সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬
Jannatul Firdaus Mithila
“কই গো? বলি ও শশীর মা! তাড়াতাড়ি বাইর হইয়া দেহো, বাপজানেরা তো আইয়া পড়ছে”
বৃদ্ধ আবুল চাচার একের পর এক হাক ছোড়ায় নিচতলার রসুইঘর থেকে শাড়ির আচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসেন তার গিন্নি আমেনা বেগম। বিরক্তমাখা কন্ঠে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
” বলি এ বয়সেও গলায় এতো জোর আসে কই থেকে তোমার? উনুনে রান্না চাপানো, তারওপর তোমার এই হাঁক ছেড়ে ডাকা। বলি এরম করলে মানুষগুলো এসে খাবে কি হ্যা?”
আবুল চাচা স্ত্রীর এমন ঝাঁঝালো কথাতেও মুচকি হাসলেন। বৃদ্ধ স্ত্রীর কুচকানো হাতটি ধরে টেনে নিয়ে গেলেন সদর কক্ষে। এদিকে স্বামীর এমন টানাটানিতে বৃদ্ধা আরও কিছু বলতে যাবেন তার আগেই তার চোখ পড়লো সদর কক্ষে বসে থাকা মানুষজনের ওপর। মুহুর্তেই আমেনা বেগমের চোখ দুটি ছলছল হয়ে ওঠে। তিনি ধীর কদমে এগিয়ে আসেন কবির সাহেবের কাছে। কবির সাহেব বৃদ্ধাকে দেখে সালাম করলেন। মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই বৃদ্ধা বলতে শুরু করলেন,
” বাপজান! অবশেষে তুমি আইলা। আমিতো ভাবছিলাম তোমারে শেষবারের মতো দেহারও সুযোগ হইবো না আমার। ”
বলেই শাড়ির আচলে চোখ মুছলেন তিনি। কবির সাহেব বৃদ্ধার মাথায় হাত রাখলেন। নরম সুরে বললেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
” মাফ করে দিও চাচি! আসলে নিজেদের সবটা সামলিয়ে এখানে আসার সময় হয়ে ওঠে না তেমন, তাই আরকি….”
থামলেন তিনি। হয়তো কথা ফুরিয়ে এসেছে তার। কবির সাহেব ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
” এই তোমরা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। অনেক বড় জার্নি করে এসেছো, নিশ্চয়ই ক্লান্ত সকলে।”
সবাই হয়তো এ কথাটারই অপেক্ষায় ছিলো। কবির সাহেবের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সবাই নিজেদের ব্যাগ-পত্র নিয়ে এগিয়ে যায় দোতলা এবং নিচতলার রুমের দিকে। এহসান বাড়ির চার ভাই নিচতলার চার রুমে নিজেদের জায়গা করে নেয়। এখন বাকি রইলো বাড়ির ছেলে-মেয়েরা।
আবুল চাচা এগিয়ে এলেন। রৌদ্রদের সামনে দাড়িয়ে বাড়ির ভেতরে আবারও হাঁক ছুড়লেন,
” শশী? ও শশী! একটুখানি এদিক আয় তো মা!”
মেয়েকে ডেকে তার জন্য অপেক্ষা করলেন আবুল চাচা। এরইমধ্যে রৌদ্রদের উদ্দেশ্যে বললেন,
” আফনেরা একটু দাড়ান। আমার মাইয়া আইয়া আফনেগো যার যার কামরা দেহায় দিবো। সবটা আমরা আগেরতেই গোছ-গাছ কইরা রাখছি।আসলে আমার আবার হাটুর গিরায় বেদনা আছে। এল্লেগা সিড়ি বাইতে কষ্ট হয়।”
রৌদ্র মুখ খুললো। ভদ্রতার সাথে বললো,
” আরে না, না সমস্যা নেই। আপনার যেতে হবে না।আমরা নাহয় অপেক্ষা করছি, আপনার মেয়ে এলেই যাবো”
বৃদ্ধ কৃতজ্ঞ হাসলেন। ঘাড় বাকিয়ে আবারও ভেতর ঘরের দিকে তাকালেন। নাহ! মেয়েটাকে নিয়ে আর পারেন না তিনি। শুধু একটু সময় পাক, ওমনি বসে পড়ে সাজগোজ নিয়ে। আবুল মিয়া মাঝেমধ্যে ভিষণ খিটখিটে হয়ে পড়েন এ নিয়ে।মনে মনে ভেবেই ফেলেন —- মাইয়াডা তার এত্তো সাজে কেমনে?
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর আলতা রাঙা পায়ে, নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ তুলে কেও একজন উপস্থিত হলো সদর কক্ষে। মেয়েটার গায়ে জড়ানো বাঙালি ধরনে লাল পাড়ের সাদা শাড়িটা কেমন চকচক করছে। মনে হচ্ছে, সবেমাত্রই হয়তো নতুন ভাজ ভেঙেছে কাপড়টার। লম্বা, ঘন চুলগুলো দুপাশে দুটো বিনুনি গেথে লাল ফিতায় বাধা। শ্যামকন্যার আখিদ্বয়ে মোটা করে কাজল দেওয়া, ঠোঁটে শোভা পাচ্ছে টকটকে লাল রঙের লিপস্টিক। সদর কক্ষে উপস্থিত সকলে একযোগে তাকালো মেয়েটার দিকে। সকলের ওমন দৃষ্টি নিজের ওপর নিবদ্ধ হতে দেখে ভড়কায় শশী। আঙুল দিয়ে মাথা চুলকে বলে,
” ইয়ে, কি হইছে? আফনেরা এমনে তাকায় আছেন।আমারে কি খুব খারাপ লাগতাছে দেখতে?
আবুল মিয়া খানিকটা ফুঁসে ওঠেন মেয়ের কান্ডে। গলায় ঝাঁঝ এনে বললেন,
” তোরে কত্তবার কইছি শশী ওতো সাজগোজ ভালা না। কিন্তু তুই আমার কোন কথা-ই তো পাত্তা দেস না। ”
সহসা হাসি মুখটা থমথমে হয়ে যায় শশীর।মাথানিচু করে দাড়িয়ে রইলো মেয়েটা। বিষয়টা বুঝি অরিন আর রুহির বেশ খারাপ লাগলো, তারা এগিয়ে আসলে শশীর কাছে। মেয়েটার লম্বাটে থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে উপরে তুলে বললো,
” এই মেয়ে! তুমি মন খারাপ করছো কেন? জানো তোমাকে এই মুহুর্তে ঠিক কতোটা সুন্দর লাগছে? কিন্তু তোমার মন খারাপে তো এই সাজটা একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই একটুখানি হাসো দেখি”
শহুরে নতুন মানুষদের মুখে এতো সুন্দর কথা শুনে মুগ্ধ হলো শশী। চিরল দাঁতের হাসিখানা দিয়ে আপ্লুত কন্ঠে বলে ওঠে,
” সত্যি! আমারে সুন্দর লাগতাছে? ”
অরিন মুচকি হাসলো। শশীর গাল টেনে দিয়ে বললো,
” হুম সত্যি, সত্যি! তোমায় খুব সুন্দর লাগছে। ”
এতবার নিজের প্রশংসা শুনে খানিকটা লজ্জা পেলো শশী। শ্যামবরনের মুখটা লাজুক করে বললো,
” আফনেরা খুব ভালা মানুষ। আমার আফনেগো পছন্দ হইছে”
শিশির আর কুহেলি বাদে উপস্থিত সকলেই হেসে ওঠে শশীর কথায়। কুহেলিতো শশীর পানে তাকিয়ে বিরবির করে বলেই ফেললো,
” যত্তসব আদিখ্যেতা!”
শশী কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে জিভ কাটে। মাথায় হালকা চাপড় দিয়ে বলে,
” এইরে! আফনেগোরে কামরা না দেখায়াই এহানে দাড়া করায় রাখছি। চলেন চলেন উপরে চলেন। আফনেগো রুম দেখাই দেই।”
সকলেই সম্মতি জানায় শশীর কথায়। আসলে তারাও যে বড্ড ক্লান্ত। এমুহূর্তে ফ্রেশ হওয়া যে অতীব জরুরি।
সিলেটের সুনামগন্জ জেলার গৌরিপুর( ছদ্ননাম) গ্রামের বেশ সুপরিচিতি এহসান বাড়ির। এহসান বাড়িটি দুভাগে বিভক্ত।বড় একটি উঠোনের মাঝ বরাবর দেয়ালের বর্ডার দেয়া। একপাশে খায়রুল এহসানের বাড়ি অন্যপাশে আব্দুল মান্নান এহসানের বাড়ি। তারা দুজনেই আপন ভাই। কিন্তু কালের বিবর্তনে এ-দু পরিবারের মাঝে তৈরি হয়েছে এক-আকাশসম দুরত্ব।
কবির সাহেব ফ্রেশ হয়ে উঠোনে দাড়িয়ে ছিলেন। কোমরের পেছনে দুহাত বেধে অদূরে থাকা বড় দেয়াল বর্ডারটির দিকে তাকিয়ে রইলেন একমনে।
তখনি আবুল মিয়া সেখানে উপস্থিত হন। কবির সাহেবকে খাবারের জন্য ডাকতে এসেছিলেন তিনি, কিন্তু তাকে এমন অন্যমনস্ক দেখে ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলেন বৃদ্ধ। বলে ওঠেন,
” বাপজান মেহু আইবো না?”
বৃদ্ধ কেয়ার টেকার আবুল চাচার কথায় ভাবনার সুতো ছিড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলেন,
” হুম রাতেই চলে আসবে।”
বৃদ্ধ মাথা নাড়ালেন। খানিকক্ষণ সময় চুপ করে থেকে আমতা আমতা করে বললেন,
” আর ও আইবো না?”
সহসা কবির সাহেবের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো। চোয়াল হয়ে ওঠলো খানিকটা দৃঢ়। গলায় তাচ্ছিল্য এনে বললো,
” এই মনে যাকে বহু আগে থেকেই কবর দিয়ে ফেলেছি তাকে এখন কিভাবে আনি বলোতো?”
বৃদ্ধ আঁতকে ওঠেন এ কথায়। হায় হায় করে বলে ওঠেন,
” ও কথা বইলনা বাপজান! এতে আল্লাহ নারাজ হইবো। ”
কবির সাহেব তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন। আর কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলেন গটগট পায়ে। পেছনে হতবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলেন আবুল মিয়া। মনে তার একটাই কথা, —– এ ভাঙন কি আর কোনদিনি জোড়া লাগবে না?
সুবিশাল ডাইনিং টেবিল জুড়ে হরেকরকম খাবারের বাহার! পুরো বাড়ি খাবারের সুঘ্রাণে মো মো করছে। শশী আর দুটো কাজের মেয়ে ব্যস্ত হাতে টেবিলে এটা-ওটা আনা নেওয়া করছে। একে একে টেবিলে এসে উপস্থিত হন বাড়ির সকলে। আহি-মাহি দুজনেই একই রঙের জামা পড়ে নিচে নেমেছে। তাদের দেখে শশী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিয়তক্ষন। তারপর উৎফুল্ল ভরা কন্ঠে বলে ওঠে,
” আফনেগো দেখলে মনে হয় একজনের সামনে আয়না ধইরা রাখছে কেও।মাশাআল্লাহ কি সুন্দর লাগে আফনেগোরে।”
আহি-মাহি দুজনেই একসঙ্গে হেসে ওঠে। একইসাথে বলে,
” তুমিও খুব সুন্দর শশী”
শশী মুচকি হাসলো। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো অরিনকে। মেয়েটাকে তার বড় পছন্দ হয়েছে। কি সুন্দর নাদুসনুদুস গালদুটো মেয়েটার।হাসলে কেমন গর্ত হয়ে যায় গালে। শশীর একবার বেশ ইচ্ছে করলো, নিজ হাতে অরিনের গালদুটো একটু টেনে দিতে কিন্তু নিজের ওমন উদ্ভট ইচ্ছাকে একপ্রকার ধামাচাপা দিয়ে সে মনোযোগ টানলো নিজের কাজের দিকে।
অরিন এসে বসে পড়ে চেয়ারে। একে একে চোখ বুলায় টেবিলের ওপর রাখা খাবার গুলোর দিকে। তখনি তার নজর আটকে যায় তার প্রিয় মাছের তরকারিতে।অরিনের জিভে মুহুর্তেই পানি চলে আসলো। ঠিক তখনি তার পাশের চেয়ারেই ধপ করে বসে পড়ে একজন।অরিন ভেবেছিলো অনিক হয়তো। তাই সে দৃষ্টি না ঘুরিয়েই বললো,
” ভাইয়া, দেখ! ইলিশ মাছটা কি সুস্বাদু দেখাচ্ছে! আজকে কিন্তু আমি দুটো মাছ খাবো। তুমি আমায় বেছে দিয়ো কেমন?”
পাশ থেকে কোন প্রতিত্তোর না আসায় ভ্রু কুচকায় অরিন। ঘাড় বাকিয়ে পাশে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে যায় মেয়েটা। হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো পাশের চেয়ারে বসা রৌদ্রের পানে। অরিন খেয়াল করলো রৌদ্র কেমন তার দিকে শান্ত অথচ নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরিন তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আমতা আমতা করে বলে,
” ইয়ে, আসলে রোদ ভাই! আমি ভেবেছিলাম ভাইয়া হয়তো, তাই বলে ফেলেছি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”
রৌদ্র কি বুঝলো কে জানে? সে মুচকি হেসে প্লেটে ভাত নিয়ে নিলো। হাত বাড়িয়ে অরিনের পাতেও ভাত তুলে দিলো। অরিন চুপচাপ সবটা দেখে যাচ্ছে নির্বিকার ভঙ্গিতে। রৌদ্র এবার অরিনের পছন্দের মাছটাই তুলে নিলো পাতে। তারপর যত্ন সহকারে মাছের কাটা ছাড়িয়ে তুলে দিতে লাগলো অরিনের পাতে। অরিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের কর্মকান্ডের দিকে। মনে মনে বললো,
” রোদ ভাই! কেন এতো যত্ন করেন আমার? কেন বুঝেন না আপনি, আপনার করা ছোট ছোট যত্নগুলো আমার মনের মনিকোঠায় বেশ শক্তপোক্তভাবে গেড়ে বসে। প্রতিবার আপনার যত্নের টানে আমার বেহায়া মনটা বারংবার অবাধ্য হতে চায়! কি করে আপনার যত্নগুলোকে ভুলব আমি?”
অরিন যখন নিজের ভাবনায় মশগুল তখনি রৌদ্র তাকে চোখ দিয়ে ইশারায় খেতে বলে। অরিনও দৃষ্টি সরিয়ে খেতে শুরু করে। তাদের দুজনের এসব কর্মকান্ডগুলো এতক্ষণ একমনে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলো কুহেলি। কেন যেন এ মুহুর্তে তার অরিনকে বেশ হিংসে হচ্ছে। সে নাক ফুলিয়ে খেতে থাকে আর বারবার আড়চোখে দেখতে থাকে দু’জনকে। অন্যদিকে অরিনের একবারে মুখোমুখি বসেছে অনিক। রৌদ্রকে অরিনের প্রতি যত্নশীল দেখে ছেলেটা মনে মনে বেশ খুশি হলো। ভাবলো, —- যাক অবশেষে সে বাদেও তার বোনটাকে আদরে আগলে রাখার জন্য কেও একজন আছে তবে!
গোধূলির শেষ লগ্নে আকাশটা বরাবরই মোহনীয় সৌন্দর্যে পতিত হয়। দূর আকাশের সাদা,নীল মিশেলের আকাশটা নিজের রুপ পাল্টে কমলা রঙের আভায় নিজেকে সজ্জিত করে। দৃশ্যটা যথেষ্ট মনোমুগ্ধকর! তারওপর পরিবেশটা যদি হয় গ্রামের,তাহলে তো কথাই নেই! গ্রামের সেদে মাটির ঘ্রাণ,বাতাসের সঙ্গে ধেয়ে আসা লাকড়ি চুলার ঘ্রান, আশপাশে পাখির কিচিরমিচির শব্দ সবটাই একজন শহুরে মানুষকে মুগ্ধ করতে যথেষ্ট! দোতলার খোলা করিডরের রেলিঙের পাশে দাড়িয়ে এসবই ভাবছিল অরিন। বাড়ির সম্পূর্ণ উঠোন জুড়ে বিয়ের ডেকোরেশনের কাজ চলমান। হাতে তো সময় একদম নেই বললেই চলে! শুধু শুধু বসে থেকে কি লাভ? তাইতো বাড়ির পুরুষরা মিলে আজকে থেকেই ডেকোরেশনের দিকটা সামলে নিচ্ছে। আর দুদিন পর রুহির মেহেদী অনুষ্ঠান। তারপরের দিন হলুদ সন্ধ্যা। আর তারপর! তারপর মেয়েটার বিয়ে।চলে যাবে মেয়েটা তাদের সবাই কে ছেড়ে। নতুন এক সংসারে, নতুন মানুষদের মাঝে।
অরিনের বুক চিড়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসে। ছোটবেলা থেকেই রুহির সাথে তার সম্পর্কটা বোনের চাইতেও বেশি ছিলো। সবসময় তারা একে-অপরের বন্ধু হিসেবেই থাকতো। কিন্তু অরিনের এই প্রিয় মানুষটা আর কদিন পরই তাদের সবাইকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে। অরিন কিছু একটা ভেবে ফট করে ঘুরে দাড়ালো। তারপর একছুট লাগালো রুহির রুমের দিকে।
রুহি বিছানায় গা এলিয়ে বই পড়ছিলো। তখনি তার খাটের ওপর ধপ করে শব্দ হয়। রুহি হকচকিয়ে ওঠে। হাতে থাকা বইটা ঠাশ করে মুখের ওপর পড়ে যায় বেচারির। রুহি ব্যাথাতুর শব্দ তুলে শোয়া ছেড়ে উঠে বসে। নাকের ডগায় আলতো হাত বুলিয়ে সামনে তাকাতেই অরিনকে দেখতে পায়। মেয়েটা কেমন ঠোঁট কামড়ে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে তার সামনে। রুহি নাকের ওপর থেকে হাত সরিয়ে বললো,
” এভাবে দাড়িয়ে আছিস কেন? কাছে আয়!”
অরিন ধীর পায়ে এগিয়ে আসে রুহির কাছে।এসেই তাকে জড়িয়ে ধরে মিনমিনে স্বরে বললো,
” সরি রুহিপু! আমি বুঝিনি তোমার এভাবে ব্যাথা লেগে যাবে।”
রুহি মেয়েটার বোকা কথায় মুচকি হাসলো। নিজেও আলতো হাতে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“সমস্যা নেই অরি! এটা ওতো বড় কোন ব্যাথা না।আচ্ছা ওসব বাদ দে। তুই হঠাৎ এখানে? কিছু বলবি?”
“বারে! কাল বাদে পরশু বিয়ে হয়ে যাবে তোমার এখন যদি একটু সময় কাটাতে না পারি তাহলে কি আর হবে? ”
রুহি হো হো করে হেসে ওঠে। অরিনের ফোলা গাল দুটো টেনে বলে,
” ওহ! তাই বুঝি? ”
“হুম”
” ভাই! শহুর তে একখান ফুটফুট মাইয়া আইছে। কি যে ভালা দেহাইছে। ইশশ যদি একবার কাছে পাইতাম তারে!”
সুজনের কথায় হাতদুটো থেমে যায় রহমতের। ডেকোরেশনের কাজগুলো বাদ দিয়ে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে চটপট করে নিচে নেমে আসে সে। তারপর ধীমী স্বরে বলে,
” ওই সুজইন্না! খবরদার কইয়া দিলাম, এহানে আইয়া কোন মাইয়ার দিকে খারাপ নজরে তাকাইবি না কইয়া দিলাম। মোডেমাডে কাম পাই না, তার ওপর দিয়া তোর এমন লুইচ্চা লুইচ্চা কাম কারবার! ”
রহমতের এরূপ কথায় বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে ফেলে সুজন। মুখ খুলে দুয়েকটা বিশ্রী গালিও দিতে ভুললো না রহমতকে। তারপর পড়নের লুঙ্গিটাকে দুহাত দিয়ে হাঁটু অবধি উঠিয়ে গিট বেঁধে বলতে লাগলো,
” তুই হালার পো একখান অলুক্ষি। যহনি মুখ খুলোস, তহনি একখান আ-কথা বাইর করস। তুই ব্যাডা এক্কেবারে চুপ থাকবি। যা করার আমি করমু”
হকচকিয়ে ওঠে রহমত। তড়িঘড়ি করে সুজনের হাত ধরে বিচলিত কন্ঠে বললো,
” ঐ সুজইন্না! কি করবি তুই? দেখ তোরে কিন্তু আমি আগেত্তেই সাবধান করতাসি। ”
সুজন রহমতকে একপ্রকার উপেক্ষা করে সেখান থেকে একগজ লাইটিং তার নিয়ে চলে আসে বাড়ির ভেতরে। বাড়ির ভেতরে ঢুকে আশেপাশে আড়চোখে নজর বুলিয়ে খুজতে থাকে কাঙ্খিত মুখখানা কে। কিছুক্ষণ পর পেয়েও যায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে। সুজন লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দোতলায় হাসতে থাকা অরিনের পানে। সে একটি বিশ্রী হাসি দেয়। তারপর হাতে থাকা তারগুলো নিয়ে হেটে যায় দোতলার দিকে।
অরিন, রুহি আর শশী মিলে দোতলায় চেয়ার পেতে আড্ডা দিচ্ছিলো। রুহির কল আসায় সে উঠে চলে যায়। তার মিনিট খানেক পর রান্নাঘর থেকে শশীর ডাক আসায় সেও চলে যায়। বাকি থাকে অরিন। অরিন কি যেন একটা কাজের জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। ঠিক তখনি সেখানে উপস্থিত হয় সুজন। ইচ্ছে করে অরিনের অনেকটা গা ঘেঁষে হেঁটে যায়।অরিন তৎক্ষনাৎ ভড়কে গিয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। খেঁকিয়ে ওঠে বললো,
” এই আপনি এটা কি করলেন? ”
সুজন থামে। ঘাড় ঘুরিয়ে অরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
” কই কি করছি?”
অরিনের মেজাজ খারাপ হয়। সে কটমট করে বললো,
” কি করেছেন মানে? আপনি ইচ্ছে করে আমার গা ঘেঁষে তারপর এখান দিয়ে হেটে গিয়েছেন।”
” আরে না! কি কন আফনে? আমি এইসব কিছুই করি নাই।”
রৌদ্র নিজের রুম থেকে বের হচ্ছিলো কিন্তু করিডরে হঠাৎ অরিনের সাথে সুজনের এমন বাকবিতন্ডায় সহসা থমকে দাঁড়ায় ও। সরু চোখে তাকিয়ে রইলো কিয়তক্ষন। তারপর জোরালো কদমে এগিয়ে আসে অরিনের নিকট।গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করে,
” কি হয়েছে এখানে ”
অরিন একবার রৌদ্রের দিকে তাকালো। তারপর অভিযোগ জানিয়ে বলতে লাগলো পুরো ঘটনা। সবটা শোনার পর রৌদ্র হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।চোয়াল শক্ত করে তাকায় সুজনের দিকে। শক্ত গলায় অরিনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
” রুমে যা অরি!”
” কিন্তু রোদ ভাই! ”
” আই সেড গো! মিনস গো”
এবারের কথটা একটু জোরেই বললো রোদ। অরিন বেচারি এত জোরে কথাটা শুনে খানিকটা কেঁপে ওঠে। মাথানিচু করে সেখান থেকে চলে যায় নিজের রুমে।তার চলে যেতেই রৌদ্র সুজনের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায়। তারপর রাশভারী গলায় বললো,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫
” চল ভাই, তোর পাওনা টা তোকে বুঝিয়ে দেই!”
সুজন কি আর বুঝলো রৌদ্রের কথার মানে? সে কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।হয়তো বুঝতে চেষ্টা করছে মানুষটার কথার গভীরতা!