সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১১
জাওয়াদ জামী
” আমি কালকে ঢাকা যাব। ” দৃষ্টিকে রুমে আসতে দেখে মৃদু গলায় বলল নিহান। কিন্তু দৃষ্টি ও কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজের কাপড় গোছাতে শুরু করল। দৃষ্টিকে নীরব থাকতে দেখে নিহান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারও বলল,
” তুই কি আমার সাথে কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, দৃষ্টি? তুই কেন বুঝিসনা, তোর নীরবতা আমাকে ভেঙেচুরে খানখান করে দেয়? তোর দূরত্ব আমাকে বিরহের অনলে পোড়ায়। আমি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। তোর এই নীরব প্রত্যাখ্যানের সাথে সন্ধি করে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। ”
” পৃথু আপু যদি সেদিন পালিয়ে না যেত, তবে আজ আমার জায়গায় সে থাকত। তুমি তাকে নিয়ে দিব্যি সংসার করতে, সে তোমার বেঁচে থাকার অবলম্বন হত। তখন আমার অস্তিত্ব কোথায় থাকত বলতে পার? তুমি একজন কাপুরুষ। ভালোবাসলে পরিবারকে জানাতে পারতে। কিন্তু সেটা না করে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ। আবার যখন বিবেকবোধ জাগ্রত হয়েছিল, তখন রাতের আঁধারে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলতে গিয়েছিলে। তোমার সাথে কথা বলতে গেলে আমার মনে হয়, একজন মেরুদণ্ডহীনের সাথে কথা বলছি। ” কথাগুলো বলেই দৃষ্টি এলোমেলো পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দৃষ্টির কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেল নিহান। ওর বিশ্বাসই হচ্ছেনা ওর সম্পর্কে দৃষ্টির ধারনা এত হীন! এই প্রথমবার নিহানের নিজেকে মেরুদণ্ডহীন বলেই মনে হল৷ দৃষ্টি ভুল কিছুই বলেনি। তার ভুলের জন্যই দৃষ্টিকে সে হারাতে বসেছিল। চিন্তার মাঝেও একটা কথা মাথায় আসল নিহানের। নিশ্চয়ই দৃষ্টিও ওকে নিয়ে ভাবত। আর সেজন্যই তার এত অভিমান। নিহানের প্রতি এত অভিযোগ। হয়তো দৃষ্টির ভালোবাসা ওর অভিমান আর অভিযোগের আস্তরণে বন্দী হয়ে আছে। নিহানের একটাই কাজ, দৃষ্টির অভিমানগুলোকে মুছে ফেলা। আর অভিযোগগুলোকে খণ্ডন করা। ও যেকোনো মূল্যেই দৃষ্টির ভালোবাসা পেতে চায়।
” আমি আমার সকল ভুল তোর কাছে স্বীকার করতে রাজি আছি, দৃষ্টি। তোকে আমি ভালোবাসি। তোর যেকোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব। তবুও তোর ভালোবাসা আমার চাই-ই চাই। আমার ভালোবাসার সাগরে তোর সকল অভিমান ভাসাতে চাই আমি। এ আমার অঙ্গীকার। ”
দৃষ্টি বারান্দার গ্রীলে কপাল ঠেকিয়ে সূদুরে তাকিয়ে আছে। দু ফোঁটা অশ্রু ঝরে পরল ওর দু-চোখ বেয়ে। গত দেড় বছর ধরে নিহানের চিরকুটে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম নিহানকে এড়িয়ে গেলেও পরে আর পারেনি। মায়া জন্মায় নিহানের প্রতি। কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস পায়নি। হঠাৎই গত দেড় মাস আগে নিহানের চিরকুট আসা বন্ধ হয়ে যায়। দৃষ্টি জানতে পারে, নিহানের বিয়ে ঠিক হয়েছে। কথাটা শোনার পর দৃষ্টির কষ্ট হয়েছে। ও সকলের অগোচরে কেঁদেছে। কিন্তু নিহানকে কিচ্ছুটি জানতে দেয়নি। সে জানার চেষ্টাও করেনি। মায়ের কথায় সায় জানিয়ে বিয়ের প্রস্তুতি নিয়েছে।
” তুমি আমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছ, তার চেয়েও দশগুণ কষ্ট তোমাকে ফেরত দেব আমি নিহান ভাইয়া। আমার কষ্টগুলো তোমাকে অনুধাবন করতেই হবে। তার আগে তুমি আমাকে ছুঁতেও পারবেনা। ” বিরবির করে বলল দৃষ্টি।
” কুহু মা, কেমন আছিস? ” বড় মামীর গলা শুনে কুহুর মন ভালো হয়ে গেল।
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন, মামী? দিদুন, মেজো মামী, সেজো মামী, ছোট মামী তারা সবাই কেমন আছেন? ” স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করল কুহু।
কুহুর প্রশ্ন শুনে হাসলেন আফরোজা নাজনীন।
” সবাই ভালো আছে। শিহাব কেমন আছে? ও কি স্কুলে গেছে? ”
” দুই দিন ধরে ওর জ্বর। তাই স্কুলে যেতে পারেনি। ”
” আহারে, ছেলেটা জ্বরে কষ্ট পাচ্ছে। ডক্টরের কাছে নিয়েছিলি? ঔষধ খাওয়াচ্ছিস ? ”
” বড় চাচা ওকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঔষধও এনে দিয়েছে। নিয়মিত খাওয়াচ্ছি। ”
” খেয়াল রাখিস ওর। পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওকে বাহিরে যেতে দিসনা। ”
” ঠিক আছে, মামী৷ ”
” কুহু মা, তোর এডমিশনের আর তো দেরি নেই। ঢাকায় আসবি কবে, সিদ্ধান্ত নিয়েছিস? কোন কোন ভার্সিটিতে এডমিশন দিবি? ”
” বুয়েটে দিতে চাই, মামী। সেখানে সুযোগ না পেলে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েই দেব। সেখানে সুযোগ পাব, সেখানেই ভর্তি হয়ে যাব। ”
” মেডিকেলে এডমিশন দিবিনা? ”
” প্রস্তুতি নেইনি, মামী। আমার হেমোফোবিয়া আছে। আর তাছাড়া কাঁটা-ছেঁড়া, ডেড বডি এসবে ভয় পাই আমি। ”
কুহুর কথা শুনে হাসলেন আফরোজা নাজনীন।
” তাহলে বাদ দে। এডমিশনের বেশিদিন আর দেরি নেই। তুই ঢাকা আসবি কবে? শোন বুয়েটে পরীক্ষার সাতদিন আগেই চলে আসবি আমাদের বাসায়। আমরা ঢাকায় চলে এসেছি। যতদিন ঢাকায় এডমিশন হবে, ততদিন আমাদের বাসায় থাকবি। ”
” কোথায় থাকব সেই সিদ্ধান্ত এখনো নেইনি, মামী। বড় চাচা যেভাবে বলবে সেভাবেই কাজ করতে হবে। ”
” নিয়াজের সাথে আমি কথা বলব। তুই মন দিয়ে পড়াশোনা কর। বাকিটা আমি দেখব। ”
আফরোজা নাজনীন আরও কিছুক্ষণ কথা বললেন কুহুর সাথে। কুহুর সাথে কথা শেষ করে তিনি ফোন করলেন রাখী আক্তারকে।
” তোরা এসে গেছিস, কুহু মা? শিহাব সোনা, তুমি কেমন আছো? নিয়াজ ভেতরে এস। ”
আফরোজা নাজনীন কুহুদের দেখে খুশি হয়ে গেলেন। তিনি সেদিন কুহুর সাথে কথা বলার পর, রাখী আক্তারকে ফোন করে কুহুর আসার ব্যাপারে কথা বলেছেন। তিনি রাখী আক্তারকে দিয়েই কুহুকে এই বাড়িতে আসবার জন্য বলেছিলেন। রাখী আক্তার বাধ্য হয়েই কুহুকে আনানের সাথে তার বাবার বাড়িতে পাঠিয়েছে।
কুহুদের দেখে সকলেই খুশি হয়েছেন। আয়েশা সালেহা অনেকক্ষণ কুহুকে বুকে জড়িয়ে রাখলেন। সিক্তা বাসায় ছিলনা। বাসায় এসে কুহুকে দেখে আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল।
” কুহু, তুই এসেছিস? এবার দু’জনে একসাথে অন্নেক মজা করব। দু’জন মিলে পুরো ঢাকা ঘুরব। ”
” শুধুই ঘুরেই বেড়াবি আর মজা করবি? পড়বিনা? নাকি এডমিশনই দিবিনা? বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে ভাত রান্না করার প্ল্যান আছে তোর? তোর যে শিক্ষাগত যোগ্যতা তাতে বড়জোর কোন চায়ের দোকানির বউ হতে পারবি। ভালোই হবে, তুই চা বানাবি আর তোর জামাই খরিদদার সামলাবে। ” আনান বিজ্ঞের মতো বলল।
” আনাইন্না, চুপ করবি তুই? আমার সাথে তোর কিসের এত শত্রুতা? আমার তো তা-ও চায়ের দোকানি জুটবে, আর তোর কপালে যে বউ-ই জুটবেনা। আজীবন তোকে বউ বিহীন জীবন কাটাতে হবে। আমাদের সুখ দেখে তুই দীর্ঘশ্বাস ফেলবি। ”
” থামবি তোরা? তোরা দুটোতে একসাথে হলেই কি শুধু ঝগড়া করবি? সিক্তা, তুই দিন দিন ঝগড়ুটে হচ্ছিস কেন? শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে যদি এভাবে ঝগড়া করিস, তবে আমাদের সম্মান নিলামে উঠবে। আনান তোর বড়, তোর সাথে দুষ্টুমি করতেই পারে। তাই বলে তুই ওকে নাম ধরে ডাকবি? আবার তুই ও বলছিস! ” নাজমা আক্তার তিরস্কার করলেন।
নাজমা আক্তারের ধমকে গুটিয়ে গেল সিক্তা। চাচীকে খেপাতে চায়না ও।
” আরে ভাই যে? কি অবস্থা তোমার? তুমি কি মেডিকেলে পড়তে যাও, নাকি রুগীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে যাও? তোমাকে দেখলে যে কেউ মনে করবে, তোমাকে দেখতে মেডিকেল স্টুডেন্ট কম রুগী লাগে বেশি। ”
আনানকে দেখে একটু অবাকই হলো তাহমিদ। ও জানতোনা আনান আসবে। তবে সেটা বুঝতে দিলনা ওকে।
” আর বলিসনা, তোর জন্য পড়াশোনার সময় পাচ্ছিনা । দিনরাত এ্যাসাইলামের রুগীদের সাথে কাটাতে হচ্ছে। তাদের রুটিন মুখস্থ করতে করতেই দিনরাত পার হচ্ছে। ”
” কেন ভাই, আমার জন্য তোমার পড়াশোনা হচ্ছেনা কেন? আর পাগলদের সাথেই বা তোমার কি কাজ? তুমি কি ভবিষ্যতে পাগলের ডাক্তার হতে চাও? তবে এর মধ্যে আমাকে জড়াচ্ছ কেন? আমি কি তোমার পড়াশোনা চুরি করে নিজের ব্যাগে রেখেছি? ”
” বলতে গেলে সেরকমই। তোর পড়াশোনার যা অবস্থা, কিছুদিন গেলে দেখা যাবে, পড়াশোনার চাপে তোর মাথার তার ছিঁড়ে গেছে। তখন তোর চিকিৎসার ভার নিশ্চয়ই ফুপু আমার কাছে দেবে। কিন্তু মেন্টালদের মতিগতি, চিকিৎসা সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নেই। তাই এ্যাসাইলামে গিয়ে তাদের সম্পর্কে ধারনা নিচ্ছি। ”
তাহমিদের কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সিক্তা। সিক্তার হাসি শুনে সেদিকে তাকাতেই চমকে গেল তাহমিদ। সিক্তার সাথে কুহুকে দেখে খুশিতে ওর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হল। অজান্তেই ঠোঁটের কোনে ফুটল সুখের হাসি। ওর মন বাগানে প্রেমের রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়াতে শুরু করল। অনেকদিনের পিপাসিত নয়ন আজ দেখছে তার শ্যামাঙ্গীনিকে। তবুও ওর তৃষ্ণা মিটছেনা। এ তৃষ্ণা মিটবার নয়।
সিক্তাকে হাসতে দেখে আনানের রাগ হলো।
” কোকিলা, তুই আমার কাছে আয়। ঐ বজ্জাত মেয়ের সাথে মিশবিনা। ঐ বজ্জাত ছেমড়ি আর ওর বজ্জাত ভাই দু’জনেই সমান। কথায় আছেনা, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই? এরা তেমনি বজ্জাতে বজ্জাতে চাচাতো ভাইবোন। এরা আমাদের দু’জনের মত ইনোসেন্ট নয়। এদের নাড়িতে নাড়িতে জিলাপির প্যাঁচ। এরা বাসি পঁচা জিলাপি। ”
” এ্যাঁহ, আসছে সাধু। আমরা বাসি পঁচা জিলাপি আর সে টাটকা করলা। মিষ্টি করলা। ”
” সিক্তা, আমার ভাইয়াকে এভাবে পঁচাচ্ছিস কেন? সহজসরল মানুষ বলেই ভাইয়াকে পঁচাতে পারছিস। অন্যকেউ হলে তোকেও পঁচাতো। ”
” ভাইয়ের প্রতি এত দরদ তোর, কুহু! তা-ও যদি ভাইটা ভালো হত। এত দরদ বাদ দিয়ে আমার পক্ষ নে। লাভ আছে এতে। ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১০
” সিক্ত, আনানের কোকিলা দেখছি তার ভাইয়ার পক্ষে কথা বলছে! বলতে দে। ভাইয়ের দরদ বোন করবে এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য আনানকে তুই যতটা অপদার্থ মনে করিস, ততটা অপদার্থ সে নয়। কিছুটা পদার্থের অস্তিত্বও আছে। আর ছেলে হিসেবেও সে খারাপ নয়। ”
তাহমিদের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে মাথা ঘুরে মেঝেতে পরে গেল আনান। হ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকল তাহমিদের দিকে।