সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫০
Jannatul Firdaus Mithila
বাড়ির সবাই একে একে ছুটে আসে বাইরে। তায়েফ সাহেব দ্রুত এগিয়ে এসে গাড়ির ব্যাকসিটের দরজাটা খুলে দিলেন। রৌদ্র তড়িঘড়ি করে তার বাবাকে গাড়ির ব্যাক সিটে শুইয়ে দেয়। ততক্ষণে অনিকও ছুটে এসেছে রৌদ্রের ইমার্জেন্সি ব্যাগ নিয়ে। রৌদ্র আর একমুহূর্তও কালবিলম্ব না করে ইমারজেন্সি ব্যাগটা নিয়ে গাড়িতে বসলো,বাবার পায়ের কাছে। তারপর তাশরিক সাহেবকে ব্যাপক তাড়া দিয়ে বললো,
“ চাচ্চু দ্রুত গাড়ি নাও আমার হাসপাতালের দিকে!”
তাশরিক সাহেব তৎক্ষনাৎ গাড়ির স্টিয়ারিং-এ টান বসালেন। মাথায় রাজ্যসম চিন্তা নিয়ে গাড়ি ছুটাতে লাগলেন হাসপাতালের দিকে।
রৌদ্র দ্রুত বাবার পাদু’টো নিজের কোলে তুলে সামান্য উঁচিয়ে রাখলো যেন অচেতন কবির সাহেবের মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলটা কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়! তারপর রৌদ্র একহাতে নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে কল লাগায় হসপিটালের রিসেপশনে।দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হলো।আর সঙ্গে সঙ্গেই রৌদ্র হুকুম ছেড়ে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ ইমার্জেন্সি ইউনিট রেডি রাখুন! আ’ম কামিং”
কথাটা শেষ করেই রৌদ্র ফোনটা পাশে রাখলো। পরক্ষণেই নিজের ইমারজেন্সি ব্যাগটা খুলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করতে লাগলো একে একে। প্রথমেই একটা পোর্টেবল পালস অক্সিমিটার লাগিয়ে নিলো সে।কিয়তক্ষন বাদেই সেটার স্ক্রিনে ফুটে ওঠে — SpO2 -৮১%. রৌদ্র আরেকধাপ চিন্তিত হয়ে পড়ে এসব দেখে।এ যে বিপদজনকভাবে খুব কম! সে আর দেরি না করে ব্যাগ থেকে ছোট্ট অক্সিজেন সিলিন্ডারটা বের করে নেয়।তারপর সেটা চালু করে কবির সাহেবের মুখে মাস্ক লাগিয়ে দেয়। পরক্ষণেই ব্যাগ থেকে IV ক্যানোলা বের করে বাবার হাতে বসায়। বাঁ-হাতে ব্যাগ হাতড়ে নরমাল স্যালাইনটা বের করে লাগিয়ে দেয় ক্যানোলায়!
তারপর রৌদ্র একহাতে বাবার পালস রেট ধরে ঘড়ির দিকে দৃষ্টি রেখে অপেক্ষা করলো — মাত্র ২ মিনিট! নাহ!তার বাবার পালস দূর্বল হয়ে আসছে।মাত্র ৪০-৪৫ bpm — যা কি-না একদম বিপদসীমার কাছে। রৌদ্র তখন ব্যস্ত হাতে ব্যাগ থেকে বের করে Atropine injection IV. তারপর মুহুর্ত ব্যয়ে সেটি পুশ করে দেয় বাবার শরীরে। হাতের কাজ শেষে রৌদ্র একপলক তাকালো বাবার ফ্যাকাশে হয়ে আসা মুখপানে। ছেলেটার চোখদুটো কেমন ভরে আসলো হঠাৎই। সে তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে বাবার ওপর থেকে। মনে মনে নিজেকে শক্ত করে বলে,
“ স্টে স্ট্রং রৌদ্র! স্টে স্ট্রং!”
প্রায় মিনিট ত্রিশেক পর রৌদ্রদের গাড়ি এসে থামলো হসপিটালের সামনে। রৌদ্র দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে। এরইমধ্যে দু’জন ওয়ার্ডবয় স্ট্রেচার নিয়ে হাজির! রৌদ্র ধীরে ধীরে তার বাবাকে কোলে তুলে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিলো।ওয়ার্ড বয়রা স্ট্রেচারটা ধরে সামনে এগোতে এগোতে সকলের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
“ দি পেশেন্ট ইজ আনকন্সাস! প্লিজ মেক ওয়ে! মেক ওয়ে!”
আশেপাশের লোকজন সরে গেলো তৎক্ষনাৎ। রৌদ্র দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো ইমার্জেন্সি ইউনিটের দিকে। কবির সাহেবকে ইমার্জেন্সী রুমে নেওয়ার পর তাকে Resus bed-1 এ তোলা হলো।রুমটিতে আগে থেকেই রেডি করা ছিলো — অক্সিজেন সিলিন্ডার, পোর্টেবল ইসিজি মেশিন, Ambu ব্যাগ,ভাইটালস মনিটটর।বেডের মাথার পাশে রাখা আছে ক্র্যাশ কার্ট।
রৌদ্র দ্রুত ছুটে যায় রেডি হতে। অন্যদিকে, কবির সাহেবকে বেডে তোলার সাথে সাথে নার্সদের মধ্যে একজন ছুটে এসে ইসিজি মেশিন সংযোগ করলো। অন্যজন বিপি মনিটরিং স্টার্ট করলো, পাশে দাড়ানো আরেকজন পালস রেট চেক করতে লাগলো। তারপর রৌদ্র নিজে এসে SpO২ চেক করতে লাগলো। কিয়তক্ষন বাদেই ইসিজির স্ক্রিনে স্পষ্ট ফুটে ওঠে — STEMI (হার্ট অ্যাটাক)। রৌদ্র দ্রুত ট্রপনিন টেস্ট পাঠায়।রিপোর্ট আসার আগেই নার্সদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“ Adrenaline রাখা আছে তো? Inj. Dopamine drip চালাও। Thrombolysis ইনজেকশন প্রস্তুত করো — Streptokinase 15 লাখ ইউনিট IV। ফাস্ট! ”
নার্সরা দ্রুত মাথা ঝাকিয়ে কাজে লেগে পড়ে। এরইমধ্যে একজন নার্স প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,
“ স্যার! ওনার হাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে…. পালস পাওয়া যাচ্ছে না!”
তখনি মনিটরে দেখা মিলে একটানা সাদা রেখার।যেখান থেকে ভেসে আসছে বিষাদ শব্দ — বিপ,বিপ,বিপপপপ
সবাই একমুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো। পুরো ইমারজেন্সি রুমে তৎক্ষনাৎ ছেয়ে গেলো এক অন্যরকম নিরবতা! রৌদ্রের বুঝতে আর বাকি রইলো না, তার বাবার কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়েছে। সে একমুহূর্ত থমকে থেকে পরক্ষণেই প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,
“ Code blue, CPR শুরু করো। এই তারাতাড়ি Crash cart আনো। Adrenaline আনো এক্ষুণি!”
নার্সরা দ্রুত রৌদ্রের কথানুযায়ী কাজে লেগে পড়ে। সকলে মিলে তৎক্ষনাৎ প্রথম সিপিআর সাইকেল শুরু করে।একজন নার্স নিস্তেজ কবির সাহেবের বুকে চাপ দিচ্ছে ছন্দে ছন্দে। অন্যজন মুখে অক্সিজেন দিচ্ছে Ambu ব্যাগ দিয়ে। রৌদ্র নিজেই Adrenaline 1mg IV পুশ করলো বাবার শরীরে। তারপর থামলো এক মিনিট! নাহ… এখনও পালস মিলছে না কবির সাহেবের। রৌদ্র দ্রুত অর্ডার দেয় দ্বিতীয় সিপিআর সাইকেল চালাতে। নার্সরা আবারও আগের ন্যায় নিজেদের কাজে তৎপর হলো। রৌদ্র এবার ২য় ডোজ Adrenaline পুশ করে। তারপর dopamine drip শুরু করে প্রেশার সাপোর্টে। চলতে থাকলো জীবনযুদ্ধ! নার্সরা একে একে নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন নিস্তেজ মানবের পালস ফিরিয়ে আনতে।রৌদ্র দৃঢ় চোখে তাকিয়ে আছে দেয়ালের ঘড়ির দিকে। সেকেন্ডের প্রতিটি ঘূর্ণন যেন তার হার্টবিট বাড়িয়ে দিচ্ছে। অজানা আতঙ্কে গলা শুকিয়ে গেছে তার। মস্তিষ্কে এসে হানা দিচ্ছে অহেতুক চিন্তাভাবনা — তার বাবা ফিরবে তো?
প্রায় মিনিট দুয়েক পেরুলো।এরইমধ্যে মনিটরে একটা ছোট্ট কম্পনের দেখা মিললো। তারপর সামান্য একটা ঢেউ খেললো। বিপ….পউজ….বিপ…পউজ…. বিপপপপ!
কবির সাহেবের পালস ফিরে এসেছে। SpO2 বাড়ছে ধীরে ধীরে। এহেন দৃশ্যে রুমে উপস্থিত সকলেই একযোগে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সকলের চোখেমুখে ছেয়ে গেলো একধরনের প্রশান্তি। রৌদ্র অনিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো বেডে শুয়ে থাকা বাবার পানে।চোখদুটো তার ইতোমধ্যেই ভরে এসেছে। আজ যদি ডাক্তার হয়েও বাবাকে ফেরাতে না পারতো,তখন এই মুখ কিভাবে দেখাতো সে? কিভাবে ক্ষমা করতো নিজেকে?
ছেলেটা পরপর দুটো শুকনো ঢোক গিলে পিছিয়ে গেলো এক-কদম। শুষ্ক অধরজোড়া জিভ দিয়ে খানিকটা ভিজিয়ে নার্সদের দিকে তাকালো। হুকুম ছুড়লো একপ্রকার,
“ চেক পিউপিলস!”
বলেই সে পড়নের এপ্রনটার হাতায় চোখদুটো মুছে নিলো কোনরকম। তখনি একজন নার্স বললো —
“ স্যার! পেশেন্ট আনকন্সাস হলেও রেসপন্স করছে!”
তারপর অন্যজন এগিয়ে গিয়ে কবির সাহেবের বন্ধ চোখের পাতা খুলে লাইট দিয়ে চোখদুটো চেক করে বলে,
“ স্যার! পিউপিল রিএক্টিভ! অক্সিজেন যাচ্ছে মস্তিষ্কে।”
তারমানে বিপদ এখনো কাটেনি! রৌদ্র তখন দ্রুত সটান হয়ে দাঁড়ায়। ওয়ার্ড বয়দের উদ্দেশ্যে জোর গলায় বলে,
“ পেশেন্টকে দ্রুত আইসিইউ তে শিফট করুন! কুইক!”
ওয়ার্ড বয় দুজন তড়িঘড়ি করে ছুটে আসলো যেন।কবির সাহেবের নিথর দেহটাকে হুইল বেডে তুলে নেয় তারা। একে একে নিস্তেজ কবির সাহেবকে ঠিকঠাক মতো রেডি করতে থাকে আইসিইউ তে নেওয়ার জন্য।
অন্যদিকে, এহসান বাড়ির সকলে সেই কখন এসে পৌঁছেছে হাসপাতালে।সবাই ইমার্জেন্সি ইউনিটের বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে তাকিয়ে আছেন ভেতরকার খবরা-খবর জানার জন্য!
সকলের মাঝেই যেন একপ্রকার চাপা কান্নার রোল পড়েছে যেন। জুবাইদা বেগম তো ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছেননা কান্নার তোড়ে। তিনি বারবার বিলাপের সুরে নিজেকে দোষারোপ করে বলেই যাচ্ছেন —
“ কেনো আমি তাকে এতোগুলো কথা বলতে গেলাম? কেনো তাকে এতো কষ্ট দিতে গেলাম! আমি যে পাপি! ও আল্লাহ! এই মানুষটার কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে বাঁচবো মাবুদ! আল্লাহ তুমি সহায় হও খোদাঁ! তুমি তাকে সুস্থ করে দাও”
জুবাইদা বেগমের এহেন বিলাপ শুনে সকলেই কেঁদে যাচ্ছেন মুখ টিপে। পাশ থেকে রাফিয়া বেগম ও তার বাকি জা’য়েরা মিলে কোনমতে সামলাচ্ছেন ক্রন্দনরত জুবাইদা বেগমকে।জুবাইদা বেগম আজ বুঝি কারো বোঝানোতেই বুঝছেন না কিছু! তিনি বারংবার কেঁপে কেঁপে ওঠছেন কান্নার তোড়ে।
অন্যদিকে,তায়েফ সাহেব বারেবারে ঢোক গিলে নিজের কান্নাগুলো আঁটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। অদূরেই দেয়ালে পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন তাশরিক সাহেব। চোখদুটো তার লাল হয়ে গেছে কেন যেন! হয়তো কান্না আঁটকে রাখার দরুন এহেন অবস্থা তার। দু’হাত দূরেই একটা চেয়ারে বসে আছেন সাব্বির সাহেব। লোকটা চোখবুঁজে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কাঁদছেন! আচ্ছা এভাবেও কি কেও কাঁদে? সাব্বির সাহেবকে দূর থেকে দেখলে মনে হবে — মানুষটা বুঝি কোথাও হতে দৌড়ে এসে হাঁপাচ্ছেন। অথচ না! মানুষটা হাঁপাচ্ছেন বুকের ভেতরের নিভৃত দহনে! যেই দহনে পুড়ে যাচ্ছে তার কলিজাটা! এতোটা কষ্ট হচ্ছে তার যা বলে বোঝানো মুশকিল! তিনিও হয়তো মনে মনে নিজেকে দুষছেন। হয়তো ভাবছেন —
“ রাতের কথাগুলোর কারণেই কি তার বড় ভাইজানের এই হাল হলো?”
অনিক মাত্রই এলো রিসেপশন থেকে।সে গিয়েছিল তার বড় বাবার নামটা এন্ট্রি করতে। পরিবারের সদস্যদের মাঝে আসতেই বুকটা ভার হয়ে আসলো তার! প্রতিটা মানুষের মুখেই লেপ্টে আছে হারিয়ে ফেলবার আতংক! ভেতরের রুমে ঠিক কি কি হচ্ছে তা জানার চাপা উৎকন্ঠা। অনিক ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে এলো মায়ের কাছে। বললো,
“ বাড়িতে ওরা একা আছে আম্মু! তোমরা সবাই এখানে না থেকে, চলে যাও বরং! আমি,আব্বু,চাচ্চুরা থাকছি নাহয়।”
ছেলের কথায় কাঁদো কাঁদো মুখটা কোনমতে উপরে তুলে না বোধক মাথা নাড়লেন রাফিয়া বেগম। ধরে আসা কন্ঠে বললেন,
“ আমি কোথাও যাবো না অনি! কোথাও যাবো না!”
অগত্যা এমন কথার পিঠে অনিক আর কিছু বললোনা। শুধু মনে মনে দোয়া করতে লাগলো বড় আব্বুর জন্য!
ঠিক এমন সময় ইমার্জেন্সি ইউনিটের দরজাটা খুলে গেলো।বাড়ির সবাই তৎক্ষনাৎ আকুল নেত্রে তাকালো সেদিকে। কিন্তু পরক্ষণেই যা দেখলো, তা দেখে মুহুর্তেই থমকে গেলো সকলে! একটা হুইল বেডে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছেন কবির সাহেব। লোকটার উম্মুক্ত বুকে লাগানো কতগুলো ইসিজি তার। মুখে অক্সিজেন মাস্ক।বেডের সংলগ্ন স্ট্যান্ডে ঝুলানো ইনফিউশন পাম্পে চলছে ডোপামিন। শরীরের ভেতরে এবং বাইরের বিভিন্ন অংশ মেশিনের তারে জড়ানো। বেডের পাশ ঘেঁষে হেঁটে আসছে রৌদ্র।
এহেন দৃশ্য দেখে থমকালেন সকলে। জুবাইদা বেগম তো একপ্রকার ছুটে আসতে লাগলেন স্বামীর দিকে। হঠাৎ এমন দৌড়ে আসায় শাড়িতে পা লেগে যায় তার।মানুষটা উপুড় হয়ে পড়তে নিলেই তাকে নিজ বাহুডোরে আগলে নেয় রৌদ্র। জুবাইদা বেগম ছেলেকে শক্ত করে ধরলেন।পাগলের মতো থেমে থেমে ছেলেকে বলতে লাগলেন,
“ তোর বাবার কি হইছে রোদ? তোর বাবার শরীরে এসব কি লাগানো? রোদ! আমার স্বামী সুস্থ হয়ে যাবে তো রোদ? ”
রৌদ্র ওয়ার্ড বয়দের ইশারায় আইসিইউর দিকে এগিয়ে যেতে বললো। জুবাইদা বেগম তখন পাগলের মতো স্বামীর কাছে যেতে চাইলেন। কিন্তু ছেলের শক্ত বাহুডোর হতে ছুটতে পারলেন না তিনি! তবুও মানুষটা হাত-পা ছুঁড়োছুড়ি করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“ আমায় একটু তার কাছে যাইতে দে বাবা! একটু ছুঁতে দে মানুষটারে। ও বাবা,বাবারে! তোর বাবা সবসময় বলতো — জবা! হাসপাতালে গেলে আমার মাথা ব্যাথা করে, আমি হাসপাতালের তীব্র উটকো গন্ধটা সহ্য করতে পারিনা! তাহলে…তাহলে আজ কেনো মানুষটা এখনো হাসপাতালে শুয়ে আছে? তার নাকে কি আজ সেই উটকো গন্ধটা যাচ্ছে না? যাচ্ছে… হয়তো যাচ্ছে রোদ। তোর বাবার কষ্ট হচ্ছে। তার কাছে আমায় একটু যেতে দে বাবা! একটু স্পর্শ করতে দে লোকটাকে।”
রৌদ্র ধীরে ধীরে মায়ের দিকে তাকায়। লাল হয়ে আসা চোখদুটো তাক করে মায়ের ক্রন্দনরত মুখপানে। তারপর
মুখ থেকে মাস্কটা খুলে নিয়ে বলে,
“ এমন করে না আম্মু! আব্বুকে ইমার্জেন্সি আইসিইউতে নিতে হবে। এখন একটা মুহুর্ত সময় নষ্ট করা মানে অনেক কিছু! প্লিজ তুমি একটু ধৈর্য্য ধরো!”
জুবাইদা বেগম ছলছল চোখে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে। কান্নাটা কোনরকমে গিলে নিয়ে থেমে থেমে বললেন,
“ তোর বাবা সুস্থ হয়ে যাবে তো রোদ?”
রৌদ্র মায়ের কপাল বরাবর আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
মায়ের আদুরে মুখটা নিজের দু’হাতের তালুতে নিয়ে আশ্বাসের সুরে বলে,
“ তুমি চিন্তা করো না মা! তোমার ছেলে ঠিক তার বাবাকে সুস্থ করে ছাড়বে ইনশাআল্লাহ! তুমি শুধু আল্লাহকে ডাকো!”
জুবাইদা বেগম ভেজা চোখে মাথা নাড়ালেন। ছেলের হাতদুটোতে পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে হাতদুটোতে নিজের গাল ঠেকালেন। তারপর আবারও হু হু করে কেঁদে উঠে বললেন,
“ তাই যেন হয় বাবা! তাই যেন হয়!”
রৌদ্র এসে আইসিইউ তে ঢুকলো।বাবার বেডের কাছে এসে সরু চোখে মানুষটার অবস্থা পর্যবেক্ষণ চালালো কিয়তক্ষন। কবির সাহেবের শরীরে IV ডোপামিন চলমান। অক্সিজেন চলছে ১০ লিটার/মিনিট। পাশেই ইসিজি মনিটরিং চলছে,সেই সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে এন্টিবায়োটিকস। স্টাফদের মধ্যে একজন রৌদ্রের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,
“ স্যার, পেশেন্ট ইজ স্ট্যাবল বাট স্টিল ইন ডেলিকেট কন্ডিশন।”
রৌদ্র ধীরে ধীরে বাবার হাত স্পর্শ করে। যাক হাতটা আগের চেয়ে কিছুটা উষ্ণ হয়েছে। রৌদ্র মনে মনে একবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর আবারও চলে এলো কালক্ষন! হঠাৎ করে আবারও একজন নার্স জোর গলায় বলে ওঠে,
“ স্যার! পালস আবারও থেমে গেছে!”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ মনিটরে চোখ রাখে।দেখতে পায় একেবারেই সোজা লাইনটার অস্তিত্ব! রৌদ্র এবার নিজের পেশাদারিত্বকে সামনে রেখে মুখের আদলে গাম্ভীর্যের ছাপ ফুটিয়ে বলে,
“ কোড ব্লু! কুইক!”
রৌদ্র ফের মনিটরে খেয়াল করলো।হার্টবিট কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। পালস হারিয়ে যাচ্ছে আবারও। রৌদ্র তৎক্ষনাৎ বাবার বুকে হাত রাখে।বুঝতে পারে — হার্ট থেমে গেছে আবারও। তখনি পাশ থেকে একজন নার্স অস্থির গলায় বলে ওঠে,
“ স্যার VF শুরু হয়েছে।”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ হাত বাড়িয়ে বলে ওঠে,
“ Defibrillator আনো 200J, Synchronized কুইক!”
নার্স দুজন সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এলো Defibrillator. এনেই বললো,
“ Clear স্যার!”
রৌদ্র ফটাফট এসে ডিসি শক হাতে নিলো।তারপর ইশারায় একজনকে বললো সুইচ দিতে। নার্স মাথা ঝাকিয়ে সুইচ অন করলো।রৌদ্র সবাইকে বললো,
“ সরে দাঁড়াও!”
সকলেই সরে গেলো তৎক্ষনাৎ। রৌদ্র ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ফেলে শক দিলো বাবার বুক বরাবর। মুহুর্তেই পুরো শরীর ঝাকিয়ে ওঠে কবির সাহেবের।তারপর আবারও নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো চারপাশ। রৌদ্র ফের দিলো শক।আবারও পুরো শরীর কেঁপে ওঠে নিস্তেজ কবির সাহেবের। হুট করেই মনিটরে দেখা মিললো ছোট্ট একটা ঢেউয়ের, ঢেউয়ের রেখাটি একবার ছোটো হচ্ছে আরেকবার বড় হচ্ছে। আর পাশ থেকে শব্দ হচ্ছে, — বিপপপ,বিপপ,বিপ….
কিয়তক্ষন বাদেই কবির সাহেবের পালস ফিরে। হার্ট রেট এসে দাঁড়ালো ৭৮, বিপি গড়ালো ১০৬/৬৮, SpO2 গিয়ে ঠেকলো ৮৯% এ। তবুও যেন কষ্ট কমলো না কবির সাহেবের।মানুষটার নিশ্বাস কেমন ঘন হয়ে আসছে ক্রমাগত। মুখে জমেছে ফেনা, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল! মনিটরে দেখাচ্ছে — SpO2 ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এখন তা গড়িয়েছে ৭৫% এ। তক্ষুনি নার্স বলে ওঠে,
“ স্যার! Pulmonary edema developing. ”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ একটা ফার্ম ইনজেকশন হাতে নেয়।বলে,
“ Lasix 40 mg IV push.. Now!”
নার্স দৌড়ে গেলো।ইনজেকশনটা হাতে নিতেই রৌদ্র আবারও বললো,
“ BiPAP মাস্ক ফিট করো।অক্সিজেন ১৫ লিটার /মিনিট তোলো।”
বাকি নার্সরা রৌদ্রের কথানুযায়ী কাজে লেগে পড়ে। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ পর এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি পেরিয়ে কবির সাহেবের শরীরটা খানিক শিথিল হলো।তার শরীরের ঝাঁকুনি কমে আসে ধীরে ধীরে। রৌদ্র মনিটরে চোখ রাখে। তার বাবার হার্ট রেট এসে দাঁড়িয়েছে ৮৪, SpO2 এসে ঠেকছে ৯৫% আর বিপি ১১০/৭২।
রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। চোখের কার্নিশে এসে জমে থাকা অশ্রুটুকু আঙুলের সাহায্যে মুছে নেয় আলগোছে। এ নিয়ে দুবার কার্ডিয়াক এরেস্ট হলো ওর বাবার! সময় যত পেরুচ্ছে,ঠিক ততই জটিল হয়ে যাচ্ছে কবির সাহেবের শরীরের অবস্থা।এমন সময় অবশ্যই মেডিকেল টিমের সাথে আলোচনায় বসতে হবে তার! কেননা পরপর দুবার কার্ডিয়াক এরেস্টের পর তৃতীয় বার হলেই হয়তো আর বাঁচানো যাবে না মানুষটাকে। এসব ভাবনা মাথা নিয়ে রৌদ্র গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ আইসিইউ তে থেকে পরক্ষণেই বাইরে বেরিয়ে আসে। সে বাইরে বেরোতেই বাড়ির সকলে একপ্রকার জেঁকে ধরে তাকে।সকলেই একযোগে জিজ্ঞেস করতে থাকে,
“ মানুষটার কি অবস্থা?”
রৌদ্র গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ মৌন রইলো। তা দেখে কলিজায় মোচড় দিয়ে ওঠে জুবাইদা বেগমের।তিনি ছেলের হাত ঝাকিয়ে বলতে লাগলেন,
“ চুপ করে আছিস কেনো রোদ? তোর বাবার কি অবস্থা?”
রৌদ্র তখন ধীরে ধীরে নিজের দৃষ্টি ওপরে তুলে। মায়ের দিকে লাল হয়ে আসা চোখদুটো দিয়ে তাকিয়ে বলে,
“ আশঙ্কাজনক আম্মু! পরপর দুবার কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়েছে আব্বুর! হয়তো সার্জারি করা লাগতে পারে।তোমরা প্লিজ নিজেদের শক্ত করো!”
ব্যস! এটুকু কথাতেই থমকে গেলো সকলে। কি বললো রৌদ্র? মানুষটার অবস্থা এতো খারাপ? আচ্ছা মানুষটা সত্যি বাঁচবে তো? জুবাইদা বেগম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেননা। দূর্বল শরীরটা টলতে টলতে জ্ঞান হারালেন তিনি।রৌদ্র চট করে মা’কে বুকে আগলে নেয়। মায়ের গালে আলতো করে হাত চাপড়ে দিয়ে বলে,
“ মা…মা.. চোখ খুলো মা…”
নাহ! চোখ খুললেন না জুবাইদা বেগম। ছেলের বুকে পড়ে রইলেন অচেতন হয়ে। রৌদ্র কোনরূপ কালবিলম্ব না করে মা’কে কোলে তুলে হাটাঁ ধরে অন্য একটা কেবিনের দিকে। তার পেছন পেছন সবাই আসে সেই কেবিনের দিকে। রৌদ্র মা’কে শুইয়ে দিলো বেডে।তারপর মায়ের পালস চেক করলো।পরক্ষণেই প্রেশার মাপলো, তার মায়ের প্রেশার ফল করেছে। হয়তো সারাদিনের এতো ঝড়-ঝাপটায় দূর্বল হয়ে পড়েছেন মানুষটা! রৌদ্র তৎক্ষনাৎ একজন নার্সকে ডাক দেয়। নার্সটিও প্রায় ছুটে আসে তার ডাক পেয়ে। রৌদ্র নার্সকে বললো,
“ স্যালাইন রেডি করুন!”
নার্স মাথা ঝাকিয়ে স্যালাইন রেডি করলো।হাতে ক্যানোলা নিয়ে জুবাইদা বেগমের দিকে এগোতে নিলে বাঁধ সাধলো রৌদ্র। সে নিজে হাত বাড়িয়ে নার্স থেকে ক্যানোলাটা নিয়ে মায়ের হাতে বসিয়ে দিলো। তারপর স্যালাইনটা সেট করে দিলো।
স্যালাইন চলছে আপন গতিতে। রৌদ্র মায়ের হাত ধরে বসে আছে বেডের পাশে।তার কাতর দৃষ্টি মায়ের নিস্তেজ মুখটার ওপর নিবদ্ধ। ছেলেটা একবুক কষ্ট নিয়ে বিরবির করে বললো,
“ ভেবেছিলাম সবটা ঠিক করে ফেলবো আম্মু! কিন্তু দেখো, আমি অভাগা সবটা ঠিক করার বদলে, তোমাদের কেমন ক্ষতি করে ফেললাম। তোমাদের কিছু হয়ে গেলে নিঃস্ব হয়ে যাবো আম্মু! আমার..আমার যে বেঁচে থাকার কারণটাই হারিয়ে যাবে তখন!”
ভোর ৪ টা!
জুবাইদা বেগমের কেবিনের বাইরে কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সকলে।এতক্ষণ সবাই ছিলো কবির সাহেবের কেবিনের বাইরে। কিন্তু ঐটা তো আইসিইউ, বেশিক্ষণ কেবিনের বাইরে কাওকে থাকতে দেওয়া হয়না! তাই সবাই আবারও চলে আসে এদিকে। কিয়তক্ষন বাদেই রৌদ্র বেরিয়ে আসে কেবিন থেকে। এসেই সকলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“ তোমরা প্লিজ বাড়িতে যাও! দেখো, অলরেডি আব্বু আম্মু দু’জনেই অসুস্থ। তারওপর তোমরাও এভাবে রাত জেগে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।দয়া করে আমার কাঁধে আর অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিও না! আমি সত্যি ক্লান্ত! বড্ড ক্লান্ত!”
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা বুঝি ধরে এসেছে রৌদ্রের।তাশরিক সাহেব ছেলেটার কাঁধে ভরসার হাত রাখলেন। অসহায় মুখে বললেন,
“ ভেঙে পড়িস না বাচ্চা! তুই-ই যে এখন একমাত্র সম্বল আমাদের! ”
রৌদ্র মাথা নুইয়ে রেখেই খানিকটা ঝাঁকালো।তারপর সবার উদ্দেশ্যে আবারও বললো,
“ বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নাও সবাই! কোনো প্রয়োজন পড়লে আমি কল দিবো তোমাদের!”
অগত্যা এমন কথার পিঠে বলার মতো আর কিছুই পেলো না বাড়ির সকলে। তারা সবাই একে একে চলে যেতে লাগলো করিডর ছেড়ে। কিছুটা সামনে যেতেই সকলে থমকে দাঁড়ালো একপ্রকার! সামনে থেকে ছুটে আসছে আমরিন।তার পিছুপিছু তার পরিবারও আসছে এদিকে। তাদের দেখামাত্রই সকলের মুখের আদলে পরিবর্তন ঘটলো ব্যাপক! সাব্বির সাহেব কোমরের পেছনে বেধে রাখা হাতদুটো হঠাৎই মুষ্টিবদ্ধ করে নিলেন। মুখের অভিভ্যাক্তি হলো কঠোর! তিনি শক্ত চোখে তাদের দিকে একপলক তাকিয়ে হনহন করে চলে গেলেন সেখান থেকে। তায়েফ সাহেবও তাই করলেন! তাশরিক সাহেব একবার চেয়েছিলো আগ বাড়িয়ে কথা বলবে কিন্তু পরক্ষণেই বাড়ির পরিস্থিতি মাথায় রেখে মনটা আর সায় দিলোনা তার! তাই তিনিও তাদের একপ্রকার উপেক্ষা করে চলে গেলেন সেখান থেকে।
রাইসা বেগম রাফিয়া বেগমের সাথে সাথে আসছেন। তাদের পেছনে অনিক হাঁটছে ধীরে ধীরে। কিয়তক্ষন বাদেই পেছন থেকে ভেসে আসে রৌদ্রের কন্ঠ!
“ অনিক দাঁড়া!”
অনিক থামলো। পেছনে ফিরে জিজ্ঞাসু চোখে চাইলো রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র দৌড়ে আসে ছেলেটার কাছে। ধীমী স্বরে বলে,
“ বাসায় গিয়ে অরিনকে খাবার খাইয়ে দিবি! ও আবার কান্নাকাটি করলে খাবারের ওপর অভিমান করে বসে থাকে। আমি ড্যাম শিওর,ও হয়তো কালকেও না খেয়ে ছিলো।তুই বাড়িতে গিয়েই ওকে নিজ হাতে খাইয়ে দিবি। ও যদি খেতে না চায় তাহলে জোর করে খাওয়াবি।দরকার হয় দুটো ধমক দিবি, কিন্তু খেয়াল রাখিস, ধমকটা যেন বেশি জোরে নাহয়! আর হ্যা…ও খেয়ে নিলে আমায় একটা মেসেজ দিয়ে জানাবি! গট ইট?”
অনিক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে। হয়তো ভাবছে — একটা মানুষ কি পরিমাণ ভালোবাসলে এমন একটা পরিস্থিতিতে নিজের চিন্তা না করে অন্যের চিন্তা করে?
অনিককে এমন নিজের ভাবনায় নিমগ্ন থাকতে দেখে রৌদ্র ভ্রু কুঁচকায়।অনিকের মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে ওঠে,
“ কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?”
অনিক প্রতিত্তোরে কিছু না বলে হুট করে জড়িয়ে ধরলো রৌদ্রকে।হঠাৎ এহেন কান্ডে ভড়কে যায় রৌদ্র। অনিকের পিঠে নরম হাত বুলিয়ে বললো,
“ খারাপ লাগছে তোর?”
অনিক রৌদ্রকে আরেকটু চেপে ধরে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
“ সরি রোদ ভাই! আমি…আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না তোমার জন্য!”
রৌদ্র ব্যাথাতুর হাসলো।দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলে অনিককে নিজ থেকে ছাড়িয়ে বললো,
“ এখন আর আমাদের কিছুই করার নেই ভাই! যা হবার হবে!”
অনিক আহত চোখে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে। ধরে আসা কন্ঠে কিছু বলতেই যাবে তার আগেই তার চোখ পড়ে রৌদ্রের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের দিকে। রৌদ্র অনিকের দৃষ্টি দেখে পেছনে তাকায়। পরক্ষণেই দেখতে পায় — রাফিয়া বেগম কেমন ছলছল চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে! রৌদ্র মিহি হাসলো খানিকটা। রাফিয়া বেগম ধীরে ধীরে ছেলেটার দুগালে হাত রাখে আলতো করে। ধরে আসা কন্ঠে বলতে থাকে,
“ অযোগ্য মানুষকে এতোটা ভালোবাসতে নেই রোদ! এতে বুকের মাঝে জ্বালা বাড়ে আব্বু! কষ্ট বাড়ে কয়েকগুণ!”
রৌদ্র ফিচেল হাসে। গালের ওপর ধরে রাখা রাফিয়া বেগমের হাতদুটোর ওপর হাত ছুঁইয়ে বলে,
“ ভালোবাসা কি আর যোগ্য/অযোগ্যতা দেখে হয় মেজো মা? এ যে আপনা-আপনিই হয়ে যায়
আড়ালে,নিরবে,নিভৃতে! তাছাড়া কষ্ট পাওয়ার বাকিই বা কি আছে মেজো মা? ওর ভালোবাসার আগুনে পুড়ে আমি যে ছারখার হয়ে গেছি অনেক আগে।এখন শুধু অবশিষ্ট আছে ছাই গুলো! ছাইদের কি আর কষ্ট হয় বলো?”
রাফিয়া বেগমের চোখদুটো আর বাঁধ মানলো না।সেখান থেকে গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা নোনাধরা। রাফিয়া বেগম মুখটা এগিয়ে এনে রৌদ্রের কপাল বরাবর ঠোঁট ছোঁয়ায়।সেভাবে থেকেই বলতে লাগলেন,
“ আমার একবুক আফসোস রোদ,আমি তোর মতো সন্তান পেটে ধরতে পারিনি! তারচেয়েও বড় আফসোস তোর ভালোবাসার মানুষটাকে তোর যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি!”
রৌদ্র রাফিয়া বেগমের দিকে তাকায়। মোটা হয়ে আসা গলায় বলে,
“ এভাবে বলো না মেজো আম্মু! ওর কোনো দোষ নেই। ও হয়তো ভয় পেয়ে আছে কোনো বিষয় নিয়ে!”
রাফিয়া বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি টানে ঠোঁটের কোণে। শাড়ির আঁচলে ভেজা চোখদুটো মুছে নিয়ে বলে,
“ ভাগ্য করে তোর মতো প্রেমিক পুরুষ পেয়েছিলো হতভাগী! কিন্তু… থাক আর বলতে ইচ্ছে করছে না!”
কথাটা শেষ করেই আর কোনদিক না তাকিয়ে হাঁটা ধরেন রাফিয়া বেগম। অনিকও যায় মায়ের পিছুপিছু। কিছুটা সামনে এগোতেই আমরিন বেগমকে এই অসময় এখানে দেখতে পেয়ে থমকালেন রাফিয়া বেগম। সরু চোখে তাকালেন তাদের দিকে। আমরিন মেজো ভাবিকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসে তার কাছে। অস্থির হয়ে রাফিয়া বেগমের হাতদুটো ধরতেই সেগুলো ছাড়িয়ে নেয় রাফিয়া বেগম। আমরিন স্তব্ধ হয়ে গেলো ভাবির এমন কান্ডে। তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন মেজো ভাবির দিকে। রাফিয়া বেগম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললেন। শক্ত গলায় বলতে লাগলেন,
“ কেনো এসেছো এখানে?”
আমরিন যেন আকাশ থেকে পড়লো এহেন কথায়। তিনি আহত গলায় বললো,
“ ভাবি! ভাইজান….!”
কথাটা শেষ হবার আগেই তার দিকে শক্ত চোখে তাকালেন রাফিয়া বেগম। কর্কশ গলায় বলতে লাগলো,
“ সেটা জেনে তুমি কি করবে? না-কি আরও কিছু ক্ষতি করবার মনোবাসনা বাকি আছে তোমার! কিসের উদ্দেশ্যে এসেছো এখানে? আজকে তোমার জন্য এই পরিবারটার এই দিন দেখতে হচ্ছে! একমাত্র তোমার জন্য আমার সন্তানদুটো একে-অপরকে ভালোবেসেও আপন করতে পারছেনা। তোমায় দেওয়া কথা রাখতে তোমার বড় ভাইজান আজ মৃত্যুর পথযাত্রী!”
রাফিয়া বেগমের একের পর এক শক্ত কথায় মাথাটা যেন ফাঁকা হয়ে আসছে আমরিনের।তিনি কাঁপতে লাগলেন দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়। পেছন থেকে শাহানুর তৎক্ষনাৎ স্ত্রীকে আগলে নিলেন নিজের সঙ্গে। রাফিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন,
“ ভাবি আপনি…! ”
“ চুপ করে যাও শাহানুর! কেননা আজ আমার মন-মেজাজ একদমই ঠিক নেই। এমনও হতে পারে সম্পর্কের বেড়াজাল ভুলিয়ে তোমায় দু-কথা শুনিয়ে দিতে একমুহূর্তও দেরি হবে না আমার! তাই দয়া করে চুপ করো!”
তারপর তিনি আবারও তাকালেন আমরিনের দিকে।গলায় একরাশ ঝাঁঝ ঢেলে বললেন,
“ আমার সন্তানদের সাথে যা-কিছুই হচ্ছে এর জন্য তোমাকে আমি কোনোদিনও মাফ করবো না আমরিন! কোনদিনও মাফ করবো না! ”
কথাটা বলে আর একমুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালো না রাফিয়া বেগম। গটগট পায়ে চলে গেলেন সেখান থেকে। আর পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো অনিক।যার কাতর দৃষ্টি নিবদ্ধ আমরিন বেগমের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা, ইকরার জ্বলতে থাকা আগুন চোখের দিকে। আবার না জানি কোন আগুন লাগবে এই পরিবারে!
প্রায় আধঘন্টা পর অনিকরা বাড়িতে এসে পৌঁছালো। রাফিয়া বেগম গটগট পায়ে বাড়িতে ঢুকলেন। ড্রয়িং পেরিয়ে রুমের দিকে যেতেই থমকে দাঁড়ালেন তিনি।চোখদুটো ছোট ছোট করে তাকালেন সোফায় বসে ঝিমতে থাকা অরিনের পানে। রাফিয়া বেগম আর রুমের দিকে না গিয়ে মেয়ের কাছে এলেন।শক্ত কন্ঠে ডাক দিয়ে বললেন,
“ এখানে বসে ঝিমাচ্ছিস কেনো?”
হঠাৎ ডাকে একপ্রকার হকচকিয়ে ওঠে অরিন। দৃষ্টি এলোমেলো করে সামনে তাকাতেই মা’কে দেখে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেয়েটা। অরিন তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ায়। মায়ের হাতদুটো ধরে জিজ্ঞেস করে,
“ বড় আব্বুর শরীর এখন কেমন আছে আম্মু?”
রাফিয়া বেগম শক্ত মুখে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন। খামখেয়ালি হয়ে জবাব দিলেন,
“ সেটা জেনে তুই কি করবি?”
অরিন অবুঝের ন্যায় মায়ের দিকে তাকিয়ে আবারও বললো,
“ বলো না আম্মু! বড় আব্বু ঠিক আছে না?”
“ হু!”— রাফিয়া বেগমের ছোট উত্তর।
অরিন তখন কি মনে করে যেন মা’কে এসে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগলো —
“ আম্মু! আমি এখানে থাকবো না আর।আমি হোস্টেলে চলে যাবো! তুমি আমার যাওয়ার ব্যাবস্থা….”
বাকিটা আর শেষ করতে পারলোনা অরিন। তার আগেই তাকে বুক থেকে উঠিয়ে সশব্দে চড় মারলেন রাফিয়া বেগম। অরিন হতবিহ্বল হয়ে গেলো এমন আক্রমণে। সে মুখ তুলতেই আরেকটা থাপ্পড় পড়লো তার অন্যগালে। অরিন দুগালে হাত রেখে ফুপিয়ে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে। তা দেখে রাগে ফোঁস ফোঁস করছেন রাফিয়া বেগম। তিনি আর কিছু না ভেবে মেয়ের চুলের মুঠি টেনে ধরে শক্ত হাতে। অরিন মৃদু ককিয়ে উঠে তৎক্ষনাৎ। বাইরে থেকে অনিক মাত্রই ঘরে ঢুকছিলো।হঠাৎ মা’কে এমন রুপে দেখে দৌড়ে আসলো ছেলেটা। মায়ের হাত থেকে বোনকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে অনুরোধ করে বলতে থাকে,
“ ছেড়ে দাও মা! কি করছো তুমি! ছাড়ো ওকে!”
শুনলেন না রাফিয়া বেগম। তিনি রণমুর্তি ধারন করে খেঁকিয়ে বলতে লাগলেন,
“ আমার হাত ছাড় অনিক! আজকে এই নেমকহারাম মেয়েকে আমি কবরে পাঠিয়ে ছাড়বো! ওর কতবড় সাহস, ও আমার সামনে আবদার জুড়ে বসে!”
কথাটা বলেই তিনি আরেকটা চড় মারলেন মেয়ের নাকমুখ বরাবর।অরিন নাকমুখ কুঁচকে কাঁদতে থাকে অনবরত। অনিক তখন বহুকষ্টে মায়ের হাত থেকে বোনকে ছাড়িয়ে আনে।রাফিয়া বেগম তেড়ে আসেন আবারও। তিনি রাগে গজগজ করতে করতে বলেন,
“ ওড়ে ছাড় অনিক! ওর মতো মেয়ের উচিৎ শিক্ষা হওয়া প্রয়োজন। যাকে মন দিলো,যাকে এতোটা দিন ভালোবাসলো তাকে আজ সবার সামনে অস্বীকার করলো এই মেয়ে? ভাবতে পারছিস ও কতবড় বিশ্বাসঘাতক! আমি যেদিন প্রথম জানতে পেরেছিলাম ও রোদকে ভালোবাসে সেদিন আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম,ভেবেছিলাম — রোদ সকল প্রতিকূলতায় ওর হাতটা ধরে রাখতে পারবে তো? কিন্তু আজ আমার ভাবনা সম্পূর্ণ পাল্টে দিলো এই মেয়ে!যেখানে আমার রোদ ওর জন্য পাগলের মতো আহাজারি করছে সেখানে ও কি করলো? ছেলেটার হাত ছেড়ে দিলো এই মাঝ পথে এসে! আমিতো গতকালই ওকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়তাম — যখন ও আমার চোখে তাকিয়ে মিথ্যা বলেছিল যে ও না-কি এই বিয়েতে রাজি!”
অনিক মায়ের কথায় আকাশ থেকে পড়লো যেন। সে অবাক কন্ঠে বললো,
“ তুমি সবটা আগে থেকেই জানতে আম্মু? ”
“ হ্যা জানতাম! যেদিন তোর বোন রৌদ্রের বিয়ের কথা শুনে ভেঙে পড়েছিলো সেদিনি সন্দেহ হয়েছিল আমার! তারপর থেকেই ওর ওপর নজর রেখেছিলাম আমি। পরবর্তীতে রুহির হলুদের দিন যখন রোদ ছাঁদে বৃষ্টির মাঝে ওকে ভালোবাসার কথা বলেছিলো,সেদিন সবটা নিজ কানে শুনেছি আমি! আমি জানতাম ওরা একে-অপরকে ভালোবাসে।তবুও আমি চুপ থেকেছি এতোদিন! কারণ আমার রোদের ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা ছিলো! আমি জানতাম ছেলেটা ঠিকই সবাইকে মেনেজ করতে পারবে।কিন্তু শেষমেশ কি হলো দেখ! তোর কালসাপ বোনটা আমার সোনার টুকরো ছেলেটার মনে কি পরিমাণ কষ্ট দিলো! ছেলেটার কান্না দেখলে পাষাণও অটল থাকতে পারবেনা সেখানে তোর বোন কি-না চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখেছে!আল্লাহ! এ কেমন বিশ্বাস ঘাতক জন্ম দিলাম আমি!”
কথাটা ব’লেই রাফিয়া বেগম পাশের সোফাটায় ধপ করে বসে পড়লেন। মাথায় হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৪৯
“ তোর মতো মেয়েকে এতোটা ভালোবাসলো রোদ! যেখানে তুই ওর যোগ্যই না! তোর মতো অযোগ্য মেয়েকে কেও কিভাবে এতোটা ভালোবাসতে পারে? জিজ্ঞেস কর তোর ভাইকে, আসবার সময়ও পাগল ছেলেটা বারবার বলে দিয়েছে তোকে খাবার খাইয়ে দিতে,তোর খেয়াল রাখতে! ভাবতে পারছিস? একবুক পরিমাণ কষ্ট বুকে চেপে রেখেও এ কথাগুলো বলেছে রোদ! আর তুই? ছিঃ তোকে নিজের মেয়ে বলতেও ঘৃণা হচ্ছে আমার! যেই মেয়ে কারো ভালোবাসা, আবেগ অনুভূতি নিয়ে খেলতে পারে সেই মেয়ে কোনদিন আমার মেয়ে হতে পারেনা! এমন বিশ্বাসঘাতক আমি রাফিয়া পেটে ধরিনি! অনিক,ওকে সরা আমার সামনে থেকে! নাহলে আজ হয়তো এই বিশ্বাসঘাতককে মেরেই ফেলবো আমি!”