সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৮
Jannatul Firdaus Mithila
“ কোথায় ছিলে তুমি?”
বাবার কথায় পাদু’টো হুট করেই থেমে গেলো রৌদ্রের। কবির সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ছেলের পানে।কোমরের পেছনে দু’হাত গুঁজে তিনি কেমন গম্ভীর হয়ে আছেন! ছেলেকে ওমন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি ফের খেঁকিয়ে বললেন,
“ কি জিজ্ঞেস করলাম? কথা বলছো না কেনো?”
রৌদ্র এবার চোখ তুলে। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে সামান্য কাঁধ উঁচিয়ে বলে,
“ কোথায় আর যাবো? নিচেই ছিলাম। বউটা তো আর কাছাকাছি নেই, যার জন্য সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকবো!”
এহেন কথায় হুট করেই কপালে দু-তিনেক ভাজ পড়লো কবির সাহেবের। তিনি চোয়াল শক্ত করে ছেলের দিকে তাকালেন। কটমট করতে করতে বললেন,
“ কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো সেটা মাথায় রাখো নির্লজ্জ ছেলে। কথায় কথায় বউ বউ করতে লজ্জা লাগেনা তোমার?”
রৌদ্র ভ্রু কুঁচকায়। মুখ কুঁচকে একরাশ অনিহার সুরে বলতে থাকে,
“ লজ্জা? ওটা আবার কি জিনিস? খায় নাকি মাথায় দেয় আব্বু? তাছাড়া আমিতো কোনো চুরি-ডাকাতির কথা বলছিনা যে লজ্জা পাবো। আমি স্রেফ নিজের বাচ্চা বউটার কথা বলছি।”
কবির সাহেব মুখ কুঁচকে ফেলেন সঙ্গে সঙ্গে। ছেলের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই রৌদ্র কেমন দু’হাত দুদিকে ছড়িয়ে মিছে মিছে আর্তনাদ করে বলে ওঠে —
“ দাও,দাও! তোমার ঐ চোখের আগুনেই ঝলসে দাও আমায়।বউটাকে তো আর দিচ্ছোনা।এর পরিবর্তে নাহয় ঝলসেই দাও।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ছেলের এহেন নাটকীয় ভাবসাব দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন কবির সাহেব। বেচারা কি বলবেন তাই যেন ভাবছেন সময় নিয়ে। কিয়তক্ষন যেতেই তিনি কেমন ক্ষীণ স্বরে বললেন,
“ ভুল হয়েছে আমার।তোমাকে ডাক্তার না বানিয়ে একটা অভিনেতা বানানো উচিৎ ছিলো।অন্তত অল্প বয়সেই নিজের এরূপ নাটক দেখিয়ে বেশ নাম করতে!”
রৌদ্র বাঁকা হাসলো। গা-ছাড়া ভাব নিয়ে পাজামার পকেটে দু’হাত গুঁজে বললো,
“ হলেও হয়তো মন্দ হতোনা আব্বু।এমনিতেও আমার চেহারা সুরত কিন্তু মাশাআল্লাহ। শত হলেও মায়ের ছেলে বলে কথা!”
শেষ কথাটা খানিক টেনে টেনে বললো রৌদ্র। তা দেখে কবির সাহেব রাগে কেমন ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন। দাঁতে দাঁত চেপে ছেলের দিকে শক্ত দৃষ্টি ফেলে চলে গেলেন সেখান থেকে। তিনি যেতেই রৌদ্র হাঁফছেড়ে বাঁচলো। ভাগ্যিস সে আগেভাগেই গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে। নাহলে যে কি হতো!
রৌদ্র অরিনের রুমের পাশ দিয়ে যেতে নিলেই তার অবচেতন মনটা কেমন বউ বউ করে উঠলো যেন। সে বেশ করে চাইলো, এখন আর দেখবেনা বউটাকে কিন্তু তার বেহায়া মন কি আর ওতো কথা শোনে? সেতো সারাক্ষণই বউ বউ করে! এই যেমন এখন করছে। রৌদ্র পা টিপে টিপে মেয়েটার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়।হালকা ভিড়িয়ে রাখা দরজাটা দিয়ে খানিক উঁকি ঝুঁকি দেয় ভেতরে। ঠিক সেই মুহুর্তেই কেউ একজন এসে হুট করে দরজাটা ভেতর থেকে টান দিয়ে খুলে দেয়। বেচারা রৌদ্র উঁকি দিয়ে থাকার দরুন খানিকটা হেলে পড়ে সামনের দিকে। পরক্ষণেই সে তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়ায়। চোখ তুলে চায় সম্মুখে। দেখে, রুহি আর আমরিন বেগম কেমন সরু চোখে তাকিয়ে আছে তার পানে। রৌদ্র ঢোক গিললো সামান্য। ঠোঁটের কোণে হাসি টানলো জোরপূর্বক। আমরিন বেগম গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
“ এখানে কি?”
পাশ থেকে রুহিও তৎক্ষনাৎ একই ভঙ্গিমায় জিজ্ঞেস করে বসে, “ কি চাই?”
রৌদ্র কিছুক্ষণ দোনোমোনো করে অবশেষে বললো,
“ ইয়ে মানে….সানশাইন.. আই মিন অরি কই?”
আমরিন বেগম একপলক গম্ভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন।পরক্ষণেই ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে ছেলেটাকে বললেন,
“ এতোটা অধৈর্য্য হওয়া ঠিক না রোদ। এইতো আর একটা দিনের ব্যাপার।তারপর নাহয় মন ভরে দেখিস মেয়েটাকে! কেমন?”
রৌদ্র ভেতর ভেতর অসন্তুষ্ট হলেও বাইরে থেকে মুখাবয়ব একেবারেই শান্ত রাখলো।হালকা মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেলো গটগট পায়ে। নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো আলগোছে। বিছানায় বসা মাত্র ফুপুর বলা কথাটা স্মরণ হতেই সে হেসে ফেললো আনমনে।দু’হাত ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বিরবির করে বললো,
“ এপর্যন্ত আমি যে ঠিক কতোবার ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়েছি ফুপিজান..তা যদি আপনি জানতেন, তাহলে এক্ষুণি বউটাকে দিয়ে দিতেন আমার কাছে।”
কথাটা বলেই রৌদ্র তাকালো সিলিংয়ের দিকে।কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকতেই কল্পনার মানসপটে অরিনের মুখাবয়ব স্পষ্ট হলো যেন। রৌদ্র হাসলো একটুখানি। আনমনে বিরবির করে বললো,
“ রাতটা কেন এতো দীর্ঘ লাগছে সানশাইন?”
কল্পনার অরিন হাসছে শুধু। রৌদ্র আলগোছে চোখ দুটো বুঁজে ফেলে। বুক ভরে নিশ্বাস টেনে শান্ত কন্ঠে বলে,
“ ঠিক আছে ব্যাপার না।আজকের রাতটা নাহয় আমার জন্য দীর্ঘ থাক। আগামী রাতটা তোর জন্য দীর্ঘ করার দায়িত্বটা নাহয় আমার থাকলো।”
সকাল গড়িয়ে বেলা হচ্ছে ধীরে ধীরে। এহসান বাড়িতে শুরু হয়েছে একপ্রকার ছুটোছুটি। বাড়ির পুরুষ সদস্যরা সেই সকাল থেকে একবার কমিউনিটি সেন্টারে তো আরেকবার বাড়িতে ছুটছেন।অনিক বেচারার তো আজ বসবার মতো ফুরসত নেই। ছেলেটা কেমন নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে ছুটোছুটি করছে এদিক ওদিক।
বাড়িভর্তি মানুষজনের ঢল। এহসান বাড়ির গৃহিনীদের আত্মীয় স্বজনরা সকলে এসে উপস্থিত হয়েছেন ইতোমধ্যে। জুবাইদা বেগম আর রাফিয়া বেগম মিলে দু-তিনজন হেল্পিং হ্যান্ড নিয়ে দুপুরের রান্নাটা সেরে নিচ্ছেন।বিয়ে তো রাতে পড়ানো হবে কমিউনিটি সেন্টারে, সে অব্ধি বাড়ির মেহমানদের খানা-পিনার দায়িত্বটা যে তাদের উপরেই বর্তায়। রাইসা বেগম ও মাইমুনা বেগম একটু পরপর গিয়ে মেহমানদের প্রয়োজন দেখছেন। পাছে না আবার কার কি লেগে বসে! অন্যদিকে, বাড়ির মেয়েরা বুঝি একপ্রকার হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে নিজেদের সাজগোজ নিয়ে। একটু পরেই সবাই বেরোবে পার্লারের উদ্দেশ্যে। অরিনকেও নিয়ে যাওয়া হবে পার্লারে।গতকাল মেয়েটাকে সাজাতে গিয়ে যা হলো! সে কথা কি আর ভুলবে কেউ?
বিছানার মাঝ বরাবর গোল হয়ে বসে আছে অরিন। তার চারদিক ঘিরে রেখেছে আত্মীয় স্বজনরা। প্রত্যেকে তাকে নিয়ে সে-কি আহ্লাদী মশকরা করছে! কেউ কেউ বিরতিহীনভাবে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে বিব্রত করছে মেয়েটাকে।অরিন না পারতে উত্তর দিচ্ছে সকলকে। আত্মীয় স্বজন কিনা! কথা না বললে আবার পাছে কি না-কি বলে বসে কে জানে! তাছাড়া মেয়েটা প্রায় ঘন্টা তিনেক ধরে বসে আছে একই জায়গায়, একই ভঙ্গিমায়। এইবার যেন কোমর আর পিঠও ব্যাথা হয়ে আসছে তার। তবুও একচুল নড়তে দিচ্ছেনা তাকে কেউ। অরিন যে কাউকে ডাকবে তাঁরও তো সুযোগ নেই। সবাই বোধহয় ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে। রৌদ্র ঘুম ছেড়ে উঠেছে মিনিট দশেক হবে। ছেলের আজ বিয়ে, সে বেলা করে ঘুমাবেনা
তো কে ঘুমাবে শুনি? রৌদ্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ে গটগট পায়ে। অরিনের রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় নিজের বরাবরের স্বভাব বশত আজও খানিক উঁকি দিয়ে বসে ছেলেটা। কিন্তু পরমুহুর্তেই ঘরের ভেতরকার পরিবেশ দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। সে চোয়াল শক্ত করে ঘরে ঢুকে। তাকে দেখেই রাইসা বেগমের বড় ভাবি টিপ্পনী কেটে বলে ওঠেন,
“ কিগো রোদ? এখনি বউয়ের কাছে চলে এলে যে।বলি একটুতো… ”
বাকিটা আর শেষ করতে দিলোনা রৌদ্র। তার আগেই সে কোমরের ওপর দু’হাত রেখে কর্কশ গলায় বললো,
“ এখানে কি কোনরকম সার্কাস হচ্ছে? আপনারা এর আগে আমার বউজানকে দেখেননি? নাকি বিয়ের উদ্দেশ্যে ওর আলাদা করে রুপ বেড়েছে যার জন্য এভাবে দলবেঁধে আমার বউকে পুতুলের মতো বসিয়ে রেখেছেন নিজেদের সামনে! উঠুন আপনারা.. আমি বলছি এক্ষুণি উঠুন।”
অগত্যা এমন কাঠখোট্টা কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলেন সকলে। প্রত্যেকে হয়তো রৌদ্রকে মনে মনে বেয়াদবের তকমাও দিয়ে বসেছেন ইতোমধ্যে। তবে এতে রৌদ্রের কিছু যায় আসলে তো! সে-তো শুধু নিজের বউজানের কষ্ট বোঝে,এছাড়া আর কিছুই নয়। আত্মীয় স্বজনরা একে একে মুখ বাকিয়ে চলে গেলেন রুম থেকে। ঘর খালি হতেই রৌদ্র এগিয়ে আসে মেয়েটার কাছে। নিঃশব্দে বসে পড়ে পাশে।অরিনটা মুচকি মুচকি হাসছে তাকে দেখে। রৌদ্র আলতো করে হাত রাখলো মেয়েটার গালে।নরম গলায় শুধালো,
“ কতক্ষণ ধরে বসেছিলি জানবাচ্চা?”
অরিন তৎক্ষনাৎ আহত সুরে জবাব দিলো, “ তিন ঘন্টা!”
রৌদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে আবারও। হাতদুটোও অলক্ষ্যে মুঠোবন্দি হয়ে যায় আপনাআপনি। রৌদ্র কিছুটা সময় নিয়ে নিজের রাগটাকে কোনমতে সংবরণ করে খেঁকিয়ে বললো,
“ তোর মুখ নাই?নিজে থেকে বলতে পারিসনি তোর কষ্ট হচ্ছে? যত্তসব ঢং করতে বসছিস এখানে?”
অরিন ওপর নিচ মাথা নাড়াতে গিয়েও থেমে গেলো হুট করে। এই যাহ! ভুলবশত কি করতে বসেছিলো তা ভাবতেই দাঁতে জিভ কাটলো অরিন। নিজেকে শুধরে ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে গালভর্তি হাসি দিলো মেয়েটা। রৌদ্র অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো। ভাবা যায়, মেয়েটা দিনকে দিন কি পরিমাণে পাজিঁ হচ্ছে! এ ক’দিনেই বেশ কায়দা করে শিখে ফেলেছে রৌদ্রের রাগ নামানোর উপায়। এই যে এখন যেমন কায়দা করে নিজের মন ভোলানো হাসি দিয়ে ছেলেটার রাগগুলোকে কেমন হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো! রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো তৎক্ষনাৎ। মেয়েটার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে দুষ্ট হেসে বললো,
“ আমাকে ঠান্ডা করার মন্ত্র শিখে ফেলেছিস দেখছি! নট ব্যাড!”
বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। অরিন রেডি হচ্ছে পার্লারে যেতে।ড্রয়িং রুমে রাইসা বেগম ও মাইমুনা বেগম অপেক্ষা করছেন তারজন্য। অরিন তড়িঘড়ি করে মাথায় ওড়নাটা সেট করেই রুম থেকে বেরিয়ে আসে।সিঁড়ির দিকে দু-কদম এগিয়ে যেতেই রৌদ্র এসে হুট করে আকড়েঁ ধরে তার কোমর। অরিন ভড়কে তাকায় এরূপ কান্ডে। রৌদ্র গভীর চোখে তাকিয়ে আছে তার পানে। অরিন খানিকটা সময় নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,
“ কি হয়েছে? এভাবে পথ আটকালেন কেনো?”
রৌদ্র নিশ্চুপ। তার গভীর দৃষ্টি যেন ছুয়েঁ যাচ্ছে মেয়েটার সারা মুখমণ্ডল। সে কিছুটা সময় নিয়ে অরিনের গালে হাত রাখলো।বৃদ্ধ আঙুলটা মেয়েটার ঠোঁটের কোণে আলতো স্লাইড করতে করতে বললো,
“ বেশি সাজবে না বউজান। আর খবরদার, মাথায় কোনো ক্লিপ জাতীয় কিছু লাগাবেনা।আমি আমার বাসর ফেলে ওসব খুলতে-টুলতে সময় নষ্ট করতে পারবোনা। আর হ্যা…!”
থামলো রৌদ্র। একমুহূর্ত চেয়ে থাকলো মেয়েটার দিকে। পরক্ষণেই মুচকি হেসে বললো,
“ সাবধানে যেও কেমন?”
অরিন আলতো করে মাথা কাত করে। হালকা হেসে বলে,
“ আর কিছু?”
রৌদ্র কপট ভাবুক হলো।পরমুহূর্তেই বাঁকা হেসে মেয়েটাকে চোখ মেরে বললো,
“ রাতে বলবো। ওপস..ওয়েট ভুল বললাম।রাতে করবো অনেক কিছু!”
অগত্যা এহেন কথায় মুহুর্তেই সারামুখে এক আকাশসম লজ্জা এসে ভিড় জমালো মেয়েটার। সে তৎক্ষনাৎ নিজের মাথা নুইয়ে বিরবির করে বললো,
“ অসভ্য মানুষ!”
বিরবির করে বলা কথাটাও বেশ কানে গেলো রৌদ্রের। সে তৎক্ষনাৎ মেয়েটার কোমর ছেড়ে দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়ায়।অরিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য একপা বাড়িয়ে আবারও কি মনে করে পিছিয়ে এসে টুপ করে চুমু খেয়ে বসে মেয়েটার ফোলা ফোলা ডান গালটায়। ফিসফিস করে বলে,
“ রাতে দেখাবো অসভ্য কাকে বলে।”
কথাটা বলে আর একমুহূর্তও দাড়ালোঁ না রৌদ্র। তৎক্ষনাৎ পা চালিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। এদিকে হতবাক অরিন লজ্জালু ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। বিরবির করে বলছে,
“ শুধু অসভ্য না, এই লোক চরম মাত্রায় নির্লজ্জ!”
সন্ধ্যার পর থেকেই কমিউনিটি সেন্টারের গেটটা ঝলমল করছে। চারপাশে ঝুলছে হরকরকমের রঙিন ফেয়ারি লাইট। বাইরের বড় ব্যানারে সোনালি রঙের টাইপোগ্রাফি দিয়ে লেখা হয়েছে — রৌদ্রিন!
চারপাশে অতিথিদের ভিড়। কবির সাহেব এবং তার ভাইয়েরা মিলে একে একে সকলের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করছেন। এহসান বাড়ির সকল আত্মীয় স্বজনরাও চলে এসেছেন ইতোমধ্যে। জুবাইদা বেগম হালকা সাজে সজ্জিত আজ।গায়ে জড়িয়েছেন খয়েরী রঙের জামদানী শাড়ি। রাইসা বেগমও বান্ধবীর সাথে তাল মিলিয়ে একই রঙের শাড়ি পড়েছেন।সাজের দিক থেকেও তো একইরকম লাগছে দু’জনকে। আশেপাশের লোকজন আড়চোখে বেশ কয়েকবার তাকিয়েছেন দু’জনের দিকে।
রেহান আজ সেজেছে নীল রঙের পাঞ্জাবিতে।সুদর্শন যুবককে আজ যেন আরও বেশি সুন্দর লাগছে। বেচারা একহাতে বউয়ের পার্স এবং অন্যহাতে বউয়ের জুতো নিয়ে বউয়ের পেছন পেছন ঘুরছে। আশেপাশের মানুষ তার দিকে তাকিয়ে থাকলেও সে থোড়াই পাত্তা দিচ্ছে তাদের! রুহি নিজের পরনের ভারি কারুকাজে সজ্জিত নীল রঙের লেহেঙ্গাটার দুপাশ ধরে ধরে হাঁটছে। মেয়েটার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ।এমনিতেই নিজের জান নিয়ে চলতে পারছেনা মেয়েটা, তারওপর আবার এতোভারি একটা লেহেঙ্গা পড়েছে! এ নিয়েই যেন বিরক্তির শেষ নেই মেয়েটার। রুহি মুখ কুঁচকে রেস্টরুমের দিকে পা বাড়ায়। সেখানে গিয়েই সবার আগে লেহেঙ্গার দুপাশ ছেড়ে দিয়ে, ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে পাশের সোফাটায় গা এলিয়ে বসলো মেয়েটা। রেহানও বসলো বউয়ের পাশে। হাত থেকে বউয়ের জুতো এবং পার্সটা পাশে রেখে, রেহান এগিয়ে যায় অদূরের টেবিলের দিকে। সেখান থেকে গ্লাসভর্তি পানি এনে বউয়ের দিকে এগিয়ে দেয়। রুহি ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। রেহান মুচকি হাসলো খানিকটা। তা দেখে রুহিটা কেমন খেকঁ খেকঁ করে ওঠে তৎক্ষনাৎ।বলে,
“ আমায় এতো সমস্যায় ফেলে তুমি আবার হাসছো? জানো আমি এখন অসুস্থ। তারওপর এতো ভারি লেহেঙ্গাটাকে ক্যারি করা কি আর চাট্টিখানি কথা? আমিতো নিজের শরীর নিয়েই নড়তে পারছিনা কোথাও।তারওপর এই উটকো ঝামেলা! কোথায় যাবো আমি?”
রেহান মনোযোগ দিয়ে শুনলো বউয়ের কথা। পরক্ষণেই ছেলেটা কেমন মুচকি হেসে বউকে পানিটা খাইয়ে দেয় যত্ন করে। রুহির পানি খাওয়া শেষ হতেই সে আলতো করে মেয়েটার মাথা চেপে ধরে নিজের বুকের মাঝে। রুহির মাথায় নরম হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বলতে থাকে,
“ বউ! আমিতো তোমায় আগেই বলেছিলাম এটা না পড়তে। কিন্তু সেই তুমিই তো জেদ ধরলে, সবার থেকে প্রিটি দেখাতে হবে তোমাকে। তাইতো তুমি নিজে যেচে পড়ে এই লেহেঙ্গাটা নিলে।তখন কি আমার বারণ শুনেছিলে একবারও? সে যাকগে… তুমি চাইলে এখনি এটা চেঞ্জ করে ফেলতে পারো।আমি নাহয় নরমাল একটা লেহেঙ্গা নিয়ে আসি?”
রুহি থমকায়। তৎক্ষনাৎ মাথা তুলে তাকায় রেহানের দিকে। আশ্চর্য! সে-তো ভুলেই বসেছিলো —লেহেঙ্গাটা সে নিজেই কিনেছে। আবার পড়েছেও একপ্রকার জেদ করে।তারপরও সে-কিনা রেহানকে এভাবে দোষারোপ করলো! রুহি নিজের করা কৃতকর্মের প্রতি ভিষণ লজ্জিত হলো।কাঁদো কাঁদো মুখ করে রেহানের দিকে চাইতেই বেচারা যেন অস্থির হয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ। সে তড়িঘড়ি করে মেয়েটার দুগালে হাত রেখে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ এই শ্যামবতী! কি হয়েছে তোমার? আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো? আচ্ছা.. আচ্ছা বউ সরি! এই যে.. কানে ধরছি আমি।”
কথাটা বলেই রেহান নিজের দু-কানে আঙুল চেপে ধরলো।আকুতিভরা কন্ঠে ফের বললো,
“ প্লিজ বউ মন খারাপ করোনা। আমি মানছি সব ভুল আমার। একদম আমার।আমার উচিত হয়নি তোমাকে এভাবে বলা। আর বলবোনা বউ।তুমি আমায় বকো,দরকার পড়লে মারো।তবুও কেঁদো না প্লিজ! ও বউ! শুনছো? কেঁদো না প্লিজ!”
রুহি আর ধরে রাখতে পারলোনা নিজেকে। সে ফট করে জড়িয়ে ধরলো রেহানকে।রেহানও মেয়েটাকে নিজের বুকে আগলে নিলো আলগোছে। রুহি নাক টেনে বলতে লাগলো,
“ আমার দোষ জেনেও সবটা নিজের কাঁধে নিলে কেনো তুমি?তুমিতো বলতে পারতে সব দোষ আমার।”
রেহান হাসলো খানিকটা। মেয়েটার মাথা বরাবর ঠোঁটের পরশ একেঁ দিয়ে আদুরে কন্ঠে বললো,
“ দোষ? তাও আবার আমার শ্যামবতীর? উঁহু! এটা কোনোদিন হতেই পারেনা!”
রুহি হেসে ফেললো এহেন কথায়। রেহানের বুকের মাঝে মাথা লুকিয়ে শান্তির নিশ্বাস টানলো। মনে মনে বলেই ফেললো,
“ তোমায় বড্ড ভাগ্য করে পেয়েছি রেহান!”
আমরিন বেগম তার পরিবারসহ মাত্রই এসে পৌঁছালেন সেন্টারে। ইকরা আর ইফতি হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে। বেচারা ইফতি বোনের পরনের নীল রঙা লেহেঙ্গাটা ধরে ধরে হাঁটছে। বারকয়েক মুখ কুঁচকে বলেই বসেছে,
“ যেটা সামলাতে দু-তিনজন এক্সট্রা মানুষ লাগে,সেটা পড়তে যাস কেনো রে? সবাইকেই কেনো সুন্দর লাগতে হবে? দু-একজন বান্দরের মতো থাকলে কি’বা হবে?”
অগত্যা এমন কথায় মুহুর্তেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ইকরা।ভাইয়ের দিকে তাকায় গিলে ফেলবে এমন দৃষ্টিতে। ইফতি এহেন দৃষ্টি দেখে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিলো। লেহেঙ্গার একাংশ ধরে হাটতে হাটতে ফের বললো,
“ উচিৎ কথার দাম নেই তাই-না?”
এইবার আর চুপ করে থাকতে পারলোনা ইকরা।সে মুখ ফুটে কন্ঠে একরাশ ঝাঁঝ ঢেলে বলেই ফেললো,
“ বান্দার কেয়া জানে আদরাক কা সোয়াদ! তোর জন্য একথাটা একেবারেই প্রযোজ্য। বাকিটা আর ভেঙে বললাম না।কেননা বুদ্ধিমানদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট!”
তেতে উঠে ইফতি। কপাল কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
“ তুই আমাকে ইন্ডাইরেক্টলি বান্দর বললি?”
ইকরা হাত বাড়িয়ে ইফতির হাত থেকে লেহেঙ্গার অংশটা ছাড়িয়ে নেয়।তারপর বাঁকা হেসে বলে,
“ এনি ডাউট মিস্টার বান্দর? আর হ্যা…আমি তোকে ইন্ডাইরেক্টলি নয় একদম ডাইরেক্টলি বান্দর বলছি। বুঝলি?”
কথাটা বলেই ইকরা চলে গেলো গটগট পায়ে। এদিকে ইফতি দাঁড়িয়ে থেকে ফুঁসছে রীতিমতো। কিছুক্ষণ পরেই সে কেমন বিরবির করে বললো,
“ একবার শুধু হাতের কাছে পাই তোরে। থাপড়িয়ে জামাই বাড়ি পাঠিয়ে দিবো।”
“ কাকে কোথায় পাঠাবেন?”
পেছন থেকে ভেসে আসা পরিচিত কন্ঠে তৎক্ষনাৎ সেদিকে তাকায় ইফতি।মাহিরা হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটা বোধহয় তার কাঙ্ক্ষিত উত্তরের অপেক্ষায়! ইফতি সামান্য হেসে বলে ওঠে,
“ না তেমন কিছু না।”
বলেই ইফতি চোখ ঘোরায় অন্যপাশে।তক্ষুনি তার চোখ আঁটকে যায় সম্মুখের টেবিলে বসে থাকা আহিরার পানে।যে কিনা আপাতত ঈগল দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে। ইফতি খানিক ঢোক গিললো। বুকের কাছটায় নিজ অজান্তেই ডলতে লাগলো ঘনঘন। মাহিরা ভ্রু কুঁচকায় তা দেখে। সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করে,
“ কি হলো আপনার? বুক ডলছেন কেনো?”
এহেন কথায় তৎক্ষনাৎ থেমে গেলো ইফতি।মাহিরার কথামতো নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাত ফেলে ছেলেটা। অতপর গবেটের মতো ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বললো,
“ না ঐ আরকি.. একটু গরম লাগছিলো।”
মাহিরার চোখেমুখে স্পষ্ট বিভ্রান্তি। তবুও মেয়েটা চুপ করে রইলো। এদিকে ইফতির অবস্থা বেগতিক। আহিরা যেভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে, এতে সে দুশো পার্সেন্ট নিশ্চিত আজ এই মেয়ে তাকে কিছু একটা করবেই।
কমিউনিটি সেন্টারের দেয়ালে ঝুলছে ফুলের ঝাড়। ছাদ থেকে ঝুলছে ঝলমলে ঝাড়বাতি। হলের একপাশে সাজিয়ে রাখা খাবারের সুবাসে চারপাশ মো মো করছে। অন্য পাশে ফটোগ্রাফারের টিম দাঁড়িয়ে আছে। বর-কনে এলেই বুঝি তারা কাজ শুরু করে দিবে। ড্রোন ক্যামেরা ঘুরছে সেন্টারের উপর দিয়ে।
ইকরা লেহেঙ্গা উঁচিয়ে হাঁটছে এদিক ওদিক। তার ক্লান্ত চোখদুটো হন্যে হয়ে খুঁজছে কাউকে।কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটা যে কোথায় আছে কে জানে! ইকরা উদাস মনে স্টেজের পাশে দাঁড়ায়। ঠিক তখনি অনিক এসে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“ আমায় খুঁজছেন মায়াবতী?”
ইকরা হকচকিয়ে পেছনে তাকায়। অনিক হাসছে মিটিমিটি। ইকরা তৎক্ষনাৎ বুকে হাত দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলে,
“ এভাবে কেউ পেছন থেকে ডাক দেয়?”
অনিক কপট ভাব ধরলো।অবুঝের ন্যায় টেনে টেনে বললো,
“ ভয় পেলে বুঝি? এটুকুতেই এতো ভয়?”
ইকরা প্রতিত্তোরে মৌন রইলো। এদিকে অনিক গভীর চোখে পরোখ করতে লাগলো মেয়েটাকে। ইকরাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সে তৎক্ষনাৎ নিজের চোখদুটো বন্ধ করে নেয়।ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ফেলে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,
“ একটু পরেই হয়তো পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে তোমায় মায়াবতী!”
ইকরা হতবুদ্ধিকর ভাব নিয়ে তাকায়।পরপর বিচলিত হয়ে বলে,
“ কেনো কেনো? আমি আবার কি করলাম?”
অনিক আস্তে করে চোখ দুটো খুললো।মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট পিষে হাসলো।পরক্ষণেই বললো,
“ তোমাকে দেখে আমার মতো দূর্বল হৃদয়ের মানুষের ফিট খাওয়া ব্যাপারমাত্র। তাই আমার কিছু হয়ে গেলে পুলিশ নিশ্চয়ই তোমায় ছেড়ে দেবে না! ”
এতক্ষণে সবটা বোধগম্য হলো ইকরার।মেয়েটা লজ্জালু হেসে মাথা নিচু করে নিলো আলগোছে। লজ্জার মাথা খেয়ে মুখ ফুটে বলেই বসে,
“ আপনিইবা কম কিসে?”
অবশেষে অরিনের সাজসজ্জা শেষ হলো। মেয়েটাকে সাজিয়ে বিউটিশিয়ান নিজেই কিয়তক্ষন তব্দা খেয়ে তাকিয়ে রইলেন।মেয়েটাকে তো খুব বেশি সাজাননি তিনি।তারপরও কেনো ওর ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছেননা তিনি। বিউটিশিয়ান ক্যামেলা অরিনের থুতনিতে আলতো করে হাত রাখলেন। আয়নায় চোখ রেখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ ইউ আর গর্জিয়াস ইন ইউর ওউন ওয়ে ডিয়ার।”
অরিন ধীরে ধীরে নিজের নামিয়ে রাখা চোখটা আলতো করে রাখলো আয়নার ওপর। নিজেকে এরুপ বউসাজে দেখে একমুহূর্তের জন্য থমকে গেলো মেয়েটা! কিয়তক্ষন বাদেই সে কেমন কন্ঠ খাদে নামিয়ে বিউটিশিয়ানকে বললো,
“ উইল হি লাইক ইট?”
বিউটিশিয়ান মুগ্ধ হাসলেন। ফটাফট বললেন,
“ ইনডিড।”
অরিন মুচকি হেসে মাথা নিচু করে নিলো। এমন সময় রাইসা বেগম অরিনের দিকে না তাকিয়েই দ্রুত কদমে সেখানে এসে বলেন,
“ কই হলো সাজানো?”
অরিন তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ায়। হাসিমুখে রাইসা বেগমকে বলে,
“ দেখো তো কেমন লাগছে আমায়?”
রাইসা বেগম ব্যস্ত চোখেই তাকালেন একপলক। তাতেই যেন চোখ আঁটকে গেলো তার। তিনি খানিক বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন মুখোমুখি হয়ে। আলতো করে মেয়েটার থুতনিতে দুআঙুল ঠেকিয়ে বললেন,
“ মাশাআল্লাহ! পরি লাগছে মা।”
অরিনকে ধরে ধরে নিয়ে আসা হলো বিউটি পার্লারের বাইরে।মেয়েটার গলা অব্দি ঢেকে রাখা লম্বা ঘোমটায়। মাইমুনা বেগম অরিনের লেহেঙ্গাটা ধরে ধরে সামনে এগোচ্ছেন।আনমনেই রাস্তার ওপারে একপলক চোখ যেতেই থমকে গেলেন তিনি। মাইমুনা বেগম বিভ্রম নিয়ে তাকালেন আরেকবার। চোখবুঁজে আবারও খুলে সেথায় তাকালেন। নাহ..এবারেও একি দৃশ্য দেখছেন তিনি। রাস্তার ওপারে বিয়ের শেরওয়ানি গায়ে, বুকের কাছে দুহাত বেধেঁ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র। তার নিষ্পলক দৃষ্টি এখানেই নিবদ্ধ। মাইমুনা বেগম হতভম্বিত কন্ঠে রাইসা বেগমকে বলে ওঠেন,
“ রাইসা! ওটা আমাদের রোদ না?”
তড়িৎ সেদিকে চোখ ফেললেন রাইসা বেগম। অরিনও ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে দেখলো। হ্যা, যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে এটা তার ডাক্তার সাহেব বৈকি! রাইসা বেগম আলতো হাত নাড়ালেন রৌদ্রকে দেখে। রৌদ্র তৎক্ষনাৎ গাড়িতে বসে গাড়িটা ঘুরিয়ে আনে তাদের কাছে।তারপর আবারও গাড়ি থেকে বের হয়ে, পাশাপাশি দাঁড়ায় মেয়েটার। রাইসা বেগম পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
“ তুই এখানে কেনো এলি রোদ?”
রৌদ্র ঘোমটা পড়া অরিনের পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“ আমার বউকে তার ডাক্তার সাহেব ছাড়া বিয়ের আসরে কে নিয়ে যাবে শুনি? আমিতো এই অধিকার অন্য কাউকে দিবো না!”
ছেলেটার এরূপ পাগলামি দেখে মুগ্ধ হাসলেন বাকিরা।রাইসা বেগম মেয়েটার মাথা হতে ঘোমটা সরাতে নিলেই হাত উঁচিয়ে বাঁধ সাধলো রৌদ্র। অস্থির গলায় বললো,
“ উঠাবে না কাকিয়া। আমি অধম নিশ্চিত ওকে এমুহূর্তে দেখলে পাগল হয়ে যাবো আমি।তখন আর বিয়ে পড়ানো অবধি ধৈর্য্য ধরে থাকতে পারবোনা নিশ্চয়ই! তাই থাকুক এই ঘোমটাটুকু।”
রাইসা বেগম আলতো হেসে ঘোমটার ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিলেন। তারপর গিয়ে বসলেন গাড়ির ব্যাক সিটে। মাইমুনা বেগমও পিছু পিছু গিয়ে বসলেন। তারা যেতেই রৌদ্র একপা এগিয়ে এসে মেয়েটার মেহেদী রাঙা হাতদুটো নিজের সামনে মেলে ধরে। মুচকি হেসে মেয়েটার কানের কাছে মুখ এনে, ফিসফিস করে দুষ্ট কন্ঠে বলে ওঠে,
“ মেহেদীর রঙটা তো খুব ভালো এসেছে বউজান! এরমানে কি দাঁড়ালো? তোমার বর বুঝি তোমায় খুব ভালোবাসে?”
অরিন ঘোমটার আড়ালেই ফিচেল হাসলো। রৌদ্রের মতোই ক্ষীণ স্বরে বললো,
“ বাসে বৈকি!”
রৌদ্রের গাড়ি এসে দাঁড়ালো কমিউনিটি সেন্টারের সামনে। উপস্থিত অতিথিরা উৎসুক হয়ে বসে আছেন বর-কনের জন্য। তারা যখন শুনলেন ❝ বর নিজে গিয়েছে তার বউকে আনতে❞ এটুকু শুনতেই যেন সকলের উৎসাহ দ্বিগুন বেড়ে গেলো। সবাই একে একে এসে ভিড় জমিয়েছে গেটের সামনে। কিছুক্ষণ পর রৌদ্র নেমে আসে গাড়ি থেকে। জুবাইদা বেগম ভিড়ের আড়ালেই ছেলেকে নয়ন ভরে দেখলেন। প্যাস্টেল রঙের কারুকার্যে খচিত শেরওয়ানিতে ছেলেটাকে যেন চোখ ধাধানো সুন্দর লাগছে! মাথায় আবার পড়েছে পাগড়ি। জুবাইদা বেগম শাড়ির আঁচলে আলতো করে চোখদুটো মুছে নিলেন। ছেলেটাকে বর বেশে দেখবার একবুক ইচ্ছে ছিলো তার।আজ যেন তা পরিপূর্ণ হলো।
রৌদ্র এগিয়ে এসে অরিনের পাশের দরজাটা খুলে দেয়। তারপর একহাত বাড়িয়ে দেয় মেয়েটার দিকে। অরিনও বাড়িয়ে রাখা হাতটা চেপে ধরে বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে। অনিক এবং রেহান এগিয়ে এসে মেয়েটাকে ধরে ধরে নিয়ে যায় ভেতরে। রৌদ্র পেছন পেছন ঢুকলো। কিছুটা সামনে যেতেই সাব্বির সাহেব এসে ছেলেটার কাঁধে হাত রাখলেন। রৌদ্র থামলো। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো —
“ কি ব্যাপার শ্বশুরমশাই? লাগছে নাকি আপনার জামাইয়ের মতো?”
সাব্বির সাহেব গালভর্তি হাসি টানলেন। ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে পিঠ চাপড়ে বললেন,
“ আবার জিগায়! না লেগে যাবে কই?”
অরিনকে বসানো হয়েছে আলাদা একটা রুমে। রৌদ্র বসে আছে স্টেজে।দু’জনার বিয়ে পড়ানো শেষে একসাথে বসানো হবে দু’জনকে। অরিনের আশেপাশে মানুষের ঢল।সাব্বির সাহেব বসেছেন মেয়ের ডানপাশে। আর রাফিয়া বেগম আরেকপাশে।অনিক রেহানসহ বাকিরাও আছে এদিকে। প্রায় আধঘন্টা পর কাজী সাহেব এসে হাজির হলেন অরিনের কামরায়। মধ্যবয়স্ক কাজী ধীর পায়ে এসে বসলেন সোফার এককোণে। মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে অনুমতি চেয়ে বললেন,
“ বিয়ে পড়ানো শুরু করি তাহলে?”
সকলেই অনুমতি দিলেন। কাজী সাহেব খুতবা পড়ানো শুরু করলেন। খুতবার প্রতিটি লাইন যত পড়া হচ্ছে, ততই যেন হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে অরিনের। আশ্চর্য! হুট করে আবার তার এমন কেনো লাগছে কে জানে! মেয়েটা ক্ষনে ক্ষনে কাঁপছে। সাব্বির সাহেব তা টের পেয়ে মেয়েকে একহাতে চেপে ধরলেন নিজের সঙ্গে। খুতবা পড়ানো শেষে কাজী সাহেব সাব্বির সাহেবকে বললেন,
“ মোহর কত লিখবো?”
এপর্যায়ে অনিক দৌড়ে গেলো রৌদ্রের কাছে। গিয়েই জিজ্ঞেস করলো —
“ দেনমোহর কত লিখবে ভাইয়া?”
রৌদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবলো কিছু একটা। পরক্ষণেই গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ আমার সারাজীবনের সমস্ত আয়!”
অনিক চোখ বড়সড় করে তাকায়।খানিক গলা খাঁকারি দিয়ে ফের বলে,
“ ইয়ে মানে… ভাইয়া!”
“ যা বলেছি তাই।যা..!”
অগত্যা এহেন কথায় দ্রুত সেখান থেকে চলে আসে অনিক। কাজী সাহেবকে বলে দেয় রৌদ্রের বলা কথাটা। যা শুনে একমুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন সকলে।কবির সাহেবতো দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে স্ত্রীর কানে কানে বললেন,
“ রোদ পেটে থাকতে আমি কি তোমায় ভুলভাল কিছু খাইয়েছিলাম জবা? সত্যি করে বলবে কিন্তু!”
জুবাইদা বেগম স্তম্ভিত নয়নে তাকালেন স্বামীর পানে।হতবাক কন্ঠে বললেন,
“ এ আবার কোন কথা? ভুলভাল কিছু মানে?”
কবির সাহেব ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন। ঠোঁট দু’টো খানিকটা চেপে ধরে বললেন,
“ তোমার ছেলেটার পাগলামি দেখে তো মনে হচ্ছে, ও পেটে থাকতে নিশ্চিত উল্টাপাল্টা খেয়েছো তুমি।নাহলে এমন পাগল জন্মায় কিভাবে?”
কথাটা বলেই তিনি স্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন সামনে।এদিকে জুবাইদা বেগম মুখ ভেংচি কাটলেন স্বামীর চলে যাওয়া দেখে। বিরবির করে আপনমনে বললেন,
“ আমার ছেলের মতো ছেলেকে পেটে নেওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হুহ্!”
কাজী সাহেব দেনমোহর টুকলেন রৌদ্রের কথামতো। তারপর কাবিননামায় সবটা ঠিকঠাক মতো উঠিয়ে সাব্বির সাহেবকে বলে ওঠেন,
“ আপনি জনাব মো: সাব্বির এহসান। আপনি কি আপনার কন্যা অরিনকে জনাব মোঃ ইফতেখার এহসান রৌদ্রের সাথে বিয়ে দিতে রাজি?”
সাব্বির সাহেব মাথা ঝাঁকালেন।আলতো করে বললেন,
“হ্যাঁ, আমি রাজি।”
কাজী সাহেব আলহামদুলিল্লাহ বললেন। তারপর অরিনের দিকে তাকিয়ে ফের বললেন,
“ আপনি জনাবা তাফসিরা এহসান অরিন,মোঃ ইফতেখার এহসান রৌদ্রকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি? যদি রাজি হয়ে থাকেন তাহলে বলুন — কবুল!”
অরিন কাঁপছে! হয়তো ঘোমটার আড়ালে ছোট্ট মেয়েটা কাঁদছে ফুপিয়ে। সাব্বির সাহেব মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন।এমুহূর্তে হঠাৎ করে বুকটাও কেমন ভারি হয়ে এসেছে তার। লোকটার চোখেমুখেও রাজ্যের কষ্ট কষ্ট ভাব! অনিক বসে আছে অন্যপাশের সোফাটায়।কাজী সাহেব উত্তর না পেয়ে ফের বললেন,
“ বলো মা কবুল!”
অরিনের গলা ধরা এসেছে যেন।সেটা যে কিসের জন্য হচ্ছে তা আর বোঝা যাচ্ছে না। এমন সময় পুতুল দৌড়ে গেলো স্টেজের দিকে। রৌদ্র বসে বসে কথা বলছে কারো সাথে। পুতুল রৌদ্রের হাত ধরে তৎক্ষনাৎ বলে ওঠে,
“ রোদ ভাইয়া।অরিপু কাঁদছে। কবুল বলছেনা।”
কথাটা শোনামাত্রই রৌদ্র পাগড়ি মাথায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর গটগট পায়ে চলে আসে মেয়েটার কক্ষে! এদিকে নতুন বরকে এমন হুট করে চলে আসতে দেখে ভড়কায় সকলে। কবির সাহেব গম্ভীর মুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রৌদ্র কোনরূপ কালবিলম্ব না করে অরিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর একহাঁটু মাটিতে গেঁড়ে মেয়েটার সামনে বসে।হাত বাড়িয়ে মাথা থেকে পাগড়িটা খুলে নিয়ে,আলতো করে অরিনের হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। অতঃপর হাতদুটো শক্ত করে চেপে রেখেই চমৎকার হেসে কাজী সাহেবকে বলে ওঠে,
“ কাজী সাহেব! বিয়ে পড়ান!”
কাজী সাহেব আদেশ পাওয়া মাত্রই বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। সবকিছু ফের সাজিয়ে গুছিয়ে প্রথমে রৌদ্রকে বললেন,
“ বলুন বাবা কবুল!”
রৌদ্র ঘোমটাপরা অরিনের দিকে তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক চোখে।ছেলেটার চোখেমুখে এক অদ্ভুত দীপ্তী।সে মুগ্ধ হেসে বলতে লাগলো —
“ আমার হৃদয়ারন্যের সবটা জুড়ে বসবাস করা একমাত্র মায়াবতী! আজ থেকে আপনাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে কবুল করলাম আমি।আমার হৃদয় রাজ্যে আজ থেকে সুস্বাগতম আপনাকে।এই যে আপনার হাতটা ধরলাম…. মৃত্যুর আগ অবধি এই হাত আর ছাড়ছিনা আমি।যতদিন এই দেহে প্রান রবে, ততদিন আপনি শুধুই আমার…এই ইফতেখার এহসান রৌদ্রের। আল্লাহ করুক… আমার সকল হায়াতও যেন আপনার গায়ে লেগে যাক। আমার ভাগের যত সুখ আছে সবটা আবারও নতুন করে আপনার নামে লিখা হোক। আপনার সকল দুঃখ যেন আপনাকে ছোঁয়ার আগে এই রৌদ্রকে ছুঁয়ে যায়। আজ সবার সামনে আমি আবারও আপনাকে কবুল করে নিচ্ছি বউজান! কবুল করে নিচ্ছি আপনার সকল রাগ-অভিমানকে। কবুল করে নিচ্ছি আমার প্রাণভোমরাকে! কবুল..কবুল..কবুল..”
পরমুহূর্তেই সকলে একযোগে আলহামদুলিল্লাহ বলে ওঠে। সাব্বির সাহেব ভেজা চোখে মন ভরে হাসছেন।অনিকও কাঁদছে.. আশ্চর্য! ছেলেটার মুখে হাসি অথচ চোখভর্তি অশ্রু! কেননা এই কান্না যেই সেই কান্না নয়তো!এ হচ্ছে পূর্ণতার কান্না! কত-ঝড় ঝাপ্টা পেরিয়ে অবশেষে এই প্রেমিক-যুগল পূর্ণতা পাচ্ছে তা ভাবতেই চোখ ভরে আসছে অনিকের।কবির সাহেব সিনা চওড়া করে দাঁড়িয়ে আছেন।আজ আবারও ছেলেটার জন্য গর্বে বুক ভরে আসছে তার!অবশেষে তিনি বুঝে গেলেন — অরিনের জন্য তার ছেলের চাইতে ভালো আর কাউকেই পেতেন না তিনি। অরিন ভেজা চোখে ঘোমটার আড়ালে রৌদ্রের সুদর্শন মুখটাকে দেখছে। তার চোখে এখন আর কান্না নেই! ঠোঁটের কোণে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে এক চিলতে প্রাপ্তির হাসি। রৌদ্র ঘোমটাপড়া মেয়েটার দিকে চোখ রেখেই আবারও বললো,
“ এবার বলুনতো বউজান!আপনার এই ডাক্তার সাহেবকে কবুল করবেন কি-না!”
অরিন তৎক্ষনাৎ মাথা ঝাকায়। তা দেখে আবারও হাসির রোল পড়ে যায় সকলের মাঝে।কাজীও খানিকটা হেসে অরিনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“ বলো মা! কবুল..!”
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৭ (২)
এবার আর সময় নিলোনা মেয়েটা। ফটাফট একসাথে তিনবার বলে দিলো কবুল। সকলে আবারও আলহামদুলিল্লাহ বলে ওঠে। রৌদ্র তৎক্ষনাৎ মেয়েটার হাতদুটো ছেড়ে দিয়ে সকলের সামনেই তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের বুক পিঞ্জরে। কি এক অদ্ভুত শান্তি যে পাচ্ছে ছেলেটা তা বলে বোঝানো মুশকিল! তাছাড়া পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক তাইনা?কেননা ভালোবাসার পূর্ণতা নিসন্দেহে সুন্দর!