয়।দেহোনা,কয়বার আইছে তোমগো খোঁজে। এহন কও তুমরা কি যাইবা?”
এপর্যায়ে সবাই মৌন রইলো। সকলের দৃষ্টি এসে পড়লো জুবাইদা বেগমের দিকে। হয়তো তার সিদ্ধান্তের ওপরই ভরসা করছেন সকলে। জুবাইদা বেগম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে কিছু একটা ভাবলেন। পরক্ষণেই গলা মৃদু খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠেন,
“ যাবো চাচী! একজন মৃত্যুশয্যায়ী মানুষকে শেষবারের জন্য দেখতে হলেও যাবো।”
তার এহেন কথায় সকলে একমত হলেও বাঁধ সাধলেন মেহনুর। মুখে একরাশ ঘৃণার প্রলেপ একে মোটা কন্ঠে বললেন,

“ কেন বড় ভাবি? কেন ঐ খুনি মহিলাকে দেখতে যাবে তোমরা? কি দরকারে যাবে? যেই মানুষটা আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী, সেই মানুষটাকে শেষবারের মতো দেখতে যেতে চাচ্ছো তোমরা?”
জুবাইদা বেগম হাতের কাজ ফেলে এগিয়ে আসেন মেহনুরের দিকে।মেয়েটা ইতোমধ্যেই কেঁদে দিয়েছে। জুবাইদা শাড়ির আচল টেনে আলগোছে মুছে দিলো মেহনুরের চোখ। বোঝাতে লাগলো,
“ মেহু! কার মৃত্যু কখন হয় তা আমরা কেও জানিনা বোন। জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটাই বিধাতার হাতে।আম্মার মৃত্যুতে হয়তো উসিলা ছিলেন তোমার চাচী।কিন্তু মৃত্যু তো অনিবার্য তা-ইনা? তাছাড়া সেই মানুষটা নিজের পাপের শাস্তি ইতোমধ্যেই যা পাওয়ার পেয়ে গেছে। বাকিটুকু নাহয় আল্লাহই দিবেন। তাছাড়া ভুলে যেও না, ক্ষমা করা কিন্তু মহৎ গুণ! ”
মেহনুর কি বুঝলো কথাগুলো! তিনি তো অশ্রুসিক্ত লোচনে তাকিয়ে রইলো ভাবিদের দিকে।

সকাল সকাল উঠোনজুড়ে বাড়ির কর্তাদের চা-নাশতার আড্ডা বসেছে বেশ।বৃদ্ধ আবুল মিয়া এটাসেটা বলে যাচ্ছেন আর তার সঙ্গেই নিজেদের মত বিনিময় করে যাচ্ছেন কবির সাহেব আর তার ভাইয়েরা।কথা বলার একপর্যায়ে সেখানে এসে উপস্থিত হয় রৌদ্র আর অনিক।কবির সাহেব সরু চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে ফের দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
“ সন্ধ্যায় রওনা দিচ্ছি! তোমরা চাইলে গ্রামটা একবার ঘুরে আসতে পারো।”
অনিক আলতো করে মাথা কাত করে। রৌদ্র সেদিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে খালি চেয়ার টেনে বসে পড়ে আলগোছে। আবুল মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“ দাদুভাই! আপনার গিঁটে ব্যাথাটার কি অবস্থা এখন?”
বৃদ্ধ তার ফোকলা দাঁতগুলো বের করে একগাল হাসলো। রৌদ্রের মাথায় হাত রেখে কৃতজ্ঞতার সহিত বললো,
“ এহন এক্কেবারে কইম্মা গেসে ভাই। তোমার দেওয়া ঔষধটা আমার মেলা উপকারে আইসে।”
রৌদ্র মুচকি হাসলো। তার সাথে উপস্থিত সকলেও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের পানে।কবির সাহেব ছেলের প্রশংসায় মৃদু হাসলেন। পরক্ষণেই তা মিলিয়ে দিলেন অজানায়। মুখাভঙ্গী আগের ন্যায় রেখে আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছেন তিনি।

সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়েছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোদের উত্তপ্ততা।অরিনসহ বাড়ির মেয়েগুলো সবাই এসে বসেছে পুকুর ঘাটে। রোদের যা উত্তাপ! সেখানে পুকুর ঘাটের বড় বড় গাছগুলোর ছায়াতলেই যেন প্রাণটা জুড়চ্ছে সবার। শশী বসে আম কাটছে। কুহেলি মাখছে পাকা জামমাখা। সোহেলী গেছে বাড়ির ভেতরে নুন-মরিচগুড়ো আনতে। কাঁচা আম কি আর এমনি এমনি খাওয়া যায়? সেগুলো খেতে হলে নুন-লঙ্কাগুড়ো যে চাই চাই! অরিন একপা ভাজ করে অন্যপা দুলিয়ে বসে আছে ঘাটের পাশের উঁচু বেঞ্চিতে। তার পাশেই বসে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে আহিরা। আর মাহিরা করছে আরেক কাজ। পুতুল আর রাতুল দু’জনকে নারকেল পাতা দিয়ে চশমা বানিয়ে দিচ্ছে গুণী মেয়েটা। তা দেখে অরিন খানিকটা চেচিয়ে উঠে,

“ এই মাহি! ওদের জন্য বানানো শেষ হলে আমাকেও একটা বানিয়ে দিস প্লিজ!”
মাহিরা তাকায় অরিনের দিকে। মৃদু হেসে বলে,
“ আচ্ছা! ”
শশী আম কাটা শেষ করে উঠে দাড়ায়। পুকুরের দু সিড়ি নিচে নেমে বটিটা হালকা ধুয়ে, নিজেও হাতদুটো ধুয়ে চলে আসে। এসেই সবাইকে তাড়া দিয়ে বলে ওঠে,
“ এই, যারা যারা খাইবে তারা চইলা আসো।নাইলে কিন্তু পরে ভাগেও পাইবানা!”
মেয়েটার বলতে দেরি,সকলের এসে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেরি নেই। একে একে সবাই যার যার মতো আম নিয়ে খেতে শুরু থাকে আয়েশ করে। খাওয়ার এক পর্যায়ে সেখানে আগমন ঘটে তামিমের। ছেলেটার আজকে গেটআপটাই আলাদা।সবসময়ের মতো ঢিলেঢালা শার্ট আর প্যান্টের বদলে আজকে তার গায়ে শোভা পাচ্ছে টিশার্ট আর শর্টস। শশী খেতে খেতে আড়চোখে তাকিয়ে রইলো তামিমের দিকে।হয়তো বুঝতে চেষ্টা করছে ছেলেটার ভাবভঙ্গি। তামিম হালকা হেসে বলে ওঠে,

“ কি খাচ্ছো তোমরা?”
শশী নাক কুঁচকায়। জবাব দেয়,
“ গরুর মাথা! খাইবা?”
এহেন কথায় তামিম ভ্রু কুচকায়। দৃষ্টি খানিকটা সরু করে খেঁকিয়ে বলে ওঠে,
“ ফাইজলামি করস আমার লগে? মুখে দেহি একগাদা আম ঢুকাইয়া রাখছস।তারওপর মিছা কথা কস আমার লগে।”
শশী এবার চটে যায়। মুখ ঝামটি মেরে বলে,
“ চোখে যহন এতোই পাওয়ার, তাইলে মুখে মুখে হুদাই কথা খরচ করো কেন? তুমিতো দেখতেই পারতেছো আমরা কি খাই,তাইলে আবার জিগাও কোন আক্কেলে?”
তামিম দাত কটমট করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অরিন তাদের থামিয়ে দেয়। বলে,
“ আরে, থামো তোমরা।এভাবে ঝগড়া না করে আম খাও। তামিম ভাইয়া, এই নিন!”
বলেই কাটা আমের বাটিটা এগিয়ে দেয় তামিমের দিকে। তামিমও অরিনের দিকে একবার তাকিয়ে বাটি থেকে আম তুলে নেয়। বলে,

“ শুধু তুমি বললে দেখে চুপ করে গেলাম। নাহলে আজকে ওরে ঠিকই পানিতে চুবানি খাইয়ে ছাড়তাম। ”
অরিন ঠোঁট টিপে হাসে।শশীর দিকে তাকাতেই দেখতে পায়, মেয়েটার সরু দৃষ্টি যা কি-না তামিমের দিকেই নিবদ্ধ। অরিন অবস্থার বেগতিক দেখে শশীর হাত ধরে নিজের সাথে বেঞ্চিতে নিয়ে আসে। তখনি তামিম ফের বলে ওঠে,
“ আচ্ছা তোমরা তো আজকেই চলে যাবে তাইনা?”
আহিরা পাশ থেকে ফট করে জবাব দেয়,
“ হু, কেন?”
তামিম এবার মৃদু হাসে।সময় নিয়ে বলে,
“ না ভাবছিলাম আজকে বিকেলের দিকে তোমাদের নাহয় গ্রামটা একটু ঘুরে দেখাই।কেননা, তোমরা তো বিয়ে উপলক্ষে এতদিনে একবারও ঘোরার সুযোগ পাওনি। তাই বলছিলাম তোমরা যদি চাও তাহলে আজ নাহয় আশপাশটা একটু ঘুরে দেখলে!”

তামিমের কথাটা বেশ মনে ধরলো সকলের। ঠিকই তো বিয়ের জন্য তারা তো কোথাও ঘুরতে অবধি গেলোনা। অরিন চুপ করে রইলো। পাশ থেকে কুহেলি উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো,
“ হ্যা,অবশ্যই। আজকে তাহলে গ্রামটা ঘুরে আসি আমরা। এই কি বলিস তোরা?”
অগত্যা সকলেই অবশেষে রাজি হলো প্রস্তাবে।অরিনও খানিকক্ষণ দোনোমোনো করে শশীর চাপাচাপিতে পড়ে অবশেষে রাজি হলো। তা দেখে তামিমের ঠোঁটের কোণে বক্র হাসি ফুটে ওঠে। কে জানে আবার কি চলছে তার মনে!
কিছুক্ষন পরে রিমি কোথা থেকে যেন ছুটে আসে সকলের মাঝে। এসেই দুহাটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে থাকে মেয়েটা। অরিন এগিয়ে এসে মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,

“ কি হয়েছে রিমু? এভাবে হাঁপাচ্ছো কেন?”
রিমি সময় নিলো স্বাভাবিক হতে। তারপর থেমে থেমে বললো,
“ অরিপু, তোমায় ছোট মামি ডাকছে। ছাদের চিলেকোঠার ঘরে। একটু তারাতাড়ি যেতে বলেছে তোমায়!”
অরিন মাথা নাড়িয়ে সায় জানায় রিমির কথায়।তারপর হাতে থাকা আমটা খেতে খেতেই চলে যায় বাড়ির ভেতরে। পেছন থেকে অবশ্য কেও একজন নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

“ ছোট মা! ও ছোট মা? কোথায় তুমি? ”
ছাঁদে এসেই একপ্রকার হাঁক ছুড়ছে অরিন। কিন্তু আশপাশ থেকে কোনরূপ প্রতিত্তোর আসছেনা তার ছোট মা’র। অরিন খেতে খেতেই চিলেকোঠার ঘরের দিকে যায়।ভিড়িয়ে রাখা দরজা সামান্য ঠেলে দিতেই ভেতর থেকে একজোড়া পুরুষালী হাত এসে টেনে নিয়ে যায় মেয়েটাকে। অরিন ভরকায়।ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে ওঠে মেয়েটা। চোখ কুঁচকে চিৎকার করতে যাবে তার আগেই তার মুখটা চেপে ধরে সামনের মানুষটা। ফিসফিসিয়ে বলে,
“ এই সানশাইন! আমি এটা।দেখ আমার দিকে।চোখ খোল জান।”
কর্ণকুহরে পরিচিত কন্ঠ পৌছুতেই ফট করে
আঁখিদ্বয় মেলে তাকায় অরিন। কিয়তক্ষন পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র মেয়েটার মুখ হতে হাত সরায়।তখনি অরিন মেকি অভিমানী কন্ঠে বললো,

“ এভাবে কেও ভয় দেখায়? আরেকটু হলেই তো জানটা বেরিয়ে আসতো আমার!”
চট করে ভ্রুদ্বয়ের মাঝে গুটিকয়েক ভাজ পড়লো রৌদ্রের।গম্ভীর গলায় শুধায় সে,
“ জান বেরিয়ে আসবে মানে? আমি বেঁচে থাকতে এই কথা মুখে আসে কেন তোর? ”
অরিন হতবিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে রইলো।ছেলেটাকে সে বললো কি,আর ছেলেটা বুঝলো কি? অরিন শুধরে দিয়ে বললো,
“ না, আমি এমনভাবে বলতে চাইনি, আসলে…..”
“ হয়েছে থাম।আর কখনো যেন এসব ফালতু কথা মুখে না আসে তোর। ওকে?”
তৎক্ষনাৎ মাথা ঝাকায় অরিন। স্বস্তির একখানা নিশ্বাস ফেলে যেই না চলে যেতে নিবে ওমনি তাকে দু’হাতের মাঝে আটকে ফেলে রৌদ্র। বলে ওঠে,

“ তোকে কি আমি যেতে বলেছি?”
অরিন মাথা নাড়িয়ে না জানায়।রৌদ্র ফের বলে,
“ তাহলে?”
অরিন নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে রইলো জড়সড়ভাবে।রৌদ্র খানিকটা এগিয়ে এসে মেয়েটার ঘর্মাক্ত ললাটে আলতো করে চুমু একে দেয়। তারপর মেয়েটার চোয়ালে আলতো করে ধরে উঁচুতে তুলে বললো,
“ বিকেলে কোত্থাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই জান! সবাই গেলেও তুই বাড়িতে থাকিস কেমন? আমি তোকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে আনবো ঠিক আছে? ”
অরিন উপর নিচ মাথা দোলায়।তা দেখে রৌদ্র মুচকি হাসলো। কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো,
“ আর হ্যা! কোন ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলার দরকার নেই সানশাইন! এই ওয়েট, হেসে হেসে কথা কি… তোর কোন ছেলের সাথেই কথা বলার প্রয়োজন নেই ওকে? কেও কথা বলতে এলেও জাস্ট ইগনোর দেম। গট ইট সানশাইন? ”

এপর্যায়ে দুষ্ট হাসলো অরিন।চোখদুটো সরু করে প্রশ্ন করলো,
“ আপনি কি জেলাস হচ্ছেন ডাক্তার সাহেব? ”
রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের। অরিনের চোখের দিকে নিজের ঘোলাটে চোখদুটো রেখে স্মিত হেসে বললো,
“ কোন সন্দেহ? ”
খিলখিল হাসিতে মেতে ওঠে অরিন। হাসতে হাসতে মেয়েটার দাঁড়িয়ে থাকাও মুশকিল হয়ে পড়েছে যেন। তার এমন ভুবনমোহিনী হাসিতে নিজেও একপর্যায়ে হেসে ওঠে রৌদ্র। তারপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। অদ্ভুত শান্ত কন্ঠে বললো,
“ তোর মুখের হাসিতে কারো নজর না লাগুক!
বিনিময়ে পৃথিবীর সকল কলংক আমার নামে থাকুক!”

ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন কবির সাহেব। তখনি কাজকর্ম শেষে ঘরে ঢুকেন জুবাইদা বেগম।স্বামীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন বিছানার কাছে। স্বামীর শিউরে বসে ধীমী স্বরে বললেন,
“ রোদের আব্বু? ঘুমিয়ে আছো?”
চোখ মেলেন কবির সাহেব। আলতো হেসে বললেন,
“ না, কিছু বলবে?”
জুবাইদা বেগম খানিকক্ষণ ইতস্ত করতে লাগলেন। তার এহেন ভাবমূর্তি দেখে কবির সাহেব গম্ভীর হলেন,
“ কি হলো? বলো কি বলবে।”
জুবাইদা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন।মনে একরাশ সাহস সঞ্চার করে বললেন,

“ আমি… না,আসলে আমরা সবাই চাচ্ছিলাম…যদি একবার ঐবাড়ি গিয়ে চাচীকে….”
কথাটা শেষ করবার আগেই হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলেন কবির সাহেব। মুখভঙ্গি আরেকটু শক্ত করে নিলেন মুহুর্তেই।কাঠকাঠ গলায় বললেন,
“ একবার বলেছো তাই কিছু বললাম না। কিন্তু দ্বিতীয়বার ভুলেও এ-কথাটা উচ্চারণ করতে যেয়ো না জবা।কেননা পরবর্তীতে আমি হয়তো এতোটাও শান্ত থাকবো না জবাব দিতে।আশা করি তুমি তোমার কাঙ্খিত কথার উওর পেয়ে গিয়েছো!”
কথাটা বলে আর একমুহূর্তও বিছানায় থাকলেন না কবির সাহেব। গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। অথচ পেছনে পড়ে রইলেন আহত মনের জুবাইদা বেগম। স্বামীর চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে মনে মনে বললেন,
“ এই রাগ যেন আবার নতুন কোন শোকের ছায়া না নিয়ে আসে রোদের আব্বু! ”

“ তোরা আবার কোথায় যাচ্ছিস এখন? আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তো রওনা দিতে হবে!”
রাফিয়া বেগমের কথায় পেছনে ফিরে আহিরা।চুলের পিঠে বো-ক্লিপটা ঠিকঠাক করে নিয়ে ব্যস্ত গলায় বললো,
“ মেজো মা,আমরা সবাই একেবারে রেডি হয়েই নিচে নেমেছি।আমরা এখন যাচ্ছি গ্রামটা একটু ঘুরতে। ঘোরা শেষ হলে এসেই রওনা হবো একেবারে! ”
“ ঠিক তো? সময়মতো এসে পড়িস সবাই কেমন?”
রাফিয়া বেগমের উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলা কথায় মুচকি হেসে সায় জানায় আহিরা।দ্রুত কদমে বাইরে গিয়ে মিনিটের ব্যাবধানে আবারও ফিরে আসে সে।তা দেখে রাফিয়া বেগম ফের বললেন,
“ কি হলো? কিছু ভুলে গেলি না-কি? ”
আহিরা এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘোরায়।বলে,

“ অরিপু কোথায় মেজো মা? আপুও তো যাবে বলেছিলো।”
রাফিয়া বেগম বসা ছেড়ে উঠে দাড়ায়। জোর গলায় ডাক ছাড়েন দোতলার দিকে,
“ অরি? অরি? নিচে নাম মা!”
প্রায় মিনিট খানেক পর নিচে নামে অরিন। পড়নে তার সাদামাটা কাপড়।রাফিয়া বেগম ভ্রু গোটালেন। বললেন,
“ তোর নাকি ঘুরতে যাওয়ার কথা! তাহলে এখনও রেডি হলি না যে?”
অরিন মাথা নাড়িয়ে নাকচ করে। খামখেয়ালি কন্ঠে বলে,
“ না মা! এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। আরেকটু পর তো রওনা দিতেই হবে তা-ই না!”
অরিনের কথা শেষ হতেই আহিরা আহত গলায় বললো,
“ কি বললে? তুমি যাবেনা মানে? তুমি না গেলে আমরা যাবো কেন? যাবো না আমরা!”
অরিন এগিয়ে আসে। আহিরাকে বুঝিয়ে বলে,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২৩

“ আহি একটু বোঝ! আমার ইচ্ছে করছে না সত্যি!”
“ ঠিক আছে ফাইন! যেতে হবে না তোমার। আমিও যাচ্ছি না।”
এরূপ পরিস্থিতিতে রাফিয়া বেগম অরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ তুই তো এর আগে কখনো যাসনি ঘুরতে।আজকে নাহয় ওদের সাথে ঘুরে আয়!”
অগত্যা মায়ের এবং বোনের জুরোজুরিতে না চাইতেও রাজি হতে হলো অরিনকে।মেয়েটা মুখে মুখে রাজি হলেও মনে তার হাজারটা সংশয় এসে দানা বাধছে। তার ডাক্তার সাহেব যদি রাগ করে এ নিয়ে তখন?

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here