সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৭৩
Jannatul Firdaus Mithila
সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যাচ্ছে। আকাশটাও তার রঙ বদলাচ্ছে ধীরে ধীরে। বারান্দার পাশে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা শিমুল ফুল গাছের পাতাগুলো হালকা বাতাসে নড়ছে ক্রমাগত। প্রায় ঘন্টা খানেক আগে রুহি চলে গিয়েছে শ্বশুরবাড়ি। রেহানের বাবা-মা সেই সকালের দিকে ফোন করে বলেছেন — তাদের না-কি ওতো বড় বাড়িতে একা একা আর ভালো লাগছেনা।অগত্যা এমন কথায় আর চাইলেও থাকা সম্ভব হয়নি রুহির। অতঃপর সে চলে গেলো শ্বশুরবাড়ি। সাথে অবশ্য মাহিরাকে নিয়ে গিয়েছে। মেয়েটাই কেন যেন আজ যেচে পড়ে যেতে চাইলো রুহির সাথে। রুহিও আর তেমন বারণ করেনি।নিয়ে গেলো মেয়েটাকে।
উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে রৌদ্র। সামনে ল্যাপটপ নিয়ে ঘাঁটছে জরুরী ফাইল। তার চওড়া পিঠখানায় পিঠ লাগিয়ে শুয়ে আছে অরিন। হাতে নতুন বই,সঙ্গে একগাদা পড়া। ভার্সিটির মেসেঞ্জার গ্রুপ থেকে খবর পেয়েছে — আর সপ্তাহ খানেক পরেই না-কি তার প্রথম ইনকোর্স পরিক্ষা। এ নিয়ে যত টুকরো টুকরো আফসোস মেয়েটার! কই সে ভেবেছিলাে সদ্য বিয়ে হয়েছে, স্বামীর সঙ্গে ঘুরেফিরে দেদারসে ক’টাদিন কাটাবে কিন্তু বালাইষাট! কপালে তার অতো সুখ সইলে তো! রৌদ্র পরিক্ষার কথা টের পেতেই মেয়েটাকে একপ্রকার হুমকি-ধমকি দিয়ে পড়তে বসিয়েছে। প্রথম দিকে অরিনটা নাক-মুখ কুঁচকালেও পরক্ষণেই বই নিয়ে বসেছে রৌদ্রের ওমন ধমকে। প্রায় আধঘন্টা পেরুলো,অরিনের তেমন নড়চড় টের না পেয়ে রৌদ্র খানিক নড়েচড়ে উঠে। সন্দিহান হয়ে গলা উঁচিয়ে বলে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ সানশাইন? আর ইউ দেয়ার?”
অরিন নিশ্চুপ! রৌদ্র এবার ভ্রু-গোটায়। তড়িৎ একহাতে মেয়েটাকে ধরে পাশে আনতেই দেখে — অরিন কেমন বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছে মেয়েটা।রৌদ্র একপলক তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে ওঠে। বিরবিরিয়ে বলে —
“ পাগলী একটা!”
পরক্ষণেই রৌদ্র হাত বাড়িয়ে পাশ থেকে একটা বালিশ এনে আস্তেধীরে মেয়েটার মাথার নিচে রাখে। অতঃপর অরিনের দু’হাতের ভাঁজ থেকে বইটা আলগোছে সরিয়ে দিয়ে নিজে মেয়েটার বুকের মাঝে টুপ করে মুখ লুকায়।দু’হাতে ঘুমন্ত অরিনকে জড়িয়ে ধরে নিজেও একটুখানি সময়ের মধ্যে পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে।
ছাই-রঙা গাড়িটার সাথে পিঠ এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিক।চোখদুটো তার এদিক ওদিক ছুটছে রীতিমতো। বোধহয় অপেক্ষা করছে কারো। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর,সামনের কেঁচিগেট থেকে ধীরপায়ে বেরিয়ে আসে ইকরা। তা টের পেতেই সেদিকে তাকায় অনিক।পরমুহূর্তেই চোখদুটো তার আঁটকে যায় মেয়েটার দিকে। ছাই রঙের একটা লম্বা ফ্রক পড়েছে, চুলগুলো খুলে রাখা। গলায় পেঁচানো জরজেটের ওড়না।সেটা দিয়েই কোনমতে মাথাটা ঢেকে-ঢুকে রেখেছে আরকি! অনিক থমকায় একমুহূর্তের জন্য। বুকের ভেতর কেমন দ্রিম দ্রিম শব্দ বেরুচ্ছে মনে হচ্ছে! সেই সাথে গলাটাও কেমন খা খা করছে তেষ্টায়! অদ্ভুত তো, বর্ষার মৌসুম চলছে। সেই সাথে পরিবেশ যথেষ্ট ঠান্ডা তবুও অনিকের হুট করেই এমন গরম লাগছে কেনো? তাছাড়া গরমটা কি শুধু তারই লাগছে? নাকি ইকরারও?
অনিকের ভাবনার মাঝেই ইকরা মাথানিচু করে এসে দাঁড়ালো তার সামনে। মিনমিনে স্বরে বললো,
“ জ্বি বলুন। কেনো আসতে বলেছিলেন?”
অনিক ফাঁকা ঢোক গিললো। মনোযোগ মেয়েটার ওপর বরাদ্দ রেখে আনমনেই বললো,
“ হ্যা? আমি বলেছি? ওহ হ্যা.. বলেছি।তোমায় প্রাণভরে দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই… ”
কথার মাঝে আবারও থামলো বেচারা।ওদিকে ইকরা মাথানিচু রেখেই মুখটিপে হাসছে।লোকটার কথাগুলো কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। সে অনিককে আরেকটু বাজিয়ে দেখতে চোখ তুলে তাকায়।ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেশ টেনে বলে,
“ দেখুন তাহলে!”
এই বুঝি অনিকের দমটা আঁটকে এলো! ছেলেটা বুক ফুলিয়ে লম্বা এক নিশ্বাস টেনে তৎক্ষনাৎ একহাতে চেপে ধরলো ইকরার বাঁহাতের কব্জি। ইকরা হকচকিয়ে ওঠে। প্রতিত্তোরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনিক তাকে তড়িঘড়ি করে বসিয়ে দেয় গাড়ির ব্যাক সিটে। তারপর দ্রুত কদমে নিজে গিয়ে বসে ড্রাইভিং সিটে। মুহুর্ত খানেক ব্যায়ে গাড়িটা স্টার্ট দেয় অনিক।এদিকে চোখের পলকে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা যেন পুরোই মাথার ওপর দিয়ে গেলো ইকরার। মানুষটা আবার হুট করে কী থেকে কী করে বসতে চাইছে কে জানে!
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর, অনিকের গাড়ি এসে থামলো একটি নির্জন লেকের সামনে। অনিক একহাতে গায়ের সিটবেল্ট খুলে পরক্ষণেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে আসে ইকরার কাছে। অতঃপর মেয়েটার দিকে তাকায় নেশালো চোখে। এহেন দৃষ্টি দেখে ইকরা কেমন শুকনো ঢোক গিললো কয়েকটা। ভয়ে ভয়ে খানিক পেছাতে লাগলো সে। অনিক বাঁকা হাসলো তা দেখে। নিজে থেকে নিজেদের মধ্যকার দুরত্ব বেশ কিছুটা ঘুচিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসলো ছেলেটা। পরক্ষণেই ইকরার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে দুষ্ট কন্ঠে বললো,
“ ভয় লাগছে নাকি?”
ইকরা হতবিহ্বলের ন্যায় দু’ধারে মাথা নাড়াতে গিয়েও থমকে গেলো পরমুহূর্তে। শুষ্ক ফাঁকা ঢোক গিলে কোনমতে বললো,
“ না মানে… এতো কাছে আসছেন কেনো আপনি?”
অনিক ফিচেল হাসলো। পরনের শার্টের বোতামগুলোতে হাত চালাতে চালাতে বললো,
“বউ আদর করবো তাই!”
হকচকিয়ে ওঠে ইকরা। তড়িৎ দু’ধারে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ না না… আপনার, আমার বিয়ে হয়নি এখনো। এর আগে এসব কিছু করবেন না প্লিজ!”
অনিক থামলো একমুহূর্তের জন্য। পরনের আধখোলা শার্টের ওপর থেকে হাত সরিয়ে এনে,ঠোঁট কামড়ে ভাবলো কিছু একটা। পরক্ষণেই আবার কি মনে করে হালকা হেসে বললো,
“ ঠিক আছে, তবে তাই হোক।”
চোখদুটো বড়সড় করে সামনে তাকিয়ে আছে ইকরা। মেয়েটা বুঝি রীতিমতো শক খেয়েছে কোনো ব্যাপারে! সে ফট করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনিকের দিকে তাকায়।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“ আমরা কাজী অফিসে কেনো এসেছি?”
অনিক বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়।ঘাড় বাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“ হাডুডু খেলতে!”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ইকরা। ওদিকে অনিক তার হাত ধরে সামনে এগোচ্ছে। ইকরাও তার সাথে পায়ে পা মিলাতে গিয়ে রীতিমতো দৌড়াচ্ছে। দু’মিনিটের পথ অতিক্রম করে দু’জনেই এসে দাঁড়ালো কাজীর সামনে। অনিক তাকে দেখেই গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ হুজুর! আমরা বিয়ে করবো।বিয়ে পড়ান!”
ভড়কে তাকায় ইকরা।অনিকের হাতটা খানিক টেনে ধরে নিচু কন্ঠে বলে,
“ কি বলছেন আপনি? বিয়ে মানে? আমাদের বিয়ে তো ফেমিলি থেকেই দিবে।সেখানে কাজী অফিসে এসে বিয়ে করবার মানে কি?”
অনিক ঘাড় বাকিয়ে তাকায়। মেয়েটার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে —
“ আমার তোমাকে আজকেই চাই মায়াবিনী, আজকে মানে আজকেই!”
অনিকের এহেন কথায় ইকরার শীরদাড়া বেয়ে এই বুঝি নেমে গেলো এক ঠান্ডা স্রোত।ক্ষুদ্র বদনখানি কাঁপছে মৃদুমন্দ। চোখদুটো তুলে তাকানোও যেন এমুহূর্তে দায় হয়ে পড়েছে তারজন্য! অনিক হাসলো নিঃশব্দে। কাজী সাহেবকে একপ্রকার তাড়া দিয়ে বলে ওঠে,
“ কি হলো কাজী সাহেব? বিয়ে পড়াচ্ছেন না কেনো? কই তারাতাড়ি বিয়ে পড়ান!”
পিটপিট করে ঘুম জড়ানো চোখদুটো বহুকষ্টে টেনেটুনে খুললো অরিন। চোখের সামনে রৌদ্রের সুশ্রী মুখখানাকে ঝুঁকে থাকতে দেখে ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। সে দু’হাত দিয়ে আলতো করে টেনে ধরে রৌদ্রের গলা। রৌদ্রের মুখাবয়ব গম্ভীর। সে অরিনের মুখের ওপর ঝুঁকে আসে।মেয়েটার মুখের ওপর আছড়ে পড়া চুলগুলোকে আলতো করে আঙুলের সাহায্যে সরিয়ে, গুঁজে দিলো কানের পিঠে। অরিন আবেশে চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। রৌদ্র একপলক তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। পরক্ষণেই মুখটাকে এগিয়ে এনে আলতো করে চুমু বসালো মেয়েটার বন্ধ চোখের পাতায়।অরিন মুচকি হাসলো। নিঃশব্দে অনুভব করতে লাগলো রৌদ্রের আদুরে স্পর্শ গুলো। রৌদ্র খানিক সময় নিয়ে ঠোঁট সরায়। তারপর আবারও ঠোঁট রাখে অরিনের কপাল বরাবর। পরক্ষণেই সেখান থেকে ঠোটঁ সরিয়ে এনে দুগালে টুপ করে বসিয়ে দেয় ঠোঁটের পরশ। রৌদ্রের ইদানিং কেন যেন ইচ্ছে হয় মেয়েটার ফোলা ফোলা গালদুটোর ওপর বেশ শক্তপোক্ত অত্যাচার চালাতে। মেয়েটার গালদুটো যে কি নরম! রৌদ্র ঠোঁট ছোঁয়াতেই দেবে যায় বেশ খানিকটা! এখনও হলো তাই! রৌদ্র মেয়েটার গালে নাক ঘষতে ঘষতে ভরাট কন্ঠে বললো,
“ ওঠ সানশাইন! পড়তে হবে তো জানবাচ্চা!”
ফট করে চোখদুটো মেলে তাকায় অরিন। হ্যা তাইতো, তার তো পড়তে হবে! তখন কি তাহলে পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দাঁতে জিভ কাটলো অরিন। রৌদ্রকে নিজের ওপর থেকে সরিয়ে দিতে হাত চালাতেই রৌদ্র একহাতে চেপে ধরে সেই হাত। অরিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলো। রৌদ্র তখন মেয়েটার ঠোঁটের দিকে চোখ রেখে ঠোঁট কামড়ে হাস্কি স্বরে বললো,
“ একটা ভিটামিন চুমু দে বউজান! শরীরটা কেমন দূর্বল লাগছে…ইশশ্ বোধহয় জ্বরও আসবে!”
ছেলেটার এহেন নাটকীয় কথায় না চাইতেও ফিক করে হেসে ওঠে অরিন। হাসতে হাসতেই বলে,
“ একটা চুমু নেওয়ার জন্য এতো নাটক করা লাগে?”
রৌদ্র এগিয়ে আসে মেয়েটার ঠোঁটের দিকে। তার ঠোঁট যখন মেয়েটার ঠোঁটের প্রায় ছুঁই ছুঁই তখনি সে কেমন ফিসফিস করে বলে ওঠে,
“ ও তুমি বুঝবেনা বউজান!”
অতঃপর.. অতঃপর পাগল ছেলেটা আবারও আঁকড়ে ধরলো মেয়েটার ওষ্ঠপুট। গভীর আশ্লেষে অধরজোড়া টেনে নিতে লাগলো নিজ ওষ্ঠপুটের মাঝে। তার বেহায়া হাতদুটো ইতোমধ্যেই মত্ত হয়েছে মেয়েটার সর্বাঙ্গে নিজেদের বেহায়া স্পর্শ একেঁ দিতে। ওদিকে অরিন অস্থির। তার কাঁপা কাঁপা একহাত উঠে এলো রৌদ্রের ঘাড়ে।অন্যহাত শক্ত করে চেপে ধরলো ছেলেটার মাথার পেছনের দিকের চুলগুলো।
রাতের খাবার খেতে সকলে একসঙ্গে বসেছে টেবিলে। অরিনও এসে বসেছে সেই সাথে। অপেক্ষা করছে রৌদ্রের আসার।ছেলেটা একটা জরুরী কল পেয়ে চলে গেছে কথা বলতে,বোধহয় এখনো বলছে। এদিকে কবির সাহেব ভাইদের সঙ্গে আলাপচারিতা করছেন, পাশ থেকে জুবাইদা বেগম স্বামীর পাতে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। ওদিকে রাফিয়া বেগম অস্থির। ছেলেটা তার কই যে গেলো কে জানে! কখন থেকে কল দিয়েই যাচ্ছেন তিনি, অথচ অনিকটা ফোন ধরছেইনা! রাফিয়া বেগম অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন ড্রয়িং রুমে। তক্ষুনি মাইমুনা বেগম হাসিমুখে এগিয়ে এলেন রাফিয়া বেগমের নিকট। বললেন,
“ এতো অস্থির হচ্ছো কেনো মেজোবু? অনিক তো আর বাচ্চা না।বোধহয় বাইরে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা জমিয়েছে আজ।তাই হয়তো লেট হচ্ছে আসতে।”
রাফিয়া বেগম নিজেও মনে মনে ধরে নিয়েছেন এহেন কথা।তবুও সেই সন্ধ্যা থেকে তার মনটা কেনো যেন বড্ড অস্থির হয়ে আছে! বারবার মনে হচ্ছে, ছেলেটা আজ না আবার কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে। বেচারি বিরস মুখে জা’য়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ তুই বোধহয় ঠিক বলছিস! আমি হয়তো একটু বেশিই ভাবছি”
মাইমুনা বেগম সায় জানালেন এরূপ কথায়। পরক্ষণেই এগিয়ে এসে রাফিয়া বেগমের হাত টেনে নিয়ে গেলেন খাবার টেবিলে। তাদের যাওয়ার ঠিক মিনিট খানেক পর রৌদ্র এসে উপস্থিত হয় সেথায়। রাফিয়া বেগম পাশ ফিরে ছেলেটার পিঠে হাত রেখে বললেন,
“ বস বাবা! খাবার বেড়ে দিচ্ছি!”
রৌদ্র গম্ভীর মুখে জবাব দেয় — এক মিনিট মেজো মা।আমার একটা গুরত্বপূর্ণ কথা বলার আছে।
ছেলেটার এরূপ কথায় সকলেই নড়েচড়ে বসলেন যেন।কবির সাহেবও নিজের কথাবার্তায় বিরতি নিয়ে শীরদাড়া সোজা করে বসে ছেলের দিকে তাকালেন। রৌদ্র কিছুটা সময় নিয়ে মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে। বলে,
“ হসপিটাল থেকে কল এসেছিলো। আমাকে এপয়েন্ট করা হয়েছে পরবর্তী ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য।”
এমন একটা সুসংবাদে খুশি হওয়ার বদলে আপাতত চিন্তিত সকলে। সবার মনে মনে একটাই কথা — ছেলেটা সবেমাত্র বিয়ে-শাদি সেরেছে, আর ওমনি ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য চলে যেতে হবে?কিয়তক্ষন বাদে কবির সাহেব মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠেন। গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করেন,
“ কোথায়? এবং কতদিনের জন্য যাবে?”
রৌদ্র কোনরূপ ভনিতা ছাড়াই প্রতিত্তোরে বলে,
“ তিনমাসের জন্য যেতে হবে ইউকে!”
এপর্যায়ে রৌদ্রের দিকে উদাস চোখে তাকায় অরিন। মেয়েটার বুক ফেটে যেন এক্ষুণি কান্না বেরিয়ে আসবে। চোখদুটোতেও ইতোমধ্যে দেখা মিলেছে বারিকণার উপস্থিতি। রৌদ্র আড়চোখে তাকালো মেয়েটার দিকে। পরক্ষণেই দু’জনার চোখাচোখি হতেই ভ্রু কুঁচকে আসে রৌদ্রের। সে চোখ সরু করে তাকায় অরিনের দিকে। অতঃপর খানিকক্ষণ সময় লাগলো বুঝতে যে মেয়েটা কাঁদতে চাইছে, ওমনি রৌদ্র তৎক্ষনাৎ ছুটে আসে অরিনের নিকট। দু’হাতে মেয়েটাকে চেয়ারসহ ঘুরিয়ে এনে নিজে তার সামনে বসে পড়লো হাঁটু গেড়ে। ওদিকে আশেপাশে যে বাড়ির সকলের দৃষ্টি তাদের ওপরেই নিবদ্ধ, সেদিকে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই ছেলেটার। সে-তো উদ্বিগ্ন তার সানশাইনের জন্য। রৌদ্র দু’হাতে আলতো করে অরিনের কাঁদো কাঁদো মুখটা দু’হাতের আঁজলায় পুরে নেয়। অস্থির গলায় বলে,
“ এই মেয়ে! কি হয়েছে তোর? তুই কাঁদছিস কেনো? কে কি বলেছে তোকে, আমায় জাস্ট একবার বল। এই অরি! তাকা না জানবাচ্চা!”
রৌদ্রের এহেন অস্থিরতায় দমবন্ধ হয়ে আসে অরিনের। সে সময় নিয়ে নিজের ছলছল চোখজোড়া তুলে তাকায়।ধরে আসা কন্ঠে বলে,
“ আপনি তিনমাসের জন্য দেশের বাইরে যাবেন?”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ ওপর নিচ নাড়ায়।আগের ন্যায় জিজ্ঞেস করে,
“ হ্যা,তো?”
এবার যেন ভেতরের কান্নাগুলো একপ্রকার উগড়ে আসছে অরিনের। সে বহুকষ্টে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজের কান্নাগুলোকে আঁটকে রাখার বৃথা প্রয়াস চালায়। তবুও সে চেষ্টা বরাবরের ন্যায় ব্যর্থ হলো আজও। তার চোখ বেঁয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছে দুফোঁটা অশ্রু কণা। তা দেখে রৌদ্র বুঝি আরেকদফা অস্থির হলো।সে মেয়েটার হাতদুটো খানিক ঝাঁকিয়ে বললো,
“ প্লিজ কাঁদেনা বউজান।এটলিস্ট আমায় বল না,তুই কেনো কাঁদছিস?”
অরিন নাক টেনে টেনে বলে,
“ আপনি চলে যাবেন।আমিতো মিস করবো আপনাকে।”
রৌদ্র ভ্রু কুঁচকায় এবার। সন্দিহান গলায় বলে,
“ স্ট্রেঞ্জ! আমার সাথে থেকে আবার আমাকেই মিস করবি মানে?”
অরিন অবুঝ চোখে তাকায়। রৌদ্রের কথার গভীরতা ধরতে না পেরে অবুঝ গলায় বলে,
“ মানে?”
রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো।মেয়েটার দিকে ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ অপলকভাবে তাকিয়ে থেকে পরক্ষণেই মুচকি হাসলো। হাত বাড়িয়ে মেয়েটার ফোলা ফোলা গালদুটো খানিক টেনে দিয়ে বললো,
“ মানে আপনিও আমার সাথে যাচ্ছেন বউজান!”
এহেন বাক্যে আশ্চর্য হলেন সকলে।কবির সাহেব মাঝ থেকে বলে ওঠেন,
“ ওকে নিয়ে যাবে মানে? তুমি সেখানে ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য যাচ্ছো,ঘুরতে নয়।তাছাড়া তুমি সারাদিন ব্যস্ত থাকবে মেয়েটাকে সাথে করে নিয়ে গেলেও ঠিকঠাক সময় দিতে পারবেনা।তখন আবার অরি মন খারাপ করে থাকবে। তারচেয়ে বরং ও এখানেই থাকবে।সবার সাথে হেসেখেলে তিনমাস এমনিতেই কেটে যাবে।”
এহেন কথায় বাকিরা সম্মতি জানালেও রৌদ্র কপাল কুঁচকায়।কন্ঠে একরাশ নাখোশ ভাব ঢেলে বলে ওঠে,
“ তোমার কথা ঠিক হলেও আমি মানতে পারছিনা আব্বু।”
কবির সাহেব তড়াক ঘাড় বাকিয়ে চাইলেন ছেলের দিকে। গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“ কেনো কি সমস্যা তোমার?”
রৌদ্র গা-ছাড়া ভাব নিয়ে পকেটে দু’হাত গুঁজে দাঁড়ালো। সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো,
“ কজ বিয়ের পরেও আমি আমার বউজানকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।”
ছেলের এহেন সোজাসাপটা উত্তরে বোকা বনে গেলেন কবির সাহেব। তিনি কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন হতবুদ্ধির ন্যায়। ওদিকে বাকিরা মুখ টিপে হাসছে। রৌদ্র আর কারো দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ চেয়ার টেনে বসে পড়ে অরিনের পাশে। কিয়তক্ষন বাদে নিজের পাতে খাবার নিতে নিতেই গম্ভীর কন্ঠে বাবার উদ্দেশ্যে বলে,
“ আমার দিকে এভাবে হা করে তাকিয়ে না থেকে খাবার খাও আব্বু। খাবার তো দেখছি ঠান্ডা হয়ে গেলো!”
এহেন কথায় তৎক্ষনাৎ থতমত খেয়ে বসেন কবির সাহেব। তড়িঘড়ি করে ছেলের ওপর থেকে নজর সরিয়ে আনলেন নিজ প্লেটের ওপর। মনে মনে যদিও ছেলেকে ইতোমধ্যেই কষিয়ে দু-চারটে গালি দিয়েছেন। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।ছেলেটা যে তার দিনকে দিন নির্লজ্জ হচ্ছে এ যে আর নতুন নয়।
সবার খাওয়া প্রায় মাঝামাঝি পর্যায়ে, এমন সময় কর্কশ শব্দে বাড়ির সদর দরজার কলিং বেল বেজে ওঠে। রাফিয়া বেগম তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে বসলেন। এঁটো হাতেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। মনে মনে ধরেই নিয়েছেন —
“ অনিক এসেছে হয়তো!”
রাফিয়া বেগম একছুটে এসে দরজাটা খুলে দিলেন। পরক্ষণেই অস্থির গলায় ছেলেকে দু’টো শক্তবাক্য বলার জন্য মুখটা খুলতেই যাবেন, ওমনি সম্মুখে দাঁড়ানো অনিক আর ইকরাকে পাশাপাশি দেখে কথাগুলো আর মুখ ফুটে বেরুলো না তার। তিনি ভ্রু কুঁচকে দুজনের পানে তাকালেন। ছেলেমেয়ে দুটো এরম হাতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেনো? তাছাড়া এতো রাতে ইকরাই বা কি করছে অনিকের সাথে? এহেন বেশ কতক প্রশ্ন ইতোমধ্যেই এসে হানা দিয়েছে রাফিয়া বেগমের বিচক্ষণ মস্তিষ্কে।কিয়তক্ষন বাদে তিনি কেমন গম্ভীর মুখে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ এতো রাত অবধি কোথায় ছিলি তুই? তাছাড়া ইকরা এতোরাতে তোর সাথে কি করছে?”
অনিক সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ইকরার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় শক্তভাবে চেপে রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“ আমরা বিয়ে করেছি আম্মু!”
ব্যস! কোথাও যেন আকাশ ভেঙে পড়লো মনে হচ্ছে। রাফিয়া বেগমের ছানাবড়া চোখদুটো দেখে আপাতত মনে হচ্ছে তার মাথার ওপরেই বুঝি আলগোছে ভেঙে পড়েছে আকাশটা। তিনি কিয়তক্ষন চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেলেন যেন। কানদুটো কী ভুল শুনলো কি-না তা যাচাই করতে তিনি ফের জিজ্ঞেস করলেন,
“ কী বললি?”
অনিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে দাঁড়ায়। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে আবারও বলে,
“ তোমার ছেলের বউ নিয়ে এসেছি। কই এসো..বরণ করো ছেলের বউকে!”
এপর্যায়ে কটমট দৃষ্টিতে তাকালেন রাফিয়া বেগম। দাঁতে দাঁত চেপে ছেলেকে কিছু বলতে যাবেন তার পূর্বে চোখজোড়া গিয়ে আটকালো, অনিকের পাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইকরার পানে। কেন যেন এমুহূর্তে মেয়েটাকে দেখে বড্ড মায়া লাগলো রাফিয়া বেগমের। তিনি ছেলেকে শায়েস্তা করার কথা মাথা থেকে আপাতত ঝেড়ে ফেলে ইকরার একহাত টেনে ধরলেন। পরক্ষণেই মেয়েটাকে নিজের একহাতে আগলে নিয়ে গটগট পায়ে চলে গেলেন ডাইনিং এর দিকে। এদিকে অনিক হালকা উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখলো মায়ের চলে যাওয়া। পরক্ষণেই মনে মনে একরাশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিরবির করে বললো,
“ যাক…নতুন বউয়ের সামনে মায়ের হাতের ঝাঁটার বাড়ি খাইনি,এটাই আলহামদুলিল্লাহ!”
অন্যদিকে, রাফিয়া বেগম ইকরাকে সঙ্গে নিয়ে ডাইনিং এ এসে দাঁড়ালেন। ওদিকে হঠাৎ এতোরাতে ইকরাকে এভাবে দেখে ভড়কে গেলেন সকলে। প্রত্যেকে কেমন হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। ইকরা আড়চোখে দেখলো সবটা। পরক্ষণেই কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলো নিজ জায়গায়। রাফিয়া বেগম আলতো করে ইকরার মাথায় রাখলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“ রাতের খাবার খাওনি নিশ্চয়ই? যাও..চেয়ারে গিয়ে বসো।আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।”
সকলে আরেকদফা অবাক হলেন রাফিয়া বেগমের এহেন কথায়। সাব্বির সাহেব নিজের অভ্যন্তরীণ কৌতুহলকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে বলেই বসলেন,
“ ইকরা মামণিকে হঠাৎ কোথায় পেলে? আর ও এসেছে কার সাথে?”
রাফিয়া বেগম গম্ভীর মুখেই প্রতিত্তোর করলেন,
“ তোমার ছেলের সাথে।….. ওরা নাকি বিয়ে করেছে!”
সদ্য গ্লাস ভর্তি পানিতে চুমুক বসিয়েছিলেন তাশরিক সাহেব। ওমনি ভাবির এহেন কথা শোনামাত্রই মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে পানিটুকু। যা গিয়ে পড়লো মুখোমুখি হয়ে বসে থাকা তায়েফ সাহেবের ওপর। ওদিকে তায়েফ সাহেব মাত্রই গরম গরম মাংসটা পাতে নিয়েছিলেন কোনরকম। একটু-আধটু বোধহয় ছিঁড়েও ফেলেছিলেন ইতোমধ্যে। তবে সেটা আর মুখে দিতে পারলেন না বেচারা! তার আগেই তাশরিক সাহেবের এহেন কান্ডে খাবারটা একদম মাটি হয়ে গেলো তার।আপাতত তার কাছে প্লেট ভর্তি গরম গরম মাংস কষা খেতে না পারাটা অনিক বিয়ে করেছে এই সংবাদের চাইতে বেশি দুঃখজনক। বেচারা আর্তনাদ করে উঠলেন তৎক্ষনাৎ! চেঁচিয়ে বলে ওঠেন,
“ আল্লাহ রে আল্লাহ! তোর কী সমস্যা তশু? তুই আমার সাথে তোর কোন জনমের শত্রুতা এ জনমে মেটাচ্ছিস ভাই? কেন আমার এতো সাধের খাবারটা খেতে দিলি না তুই?”
সামনে দাঁড়িয়ে আছে সদ্য বিবাহিত জোড়া।যার দিকে আপাতত সকল মনোযোগ তাশরিক সাহেবের।কিন্তু মাঝখান থেকে তায়েফ সাহেবের ওমন কথায় মুখ কুঁচকে আসে মানুষটার।তিনি কেমন করে যেন বলে ওঠেন,
“ আরে সেজো ভাই! ক্লাইমেক্স দেখো বুঝছো,ক্লাইমেক্স! কি সব খানাপিনা নিয়ে পড়ে আছো!”
বেচারা তায়েফ সাহেব শান্ত হলেন না।উল্টো আর্তনাদ করে বসে রইলেন নিজ আসনে। এদিকে বেচারা সাব্বির সাহেব স্ত্রীর কথা পুরোটা না শুনেই বোকার মতো ওপর নিচ মাথাটা নাড়াতে গিয়ে পরক্ষণেই থতমত খেয়ে বসলেন। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন স্ত্রীর দিকে। ডানহাতে নেওয়া সদ্য লোকমাটা মুখের কাছে এসেই থমকে গেলো তার। সেটা আর মুখে পুরে নেওয়ার সময় পেলেন না বেচারা। সবার এতো এতো অবাক রিয়েকশনে একটিমাত্র মানুষ একদম স্বাভাবিকভাবে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে অরিনের ডাক্তার সাহেব। যেখানে অরিন অবাক হয়ে খাবার গিলতে ভুলে গেছে, সেখানে রৌদ্র কি সুন্দর দেদারসে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। কিয়তক্ষন বাদে অরিন চোখ নামিয়ে আনলো রৌদ্রের ওপর। রৌদ্রকে ওমন ভ্রুক্ষেপহীন দেখে সে কন্ঠ খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ ডাক্তার সাহেব!”
রৌদ্র খাবার খেতে খেতেই ছোট্ট করে জবাব দিলো — হু?
অরিন সামান্য ঢোক গিললো। আগের ন্যায় নিচু কন্ঠে রৌদ্রকে বললো,
“ শুনেছেন? ভাইয়া নাকি বিয়ে করে ফেলেছে!”
এপর্যায়ে খাওয়া থামিয়ে ক্ষুদ্র চোখে তাকায় রৌদ্র। মুখের খাবারটুকু আয়েশ করে চিবিয়ে অবশেষে গিলে নিয়ে বললো,
“ হ্যা, তো? বিয়েই তো করেছে.. কোনো চুরি নয়।এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে?”
অরিন হাসবে না কাঁদবে কে জানে! ওদিকে কবির সাহেব এতক্ষণে মুখ খুললেন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে অনিকের পানে তাকিয়ে বললেন,
“ বড় ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে না-কি? সবকিছুতে এতো অধৈর্য্য কেনো তোমরা? আমরা তো বলেছিলাম — পারিবারিক ভাবে ধুমধামে বিয়ে দিবো।সেটায় কি এমন ক্ষতি হতো তোমার বুঝলাম না!”
অনিক নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে রৌদ্রের খাওয়া এতক্ষণে শেষ। সে এঁটো হাতে বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে ফিরে আসে। তারপর কেমন বিজ্ঞের ন্যায় সাফাই দিয়ে বলে ওঠে,
“ তুমিই তো সেদিন বললে — ছেলেটার নাকি বিয়ের বয়স হয়েছে। সেক্ষেত্রে আর দেরি করা কি ঠিক বলো? তাছাড়া ওর ইচ্ছে হয়েছে তাই তারাতাড়ি বিয়ে করে ফেলেছে। পরবর্তীতে আমি ফিরে এলে নাহয় ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করবে।ব্যস! হয়ে গেলো।এটুকু ব্যাপার নিয়ে বাচ্চা ছেলেটার ওপর শুধু শুধু হম্বিতম্বি করছো কেনো?”
এপর্যায়ে সাব্বির সাহেব মুখ গম্ভীর করলেন। বললেন,
“ নিজে নিজে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে যেই ছেলে,সে আবার বাচ্চা ছেলে?”
রৌদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। ঠোঁটের কোণে আলতো হাসির রেশ টেনে বলে ওঠে,
“ আরে শ্বশুর মশাই! এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাবেন না।যা হওয়ার হয়েছে। বাদ দেন!”
অগত্যা চুপ করে গেলেন সাব্বির সাহেব। তবে ছেলের পানে তাকিয়ে রইলেন শক্ত চোখে। ওদিকে হুট করেই কবির সাহেবের পরনের সফেদ রঙা পাঞ্জাবির পকেটে রাখা ফোনটা বেজে ওঠে সশব্দে। কবির সাহেব কালবিলম্ব না করে ফোনটা বের করে হাতে নেন।দেখেন — আমরিন বেগমের কল। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে ফোনটার দিকে চেয়ে থেকে অবশেষে কলটা রিসিভ করলেন।ফোন কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে আমরিন বেগমের চিন্তিত কন্ঠ।
“ ভাইজান! আমার ইকরা কোথায়? অনিক এসেছিলো বাড়ির সামনে এরপর তো মেয়েটাকে আর তাকে দুজনের কাউকেই দেখছিনা।”
বোনের কথায় ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়েন কবির সাহেব। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা অনিকের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বোনকে বললেন,
” তুই-ই বাকি ছিলি! শোন,ওরা বিয়ে করে ফেলেছে। আপাতত বাড়িতে এসেছে।তুই নাহয় কাল সকালে সবাইকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসিস।”
ওপাশে আমরিন বেগম কি বললেন শোনা যায়নি। তবে কবির সাহেব যে ভীষণ চটেছেন তা বোঝা যাচ্ছে বরাবর!
অনিকের বিছানার মাঝ বরাবর লাজুক মুখে বসে আছে ইকরা।গায়ে জড়িয়েছে লাল টকটকে জামদানী শাড়ি। শাড়িটা অরিনের, বিয়েতে কতগুলো উপহার যে পেয়েছে সে! যা এখনো খোলাই হয়নি।তারমধ্যে থেকেই শাড়িটা বের করে এনে শখের ভাবিকে পড়িয়েছে অরিন। সেই সাথে মেয়েটাকে হালকা পাতলা সাজিয়ে দিয়েছে মেয়েটা।আহিরাও পাশ দিয়ে টুকটাক সাহায্য করছে অরিনকে। সাজসজ্জার কাজ শেষ হতেই অরিন তাকায় তার নতুন ভাবির দিকে। ইকরার থুতনিতে আলতো করে আঙুল ঠেকিয়ে মেয়েটার লজ্জালু মুখটার পানে তাকিয়ে হেসে ওঠে অরিন। সশব্দে বারকয়েক মাশাআল্লাহ বলে ওঠে তৎক্ষনাৎ। পরক্ষণেই দুষ্ট হেসে বলে,
“ আমার ভাইয়া তোমায় এভাবে দেখলে একদম ফিট হয়ে পড়বে।মিলিয়ে নিও!”
লজ্জায় পড়লো ইকরা।পারছেনা লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে। অরিন যে তাকে এভাবে লজ্জা দিবে তা যেন ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি মেয়েটা। সে তৎক্ষনাৎ মুখটা নুইয়ে নিলো আরেকটু। তা দেখে অরিন কেমন গা দুলিয়ে হেসে ওঠে। কিন্তু মেয়েটার এহেন প্রাণখোলা হাসিটা স্থায়ী হলোনা বেশিক্ষণ। এরইমধ্যে ঘরে এসে উপস্থিত হলো রৌদ্র।নিঃশব্দে অরিনের পাশে এসে বসলো গা ঘেঁষে। অরিন হাসি থামিয়ে পাশে তাকায়।রৌদ্রকে দেখে বলে ওঠে,
“ দেখুন, আমি ভাবিকে কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছি।”
রৌদ্র তাকালোনা অন্যদিকে।উল্টো অরিনের দিকে নিখাঁদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
“ ঘরে চল সানশাইন!”
এপর্যায়ে গাল ফোলায় অরিন। মিনমিনে স্বরে বলে,
“ আরেকটু থাকিনা!”
রৌদ্র মুচকি হাসলো। অরিবকে আলগোছে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে বললো,
“ আমার ঘুম পেয়েছে জানবাচ্চা! সো আই নিড ইউ।”
অরিন আর কি বলবে? এ লোককে কিছু বললেও বা শুনবে সে? তাইতো অরিন কেমন চুপচাপ গাল ফুলিয়ে পড়ে রইলো রৌদ্রের কোলে। রৌদ্র ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে আহিরার উদ্দেশ্যে বলে,
“ ঘরে যা আহি!”
আহি মাথা নাড়ায়। ইকরার থেকে বিদায় নিয়ে তৎক্ষনাৎ চলে যায় নিজের রুমে। এদিকে রৌদ্র অনিকের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সামনে পড়লো অনিক।রৌদ্রকে দেখে মুচকি হেসে ইশারায় কি যেন বললো।রৌদ্রও হালকা হেসে মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেলো নিজ রুমে।
ঘরের দরজা আঁটকে নিঃশব্দে পা ফেলে ইকরার সামনে এসে বসলো অনিক।চুপচাপ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়তক্ষন। অতঃপর কেমন ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,
“ এবার তোমায় ছুঁতে পারি মায়াবিনী?”
ইকরা লজ্জায় কুন্ঠা যাচ্ছে একপ্রকার। যা আরেকদফা মুগ্ধ করলো অনিককে।সে তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এসে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে। কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে বললো,
“ সরি!”
ভ্রু কুঁচকায় ইকরা।সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করে,
“ কেনো?”
অনিক দুষ্ট হাসলো। দুষ্ট কন্ঠে প্রতিত্তোরে বললো,
“ নিজ ইচ্ছায় সারারাত কাঁদাবো তোমায় মায়াবিনী, তাই আগে-ভাগে সরি বলে নিচ্ছি!”
রাতের আধার ছাপিয়ে ধরণীতে নেমেছে এক নতুন সকাল। গতরাতের পর থেকেই গাল ফুলিয়ে আছে অরিন।তার পিছে অবশ্য বেশ কারণ আছে বৈকি। গত রাতে রৌদ্র তাকে জানিয়েছে — সে আগামী তিনমাস বাইরে স্টাডি করবে। একে-তো প্রথমবার বিদেশে যাচ্ছে মেয়েটা।তার ওপর সম্পূর্ণ নতুন জায়গা, নতুন মানুষের মাঝে হুটহাট কিভাবে মানাবে নিজেকে? এসব ভাবতে ভাবতেই অরিন গাল ফুলিয়ে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ হাঁটছে।অদূরে দাঁড়িয়ে রৌদ্র আড়চোখে পরোখ করছে মেয়েটাকে। সে ধীরে ধীরে অরিনের কাছে এসে, মেয়েটাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে। আদুরে কন্ঠে বলে,
“ কাছে আসো বউজান! ইটস মাই ওয়ার্ক আউট টাইম!”
অরিন রৌদ্রের হাতদুটো ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয় নিজের পেটের ওপর থেকে। মুখে ভীষণ রাগ ফুটিয়ে বলে,
“ তো যান না।করুন গিয়ে ওয়ার্ক আউট! আমি কি ধরে রেখেছি না-কি আপনাকে?”
মেয়েটার এহেন কথায় রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে হাসে। তারপর কোনরূপ আগাম সংকেত ছাড়াই অরিনের কোমর একহাতে চেপে ধরে তাকে ফ্লোরে শুইয়ে দেয় আলতো করে।মেয়েটা হতবুদ্ধিভাব নিয়ে উঠতে নিলেই বাঁধ সাধে রৌদ্র। অরিনকে ফের শুইয়ে দিয়ে নিজেও তার ওপর ঝুঁকে আসে।তারপর অরিনের ওপর পুশআপ পজিশন নিয়ে হাস্কি স্বরে বলে,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৭২
“ বউ ছাড়া ওয়ার্ক আউট করলে তেমন একটা বিবাহিত ফিল পাই না বউজান!”
বলেই সে তার পুশআপ শুরু করে। আর একটু পরপর মেয়েটার ফোলা ফোলা গালদুটোতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।এহেন পরিস্থিতিতে অরিন না চাইতেও হেঁসে দেয়।বিরবির করে বলে,
“ পাগল একটা!”
বিরবির করে বলা কথাটাও বেশ কানে গেলো রৌদ্রের।সে তৎক্ষনাৎ মুখটা নামিয়ে আনে অরিনের ঠোঁটের দিকে। সেথায় আলতো করে একের পর এক চুমু একেঁ দিয়ে বলে,
“ এটা নতুন নয় হানি!”