সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৩
Jannatul Firdaus Mithila
অরিন থমকায়! রৌদ্রের বলা এহেন শক্ত কথাগুলো যেন এখনো কানে বাজছে তার।বুকটায় চলছে অনিয়ন্ত্রিত তান্ডব। চোখদুটো কেমন আঁটকে আছে রৌদ্রের পিঠ বরাবর। অরিন ক্ষনে ক্ষনে ঢোক গিললো কয়েকটা। রৌদ্র কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে গেলো কেবিন হতে।ছেলেটার চোখদুটোর কার্নিশে কেন যেন জলের উপস্থিতি! চেহারার ভঙ্গিমায় স্পষ্ট লেপ্টে আছে ব্যাথার ছাপ! ভাব এমন — অরিনকে এইটুকু কথা বলতেই যেন রাজ্যের কষ্ট পোহাতে হয়েছে তার! রৌদ্র ফটাফট কেবিনের বাইরে এসে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়।চোখবুঁজে বড় বড় নিশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর কঠিন প্রয়াস চালায়।
এদিকে অরিনের কেবিন থেকে খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো অনিক।এরইমধ্যে রৌদ্রকে হঠাৎ বেরিয়ে আসতে দেখে খানিকটা নড়েচড়ে দাঁড়ালো সে। কিন্তু পরক্ষণেই রৌদ্রকে ওমন চোখবুঁজে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুদ্বয় আপনা-আপনি কুঁচকে আসে তার।সে কিছুক্ষণ দোনোমোনো করে এগিয়ে আসে রৌদ্রের নিকট। রৌদ্র এখনও আগের ন্যায় চোখবুঁজে আছে।অনিক কিছুক্ষন রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে তার কাঁধে হাত রাখতে চাইলো কিন্তু পরক্ষনেই কিছু একটা মনে করে গুটিয়ে নিলো হাতটা।কিয়তক্ষন বাদে, অনিক মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে। রৌদ্র তৎক্ষনাৎ চোখদুটো মেলে ঘাড় বাকিয়ে তাকায় অনিকের দিকে। অনিক তখন মিনমিনে স্বরে বলে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?”
এমন কথায় রৌদ্র কেন যেন তাচ্ছিল্যের হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে। সে আগের ন্যায় দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থেকেই তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
“ আমিতো এখন আর মানুষ নই রে অনিক! আমি হয়ে গেছি রক্তে-মাংসে গড়া এক অনুভূতিহীন যন্ত্র। যার কোনো ব্যাথা নেই,কষ্ট নেই, হারানোর শোক নেই। এ জন্যই হয়তোবা এখন আর খারাপ -টারাপ লাগে না।”
অনিক হতভম্ব হয়ে গেলো এরূপ কথায়। তার বিমূঢ় চোখদুটো কেমন একদৃষ্টিতে আঁটকে আছে রৌদ্রের পানে। আচ্ছা! আজকে তার রোদ ভাই হঠাৎ এমন সুরে কথা বলছে কেনো? তার রোদ ভাইয়ের ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা হাসি আজ কেনো প্রানবন্ত ঠেকছে না তার কাছে? কিয়তক্ষন বাদে অনিক নিজের সকল হতভম্বতা একপাশে রেখে চিন্তিত গলায় বলতে লাগলো,
“ কি হয়েছে তোমার? হঠাৎ এমন কথাই বা বলছো কেন?”
রৌদ্র এহেন কথার জবাব দিতে একেবারেই প্রয়োজনবোধ করলো না। সে ধীরে ধীরে সটান হয়ে দাঁড়ায়।তারপর পকেটে দু’হাত গুঁজে অনিকের দিকে তাকায় সরু চোখে। গলায় একরাশ গম্ভীরভাব ফুটিয়ে বলে ওঠে,
“ ভেতরে গিয়ে অরিকে খাবার খাইয়ে দিবি। না খেতে চাইলেও জোর করে খাওয়াবি।তারপর টেবিলের ওপর রাখা প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষধগুলো খাইয়ে দিবি। গট ইট?”
অনিক মাথা দোলায়। রৌদ্রের কথানুযায়ী কেবিনের দিকে একপা এগোতেই আবার কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় রৌদ্রের দিকে তাকায় ছেলেটা।রৌদ্র চলেই যাচ্ছিলো কিন্তু অনিকের হঠাৎ থেমে যাওয়ায় সে-ও দাঁড়িয়ে পড়ে। ইশারায় জিজ্ঞেস করে, — কি হলো?
অনিক তখন চিন্তিত গলায় বলে ওঠে,
“ আচ্ছা! তুমি খাবার খেয়েছো তো?”
রৌদ্র ফিচেল হাসলো।অনিককে একপ্রকার উপেক্ষা করে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিলো আবারও। চলে যেতে যেতে পেছনে না তাকিয়েই বললো —
“ যন্ত্রদের আবার খিদে লাগে না-কি?”
কথাটা বলতে বলতেই রৌদ্র এগিয়ে গেলো বেশ কিছুটা।আর তার পেছনে একরাশ কাতর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো অনিক। ভেতরটা এই বুঝি দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে তার। কেনো তার পরিবার শুনতে পাচ্ছে না তার রোদ ভাইয়ের নিরব হাহাকার? কেনো তার বনু সবটা জেনেও এভাবে অবুঝ হয়ে বসে আছে? কবে শেষ হবে এই অভিশপ্ত দিনগুলো?
“ কেনো মা? কেনো তোমরা একটিবারও আমায় ফোন দিয়ে বললে না আব্বুর এমন অবস্থার কথা? বিয়ে হয়ে গেছে বলে কি আমি এতোটাই পর হয়ে গেলাম তোমাদের কাছে?”
মেয়ের একের পর এক কান্নারত কন্ঠে বলা কথাগুলো মুখ বুঁজে শুনে যাচ্ছেন জুবাইদা বেগম।এইতো মিনিট দশেক হবে রুহিটা এসেছে হসপিটালে।আর এসেছে পর থেকেই শুরু হয়েছে তার আহাজারি। রেহান বেচারা তো বউকে সামলাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। মেয়েটা তার এতো শোতে বোঝানোতে থামছেই না! বরং আরো খানিকটা বাড়িয়ে কাঁদছে।তাই অবশেষে বউয়ের কান্নার প্রকোপের সামনে একপ্রকার হেরে যাওয়া যোদ্ধার ন্যায় হার স্বীকার করে দূরে সরে দাঁড়ালো রেহান।কাঁদতে দিলো মেয়েটাকে নিজের মতো করে।তখনি কেবিনে ঢুকে রৌদ্র। তার পেছন পেছন ভেতরে আসেন রেহানের মা ও বাবা। সায়মা খাতুন জুবাইদা বেগমের এমন করুণ অবস্থায় দেখে ছলছল চোখে এগিয়ে আসেন।মানুষটার পাশে বসে আলতো করে বললেন,
“ এখন কেমন লাগছে আপা?”
জুবাইদা বেগম কৃতজ্ঞ হাসলেন। খানিকটা নড়েচড়ে বসে বেয়াইনের দিকে তাকিয়ে সহাস্য মুখে বললেন,
“ আলহামদুলিল্লাহ! আগের চেয়ে ভালো আছি।”
অতঃপর দু’জনের কথা চলতে লাগলো নিজেদের মতো করে। এদিকে, ভাইকে দেখে রুহি বুঝি আহ্লাদী হয়ে গেলো। সে তৎক্ষনাৎ ছুটে এলো ভাইয়ের কাছে।ছলছল চোখজোড়া ভাইয়ের দিকে তাক করে অভিমানী সুরে বলতে থাকে,
“ একটাবারও বললে না কেনো ভাইয়া? কেনো জানালে না আমায়? আমি কি….”
বাকিটা বলতে গিয়ে হঠাৎ করেই গলাটা কেমন ধরে আসলো রুহির।মেয়েটা দাঁড়িয়ে থেকেই হু হু করে কেঁদে উঠে। রৌদ্র একহাত বাড়িয়ে বোনকে আগলে নেয় নিজের সঙ্গে। রুহিও কেমন পা গুটিয়ে ভাইয়ের বুকের পাশে লেপ্টে দাঁড়িয়ে পড়ে।ভাইয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে মেয়েটা। রৌদ্র আলতো করে বোনের মাথায় হাত বোলাতে থাকে।নরম সুরে বলে ওঠে,
“ কাঁদে না বুড়ি! ভাইয়া ভিষণ ছোটাছুটিতে ছিলাম বাচ্চা। তাই তোকে জানাতে লেট হয়ে গেছে আমার। সো সরি ফর দেট বুড়ি!”
বাহ! রৌদ্রের এটুকু কথাতেই কান্নার বেগ বুঝি কমে এলো রুহির। মেয়েটা এখনো কাঁদছে কিন্তু অল্প! রৌদ্র বোনের মাথায় এখনো হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। এরইমাঝে, একনাগাড়ে কাঁদার ফলে রুহির হেঁচকি উঠতে শুরু করে।সে ভাইয়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে পাশে দাঁড়ায় ।এদিকে, রেহান তৎক্ষনাৎ বিচলিত হয়ে পড়ে বউয়ের জন্য। সে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসে জুবাইদা বেগমের বেডের পাশে রাখা টেবিল থেকে গ্লাস ভর্তি করে পানি নিয়ে রুহির মুখের সামনে ধরে। রুহি কান্নার তোড়ে মুখটা ঘুরিয়ে ফেলে অন্যদিকে।তা দেখে রেহান কেমন অসহায় কন্ঠে বলে ওঠে,
“ আল্লাহর দোহাই লাগে শ্যামবতী, একটু পানি খেয়ে নাও।তারপর নাহয় আবারও কান্না স্টার্ট কইরো,আমি থামাবো না তোমায়, কথা দিচ্ছি!”
রেহানের এমন কথা শুনে রুহি কান্না থামিয়ে হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে রইলো। পাশে দাঁড়ানো ওসমান সিকদার ছেলের এহেন কান্ডে তৎক্ষনাৎ সরে গেলেন কেবিন থেকে। রৌদ্রও মুখাবয়ব গম্ভীর করে বোনকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
অন্যদিকে, জুবাইদা বেগম আর সায়মা খাতুন এদের এমন কান্ড দেখে হালকা হেসে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে।অথচ রেহানের বুঝি ঘরভর্তি মানুষগুলোর দিকে কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ নেই।সে আবারও তাড়া দিয়ে ওঠে রুহিকে,
“ কি হলো? নাও না পানিটা!”
রুহি তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে রেহানের হাত থেকে পানিটা নিয়ে নেয়।তারপর গটগট করে সবটা পানি শেষ করে ফেলে চোখের পলকে।রেহান হা করে তাকিয়ে রইলো রুহির দিকে। পরক্ষণেই কেমন ঠোঁট উল্টে বলতে লাগলো,
“ আল্লাহ! আমার বউটার কতো পিপাসা লেগেছিলো…. এই, তুমি কি আরেকটু পানি খাবে? দিবো?”
এহেন কথায় রুহি বুঝি লজ্জায় পড়লো কিছুটা। এই লোক কি সময়-গময় কিচ্ছু বোঝেনা? তার মা এবং শাশুড়ির সামনে এভাবে বউ বউ করছে কেনো উনি? পৃথিবীতে তারই একমাত্র বউ আছে? অন্য কারোর নাই?
জুবাইদা বেগম আর সায়মা খাতুন পড়লেন বিপাকে। ছেলেমেয়ে দুটোর সামনে এ মুহুর্তে বসে থাকতে খানিকটা ইতস্তত বোধ করছেন তারা।সায়মা খাতুন একবার ভাবলেন উঠে চলে যাবেন কিন্তু পরক্ষণেই জুবাইদা বেগম এহেন পরিস্থিতিতে একা পড়ে যাবেন বিধায় তিনি আর গেলেন না।তাছাড়া জুবাইদা বেগমের শরীরটাও তো দূর্বল। এই দূর্বল শরীরে রুম ছেড়ে কিভাবে বেরোবেন তিনি? রুহি আড়চোখে মা এবং শাশুড়ির মুখপানে তাকায়।ইশশ্! মানুষগুলোর সামনে এই লোকটা কি শুরু করলো!
রুহি খানিকটা ঢোক গিলে নিচু গলায় রেহানকে ফিসফিস করে বলে,
“ বাইরে আসুন কথা আছে!”
রেহান ভ্রু গোটায়।তবুও আজ্ঞাকারী স্বামীর ন্যায় মাথা নাড়িয়ে বলে,
“ চলো!”
কথাটা বলেই সে রুহির হাত ধরে হেঁটে চলে আসে কেবিনের বাইরে। অন্যদিকে,তারা চলে যেতেই বুঝি মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সায়মা খাতুন।
রুহি কেবিন থেকে খানিকটা দূরে এসে দাঁড়ায়।তারপর আড়চোখে একবার আশপাশে সর্তক চোখে পরোখ করলো।তেমন কাউকে দেখতে না পেয়ে সে রেহানের দিকে তাকায় বিরক্ত চোখে।খেঁকিয়ে বলে ওঠে,
“ আপনি কি হ্যা? ভেতরে আম্মু আর মায়ের সামনে বারবার বউ বউ করছিলেন কেনো আপনি? মানে, কি বোঝাতে চাচ্ছেন? পৃথিবীতে বউ খালি আপনারই আছে?”
এহেন কথায় রেহান সরু চোখে তাকায় রুহির পানে।পরক্ষনেই সে কেমন সন্দিহান গলায় বলে ওঠে,
“ ওয়েট আ মিনিট! তুমি আমায় আপনি আপনি করে কেনো বলছো শ্যামবতী? হানিমুনে গিয়ে এতদিন কি শিখালাম তোমায়? এরইমধ্যে ভুলে গেলে সবটা? আর রইলো বাকি তোমায় বউ বলার ব্যাপারটা! দেখো শ্যামবতী…যাকে বিয়ে করছি, যার সাথে সংসার করছি তাকে বউ ডাকবো না তো কি ডাকবো? হ্যা মানছি আরও বোল্ড কিছু ডাকাই যায় কিন্তু সেটাতো বেডরুমে রাইট? সেগুলো তো আর এমন পাবলিক প্লেসে ডাকতে পারিনা।অবশ্য তুমি বললে ডাকতেই পারি!”
রুহি হতবিহ্বল হয়ে গেলো এহেন কথায়। এমন একটা সিরিয়াস মুহুর্তে এসেও এমন নির্লজ্জ কথাবার্তা কিভাবে বলে মানুষ? ওহ! সে-তো ভুলেই গিয়েছিল — এই ছেলে তো আবার তার সামনে চরম মাত্রার নির্লজ্জ।রুহি নিজের সকল ভাবনাগুলোকে একপাশে ঠেলে দিয়ে ফের খেঁকিয়ে ওঠে,
“ আপনি তো দেখছি ভারি নির্লজ্জ! দেখুন — ভুলে যাবেন না, আমরা এখন হসপিটালে আছি।”
রেহান ঠোঁট কামড়ে হাসলো। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো,
“ তাতে কি?”
রৌদ্র নিজের কেবিনে বসে ফাইল ঘাঁটছে।আজকে তার আরেকটা অপারেশন আছে।সম্পূর্ণ বদনে ঢের ক্লান্তি থাকা স্বত্বেও নিজের দায়িত্ব থেকে সরছেনা ছেলেটা। রৌদ্র একহাতে নিজের কাঁধ চেপে যাচ্ছে বারংবার। বেশ কিছুক্ষণ যাবত দু- কাঁধে খানিকটা ব্যাথা হচ্ছে কেন যেন।হয়তো টানা দুদিন একনাগাড়ে জেগে থাকার দরুন এমনটা হচ্ছে তার সঙ্গে! রৌদ্র আর ঠিকভাবে বসে থাকতে পারলোনা। সে তৎক্ষনাৎ নিজের আঙুলের ভাজে আঁটকে থাকা কলমটা ফাইলের পাশে রেখে, চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। চোখদুটো যেই-না বন্ধ করতে যাবে ওমনি কেবিনে ঢুকলো একজন নার্স। রৌদ্র খানিকটা নড়েচড়ে বসলো। নার্স হন্তদন্ত হয়ে ঢুকেই বলতে লাগলো,
“ স্যার! ৫ নম্বর আইসিইউতে থাকা রোগীর জ্ঞান ফিরেছে।”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের ওপর থেকে স্ট্যাথোস্কোপটা হাতে নিয়ে ছুটে যায় বাহিরের দিকে।যাক অবশেষে তার বাবার জ্ঞান ফিরেছে।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পরেই রৌদ্র এসে দাঁড়ালো কবির সাহেবের আইসিইউর সামনে। ছেলেটা উদগ্রীব হয়ে আইসিইউর দরজার হাতলে হাত রাখলো।কিন্তু পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় সেখানেই থমকে দাঁড়ালো রৌদ্র। দরজার হাতলে ধরে রাখা তার হাতদুটো আপনাআপনি নেমে গেলো। পেছনে থাকা নার্স ভ্রু কুঁচকান এমন কান্ডে। তিনি সন্দিগ্ধ কন্ঠে বলেন,
“ স্যার? ভেতরে যাবেন না?”
রৌদ্র মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নার্সের এহেন কথার পিঠে সে গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,
“ আপনি ড.আহমেদকে গিয়ে ডাকুন! এবং এই ফাইলটা তার হাতে দিয়ে বলবেন সবকিছু ঠিকঠাক মতো পর্যবেক্ষণ করতে।আর পরিশেষে আমায় জানাতে বলবেন রোগীর সামারি!”
নার্স অবাক হয়ে মাথা নাড়লেন শুধু। রৌদ্র এখনো আইসিইউর বাইরে দাঁড়িয়ে, দরজায় লেগে থাকা কাচ গলিয়ে ভেতরে তাকিয়ে আছে। তার বাবা হয়তো চোখবুঁজে আছে।রৌদ্র বাইরে দাঁড়িয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো খানিকটা। তারপর হুট করে পাশে তাকাতেই দেখতে পেলো নার্স এখনো আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্র ভ্রু কুঁচকায়।গম্ভীর গলায় বলে,
“ এখনো দাঁড়িয়ে কোন শুভক্ষণের অপেক্ষায় আছেন আপনি? যাচ্ছেন না কেন?”
নার্স থতমত খেলেন কিছুটা। যাহ বাব্বা! সে-তো একটা বিষয় জানতেই দাঁড়িয়ে ছিলো এভাবে। নার্স আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন,
“ ইয়ে..মানে স্যার! এই পেশেন্টের পর্যবেক্ষণে তো আপনি ছিলেন… ”
নার্সের কথাটা সম্পূর্ণ হবার আগেই রৌদ্র খেঁকিয়ে ওঠে। কর্কশ গলায় বলে,
“ তা দিয়ে আপনার কি কাজ? আপনার কাজ শুধু আমি যা বলবো তাই শোনা, আমায় প্রশ্ন করা নয়!সো গো এহেড!”
নার্স তৎক্ষনাৎ মাথা ঝাকিয়ে কেটে পড়লেন সেখান থেকে। রৌদ্র দাঁত কিড়মিড় করে দাঁড়িয়ে রইলো নিজ জায়গায়। তারপর পকেট থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে কল দিলো তায়েফ সাহেবের নাম্বারে। ওপাশে একবার রিং হতেই কলটা রিসিভ করলেন তায়েফ সাহেব। রৌদ্র বললো,
— “ আসসালামু আলাইকুম! কোথায় তুমি?”
— বউমনির কেবিনে! কেনো, কিছু দরকার?”
রৌদ্র কপাল বরাবর আঙুল ঘষলো একটু।তারপর দৃঢ় কন্ঠে বললো,
— “আব্বুর জ্ঞান ফিরেছে। আম্মুকে নিয়ে উপরে এসো।”
ওপাশে তায়েফ সাহেব অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ফের জিজ্ঞেস করলেন,
— “সত্যি?”
রৌদ্র ছোটো করে উত্তর দিলো — হুম!
তায়েফ সাহেব তৎনগদ ফোন কেটে দিয়ে জুবাইদা বেগমের পানে তাকালেন। লোকটার চোখের কার্নিশে ইতোমধ্যেই জল এসে ভিড় জমিয়েছে। তিনি জুবাইদা বেগমের হাতদুটো আলতো করে চেপে ধরে দাঁড় করালেন। জুবাইদা বেগম সন্দিহান গলায় বললেন,
“ কি হয়েছে?”
তায়েফ সাহেব একমুহূর্ত থেমে কোনমতে নিজেকে সামলালেন।পরক্ষণেই উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে ওঠেন,
“ ভাইজানের জ্ঞান ফিরেছে। রোদ যেতে বলেছে।”
এহেন কথা কর্নকুহরে পৌছানো মাত্রই জুবাইদা বেগম খানিকটা নড়েচড়ে গেলেন। দূর্বল শরীরটা আর দাঁড় করিয়ে রাখতে না পেরে বসে পড়লেন বিছানায়। ধরে আসা কন্ঠে থেমে থেমে বললেন,
“ কোন মুখে মানুষটার সামনে যাবো ভাই? মানুষটাকে যে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি! আমি….আমি ওর সামনে যাবো না ভাই! আমি দরকার হয় দূর থেকেই ওকে দেখে নিবো।তুমি যাও…”
অগত্যা এমন কথায় চুপ করে গেলেন তায়েফ সাহেব।এ মুহুর্তে বউমনির কথার পিঠে বলার মতো উপযুক্ত কথা না পেয়ে তিনি মাথা নিচু রেখেই বেরিয়ে আসলেন কেবিন থেকে।তারপর জোর কদমে হাঁটা ধরলেন সাব্বির সাহেবের রুমের দিকে।
সাব্বির সাহেব মাত্রই মেয়ের সঙ্গে দেখা করে বাইরে এলেন। এরইমধ্যে দূর থেকে তায়েফ সাহেবকে ওমন ছুটে আসতে দেখে চিন্তিত হলেন বেশ খানিকটা।তায়েফ সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে তার সামনে এসে দাঁড়ালেন।মানুষটা দুঁ-হাটুতে হাত ঠেকিয়ে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন।সাব্বির সাহেব তায়েফের এমতাবস্থা ভড়কালেন। চিন্তিত গলায় বললেন,
“ হঠাৎ করে এভাবে ছুটে যাচ্ছিস কোথায়? কোনো সমস্যা?”
তায়েফ সাহেব সময় নিয়ে সটান হয়ে দাঁড়ালেন।মেজো ভাইয়ের হাতের কব্জি চেপে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললেন,
“ মেজো ভাইজান! বড় ভাইজানের জ্ঞান ফিরেছে!”
সাব্বির সাহেব থমকালেন। খানিকটা ঢোক গিলে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
“ চল! তারাতাড়ি!”
সাব্বির সাহেব এবং তায়েফ সাহেব দ্রুত কদমে ছুটে এলেন আইসিইউর সামনে। তারা এসেই রৌদ্রকে এমন বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরের দিকে উঁকি মেরে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলেন।তারা দুজনেই অবাক চোখে একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন একবার। পরক্ষণেই সাব্বির সাহেব বললেন,
“ তুই বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো? ভেতরে যাবি না? ”
এমন কথায় রৌদ্র ঘাড় বাকিয়ে তাকায় সাব্বির সাহেবের দিকে। ছেলেটার চোখদুটো কেমন লাল হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। হয়তো এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেঁদেছে নিঃশব্দে। মুখটারও কেমন ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা! অথচ পুরো হসপিটালেই এসির সু-ব্যাবস্থা রয়েছে। সাব্বির সাহেব ছেলেটার চোখমুখের এহেন দূরাবস্থা দেখে ব্যাথিত হলেন। তিনি রৌদ্রের দিকে এগিয়ে এলেন দু-কদম।ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে আলতো করে বললেন,
“ কাঁদছিস কেনো? ভাইজানের তো জ্ঞান ফিরেছে!”
রৌদ্র নিজের কাঁদো কাঁদো মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলে। ভাব এমন — এই বুঝি ছেলেটা বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠবে।কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে না হওয়ায় হয়তো কান্নাগুলো গিলে ফেলতে হচ্ছে তার। সাব্বির সাহেব হয়তো বুঝলেন ছেলেটার মনের অবস্থা। তিনি আলগোছে ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,
“ ভেতরে আয় বাবা!”
রৌদ্র মাথা নিচু রেখেই মাথা নাড়িয়ে না জানায়।কিয়তক্ষন বাদে মোটা হয়ে আসা কন্ঠে বলে—
“ আজকে আমার জন্যই আব্বুর এই হাল মেজো আব্বু! সবটার জন্য প্রতক্ষ্য কিংবা পরোক্ষভাবে আমি-ই দায়ী। তাই আমি চাচ্ছিনা ভেতরে যেতে।খোদা না করুক, আমায় দেখে যদি আব্বু আবারও চিন্তিত হয়ে পড়েন তখন? যদি আবারও হাইপার টেনসড হয়ে পড়েন তাহলে আব্বুর জন্য তো খুব ভয়াবহ একটা ব্যাপার হয়ে যাবে!তাই তোমরা যাও।আর হ্যা….বিগত প্রসঙ্গ নিয়ে কোনো ধরনের কথা যেন নাহয়।খেয়াল রেখো!”
সাব্বির সাহেব ছলছল চোখে মাথা নাড়ায়। কিছুক্ষণ রৌদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে পরক্ষণেই ভেতরে চলে যায় ভাইকে দেখতে।আর রৌদ্র! সে বাইরে দাঁড়িয়ে একমনে দেখে যাচ্ছে নিজের বাবাকে।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আইসিইউ কেবিনের মাঝামাঝিতে রাখা হয়েছে একটি বেড।যেথায় নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছেন কবির সাহেব।মানুষটার কোমর অবধি সাদা চাদরে ঢেকে রাখা। নাকের নিচে অক্সিজেন নল লাগানো। হাতের ওপর বসানো আছে ক্যানোলা।কবির সাহেবের সম্পূর্ণ বুকজুড়ে ইসিজি মেশিনের তার লাগানো। বেডের পাশে রাখা মনিটরে স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে তার হৃৎস্পন্দনের উঠানামার ঢেউ।তার পাশের স্ট্যান্ডেই ঝুলছে ঔষধ আর স্যালাইনের বোতল।যেখান থেকে একটু একটু করে শরীরে যাচ্ছে তার। রুমটির চারপাশে নিরবতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে একপ্রকার। তবে মাঝেমধ্যে যন্ত্রপাতির বিপ,বিপ শব্দগুলো কানে আসছে তাদের। একজন নার্স এগিয়ে এসে কবির সাহেবের পালস রেট চেক করছে।অন্যজন রক্তচাপ চেক করছেন।তাদের থেকে খানিকটা দুরত্বে দাঁড়িয়ে ডিউটি ডক্টর কিছু একটা নোট করে যাচ্ছেন। সাব্বির সাহেব ভাইয়ের এহেন করুণ অবস্থা দেখে ভেঙে পড়লেন যেন।তিনি টলমল পায়ে খানিকটা পেছাতেই তায়েফ সাহেব তাকে একহাতে আগলে নিলো।সাব্বির সাহেবের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
“ দয়া করে নিজেকে সামলাও মেজো ভাই! তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে বড় ভাইজানও ভেঙে পড়বেন। একটু বোঝো প্লিজ!”
সাব্বির সাহেব ফোঁস করে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন ভাইয়ের বেডের পাশে।তারপর সেখানে থাকা টুলটায় নিঃশব্দে বসে ভাইয়ের ক্যানোলা লাগানো হাতটা আলতো করে নিজের হাতের মাঝে নিলেন। হঠাৎ হাতের মাঝে এহেন স্পর্শ পেয়ে কবির সাহেব চোখ মেলে তাকালেন।প্রথম দিকে চোখ মেলতেই সবটা কেমন ঘোলাটে লাগলো তার কাছে।পরক্ষণেই তার চোখের সামনে সাব্বির সাহেবের মুখটা স্পষ্ট হলো।কবির সাহেব কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সাব্বির সাহেবের দিকে। পাশ থেকে মনিটরিং ডক্টর আলতো করে জিজ্ঞেস করলেেন,
“ ওনাকে কি চিনতে পারছেন আপনি?”
কবির সাহেব মৃদু হাসলেন যেন।চোখের পাতা দুবার নাড়িয়ে বহুকষ্টে দূর্বল কন্ঠে বললেন,
“ আ-মা-র সা-ব্বি-র!”
সাব্বির সাহেব ভেজা চোখে হাসলেন। শার্টের হাতায় চোখদুটো মুছে নিলেন আলগোছে। মনিটরিং ডক্টর আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
“ ঐযে…ওনাকে দেখতে পাচ্ছেন? কে ওনি?”
কবির সাহেব চোখ তুললেন তায়েফ সাহেবের দিকে। এবারেও আলতো হাসলেন তিনি। দূর্বল গলায় বললেন,
“ তা-য়ে-ফ!”
তায়েফ সাহেব ছলছল চোখজোড়া নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।ডক্টর এবার খানিকটা নড়েচড়ে দাঁড়ালেন।বললেন,
“ আপনার কি মনে হচ্ছে — আপনার কোনো অঙ্গ রেসপন্স করছে না? আই মিন, আপনার কোনো অঙ্গ আসাড় লাগছে কি?”
“ নাহ!”
“ ঠিক আছে। আপনি তাহলে ওনাদের সাথে কথা বলুন।আর হ্যা…আপনারা শুধু দু’মিনিট কথা বলতে পারবেন। এরপর রোগী রেস্ট নিবে।”
কথাগুলো বলেই তিনি চলে গেলেন ICU থেকে।এদিকে, সাব্বির সাহেব আর তায়েফ সাহেব ভাইয়ের দিকে তাকালেন। সাব্বির সাহেব ধরে আসা গলায় বললেন,
“ শরীরটা এখন কেমন লাগছে ভাইজান?”
কবির সাহেব চোখে হাসলেন একটুখানি। তায়েফ সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন সেই হাসি।আশ্চর্য! মানুষটা এতোটা অসুস্থ থাকার পরও কি সুন্দর করে হেসেখেলে কথা বলছেন তাদের সঙ্গে!কিছুক্ষণ পর কবির সাহেব এবার ধীরে ধীরে বললেন,
“ তোরা কেমন আছিস?”
“ ভিষণ ভালো আছি ভাইজান।তুমি তারাতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও,তাহলে আরও ভালো হয়ে যাবো দেখে নিও।”
কবির সাহেব ভাইয়ের কথা শুনে মুচকি হাসলেন।ভাইদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন একটু-আধটু করে।
“ স্যার!রাত তো হয়ে গেছে। পেশেন্টকে কি রাতের খাবারটা দিয়ে দেবো?”
রৌদ্র এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে আছে।হাতে তার বাবার সামারি ফাইল।সবটাই আল্লাহর রহমতে ঠিকঠাক আছে এপর্যন্ত। তক্ষুনি পাশ থেকে ভেসে আসা নার্সের কন্ঠে সেদিকে ফিরলো রৌদ্র। নার্সের হাত থেকে কাগজ-কলম নিয়ে কিছু একটা লিখলো দ্রুত হাতে।তারপর সেটা এগিয়ে দিলো নার্সের দিকে। নার্স কাগজটা হাতে নিয়ে পড়লো একবার।খাবারের মেন্যাু সাধারণত নার্সদের জানাই থাকে, তবুও রৌদ্র হয়তো রিস্ক নিতে চায়নি।সে নিজে থেকে লিখে দিলো মেন্যাুটা।মেন্যাুতে রেখেছে —
১/পাতলা স্যুপ।
২/সামান্য মাছ সেদ্ধ।
৩/ একটা ডিমের সাদা অংশ।
নার্স মেন্যাুটা নিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। রৌদ্র বাইরে দাঁড়িয়ে আবারও বাবার ঘরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
কবির সাহেব কথাবার্তার একপর্যায়ে ধীমী স্বরে বললেন,
“ রোদ কই?”
সাব্বির সাহেব সামান্য ঢোক গিললেন এহেন কথায়। তিনি আড়চোখে একবার পাশে থাকা তায়েফ সাহেবের দিকে তাকালেন। পরক্ষণেই কিছুটা সময় নিয়ে মুখে কপট হাসির রেশ টেনে বললেন,
“ হয়তো নিজের কেবিনে আছে ভাইজান!”
“ওহ!”
সাব্বির সাহেব এবার বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কবির সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে বলে,
“ তুমি এখন রেস্ট নাও ভাইজান। আমরা আসছি।”
বলেই তারা এগোতে লাগলেন সামনের দিকে। তক্ষুনি পেছন থেকে কবির সাহেব কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠেন,
“ ওকে ভেতরে পাঠা!”
তায়েফ সাহেব আর সাব্বির সাহেব থমকালেন। তারা আলগোছে পেছনে ফিরলেন।তায়েফ সাহেব কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“ কাকে ভাইজান?”
কবির সাহেব ফের চোখে হাসলেন। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলেন,
“ রোদকে।”
সাব্বির সাহেব এবং তায়েফ সাহেব উচ্ছ্বসিত মুখে বেরিয়ে আসলেন কেবিন থেকে। রৌদ্রকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই তায়েফ সাহেব আপ্লুত কন্ঠে বললেন,
“ ভাইজান তোকে ডাকছে!তারাতাড়ি ভেতরে যা!”
রৌদ্র চমকে ওঠে এহেন কথায়। এমন একটা কথা যে সে মোটেও ভাবেনি এ মুহুর্তে। সাব্বির সাহেব ছেলেটার চমকিত দৃষ্টি দেখে হাসলেন একটুখানি। আশ্বাস দেওয়ার সুরে বলতে লাগলেন,
“ ভেতরে যা বাবা! কথা বল ভাইজানের সঙ্গে।”
রৌদ্র কিছুক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। হয়তো মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করছে ভেতরে যেতে। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে সে দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলে কাঁপা কাঁপা বদনে ভেতরে ঢুকলো।রৌদ্র কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঢোক গিললো কয়েকটা। কি একটা অবস্থা! বাবার থেকে তার দুরত্বটা যে খুব একটা বেশি নয় তবুও কেনো তার মনে হচ্ছে — দুরত্বটা খুব বেশি। আচ্ছা! এই দুরত্বটা তো অবস্থানের নয়,এই দুরত্ব হয়তো মনের দিক দিয়ে। রৌদ্র নিজেকে শক্ত করে সামনে এগিয়ে আসে। কবির সাহেব কিভাবে যেন টের পেয়ে গেলেন ছেলের উপস্থিতি। তিনি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন ছেলের দিকে। রৌদ্রের বুকটা বুঝি তৎক্ষনাৎ কেঁপে ওঠে খানিকটা। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কোনমতে বলে,
“ এখন কেমন লাগছে তোমার?”
কবির সাহেব কিছু না বলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। কিয়তক্ষন বাদেই তার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা নোনাধরা। রৌদ্র হকচকিয়ে ওঠে বাবার চোখে অশ্রু দেখে। সে দ্রুত হাতে নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে বাবার চোখদুটো মুছে দিলো।মোটা হয়ে আসা কন্ঠে বললো —
“ কাঁদছো কেনো তুমি? তোমার কি কষ্ট হচ্ছে কোথাও?”
কবির সাহেব এবারেও নির্বাক হয়ে আছেন।রৌদ্র ফোঁস করে খানিকটা নিশ্বাস ফেললো। বেডের পাশের টুলটা হাতে নিয়ে বাবার পায়ের কাছে এসে বসলো নিঃশব্দে। তারপর পুরো রুমজুড়ে চললো কিছুটা নিরবতা। কিয়তক্ষন বাদে রৌদ্র নিজের নিচু করে রাখা মাথা উঁচিয়ে তুললো।বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলো ভেজা চোখে। তারপর আলতো করে বাবার পাদু’টোর ওপর নিজের কপাল ঠেকিয়ে ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ আমার সব আয়ু তোমার হোক আব্বু! তোমার যত দুঃখ,কষ্ট আছে সব আমার ভাগ্যে লেখা হোক। আমি…আমি সত্যিই অবুঝ আব্বু। আমি এখনো বুঝতে পারিনি তোমার মূল্য!আব্বু! আমায় কি একটু ক্ষমা করতে পারবে আব্বু? বেশি না একটুখানি! কথা দিচ্ছি — দ্বিতীয়বার আর কোনোদিন কোনো ভুল করবো না আমি।আমায় শুধু একটুখানি ক্ষমা করে দাও।”
ছেলেটার কথাগুলো যদি ওজন করা যেতো,তাহলে বোধহয় এ মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি জিনিস এই কথাগুলোই হতো।কবির সাহেব নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ সময় পেরোতেই রৌদ্র মাথা ওঠায়।বাবার পায়ের কাছ থেকে উঠে আসে বাবার সামনে। হাতের রুমালটা দিয়ে আবারও বাবার সিক্ত চোখদুটো মুছে দিয়ে বললো,
“ বাবারা না-কি কাঁদে না আব্বু! তাহলে তুমি কেনো কাঁদছো আজকে?”
কবির সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন সিক্ত নয়নে।কিছু একটা বলার জন্য হয়তো মুখিয়ে আছেন তিনি।কিন্তু গলাটা ধরে আসায় আর কথাগুলো বলতে পারছেন না মানুষটা। ঠিক এমন সময় নার্স হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকেন।ট্রে টা ধীরসুস্থে টেবিলের ওপর রাখলেন।তারপর কবির সাহেবকে খাবার খাইয়ে দিতে প্রস্তুত হতে নিলেই বাঁধ সাধলো রৌদ্র। নার্স জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র কোনরূপ ভনিতা ছাড়াই বললো,
“ আপনি যান।আমি খাইয়ে দিচ্ছি। ”
নার্স আর কিছু না বলে চলে গেলেন কেবিন থেকে। নার্স চলে যেতেই রৌদ্র এগিয়ে যায় কেবিন সংলগ্ন ওয়াশরুমে।মিনিট পাঁচেক বাদে বেরিয়ে আসে ফ্রেশ হয়ে। তারপর বাবার বেডের পেছনের আধুনিক সুইচটা টিপে দিয়ে বেডটা ৩০°-৪৫° কোণে রাখলো।কবির সাহেব বেডে আধশোয়া হয়ে বসে রইলেন।রৌদ্র খানিকটা এগিয়ে এসে বাবাকে ঠিক মতো বসিয়ে দিলো। তারপর বেডে বসে খাবারের ট্রে টা হাতে নিয়ে বসলো সে।কিয়তক্ষন বাদে স্যুপের বাটি থেকে এক চামচ স্যুপ উঠিয়ে বাবার মুখের সামনে ধরলো রৌদ্র। কবির সাহেব ভেজা চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রৌদ্র মৃদু হেসে বলে ওঠে,
“ খেয়ে নাও।আমায় বকার জন্য হলেও তোমার সুস্থ হওয়া প্রয়োজন!”
কবির সাহেব খানিকটা ভ্রু কুঁচকান এহেন কথায়। ছেলেটা যে তাকিয়ে বাজাতে চাইছে তা আর বুঝতে বাকি নেই তার! কবির সাহেব ধীরে ধীরে হা করলেন। স্যুপটা মুখে নিয়ে গিলে ফেললেন। রৌদ্র সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ খেতে কষ্ট হচ্ছে?”
কবির সাহেব ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। রৌদ্র ১-২ মিনিট অপেক্ষা করে আবারও খাবার উঠিয়ে দেয় বাবার মুখের সামনে।
খাবার শেষ হতেই রৌদ্র প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষধ দিয়ে দিলো বাবাকে।কবির সাহেব চোখমুখ কুঁচকে ফেলেন ঔষধ দেখে। রৌদ্র তখন গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“ চোখমুখ কুঁচকে লাভ নেই, খেতে তো হবেই।”
অগত্যা এমন কথার পিঠে কবির সাহেবের আর কি’বা বলার থাকে।তিনি চোখ কুঁচকে রেখেই ঔষধগুলো গিলে নিলো কোনরকমে। রৌদ্র হাসলো বাবার অলক্ষ্যে।পরক্ষণেই সে বাবাকে বেডে ঠিকমতো শুইয়ে দিয়ে বলে,
“ টেক রেস্ট! আমি আবারও আসবো।”
বলেই সে চলে যেতে উদ্যত হতেই কবির সাহেব বলে ওঠেন,
“ তুমি খেয়েছো?”
হঠাৎ করেই রৌদ্রের পাদু’টো থমকে দাঁড়ায়।সে বাবার দিকে সহাস্যে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“ তুমি খেয়েছো না? এবার আমিও খাবো। আর চিন্তা করোনা।আমি নিজের খেয়াল ঠিকমতই রাখছি।কেননা আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে,তোমায় সুস্থ করবে কে শুনি?”
কবির সাহেব এবার কেমন মুখ টিপে হাসলেন। তবুও গলায় গাম্ভীর্যের ছাপ ফুটিয়ে বলেন,
“ ঠিক আছে। যাও!”
রৌদ্র একহাতে এপ্রন আর অন্যহাতে স্ট্যাথোস্কোপটা নিয়ে হসপিটালের বাইরে বেরিয়ে আসে। এখন বাসায় যেতে হবে তার।শরীরে খানিকটা বিশ্রাম না দিলে, কোনো কাজই হয়তো ঠিকমতো হবে না তার। বলাবাহুল্য, জুবাইদা বেগম, সাব্বির সাহেবের সঙ্গে বহু আগেই চলে গিয়েছে। হসপিটালে আপাতত তায়েফ সাহেব রয়েছেন। তিনিও চলে আসবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই।রৌদ্র গাড়িতে এসে বসতেই অরিন আর অনিক এসে উপস্থিত হয় সেখানে। অরিনকে ডিসচার্জ করা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।মূলত রৌদ্রই ডিসচার্জ করিয়েছে। অনিক রৌদ্রকে গাড়িতে দেখেই বলে ওঠে,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫২
“ ভাইয়া! আমরা আসি তোমার সঙ্গে?”
রৌদ্র অনিকের দিকে না তাকিয়েই গাড়ি স্টার্ট দিলো।জোর গলায় বললো,
“ নাহ! অন্য গাড়ি দিয়ে যা!”
বলেই সে আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না সেদিকে। চলে গেলে গাড়ির পেছনের ধূলো উড়িয়ে। আর পেছনে পড়ে হতবিহ্বল অরিন আর অনিক!