সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২৫
Jannatul Firdaus Mithila
“ ভাইয়া! আর কতদূর? ”
গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটছে অনিক আর রৌদ্র। অনিক যদিও একটু পরপর এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে কিন্তু প্রতিত্তোরে রৌদ্র বরাবরের মতো নিশ্চুপ। এবারেও তাই হলো।রৌদ্র অনিকের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সামনের দিকে। অনিক এবার দৌড়ে এসে রৌদ্রের পথ আটকে দাড়ায়। বলে,
“ তুমি বলবে আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”
রৌদ্র সরু চোখে তাকিয়ে অনিকের দিকে। খানিকটা সময় নিয়ে বলে,
“ তোর বউকে দেখতে যাচ্ছি। চল!”
রৌদ্রের কথায় অনিক অবাক হয় বেশ। পরক্ষণেই বলে,
“ মজা করোনা ভাইয়া! কোথায় যাচ্ছি আমরা? ”
রৌদ্র আগের ন্যায় অভিব্যাক্তি ধরে রেখে গম্ভীর গলায় বললো,
“ তোর কি আদৌও মনে হচ্ছে আমি মজা করছি?”
অনিক মাথা নাড়ায়।তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,
“ সত্যি যাচ্ছি? কিন্তু ওকে এখন কই পাবো আমরা?”
“ সামনেই পাবি।তোর সম্বন্ধির সাথে ঘুরতে আসছে শুনলাম। ”
অনিক একবার খামখেয়ালি হয়ে আচ্ছা বলে অন্যদিকে তাকায় কিন্তু পরক্ষণেই কথাটা বোধগম্য হতেই চোখদুটো বড়সড় হয়ে আসে ছেলেটার।রৌদ্রের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ সম্বন্ধি মানে? ইকরার আবার বড় ভাই আছে না-কি? ”
রৌদ্র হাসলো ঠোঁট পিষে।বাম ভ্রু খানিকটা উঁচিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
“ যাকে ভালোবাসিস বলছিস,তার ভাই আছে কি-না সেটাই জানিস না? সিরিয়াসলি অনিক? শেইম অন ইউ!”
অনিক লজ্জিত মুখে মাথা চুলকায়।বিরবিরিয়ে বলে,
“ ভালোতো বউকে বাসি,বউয়ের ভাইকে না। তাইতো বউয়ের প্রতি ইন্টারেস্টেড হচ্ছি তার ভাইয়ের প্রতি না।”
বিকেলটা নেমে এসেছে ধীরে ধীরে। পশ্চিম আকাশে রঙ বদলাচ্ছে, লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছে মাঠের প্রান্ত ছুঁয়ে দূরের গাছগাছালিতে।গ্রামের কাঁচা রাস্তায় ধুলা উড়ছে সামান্য,কাঁচা মেঠোপথের একপাশে ঢেউখেলানো পুকুর।পুকুরের জলে তখনো দুপুরের রোদ্দুরের রেশ, তবুও জল যেন একেবারেই শান্ত! পাড়ের কদমগাছ তার ছায়া ফেলে রেখেছে নীরবতায়। নারিকেল গাছে বসে আছে কয়েকটা শালিক, আর মাঝে মাঝে কা-কা শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে কাকের দল। গ্রামের পড়ন্ত বিকেলের এহেন সৌন্দর্যে মুগ্ধ সবাই। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে অরিনরা।আর কিছুটা সামনে এগোলেই গ্রামের স্কুল মাঠ।সেখানে আবার আজকে ছোটখাটো একটা মেলা বসেছে। কুহেলি, শশীতো মেলা দেখেই বেশ উল্লাসীত।তারা একপ্রকার ছুটে যায় মেলার দিকে।আহি,মাহি ও বাচ্চা দুটো তাদের হাত ধরে মেলার দিকে যায়।পেছনে পড়ে রইলো অরিন আর তামিম।অরিন বিরক্তি নিয়ে একে একে অনেকগুলো কল দিয়েই যাচ্ছে রৌদ্রের ফোনে কিন্তু বারবার ফোনটা নট রিচেবেল বলছে।হয়তো নেটওয়ার্কে সমস্যা হচ্ছে! অরিন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মেলার দিকে।
তখনি পেছন থেকে তার একহাত চেপে ধরে তামিম। অরিন থামে।তৎক্ষনাৎ চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঝটকা মেরে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় তামিমের হাত থেকে। ঝাঝাঁলো গলায় বলে,
“ আমায় ছোঁয়ার সাহস পেলেন কোথায় আপনি? ”
তামিম অরিনের ঝাঁঝালো কথাতেও মুচকি হাসছে।অরিন এতে বেজায় বিরক্ত হলো। আরেকধাপ চটে গিয়ে বললো,
“ এভাবে পাগলের মতো হাসছেন কেন আপনি? আমার কথা কানে যাচ্ছে না আপনার? ”
তামিম এবার আশেপাশে নজর দেয়। জায়গাটা বেশ ফাঁকা। অদূরেই মেলা বসায় এদিকটা প্রায় জনমানবহীন। তামিম এ সুযোগটাই কাজে লাগায়।ফোন বের করে কাউকে কি যেন একটা মেসেজ পাঠালো।তারপর অরিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ সরি অরিন! আসলে আমি তোমার সাথে একটু ফ্রী হয়ে গিয়েছিলাম তাই ভাবলাম হাত ধরলে হয়তো তুমি তেমন মাইন্ড করবেনা।কিন্তু তুমি কষ্ট পেয়েছো তার জন্য আমি দুঃখিত। প্লিজ ফরগিভ মি!”
এতবার ক্ষমা চাওয়ায় অরিন আর না বলতে পারলোনা।সে নাক ফুলিয়ে শক্ত গলায় বললো,
“ ঠিক আছে। বাট রিমেম্বার ওয়ান থিংক, এভরিওয়ান আর নট সেম!”
তামিম তড়িৎ মাথা ঝাকায়। হাত বাড়িয়ে সামনে ইশারা করে বললো,
“ চলো যাওয়া যাক তাহলে!”
অরিন আর কিছু না বলে আগে আগে সেখান থেকে হাঁটা শুরু করে। কিছুটা সামনে যেতেই কেও একজন পেছন থেকে তার মুখে রুমাল চেপে ধরে। অরিন হাত-পা ছুড়ে সবেগে। হাতের নখ দিয়ে খামচে ধরে পেছনের মানুষটাকে। বেশকিছুক্ষন ধস্তাধস্তি শেষে অরিন কিছুটা দূর্বল হয়ে আসে। এই সুযোগে পেছনে থাকা তামিম তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যায় রাস্তার ওপাশের জনমানবহীন গুরুর গোয়ালের দিকে।অরিন তখনো সজাগ। নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে মেয়েটা কিন্তু পুরুষালী শক্তির কাছে বরাবরই হার মানছে তার মেয়েলি শক্তি। তামিম অরিনকে একপ্রকার ছুড়ে ফেলে গরুর ঘরের দিকে। তারপর নিজেও ঘরটায় ঢুকতে নেয় তখনি পেছন থেকে তার পিঠ বরাবর সজোরে লাথি বসায় কেও।হঠাৎ আক্রমণে তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে উল্টে পড়ে তামিম।পিঠে হাত চেপে পেছনে তাকাতেই দেখতে পায় রৌদ্রের অগ্নিমূর্তি রুপ। অনিক দৌড়ে এসে বোনকে উঠে বসায়। গা থেকে খড়ের অংশবিশেষ ছাড়িয়ে দিয়ে বোনকে বুকে চেপে ধরে সে।কাঁপা কাঁপা গলায় শুধায়,
“ বনু! তোর ক-কিছু হ-হয়নি তো?”
অরিন কি বলবে? সে-তো ভাইকে পেয়ে বুক ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েছে নিমিষে।ভাইয়ের পিঠ শক্ত করে আকড়ে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় থেমে থেমে বলে,
“ ভাইয়া! ও -ও আমায় জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে। ও খুব খারাপ ভাইয়া।খুব খারাপ! ”
বোনের মুখে এহেন কথা শুনে নিজের কান্নাগুলোকে আর আঁটকে রাখতে পারলো না অনিক।সেও নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে বোনকে বুকে জড়িয়ে।
এদিকে রৌদ্র বুঝি তামিম ছেলেটাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলবে।হাতের সামনে যা পেয়েছে তাই দিয়েই ছেলেটাকে বেধড়ক মারধর করছে রৌদ্র। পরিশেষে ছেলেটার নাকমুখ ফেটে একাকার অবস্থা! তবুও থামলো না রৌদ্র। ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশ খুজে গরু বাঁধার রশি খুজেঁ পায় সে। ছো মেরে সেটাকে নিয়েই গলায় পেচিয়ে ধরে ছেলেটার।তারপর শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে ছেলেটার গলা।তীব্র আক্রোশে বলতে থাকে,
“ মৃত্যু সমতুল্য অপরাধ করেছিস তুই।তাহলে মৃত্যু তো তোর জন্য অবধারিত বাস্টার্ড**!”
তামিমের চোখ উল্টে আসে।হাত দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টায় তৎপর সে। পাদু’টো মাটিতে ছোড়াছুড়ি করছে বেশ।অনিক এবার রৌদ্রের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই বোনকে ছেড়ে দৌড়ে এসে রৌদ্রকে পেছন থেকে টেনে ধরে। অনুনয় করে বলতে থাকে,
“ রোদ ভাই! প্লিজ ওকে ছাড়ো। ও মরে যাবে। ”
“ মরুক ” – কঠোর গলায় বললো রৌদ্র।
“ ভাইয়া, ও মরে গেলে তোমার ক্ষতি হতে পারে! আর তোমার কিছু হলে আমার বোনটার কি হবে একবার ভাবো!”
তৎক্ষনাৎ হাতদুটো ঢিলে হয়ে আসে রৌদ্রের। তামিমকে ছেড়ে দিয়ে এক-কদম পেছনে সরে আসে সে। কোমরে দু’হাত চেপে ওপরের দিকে মুখ তুলে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে থাকে অনবরত। রাগে-জেদে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে তার। হাতের মুষ্ঠিতে এখনো লেগে আছে তাজা রক্ত! এ রক্ত শুধু যে তামিমের তা কিন্তু নয়, ছেলেটার হাতও যে বেশ ক্ষত হয়েছে ইতোমধ্যে! প্রায় মিনিট পাঁচেক পর রৌদ্র অরিনের দিকে তাকায়। চোখেমুখে তার ভিন্ন এক আক্রোশ! সে সবেগে অরিনের কাছে গিয়ে, একহাতে জোর করে টেনে দাড় করায় মেয়েটাকে।অরিনের বাহু বরাবর সজোরে চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলতে থাকে,
“ এই! তোরে আমি বলছিলাম না? ওর সাথে আসতে না? তবুও কেন আসলি? উত্তর দে! কেন আমার কথা অমান্য করলি তুই?”
অরিন প্রতিত্তোরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে শুধু! তা দেখে রৌদ্রের আজ মায়া হওয়ার বদলে রাগটাই যেন বেশি হলো।সে এবার সজোরে শক্ত হাতে চোয়াল চেপে ধরে অরিনের। আবারও খেঁকিয়ে ওঠে বলতে থাকে,
“ চুপ করে আছিস কেন তুই? কি মনে করিস তুই নিজেকে? প্রতিটা মুহূর্তে একটা না একটা বিপদ সেধে ডেকে এনে আমায় হয়রান করিস।কেন? আমি কি তোর চাকর? তুই টাকা দিয়ে পুষে রাখছিস আমারে? যাতে তুই যতোবার বিপদে পড়বি,ততবার আমি এসে তোরে বাঁচাবো! কি পেয়েছিস তুই আমাকে? কি ভাবিস আমায় তুই? আমি মানুষ না? আমার কথার কি নূন্যতম মূল্যটুকুও নাই তোর কাছে?”
কথাগুলো শেষ করে অরিনের চোয়াল ছেড়ে দেয় রৌদ্র। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় সে।অন্যদিকে ভয়ে-হতবাকতা সবটা মিলিয়ে একেবারেই মূর্ছাপ্রায় অরিন।কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে এসেছে তার। এবার রৌদ্র মেজাজ হারায়। তেড়ে এসে অরিনের চোয়ালে খানিকটা আলতো করে চেপে ধরে মুখটা উঁচু করে।অতপর দাঁত কটমট করে বলে,
“ এই,এই কান্না থামা! কান্না থামা বলছি! খবরদার আর একবিন্দু চোখের পানিও যদি গাল থেকে গড়ায় তাহলে আই সয়্যার আমি তোকে এক্ষুনি জানে মেরে ফেলবো! তাই ভালোয় ভালোয় কান্না থামা!”
অগত্যা এহেন ধমকিতে বহুকষ্টে নিজের কান্না মুখ চেপে বন্ধ করে অরিন।তবুও চোখ যেন তার বাঁধ মানছেনা।সেখান থেকে অঝোরে ঝরে পড়ছে অশ্রুধারা। অরিন বারবার হাতের উল্টো পিঠে চোখদুটো মুছে নিচ্ছে কিন্তু পরক্ষণেই তা আবারও ভিজে ওঠছে। রৌদ্র কোমরে দু’হাত চেপে শক্ত চোয়ালে দাঁড়িয়ে আছে অরিনের সামনে। অরিন একবার আড়চোখে রৌদ্রের দিকে তাকায়। পরক্ষণে হেঁচকি দিতে দিতে বলে,
“ থামছেনা তো!”
রৌদ্র কিছু বললো না।সে দু-কদম পিছিয়ে যায় সেখান থেকে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পরপর নিশ্বাস ফেলে আবারও চোখ দুটো মেলে তাকায়। রক্তবর্ণ দৃষ্টি অরিনের দিকে নিক্ষেপ করে এগিয়ে আসে। মেয়েটার বাহুতে আরেকবার চেপে ধরে দাঁত কটমট করে বলে,
“ এই তুই আমার কথা মানলি না কেন? আমার না বলা স্বত্বেও কেন এই বাস্টার্ডের সাথে এলি? আচ্ছা আমার কথার কি কোন মূল্য নাই তোর কাছে? কি ভেবেছিস তুই? আমি তোর সাথে সো-কলড প্রেম করছি? হাহ! সত্যি তুই এটা ভেবেছিলি? তাহলে কান খুলে শুনে রাখ মেয়ে, তুই আমার প্রেম না, তুই আমার অবসেশন! অবসেশন বুঝিস? মাদকাসক্ত মানুষ যেমন মাদকের প্রতি আসক্ত ঠিক তেমনি আমি তোর প্রতি আসক্ত। গভীরভাবে আসক্ত, যেই আসক্তির বিন্দুমাত্র পরিমাপ তুই তোর গোটা জীবন লাগিয়ে হিসাব করলেও বের করতে পারবিনা। তোকে যদি শুধুই ভালোবাসতাম তাহলে হয়তো তোর এসব কাজের জন্য তোকে এক্ষুনি নিজের দুচোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলতাম কিন্তু তোকে যে শুধু ভালোবাসিনা।তোকে যে নিজের #সঙ্গীন_হৃদয়ানুভুতি হিসেবে মানি। তাহলে তুই বল তোকে আমি কিভাবে ছাড়ি? কিভাবে বল?”
অরিন ছলছল নেত্রে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।রৌদ্রের বলা প্রতিটা কথাই যেন তার হৃদয়ে ঝড় তুলছে।মেয়েটা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রৌদ্র ফের বললো,
“ আচ্ছা! তুই আমার কথাগুলো মান্য করিসনি,তার কারণ কি শুধু এটাই যে, আমার তোর ওপরে কোনরকমের অধিকার নেই? আসলেই কি এই কারণে তুই আমার কথাগুলোর তেমন পাত্তা দেসনি? আচ্ছা ঠিক আছে। চল! এক্ষুনি তোর ওপর নিজের ন্যায্য অধিকার টানবো।চল!”
অরিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। দৃষ্টিতে তার একরাশ জিজ্ঞাসাবোধ।পেছন থেকে অনিক দাঁড়িয়ে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ মানে? কিসের অধিকারের কথা বলছো তুমি?”
রৌদ্র চোখ বন্ধ করে এদিকওদিক ঘাড় ফুটিয়ে বললো,
“ তোর বোনের ওপর নিজের আসল অধিকার টানতে।বিয়ে করবো ওকে।এক্ষুনি, এ মুহুর্তে! ”
সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে ওঠে অনিক। হতবাক কন্ঠ বুঝি বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো মুহুর্তে। অরিনটারও যে একই দশা।সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে আছে নিজ জায়গায়। অনিক এবার এগিয়ে এসে রৌদ্রের সামনে দাঁড়ায়। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“ ভাইয়া? আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড? কি বলছো তুমি এসব! বুঝলাম তুমি এখন রেগে আছো,তাই বলে রাগের মাথায় এতোবড় একটা স্টেপ নিয়ে ফেলবে? ভাবতে পারছো, ভুলক্রমেও যদি এটা ঘুনাক্ষরে কারো কানে যায় তাহলে কি তান্ডবটা শুরু হবে এহসান বাড়িতে? ”
এতো শতো কথার কোনটাই বুঝি এফেক্ট ফেললো না রৌদ্রের ওপর। সে আগের ন্যায় চোখ বন্ধ রেখে কাঠকাঠ কন্ঠে বললো,
“ যা বলার বলে দিয়েছি।আমি আজকে,এক্ষুণি তোর বোনকে বিয়ে করবো।তারপর যা হবার হবে।ওর ওপর শুধুমাত্র আমার মনের অধিকারে কাজ হবেনা অনিক, ওর ওপর আমার সম্পর্কের অধিকারও খাটাতে হবে।”
এহেন কথায় বাঁধ সাধলো অনিক।সে ফের বোঝালো,
“ ভাইয়া!প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্টেন্ড! তুমি…..”
“ স্টপ ইউর ফাকিং বুলশিটস! আমি যেটা বলেছি সেটা করবই।তুই থাকলে থাকবি না থাকলে নাই।যেটা আমার, সেটা আমৃত্যু অবধি শুধুই আমার।সেটাকে সারাজীবনের জন্য কিভাবে নিজের করে রাখতে হয় সেটা আমি রৌদ্র ভালো করেই জানি।”
কথাটা শেষ করে অনিকের পাশ কাটিয়ে অরিনের হাতটা চেপে ধরে তাকে টেনে নিয়ে আসে রৌদ্র।
মেয়েটার হাত চেপে ধরে বলে,
“ এই চল! বিয়ে করবো তোকে।আজকে বউ হবি তুই আমার।বেশি উড়েছিস, তাই ডানা ছাটঁতে হবে চল!”
অরিনও কান্না থামিয়ে মাথানিচু করে দাড়িয়ে আছে। বিয়ে করবে না বললে পাছে না আবার রৌদ্র তাকে মাথায় তুলে আছাড় মারে! সে ভয়ে মেয়েটা জড়সড় হয়ে হেঁটে যায় রৌদ্রের সাথে। এদিকে অনিক পেছন থেকে অস্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে। মনে মনে এক অজানা ভয় এসে আঁকড়ে ধরেছে তাকে। —— না জানি এই সিদ্ধান্ত আবারও কোন কাল বয়ে আনে তাদের বাড়িতে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে সেই কখন! বাড়ি থেকে একেরপর এক কল দিয়েই যাচ্ছে রৌদ্রের ফোনে। কিন্তু ছেলেটার সেদিকে কোনরূপ ধ্যান নেই।সে দক্ষ হাতে গাড়ি চালাতে ব্যাস্ত।তার পাশেই গুটিসুটি মেরে বসে আছে অরিন।আর ব্যাকসিটে অস্থির হয়ে বসে আছে অনিক।ছেলেটা যখন নিজ চিন্তায় বিভোর তখনি তার ফোনে কল আসে।সে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে বাড়ি থেকেই কল এসেছে। অনিক সেদিকে একপলক তাকিয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে। জিভ দিয়ে অধরজোড়া ভিজিয়ে ফোনটা কানে তুলে হেলো বলার আগেই ওপাশ থেকে সাব্বির সাহেবের রাগান্বিত কন্ঠ কানে আসে তার!
“ এই বেয়াদব ছেলে! কোথায় তুমি? আমার অরিমা কই? আর রোদ কই? তোমরা তিনজন বাদে সবাইতো চলে এসেছে বাড়িতে তাহলে তোমরা কোথায় রয়ে গেলে? বলি আমরা কি বের হবোনা? এখন রওনা না হতে পারলে রাত হবে কতটা সে খেয়াল কি আছে তোমাদের?”
অনিক একবার আড়চোখে রৌদ্রের দিকে তাকায়।ফের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলে,
“ আব্বু! তোমরা সবাই রওনা দিয়ে দাও।আমি, বনু,রোদ ভাই আমরা তিনজন একসাথে একটু ঘুরাঘুরি করে রওনা দিচ্ছি! ”
সাব্বির সাহেব ছেলেকে প্রতিত্তোরে কিছু একটা বলবেন তার আগেই তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয় কবির সাহেব। এতক্ষণ ফোন লাউডে থাকায় সবটাই শুনেছে তারা।তিনি গম্ভীর গলায় বলেন,
“ সারাদিন কই ছিলে তোমরা, যে এখন এই সন্ধ্যা করে তোমাদের ঘুরতে হবে?”
হুট করে বড় আব্বুর কন্ঠ পেয়ে চমকে ওঠে অনিক। হাত থেকে ফোনটা পড়তে পড়তে বেঁচে যায় তার।সে বুকের মাঝে খানিকটা থুতু ছিটিয়ে বলে,
“ ইয়ে,মানে…বড়আব্বু!”
“ থাক!আর এক্সপ্লেইন শুনতে চাচ্ছিনা কোনো। ঘোরাঘুরি শেষে তারাতাড়ি রওনা দিয়ো।আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালোনা! আমরা নাহয় রওনা দিয়ে দিচ্ছি! ”
একবুক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অনিক। মনে মনে বড় আব্বুর প্রতি একদফা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে।তবুও মুখ ফুটে শুধু এটুকুই বলে,
“ ঠিক আছে বড় আব্বু! আপনারা সাবধানে রওনা দিয়েন।”
কথাটা বলেই কলটা কেটে দেয় অনিক।যাক বাবা!এদিকটা তো কোনরকমে সামলাতে পেরেছে সে।
প্রায় মিনিট বিশেক পর রৌদ্রের গাড়ি থামায় একটা মসজিদের সামনে। মিনিট ব্যায়ে গটগট পায়ে বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে। তারপর অরিনের পাশের দরজা খুলে মেয়েটার হাত চেপে ধরে তাকে বের করে আনে গাড়ি থেকে। অনিকও বের হয়ে আসে। মনে মনে ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।কোনভাবেই কি রোদ ভাইকে বোঝাতে পারবেনা সে?
রৌদ্র মসজিদের সামনে জুতো খুলে অরিনকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তারপর এক ইমামকে ডেকে এনে বলে,
“ হুজুর! আমরা বিয়ে করতে এসেছি। আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিন।”
হুজুর একবার রৌদ্রের দিকে তো আরেকবার অরিনের দিকে তাকালেন। পরক্ষণেই মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“ আসুন আমার সাথে। ”
রৌদ্র এবং অরিনও চুপচাপ হেঁটে গেলো হুজুরের সাথে। হুজুর একটা রুমে ঢুকে চেয়ার টেনে বসলেন।হাতের ইশারায় রৌদ্র, অরিন এবং অনিককেও বসতে বললেন। তারপর রৌদ্রের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ তা বিয়েতে আপনাদের দু’জনের মতামত আছে তো?”
এহেন প্রশ্নের উত্তরে অরিন চুপ থাকলেও রৌদ্র বিরক্ত হয়।সে গম্ভীর গলায় বললো,
“ বিয়তে মত না থাকলে আমরা নিশ্চয়ই বিয়ে করতে আসতাম না!”
হুজুর খানিকটা থতমত খেলেন। আমতাআমতা করতে লাগলেন বেচারা। কিয়তক্ষন বাদে ফের বললেন,
“ আপনারা কি রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করবেন নাকি শুধু শারিয়াহ মোতাবেক? দেখুন রেজিস্ট্রি করতে চাইলে দু-তিনদিন অপেক্ষা করতে হবে। ”
রৌদ্র এবার মেজাজ হারায়। কাঠকাঠ কন্ঠে বলে ওঠে,
“ একঘন্টাও অপেক্ষা করার ধৈর্য্য নেই আমার। আপনি ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে পড়ান।”
ছেলের এমন অধৈর্য্যতা দেখে আবারও দ্বিধায় পড়লেন হুজুর সাহেব। তিনি সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।তার এমন দৃষ্টি দেখে রৌদ্র গম্ভীর গলায় শুধায়,
“ আমায় এভাবে না দেখে বিয়েটা তারাতাড়ি পড়ান!”
ফের থতমত খান হুজুর। তিনি মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। তারপর শারীয়াহ মোতাবেক রৌদ্র- অরিনের বিয়ে পড়ানো শুরু করেন।হুজুর কিছু একটা লিখে রৌদ্রকে বললেন,
“ বাবা! দেনমোহর কত লিখবো?”
রৌদ্র অরিনের দিকে নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“ আমার প্রানটা লিখুন!”
বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালেন হুজুর! কি শুনলেন তিনি? এ ছেলে কি পাগল? পাগলাগারদ থেকে ছুটে এসেছে না-কি? কিন্তু চেহারা-সূরত তো মাশাআল্লাহ! পাগলরা কি আর এতো সুন্দর হয়?
হুজুর সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললেন,
“ বাবা!কি বললেন? ”
রৌদ্র এবার সরু দৃষ্টি ফেলে হুজুরের ওপর। বলে,
“ বলেছি আমার প্রানটা লিখুন! ”
অগত্যা দ্বিতীয়বার একই কথা শুনে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন হুজুর।মাথা ঝাকিয়ে তেমনটাই করলেন যেমনটা রৌদ্র বললো।দেনমোহর টুকে
বিয়ে পড়ানোর একপর্যায়ে হুজুর অরিনকে বললেন,
“বলো মা, কবুল!”
অরিন চুপ করে রইলো। মিনিট পেরোতেই পাশ থেকে রৌদ্র খেঁকিয়ে ওঠলো,
“ এত ঢং করছিস কেন? কি বলতে বলেছে তোকে? বলছিস না কেন? দেখ অরি,এখন কোনরূপ নাটক করলে আজকে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম। ”
এহেন ধমকে অরিন কিছুটা কেঁপে উঠলেও হুজুর সাহেব চক্ষু ছানাবড়ার ন্যায় তাকিয়ে রইলেন।তিনি পুরোদস্তুর অবাক হয়ে বললেন,
“ আপনি কি মেয়েকে জোর করে বিয়ে করতাছেন?”
রৌদ্র একথার জবাব দিতে বিলকুল আগ্রহ দেখায়না।সে নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। পরক্ষণেই বাঁকা হেসে বললো,
“ ঠিক আছে। তোর বলতে হবে না। আমি তাহলে এক্ষুনি গিয়ে ঐ আধমরাটাকে পুরোপুরি মেরে দিয়ে আসি তারপর পুলিশের কাছে সারেন্ডার করবো নিজেকে।আর তুই থাকিস শান্তিতে।”
তৎক্ষনাৎ চোখ তুলে অরিন।ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
“ এই না না! এমনটা করবেন না।আমি বলছি,এক্ষুণি বলছি।হুজুর, কবুল,কবুল,কবুল,কবুল!”
হুজুর ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন এদের এসব কান্ডকারখানায়।তিনি হয়তো মনে মনে ভাবছেন, — এ কোন পাগলের পাল্লায় পরলাম বাবা!
পেছন থেকে অনিক মিটমিট করে হাসছে।রোদ ভাইয়ের প্রতি তার বোনের এমন ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হলো ছেলেটা।হুজুর এবার রৌদ্রকে বললেন,
“ বলো বাবা, ক……”
হুজুরের কথা শেষ হবার আগেই ফটফট করে তিনবার কবুল বলে দিলো রৌদ্র। হুজুর এবার আর অবাক হলোনা।এতোক্ষণে কত কাহিনিই তো দেখলেন তিনি,সেখানে এটুকু দেখে নতুন করে অবাক হবার মতো কিছু নেই।দুপক্ষের কবুল বলা শেষে হুজুর খানিকটা জোরে আলহামদুলিল্লাহ বললেন। অনিকও জোর গলায় সাথে সাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে।আর রৌদ্র? সে অনিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো তার সদ্য বিবাহিত ফুটফুটে স্ত্রীর দিকে।
হুজুরের দেনা-পাওনা বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত অনিক!এদিকে অরিনকে নিয়ে গাড়িতে এসে বসেছে রৌদ্র
। অরিনটা এখনো চুপচাপ মাথানিচু করে বসে আছে। রৌদ্র খেয়াল করলো সবটা।সে খানিকটা এগিয়ে এসে অরিনকে কাছে টেনে নেয়।মেয়েটাকে নিজের কোলের ওপর বাচ্চাদের মতো বসিয়ে দিয়ে, মেয়েটার ললাটে গাঢ় ভালোবাসার পরশ একে দেয়। অরিন চোখ বন্ধ করে নিলো আবেশে। রৌদ্র সময় নিয়ে ঠোঁট সরায় ললাট থেকে।মেয়েটার কালচে হয়ে আসা গালদুটোয় আলতো করে হাত বুলিয়ে আওরায়,
“ সরি কলিজা! তখন কি খুব ব্যাথা দিয়ে ফেলেছিলাম? ”
মাথা নাড়িয়ে না জানায় অরিন।রৌদ্র তা দেখে মুচকি হাসলো। মেয়েটার থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে মুখটা উঁচু করে, চোখে চোখ রেখে বললো,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২৪
“ আজকে থেকে তুই আমার হলি সানশাইন! আজকে থেকে তোর ওপর পূর্নাঙ্গ অধিকার পেলাম আমি।আজকে থেকে তোর প্রতিটা কদম,প্রতিটা হৃৎস্পন্দনে শুধু আমারই অধিকার থাকবে সানশাইন। এখন থেকে তুই পরিপূর্ণভাবে আমার অর্ধাঙ্গিনী হলি।অর্ধাঙ্গিনী বুঝিসতো জান? অর্ধাঙ্গিনী মানে অর্ধেক অঙ্গের অধিকারীনি! আজকের পর থেকে এক আল্লাহ ছাড়া কেউই আমাদের আলাদা করতে পারবেনা।ইনশাআল্লাহ!! ”