সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড শেষ পর্ব 

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড শেষ পর্ব 
Jannatul Firdaus Mithila

ঘুম জড়ানো চোখদুটো পিটপিট করে খুললো মাহিরা। আশেপাশে তাকায় একনজর। ঘরের একপাশের দেয়াল জুড়ে বড় একটা জানালা। সেথায় ফেলে রাখা ধূসর রঙা পাতলা ফিনফিনে পর্দা। বাইরে বোধহয় এখনো ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। কানে তো তেমন শব্দই ভেসে আসছে। মাহিরা লম্বা একটা হামি টেনে শোয়া ছেড়ে আধশোয়া হয়ে বসে।দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে শরীরের সমস্ত অঙ্গকে জানান দেয় — উঠে পড়ার সময় হয়েছে। কিয়তকাল বাদে মেয়েটা আলগোছে নেমে পরে বিছানা হতে। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই চোখ গিয়ে পড়ে দেয়ালে ঝুলন্ত ঘড়িটা দেখে। পরক্ষণেই চোখদুটো যেন চড়কগাছে রুপান্তরিত হলো মাহির। ঘড়ির কাঁটা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে — বেলা ১২ টা বাজে।তারমানে সে এতবেলা অব্ধি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলো? সিরিয়াসলি? মাহি তৎক্ষনাৎ লজ্জিত হলো নিজের এহেন কান্ডে। কোথাও বেড়াতে এসে কেউ এভাবে বেলা অব্ধি ঘুমায় নাকি? লোকজন দেখলে কি বলবে! মাহি আর ভাবতে পারলোনা। তৎক্ষনাৎ পা বাড়ালো ওয়াশরুমে।

প্রায় মিনিট দশেক পর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে মাহি। পেটের ভিতর কেমন ডাকাডাকি হচ্ছে মনে হয়!পেটের ভেতর লুকিয়ে থাকা ক্ষুধার্ত ইদুরগুলো লাফাচ্ছে রীতিমতো। মাহি কিয়তক্ষন চুপ করে বসে রইলো বিছানায়। নিচে যাবে কি-না যাবেনা তাই নিয়েই যত রাজ্যের চিন্তা তার। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ পর অবশেষে তার চিন্তাভাবনার অবসান ঘটে ক্ষুধার কাছে। অতপর আর কোনদিক না তাকিয়ে সে চটপট পায়ে বেরিয়ে যায় রুম ছেড়ে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ধীরেসুস্থে হাঁটছে মাহি। দোতলার লম্বা করিডরের বা-দিকে সারিবদ্ধ বেশ কয়েকটা রুম।একেবারে প্রথম রুমটা রেহান আর রুহির। আর মাহি আপাতত থাকছে তাদের দু-ঘর পরের রুমটায়। মাহি হাঁটতে হাঁটতেই ঘুরেঘুরে দেখছে দোতলরা সাজসজ্জা। গতকাল এসেছে পর থেকে সায়মা খাতুনের সাথে আলাপচারিতাতেই সময় কেটে গিয়েছে তার। বাড়িটা যে একটু-আধটু ঘুরেফিরে দেখবে সে সুযোগ মিলেনি অবশ্য। হাঁটার একপর্যায়ে মাহি থমকায় একমুহূর্তের জন্য। চোখে এঁটে রাখা চিকন ফ্রেমের গোল চশমাটা খানিক ঠিকঠাক করে নিয়ে দোতলার রেলিং ঘেঁষে উঁকি দেয় নিচে। সেথায় দেখে — ক’জন নতুন মানুষের উপস্থিতি।কই গতকাল এসেছিলো পরে তো এদের দেখেনি সে।তবে আজ হঠাৎ এতো মেহমান!

মাহি ঠোঁট কামড়ে ভাবলো কিছু একটা। এমুহূর্তে এতোগুলো মানুষের সামনে নিচে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করাটা আদৌও ভালো দেখাবে কি-না তাই হয়তো ভাবছে মেয়েটা। কিয়তক্ষন এই প্রসঙ্গে ভাবনা চিন্তা শেষে মাহি সিদ্ধান্তে এলো — আজ আর ব্রেকফাস্ট করবেনা সে। কথাটা ভেবেই ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেললো মাহি। আনমনে পেছনে ফিরতে গিয়েই কারো শক্তপোক্ত বুকের সাথে হঠাৎ ধাক্কা লেগে গেলো তার। ঘটনার আকস্মিকতায় বেচারির নাকটা যেমন হালকা ব্যাথা পেলো ঠিক তেমনি তার চশমাটাও নড়েচড়ে গেলো চোখ থেকে। মাহি হকচকিয়ে ওঠে। তড়িৎ চোখ তুলে ঘাড় উঁচিয়ে তাকাতেই দেখে একজোড়া বাদামী চোখের সুদর্শন যুবক তার দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহি ভড়কায়।তৎক্ষনাৎ পিছিয়ে যায় দু-কদম। হাত দিয়ে চোখের চশমাটা ঠিকঠাক করে, আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,
“ কে আপনি?”

যুবক নিশ্চুপ। তার স্থির দৃষ্টি এখনো মাহিরার মুখের পানে নিবদ্ধ। যুবক মাহিরার থেকে লম্বায় বেশ খানিকটা উঁচু। বেচারি মাহিরা তার দিকে তাকাতে কেমন ঘাড় উঁচিয়ে রেখেছে। যুবকের ফুলেফেপেঁ থাকা পেশিবহুল হাতদুটো বুকের কাছে বেঁধে রাখা। গায়ে জড়ানো টেন্ক টপ (হাতাকাটা গেঞ্জি)। সেই সাথে কালো ট্রাউজার। মাথার লম্বা চুলগুলো পেছনের দিকে টেনে ঝুঁটি বেঁধে রাখা।গৌড় বর্ণের সুদর্শন যুবকের দৃঢ় চোয়ালখানা কেমন তীক্ষ্ণ হয়ে ফুটে আছে আপাতত। মাহিরা যুবককে আপাদমস্তক পরোখ করে ফাঁকা ঢোক গিললো। যুবক ক্ষুদ্র চোখে দেখলো সবটা। কিয়তক্ষন যেতেই যুবক ভারি অথচ গম্ভীর কন্ঠে হুট করে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
“ হোয়াট’স ইউর নেম?”

মাহিরা ফের শুকনো ঢোক গিললো। মেয়েটা আবার ইন্ট্রোভার্ট কি-না! হুটহাট অপরিচিতদের সাথে খুব একটা মিশতে পারেনা মেয়েটা। মনের কোণে জেঁকে বসে অজানা ভয়! যুবক মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করলো মাহিরার উত্তরের।তবে সময় পেরুনোর পরও মেয়েটাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে তার। সে এক-কদম এগিয়ে আসতে নিলেই তৎক্ষনাৎ দু-কদম পিছিয়ে যায় মাহি।যুবক থামলো।পাদু’টো আগের জায়গায় স্থির রেখে দাঁড়ালো। ঠিক এমন সময় লম্বা করিডরের শেষ প্রান্ত থেকে ভেসে আসে রেহানের কন্ঠ। ছেলেটা তাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতেই বলছে,

“ হেই মুগ্ধ! হোয়াট’স দিস ম্যান? আমাকে রাস্তায় রেখে তুই একা একাই চলে এলি?”
মুগ্ধ ঘাড় বাকিয়ে রেহানের দিকে তাকায়। গম্ভীর মুখভঙ্গি ধরে রেখে বলে,
“ ইট’স অলরেডি শার্প 12 pm. এন্ড ইউ নো না? আ’ম ভেরি পাঙ্চুয়াল এবাউট মাই টাইম!”
রেহান গাল ভরে হাসলো।মুগ্ধের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে কিছু বলবে তার আগেই তার চোখ গেলো জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাহির দিকে। রেহান তৎক্ষনাৎ মেয়েটাকে বলে ওঠে,
“ মাহি? কি হয়েছে ভাইয়া? তুমি এভাবে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
মাহির উড়ে যাওয়া আত্মাটা যেন আবারও নিড়ে ফিরে এলো। সে রেহানকে দেখে এক চিলতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কোনমতে বললো,

“ না ভাইয়া.. তেমন কিছু না। এমনিতেই..! ”
“ ওহ আচ্ছা! তা ঘুম ভাঙলো কখন তোমার? রুহি বেশ কয়েকবার দেখে গিয়েছিলো তোমাকে, তবে তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে। তা বলি… খেয়েছো কিছু?”
মাহি লজ্জালু ভঙ্গিতে দু’ধারে মাথা নাড়ায়। তা দেখে মুহুর্তেই চিন্তিত হয়ে ওঠে রেহান।তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এসে মেয়েটার একহাত চেপে ধরে বলে,
“ কি বললে? এখনো খাওনি মানে? বেলা কয়টা বাজে হিসাব আছে? চলো নিচে চলো।খাবে!”
বলেই রেহান মাহির হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। যাওয়ার একপর্যায়ে আবার কি মনে করে যেন থেমে গিয়ে পেছনে ফিরে মুগ্ধের পানে তাকালো। দাঁতে জিভ কেটে হাসিমুখে বললো,

“ দেখো কান্ড! তোদের দু’জনের পরিচয়টাই তো করালাম না! মাহি…”
মাহির দিকে তাকায় রেহান। মুগ্ধকে দেখিয়ে বলে ওঠে,
“ ও আমার মামাতো ভাই — মুগ্ধ। সাউথ কোরিয়ায় থাকে স্বপরিবারে। এইতো আজ ভোরেই এসেছে আমাদের বাড়িতে। তুমি বোধহয় টের পাওনি।”
মাহিরা আলতো করে ওপর নিচ মাথা নাড়ায়। তার চোখদুটো নিচু করে রাখা। রেহান একইভাবে মাহিরাকে দেখিয়ে মুগ্ধকে বলে ওঠে,
“ বাডি! ও আমার শ্যালিকা! ও তুইতো আবার এতো জটিল শব্দ বুঝবিনা।আই মিন, ও রুহির কাজিন। মাহিরা এহসান!”
মুগ্ধ বাঁকা হাসলো। মাহিরার পানে অপলক তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

“ জেমি-ইত্তা! জো-আ-য়ো!”
(অর্থ— ইন্টারেস্টিং, আই লাইক ইট)
ভড়কায় রেহান।ছেলেটার কথা বুঝতে না পেরে ফের জিজ্ঞেস করলো,
“ হ্যা? কি বললি?”
মুগ্ধ প্রতিত্তোরে হাসলো ঠোঁট পিষে।গটগট পা ফেলে রেহানকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতেই বললো,
“ নাথিং সো সিরিয়াস বাডি!”
অতপর গটগট পায়ে চলে গেলো ছেলেটা।তবে তার গম্ভীর মুখাবয়বে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে একরাশ মুগ্ধতার আভাস।সেটা কি আদৌও মাহিরার জন্য কি-না কে জানে!

সময় বয়ে চলে নিরবধি, নিজের শান্ত গতিতে। কেটে গেলো আরও সাতটি দিন। আজকে রৌদ্র আর অরিনের ফ্লাইট ঠিক সন্ধ্যে সাতটার দিকে। দুপুরের খাবার খেতে বসেছে সবাই। পুরো এহসান পরিবার আজ একসাথে। মেহরিন বেগমও স্বপরিবারে চলে এসেছেন সকাল সকাল। আদরের ছেলেমেয়ে দুটো তিনমাসের জন্য বাইরে যাবে , সে খবর পেয়ে তিনি কি আর না এসে পারেন? ওদিকে আমরিন বেগমও এসেছেন। সেইদিন যখন অনিক হুট করে ইকরাকে বিয়ে করে নিলো — তখন কি রাগটাই না করেছিলেন মানুষটা! তবে পরবর্তীতে অনিকের মুগ্ধ আচরণে সেই রাগ আর বেশিক্ষণ টিকেনি মানুষটার! অতঃপর মন ভরে দোয়া করেছেন মেয়ে এবং মেয়ের জামাই এর জন্য। ওদিকে রুহি এবং রেহানও এসেছে সকাল সকাল।

খাবার টেবিল জুড়ে নানানরকম পাকোয়ান। রাফিয়া বেগম এখনো রান্নাঘরে। হয়তো মেয়ে এবং মেয়ের জামাইয়ের পছন্দের মিষ্টান্ন বানাতে ব্যস্ত তিনি। জুবাইদা বেগমও হাতে হাত লাগাচ্ছেন। রাইসা বেগম ও মাইমুনা বেগম খাবার সার্ভে ব্যস্ত।রৌদ্র খেতে বসেই এদিক ওদিক চোখ ঘুরায়।মা এবং মেজো মা’কে দেখতে না পেয়ে গম্ভীর মুখে গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ আম্মু এবং মেজো মা কোথায়?”
রাইসা বেগম খাবার সার্ভ করতে করতেই জবাব দিলেন — রান্নাঘরে বাবা!
রৌদ্র কথাটা শুনতে দেরি, রান্নাঘরের দিকে উঠে যেতে দেরি হলোনা তার। সে তৎক্ষনাৎ রসুইঘরের দরজার কাছে এসে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,

“ চুলা অফ করো মেজো মা! আপাতত খাবে চলো।”
রাফিয়া বেগম ভড়কে তাকান পেছনে। কর্মরত হাতদুটোকে খানিক বিরতি দিয়ে বললেন,
“ একি রে রোদ! তুই টেবিল ছেড়ে উঠে এলি কেনো? যা যা..খেতে বস।”
রৌদ্র শুনলোনা। গটগট পায়ে এগিয়ে এসে নিজ উদ্যোগে চুলার আচঁ নিভিয়ে দিয়ে দুহাত টেনে ধরলো মা এবং মেজো মায়ের। বললো,
“ খাবে চলো।”

অগত্যা ছেলেটার এহেন জোরাজোরিতে অবশেষে হার মানলেন দু’জনে। কাজগুলো সব স্থগিত রেখে চলে গেলেন টেবিলে। অতঃপর স্বপরিবারে বসলেন একসঙ্গে। কবির সাহেব প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে একপলক তাকালেন সবার দিকে। আজ তার পরিবারটা একদম পরিপূর্ণ। ছেলে — ছেলের বউ,মেয়ে — মেয়ের জামাই সবাই আছে একসাথে! ইশশ্ কি সুন্দর লাগছে তাদের! কবির সাহেব আনমনেই হাসলেন একটুখানি। পাশ থেকে সাব্বির সাহেব আড়চোখে দেখলেন সে হাসি। পরক্ষণেই তিনি কেমন এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“ ভাইজান! হাসছো যে।কোনো কৌতুক মনে পড়লো না-কি?”
কবির সাহেব ঘাড় বাকিয়ে চাইলেন। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেশ টেনে বললেন,
“ হ্যা তাই হয়তো!”

সবকিছু গোছানো শেষ। অরিন এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। সেই তখন থেকে সবার সাথে কথা বলতে বলতে এখন বড্ড ক্লান্ত মেয়েটা।টানটান করে বিছিয়ে রাখা বিছানার চাদরের ওপর আলগোছে এলিয়ে দিলো সম্পূর্ণ বদন। মিনিট খানেকের মধ্যেই চোখদুটো কেমন নিভু নিভু হয়ে এলো তার। কিয়তক্ষনের মধ্যেই তলিয়ে যেতে লাগলো ঘুমের দেশে।তবে এরইমধ্যে হুট করে টের পেলো তার পেটের ওপর কারো শীতল হাতের স্পর্শ। অরিন তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে উঠে। চোখদুটো ফট করে খুলে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে — রৌদ্র তার পেটের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। ছেলেটার একহাত ইতোমধ্যেই জামা ভেদ করে তার উদরে গিয়ে পৌঁছেছে। অরিন শুকনো ঢোক গিললো। রৌদ্রের হাতের বেহায়া স্পর্শ আরও গভীরে যেতেই দম আঁটকে আসে মেয়েটার। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কোনমতে বললো,

“ প্লিজ থামুন!”
রৌদ্র হাসলো ঠোঁট কামড়ে। দুষ্ট কন্ঠে হিসহিসিয়ে বললো,
“ ভালো লাগছেনা হানি?”
অরিনের নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে ক্রমাগত। ছেলেটার হাতের বেহায়া স্পর্শ আর সহ্য করতে না পেরে অরিন চোখবুঁজে ঠোঁট কামড়ে পড়ে রইলো।রৌদ্র চোখ তুলে দেখলো একপলক। পরক্ষণেই বাঁকা হেসে বললো,
“ একবার আয় না সানশাইন!”
অরিন মৌন রইলো। গলার কাছে হাজারটা কথা এসে আবারও ফিরে গেলো বোধ হারিয়ে। রৌদ্র এবার সময় নিয়ে উঠে এলো মেয়েটার ওপর। অরিনের বন্ধ চোখের পাতার ওপর পরপর ভেজা চুমু একেঁ হিসহিসিয়ে বললো,

“ সে ইয়েস হানি!”
অরিন নিশ্বাস ফেলছে ঘনঘন। রৌদ্রের ব্যস্ত হাতটা তৎক্ষনাৎ খামচে ধরে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“ এমন করছেন কেনো? আর কয়েক ঘন্টা পরেই আমাদের ফ্লাইট।”
রৌদ্র বাঁকা হেসে মেয়েটার খামচে ধরা হাতটা সরিয়ে দিলো নিজের হাতের ওপর থেকে। পরক্ষণেই নিজের আগের কাজ বহাল রেখেই মেয়েটার কান বরাবর মুখ এনে হাস্কি স্বরে বললো,
“ সে-তো অনেক দেরি হানি! এর আগে এতসময় অব্ধি নিজেকে কিভাবে কন্ট্রোল করবো বলো তো?”
অরিন আর কিছু বললোনা। বললে থোড়াই শুনবে এই লোক? এরচেয়ে বরং চুপচাপ সায় দেওয়া। রৌদ্র মেয়েটার নিরবতা দেখে বাঁকা হাসলো। অতঃপর মেয়েটাকে নিজের মাঝে গভীরভাবে টেনে নিয়ে বলতে লাগলো,
“ ভালোবাসি সানশাইন!”

বাড়িতে একদফা কান্নাকাটি শেষে এয়ারপোর্টে এসেও কান্না জুড়েছেন বাড়ির গৃহিনীরা। মেহরিন বেগম তো এমনিতেই ছিচঁকাদুনে মানুষ।তারওপর সাথে কয়েকজন কাঁদুনে মানুষ পেয়ে ক্ষনে ক্ষনে নাক টানছেন তিনি। জুবায়ের সাহেব বহুবার স্ত্রীকে থামাতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। স্ত্রী তার মুখ ঝামটি দিয়ে বলেছে — বাচ্চাগুলো চলে যাচ্ছে আর আমি কাঁদবো না? আমায় কি পাষাণ মনে হয় নাকি তোমার?

অগত্যা এমন বাক্যে পুরোপুরি দমে গিয়েছেন ভদ্রলোক। এদিকে রাফিয়া বেগমের মতো শক্ত খোলসে আবৃত মানুষটাও সেই কখন থেকে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন নিঃশব্দে। জুবাইদা বেগমসহ বাকিরাও ঘেরাও দিয়ে রেখেছেন মা-মেয়েকে।হয়তোবা সুযোগ খুঁজছেন তারাও, মেয়েটাকে বুকে নিয়ে কাঁদার। ওদিকে তাদের এমন কান্নাকাটিতে বেজায় বিরক্ত রৌদ্র। না ঠিক কান্নাকাটির জন্য না…আসলে তার বিরক্তির কারণ হচ্ছে তার পিচ্চি বউজানটা। সবাই মিলে মেয়েটার সামনে কাঁদছে, আর মেয়েটাও কেমন তাদের সঙ্গে সায় দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে হু হু করে। অথচ মেয়েটার যে কাঁদলে মাথাব্যথা করে সে খবর কি আর আছে তার! থাকলে বোধহয় গলা-ছেড়ে কাঁদত না এতো। ওদিকে কবির সাহেব ছেলেকে সর্তক বুলি দিয়ে যাচ্ছেন।

মেয়েটাকে সাবধানে রেখো,ওর খেয়াল রেখো, হ্যান-ত্যান আরও কতকি! অথচ রৌদ্রের সেসবে কোনো ধ্যান নেই। তার সকল ধ্যান যেন অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকা মেয়েটার দিকে। রৌদ্র চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে। তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙছে ধীরে ধীরে। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে বাবার হাতে ধরে রাখা পানির বোতলটা নিয়ে তৎক্ষনাৎ ছুটে গেলো মা-চাচীদের নিকট।এদিকে কথা বলার মাঝখানে ছেলের ওমন চলে যাওয়া দেখে হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে রইলো কবির সাহেব। রৌদ্র শক্ত মুখে এগিয়ে আসে অরিনের নিকট। গলায় গাম্ভীর্যের ছাপ ফুটিয়ে কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,

“ আর কত কাঁদবে তোমরা? আমার বউজানটা তো অসুস্থ হয়ে পড়বে কাঁদতে কাঁদতে। প্লিজ এবার থামো।”
ভদ্রমহিলারা সকলেই কান্না ভুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো এহেন কথা শুনে। অথচ রৌদ্রের সেদিকে কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অরিনকে নিয়ে। মেয়েটার কনুই চেপে তাকে নিয়ে গিয়ে বসালো খানিকটা দূরের একটা চেয়ারে। পকেট থেকে রুমাল বের করে সেটা পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিলো খানিকটা। অতঃপর ভেজা রুমাল দিয়ে আলতো করে মুছে দিলো মেয়েটার কান্নাভেজাঁ চোখমুখ। অরিন ফের সামান্য ফোপাঁতে নিলেই রৌদ্র দিলো এক ধমক। খেঁকিয়ে বললো,

“ গাল বরাবর থাপড়িয়ে লাল করে দিবো যদি আরেকটুও কাঁদিস তুই।”
এহেন ধমকে যারপরনাই মুখটা কাচুমাচু হয়ে এলো অরিনের। রৌদ্র দেখলো সবটা। পরক্ষণেই মেয়েটাকে দেওয়া এহেন ধমকে নিজের কাছেই কেমন একটা খারাপ লাগছে তাঁর। সে তৎক্ষনাৎ একহাতে অরিনের মাথাটা চেপে ধরে নিজের পেটের সাথে। মেয়েটার মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে নরম কন্ঠে বলে,
“সরি সানশাইন! কিন্তু তুই কেনো বুঝিস না জানবাচ্চা? তুই কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।আমাকে কষ্ট দিতে কী তোর খুব ভালো লাগে?”
অরিন দু’ধারে আলতো করে মাথা নাড়ায়। রৌদ্র হালকা হাসলো তা দেখে।মেয়েটার থুতনিতে আলতো করে আঙুল ঠেকিয়ে মুখটা সামান্য উঁচু করে বলে,

“ তাহলে একটু হাসো তো হানি!”
অরিন হাসলোনা। উল্টো ছলছল চোখজোড়া রৌদ্রের দিকে তাক করে রাখলো।রৌদ্রের বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে তা দেখে। সে তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এসে মেয়েটার পাশ ঘেঁষে বসলো।একহাতে অরিনের কাঁধ জড়িয়ে ধরে, অন্যহাতে মেয়েটার পেট বরাবর সুড়সুড়ি দিয়ে বললো,
“ দেখিতো আমার জানবাচ্চার হাসিটা কোথায় লুকিয়ে আছে!”
পেট বরাবর সুড়সুড়ি পেতেই ফিক করে হেসে ওঠে অরিন। হাসতে হাসতে ঢুলে পড়ে রৌদ্রের গায়ে। ওদিকে বাড়ির সকলে এতক্ষণ নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখলেন সবটা।রৌদ্রের কেয়ারিং এ তারা যে বরাবরই মুগ্ধ তা আর বুঝতে বাকি নেই! কিয়তক্ষন বাদে অনিক ছুটে আসে রোদ অরিনের নিকট।এসেই বলে ওঠে,

“ ভাইয়া চলো! একটা ফেমিলি ফটো হয়ে যাক!”
রৌদ্র মেয়েটাকে আগলে নিয়েই উঠে দাঁড়ায়। অনিকের কথায় সন্দিহান গলায় বলে,
“ কিন্তু ছবি কি ফোনে তুলবি?”
অনিক দু’ধারে মাথা নাড়ায়।পরক্ষণেই হাতের ইশারা অদূরে তাক করে বলে,
“ নাতো! ঐ যে প্রফেশনাল ক্যামেরা ম্যান।তাদেরকে দিয়ে তুলাবো।চলো!”
রৌদ্র হেসে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো অনিকের সাথে। এহসান বাড়ির প্রতিটি সদস্য দাঁড়ালো এয়ারপোর্টের টার্মিনাল এরিয়ায়। সকলে একযোগে পাশাপাশি দাঁড়াতেই ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা তাক করলো তাদের দিকে। গলা উঁচিয়ে বললো,

“ স্যার,ম্যাম! প্লিজ গিভ আ হিউজ স্মাইল!”
সকলেই গালভর্তি হাসি টানলো। এই সুযোগে রৌদ্র অরিনের কোমর চেপে তাকে আরেকটু কাছে টেনে আনলো।অরিন তৎক্ষনাৎ মিনমিনে স্বরে বলে ওঠে,
“ ডাক্তার সাহেব! আপনাকে স্মাইল করতে বলা হয়েছে, আমার কোমর টেনে ধরতে নয়!”
রৌদ্র ক্যামেরার দিকে চোখ রেখেই ঠোঁট কামড়ে হাসলো। পরক্ষণেই ফিসফিস করে বললো,
“ সো হোয়াট? আমার বউজানকে আমি ধরবো, তাতে তোমার কী মেয়ে?”

অরিন ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। অতিষ্ঠ কন্ঠে বলে,
“ এই পাগলামি গুলো কি আর বাদ দেবেন না আপনি?”
এপর্যায়ে মুচকি হাসলো রৌদ্র। মেয়েটার কোমর বরাবর চাপ দিয়ে বললো,
“ মৃত্যুর আগ অবধি বাদ দিবো বলে তো মনে হচ্ছে না হানি!”
অরিন হেসে ওঠে আনমনে। লোকটা যে এমন কিছুই বলবে তা যে আগে থেকেই জানা তার! তারপরও কেন যেন শুনতে বেশ লাগে অরিনের। তাছাড়া প্রেমিকের পাগলামি দেখতে কার ভালো লাগে না শুনি?

প্লেনে বসেছে অরিন,রৌদ্র। সিটে বসে থাকা অবস্থায় ইঞ্জিনের গর্জনের শব্দ স্পষ্ট কানে আসছে অরিনের। প্লেন ধীরে ধীরে রানওয়ে ছাড়ছে।এক অদ্ভুত উত্তেজনায় অরিন খুব শক্ত করে চেপে ধরে রৌদ্রের বাহু।রৌদ্র মেয়েটার অস্থিরতা টের পেয়ে তৎক্ষনাৎ অরিনকে নিজের বুকে চেপে ধরে। আলতো কন্ঠে বলে,
“ প্রথম দিকে একটু খারাপ লাগবে জানবাচ্চা। তুই আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখ। দেখবি একটুও ভয় হচ্ছেনা!”
অরিন তাই করলো।রৌদ্রের বুকে মুখ লুকিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো ছেলেটাকে।প্লেন দ্রুত গতিতে ছুটছে, সেই সাথে দমবন্ধ হয়ে আসছে অরিনের। পেছনের চেয়ারের সঙ্গে গা চাপা লাগতেই সে আবারও খপ করে চেপে ধরে রৌদ্রের বুকের কাছের শার্টের অংশ। মিনিট খানেক বাদেই প্লেন টেক-অফ হলো। পৃথিবী ধীরে ধীরে নিচে চলে যাচ্ছে! অরিন কিছুটা স্থির হয়ে রৌদ্রের বুক থেকে মাথা উঠায়।সিটে বসে জানালার বাইরে চোখ রাখতেই দেখে — ঘরবাড়ি, গাছপালা সবকিছু কেমন ছোট ছোট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অরিন তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে বসলো। রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,

“ ডাক্তার সাহেব! আমরা আকাশে!”
রৌদ্র মুচকি হাসলো। হাত বাড়িয়ে মেয়েটার গালের ওপর রেখে নরম কন্ঠে বললো,
“ হ্যা!”
অরিন খুশি হলো যেন।কিছুক্ষণ আগের সেই অদ্ভুত অস্থিরতা এখন কেমন ছুটে পালিয়েছে কোথাও। মেয়েটা উৎফুল্ল হয়ে একনাগাড়ে রাজ্যের বকবক জুড়ে বসেছে। অথচ রৌদ্র কেমন মনোযোগ সহকারে শুনছে মেয়েটার বকবক। আশ্চর্য! ছেলেটার চোখেমুখে নেই তেমন বিরক্তির ছাপ।সেথায় শুধুমাত্র মুগ্ধতার আভাস। কিয়তক্ষন বাদে অরিন কথা থামালো।রৌদ্রের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ এভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন?”
রৌদ্র মুচকি হাসলো। প্রতিত্তোরে বললো,
“ আমার সানশাইনকে!”
অরিন হেসে ওঠে এহেন কথায়। রৌদ্রের বাহু টেনে ধরে আলগোছে মাথা রাখে ছেলেটার কাঁধে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের বলে ওঠে,
“ শুনুন ডাক্তার সাহেব!”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ চুমু বসায় মেয়েটার মাথায়। ভনিতা ছাড়া জবাব দেয়,
“ বলুন বউজান!”
“ আচ্ছা একটা কথা বলুনতো! আমাদের মাঝে কোনোদিন ঝগড়া হলে সবার আগে সরি বলবে কে?”
“ অবশ্যই আমি বউজান!”
অরিন হাসলো ঠোঁট কামড়ে। পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করলো

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৭৩

“ সবসময় আমার কথা বাধ্য বরের মতো শুনবেন তো?”
“ আরে বউজান! শুনবো মানে? আমিতো আপনার আঙুলের ইশারায় নাচবো দেখে নিয়েন।”
এপর্যায়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা অরিন। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মেয়েটা।ওদিকে রৌদ্র মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো দুগালে গর্ত পড়া মেয়েটার দিকে। কে বলবে এই মেয়েটা রৌদ্রের হাঁটুর বয়সী? অথচ মেয়েটার ক্ষমতা দেখো! রৌদ্রের মতো শক্তপোক্ত যুবককে কেমন আঙুলের ডগায় নিয়ে ঘুরাচ্ছে রীতিমতো! অবশ্য ঘোরানোটাও স্বাভাবিক। যেই অনুভুতির টানে দু’জনে আজ এক হয়েছে, শত ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে নিজেদের আপন করে পেয়েছে — সে অনুভূতিকে নিসন্দেহে ভুলতে পারা দায়! আজ তাদের পূর্ণতা হলো।পূর্ণতা পেলো তাদের সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি!

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here