সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৭ (২)
Jannatul Firdaus Mithila
স্টেজের সামনে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে কতক গুলো বসার আসন। পেছনের আসনগুলোতে বসেছেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। কেউ কেউ আবার ঘুরে ঘুরে খাবার সাজসজ্জাগুলো দেখছেন। স্টেজের বা-দিকে আয়োজন করা হয়েছে খোলা বুফের। সেথায় রয়েছে হরেকরকম খাবারের বাহার।স্টার্টার হতে শুরু করে প্রত্যেক ধরনের মুখরোচক খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। সাব্বির সাহেব ও কবির সাহেব মিলে আমন্ত্রিত অতিথিদের সাথে কথাবার্তা চালাচ্ছেন। তাশরিক সাহেব বেচারা এখনও বউকে মানিয়ে যাচ্ছেন। তবুও বউটা তার কিছুতেই কথা শুনছে না! তায়েফ সাহেব, শাহানুর, জুনায়েদ এবং ওসমান সিকদার মিলে একটা টেবিল দখল করে সেখানে বসে মনের সুখে স্টার্টার খাচ্ছেন। এদিকে বাড়ির গৃহিনী এবং মহিলা সদস্যরা নিজেদের মধ্যে গুসুর-ফুসুর করতে ব্যস্ত! মহিলাদের জন্মগত স্বভাবই যেন এটা।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর অরিনকে নিয়ে আসা হলো স্টেজের কাছে।এদিকে মেয়েটাকে দেখে অতিথিরা সহ বাড়ির সকলে একমুহূর্তের জন্য পলক ফেলতে ভুলে গেলেন যেন। বাড়ির মেয়েগুলো অরিনের চারিদিকে কেমন ঘেরাও করে দাঁড়িয়ে আছে। রাফিয়া বেগমসহ বাকিরা এগিয়ে এলেন মেয়েটার দিকে। জুবাইদা বেগম মুগ্ধ হেসে অরিনের থুতনিতে আলতো হাত রেখে বললেন,
“ মাশাআল্লাহ! আমার পরি!”
অরিন লজ্জালু হাসলো। তাতে গালের গর্তদুটো সদৃশ হতেই মাইমুনা বেগম তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে,নিজ চোখের কার্নিশ থেকে খানিকটা কাজল নিয়ে মেয়েটার ডানহাতের তালুতে লাগিয়ে দিলেন। রাইসা বেগম তক্ষুনি বলে ওঠেন,
“ আহা! সেজো বু! এসব তো কুসংস্কার..”
মাইমুনা বেগম মাথা নাড়ায়। অরিনের মুখটা দুহাতে আলতো করে কাছে টেনে, তার কপাল বরাবর ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ জানি! তবুও মন মানলোনা। মায়েদের মনতো!”
এহেন কথায় মুগ্ধ হাসলেন সকলে। এরইমাঝে রাফিয়া বেগম আশপাশে খানিক চোখ বুলিয়ে রুহিকে জিজ্ঞেস করে উঠেন,
“ রোদ কোথায়? ও আসেনি? ”
রুহি ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো।কন্ঠে কপট ভাব ধরে টেনে টেনে বললো,
“ আর আসা! তোমার মেয়ের জামাই সাজতে গিয়েছে। বলেছে — তাকেও নাকি তার বউয়ের মতো সুন্দর দেখাতে হবে!”
এরূপ কথায় একদফা হাসির রোল পড়লো সকলের মাঝে। অরিনও হাসছে মুখ টিপে। কিয়তক্ষন বাদে জুবাইদা বেগম নিজের হাসি থামিয়ে অরিনের একহাতের কব্জি চেপে ধরলেন। বললেন,
“ চল মা! আপাতত বসে থাকবি নাহয়। রোদ এলে এরপর তোদেরকে একসঙ্গে হলুদ ছোঁয়াবো। কেমন?”
অরিন নির্বাক হয়ে মাথা কাত করলো কেবল। কদম বাড়িয়ে চলে গেলো নিজ আসনে। ওদিকে এতক্ষণ ধরে একদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সাব্বির সাহেব। মেয়েটা যে তার আজ পুতুল সেজেছে! সাব্বির সাহেব খেয়াল করলেন তার চোখদুটো কেমন ঘোলাটে হয়ে আসছে বারংবার। তিনি আলগোছে চোখদুটো খানিক মুছে নিয়ে ফের সামনে তাকালেন। তক্ষুনি তার পাশ থেকে কবির সাহেব গম্ভীর কন্ঠে গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠেন। সাব্বির সাহেবের ধ্যান ভাঙলো এতে। তিনি মেয়ের ওপর থেকে নিজের ছলছল হয়ে আসা দৃষ্টিটা সরিয়ে আনলেন দ্রুত। পরক্ষনেই রাখলেন পায়ের তলার জমিনের ওপর। কবির সাহেব শান্ত চোখে ভাইয়কে পরোখ করলেন। তার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক মুহুর্তেই বুঝে গেলো ভাইয়ের মনোভাব। তিনি নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় ভাইয়ের কাঁধ আগলে ধরলেন। সাব্বির সাহেব এখনো মাথা নুইয়ে রেখেছেন। কবির সাহেব তখন ক্ষীণ স্বরে বলে ওঠেন,
“ তুই কি আমাদের মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে পাঠাচ্ছিস না-কি? আমাদের অরিতো বিয়ের পর এ বাড়িতেই থাকবে তাই-না? তবুও তোর কেনো এতো মন খারাপ হচ্ছে বলতো? আচ্ছা একমিনিট… ”
কবির সাহেব থামলেন একমুহূর্তের জন্য। পরক্ষনেই চোখদুটো তিনি ছোট ছোট করে ফের সন্দিহান গলায় বলতে লাগলেন,
“ আচ্ছা.. আমাকে কি তোর বেয়াই হিসেবে পছন্দ হয়নি?”
তড়িৎ চমকিত নেত্রে তাকালেন সাব্বির সাহেব। মুখে তার ইতোমধ্যেই লেপ্টে গিয়েছে হতবাকতা। তিনি পরপর বড় ভাইকে শুধরে দিয়ে বললেন,
“ ছিহঃ ভাইজান। এসব কি বলছো তুমি? এই তুমি আমায় চিনলে ভাইজান?”
কবির সাহেব খানিক ভাব ধরলেন যেন।কন্ঠে কপট রাগী ভাব নিয়ে বললেন,
“ তোর চেহারায় যেমন ১২টা বেজে আছে, তেমনটা যেকেউ দেখলে এই একই কথা বলবে।ভাববে… তোকে ভোলাভালা পেয়ে তোর মেয়েকে নিজের মেয়ে বানিয়ে নিচ্ছি আমি।যদিও এসব কেউ ভাবলেও আমার কিছুই যায় আসেনা।”
সাব্বির সাহেব পড়লেন এবার মহাবিপাকে। বড় ভাইকে এবার কি বলে মানাবেন তিনি এ নিয়েই যেন মাথা ফেটে যাচ্ছে তার! বেচারা চোখমুখ শুকিয়ে এসেছে ইতোমধ্যেই।কবির সাহেব আড়চোখে দেখলেন ভাইকে।পরক্ষণেই তিনি কেমন ফিক করে হেসে দিলেন।সাব্বির সাহেবের খোঁচা খোঁচা চাপদাড়ি ভর্তি গালটা খানিক টেনে দিয়ে বললেন,
“ আরে বলদ! আমি মজা করেছি তোর সাথে!”
এবার যেন বুকভর্তি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন সাব্বির সাহেব। তিনি পকেট থেকে রুমালটা বের করে কপালের ঘাম গুলো মুছে নিলেন আলগোছে। একটু আগেই যা ভয় পাচ্ছিলেন না তিনি! আর কিছুক্ষণ এরম ভয় পেয়ে থাকলে নির্ঘাৎ হার্টবিট স্টপ হয়ে আসতো তার।
শ্যামরণ সুদর্শন যুবকটি গায়ে জড়িয়েছে গাঢ় অলিভ রঙের এমব্রয়ডারির কাজ করা কটনের পাঞ্জাবি।সেই সাথে পড়েছে সেম কালারের ধূতি পাজামা। বুকের কাছটা তার হা করে খুলে রাখা! দু’হাতের পাঞ্জাবির হাতাগুলো খানিকটা ওপরের দিকে জমিয়ে রাখা। বামহাতে তার শোভা পাচ্ছে সিলভার রঙের একখানা ঘড়ি। রৌদ্র ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে খানিক মুচকি হাসলো। পরক্ষণেই ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে জেলের কৌটাটা খুলে সেখান থেকে সামান্য জেল নিয়ে নিলো হাতের আঙুলে। তারপর নিজের সদ্য ফেড হেয়ারকাট দেওয়া চুলগুলোর ডগায় আলতো করে জেল লাগিয়ে দিলো। বেশ স্মার্টলি নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে অবশেষে রৌদ্র নিজের চৌকস চোয়ালখানায় হাত রেখে একবার এপাশ তো আরেকবার ওপাশটা আয়নায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। নাহ…. এই লুকটা তার সানশাইনের পাশে দাঁড়ানোর জন্য একদম পারফেক্ট। রৌদ্র সামান্য মুচকি হেসে টেবিলের ওপর থেকে Creed Aventus পারফিউমের কাচের শিশিটা তুলে নেয় হাতে।পরপর কয়েকবার স্প্রে করে দিলো নিজের সম্পূর্ণ বদনে। অতঃপর শিশিটা আবারও তার যথাযথ স্থানে রেখে দিয়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো সে।বিছানার ওপর পড়ে থাকা অলিভ রঙের লম্বা স্কার্ফটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো রৌদ্র। সেটা গলার ওপর দুভাজঁ করে ফেলে রেখে রওনা দিলো নিচে যাবার উদ্দেশ্যে!
আহি,মাহি এবং কুহেলি এরা তিনজন গিয়ে দাঁড়িয়েছে ফুচকাঁর স্টলে। একের পর এক প্লেটভর্তি ফুচকা কিভাবে যে খাচ্ছে মেয়েগুলো কে জানে! এদিকে বাকি মেয়েদেরও জিভে জল চলে আসার উপক্রম তাদের খাওয়া দেখে। অরিন তো পারছেনা ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়তে ফুচকার ওপর। নিজ বিয়ে উপলক্ষ্যে মেয়েটা বুঝি নিজেকে আঁটকে রেখেছে বহুকষ্টে! কিন্তু নিজেকে আঁটকে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস যেন বেশিক্ষণ টিকলোনা মেয়েটার। সে তৎক্ষনাৎ খানিক ঢোক গিলে উঠে দাঁড়ায়। রুহি চমকে তাকায় মেয়েটার উঠে পড়া দেখে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“ কি হলো আবার?”
অরিন কিছুক্ষণ আমতা আমতা করলো।পরক্ষণেই নিজের সকল লাজলজ্জা গুলোকে একপ্রকার চুলোয় চড়িয়ে বললো,
“ আমি ফুচকা খাবো রুহিপু!”
রুহি একবার ফুচকার স্টলের দিকে তাকালো। মেয়েটারও যে ব্যাপক ইচ্ছে করছে এক-দু প্লেট ফুচকা পেটে সাবাড় করতে কিন্তু পারছেনাতো। তাছাড়া পারবেই বা কিভাবে? তার অতি সাবধানি সোয়ামি জান যে তার দিকে চব্বিশ ঘণ্টা সুপার গ্লুয়ের মতো চিপকে থেকে বলতে থাকে,
“ এটা খেয়োনা — হজমে সমস্যা হবে।
ওটা খেয়োনা — এটা মোটেও হাইজেনিক নয়।
এটা খাও — এতে তোমার দূর্বলতা কমবে”
ব্লা ব্লা কতকিছু! রুহি মাঝেমধ্যে বিরক্ত হলেও মুখ ফুটে বলতে পারেনা কিছুই।কিছু বললেই পাগল ছেলেটা ঝাপটে ধরে বসে থাকবে ঘন্টার পর ঘন্টা। কি এক অদ্ভুত জ্বালায় পড়লো মেয়েটা! এদিকে রুহিকে আপন ধ্যানে নিবিষ্ট থাকতে দেখে অরিন বুঝি সুযোগ পেয়ে গেলো।সে তৎক্ষনাৎ মাথার চুনরিটা খানিক টেনেটুনে সামনে এগোলো। কয়েক পা এগোতেই হুট করেই থেমে গেলো তার পদযুগল। কেননা তার সম্মুখেই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে রাফিয়া বেগম।অরিন খানিক ঢোক গিললো। মায়ের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো সে। রাফিয়া বেগম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে পরক্ষণেই বললেন,
“ খেয়ে দ্রুত চলে এসো যাও। নতুন বউদের এভাবে হাটাহাটি করা ঠিক না।”
কথাটা বলেই রাফিয়া বেগম চলে গেলেন সেখান থেকে। অরিনও যেন হাঁফ ছেড়ে বাচঁলো। সে আর কোনোদিক না তাকিয়ে ছুটে গেলো ফুচকা স্টলের দিকে। গিয়েই আদেশের সুরে বললো,
“ তারাতাড়ি দু-প্লেট ফুচকা বানান।ঝাল দিবেন বেশি করে। টক দিবেন আলাদা। একপ্লেট বানাবেন দই-ফুচকা।আরেক প্লেট নরমাল ফুচকা।কই তারাতাড়ি বানান!”
হাতে,মুখে মাস্ক পড়া ছেলেদুটো যেন অরিনের এহেন কথায় মাস্কের আড়ালেই মুখ টিপে হাসলো। একজন বুঝি তৎক্ষনাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়লো অরিনের জন্য ফুচকা তৈরিতে। অরিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ছেলে দুটোর মধ্যে আরেকজন আড়ালে দাড়িয়ে আড়চোখে বারকয়েক দেখছে অরিনকে।নতুন বউ দেখলে তার আবার তর সয় না! বেহায়া চোখদুটো যেন গিলেই ফেলবে মেয়েটাকে!
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর, অরিনের সামনে দেওয়া হলো একপ্লেট নরমাল ফুচকা। ফুচকার ওপরের সাজসজ্জা দেখেই যেন লোভ ধরে গেলো মেয়েটার।সে তৎক্ষনাৎ ঝাপিয়ে পড়লো ফুচকার প্লেটের ওপর। গপগপিয়ে খেতে লাগলো একেকটা ফুচকা। প্রায় পাঁচটা ফুচকা যখন সাবাড় হলো,তক্ষুনি ঝালে যেন টনক নড়লো মেয়েটার। সে খাওয়া থামিয়ে হা-হু করতে লাগলো ঝালে। ইশারায় ছেলেদুটিকে বোঝালো পানি দিতে। ছেলেদুটোও তৎক্ষনাৎ পানি নিয়ে এগিয়ে এলো।হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে পানি এগিয়ে দিতেই কেউ একজন এসে খপ করে চেপে ধরে সেই হাত।ছেলেটা থমকায়।ঘাড় বাকিয়ে তাকায় পাশে। দেখতে পায় — রৌদ্র কেমন চোয়াল শক্ত করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে কটমট দৃষ্টিতে। ছেলেটা বুঝি ঢোক গিললো সামান্য। এদিকে তার হাতটাও কেমন কটমট করে উঠছে ব্যাথায় অথচ রৌদ্র যেন ছাড়ছেই না সে হাত! অন্যদিকে অরিন ফোপাচ্ছে। ঝালে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে মেয়েটার। রৌদ্র সেদিকে তাকায়।পরমুহূর্তেই তার চোখেমুখে ছেয়ে যায় অস্থিরতা। সে এক ঝটকায় ছেলেটার হাত টেনে তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজে এগিয়ে এলো অরিনের কাছে।মেয়েটার লাল হয়ে আসা মুখটা নিজের দু’হাতের তালুতে নিয়ে অস্থির গলায় বলে ওঠে,
“ এই…জানবাচ্চা! কষ্ট হচ্ছে খুব?”
অরিন মাথা নাড়ালো শুধু। রৌদ্র তৎক্ষনাৎ আর কিছু না ভেবে মেয়েটাকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। ভাগ্যিস এদিকটা স্টেজের একপাশে। এদিকটায় খুব একটা মানুষের ঘোরাঘুরি না থাকায় তারই যেন সুবিধা হলো এমুহূর্তে। রৌদ্র মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বাড়ির পশ্চিম পাশের বাগানটায় গিয়ে দাঁড়ালো। পরক্ষনেই অরিনকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো,
“ একটু সহ্য কর সানশাইন! আমি এক্ষুণি আনছি কিছু!”
কথাটা বলেই রৌদ্র কদম বাড়ায় সামনের দিকে। কিন্তু তক্ষুনি তার হাতের কব্জি টেনে ধরে অরিন।রৌদ্র থামলো।পেছনে ঘুরে তাকালো মেয়েটার দিকে। অরিনটা এবার কেঁদেই দিয়েছে। রৌদ্র আর ভাবতে পারলোনা কিছু।সে চটজলদি এগিয়ে এসে আঁকড়ে ধরলো মেয়েটার অধরজোড়া।গভীরভাবে আশ্লেষে টানতে লাগলো মেয়েটার নরম ওষ্ঠপুট নিজের ওষ্ঠপুটের মাঝে। অরিন থমকায়।স্তব্ধ চোখে তাকায় রৌদ্রের দিকে। এদিকে রৌদ্র যেন অস্থির। এমুহূর্তে মেয়েটার কষ্ট কমানোর সে-কি নিদারুণ প্রচেষ্টা তার!
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর অরিনের নিশ্বাস আঁটকে আসলো যেন। সে হাসফাস করতে লাগলো দাঁড়িয়ে। রৌদ্র তা টের পেয়েই আস্তে করে ছেড়ে দিলো মেয়েটার সিক্ত অধরজোড়া। এমুহূর্তে তার ঠোঁট দুটোও যেন জ্বলে যাচ্ছে ঝালে। কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ধ্যান নেই। সে আবারও মেয়েটার গালের পাশে হাত রেখে বিচলিত হয়ে বললো,
“ ঝাল কমেছে সানশাইন?”
অরিন ক্ষুদ্র চোখে তাকায় রৌদ্রের পানে।ক্ষীণ স্বরে বলে,
“ হু!”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো যেন।হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে টেনে নিলো নিজের বুকের মাঝে। অরিনের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,
“ এতোগুলো ঝাল কেনো খেতে গেলি জানবাচ্চা? কতটা কষ্ট হলো তোর…কেনো বুঝিস না তুই? এভাবে আর কখনো ঝাল খাবিনা কেমন?”
অরিন প্রতিত্তোরে মৌন রইলো। হাতদুটো দিয়ে খামচে ধরলো রৌদ্রের পিঠের একাংশ। রৌদ্র বোধহয় বুঝে গেলো মেয়েটার খারাপ লাগছে। তাই সে আর তেমন কিছু না বলে চুপচাপ মেয়েটাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
“ কই সবাই? এবার নাহয় অনুষ্ঠানটা শুরু করা যাক।কি বলেন সবাই?”
শাহানুর সাহেবের কথায় সকলেই একমত হলেন।রৌদ্র এবং অরিনও এসে বসেছে সামনের আসনে।তাদের দুপাশে বসেছে বাড়ির বাদবাকি লোকজন। ওদিকে অনিক বসেছে খানিকটা দূরে। তার পাশেই জড়সড়ভাবে বসে আছে ইকরা। মেয়েটার এহেন জড়সড়ভাবের একমাত্র কারণ অনিক নিজেই।কেননা ছেলেটা তার একহাত চেপে ধরে বসে আছে সেই কখন থেকে। ওদিকে তাকে ডাকছে সবাই অথচ ছেলেটাকে দেখো! সে যেন ছাড়ছেই না তাকে। ইকরা শেষবারের মতো অসহায় সুরে ফিসফিস করে বললো,
“ ছেড়ে দিননা।কেউ দেখে ফেলবেতো।”
অনিক যেন শুনলোই না সে কথা।সে এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে এনে সন্দিহান গলায় ইকরাকে বললো,
“ হুহ্? কিছু বললে?”
ইকরা আর কিছু বললোনা।বলে লাভটাই বা কি হচ্ছে? এ ছেলেকি শুনছে তার কথা? ইকরা গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকায়।এমন সময় সেখান থেকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলেন আমরিন বেগম। অনিকের দিকে চোখ পড়তেই তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন একমুহূর্তের জন্য। অনিকের পাশে ইকরাকে বসে থাকতে দেখে বলে ওঠেন,
“ কিরে? তোকে না ওদিকে সবাই ডাকছে? তাহলে এখানে বসে আছিস যে?”
ইকরা পরপর শুকনো ঢোক গিললো কয়েকটা। ভীতু চোখে তাকালো মায়ের দিকে। অথচ অনিক একেবারেই নির্বিকার। আমরিন বেগম মেয়ের উত্তরের অপেক্ষায় আছেন। ইকরা তা বুঝতে পেরেই খানিক জোরপূর্বক হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে। বলতে লাগলো,
“ ইয়ে মানে… আম্মু! আসলে আমার না মাথা ব্যাথা করছে। তাই ভাবলাম একটু দূরে এসে বসি নাহয়।”
আমরিন বেগম বিরক্ত হলেন বোধহয়। তার চোখেমুখে তো তাই স্পষ্ট! তিনি খানিক বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“ তোকে নিয়ে আর পারলাম না। হ্যা রে অনিক!”
অনিক নড়েচড়ে বসলো এবার। হাতের ফোনটা থেকে চোখ তুলে চাইলো ফুপুর দিকে। বললো,
“ হ্যা! কিছু বলবে?”
আমরিন বেগম আলতো হাসলেন। বললেন,
“ ওকে একটু দেখে রাখিস তো বাবা।এই মেয়ে আবার একটু সেনসিটিভ স্বভাবের। তাই আরকি…”
তার কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই বাঁকা হাসলো অনিক।আড়চোখে তাকালো ইকরার দিকে। পরক্ষণেই কেমন নিরেট কন্ঠে বলতে লাগলো ফুপুর উদ্দেশ্যে,
“ হ্যা অবশ্যই! ওকে তো আমিই দেখে রাখবো।”
আমরিন বেগম বুঝলেন না এহেন কথার গভীরতা। তিনি অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলেন,
“ কি?”
অনিক হকচকায়। আমতা আমতা করে বলে,
“ না মানে বলছিলাম আরকি… তুমি টেনশন নিও না। আমি দেখে রাখবো।”
আমরিন বেগম হালকা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে। তিনি যেতেই অনিক গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বসলো। ইকরার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে দুষ্ট হেসে বললো,
“ শেয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেবার ব্যাপারটা কিন্তু খারাপ না।তাই-না জান? ”
ইকরা আবারও ঢোক গিললো সামান্য। এই লোক যে কি শুরু করেছে তার সঙ্গে কে জানে! একটু শান্তি কি আর পাবেনা সে?
রৌদ্র নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে তার পাশে বসে থাকা ছোট্ট বউজানের পানে।মেয়েটার একহাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে রেখেছে সে। এদিকে অরিন বাকিদের সঙ্গে হাসছে কি নিয়ে যেন। রেহান এরইমাঝে পাশ থেকে রৌদ্রের কানে ফিসফিস করে বলে,
“ অল সেট!”
রৌদ্র হাসলো ঠোঁট কামড়ে। অরিন চোখ পড়লো সেই হাসির দিকে। মেয়েটা ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, — কি হয়েছে?
রৌদ্র মাথা নাড়ায় শুধু। মেয়েটার হাতটা খানিক টেনে এনে সেথায় আলতো চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা। অরিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। রৌদ্র সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যোত হতেই স্টেজের লাইটগুলো কেমন হুট করেই বন্ধ হয়ে গেলো! রৌদ্র থমকায়। হুট করে লাইট কাট হয়ে যাওয়ায় মেজাজ বিগড়ে যায় তার।সে যেই না গলা উঁচিয়ে কিছু বলতে যাবে ওমনি স্টেজে দেখা মিললো এক মৃদু গোলাকৃতি আলোর ছটাক। রৌদ্র সহ বাকিরাও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সেথায়।কিয়তক্ষন বাদেই ধীরে ধীরে স্টেজের লাইটগুলো আবারও অন হলো। পরক্ষণেই সকলের দৃষ্টি গেলো স্টেজের ওপর পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এহসান বাড়ির চার কর্তার দিকে। ওদিকে বক্সে সুর ধরেছে একটা পুরনো হিন্দি গানের — ও মেরে জোহরা যাবি….
গানের প্রথম লাইনটা বাজতেই চার ভাই নিজেদের ড্যাশিং ভাবসাব নিয়ে পেছনে তাকায়। প্রত্যেকের চোখে কালো কুচকুচে রঙের চশমা।তখনকার পড়ে রাখা চশমা থেকে এখনকার পড়ে রাখাগুলো খানিকটা ভিন্ন। কবির সাহেব ও তায়েফ সাহেবের চশমার গায়ে লেখা হয়েছে “Group Bride” অন্যদিকে সাব্বির সাহেব ও তাশরিক সাহেবের চশমায় লেখা “ Group Groom”
গানের দ্বিতীয় লাইন “ ও মেরে জোহরা যাবি,তুঝে মালুম নেহি! তু আবিতাক হে হাসি ওর মে জাবান…” বাজতেই কবির সাহেব একহাত জুবাইদা বেগমের দিকে তাক করে বাড়িয়ে দিয়ে লিপ সিন্ক করতে লাগলেন।তা দেখে বেচারি জুবাইদা বেগমের যেন জনসম্মুখেই কাশি উঠে গেলো আচমকা। ওদিকে পরবর্তী লাইনে সাব্বির সাহেবও করলেন একইরকম ভঙ্গিমা। রাফিয়া বেগম তৎক্ষনাৎ দাঁতে জিভ কেটে শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে বসলেন। অন্যদিকে রৌদ্র হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। বেচারা হয়তো ভাবতেও পারেনি এমনটা কোনোদিন হবে। ওসমান সিকদার নিজ আসনে বসেই বেয়াইদের নাচ উপভোগ করছেন।আমন্ত্রিত অতিথির মাঝ হতে কেউ কেউ বাহবা দিচ্ছেন,আবার কেউ কেউ অতি উল্লাসিত হয়ে দুয়েকবার শিস বাজিয়ে ফেলেছেন।
বাড়ির ছোটো সদস্যরা হাত তালি দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। অন্যদিকে এহসান বাড়ির কর্তারা গানের তালে তালে নিজেদের ভারি শরীরটা বহুকষ্টে নাড়াচ্ছেন।মাঝেমধ্যে দুয়েকবার কোমরও দোলাচ্ছেন তারা। গান যখন প্রায় শেষের পথে তখনি তাশরিক সাহেব দৌড়ে এলেন বড় ভাবিদের কাছে।হাত টেনে ধরলেন দু’জনের।উদ্দেশ্য তাদেরকেও স্টেজে উঠানো। রাফিয়া বেগম আর জুবাইদা বেগমতো এককথায় না বলে থেমেছেন তবুও তাশরিক সাহেবের জেদের কাছে তাদের হার মানতে হলো অবশেষে। তাদেরকেও নিয়ে যাওয়া হলো স্টেজে। সাব্বির সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন স্ত্রীর দিকে। তা দেখে আরেকদফা সিটি বাজলো যুবক-যুবতীদের মাঝে। পরিশেষে তাদের মিষ্টি খুনসুটিতে শেষ হলো নাচটা।
এটুকু নেচে-কুঁদেই বড্ড হাঁপাচ্ছেন কবির সাহেব ও সাব্বির সাহেব। তারা সকলেই এসে বসলো নিজ আসনে। কিয়তক্ষন বাদেই রৌদ্র গম্ভীর মুখে বাবার কাছে এসে দাঁড়ায়।হাত দিয়ে বাবার পালস রেট চেক করে গম্ভীর মুখে। বলে,
“ এই বয়সে এতো লম্প-ঝম্প করার কি আছে শুনি?”
কবির সাহেব গালভর্তি হাসি টানলেন।বেশ উৎফুল্লতার সাথে বললেন,
“ আমার ছেলের বিয়ে আর আমি নাচবোনা? এটা কি হয় নাকি রে ব্যাটা!”
“ যাইহোক… বয়সটা তো একটু দেখবে।”
ছেলের এরূপ কথায় যেন মুহুর্তেই তেতে উঠলেন কবির সাহেব। গলায় কপট ভাব ধরে বললেন,
“ ডাক্তার হয়েছো বলে আমার এইটুকু বয়স নিয়ে আমায় খোটা দিবে? শুনে রাখো ছেলে, আমার বয়স কিন্তু খুব একটা বেশি না। ঐ চুলগুলোতে একটু- আধটু পাক ধরেছে এই যা!”
রৌদ্র হাসলো ঠোঁট কামড়ে। বুঝলো তার বাবাকে বলে আর কোনো লাভ নেই। সে চুপচাপ বাবাকে পানি খাইয়ে চলে গেলো সেখান থেকে।
রাত ঘনিয়ে এসেছে ধীরে ধীরে। আজ মনের সুখে গা দুলিয়ে নেচেছে বাড়ির সকলে।আপাতত ক্লান্ত সবাই। স্টেজে সোফা পেতেছে ডেকোরেশনের লোকেরা।এবার রৌদ্রিনকে হলুদ ছোঁয়ানোর পালা। রৌদ্র এবং অরিনকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। বাড়ির সকলে একে একে হলুদ ছুঁইয়ে গিয়েছে তাদের গায়ে। আমন্ত্রিত অতিথিরা রৌদ্রের গায়ে হলুদ ছোঁয়ালেও অরিনের গায়ে ছোঁয়াতে পারেনি। পারবেই বা কিভাবে? রৌদ্র যে সাফ না করে দিয়েছে তার বউয়ের গালে হাত দিতে।সেটা কেবল তারই অধিকার। অগত্যা এমন কাঠখোট্টা কথায় ভড়কে গিয়েছিল সকলে।তবুও বাড়ির কর্তারা যেনতেন করে মেনেজ করে নিয়েছেন পুরো ব্যাপারটা।
গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হলো। অরিনকে নিয়ে যাওয়া হলো গোসল দিতে। রৌদ্রের সারা গায়েও লেপ্টে আছে হলুদ। অতিথিরা একে একে চলে গিয়েছেন। ডেকোরেশনের লোকজন গোছগাছ করছেন সবকিছু। ফুচকা স্টলের ছেলেদুটো কি নিয়ে যেন নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। এমন সময় সেথায় আগমন ঘটে রেহান আর অনিকের।তাদের দেখতে পেয়েই হাসি থামায় ছেলেদুটো। রেহান বাঁকা হেসে তাদের ডেকে বললো,
“ দুপ্লেট ফুচকা বানানো যাবে? খুব ঝাল দিয়ে? ”
ছেলেদুটো মাথা নাড়ায়। তৎক্ষনাৎ কাজে লেগে যায় আদেশ মোতাবেক। প্রায় মিনিট পাঁচেক লাগলো হয়তো ফুচকা সাজাতে। তারা ফুচকার প্লেটদুটো অনিক আর রেহানের দিকে এগিয়ে দিলো।রেহান একবার তাকালো প্লেটের দিকে। পরক্ষণেই ছেলেটা কেমন মুখ কুঁচকে বললো,
“ আরে ভাই! তোমাদের বললাম খুব ঝাল দিতে আর তোমরা তো দেখছি তেমন ঝালই দিলেনা। ধূরু! আরেকটু ঝাল এড করো মিয়া।”
ছেলেদুটো একবার নিজেদের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। পরমুহূর্তেই রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ স্যার! এটুকু খেতে পারলেই পেট জ্বলে যাবে নিশ্চিত। সেখানে আপনি আরও দিতে বলছেন?”
রেহান বাঁকা হাসলো। নিজ উদ্যোগে স্টলের ভেতর ঢুকে ঝালের কৌটাটা তুলে নিলো হাতে।পরক্ষণেই সেখান থেকে মুঠ ভরে ভরে শুকনো লংকা গুড়ো এবং কাঁচা মরিচ কুঁচি ঢেলে দিলো প্লেট দুটোর ওপর। ছেলেদুটোর মাথা বুঝি ঘুরে গেলো এসব দেখে। তাদের একবার ইচ্ছে হলো , রেহানকে বলতে — মরার এতো শখ থাকলে অন্যভাবে মরুক না। এতো ঝাল খেয়ে কেনো মরতে হবে রে ভাই? পরক্ষনেই মনের কথাগুলো মনেতেই রাখলো দুজন। আবারও মনে মনে বললো — যা মন চায় করুক।তাতে আমাদের কি?
রেহান নিজের কাজটা করে দিয়ে সন্তুষ্টির হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে। অনিককে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ কি মনে হয়? এটা ঠিক আছে? ”
অনিক স্মিত হাসলো। ছেলেদুটোর দিকে তাকিয়ে বললো,
“ পারফেক্ট!”
রেহান প্লেটদুটো নিয়ে সামনে এগোয়। দুকদম বাড়িয়ে আবারও পেছনে তাকায় সে।ছেলেদুটোকে হুট করেই বলে ওঠে,
“ আমার একটা ছোট্ট কাজ করে দিতে পারবে তোমরা? বিনিময়ে দশ হাজার দিবো।”
হুটহাট এরূপ উপরি ইনকামের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়ায় ছেলেদুটো। রেহান স্মিত হাসলো। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
“ এসো আমার সাথে।”
বদ্ধ গাড়ির গ্যারেজটিতে একপ্রকার ভ্যাপসা গন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ছেলেদুটো অবাক হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে বারবার। গ্যারেজে জ্বলজ্বল করছে হলদে রঙের টিমটিমে আলোর লাইট। লাইটটা একবার জ্বলছে আরেকবার নিভছে। টিমটিমে আলোর ছটাকে কোনরকমে দেখা যাচ্ছে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা কারোর অবয়ব। ছেলেদুটো খানিক ঢোক গিলে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“ ভাই.কেনো এনেছেন এখানে?”
রেহান হাতের ফুচকা গুলো ধরে রেখেই পেছনে তাকালো। বাঁকা হেসে শান্ত কন্ঠে বললো,
“ একটা কথা কি জানো? এই পৃথিবীতে লোভী মানুষদের খুব তারাতাড়ি বোকা বানানো যায়। এই যেমন তোমাদের বানানো গেলো!”
এহেন কথায় তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে দাঁড়ালো দু’জন। মুখের মাস্ক তাদের সরে গিয়েছে বহু আগে। তারা তৎক্ষনাৎ পেছন দিকে দৌড়ে যেতে লাগলেই অনিক গিয়ে গ্যারেজের দরজাটা আঁটকে দেয়। ছেলেদুটো এবার যেন কেঁদেই দিবে।তারা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে,
“ কেনো এনেছেন আমাদের? কি করেছি আমরা?”
অনিক কিয়তক্ষন চুপ থেকে শক্ত গলায় বললো,
“ তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর।যা!”
এরূপ কথায় ভড়কে যায় ছেলেদুটো। তড়িৎ পেছনে তাকায় তারা। পরক্ষণেই তারা মুখোমুখি হলো রৌদ্রের। রৌদ্র তাদের থেকে একহাত দুরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখের অবস্থা বেজায় শক্ত! ছেলেটা খানিক ক্রুর হেসে বললো,
“ আপ্যায়ন করতে এনেছি তোদের। আমার বউকে ঝাল খাওয়ানোর আনন্দে তোদের আপ্যায়ন করার শখ জেগেছে আমার।”
ছেলেদুটো অবাক হয় এরূপ কথায়। দু’জনার মধ্য থেকে একজন তৎক্ষনাৎ বলে ওঠে,
“ ভাই আমাদের কোনো দোষ নাই ভাই। বিশ্বাস করেন,আপনার বউ বলেছিলো ঝাল দিতে।”
রৌদ্র ক্রুদ্ধ চোখে তাকায় এবার। ছেলেটার চৌকস চোয়ালখানা যেন মুহুর্তেই ধারালো হয়ে এলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে বলতে লাগলো,
“ আসলেই তাই?”
ছেলেটা পরপর শুকনো ঢোক গিললো। নিজের করা শয়তানি গুলো মনে পড়তেই শরীর ঠান্ডা গেলো তার।অরিন যখন বলেছিলো ঝাল দিতে সে-তো তখন ইচ্ছে করেই অতিরিক্ত ঝাল দিয়েছিলো মেয়েটার প্লেটে। যাতে করে পরবর্তীতে পানি দেওয়ার উছিলায় একটু হলেও হাত ছুঁতে পারে মেয়েটার। এদিকে রৌদ্র আবারও ক্রুর হাসলো। একহাত পেছনে নিয়ে দু-আঙুলের ইশারায় রেহানকে ডাকলো সে।রেহানও তেমন কালবিলম্ব না করে প্লেট হাতে এগিয়ে আসে রৌদ্রের দিকে। রৌদ্র তখন ছেলেগুলোকে বলে,
“ এগুলো সব শেষ করবি এখন!”
এহেন কথায় মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো ছেলেদুটির। তারা বিস্ফোরিত নেত্রে তাকালো রৌদ্রের দিকে। মাথা পরপর দুপাশে নাড়িয়ে কান্না জুড়ে বলে,
“ মরে যাবো ভাই। সত্যি মরে যাবো।”
রৌদ্র ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে কাঁধ উঁচিয়ে তুলে খানিকটা। গা-ছাড়া ভাব ধরে কোমরের পেছন থেকে রিভলবারটা বের করে ছেলেদুটির মধ্যে একজনের কপাল বরাবর তাক করে বলে,
“ তাহলে মরে যা।”
ছেলেটা যেন এবার সত্যিই হার্ট অ্যাটাকে মরে যাবে। কপাল বরাবর বন্দুকের নল ঠেকালে কে-বা নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? কিয়তক্ষন বাদে রৌদ্র আবারও শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“ খাবি না মরবি?”
ছেলেদুটো তৎক্ষনাৎ দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো প্লেট দুটোর ওপর। চোখবুঁজে একটা ফুচকা মুখে দিতেই যেন নিশ্বাস আঁটকে আসছে তাদের। ওরে ঝাল রে! পেটের নাড়িভুড়িও যেন জ্বলে যাবে এবার। ছেলেদুটো তৎক্ষনাৎ মুখ থেকে ছিটকে বের করে ফেলে ফুচকাটা।তা দেখে রৌদ্র শক্ত মুখে এগিয়ে এসে প্রথম ছেলেটার ঘাড় চেপে ধরে। ছেলেটার পায়ের দিকে লাথি বসাতেই ছেলেটা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মাটিতে। রৌদ্র একহাতে ছেলেটার ঘাড় চেপে ধরে অন্যহাতে কয়েকটা ফুচকা তুলে সেগুলো সজোরে চেপে ধরে ছেলেটার মুখ বরাবর। ছেলেটা কাতরাচ্ছে ব্যাথায়,ঝালে।অথচ সেদিকে বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া নেই রৌদ্রের।সে-তো ব্যস্ত নিজের বউজানের কষ্টের বদলা নিতে।
প্রায় মিনিট দশেক পর এতোগুলো ঝাল খেয়ে প্রায় অর্ধজ্ঞান হারিয়ে বসে আছে প্রথম ছেলেটা।অন্যদিকে দ্বিতীয় ছেলেটাও ভয়ে নিজে থেকেই কোনমতে গিলছে ফুচকাগুলো। সবগুলো যখন প্রায় শেষের পথে তখনি বেচারা হড়হড় করে মুখ ভরে বমি করে দিলো মেঝেতে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত দেহটা নিয়ে সেথায় গড়িয়ে পড়লো আলগোছে। তা দেখে রৌদ্র বাঁকা হাসলো। অনিক আর রেহানের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বললো,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৭
“ হেই বাডিস! আমি কি ওদের মেরেছি?”
রেহান দুপাশে মাথা নাড়ায়। রৌদ্র তখন গা-ছাড়া ভাব নিয়ে ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বললো,
“ তাহলে তো আমি ভদ্র ছেলে! বউজানকে দেওয়া কথাটা রেখেছি।কারো গায়ে হাত তুলিনি…. তাই না?”
শেষের কথাটা টেনে টেনে বললো রৌদ্র। এদিকে তার এহেন কথা বলার ভঙ্গি দেখে না চাইতেও হেসে দিলো অনিক আর রেহান। মনে মনে হয়তো বললো তারা,
“ এই পাগল আর শুধরাবে না!”