সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৪
Jannatul Firdaus Mithila
“ বিয়ের আগে একটু-আধটু হলুদ ছোঁয়াবো না তোমায় বেয়াদব ছেলে? সব কি তোমার মুখের কথাতেই হবে না-কি? আরেকটা কথা বাড়ালে একেবারে আগামী বছর বিয়ে করাবো বলে রাখলাম। যত্তসব নির্লজ্জ ছেলেপেলে।”
ঘরভর্তি মানুষজন মুখ টিপে হাসছেন এমন কথায়। রৌদ্র মুখ কুঁচকে অন্যদিকে তাকায়।ছেলেটার মুখ-মন্ডলে স্পষ্ট অসন্তুষ্টির ছাপ।কই সে ভেবেছিলাে কালকেই বিয়ে হবে বেচারার, আর তারপরেই পিচ্চি বউটাকে নির্ভয়ে নিজের কাছে টানবে কিন্তু নাহ…তার এতোশতো আগাম চিন্তা – ভাবনাগুলোর ওপর যেন এক-বালতি জল ঢেলে দিলেন কবির সাহেব। অন্যদিকে আমরিন বেগম হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছেন বড় ভাইয়ের দিকে। কিয়তক্ষন বাদেই হতভম্ব মানুষটা মিনমিনে স্বরে ভাইকে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“ ভাইজান! টোটোন কি আগে থেকেই অরিকে পছন্দ করে?”
এহেন কথায় ঘাড় বাকিয়ে চাইলেন কবির সাহেব। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে গম্ভীর মুখে বললেন,
“ শুধু পছন্দ? বলো একপ্রকার পাগলামি শুরু করেছে দু’জন একে-অপরের জন্য।”
আমরিন বেগম বুঝদারের ন্যায় মাথা নাড়লেন। রৌদ্রের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন কিছুটা। তখনি রাইসা বেগম আর মাইমুনা বেগম সার্ভিং ট্রে হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে সকলকে পায়েস দিতে লাগলেন। তাশরিক সাহেব একবাটি পায়েস হাতে তুলে উল্লাসের সাথে বললেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ এমন একটা মুহুর্তে এই পায়েসটা যা দরকার ছিলো না…যাক, সবাই মিষ্টি মুখ করুন।আমার রোদের বিয়ে বলে কথা!”
বাকিরা মৃদু হাসলেন এরূপ কথায়। শাহানুর সাহেব পায়েস খেতে খেতে একপা একপা করে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন রৌদ্রের সামনে। তারপর নিজের বাটিটা থেকে এক চামচ পায়েস তুলে রৌদ্রের মুখের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে নিচু কন্ঠে বললেন,
“ প্রেমের মরা জলে ডুবে না!!!”
রৌদ্র হেসে দিলো হুট করে। শাহানুর সাহেবও মুখ টিপে হাসছেন ছেলেটার সাথে। রৌদ্র কিছুটা সময় নিয়ে হাসি থামালো। পরক্ষণেই শাহানুরের হাত থেকে পায়েসটা মুখে তুলে নিলো আলগোছে। তারপর বললো,
“ রক্ত বলে কথা! বড়রা যেভাবে যাবে,ছোটরাও তো সেভাবেই যাবে তাই-না?”
এহেন বাক্যে শব্দ করে হাসতে লাগলেন শাহানুর। তিনি হাত বাড়িয়ে রৌদ্রের কাঁধ চাপড়ে বাহবা দিয়ে বললেন,
“ দেটস লাইক এহসান’স বয়!”
রৌদ্র কাঁধ উঁচিয়ে তুললো খানিকটা। হাত দিয়ে নিজের কপালের উপর পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলোকে খানিক গুছিয়ে নিয়ে বেশ ভাবের সাথে বললো,
“ ইনডিড! হাহ!”
শাহানুর সাহেব সম্মতিতে মাথা ঝাকালেন। অন্যদিকে,
তায়েফ সাহেব হাতে পায়েসের বাটি নিয়ে তাশরিক সাহেবের পাশে এসে বসলেন। তারপর হুট করেই কোনরুপ বলা-কওয়া ছাড়াই তাশরিক সাহেবের বাটি থেকে নিশব্দে এক-চামচ পায়েস তুলে মুখে পুরে নিলেন। তাশরিক সাহেব অন্যদিকে তাকিয়ে মেহনুর বেগমের সাথে কথা বলছিলেন। এ-ই ফাঁকেই তায়েফ সাহেব করে বসলেন কান্ডটা। ঘটনাটা তাশরিক সাহেব টের না পেলেও মেহনুর বেগম সরু চোখে দেখেছেন সবটা। তিনি তখন হুট করেই তাশরিক সাহেবকে খানিক জোর গলায় বলে ওঠেন,
“ তশু ভাই। তোমার বাটি থেকে সেজো ভাই পায়েস তুলে খেয়েছে। এখন তোমার ভাগে কম পড়ে গেলো না?”
কথাটা শোনামাত্রই তড়াক করে পাশে ফিরলেন তাশরিক সাহেব। তায়েফ সাহেব কাচুমাচু করে খালি চামচটা মুখে নিয়ে বসে আছেন। এবার কি বলবেন তিনি? মেহনুরকে চোখ দিয়ে বেশ-ক’বার সর্তক করলেও মেয়েটা যেন কোনো বারণই শুনলোনা তার। আর কেনই বা শুনবে? মেহুটা যে তার তশু ভাইয়ের বিরাট ভক্ত! একথা এটুকু পায়েসের লোভে পড়ে কিভাবে ভুলে গেলেন তিনি? কিয়তক্ষন বাদেই তাশরিক সাহেব চোখদুটো কেমন সরু করে নিয়ে ঠেস মেরে বললেন,
“ কিগো সেজো ভাই? এই বয়সে এসে এসব কি করছো তুমি? কই তুমি ছোট-ভাই বোনদের আরও নিজ থেকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে দিবে কিন্তু তা না করে তুমি কি-না আমাদের থেকেই লুকিয়ে -চুরিয়ে খাচ্ছো? উঁহু! আমি এই অনাচার মানবোনা। দাও.. ফেরত দাও আমার পায়েস।”
এপর্যায়ে তায়েফ সাহেব খানিক ঢোক গিললেন। মুখ থেকে খালি চামচ বের করে এনে, তাশরিক সাহেবকে দেখিয়ে কেমন অপরাধী সুরে বললেন,
“ ঐটা তো পেটে চালান হয়ে গেছে তশু।”
তাশরিক সাহেব ভ্রু কুঁচকায়। আড়চোখে তাকায় তায়েফ সাহেবের বাটিতে। তা দেখে তায়েফ সাহেব তড়িঘড়ি করে নিজের হাতের বাটিটা সরিয়ে নিলেন অন্যপাশে। গম্ভীর মুখে বললেন,
“ এই তুই ঐদিকে তাকা।আমার বাটিতে নজর দিবিনা খবরদার।”
এবার যেন তেতে উঠলেন তাশরিক সাহেব। তিনি নিজের হাতের বাটিটা মেহনুরের হাতে দিয়ে তায়েফ সাহেবের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
“ আমারটা খাওয়ার সময় মনে ছিলোনা তোমার? এখন তোমারটাও খেয়ে ফেলবো আমি।তাহলেই শোধবোধ। দাও এদিকে দাও।”
এদের দু’জনার এহেন কান্ড দেখে উপস্থিত সকলেই হাসছেন একমনে। কবির সাহেব শান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন নিজের ভাই-বোনদের দিকে। এভাবেই তো পুরো পরিবারটাকে আগলে রাখার কথা দিয়েছিলো সে,তার মৃত্যু পথযাত্রী মা’কে। কবির সাহেবের চোখদুটো আপনা-আপনি ভিজে উঠেছে খানিকটা। অদূরে দাঁড়িয়ে সবটাই আড়চোখে পরোখ করলো রৌদ্র। সে তৎক্ষনাৎ কেমন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কিছুটা গলা উঁচিয়ে আহত সুরে বলতে লাগলো,
“ আহা! কই ভাবলাম কালকেই বিয়েটা করতে পারবো কিন্তু নাহ! চার আঙুলের কপালে আমার ওতো সুখ কি আর সয়? ধূর…!”
ছেলের মুখে ওমন কথা শুনে মুহুর্তেই ইমোশনাল ভাবটা কেটে গিয়ে রণমূর্তী ভাব এসে ছেয়ে গেলো কবির সাহেবের মুখ জুড়ে। তিনি তড়িৎ শক্ত চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। বাকিরাও এখন চুপ করে গেলেন রৌদ্রের এমন বাক্যে। মুহুর্ত ব্যায়েই কবির সাহেব কেমন কর্কশ গলায় বলে ওঠেন,
“ মুখে লাগাম টানো নির্লজ্জ ছেলে। এইটুকু বয়সে এতোটা বিয়ে পাগল ছেলেপেলে হয়তো এই জীবনে আজ প্রথম দেখলাম আমি!”
বাবার কথা শেষ হবার পরমুহূর্তেই রৌদ্র কেমন অবুঝের মতো বলতে লাগলো,
“ এইটুকু বয়স কই আব্বু? গুণে গুণে ৩০ শেষ হতে চললো আমার। বিয়ের বয়সতো সে-ই কবেই হয়ে গিয়েছে। তুমিই তো এতদিন সদয় ছিলেনা আমার ওপর। নইলে এতদিনে হালি-হালি ল্যাদা-গ্যাদার বাপ হয়ে যেতাম আমি।হুহ্! ”
এহেন কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলেন কবির সাহেব। তার কথার পিঠে ছেলেটা যে এমন লাগামহীন কথা বলে বসবে তা যেন ঘুনাক্ষরেও ভাবেননি তিনি। এদিকে রৌদ্রের কথা শোনামাত্রই নাকেমুখে উঠে গিয়ে যাচ্ছে তা-ই অবস্থা সাব্বির সাহেবের। তায়েফ সাহেব এবারেও এগিয়ে এলেন ভাইয়ের কাছে। আলতো করে হাত দিয়ে মালিশ করতে লাগলেন ভাইয়ের পিঠ। মানুষটার ঠোঁটের কোণে স্পষ্ট মুচকি হাসির রেশ। ওদিকে তাশরিক সাহেব হতভম্ব চোখে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন।মানুষটার হাত থেকে খালি চামচটা অবহেলায় গড়িয়ে পড়েছে ফ্লোরে। মাইমুনা বেগম দাঁতে জিভ কেটে তৎক্ষনাৎ সরে গেলেন সেখান থেকে।জুবাইদা বেগম শাড়ির আঁচলটা খানিক টেনেটুনে সেথায় মুখ লুকিয়ে হাসছেন। রাফিয়া বেগম এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের লজ্জালু ভাবটা কমানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছেন।তিনি তো ভেবেছিলেন তার রৌদ্রটা বড় শান্তশিষ্ট গম্ভীর মেজাজের সুপুরুষ। কিন্তু এখন এ কোন নতুন রৌদ্রকে দেখছেন তিনি? ছেলেটা কেমন হুট করেই নির্লজ্জের নাম লেখাচ্ছে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে অনিক তো ছুটে পালিয়েছে সে-ই কখন! ছেলেটা আবার ভারি লজ্জালু কি-না!
প্রায় মিনিট দুয়েক লাগলো কবির সাহেবের নিজেকে সামলাতে। তিনি নিজেকে সামলেই দাঁতে দাঁত চেপে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন,
“ বেয়াদব হচ্ছো দিনদিন? এতো বিয়ে বিয়ে করছো কেনো তুমি? দুনিয়ায় কি এই প্রথম তুমিই বিয়ে করবে না-কি হ্যা? যত্তসব নির্লজ্জ কথাবার্তা! তোমাদের বয়সে থাকতে আমরা তো বিয়ের কথা শুনলেই লজ্জা পেতাম, আর তুমি কি-না…. ”
কবির সাহেবের কথাটাও পুরোপুরি শেষ হতে দিলোনা রৌদ্র। সে তৎক্ষনাৎ পেছনে ফিরে চলে যেতে যেতে বলতে লাগলো,
“ আগের দিন বাঘে খেয়েছে আব্বু। সেই কথা এখন তুলে লাভ নেই। তাছাড়া আমি পুরুষ মানুষ। পুরুষ মানুষের আবার কিসের লজ্জা? ভারি আশ্চর্য কথাবার্তা!”
ছেলেটা চলে গেলো সিঁড়ি বেয়ে। আর এদিকে পেছনে পড়ে রইলো কয়েক জোড়া হতবাক চোখ।কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছে,তো কেউ কেউ মুখ লুকিয়ে। অন্যদিকে ওসমান সিকদার ভিষণ এনজয় করছেন ব্যাপারগুলো।লোকটা আবার ভিষণ মিশুক স্বভাবের। এ-ই যে কি সুন্দর করে এহসান পরিবারের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন তিনি!
রাত সাড়ে আটটা!
ড্রয়িং রুমে গোল হয়ে বসেছেন বাড়ির সকলে। প্রত্যেকের হাতে খাতা-কলম। কবির সাহেব এবং সাব্বির সাহেব মিলে কনভেনশন সেন্টার বুকিং, রান্না -বান্না,বাজার- সদাই ইত্যাদির ফর্দ বানাচ্ছেন। তাদেরকে মাঝেমধ্যে এটা-সেটা ধারণা দিয়ে সাহায্য করছেন ওসমান সিকদার। তাশরিক সাহেব, তায়েফ সাহেব এবং শাহানুর মিলে আত্মীয় স্বজনদের লিস্টি করছেন। খুঁজে খুঁজে নাম লিখছেন সবাই। বিশেষভাবে খেয়াল রাখছেন, কেউ যেন বাদ না পড়ে যায়। অন্যদিকে বাড়ির গৃহিনীরা দোতলার ড্রয়িং এ বসে মার্কেট করা নিয়ে পুরোদস্তুর ফর্দ কষছেন। প্রত্যেকেই লিখে যাচ্ছেন, কে কোনটা কিনবে,কোনটা বাদ রাখবে। রুহি,আহি,মাহি এমনকি পুতুল এবং অরিনও আছে তাদের সঙ্গে। অরিন যখন জানতে পারলো, কাল বাদেই পরশু তার বিয়ে, মেয়েটা যেন কয়েকদফা হোঁচট খেলো কথাটা শোনে। একে একে দুই মিলিয়ে বুঝে নিলো রৌদ্রের বলা তখনকার কথাটার মানে। বাড়ির ছোট সদস্যরা তো বেজায় খুশি, বাড়িতে বিয়ে হবে বলে। আহি-মাহি তো নিজ থেকেই লম্বা একটা লিস্ট এড করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। রুহি নিজের দুর্বল শরীরটাকে কোনমতে টেনেটুনে এসে বসেছে এখানে। যদিওবা রেহান তাকে পুরোদমে আরাম করতে বলে গিয়েছে, কিন্তু তবুও রুহি নিজ থেকেই উঠে এসেছে। কতোইবা শুয়ে-বসে থাকা যায় শুনি? সে-ও তো একটা মানুষ তাই-না!
রাফিয়া বেগম লিস্টে কিছু একটা টুকছেন,এরইমধ্যে তিনি আড়চোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। অরিন মাথা নুইয়ে বসে আছে জড়সড় হয়ে। মেয়েটার শুভ্র নির্মল মুখখানায় ছেয়ে গেছে রক্তিম আভা। রাফিয়া বেগমের দৃষ্টি নরম হয়ে এলো। তিনি লেখালেখি স্থগিত রেখে মেয়ের পাশে এসে বসলেন। অরিন একবার চোখ তুলে চাইলো মায়ের দিকে। পরক্ষণেই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে আনতে নিলেই রাফিয়া বেগম আলগোছে মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন।এদিকে জুবাইদা বেগমসহ বাকিরাও চুপচাপ তাকিয়ে রইলো এই মা-মেয়ের দিকে। রাফিয়া বেগম নাক টানলেন কিছুটা। মানুষটার চোখদুটো কেমন হঠাত করেই ভরে এসেছে যেন। তিনি আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ধরে আসা কন্ঠে কোনমতে বললেন,
“ আমায় ভুল বুঝিস না মা।আমি হয়তো রাগের মাথায় সেদিন খুব উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলেছিলাম তোকে। আমি… ”
বাকিটা আর বলতে পারলেন না তিনি। হয়তো গলা ধরে এসেছে তার। অরিন এবার মায়ের বুক থেকে ধীরে ধীরে মাথা উঠায়। মায়ের নির্মল মুখখানার দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বলে,
“ কোনো উল্টাপাল্টা কথা বলোনি তুমি আম্মু। বরং আমার চোখে তুমিই একজন আদর্শ মা! তাই এখন আর কেঁদো না তো!”
রাফিয়া বেগম ভেজা চোখে হাসলেন একটুখানি। তারপর মেয়েটাকে আবারও টেনে নিলেন বুকের মাঝে। এদিকে তাদের এহেন কান্ড দেখে আহি-মাহি সুর টেনে বলে,
“ আরে! তোমরা একা একাই এমন হাগ করতে থাকবে না-কি? বলি আমরাও তো আছি লাইনে। আমাদেরও একটু সাইড দাও!”
কথাটা বলেই মেয়ে দু’টো এগিয়ে এসে ঝাপটে ধরে রাফিয়া বেগম ও অরিনকে।তাদের দেখাদেখি পুতুলও এসে ঝাপটে ধরলো তাদের।
ধানমন্ডি লেকের পাথর খচিত পাড়ের ওপর সারিবদ্ধ হয়ে বসে আছে রেহান,অনিক এবং রৌদ্র। লেকের পাড়ে বসে থাকার দরুন কিছুক্ষন পরপরই তাদের গায়ে এসে ভিড়ছে মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাস।বছর প্রায় শেষের পথে। হয়তো আর মাস দুয়েক পরেই নেমে পড়বে শীত মৌসুম। রেহান বসে থেকে গুনগুন করে গান গাইছে। সে-ই সাথে মাঝেমধ্যে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে অনিক।ছেলেটাকে আজ যেন বড্ড খুশি খুশি লাগছে। হয়তো প্রিয় মানুষ দু’টোর বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়াতেই তার এতো খুশি। অন্যদিকে রৌদ্র দু’হাত পেছনে হেলিয়ে বসে আছে। তার চোখদুটো ঐ দূর আকাশের চাঁদের পানে। সেথায় সে কল্পনা করে যাচ্ছে তার সানশাইনকে। ঐযে..মেয়েটা তার দিকে তাকিয়েই কেমন মিটমিট করে হাসছে। হাত দিয়ে ইশারায় চুপিচুপি কাছে ডাকছে, কি যেন ফিসফিস করে বলতে চাইছে রৌদ্রকে। রৌদ্র আলগোছে মুচকি হাসলো। নিজের অনিমেষ দৃষ্টি ফেললো অদূরের চাঁদটার পানে। ঠিক তখনি তার মনে পড়লো অরিনের বলা কথাটা,
“ আপনার ঐ বেড়াল চোখদুটো নিয়ে এভাবে তাকাবেন না ডাক্তার সাহেব! আমার নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে।”
কথাটা মনে পড়তেই রৌদ্র হাসলো ঠোঁট কামড়ে। পাশ থেকে রেহান ভ্রু কুঁচকায় ছেলেটার এমন আনমনে হাসি দেখে। সে তৎক্ষনাৎ একহাতে রৌদ্রের কাধঁ জড়িয়ে,সন্দিহান গলায় বলে,
“ কাহিনি কি ডাক্তার বাবু? কাকে মনে করে এমন মুচকি মুচকি হাসছেন আপনি?”
রৌদ্র স্মিত হেসে রেহানের দিকে তাকায়। রেহানের কাঁধে মাথা রেখে ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেললো ছেলেটা।পরক্ষনেই নিজের বুকের বা-পাশে হাত রেখে, কেমন শান্ত কন্ঠে বলে,
“ এইখানটা জুড়ে যার বসতি তাকে। আমার সানশাইনকে!”
অনিক মুগ্ধ হাসলো রৌদ্রের অবস্থা দেখে। মাথাটা নিচু রেখে ছেলেটা কি যেন ভাবছে আনমনে। রেহান রৌদ্রের কাঁধ আগলে ধরতে নিলেই রৌদ্র তৎক্ষনাৎ সরে গেলো দু’হাত দূরে। রেহান ভড়কে যায় এমন কান্ডে।সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রৌদ্রের দিকে তাকায়। খানিকক্ষণ বাদেই রৌদ্র নিজ থেকে বলে ওঠে,
“ ডোন্ট টাচ বাডি! আমাকে ছোঁয়ার অধিকার শুধুই আমার সানশাইনের।”
এমন কথায় অনিক হো হো করে হেসে ওঠে। অন্যদিকে রেহান চোখদুটো ছোট ছোট করে তাকালো রৌদ্রের দিকে। অতঃপর কপট ভাব ধরে বলে,
“ আশ্চর্য! তোকে ছুঁতে বয়েই গেছে আমার।যাহ… ছুঁইলাম না তোরে, তাতে কি?”
রৌদ্র হাসলো ঠোঁট পিষে। চোখদুটো আবারও তাক করলো সেই আকাশ পানে। তারপর নিজ থেকেই দাঁড়িয়ে পড়লো ছেলেটা। রেহান, অনিক ঘাড় উঁচিয়ে তাকায় তার দিকে। রৌদ্র চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই লেকের সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। পেছন থেকে রেহান, অনিক বেশ কয়েকবার ডেকেছে তাকে অথচ ছেলেটাকে দেখো! তার কান অব্দি যেন কোনো ডাকই পৌছাচ্ছে না। সে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই লেকের হাঁটু অব্দি পানিতে নেমে পড়ে। তার পরনের প্যান্টটাও ইতোমধ্যে ভিজে নেয়ে একাকার! রৌদ্র এবার চাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকেই হাতদুটো সটান করে দু’দিকে মেলে ধরে। ওদিকে পেছন থেকে অনিক এতক্ষণে ভিডিও কল দিয়ে বসেছে তার বনুকে। প্রায় মিনিট খানেক পর অরিন কলটা রিসিভ করতেই অনিক ঠোঁটের ওপর হাত ঠেকিয়ে মেয়েটাকে চুপ থাকতে বলে।অরিনও ভ্রু কুঁচকে ভাইয়ের কথামতো চুপ করে রইলো। পরমুহূর্তেই অনিক ফোনের ব্যাক ক্যামেরা অন করে। ঠিক তখনি অরিন স্পষ্ট দেখতে পায় — রৌদ্র লেকে নেমে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এহেন অবস্থা দেখে অরিন হকচকিয়ে ওঠে। বিচলিত হয়ে যে-ই না কিছু বলতে যাবে ওমনি অনিক ফিসফিসিয়ে বলে,
“ চুপচাপ দেখতে থাক বনু। কথা বলিস না।”
অগত্যা এমন কথায় চুপ করে গেলো অরিন।কিন্তু তার ভেতরকার অস্থিরতা যেন বাড়ছে বৈ কমছেনা। এদিকে রৌদ্র দু’হাত ছড়িয়ে চমৎকার হাসছে। কিয়তক্ষন পার হতেই সে কেমন গলা উঁচিয়ে বলতে লাগলো,
“ আমার হৃদয়ের সবটা জুড়ে বসবাস করা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী, ভালোবাসি তোকে! আমাকে নিজের সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতিতে উম্মাদ করে দেওয়া নারী,ভালোবাসি তোকে। আমাকে আর আমার হয়ে থাকতে না দেওয়া অভিমানী নারী,ভালোবাসি তোকে! শুনে রাখো সবাই… আমি ভালোবাসি আমার সানশাইনকে। আমার বউজান,মিসেস ইফতেখার এহসান রৌদ্রকে। সানশাইন! তুই শুনছিস? ভিষণ ভালোবাসি তোকে মেয়ে। ভিষণ ভালোবাসি!”
অরিন ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে। লেকের আশেপাশে হাটতে থাকা শত শত মানুষ ইতোমধ্যেই ভিড় জমিয়েছে এই পাগল প্রেমিকের কথাগুলো শুনে। কেউ কেউ তো পকেট থেকে ফোন বের করে ভিডিও করা শুরু করে দিয়েছে। অথচ এতো এতো মানুষের কীর্তিকলাপে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই রৌদ্রের।সে ভেসে আছে নিজের অন্য জগতে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর রেহান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো কিছুটা। পানিতে না নেমেই রৌদ্রকে ডেকে উঠে সে,
“ ভাই! এইবার উঠে আয়!”
রৌদ্র হাসিমুখেই হাতদুটো নিচে নামিয়ে নিলো। তারপর ধীরেসুস্থে পানি থেকে উঠে এলো। সিঁড়ি বেয়ে ভেজা শরীরে দৌড়ে উঠতে লাগলো ছেলেটা। পেছন থেকে রেহান হাঁক ছেড়ে বলে,
“ আরে, এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেনো? ঐ সম্বন্ধি দাঁড়া!”
রৌদ্র থামলোনা। দ্রুত কদম ফেলে হাঁটতে লাগলো সে। অনিককে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলেই অনিক জিজ্ঞেস করে বসে,
“ কই যাও ভাইয়া?”
রৌদ্র না থেমেই প্রতিত্তোর করলো,
“ বউয়ের কথা মনে পড়েছে সম্বন্ধিসাহেব। সো আই নিডা গো।”
রাত সাড়ে বারোটার কাছাকাছি।
রৌদ্র বাড়িতে এসেছে অনেক আগেই।কিন্তু এসেছে পর থেকেই তার ছোট্ট বউটাকে একমুহূর্তের জন্যও একা পাচ্ছেনা সে।এ নিয়ে বুকে বড্ড কষ্ট ছেলেটার। তারওপর তার মা-চাচীরা মিলে তার বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে।নাহ..এই যুদ্ধ অস্ত্র চালিত যুদ্ধ না হলেও,এরচেয়েও কয়েকধাপ বড় কিছু! রৌদ্র বাড়িতে আসতেই তার মা তাকে ডেকে বলে ওঠে,
“ আগামী দু’দিন অরিনের সঙ্গে সকল প্রকার দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ তোমার।”
রৌদ্র যদিও এ কথা মানতে নারাজ। কিন্তু এবারে যেন তার মা-চাচীরাও বরাবরের চেয়ে কঠোর রুপে অবতরণ করেছে। তাদের এককথা — দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা যা হবার সব বিয়ের পর হবে। আর রৌদ্র যদি এ শর্ত না মানে তাহলে তারা বিয়ের ডেট পিছিয়ে দেবে।অগত্যা এমন কঠিন বাক্য শুনে আর কথা বাড়ালো না রৌদ্র। বেশি ত্যাড়ামি করে থোড়াই বউটাকে নিজের থেকে দূরে রাখবে সে! তাছাড়া বউটার সাথে কথা বলে যে মনটাকে হালকা রাখবে তারও তো ওয়ে নেই।কেননা অরিনের ফোনটা যে এখন জুবাইদা বেগমের দখলে।
রৌদ্র নিজের রুমে পায়চারি চালাচ্ছে। ছেলেটার মনটা বড় অস্থির। এমুহুর্তে মনটা শুধু তার বউ বউ করছে। এ নিয়ে ঠিক কয়বার যে সে অরিনের ঘরের দরজার কাছ থেকে ফিরে এসেছে তা বলার বাইরে। তার জানামতে অরিনের রুমে আরও কয়েকজন ঘুমিয়েছে আজকে।এ নিয়েও ভিষণ বিরক্ত রৌদ্র। কেনো তার বউজানের সাথে অন্য কেউ ঘুমাবে? হোক সে মেয়ে মানুষ! তাতে কি? ঘুমাতে হবেই বা কেনো? প্রায় আধঘন্টার মতো পায়চারি চালিয়ে রৌদ্রের অবচেতন মন এবার একটা সোজাসাপটা সিদ্ধান্তে এসে থামলো। সেটা হচ্ছে — এখন যেভাবেই হোক তার সানশাইনকে একটাবারের জন্য হলেও তার দেখতেই হবে। নাহলে আজ আর ঘুম আসবেনা তার। তাই যে-ই ভাবা সে-ই কাজ! রৌদ্র পা টিপে টিপে আবারও এসে দাঁড়ালো অরিনের দরজার সামনে।
ছেলেটা আশেপাশে সর্তক দৃষ্টি বুলিয়ে দরজাটার নবে হাত রাখে। তারপর ধীরে ধীরে নবটা খানিক ঘোরাতেই দরজাটা খুলে গেলো নিঃশব্দে। রৌদ্র এবার বিজয়ী হাসলো।পুরো ঘরজুড়ে ড্রিম লাইটের নিলাভ আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।সে চুপচাপ পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকলো। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই যেন বড়সড় একটা ঝটকা খেলো ছেলেটা। কেননা বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে তিনজন। প্রত্যেকের মুখের ওপর ব্ল্যানকেট দিয়ে রাখা। রৌদ্র ভিষণ বিরক্ত হলো।কি দরকার ছিলো এভাবে মুখ ঢেকে শুয়ে থাকার? মেয়েটা তাকে এতো জ্বালাচ্ছে না! রৌদ্র কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে পা টিপে টিপে বিছানার মাথার কাছে এসে দাঁড়ায়।
হাত বাড়িয়ে আলতো করে প্রথম ব্যাক্তিটির মুখের ওপর থেকে ব্ল্যানকেট সরাতেই,মানুষটাকে দেখতে পেয়ে দু-কদম পিছিয়ে গেলো রৌদ্র। কেননা ব্যাক্তিটি আর কেউ নন স্বয়ং আমরিন বেগম। রৌদ্র কিছুটা ঢোক গিলে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তখনি বিছানার মাঝে শুয়ে থাকা অরিন খানিকটা নড়েচড়ে এপাশ থেকে ওপাশ ফিরলো।যার দরুন তার মুখের ওপর থেকে চাদরটাও সরে গেলো। রৌদ্র তাকে দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো মেয়েটার পায়ের কাছে। কিছুক্ষণ আলতো করে মেয়েটার নুপুর পড়া পায়ের ওপর হাত বুলাতেই অরিনের ঘুম হালকা হয়ে এলো। মেয়েটা চোখ কুঁচকে নিজের পায়ের দিকে তাকায়। ওমনি পায়ের কাছে রৌদ্রকে দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে ওঠতে নিলেই রৌদ্র তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে।
অরিনও বাধ্যদের ন্যায় চুপ করে রইলো।রৌদ্র তাকে ফের ইশারায় তার কাছে আসতে বললো।অরিন ভয়ে ভয়ে একবার নিজের দুপাশে তাকায়।পরক্ষণেই মাথা নাড়িয়ে রৌদ্রকে না জানাতেই, রৌদ্র তখন চোখ গরম করে চাইলো তার দিকে। হাত উঁচিয়ে মেয়েটাকে থাপ্পড় দেখিয়ে, ইশারায় খাট থেকে নামতে বলে। অরিন এবার পড়লো মহা বিপাকে। সে কিছুক্ষণ বিছানায় বসে দোনোমোনো করতে করতে অবশেষে যে-ই না নামতে যাবে ওমনি তার পাশ থেকে নিচু কন্ঠে আমরিন বেগম বলে ওঠে,
“ তারাতাড়ি দেখা করে এসে শুয়ে পড়ো।”
কথাটা বলেই তিনি ওপাশ ফিরে শুলেন। আর অরিন? সে-তো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। অন্যদিকে রৌদ্র মুখ টিপে হাসছে। বুকের কাছে দু’হাত বেঁধে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। অরিন লজ্জালু ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে আসে। রৌদ্র তখন মেয়েটার হাত ধরে এগিয়ে যায় ছাঁদের দিকে।
নিকষ কালো আধারে ছেয়ে আছে চারপাশ। রৌদ্র অরিনকে নিয়ে এসেছে ছাঁদে। দূর আকাশের চাঁদটাও লুকিয়ে আছে মেঘের আড়ালে। অরিন মনে মনে ভয় পাচ্ছে কিছুটা। একেতো আধারে ছেয়ে আছে চারপাশ, অন্যদিকে তার ফুপুও টের পেয়ে গিয়েছে সবটা।এখন যদি অন্য কেউও টের পেয়ে যায় তখন কি হবে? অরিনের এহেন ভাবনার মাঝেই রৌদ্র মেয়েটার কোমর আকড়ে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। অরিনের ফোলা ফোলা গালের ওপর হাত রেখে আদুরে কন্ঠে বললো,
“ ভয় লাগছে সানশাইন?”
অরিন চোখ তুলে চাইলো। রৌদ্রের মুখের দিকে তাকাতেই সকল দুশ্চিন্তা যেন ফুড়ুৎ করে চলে গেলো মেয়েটার। সে আলতো হেসে বললো,
“ আপনি থাকতে আমার কিসের ভয় শুনি?”
রৌদ্র হাসলো গালভরে। মেয়েটার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো সযত্নে। সেখানে ঠোঁট ছুঁইয়ে রেখেই বললো সে,
“ মিস ইউ জানবাচ্চা!”
“ মিস ইউ টু ডাক্তার সাহেব!”
সকাল সকাল ভিষণ ব্যস্ত বাড়ির সকলে। সারা বাড়ি জুড়ে চলছে গায়ে হলুদের সাজ-সরঞ্জাম। বাড়ির বাইরে বাগানের পাশে বড় খোলা জায়গাটায় চলছে স্টেজের কাজ। সে-ই সাথে সাজানো হচ্ছে পুরো এহসান ভিলা। বাড়ির গৃহিনীরা সেই যে রেডি হতে যার যার কামরায় ঢুকেছে, আর তো বেরুনোর নামই নিচ্ছে না। রাতেই হলুদের ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠান হবে। সে নিয়ে সে-কি ব্যস্ততা সকলের! এখন অবধি মার্কেটেই যেতে পারলোনা কেউ। তাইতো এখন সকলে রেডি হচ্ছে মার্কেটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
শিল-পাটার খসখসে শব্দ হচ্ছে পুরো ঘর জুড়ে। সে-ই সাথে ঘরে বাজছে মৃদু শব্দের গান। রৌদ্র ফ্লোরে বসে শিলপাটায় হলুদ বাটছে। ছেলেটার পরনের ধূসর রঙা পুরো শার্টটা হলুদের ছিটেফোঁটায় আবৃত। জীবনে প্রথমবারের মতো শীল পাটায় হলুদ বাটছে কি-না! এমনতো হবেই! রৌদ্রের হাতদুটো কেমন হলদেটে হয়ে এসেছে! তার পুরো কপাল জুড়ে ঘামের উপস্থিতি। রৌদ্র কাজের ফাঁকে ফাঁকেই হাতের উল্টো পিঠে কপালটা মুছে নিচ্ছে বারকয়েক। ফলাফল স্বরুপ ছেলেটার কপালেও লেপ্টে গিয়েছে কিছুটা হলুদ। প্রায় ঘন্টা খানেক সময় ধরে রৌদ্র একপ্রকার যুদ্ধ চালাচ্ছে এইটুকুন হলুদ বাটতে।তবুও ছেলেটার চোখেমুখে নেই কোনো বিরক্তি। বরঞ্চ সেথায় দেখা মিলছে এক অদ্ভুত প্রাপ্তির।
মাত্রই গোসল সেরে বেরিয়েছে অরিন। পড়েছে একটা কলা পাতা রঙের সুতির শাড়ি। কোমর সমান ভেজা চুলগুলো থেকে চুইয়ে পড়ছে পানি। যার দরুন কোমরের কাছটা ভিজে নেয়ে একাকার অবস্থা মেয়েটার। অরিন ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো কোনমতে মুছতে থাকে সে।ঠিক তখনি বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে আহি চেচিয়ে উঠে জোর গলায়,
“ অরিপু! কাকিয়া ডাকছে।তারাতাড়ি এসো। এক্ষুণি বেরোবে সবাই।”
“ আসছি!” — খানিকটা গলা উঁচিয়ে বলে ওঠে অরিন। কথাটা বলেই সে আবারও মনোযোগ টানলো আয়নার দিকে। মিনিট খানেক পেরুতেই ফের দরজায় কড়া নাড়বার শব্দ হয়।অরিন এবার কপাল গুটিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে আসে। দরজাটা খুলে দিয়ে যেইনা কিছু বলতে যাবে ওমনি সম্মুখে দাঁড়ানো ব্যাক্তিকে দেখে গোটানো কপাল শিথিল হয়ে আসে মেয়েটার। সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটাকে আপাদমস্তক পরোখ করে হতবাক কন্ঠে সে বলে ওঠে,
“ আপনি? আপনার এই অবস্থা কেনো?”
রৌদ্র হাসলো খানিকটা। কোমরের পেছনে দু’হাত লুকিয়ে রেখেছে সে। রৌদ্র কথা না বাড়িয়ে দ্রুত কদমে ঘরে ঢুকে পড়ে। রৌদ্রের নেশালো দৃষ্টি অরিনের ওপর নিবদ্ধ। মেয়েটা যে তাকে দিনকে দিন পাগল করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে তা আর বুঝতে বাকি নেই রৌদ্রের। এই যে এখন কেমন বউদের মতো শাড়ি পড়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বোকা মেয়েটা। আচ্ছা সে-কি বোঝেনা? তাকে এভাবে দেখলে হুটহাট কিছু করে ফেলতে ইচ্ছে করে রৌদ্রের। অরিন রৌদ্রের এহেন দৃষ্টি দেখে তৎক্ষনাৎ পেছন ঘুরে দাঁড়ায়। তখনি রৌদ্র কেমন শান্ত কন্ঠে বললো,
“ গায়ে হলুদ ছোঁয়াবে না বউজান?”
অরিন থমকায়। আলগোছে ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকায়। ভ্রূদ্বয়ের মাঝে গুটিকয়েক ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
“ এতো তারাতাড়ি? হলুদ পর্ব না সন্ধ্যায় হবে?”
রৌদ্র ফিচেল হাসলো। একহাত পেছনে নিয়ে নিঃশব্দে দোরটা লাগিয়ে দিলো ঘরের। তারপর মেয়েটাকে পেছন থেকে কিছুক্ষণ আপাদমস্তক দেখে খানিকটা এগিয়ে আসে রৌদ্র। অরিনের পিঠের সঙ্গে নিজের বুকটা মিশিয়ে দাঁড়ায় সে।অরিন তৎক্ষনাৎ সটান হয়ে দাঁড়ালো। রৌদ্র আলতো হেসে মেয়েটার কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে ফিসফিস করে বললো,
“ আমার বউজানকে আমার আগে অন্য কেউ হলুদ ছোঁয়াবে? উঁহু… এই অধিকার আমি কাউকে দেবোনা সানশাইন! তোর গায়ে হলুদ উঠলে সবার আগে আমার হাত দিয়েই উঠবে।”
কথাটা ব’লেই রৌদ্র একহাতে মেয়েটার কনুই চেপে তাকে নিজের দিকে ঘোরায়। অরিনের কৌতুহলী চোখজোড়া রৌদ্রের দিকেই নিবদ্ধ। রৌদ্র এবার পেছনের হাতে লুকিয়ে রাখা হলুদের বাটিটা আলগোছে নিয়ে এলো সামনে। তারপর হলুদভর্তি বাটিটায় আঙুল ডুবিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো আড়চোখে। তার ঠোঁটের কোণে এখনো লেপ্টে আছে মুচকি হাসি। সে নিজের হলুদ রাঙা হাতটা ধীরে ধীরে নিজের ডান গালে ছোঁয়ায়। অরিন ভ্রু কুঁচকে নেয় ছেলেটার এহেন কান্ডে। রৌদ্র এবার বাঁকা হেসে আরেকটু হলুদ নিয়ে নিজের অন্যগালটাতেও লেপ্টে দেয় আলতো করে। কাজ শেষে হলুদের বাটিটা নিচে নামিয়ে রাখলো রৌদ্র।
তারপর তার হলুদ ছোঁয়া হাতদুটো নিঃশব্দে নিয়ে গেলো অরিনের শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে থাকা মসৃণ উদরে। অরিন কেঁপে ওঠে খানিকটা। মেয়েটার হাতদুটো তৎক্ষনাৎ খপ করে চেপে ধরে শাড়ির একাংশ। রৌদ্র হাসলো ঠোঁট কামড়ে। মেয়েটার মসৃণ কোমরে হালকা টেন মেরে তাকে নিয়ে আসে নিজের একদম কাছে। অরিন তৎক্ষনাৎ চোখ কুঁচকে ফেলে। তার চোখমুখে এসে আছড়ে পড়ছে রৌদ্রের উষ্ণ নিঃশ্বাসের ঝাপটা। রৌদ্র কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে রৌদ্রের গাল ছুঁইয়ে গেলো তার প্রাণভোমরার গালে। অরিন নিঃশব্দে হাসছে। লাজুকলতার গালে ইতোমধ্যে ছেয়ে গেছে রক্তাভ আভা।নাকের পাটাটাও ফুলে উঠেছে বেশ! চোখের কার্নিশে এসে ভিড় জমিয়েছে কিছু প্রাপ্তির অশ্রু!
রৌদ্র নিজের গালটা সময় নিয়ে ছুঁইয়ে দিচ্ছে অরিনের গালে। সেথায় লেপ্টে গিয়েছে হলুদ! রৌদ্র বেশ কিছুক্ষণ পর নিজের গালটা সরায়। তারপর অরিনের অন্যগালে নিজের বামগাল ছোঁয়ায়।সেখানেও একইরকমভাবে ছুঁইয়ে দেয় হলুদের ছোঁয়া। কিয়তক্ষন বাদে রৌদ্র কেমন অদ্ভুত শান্ত চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“ শাদি মোবারক বউজান! আমার ভালোবাসায় রেঙে থাকুক তোমার প্রতিটি ভোর, আমার ছোঁয়ায় লেপ্টে থাকুক তোমার প্রতিটি রাত! আর…. তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে লেপ্টে যাক আমার নাম! ভালোবাসি সানশাইন! আমার সানশাইন!”
অরিনের চোখজোড়া ছলছল হয়ে এলো এবার।সে আলগোছে মাথা রাখলো রৌদ্রের বুকের বা-দিকে। সেথায় কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে পড়ে থেকে হঠাৎই কেমন হাসিমুখে বলতে ওঠে,
“ পাগল আপনি!”
রৌদ্র মুচকি হাসলো। অরিনকে নিজের সঙ্গে ভীষনভাবে আগলে নিয়ে দুষ্ট কন্ঠে বললো,
“ পাগলের পাগলামিতো এখনো শুরুই হয়নি বউজান! সে-তো শুরু হবে কাল থেকে। তখন নাহয় রোজ কায়দা করে এই কথাটা বলবে,আর আমি সে-ই কথাটার যথাযথ যুক্তি দাড় করাবো। মনে রেখো কিন্তু হানি….কাল থেকে নো ছাড়াছাড়ি!”
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৩
অরিন আবারও হাসলো নিঃশব্দে। রৌদ্রের পিঠ আঁকড়ে ধরে, তাকে মিনমিনে স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“ পাগলামি কি আরও বাকি আছে?”
এপর্যায়ে রৌদ্র দুষ্ট হাসলো। নিজের হলুদে রাঙা হাতদুটো ধীরে ধীরে উঠিয়ে আনলো মেয়েটার পিঠ বরাবর। সেথায় অন্য কাপড়গুলোর উপস্থিতি টের পেয়েই রৌদ্র কেমন দুষ্ট কন্ঠে বলে ওঠলো,
“ নাইস ফিটিংস হানি!”