সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫২
Jannatul Firdaus Mithila
“ হু হু, কাঁদো.. কেঁদে কেঁদে আবারও বিছানায় পড়ো।তোমরা তো আবার একে একে অসুস্থ হয়ে হসপিটালের বেড ধরেছো। বলি, এভাবে এক এক করে না এসে সবাই মিলে একসাথে হসপিটালের বেডগুলো বুক করে নাও না! সমস্যা তো নাই, আমি এক অবলা প্রাণী আছি না? তোমরা একেক জন বেডে পড়বা আর আমি তোমাদের সুস্থ করে তুলবো। এটাই তো এখন আমার গুরুদায়িত্ব!”
রৌদ্রের এহেন কৌতুক ভরা বাক্যে হতবুদ্ধিভাব নিয়ে তাকিয়ে রইলেন সাব্বির সাহেব। পাশে বসে তায়েফ সাহেব মুখ টিপে হাসছেন। সাব্বির সাহেব পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠেন।আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন,
“ ইয়ে..আসলে মেয়েটার জন্য একটু চিন্তা হচ্ছিলো তাই আরকি…”
রৌদ্র সরু চোখে তাকায় এবার।মুখের সামনে মাছি তাড়াবার ন্যায় হাত নেড়ে, হেয়ালি সুরে বলে ওঠে,
“ ওর জন্য আমি আছি না? আমি থাকতেও এতো কিসের চিন্তা তোমার? না-কি আমায় পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছো না?”
সাব্বির সাহেব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছেলেটার দিকে। ছলছল চোখদুটোতে তার স্পষ্ট ফুটে উঠেছে খুশির ঝলক! মনটায় ছেয়ে গেছে এক অদ্ভুত শান্তি।তিনি বিছানায় পা গুটিয়ে রৌদ্রের কাছে এলেন খানিকটা। ছেলেটার মাথায় পরম যত্নে হাত রাখলেন। ধরে আসা কন্ঠে কোনমতে বলতে লাগলেন,
“ তোর ওপর আমি আমার নিজের চাইতেও বেশি ভরসা করি রোদ। আমি জানি,তুই সবটা সামলে নিবি।”
রৌদ্র মাথা নুইয়ে রেখে ফিচেল হাসলো।কিয়তক্ষন নিরব থেকে হুট করেই কেমন অদ্ভুত শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ হুম…সবটাই ঠিক করে ফেলবো। এমন কিছুই করবো — যাতে করে এহসান বাড়ির প্রতিটি সদস্য নিজ নিজ জায়গা থেকে ভালো থাকে।তোমার মেয়ের মনের অজানা কথাগুলো যেন আর কখনো ওকে কুড়ে কুড়ে না খায় — সেই ব্যাবস্থাই করবো। আব্বুর দেওয়া ওয়াদাও যেন কোনমতেই ভঙ্গ না হয় সেই ব্যাবস্থাও করবো!”
এহেন বাক্যে হতভম্ব হয়ে গেলেন সাব্বির সাহেব আর তায়েফ সাহেব। তারা দু’জনেই কেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রৌদ্রের পানে।তায়েফ সাহেব তো সঙ্গে সঙ্গে রৌদ্রের পাশে এসে দাঁড়ালেন।ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে অস্থির গলায় বলতে লাগলেন,
“ এসবের মানে কি রোদ? কি করতে চাচ্ছিস তুই? দেখ…খবরদার ভুলভাল কিছু করতে যাবি না কিন্তু!”
রৌদ্র এখনো আগের ন্যায় মাথা নিচু করে রেখেছে। কি আশ্চর্য! ছেলেটা সে-ই কখন থেকে মাথাটা নিচু করেই রেখেছে। আচ্ছা.. সে কি নিজের ছলছল চোখজোড়া আড়াল করতে চাইছে নিজের চাচাদের সামনে? না-কি নিজেকে শক্ত প্রমাণ করার জন্য কপট ভাব নিয়ে রেখেছে সে?
কিয়তক্ষন বাদে রৌদ্র নিজের আঙুলের সাহায্যে চোখের কার্নিশদ্বয় খানিকটা মুছে নিলো। তারপর বসা ছেড়ে সটানভাবে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে দিলো।তায়েফ সাহেব এখনো কেমন জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছেন ছেলেটার দিকে। রৌদ্র চাচার এহেন দৃষ্টি দেখে খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“ চিন্তা করো না। আমি এতোটাও দূর্বল নই! যা করবো — সবার ভালোর জন্যই করবো।”
কথাটা শেষ করে আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না রৌদ্র। সে একপ্রকার জোরালো কদমে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। আর তার চলে যাওয়ার পথে দু-জোড়া অবাক নেত্র তাকিয়ে রইলো একযোগে।এরইমাঝে হঠাৎই শোনা গেলো সাব্বির সাহেবের ভয়ার্ত স্বর!
“ নতুন করে আর কি কি সহ্য করা বাকি আছে তায়েফ?”
চিন্তিত মুখে কপালে আঙুল ঠেকিয়ে নিজ কেবিনে বসে আছে রৌদ্র।ছেলেটার চোখেমুখে লেপ্টে আছে আমাবস্যার আধার। কপালে দেখা মিলেছে দু-তিনেক চিন্তার ভাজ। ছেলেটার এহেন চিন্তার পেছনে কারণ হচ্ছে — কবির সাহেবের মেডিকেল সামারি রিপোর্ট। এইতো কিছুক্ষণ আগেই রৌদ্রের হাতে এসে পৌঁছেছে রিপোর্টটা।আর সে-ই থেকেই ছেলেটা কেমন রাজ্যের চিন্তায় অস্থির! কবির সাহেবের রিপোর্টটা যে খুব ভালো আসেনি।এখনই এ নিয়ে মেডিকেল বোর্ডের সাথে জরুরি মিটিংয়ে বসতে হবে তার!
রৌদ্র তার চিন্তা ভাবনার একপর্যায়ে নিজের হাতের কব্জিতে শোভিত হয়ে থাকা ঘড়িটার পানে তাকায়।সময় ৩:২৩ মিনিট! আর মাত্র কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে মিটিং। রৌদ্র মনে মনে নিজেকে শক্ত রেখে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে চেয়ারের গায়ে ঝুলে থাকা এপ্রনটা নিজের একহাতে ঝুলিয়ে নেয়,এবং অন্যহাতে রিপোর্ট আর স্ট্যাথোস্কোপটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসে কেবিন থেকে।
হাসপাতালের চতুর্থ তলায় অবস্থিত একটি সুবিশাল কাচেঁ ঘেরা ঘর।ঘরটির দরজার গায়ে বড় বড় সোনালি রংয়ের হলফে খোদাই করে লেখা —
❝ Cardiac Medical Board ❞
ঘরটির ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে বিশাল ওভাল-আকৃতির একটি কাঠের টেবিল। তার চারপাশে বেশ গাম্ভীর্যের সঙ্গে বসে আছেন হাসপাতালের অভিজ্ঞ ডাক্তাররা—কার্ডিওলজিস্ট, কার্ডিয়াক সার্জন, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, নিউরোলজিস্ট, এবং একটি সাদা কোট পরিহিত নার্সিং অফিসার।এ মুহুর্তে প্রত্যেকের চোখে-মুখেই বেশ সিরিয়াস ভাব।
সুবিশাল টেবিলের মাঝখানে রয়েছে একটি বড় মনিটর, তাতে ভেসে উঠছে কবির সাহেবের মেডিকেল রিপোর্ট।যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কবির সাহেবের —
* ECG গ্রাফের লাল তরঙ্গ
* ECHO রিপোর্টে হার্টের দূর্বল গতিপ্রবাহ।
রৌদ্র বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হাতে তার একটা ক্লিপবোর্ড ধরে রাখা। তাকে উঠতে দেখেই রেসিডেন্ট ডক্টর বুঝি খানিকটা নড়েচড়ে উঠলেন।তিনি কন্ঠে একরাশ অনিহা ঢেলে বললেন,
“ ড.রৌদ্র! আই থিংক আপনার বসা উচিত। কেননা আপনি এখনো ঠু ইয়াং এসবের জন্য।আপনার বদলে নাহয়…. ”
রেসিডেন্ট ডক্টরের কথা শেষ হবার আগেই হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন বোর্ড রুমের একজন সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট যিনি কি-না বোর্ড প্রেসিডেন্ট।তিনি হাত দিয়ে নিজের চোখের ওপর এঁটে থাকা মোটা ফ্রেমের চশমাটা খানিকটা ঠিক করে নিলেন। তারপর ঠোটেঁর কোণে একটা ছোট্ট ফিচেল হাসি টেনে গর্বের সঙ্গে বলতে লাগলেন,
“ ডোন্ট ফরগেট মিস্টার আহমেদ! ড:রৌদ্র ইজ আ লন্ডন -ট্রেইনড! তিনি লন্ডনের বিখ্যাত Imperial College London থেকে কার্ডিওলজি -তে MRCP শেষ করে দেশে ফিরেছেন।ইভেন ঢাকা মেডিকেল থেকে MD কমপ্লিট করছেন। হি ইজ ইয়াং বাট শার্প ঠু! সো লেটস হিয়ার হিম আউট!”
বোর্ড প্রেসিডেন্টের এহেন বাক্যে উপস্থিত সকলেই কেমন নড়েচড়ে বসলেন যেন।কেও কেও তো আবার ফিসফিস চালাচ্ছে একে-অপরের সাথে। রেসিডেন্ট ডক্টরের হাসি হাসি মুখটাও কেমন থমথমে হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট সকলের এহেন ভাবভঙ্গি একপ্রকার উপেক্ষা করে রৌদ্রের দিকে চাইলেন। সহাস্যে বললেন,
“ গো এহেড ড.রৌদ্র!”
রৌদ্র অনুমতি পেয়ে মাথা নাড়লো।হাতের ক্লিপবোর্ডটা টেবিলে রেখে চোখের চশমাটা আরেকটু ঠেলেঠুলে চোখে আটঁলো।সকলেই এবার নিজেদের চাক্ষুষ দৃষ্টি রৌদ্রের দিকে নিবদ্ধ করলো। রৌদ্র শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলো —
“Patient: Kabir Ehsan. Age: 64.
Known diabetic for 20 years. Moderate renal impairment. EF down to 35%.
Coronary angiography shows:
→ LAD 90% occlusion — that’s the main culprit.
→ RCA 85% — also significant.
→ LCX borderline, about 60%.
দুইবার কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়েছে গত ২৭ ঘন্টায়। এখনো post-MI arrhythmia চলছে মাঝেমধ্যে।
Stenting is not an option — multiple vessel disease, proximal LAD involvement.
We’re looking at high risk. Very high.”
এটুকু বলেই থামলো ছেলেটা।হয়তো বাকিটা বলতে ভিষণ বেগ পেতে হচ্ছে তার! নয়তো বা গলা ধরে আসছে এই যুবকের।রৌদ্র একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো।নিজেকে কোনমতে সামলে,পরক্ষনেই সে তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি তুলে তাকায় সবার দিকে। বলে,
“আমার মতে, আমাদের হাতে আর বেশি সময় নেই। যা করার খুব শীঘ্রই করতে হবে। তবে সরাসরি bypass-এ গেলে কমপ্লিকেশন রিস্ক বাড়বে।আমাদের আগামী ৪৮ ঘণ্টা তাকে ICU -তে স্টেবিলাইজ করতে হবে। রোগীর
ব্লাড সুগার কন্ট্রোল, রেনাল অপটিমাইজেশন, ইলেকট্রোলাইটস এর ওপর কড়া পর্যবেক্ষণ চালাতে হবে। আফটার দ্যাট,উই উড গো ফর CABG. যেটা কি-না তার জন্য সবচেয়ে ভালো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।
আদারওয়াইজ…এনাদার এরেস্ট কুড বি ফেট!”
বোর্ড প্রেসিডেন্ট মনোযোগ দিয়ে শুনলেন সবটা।রৌদ্রের বলা শেষ হতেই তিনি মৃদু হেসে বললেন,
“ ওয়েল প্রেজেন্টেন্ড ড.রৌদ্র! আই টোটালি এগ্রি উইথ ইট!”
তারপর তিনি বাকি বোর্ড মেম্বারদের দিকে সরু চোখে চাইলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“ এ নিয়ে আপনাদের কিছু বলার আছে?”
এহেন কথায় বাকিরা মাথা নাড়লেও নিউরোলজিস্ট মো:আকরাম খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠেন,
“ আমার কিছু বলার আছে, মে আই?
প্রেসিডেন্ট মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়।ড.আকরাম এবার টেবিলের ওপর খানিকটা ঝুঁকে আসে। আবারও বলতে থাকে,
“ বলতেই হবে ড.রৌদ্রের প্রেজেন্টেশন ভিষণ কোয়ালিটিফুল! ইভেন যথেষ্ট উপকারীও।কিন্তু একটা বিষয় হয়তো আমরা সবাই ভুলে যাচ্ছি, সেটা হচ্ছে — যেই পেশেন্টের সামারি এতক্ষণ আমরা শুনলাম তিনি আর অন্য কেও নন ড. রৌদ্রের বাবা। এজ উই অল নো — একটা মানুষ যতই বিচক্ষণ কিংবা ওয়েল ট্রেনড হোক না কেন, সন্তান হিসেবে তারা বরাবরই আবেগপ্রবণ হয়।ঠিক যেমনটা এ মুহুর্তে ড.রৌদ্রের সাথে হচ্ছে। আপনারা হয়তো খেয়াল করেন নি,রিপোর্টটা সামারি করতে গিয়েই ড.রৌদ্রের গলাটা বেশ কয়েকবার কেঁপে কেঁপে ওঠেছে। সেখানে তিনি সন্তান হয়ে বাবার বাইপাস সার্জারি করতে গিয়ে যদি আল্লাহ না করুক — একটাবার ভুলক্রমেও হাতটা নড়ে উঠে তাহলে ভাবতে পারছেন? বিষয়টা কতটা ভয়ংকর হতে পারে? আর সবচেয়ে বড় কথা, রোগীর সামারি শুনে মনে হচ্ছে এই অপারেশনে ওনার সার্ভাইব করার চান্স ৫০/৫০। তো আমার মনে হয় এই মুহূর্তে ওনার সাথে কোনো ধরনের রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না। সো দ্যাটস অল আই ওয়ান্না সে!”
এহেন কথায় প্রেসিডেন্টসহ বাকিরাও বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন।রেসিডেন্ট ডক্টর সময় বুঝে বলতে লাগলেন,
“ ড.আকরাম তো একদম ঠিক কথাটাই বলছেন। আমাদের উচিত ওনার কথাটাকে গুরুত্ব দেওয়া। এটলিস্ট আমরা আবেগে পড়ে কারো জীবন নিয়ে খেলতে পারিনা!”
প্রেসিডেন্ট গম্ভীর মুখে বসে রইলেন।চেয়ারের হাতলে হাতের কনুই ঠেকিয়ে থুতনিতে আঙুল ঘষলেন খানিকটা। এরইমধ্যে রৌদ্র ভিষণ শ্রদ্ধার সাথে অনুমতি চেয়ে বললো,
“ স্যার! ক্যান আই সে সামথিং?”
প্রেসিডেন্ট মাথা উঠিয়ে রৌদ্রের দিকে চাইলেন। মুখে কিছু না বলে ইশারায় অনুমতি দিলেন। রৌদ্র এবার সটান হয়ে দাঁড়ায়। প্যান্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে বেশ গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলে ওঠে,
“ হ্যা, আমি মানছি পেশেন্ট আমার আব্বু! কিন্তু তাই বলে যে আমি তার অপারেশন করতে পারবোনা এটা একেবারেই আপনাদের ভুল ধারণা। কেননা আমি আমার ফেমিলি এবং প্রফেশন দু’টোকেই আলাদা রাখি।…”
“ বাট ড.রৌদ্র… ”
“ নো ইফ অর বাট’স মিস্টার আহমেদ। এই মুহুর্তে তিনি আমার কাছে শুধুমাত্রই আমার একজন পেশেন্ট। তাছাড়া আর কিছুই নয়।তাই বলছি আমার পেশাদারিত্বের ওপরে আর আঙুল তুলবেন না। ধন্যবাদ!”
রৌদ্রের এহেন শক্ত বাক্যের পিঠে বলার মতো আর কিছুই পেলেন বাকি সদস্যরা।সকলেই একপ্রকার চুপ করে গেলেন যেন।কিয়তক্ষন বাদে প্রেসিডেন্ট গম্ভীর মুখে বলে ওঠেন,
“ ঠিক আছে। আপনার কথাই রইলো।কিন্তু তার আগে আপনার একটা এগ্রিমেন্টে সাইন করতে হবে।”
রৌদ্র ভ্রু কুঁচকায়।সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে,
“ কিসের এগ্রিমেন্ট?”
প্রেসিডেন্ট এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন কিছুটা শব্দ করে। তারপর নিজের ঘোলাটে চোখদুটো রৌদ্রের পানে নিবদ্ধ করে বললেন,
“ একটা সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট — যেখানে স্পষ্ট লেখা থাকবে, এই অপারেশনের সকল দায়ভার আপনার ওপর।অপারেশন থিয়েটারে ভুলক্রমেও যদি কোনপ্রকার ১৯/২০ হয় তাহলে তার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী থাকবেন আপনি। এক কথায় — এই অপারেশনটার ওপরই ডিপেন্ড করবে আপনার পরবর্তী প্রফেশন লাইফ। ”
তিনি কিছুটা থেমে আবারও বলতে লাগলেন,
“ তাছাড়া আপনি যদি এই অপারেশনটা করতে না চান তাহলেও কোনো সমস্যা নেই, আমরা বিদেশ থেকে বড় বড় অভিজ্ঞ ডাক্তারদের নিয়ে আসবো এখানে। এর জন্য হয়তো একটু সময় লাগতে পারে।আমরা…..”
“ বাট আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই স্যার! যা করার তারাতাড়ি করতে হবে। উমম…ঠিক আছে।আপনার এগ্রিমেন্টে আমি রাজি! তবুও এই অপারেশন আমিই করবো।এবং সাকসেসফুলও হবো ইনশাআল্লাহ!” — প্রেসিডেন্টের কথার মাঝেই বলে ওঠে রৌদ্র।
প্রেসিডেন্ট রৌদ্রের এহেন আত্মবিশ্বাসে খানিকটা মুগ্ধ হাসলো। তিনি হালকা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন বোর্ড রুম থেকে। তার পিছুপিছু একে একে সবাই চলে যেতে লাগলেন। আর রৌদ্র? সে মাথ নিচু রেখে দাঁড়িয়ে রইলো কিয়তক্ষন। দৃষ্টি তার ফ্লোরের উপর নিবদ্ধ! ছেলেটার মনে চলছে হাজারো চিন্তা। না, প্রফেশন নিয়ে নয় — বরং নিজের বাবা এবং পরিবারকে নিয়ে।
“ স্যার! ৩০২ নং রুমের পেশেন্ট, আই মিন — আপনার আম্মুর জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু ম্যাম জ্ঞান ফেরার পর থেকেই প্রচুর কাঁদছেন।”
রৌদ্র বোর্ড রুম থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে করিডরে হাঁটছিলো।এরইমধ্যে একজন নার্স ছুটে এসে কথাটা বলে থামলো।রৌদ্র কথাটা শোনামাত্রই পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলো।করিডরের বা-দিকে থাকা লিফটে ওঠে পড়লো তিন তলার উদ্দেশ্যে!”
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর, রৌদ্র জোরালো কদমে মায়ের কেবিনে এসে ঢুকলো।আর এসেই দেখতে পেলো — তার মা কেমন হাউমাউ করে কাঁদছে।রৌদ্র দ্রুত এগিয়ে এলো মায়ের কাছে।হাত বাড়িয়ে মা’কে বুকে চেপে ধরলো ছেলেটা।তারপর মায়ের মাথাটায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
“ হুঁশ! আর কেঁদো না আম্মু! প্লিজ আর কেঁদো না।”
জুবাইদা বেগম এখনো কাঁদছেন।ছেলের কথা শুনে হয়তো তার কান্নার বেগ কমলো কিছুটা। তিনি শক্ত করে ছেলেকে চেপে ধরলেন।রৌদ্রের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,
“ তোর আব্বুর কেমন আছে রোদ? ও সুস্থ হয়ে যাবে তো? ওর কোনো ক্ষতি হবে না তো রোদ?”
রৌদ্র মায়ের কথায় খানিকটা ঢোক গিললো। কেন যেন এই অল্প কিছু কথার জবাব দিতে গিয়ে গলাটা আচমকাই ধরে আসছে তার! রৌদ্রকে ওমন চুপ করে থাকতে দেখে জুবাইদা বেগম আরও কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠলেন।ছেলের বুক হতে মাথা উঠিয়ে তার চোখ বরাবর নিজের ছলছল চোখজোড়া তাক করলেন। ছেলের হাতদুটো মৃদু ঝাকিয়ে বললেন,
“ বল না বাবা!”
রৌদ্র আলগোছে মায়ের মুখটা নিজের দু’হাতের তালুতে নিয়ে নেয়।তারপর হাতের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে মায়ের চোখদুটো খানিকটা মুছে দিয়ে নমনীয় কন্ঠে বলে,
“ আব্বু ঠিক হয়ে যাবে আম্মু! তুমি শুধু একটু ধৈর্য্য ধরো! দয়া করে এভাবে আর ভেঙে পড়োনা।বিশ্বাস করো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তোমাদের এভাবে দেখে!”
কি এমন বললো ছেলেটা? কেনো ছেলেটার এহেন বাক্যগুলো একেবারে বুকে এসে বিঁধলো জুবাইদা বেগমের? সত্যিই কি তার ছেলেটা খুব কষ্ট পাচ্ছে?
নিজের এমন ভাবনা শেষে জুবাইদা বেগম নিজের কান্নাগুলো গিলে নিলেন একপ্রকার। তিনি গালের ওপর ধরে রাখা ছেলের হাতদুটোকে নিজের সামনে এনে পরপর চুমু খেলেন কয়েকটা। বললেন,
“ খুব কষ্ট হচ্ছে তোর তাই-না বাবা?”
রৌদ্র হাসলো একটুখানি।হাত উঁচিয়ে মায়ের মাথার এলোমেলো চুলগুলো আলতো করে গুছিয়ে দিয়ে বলতে থাকে,
“ উঁহু… কোনো কষ্ট নেই আমার।”
জুবাইদা বেগম আহত চোখে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে। ছেলেটার চোখেমুখের এ কি অবস্থা হয়েছে? মুখটা কেমন হঠাৎই মলিন হয়ে গেছে বুঝি।চোখদুটোও কেমন লাল হয়ে আসছে।আচ্ছা… ছেলেটা কি কাল থেকে জেগেই আছে? একটুও কি চোখদুটো বন্ধ করার সময় পায়নি? জুবাইদা বেগম নিজের মনের কথাগুলো ঠোঁটের আগায় নিয়ে এলেন।ছেলের পানে আহত চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ তুই কি একটুও ঘুমাসনি বাবা?”
রৌদ্রের কর্মরত হাতদুটো হঠাৎই থমকে গেলো যেন।সে কেমন চমৎকার হাসলো মায়ের কথায়। বললো,
“ নাহ…তোমরা আগে সুস্থ হও,তারপর মন ভরে তোমাদের কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো।”
এহেন কথায় জুবাইদা বেগমের চোখদুটো আবারও ভরে আসলো যেন। তিনি আলগোছে নিজের শাড়ির আঁচলে ভেজা চোখদুটো মুছে নিলেন।তারপর ছেলের দিকে না তাকিয়েই বললেন,
“ কবে সব আবারও আগের মতো হবে রোদ? আমার যে আর ভালো লাগছে না বাবা!”
রৌদ্র আহত হাসলো।কি আশ্চর্য! ছেলেটার হাসিতেও এতো ব্যাথা কেনো? কি এমন ব্যাথা তার — যেটা সে লুকিয়ে রেখেছে তার ওমন মুগ্ধ হাসির মাঝে! কিছুক্ষন বাদেই রৌদ্র তার মায়ের কথার প্রতিত্তোরে কেমন অদ্ভুত শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
“ হবে আম্মু… খুব শীঘ্রই সবটা আবারও ঠিক হয়ে যাবে।তুমি চিন্তা করো না।”
জুবাইদা বেগম ছেলের ওমন গভীর কথার ভাবার্থ না বুঝেই মাথা নাড়ান। ঠিক সে-ই সময় কেবিনে এসে ঢুকলো একজন নার্স। হাতে তার একটা মাঝারি সাইজের ট্রে ধরে রাখা। তিনি এসেই রৌদ্রের থেকে খানিকটা দূরে দাড়িয়ে বললেন,
“ স্যার খাবারটা!”
“ টেবিলে রাখুন!” — ছোট করে উত্তর দিলো রৌদ্র।
নার্সও রৌদ্রের কথানুযায়ী খাবারটা টেবিলে রেখেই চলে গেলেন। রৌদ্র একপলক সেদিকে তাকিয়ে চলে গেলো কেবিন সংলগ্ন ওয়াশরুমের দিকে। তারপর মিনিট খানেক পেরুতেই বেরিয়ে আসে ছেলেটা। জুবাইদা বেগম ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকালেন ছেলের দিকে। পরক্ষণেই তার ভ্রু কুঁচকে আসে আপনাআপনি। ছেলেটা হয়তো চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে এসেছে, তাইতো তার মুখ এবং চুলগুলো কেমন ভিজে আছে।আবার সেখান থেকে পানিও চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। যার দরুন শার্টটাও ভিজে জবুথবু অবস্থা! রৌদ্র ধীর পায়ে এগিয়ে আসে মায়ের সামনে। জুবাইদা বেগমও তৎক্ষনাৎ ছেলের হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে দিলেন।তারপর নিজের শাড়ির আঁচলে ছেলের ভেজা মুখটা, চুলগুলো আলতো করে মুছে দিতে লাগলেন। রৌদ্র চোখ বন্ধ করে রইলো। মনটা এতক্ষণে কিছুটা হলেও শান্তি পাচ্ছে তার।
প্রায় মিনিট খানেক পর জুবাইদা বেগম রৌদ্রের মুখ থেকে আঁচল সরালেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ এভাবে কেও হাতমুখ ধোঁয় বাবা? ইশশ্… কি করলি শার্টটার অবস্থা? এ-তো একেবারে ভিজে গেছে।”
রৌদ্র ফিচেল হাসে। মায়ের কন্ঠ কানে পৌঁছাতেই বুঝি স্বস্তি মিলছে ছেলেটার।সে কেমন মগ্ন হয়ে শুনছে মায়ের কথা। তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই ছেলেটা তৎক্ষনাৎ সোজা হয়ে বসে। টেবিলের ওপর থেকে খাবারটা হাতে নিয়ে বলে,
“ দেখি..হা করো তো।খাবারটা খেয়ে নাও।আমার আবার বেশি সময় নিয়ে এখানে বসে থাকলে চলবে না।রাউন্ডেও যেতে হবে। তাই লক্ষ্মী মেয়ের মতো খাবারটা খেয়ে না-ও তো!”
জুবাইদা বেগম ছেলের ওমন কথার বলার ভঙ্গিতে মুখ টিপে হাসলেন। ভাবলেন — ছেলেটা কেমন তার বাবা বনে গেলো হঠাৎ করে! বাবারা যেমন ছেলেমেয়েদের আদর করে খাবার খাইয়ে দেন,তার ছেলেটাও তো এখন এমনি করছে। রৌদ্র ভাত মেখে এক লোকমা তুলে ধরে মায়ের মুখের সামনে। হুট করে খাবারের গন্ধে জুবাইদা বেগম নাক মুখ কুঁচকে ফেললেন খানিকটা।সেদিকে তাকিয়ে রৌদ্র কপট রাগ নিয়ে বলে ওঠে,
“ ভাব করলে লাভ হবেনা আম্মু! তোমার এখন খেতেই হবে।নেও…জলদি হা করো।”
অগত্যা এমন কথায় জুবাইদা বেগমের আর কি’বা করার থাকে? তিনি বাধ্যের ন্যায় মুখে তুলে নিলেন খাবারটা। রৌদ্র হাসলো এতে।খাবারের প্লেটটা একহাতে নিয়ে, অন্যহাতে মায়ের মাথাটা নিজের মুখের সামনে এনে শব্দ করে চুমু বসিয়ে দিলো।বললো,
“ দেটস লাইক আ গুড গার্ল!”
বিকেল পাঁচটা🌸
রৌদ্র বেরিয়েছে রাউন্ড দিতে। ছেলেটা এখন বেশ পরিপাটি। শত হলেও এখানকার একজন দক্ষ কার্ডিওলজিস্ট সে।যেন-তেন এলোমেলো হয়ে থাকলে তো আর চলবে না তার! রৌদ্র নিজের রাউন্ড শেষে একবার মত করলো অরিনের কেবিনে যেতে।মেয়েটাকে কেবিনে আনার পর মাত্র দুবার দেখে এসেছে সে।কাজের চাপে খুব একটা সময় দিতে পারেনি মেয়েটাকে।রৌদ্র আর কিছু না ভেবে হাতে কিছু জরুরি ফাইল নিয়েই হাঁটা ধরে অরিনের রুমের দিকে।
অরিনের রুমের কাছে আসতেই একজন নার্স দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। রৌদ্র তাকে দেখে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই নার্স নিজে থেকে ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলো,
“ স্যার,স্যার…মেডামের জ্ঞান ফিরেছে। তিনি এখন পুরোপুরি বিপদমুক্ত।কিন্তু…. ”
“ কিন্তু কি?” — তৎক্ষনাৎ সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে রৌদ্র।
নার্স খানিকটা হাঁপিয়ে বললেন,
“ ভেতরে হয়তো মেডামের ভাই বসে আছেন।তিনি সে-ই কখন থেকে অনবরত কাঁদছেন।আমি কয়েকবার বললাম — না কাঁদতে কিন্তু কে শোনে কার কথা!”
রৌদ্র ফিচেল হাসলো।মেয়েটাকে যেতে বলে দাঁড়িয়ে রইলো বাইরে। থাক না…কথা বলুক অনিক তার বনুর সঙ্গে। ছেলেটাও তো কম কষ্ট পায়নি বোনের জন্য!
অরিনের জ্ঞান ফিরেছে এইতো মিনিট দশেক হবে! সেই থেকে মেয়েটার সামনে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে অনিক।থামা-থামির নামগন্ধও নেই তার! অরিন বেশ কয়েকবার ভাইকে কান্না থামাতে বলেছে,কিন্তু তার ভাইটা কান্না থামালে তো! ছেলেটা কেমন বাচ্চাদের মতো বোনের পায়ের ধারে বসে মাথানিচু রেখে কাঁদছে। বারেবারে নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করে বলেই যাচ্ছে —
“ আমি খুব খারাপ ভাই… আমি তোকে আগলে রাখতে পারিনি।আমার ভুল হয়ে গেছে বনু! আমায় প্লিজ ক্ষমা করে দে!”
অরিন ভাইয়ের এহেন কান্ডে আহত অবস্থাতেও হাসলো খানিকটা। মেয়েটা আর কিছু না ভেবে ভাইকে হাত উঁচিয়ে ডাকতে গেলেই হাতে খানিকটা টান পড়ায় মুখ কুঁচকে উহঃ বলে ওঠে তৎক্ষনাৎ। অনিক হকচকিয়ে ওঠে বোনের ব্যাথাতুর শব্দে। সে তড়িৎ এগিয়ে আসে বোনের কাছে। বিচলিত হয়ে বলতে থাকে,
“ কি হয়েছে বনু? কি লাগবে তোর? কোথায় ব্যাথা পেলি বনু? এই বলনা বনু!”
ভাইয়ের একের পর এক প্রশ্নে একপ্রকার অতিষ্ঠ অরিন। মেয়েটা খানিকটা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে ভাইয়ের দিকে তাকায়। বলতে থাকে,
“ একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করলে কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দেই বলোতো?”
অনিক নিজের করা এহেন বোকামিতে জিভ কাটলো আলগোছে।মাথা চুলকে বোকাদের মতো হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
“ ইয়ে মানে… সরি।”
অরিন হাসলো ভাইয়ের কর্মকাণ্ডে।হাসতে হাসতেই মেয়েটার চোখের কার্নিশ ভরে এলো। গোটা একটাদিন পর তার ভাই আবারও তার সঙ্গে হেসেখেলে কথা বলছে। সময়টা খুব একটা বেশি নাহলেও অরিনের বুঝি মনে হচ্ছে ভাইয়ের সঙ্গে তার গোটা এক-জনম ঠিকভাবে কথা হয়না!অনিক বোনের হাসিমুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মনটা এতক্ষণে গিয়ে খানিকটা শান্তি পেলো তার। অনিক ভেজা চোখে হাসলো বোনের সঙ্গে। সে গুটিগুটি পায়ে বোনের মাথার কাছে এসে দাঁড়ায়।তারপর হাত বাড়িয়ে বোনের মাথাটা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। ধরে আসা কন্ঠে বললো,
“ আর কখনো এতোবড় কাজ করতে যাস না বনু! বিশ্বাস কর, তোর কিছু হয়ে গেলে সত্যি মরে যাবো আমি। ভাইয়ার ওপর তোর যত রাগ-ক্ষোভ যা-ই থাকুক না কেন, তবুও তুই দ্বিতীয়বার এমনটা করার কথা স্বপ্নেও ভাবিস না!”
অরিন ভাইয়ের কথাগুলো বেশ মনোযোগের সাথে শুনলো।মেয়েটার চোখ থেকে অবলীলায় গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু, তাও আবার নিঃশব্দে! অরিন খানিকটা নাক টানে। ধরে আসা কন্ঠে বলতে থাকে,
“ আমায় ক্ষমা করে দাও ভাইয়া! আমি….. আসলে!”
বাকিটা আর বলতে পারলোনা অরিন। হয়তো কথাগুলো গলাতেই আটকে গেছে তার। অনিক বোনের মাথাটা আরেকটু চেপে ধরে নিজের বুকের সঙ্গে। অরিনের মাথায় পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে বলে,
“ হুঁশ! আর বলতে হবেনা বাচ্চা… এ বিষয়টা একেবারেই ভুলে যা।”
অরিন এবার ভাইয়ের বুক থেকে মাথা তুলে, ভাইয়ের মুখের দিকে চাইলো।ছলছল চোখে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
“ আমায় একটা ছোট্ট প্রমিস করবে ভাইয়া?”
অনিক তৎক্ষনাৎ বোনের কপাল বরাবর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।পরক্ষণেই বোনের গালের ওপর হাত রেখে আলতো স্বরে বললো,
“ হুম…বল সোনা!”
“ যত,যা-ই হয়ে যাক না কেন… তুমি আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করবে না প্লিজ… দরকার হয় ধমক দিবে,শক্ত কথা বলবে তবুও কথা বইলো প্লিজ।আমি তোমার নিরবতা সহ্য করতে পারিনা ভাইয়া।আমার খুব কষ্ট হয় তুমি যখন আমার সঙ্গে কথা না বলে থাকো।”
এহেন কথায় অনিকের বুকটা বুঝি মোচড় দিয়ে ওঠে খানিকটা। বোনটা তার গত একদিনের দূর্ব্যাবহারে কেমন মূর্ছা প্রায়।নিশ্চয়ই বোনটা তার এহেন ব্যাবহার গুলোতে ভিষণ রকমের কষ্ট পেয়েছে। অনিক নিজের করা কৃতকর্মে মনে মনে ভিষণ কষ্ট পেলো।সে নিজের মাথাটা নিচু রেখে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে দিলো আবারও। অরিন তৎক্ষনাৎ অস্থির হয়ে বলে ওঠে,
“ এই ভাইয়া.. প্লিজ কান্না থামাও।দেখো তুমি এভাবে কাঁদলে কিন্তু আমিও কেঁদে দিবো।”
এরূপ কথায় অনিক কান্না থামিয়ে ফিক করে হেসে ওঠে। বোনের পানে ছলছল চোখজোড়া তাক করে নাক টানে সামান্য। তারপর মেয়েটাকে আবারও নিজের বুকের মাঝে টেনে নিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,
“ আমি কথা দিচ্ছি আমার বনুকে… আজকের পর থেকে কোনোদিনও আমার বনুর সঙ্গে বাজে ব্যাবহার করবোনা আমি।এমনকি কোনদিন রাগ করে কথা বলাও বন্ধ করবোনা ইনশাআল্লাহ! খুশি?”
অরিন ভাইয়ের বুকে মাথা রেখেই খানিকটা জোর গলায় বলতে লাগলো,
“হুম… ভিষণ খুশি!”
ভাই-বোনের এমন কান্ডের মাঝেই কেবিনে ঢুকে রৌদ্র। তাকে দেখা মাত্রই অনিক মাথাটা নিচু করে বোনকে বুক থেকে সরিয়ে দেয়। তখনের দেওয়া রৌদ্রের ধমকে বেচারার বুকটা এখনো কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে।বোঝাই যাচ্ছে — ছেলেটা হয়তো বেশ ভালোই ভয় পেয়েছে রৌদ্রের হুংকারে। অরিন আড়চোখে একপলক রৌদ্রের দিকে তাকায়। শ্যামবরণ পুরুষটার চৌকস বেড়াল চোখদুটো সেই চিরচেনা খয়েরী রঙের চিকন ফ্রেমের চশমাটির আড়ালে। গায়ে জড়ানো শুভ্র এপ্রন, গলার ওপর ঝুলে আছে স্ট্যাথোস্কোপ। এপ্রনের ভেতরে পড়ে রেখেছে কালো রঙের শার্ট।এমনিতেই কি লোকটা কম সুন্দর? যা পড়ে তাতেই তো মাশাআল্লাহ লাগে দেখতে তবুও কেনো সোনায় সোহাগা হিসেবে শার্টের গলার কাছের দুটো বোতাম হা করে খুলে রাখা? এই লোক কি চায়? মেয়ে মানুষ তার এহেন রুপ দেখে ঝলসে যাক! না-কি অরিন নামক এক নিরীহ প্রাণীকে সম্পূর্ণ পাগল করে দিতেই তার এতো কৌশল?
অরিনকে নিজের দিকে ওমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো রৌদ্র।পরক্ষণেই নিজের হাতের ফাইলটার দিকে খানিক ভাব নিয়ে তাকিয়ে দুষ্ট কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ দেখা শেষ হয়েছে? না-কি আরেকটু দেখবেন?”
হঠাৎ এহেন বাক্য কর্ণগোচর হওয়া মাত্র থতমত খায় অরিন।মেয়েটা তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে আনে রৌদ্রের ওপর থেকে। রৌদ্র আড়চোখে দেখলো সবটা। পরক্ষণেই তার নজর গিয়ে পড়লো বেডের পাশে দাঁড়িয়ে মুখ টিপ হাসতে থাকা অনিকের ওপর। সে কেমন গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,
“ কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য তোকে কি এখন ইনভিটেশন কার্ড দিতে হবে?”
অনিক ভড়কে ওঠে এহেন বাক্যে।ছেলেটা আর কিছু না বলে ভদ্র ছেলের মতো মাথা নিচু রেখে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। শত হলেও এদের দু’জনের মধ্যে কাবাব মে হাড্ডি হতে পারবে না সে। অনিক বেরিয়ে যেতেই রৌদ্র এগিয়ে আসে অরিনের নিকট। অরিনের মাথাটা এখনো আগের ন্যায় নুইয়ে রাখা। রৌদ্র নিজের হাতের ফাইলটা টেবিলের ওপর রাখলো।পরক্ষণেই টেবিলের ওপর থেকে
একটা স্যানিটাইজার হতে দু-তিন ফোটা হাতে নিয়ে হাতটা ভালো করে স্যানিটাইজ করে নিলো।পরক্ষণেই ট্রে থেকে একজোড়া স্টেরাইল গ্লাভস পড়ে নিলো।
তারপর অরিনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“ আমি ক্যানোলা খুলবো এখন।তুই আমার দিকে তাকা!”
অরিন ধীরে ধীরে রৌদ্রের দিকে তাকায়। মেয়েটা ইতোমধ্যেই ভয়ে আটখানা হয়ে পড়েছে। রৌদ্র মেয়েটার পাশে এসে বসে।অরিনের চোখে চোখ রেখে বলে,
“ নিচে তাকাবি না ওকে?”
অরিন মাথা কাত করে। রৌদ্র এবার নিজের কাজে মনোযোগ টানে।অরিনের হাতের পিঠে বসানো ক্যানোলার চারপাশে থাকা টেপ আলতো করে খুলে নেয়।তারপর ট্রে থেকে একটুখানি কটন নিয়ে ইনসার্শন সাইটে হালকা করে চেপে ধরে। অন্যহাতে ধীরে ধীরে ক্যানোলাটা টেনে বের করে নেয়।অরিন ব্যাথায় খানিকটা নড়েচড়ে বসতেই রৌদ্র অস্থির হয়ে বলে ওঠে,
“ সরি জানবাচ্চা… সরি… এইতো শেষ… আর একটুখানি.. ”
বলেই সে তৎক্ষনাৎ ইনসার্শন সাইটে কটন দিয়ে চেপে ধরে যাতে রক্ত না বের হয়।মিনিট খানেক পেরুনোর পর সেখানটায় ভালো করে এন্টিসেপ্টিক দিয়ে পরিষ্কার করে দিলো।পরক্ষণেই একটা টেপ বসিয়ে দিলো ক্যানোলা বসানো জায়গায়।
তারপর রৌদ্র ব্যবহৃত সকল মেডি বায়োওয়েস্ট এবং নিজের হাতের গ্লাভস দুটো খুলে ফেলে দিলো ডাস্টবিনে।হাতের কাজ শেষে সে আবারও নিজের হাতদুটো স্যানিটাইজ করে মেয়েটার পাশে এসে বসে। অরিনের ক্ষত হাতদুটোর পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,
“ নেক্সট টাইম একটু ভালোমতো করিস সবটা। হাত কাটতে চাইলে একটা ধারালো ছুরি নিবি কেমন? এসব সবজি কাটাঁর ছুরিতে তো ওতো ধার নেই! এই দেখনা, তুই এতো কষ্ট করে সুইসাইড এটেম্প করতে চাইলি অথচ গাদ্দার ছুরিটার গাদ্দারির জন্য তোর মনের ইচ্ছেটা পূরণ হলোনা! হাহ…. তোর জন্য ভিষণ স্যাড স্যাড ফিলিংস হচ্ছে রে… ভেরি স্যাড!”
লোকটার এমন কথায় হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে রইলো অরিন।কি বলছে এই লোক? সত্যি সে বলছে এগুলো? অরিন খানিকক্ষণ সময় নিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
“ মানে?”
রৌদ্র এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে অরিনের দিকে। ছেলেটার চোখদুটো এমনিতেই লাল তারওপর এখন কেমন ঘোলাটে হয়ে আসছে যেন।অরিন ভড়কে যায় খানিকটা। সে তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয় রৌদ্রের ওপর থেকে। রৌদ্র তখন বলা -কওয়া নেই হুট করেই নিজেদের মাঝের দুরুত্ব কাটিয়ে নিয়ে অরিনের একেবারে মুখোমুখি এসে বসে।অরিন কেঁপে ওঠে খানিকটা। মেয়েটা নিজের মাথা নুইয়ে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে। রৌদ্র ধীরে ধীরে নিজের মুখাবয়বে পরিবর্তন আনে।ছেলেটার চোয়াল হয়ে ওঠে শক্ত। চোখদুটোতে ছেয়ে যায় আগুন! সে আলতো করে অরিনের গালে আঙুল বুলায়।অরিন তৎক্ষনাৎ নিজের চোখদুটো কুঁচকে ফেলে।রৌদ্র ধীরে ধীরে তার আঙুল অরিনের গাল বেয়ে খানিকটা পিছনে নিয়ে যায়। আর তারপর হুট করেই মেয়েটার চুলের মুঠি চেপে ধরে শক্ত হাতে। অরিন মৃদু ব্যাথায় ককিয়ে উঠে।হাতদুটোও উঠাতে পারছেনা মেয়েটা। রৌদ্র এবার বেশ শক্ত গলায় রাগে হিসহিসিয়ে বলতে লাগলো,
“ তোর ভাগ্য ভালো তুই এখন অসুস্থ হয়ে আমার হসপিটালের বেডে পড়ে আছিস.. নইলে এতক্ষণে তোরে নিজ হাতে আমি কবরে পাঠিয়ে ছাড়তাম।”
রৌদ্রের এহেন কথায় জান যায় যায় অবস্থা অরিনের। মেয়েটা ভয়ে ঢোক গিললো কয়েকটা। রৌদ্র এবার অন্যহাতে শক্ত করে অরিনের চোয়াল চেপে ধরে। অরিন আবারও অস্ফুটে মৃদু ককিয়ে উঠে। অথচ সেদিকে কোনরূপ পাত্তা দিলো না রৌদ্র। ছেলেটা কেমন আগুন চোখে তাকিয়ে আছে অরিনের দিকে। ভাব এমন — এই আগুনেই বুঝি সে ঝলসে দিবে অরিনকে।রৌদ্র বুঝি এতক্ষণ নিজেকে বহুকষ্টে এই রাগ থেকে সামলে রেখেছিলো।কিন্তু এই সামলানো আর বেশিক্ষণ টিকলো না! সে এবার একপ্রকার গর্জে উঠে বলতে লাগলো,
“ মরার খুব শখ না তোর? মরণকে খুব সহজ মনে হয় তোর কাছে? ঠিক আছে! কিভাবে মরবি বল…আমি নিজ হাতে তোরে খুন করবো।তোর মতো আহাম্মক মেয়েমানুষের বাঁচতে হবে না।ভাবতেই অবাক হচ্ছি, কতবড় কলিজা তোর?এইটুকু বয়সে আমাকে… এই ইফতেখার এহসান রৌদ্রকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছিস।তোর আগেপিছে পাগলের মতো ঘুরপাক খাওয়াচ্ছিস! এই…তোর কি মনে হয় রে? আমি কি? আমারে তোর মানুষ বলে মনে হয়না?”
অরিন এবার ফুপিয়ে ওঠে। তা দেখে রৌদ্র অরিনের মুখটা ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয় হাত থেকে।তারপর দু’হাতে নিজের চুলগুলো খামচে ধরে গজগজ করতে করতে বলে,
“ শালার….পান থেকে চুন খসলেই নাকে কান্না শুরু! আল্লাহ… কি করবো আমি এরে নিয়ে! কই যাবো আমি?”
অরিন এখন হেঁচকি তুলে কাঁদছে।রৌদ্র বাঁকা চোখে মেয়েটার দিকে তাকায়। মনটা তো তার চাইছে — আরও দুয়েকটা শক্ত কথা বলতে এই মেয়েকে।কিন্তু পরিস্থিতি যে ওতোটাও ভালো না।রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। নিজের উরুতে পরপর দুটো ঘুষি মেরে নিজের রাগটাকে কমানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে ছেলেটা। অরিন কান্না থামিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখলো সবটা।এ মুহূর্তে রৌদ্রের এহেন ভাবভঙ্গিতে ভিষণ ভয় লাগছে তার। কিয়তক্ষন বাদে রৌদ্রের রাগ বুঝি কমলো কিছুটা। সে খানিকটা ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ফেলে অরিনের দিকে তাকায়। অরিন মাথা নিচু করে রেখেছে। তা দেখে রৌদ্র নিজের শুষ্ক অধরজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো কিছুটা। তারপর মেয়েটার মুখের দিকে আবারও হাত বাড়াতেই অরিন ভয়ে সিটিয়ে গেলো কিছুটা। রৌদ্র বেশ আহত হলো এহেন কান্ডে। সে মনে মনে নিজেকে আচ্ছামতো শাসিয়ে, মেয়েটার গালের একপাশে হাত রাখে আলতো করে। তারপর কেমন নরম সুরে বলে,
“ তাকা আমার দিকে!”
অরিন চোখ তুললো না।মেয়েটা এখনো কাঁদছে আগের মতো। রৌদ্র এবার অস্থির হলো।সে অরিনকে তৎক্ষনাৎ জড়িয়ে ধরে, অরিনের কাঁধের ওপর মুখ রাখে।অরিন হকচকিয়ে ওঠে খানিকটা। কি থেকে কি হয়ে গেলো ইতোমধ্যে, সবটাই যেন মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে তার। অরিনের এহেন ভাবনার মাঝেই তার কর্ণকুহরে এসে পৌঁছায় রৌদ্রের ভারি কন্ঠ!
“ এতোটা রেগে থাকিস না আমার ওপর! আমি কিন্তু মোটেও এসবের যোগ্য নই সানশাইন!”
অরিনের বুকটা বুঝি কেঁপে ওঠে তৎক্ষনাৎ। এসব কেনো বলছে তার ডাক্তার সাহেব? রৌদ্র ধীরে ধীরে অরিনকে ছেড়ে দেয়। অরিনের ছোট্ট মুখখানার ওপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হালকা ব্যাথাতুর হেসে বলে ওঠে,
“ তোর সাথে রাগ করার হাজারটা কারণ থাকলেও,সে সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে আমি তোকে ভালোবাসি সানশাইন। তোর করা পাগলামি গুলোকে ভালোবাসি।তোর এই ছিচঁকাদুনে স্বভাবটাকে ভালোবাসি। তোর হুটহাট গাল ফুলিয়ে রাখাটাকেও ভালোবাসি। তোর মুখের “ ডাক্তার সাহেব ” ডাকটাকেও ভিষণ ভালোবাসি। সানশাইন… তুই আমার এক ভয়ংকর আসক্তি! যা কি-না আমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে ওতোপ্রোতভাবে। আবার যদি বলি — তুই আমার সেই অভ্যাস,যে অভ্যাসকে নিয়ে আমি সারাজীবন বাঁচতে চাই। এখন তুই-ই বলনা সানশাইন…. এতোটা ভালোবেসে কিভাবে তোকে ভুলে থাকবো আমি? তোকে ভুলার আগে মরণ হয়ে যাক আমার।পৃথিবী থেকে মিটে যাক এই রৌদ্র নামক অহেতুক মানুষটার সকল অস্তিত্ব! তবুও সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে আমি বলবো — আমি ভালোবাসি তোকে সানশাইন।”
অরিন মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনলো সবটা।রৌদ্রের বলা প্রতিটি কথাই যেন বুকে এসে বিঁধছে তার।অরিন চোখ নামিয়ে নেয় আবারও। রৌদ্র তখন ফের বললো,
“ আমাকে দূর থেকে ভালোবাসতে পারবি বলেছিলি না? ঠিক আছে! তবে তাই হোক।কান খুলে শুনে রাখো মেয়ে — তুমি জিতলে…অবশেষে তুমি তোমার কথায় জিতলে।”
অরিন তৎক্ষনাৎ নিজের মাথা উঠায়। চোখেমুখে একরাশ অবাক ভাব লেপ্টে অস্থির গলায় বলে ওঠে,
“ মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?”
রৌদ্র তাচ্ছিল্যের হাসি টানে ঠোঁটের কোণে। হাতদুটো পিছিয়ে নিয়ে খানিকটা হেলে পড়ে বলতে থাকে,
“ সময় হলে সব জানতে পারবি।আপাতত…. ভালো থাক!”
অরিনের মাথার উপর দিয়ে গেলো সবটা।সে কেমন চিন্তিত সুরে আবারও বললো,
“ আপনি হেয়ালি না করে ঠিকমতো বলবেন প্লিজ?”
রৌদ্র এবার সোজা হয়ে বসে।অরিনের চোখের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে শান্ত অথচ নিরেট কন্ঠে বলে,
“ তেমন কিছুই না সানশাইন…. তোকে ভুলতে পারার চাইতে তোকে নিজের মনের মনিকোঠায় নিয়ে সারাজীবন বাঁচতে চাই আমি।হোক সেটা তোর সাথে… কিংবা অদূরে!”
অরিন মাথায় বাজ পড়লো যেন। মেয়েটার চোখদুটো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো এহেন কথায়। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“ মানে? কোথায় যাবেন আপনি?”
রৌদ্র আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়। রুম থেকে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই আবারও পিছনে ফিরে তাকায়।অরিনের চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫১
“আমি তোর কাছে থাকি কিংবা দূরে থাকি তাতে কিছুই যায় আসে না সানশাইন। তুই আমার ছিলি,আছিস এবং সারাজীবন থাকবি। আমি রৌদ্র বাদে তোকে আর কেও ছোঁয়াতো দূর তোর আশেপাশে ঘেঁষতেও পারবেনা। এতে যদি তোর মনে হয়ে থাকে — আমি তোকে নিজের সম্পত্তি মনে করছি তাহলে তুই একেবারেই ঠিক ভাবছিস।তুই আমার সম্পদ! একমাত্র এই ইফতেখার এহসান রৌদ্রের ব্যাক্তিগত সম্পদ। আর নিজের সম্পদের ওপর দখলদারিত্ব বরাবরই ভালো পারি আমি।”