সাতরঙা প্রজাপতি গল্পের লিংক || মাশফিত্রা মিমুই

সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১
লেখনীতে: মাশফিত্রা মিমুই

“তোমাদের জামাই না আমায় একটুও ভালোবাসে না ভাবী। উনার চাহনি হাবভাব দেখলেই শুধু মনে হয় উনি আমার উপর বেজায় বিরক্ত।”
ননদের কথায় বিরক্ত হয়ে চোখমুখ কুঁচকে নিলো সম্পা।ভাবীর এমন মুখভঙ্গি দেখেও জ্যোতির কোনো ভাবান্তর হলো না। উদাস কণ্ঠে বললো,

“আমার কেন জানি মনে হয় আমাকে বিয়ে করতে উনি বাধ্য হয়েছেন। হয়তো কেউ জোর করে আমার সঙ্গে উনার বিয়ে দিয়েছে। আচ্ছা ভাবী উনি কী অন্য কাউকে ভালোবাসে?”
সম্পা এবার মুখ খুললো। কর্কশ কণ্ঠে বললো,”তোর স্বামী কি বাচ্চা ছেলে নাকি? এত বড়ো ছেলেকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার সাধ্য কার আছে শুনি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তাহলে উনি কেন আমার সঙ্গে ঠিক করে কথা বলে না? কেন আমায় ভালোবাসে না?”
“বিয়ের এক বছর হয়েছে যতবার আসিস এই এক কথাই বারবার বলতে বলতে আমার কান নষ্ট করে দিচ্ছিস। আচ্ছা এসব আমায় বলে কী লাভ?সরাসরি তোর স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।”
জ্যোতি মন খারাপ করে বললো,”অনেকবার ভেবেছিলাম প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে চাইবো কিন্তু উনার সামনে গেলেই যে আমার ভয় করে সব কথা অগোছালো হয়ে যায়।”

সম্পা আর কথা বাড়ালো না। নিজের কাজে মন দিলো। তরকারি কাটা শেষে রান্না বসালো চুলায়। ভাবীর নিরবতা দেখে জ্যোতি উঠে গেলো সেখান থেকে। যহরের আজান দিয়েছে তাই গোসল সেরে নামাজ পড়তে গেলো। নামাজ শেষে মায়ের ঘরে এলো। জায়েদা খাতুন শুয়ে আছেন বিছানায়।কয়েক বছর ধরেই প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন তিনি। মুখ বেঁকে গেছে,একা একা চলাফেরাও করতে পারেন না। শুয়ে বসেই দিন কাটে উনার।

অস্পষ্ট শব্দে মেয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,”ওই বাড়ির কারো লগে কী ঝামেলা হইছে? ফিরবি কবে? জামাই অহনো আহে নাই?”
জ্যোতি উদাস ভঙিতে জানালার ধারে চলে গেলো। গ্ৰিল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি স্থির করল। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে বললো,”কার সঙ্গে ঝামেলা হবে মা? আমি নামক মানুষটির অস্তিত্ব কী কারো কাছে আদৌ আছে?আর তোমার জামাই!উনার তো অনেক কাজ মা। অনেক ব্যস্ত মানুষ উনি। উনার ফেরার সময় কোথায়?”

“ফোন দে একটা।”
জ্যোতি মুচকি হাসলো। যেই হাসিতে অনেক না পাওয়া দুঃখ বেদনা ভর করেছে। চোখ দুটো হয়ে গেছে পানিতে টুইটম্বুর। কাঠের আলমারির উপর রাখা বাটন মোবাইলটির দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ক্লাস থ্রিতে পড়া এক বাচ্চা মেয়েকে তিন মাস টিউশন করানোর টাকা দিয়ে এই মোবাইলটি কিনেছিল জ্যোতি। তাও আবার বিয়ের আগে। বর্তমান যুগে মোবাইল ছাড়া কী আর চলে?এন্ড্রোয়েড মোবাইল কেনার সামর্থ্য ছিলো না জ্যোতির। তাই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী এই মোবাইলটিই কিনেছিল সে। অনেক দিন হয়েছে মোবাইলে রিচার্জ করা হয় না। রিচার্জ করার দরকারও হয় না কার সঙ্গেই বা কথা বলবে? একটা সময় অনেক বান্ধবী ছিলো জ্যোতির কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখন আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তারাও খোঁজ নেয় না তাই জ্যোতিও আগ বাড়িয়ে আর কথা বলে না তাদের সঙ্গে।

চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল জ্যোতির। তার দৃষ্টি তার মুখায়ব দেখে যে কেউই বুঝে ফেলবে তার মনে অনেক দুঃখ। সে দুঃখী একটি মেয়ে। কিন্তু কীসের এত দুঃখ তার? খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে জ্যোতি বললো,”জানো মা মাঝে মাঝে না আমার মনে হয় আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মা’রা যাবো।।”
মেয়ের এমন কথায় আঁতকে উঠলেন জায়েদা খাতুন। মায়ের দিকে না তাকিয়েই তার মুখে ফোটা আতংকের ছাপ বুঝতে পারলো জ্যোতি। বললো,

“আমি হয়তো মন খুলে কথা বলতে না পারার কারণে মা’রা যাবো। হয়তো কোনো আবদার করতে না পারার কারণে মা’রা যাবো। আমি হয়তো সামান্য একটু ভালোবাসার অভাবে মা’রা যাবো মা।”
জায়েদা খাতুনের মনটা ছটফট করে উঠল। মেয়ের উদ্দেশ্যে কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিলেন তখনি ঘরে আগমন ঘটে সম্পার। বিছানার একপাশে খাবারের প্লেট আর গ্লাস রেখে বললো,”মাকে খাবার আর ওষুধ খাইয়ে নিজে খেতে আয় জ্যোতি।”

আলগোছে চোখের পানি মুছে জানালার কাছ থেকে সরে এলো জ্যোতি। হাত ধুয়ে ভাত মাখিয়ে মায়ের মুখের কাছে এক লোকমা ধরতেই তিনি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। ছোটো থেকেই মায়ের চাহনি অঙ্গভঙ্গি দেখেই মায়ের অব্যক্ত কথা বুঝতে পেরে যেতো জ্যোতি। হেসে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,”কিছু হয়নি মা।আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি যে খুব সুখে আছি।”
জায়েদা খাতুন নিশ্চিন্ত হলেন। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়ে গেলো উনার। প্রশ্ন করলেন,”তাহলে ওমন একটা কথা ক্যান বললি?”

ভেতরে হাজারো যন্ত্রনা জমিয়ে রেখে সবার সামনে কি সুন্দর হাসতে পারে জ্যোতি। সবসময় সবার সামনে ঠোঁটের কোণে নির্মল হাসি ঝুলেই থাকে তার। এই হাসির কারণেই হয়তো কেউ তার ভেতরের দহন টের পায় না। জ্যোতি উত্তরে বললো,”এমনি বলেছি মা। এবার খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি। আমারও তো খিদে পেয়েছে নাকি।”

মেয়ের কথায় লজ্জা পেলেন জায়েদা খাতুন। প্যারালাইসড হওয়ার পর থেকে কোনো কাজই তিনি করতে পারেন না খাবারটাও খেতে পারেন না। বিয়ের আগে জ্যোতিই এই দায়িত্বটি পালন করতো। কিন্তু জ্যোতির বিয়ে হবার পর থেকে পুত্রবধূই উনাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। আর রাতে ছেলে বাড়ি ফিরে মায়ের প্রতি এই দায়িত্বটা পালন করে। প্লাস্টারহীন ছোট্ট একটা ইটের বাড়িতে থাকলেও দু বেলা ডাল ভাত খাওয়ার পরেও মনে উনার কষ্ট নেই। এই ছোট্ট কুটিরেই যেনো পৃথিবীর সব সুখ এসে ঠাঁই করে নিয়েছে।

জায়েদা খাতুনকে খাইয়ে ঘর থেকে বের হলো জ্যোতি। সম্পা খাবার বেড়ে রেখেছে। সেখানে বসেই নিজের ছোটো ছেলে মিহাদকে খাইয়ে দিচ্ছে। জ্যোতিকে দেখেই মিহাদ বলে উঠল,”মা মা ফুপি আচছে।”
জ্যোতি পাটিতে বসলো। মিহাদের কথাগুলো এখনো সম্পূর্ণ স্পষ্ট আর শুদ্ধ হয়নি। সম্পা আরেক লোকমা খাবার তুলে মিহাদের মুখের দিকে ধরতেই মিহাদ মুখ সরিয়ে নিয়ে বায়না ধরে বললো,”আমি ফুপির হাতে কাবো মা।”

ছেলের কথায় বিরক্ত হলো সম্পা। ধমক দিয়ে বললো,”কোনো বায়না নয়। আমার হাতেই চুপ করে খেয়ে নে।”
মায়ের কথা শুনলো না মিহাদ। দৌড়ে এসে জ্যোতির কোলে বসলো। জ্যোতি বললো,”থাক না ভাবী। ও না হয় আজ আমার হাতেই খাক। তুমিও খেতে বসো।”

সম্পা আর দ্বিমত করল না। প্লেটে ভাত নিয়ে নিজে খেতে লাগলো। আর জ্যোতি যত্ন সহকারে মিহাদকে খাওয়াতে লাগলো। একপর্যায়ে মিহাদ উঠে গেলো। বললো,”আর কাবো না। মুখ ধুইয়ে দাও ফুপি।”
পাশ থেকে একটি বাটি নিয়ে তার মধ্যে হাত ধুয়ে মিহাদের মুখ মুছিয়ে দিলো জ্যোতি। মিহাদ দৌড়ে চলে গেলো। জ্যোতি এবার নিজের খাওয়ায় মনোনিবেশ করল। বারবার জ্যোতির দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে সম্পা।
ভাবীর এমন চাহনি দেখে খাওয়ার ফাঁকেই জ্যোতি শুধালো,”কিছু বলবে ভাবী?”

“বলতে তো অনেক কিছুই চাই।”
“বলো তাহলে।”
খানিকটা সময় নিয়ে সম্পা বলতে লাগলো,”তোর ভাইয়ের ছোট্ট একটা মুদির দোকান। ওই মুদির দোকানের থেকে যা আয় হয় তাই দিয়েই মায়ের চিকিৎসা, ছেলে-মেয়ে দুটোর লেখাপড়া আর সংসার চলে। মিহাদও বড়ো হয়ে যাচ্ছে বছর ঘুরলে ওকেও তো স্কুলে ভর্তি করতে হবে তার উপর অনেক টাকা খরচা করে তোকে বিয়ে দিয়েছি।মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে সেই ঋণ এখনও পুরোপুরি শোধ করা হয়নি। বাজারে দ্রব্যের দাম অনেক চড়া, একা হাতে তোর ভাইকে সংসার চালাতে কত হিমসিম খেতে হয় সবই তো বুঝিস তুই।”

খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো জ্যোতির।পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্পার দিকে।সম্পা আবারো বললো,”দুদিন পর পর শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে ভাইয়ের বাড়ি এসে পড়ে থাকলে হবে? সবসময় তো আর তোকে খালি হাতে পাঠাতে পারি না। এতকিছু কোত্থেকে জোগাড় করবো বল তো?”

খাওয়া থেমে গেলো জ্যোতির,লজ্জাবোধ হচ্ছে তার। ভাবীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সম্পা বললো, “আমার শ্বশুর তার বউ আর ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে রেখে ঠিকই আরেক জায়গায় বিয়ে করে নিয়ে শান্তিতে সংসার করছেন। সম্পত্তি তো দূরে থাক ছেলে মেয়ের দায়িত্ব পর্যন্ত নিলেন না। মা কষ্ট করে তোদের বড়ো করেছে তোর ভাই তোকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িই তো মেয়েদের আসল ঠিকানা।

এভাবে এখানে পড়ে থাকলে আশেপাশের লোকজন তো মন্দ কথা বলবে। কাল তো পাশের বাড়ির চাচী সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন জ্যোতি কী শ্বশুর বাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছে? জামাই কী ছেড়ে দিলো নাকি ওকে?”
জ্যোতি নিশ্চুপ হয়ে আছে। সম্পা আবারো বললো, “সময় থাকতে থাকতে নিজের সংসার নিজে বুঝে নে।তোর স্বামীকে বল তোকেও যেনো তার সঙ্গে করে নিয়ে যায়। অযথা শ্বশুর বাড়িতে পড়ে থাকবি কেন? তুই বলতে না পারলে আমি তোর ভাইকে বলে তোর শাশুড়ি কিংবা তোর স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে বলি।”

জ্যোতি খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। জড়ানো কণ্ঠে বললো,”দরকার নেই ভাবী। আমি আজ বিকেলেই চলে যাবো।”
কথাটি বলেই ঘরে চলে গেলো জ্যোতি। চোখের পানি আর বাঁধ মানছে না। পৃথিবীতে সব সহ্য করা গেলেও কাছের মানুষের জীবনে বোঝা হয়ে থাকার মতো বড়ো দুঃখ কষ্ট হয়তো আর দ্বিতীয়টি নেই। জ্যোতি যখন জায়েদা খাতুনের গর্ভে বেড়ে উঠছিল তখন জ্যোতির বড়ো ভাই জাহিদের বয়স ছিলো মাত্র ছয় কিংবা সাত। ওদের বাবা ছিলেন একজন প্রবাসী। একটা সময় তাদের বাবা মিজান উদ্দিন বাড়িতে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেন। জায়েদা খাতুন যেনো সন্তানদের নিয়ে অথৈ সাগরে ভেসে যাচ্ছিল‌। একদিক দিয়ে অসুস্থতা, সংসার আরেকদিক দিয়ে স্বামীর চিন্তা অর্থ সংকট।

জায়েদা খাতুনের শ্বশুর শাশুড়ি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন তাদের হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই তারা পুত্রবধূ এবং নাতি নাতনিদের কোনো খরচা বহন করতে পারবেন না। তখন বাধ্য হয়েই বাপের বাড়ি গিয়ে উঠেন জায়েদা খাতুন। বাবা উনার বছর দুয়েক আগেই মা’রা গেছিলেন। মা’কে ভাইরা খাওয়া পড়া দেয়। বোনের এমন অবস্থায় জায়েদা খাতুনের ভাইরা স্পষ্ট বলে দিয়েছিল উনারা বোনের দায়িত্ব নিতে পারলেও বোনের সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারবে না।

তখন বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া সামান্য ওয়ারিশ টুকু বিক্রি করে দিতে চাইলেন জায়েদা খাতুন। কিন্তু ভাইরা এসে বাঁধা দেয় তাতে। শেষে ভাইদের সঙ্গে লড়াই করে এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিদের সাহায্যে ওয়ারিশ বিক্রি করে মেয়েকে দুনিয়ার আলো দেখান তিনি। ছেলে মেয়েদের লালন পালন করতে থাকেন।

বছর চারেক পর মিজান উদ্দিন দেশে ফিরেন। লোকমুখে স্বামীর ফেরার কথা শুনে ছেলে মেয়েসহ শ্বশুর বাড়িতে ফিরে যান জায়েদা খাতুন কিন্তু সেখানে গিয়েই মাথায় বাজ পড়ে উনার। মিজান উদ্দিন এক বিদেশি মহিলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।মহিলাটি নাকি উনার স্ত্রী। জায়েদা খাতুন যখন এর প্রতিবাদ করে‌ তখন উনার শ্বশুর শাশুড়ি আর ননদরা মিলে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে বাড়ি ছাড়া করে উনাকে।

ছেলে মেয়েদেরকে তাদের বাবা ত্যাগ করতে পারলেও মা জায়েদা খাতুন ত্যাগ করতে পারেননি। তিনি ছিলেন মোটামুটি শিক্ষিত একজন নারী। সন্তানদের নিয়ে শহরে চলে আসেন ছোট্ট একটি টিনের বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি শুরু করেন। জাহিদ যখন এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চিন্তা করছিল তখনি জায়েদা খাতুন স্ট্রোক করেন। অফিসের লোকেরা হাসপাতালে ভর্তি করে উনাকে। ডান পাশ প্যারালাইসড হয়ে যায় উনার। তারপর মা বোনের সব দায়িত্ব জাহিদই নিজ কাঁধে তুলে নেয়।

মায়ের জমানো টাকা দিয়ে গ্ৰামে ফিরে হাস মুরগীর ব্যবসায় শুরু করে। প্রথম প্রথম ভালোই লাভ হচ্ছিলো তার। লাভের টাকায় তিন রুমের একটি ইটের বিল্ডিং তৈরি করে ভাড়া বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়িতে উঠে। তারপর সম্পাকে বিয়ে করে। কিন্তু হঠাৎ করেই এক অসুখে আক্রান্ত হয়ে ফার্মের হাস মুরগী মা’রা যেতে থাকে। আর জাহিদ ব্যবসায় লস খায়। তারপর বাজারে একটি মুদি দোকান ভাড়া নেয়, ধার দেনা করে ভালো একটা পরিবারে বোনের বিয়ে দেয়।এই মুদির দোকান চালিয়েই ধারকৃত অর্থ পরিশোধের পাশাপাশি এখন সংসার চালায় জাহিদ।

বোরকা হিজাব পরে তৈরি হয়ে নিলো জ্যোতি। মায়ের ঘরে এলো বিদায় নেওয়ার জন্য। জায়েদা খাতুন ঘুমাচ্ছেন। ওষুধ গুলো সেবন করার পর আর তিনি জেগে থাকতে পারেন না। মায়ের আর ঘুম ভাঙালো না জ্যোতি। দু চোখ ভরে মাকে দেখে ব্যাগ হাতে বের হলো ঘর থেকে।

সম্পা পেছন থেকে বললো,”আমরা সবসময় তোর ভালোই চাই। এটা তোর নিজের বাড়ি যখন ইচ্ছে তখনি তুই এখানে আসতে পারিস কিন্তু তাই বলে নিজের সংসার ফেলে যখন তখন তো আর এসে থাকা উচিত নয় বল।”
“হুম আসি।” কোনদিকে না তাকিয়েই বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো জ্যোতি। ভাইয়ের বাড়ি থেকে জ্যোতির শ্বশুর বাড়ির দূরত্ব প্রায় এক দেড় ঘণ্টার মতো। সম্পা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে চলে গেলো।

সন্ধ্যার সময়ই বাড়িতে ফিরে এসেছে জাহিদ।হাতমুখ ধুয়ে বসার ঘরে বসলো।মিহাদ দৌড়ে এসে জাহিদের কোলে চড়ে বসে বললো,”বাবা আমার মজা কই?”
ছেলের কথায় মুচকি হেসে চিপসের প্যাকেটটা ছেলের হাতে ধরিয়ে দিলো জাহিদ। চিপস পেয়ে মিহাদ দৌড়ে চলে গেলো বোনেদের কাছে। সম্পা পানির গ্লাস স্বামীর হাতে দিয়ে প্রশ্ন করল,”কী ব্যাপার আজ তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?”

“এমনিই চলে এসেছি। তা জ্যোতি কই? মায়ের ঘুম ভেঙেছে?”
“না শুয়ে আছেন মা। আর জ্যোতি ফিরে গেছে শ্বশুর বাড়ি।”
জাহিদের কপালে সুক্ষ্ম কয়েকটি ভাঁজ পড়ল।বললো,”কালও তো বললো এখানে আরও কিছুদিন থাকবে। তাহলে হুট করে চলে গেলো কেন?”

“আমি যেতে বলেছি।”
কিছুটা অবাক হলো জাহিদ। প্রশ্ন করল,”তুমি চলে যেতে বলেছো! কেন বলেছো?”
সম্পা মুখ ভার করে উত্তর দিলো,”মাসের অর্ধেক সময় ভাইয়ের বাড়ি পড়ে থাকলে নিজের সংসার চালাবে কে? আর তুমিই বা কি বলো, বোনের বিয়ে দিয়েছো বলে কি বোনের প্রতি সব দায়িত্ব শেষ?”
“কেন? আমি আবার কী করলাম?”

“কী করলাম মানে? জ্যোতির বিয়ে দেওয়ার সময় ওর শ্বশুর শাশুড়ি বলেছিল শোভন যেখানে থাকে বিয়ের পর জ্যোতিকেও নাকি তার সঙ্গে সেখানেই নিয়ে যাবে অথচ বিয়ের এক বছর পার হয়ে গেলো কই জ্যোতিকে তো নিলো না।”
জাহিদ চোখমুখ কুঁচকে নিলো। বললো,”বাদ দাও তো ওসব। ওদের পরিবারের ব্যাপার ওরা বুঝে নিবে।”

“ওদের পরিবারের ব্যাপার মানে?এর সঙ্গে আমাদের জ্যোতির জীবন জড়িয়ে আছে। যা করার এখনি করো বেশি দেরি হয়ে গেলে দেখো আবার যেনো তোমাদের মতো অবস্থা না হয় মেয়েটার। তোমার বাবার কালের কোনো জমিজমা নেই যে মায়ের মতো জ্যোতি এসেও ওয়ারিশ বেঁচে জীবন চালাবে।”
কথাগুলো বলে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো সম্পা। জাহিদ এবার সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেলো।

সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ২