সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩৯

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩৯
লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা

শ্রেয়া ধীরস্থির ভঙ্গিতে, গুটি গুটি পায়ে ছাদের দরজা অবধি এলো। গরম গরম নিঃশ্বাস ফেলছে ও। সামনে তাকিয়ে দেখে তূর্য কানে মোবাইল ধরে রেখেছে। হয়ত কথা বলছে কারো সাথে। সূর্যের প্রখর তাপে ছোট ছোট চুল থেকে ঘাম বেয়ে ঘাড়,পিঠ স্পর্শ করছে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভিজে উঠেছে পড়নের নীল টি শার্ট। এই লোকের কি কষ্ট হচ্ছে না?ঘামে হাতের লম্বা লম্বা লোমশগুলোও হতাশায়,দুঃখে লেপ্টে আছে। এইবার শ্রেয়ার ভীষণ খারাপ লাগছে। তূর্য কেমন করে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারছে না ও।

আষাঢ় মাসে কথা ছিল বৃষ্টি রিমঝিম ছন্দ তোলার। সেই ছন্দে মানবমন উতলা হতো,নৃত্য তুলে নাচত। রোমাঞ্চকর হতো পরিবেশ, প্রকৃতি, মানুষজন। অথচ হচ্ছে তার উল্টো। পা বাড়িয়ে মন্থরগতিতে সুঠাম,সৌষ্ঠব দেহের সান্নিধ্যে নিজের শীর্ণ,চিকন গা এগিয়ে আনল শ্রেয়া। তূর্য তীররেখা নজরে একবার তাকাল ওর দিকে। পুনরায় দৃষ্টি অদূর অম্বরে নিবদ্ধ করে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ রাখছি ভাই। বউ দাঁড়িয়ে আছে কিছু বলার জন্য। তাকে অপেক্ষা করাতে কষ্ট হয় আমার। ‘
শ্রেয়া অতিকায় অবাক হলো। চমকপ্রদ চাউনি নিক্ষেপ করলো তূর্যর দিক। তূর্য মোবাইল টা পকেটে রেখে এক হাত বাড়িয়ে শ্রেয়ার শরীর টা নিজের মধ্যে আবদ্ধ করতে গিয়েও থেমে যায়। কপালে
তুষ্ট বলিরেখার ভাঁজ ফোটে ওঠে। শ্রেয়া রিনঝিনে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,’ কি হয়েছে?’
তূর্যর নিরলস জবাব, ‘ ঘেমে আছি,এখন জড়িয়ে ধরবো না। ‘

শ্রেয়ার কন্ঠনালি ভেদ করে কোনো কথা এলো না। একটু একটু করে অতীব নিকটস্থে যায় ও তূর্যর। ছোট্ট বাচ্চাদের ন্যায় মিশে যায় বুকে। আঁকড়ে ধরে গেঞ্জি। তূর্যর ওষ্ঠদ্বয়ে নিঃশব্দ হাসি অনেকখানি জায়গা দখল করে। শ্রেয়ার ছাদের মেঝে ছুঁয়ে থাকা ওড়না টা টেনে ওর মাথার উপর দিয়ে সমস্ত চুল,মাথা ঢেকে দিল। সর্বদা ভরাট,গম্ভীর কন্ঠস্বর টা কেমন আদুরে, নরম হয়ে উঠলো। বললো,’ রোদ আমার বউকে কালো ভূত বানাতে চাইছে। ‘

‘ আর আপনি?আপনার শরীর খারাপ লাগছে না। এখানে এসে ফোনে কথা বলতে হয়?’— নির্ভয়ে প্রশ্ন করে শ্রেয়া।
প্রশ্ন করার অনুমতি টা তূর্য-ই দিয়েছে ওকে। তবুও বেশ ভয় হয় ওর। তূর্যর বদমেজাজী, রূঢ় স্বভাব সম্পর্কে ও অবগত। অবশ্য প্রথম পরিচয় টা ফুলশয্যায় হয়েছিল যদিও মানুষ টা মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত ছিল। এবং দ্বিতীয় বার সুস্থ মস্তিষ্কে এই ছাদেই দাঁড়িয়ে কি ত্যাড়া বাঁকা ব্যবহার করে ওর সঙ্গে। তখন থেকেই তূর্যর প্রতি ওর ভীতি। শ্রেয়া ভীতি কে একপাশে রেখে তূর্যর সামনে কথা বলতে গিয়ে দোনোমোনো করার আরেকটা কারণ বের করেছে, তা হলো সম্মান। ও এই মানুষ টাকে প্রচন্ড সম্মান করে। বুকে মুখ গুঁজে চক্ষুদ্বয় বুঁজে ফেলল। অচিরেই শ্রবণ হলো গলার আওয়াজ,
‘ তোমার মতো সুন্দরী বউ ফেলে প্রেমটেম আমার দ্বারা হবে না। আমি যেদিন ছোট্ট শ্রেয়সীর মাথায় জুটি দেখেছি,বড় শ্রেয়সীর কাজলমাখা আঁখি দেখেছি সেদিনই শেষ। একদম শেষ। সেটা আমার বউও জানে ভালো করে। ‘
শ্রেয়া লাল রঙের প্রলেপে ঢাকা কপোলদ্বয় লুকোতে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো। তূর্য কর্ণ পাতায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
‘ কি করছো?এটা কিন্তু ছাদ। চলো রুমে যাই। ‘

বড্ড রসাত্মক শুনালো কন্ঠ টা। কানে ঝংকার তুলে একেকটা ধ্বনি। শ্রেয়া লজ্জায় নেতিয়ে পড়ছে। তবুও অস্পষ্ট,মিহি স্বরে প্রতিবাদ করার তীব্র প্রচেষ্টা করে,
‘ আমি তো,’
‘ তুমি তো কি?চেক করতে এসেছো ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি কিনা?’
‘ চেক করতে আসবো কেন?আপনি সিগারেট খান। স্বচক্ষে দেখলাম একদিন। ‘
বুক থেকে মুখ তুলে নির্দ্বিধায় কথা খানা ব্যক্ত করে শ্রেয়া। তূর্য ওকে ছাদের রেলিংয়ের সঙ্গে ঠেসে ধরলো। দু হাত দুই পাশে রেখে আঁটকে ফেললো ওকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘ কিস করার সময় নাকে সিগারেটের গন্ধ লেগেছিল?লাগলে ওয়াক,থু থু করো নি কেন?লেগেছিল?’
শ্রেয়া কিংকর্তব্য বিমূঢ়। স্থির নেত্রে তাকিয়ে রইল। ওর ললাটে জমাট হয়ে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে যাচ্ছে কানের কাছ দিয়ে। তূর্য একটু একটু করে ঘমার্ক্ত ফোঁটাতে হাত ছুঁয়ে দিল। নিশ্চল, মায়াবী নয়ন জোড়ায় কতক্ষণ চেয়ে থেকে কপালে রাখল ওষ্ঠদ্বয়। শ্রেয়ার বক্ষস্থল থরথর করে কেঁপে উঠলো। শরীরের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সেই কম্পন। ওর মনে হচ্ছে জীবন টা এখন সুখের অনুচ্ছেদ। ভালোবাসার অভাব নেই। যেদিকে দৃষ্টি মেলে রঙিন সুতোয় যেন বাঁধা পড়ে। মাস খানেক আগেই প্রাণ টা চলছিল কোনোরকম। সবকিছু সাদা মলাটে আবৃত থাকে। অতঃপর রঙিন প্রচ্ছদের শিল্পী হিসেবে আসে তূর্য নামক গম্ভীর পুরুষ। ওষ্ঠ এখনও শ্রেয়ার ললাটে ডুবে। কিয়ৎক্ষণ পর কপাল ছেড়ে নেমে আসে তিরতির করা অধর পানে। মুখোমুখি অধর জোড়া। গলা শুকিয়ে গেল শ্রেয়ার। তূর্য কি আজও পানি সাধবে?এখানে জল কোথায় পাবে?সেদিন কি তাড়াহুড়ো করেই না গ্লাসের পানি সমাপ্ত করে ও,মনে হয়েছিল কতযুগ পানি পান করা হয় নি। ভাগ্যিস তূর্য পানি দিয়েছিল নয়ত তৃষ্ণার্ত হয়ে লজ্জার ভারে সোফায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকত।

তূর্য সরে গিয়ে বললো,’ আমি সিগারেট খাই না। একবার যে ছাদে দেখে ভেবেছিলে সেটা ছিল ভুল দেখা। নিচের ফ্ল্যাটের একটা ছেলে খেয়েছিল। অর্ধ অংশ টা ফেলে চলে যেতেই তোমার আগমন। ‘
বিস্ময়াহত চক্ষে তাকায় শ্রেয়া। আনমনে,অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করে বসে,’ সত্যি? ‘
‘ বউ কি বিশ্বাস করে না?’
তূর্যর প্রশ্নে থ মে’রে যায় ও। বিশ্বাস করে ও। অনেক বেশিই করে৷
পুনশ্চঃ লহু স্বরে বলে ওঠে তূর্য,

‘ আমার জীবনের কিছু ভুল অনেকখানি সময় নষ্ট করে দিয়েছে। সুস্থ স্বাভাবিক থেকে আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। অ্যাল-কোহল, সিগারেট এসব ক্ষণিকের ডিপ্রেশন কাটিয়ে একটা মানুষকে মিছে সুখ দিতে পারবে। কিন্তু একটা সময় পাল্টা আক্র’মণ করবে এসব। তোমার কাছাকাছি আমি যে সুস্থতা অনুভব করি সেটা কাটিয়ে আমাকে পা’গল বানানোর ক্ষমতা একমাত্র তুমিই রাখো।যদি মানুষের জীবন সীমা হাজার বছর হতো,তাহলে তোমার সাথেই হাজার বছর বাঁচার আকুতি করে যেতাম শ্রেয়সী। ‘

শ্রেয়া নিশ্চুপ। অন্তর্দেশে শীতল অনুভূতি। অতিরিক্ত দুঃখে চুপ হয়ে যায় একটা মানুষ,শ্রেয়ার তা হচ্ছে না। বরঞ্চ অত্যধিক আনন্দে নির্বাক সে। তূর্য ফের বলে,
‘ ছাদে আসলে যে?’
‘ আয়ুশ ভাইয়া এসেছে। ‘
‘ হঠাৎ? ‘
‘ প্রিয়ু নাকি অনেকদিন ধরে ওনার সাথে কথা বন্ধ করে রেখেছেন তাই। ‘
তূর্য উল্টো ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে বললো,

‘ বাহ!আয়ুশ তো উন্মাদ প্রেমিক হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। চলো নিচে যাই। ‘
এক প্রকার দৌড়ে কাছাকাছি আসলো শ্রেয়া। সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। তূর্য ভ্রুঁ কুঁচকালো ঈষৎ। রাশ ভারী গলায় বললো,
‘ কি হলো?’
‘ আমরা আরও পরে যাই। ‘— কম্পনরত কন্ঠে উত্তর দেয় শ্রেয়া।
তূর্য বাঁকা হাসে। বলে,’ ওদের কি প্রাইভেসির জন্য পুরো ফ্ল্যাট লাগবে?এক রুমে হয় না?আমাদের তো এক রুমেই চলে। সারাজীবন নিরব থেকে এখন আমার থেকে ধাপে এগিয়ে গেল আয়ুশ। বউটা গাধী, বোকাসোকা নাহলে আমি অনেক ধাপ পেরিয়ে যেতাম। ‘
এ যাত্রায় আর সহ্য করতে পারলো না শ্রেয়া। এত মা’রাত্মক কথা!এদিক সেদিক তাকাতেই তূর্য কব্জি চেপে ধরে বুকে মিশিয়ে বললো,’ লুকোচুরি খেলতে হলে আমার বুকেই লুকাও। ‘

প্রিয়ু ভয়ংকর রেগে আছে। রাগের কারণ আয়ুশ সত্যিই ওকে পরীক্ষা খারাপ হওয়াতে আদর দূর ফোনও দেয় নি। পরীক্ষা শেষ হয়েছে কতদিন,ঘন্টা, সেকেন্ড পেরিয়ে গেল। পাঁচটা দিন আয়ুশ ওকে যন্ত্রণায় রেখেছে। বাড়িয়েছে ছটফটানি। পরে যখন রাগ কমলে কল দেয় প্রিয়ু পাল্টা জেদ ধরে ফোন ধরে না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে আবারও চট্টগ্রাম ছুটে এসেছে। এখনও আসার পর থেকে কথা বলছে না প্রিয়ু। এমনকি দরজা লাগিয়ে রুমের ভেতর বসে আছে। আয়ুশ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মলিন কন্ঠে বললো,

‘ আমার যন্ত্রণা হচ্ছে লেট লতিফ। বেরিয়ে আসো। রেজাল্ট খারাপ হলেও বকা দেবো না। বিশ্বাস করো, খুব ভালোবাসি তোমাকে। তোমার চেহারা না দেখলে ভিতরটা ব্যথা করে,কন্ঠ না শুনলে অশান্তি লাগে। বেরিয়ে আসো প্লিজ। ‘
চট করে দরজা টা খুলে গেল। আয়ুশ মুখশ্রী দেখার পূর্বেই ওর উপর ঝাপিয়ে পড়লো কাঙ্ক্ষিত মানুষ টা। প্রিয়ুর নিকট তার নিরামিষ স্বামী এখন বদ প্রেমিক। আয়ুশ শক্ত হাতে পেঁচিয়ে নেয় ওকে নিজের সঙ্গে। গলায় ঠোঁটের তীব্র স্পর্শ মেখে বললো,

‘আমি বার বার ছুটে আসতে রাজি কিন্তু আর একদিনও কথা না বলে থাকতে পারবো না। ছোট্ট জীবন টা অভিমানে কাটিয়ে দিলে ভালোবাসবো কখন?আই লাভ ইউ প্রিয়ু। ‘
প্রিয়ু সঙ্গে সঙ্গেই এক হাত আয়ুশের হৃদয়স্থল বরাবর রাখে। ধ্বক করে ওঠে আয়ুশের ভিতরটা। শুনতে পায় প্রিয়ুর মায়ামিশ্রিত স্বর,
‘ এই স্থানের মালিক আমিই যেন চিরকাল থাকি। ‘

শ্রাবণের হাওয়ায় বিষাদের গন্ধ। মধ্য রাতে ঘুম থেকে ওঠে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে শ্রেয়া। দেখে তূর্য হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার তোরজোর চালাচ্ছে। শ্রেয়া কোনো কিছু না ভেবে বিছানা ছেড়ে ভয়ার্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,’ কোথায় যাচ্ছেন?’
তূর্য ওর হাত ধরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। বলে,’ যেমনই আছো,তেমনভাবেই চলো। ‘
মনটা কু ডাক ডাকছে শ্রেয়ার। গলা ধরে এলো,’ কেন?’

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩৮

‘ প্রিয়ু গাড়িতে অপেক্ষা করছে। বাবার শরীর ভালো নেই। হার্ট অ্যা’টাক করেছেন। ‘
ভূ-তল কেঁপে উঠলো শ্রেয়ার। সেদিনই না ওর সন্ধি হলো বুড়ো মানুষ টার হৃদয়ের সঙ্গে? সুন্দর একটা বাবা- মেয়ের সম্পর্কও সৃষ্ট হয়েছিল। এভাবেই কি সুন্দর মুহুর্ত গুলো জলদি জলদি ফুরিয়ে যায়?

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৪০