সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৩
জাওয়াদ জামী
তাহমিদের কথার বাণ থেকে বাঁচতে কুহু কামিনী গাছের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গাছ ভর্তি থোকা থোকা ফুল তারার মত জ্বলছে। ফুলের সুবাস কুহুর তনু মন বিবশ করে দিচ্ছে৷ আগ্রহ নিয়ে মেয়েটা ফুলের থোকায় আঙুল ছোঁয়াল।
” আমার অনুমতি ছাড়াই আমার গাছের ফুল ছুঁয়ে দিচ্ছ তুমি? এ অন্যায়, ভারী অন্যায়। তোমার কি জানা নেই, মালিকের অনুমতি বিনা তার কোনকিছুতেই হাত দিতে নেই? নাকি ইচ্ছে করেই এমনটা করেছ, গাছের মালিককে সিডিউস করতে? মতলব কি তোমার? ” কুহুর কানেরড়ড়ড়ড়ড়ড়ড়ড় কাছে এসে ফিসফিস করে বলল তাহমিদ। ওর চোখে নেই তিরস্কার। আছে শুধু একরাশ ভালোলাগা।
নিজের খুব কাছে তাহমিদের গলা পেয়ে চমকায় কুহু। লাজে রাঙা হলো ওর মুখপট। তাহমিদ ওকে এভাবে লজ্জা দেবে সেটা ওর ভাবনায় আসেনি কভু। লজ্জা ঢাকতে রিনরিনে গলায় বলল,
” গাছের ফুল ছুঁয়ে দিতেও কারও অনুমতি লাগে! জানতাম না তো। ”
” কারও অনুমতি নয়, মালিকের অনুমতি । শুধুমাত্র মালিকের অনুমতির কথা বলেছি আমি৷ ” তাহমিদের ঠোঁটে শোভা পাচ্ছে দুষ্টুমির হাসি।
” আমাদের বাড়িতেও কামিনী গাছ আছে। ফুল ফুটলে কতজন এসে ডাল সুদ্ধ ফুল নিয়ে যায়। কই তারা কখনো তো আমার থেকে অনুমতি নেয়না। ফুল পবিত্র জিনিস। সেই সাথে ভালোবাসারও একে ছুঁতেও বুঝি অনুমতি লাগে? ”
” পবিত্র জন্যই তো অনুমতি লাগবে। সব পবিত্র জিনিসই অমূল্য। সেই অমূল্য সম্পদে যে কেউ নজর দেবে এটা কি মানা যায়? ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” ঠিক আছে, আপনার গাছের ফুলের দিকে ভুলেও আর নজর দেবোনা৷ ”
” নজর দেবেনা কেন? একশোবার নজর দেবে। এমনকি তুমি চাইলে গাছটাই নিয়ে যেতে পারো। ফুল যতই পবিত্র হোক না কেন, কেউ কেউ তাকে অনায়াসেই ছুঁয়ে দিতে পারে। ”
তাহমিদের আবোলতাবোল কথা শুনে কুহুর মাথা ঘুরে উঠল। একটু আগেই সে বলল, তার অনুমতি ছাড়া গাছে হাত দেয়া যাবেনা। আবার এখনই সে বলছে, ইচ্ছে করলে কুহু গাছটাই নিয়ে যেতে পারে। কুহু ভাবল, এই ছেলেটার মনে কখন যে কি চলে সেটা বোধহয় সে ও জানেনা।
” চা এসে গেছে। কুহু চলে আয়। ভাইয়া তুমিও এসো। ” সিক্তা টেবিলে ট্রে রেখে কুহু তাহমিদকে ডাকল।
সিক্তা আসায় কুহু হাঁফ ছাড়ল। এই ছেলেটা ওকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে কি মজা পায়, সেটা কুহু জানেনা।
” বুঁচি রে, এখন থেকে রাত-বিরেতে ক্ষুধা লাগলে, তোকে বিরক্ত করব। আর কি কি রান্না করতে পারিস তুই? একটা লিস্ট করে দিবি। লিস্ট অনুযায়ী সবকিছু কিনে এনে রাখব৷ ”
” আপাতত নুডলস ছাড়া আর কিছুই রান্না করতে পারিনা। তাই লিস্টের দরকার নেই। আমি প্রতিদিনই তোমাকে নুডলস রান্না করে খাওয়াব। ”
” মাফ কর বইন, প্রতিদিন নুডলস খেলে আমার নাড়িভুুঁড়িতে মরিচা ধরে যাবে। তারচেয়ে তুই বরং নিহানের বউয়ের বড় বোনের কাছ থেকে রান্না শিখ। ”
” নিহান ভাইয়ার বউ আমাদের ভাবী। সেই হিসেবে কুহু আমাদের বেয়ান হচ্ছে। অথচ আমি ওকে একদিনও বেয়ান বলে ডাকিনি। এটা কিন্তু আমরা কুহুর সঙ্গে অন্যায় করেছি, ভাইয়া। ”
” তুই ডাকা শুরু করলে আমরাও ডাকতে পারি। কি ডাকব নাকি, বেয়ান? ” তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
” আপনার নুডলস ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। ” কুহুর তাহমিদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল।
” আমি গরম নুডলস খেতে পারিনা। তুমি বরং আমারটা নাও, আর তোমারটা আমাকে দাও। ” তাহমিদ কুহুর পারমিশনের অপেক্ষা না করেই কুহুর নুডলসের বাটি নিয়ে চপস্টিক দিয়ে খাওয়া শুরু করল।
তাহমিদের কর্মকাণ্ড দেখে সিক্তা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। কারন ও ভালো করেই জানে, তাহমিদ কখনোই ঠান্ডা খাবার খায়না। ও প্রশ্নটা তাহমদিকে না করে পারলনা।
” ভাইয়া, তুমি না ঠান্ডা খাবার খেতে পারোনা? আজ হঠাৎ ঠান্ডা খাবার তোমার প্রিয় হলো কিভাবে? ”
” মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন হতে সময় লাগে নাকি! রেগুলার গরম খাবার খেয়ে আমার রুচি কমে গেছে। তাই রুচি বাড়াতে ঠান্ডা খাবার খাওয়া শুরু করেছি। ”
তাহমিদের উদ্ভট যুক্তি শুনে কুহু মুচকি হাসল।
কিন্তু তাহমিদ কেন ওর খাবার খেল, সেটা কুহুর অজানাই থেকে গেল। ওর জানতেও পারলনা, ওর হাতের রান্না খেতেই তাহমিদের এত অভিনয়।
” ভালো কথা, নিহানের বউয়ের বড় বোন, আমার বেয়ান, ভাইভার প্রস্তুতি কেমন নিয়েছ? ”
” ভালো। ”
” গুড। আজ থেকে শুরু করে ভাইভার আগ পর্যন্ত কোন চাপ নিবেনা। একদম চাপমুক্ত থাকবে। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর থাকতে হবে তোমাকে। এবং অবশ্যই গুছিয়ে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবে। পারবে তো? ”
” পারব। ”
এরপর আর কেউ কোন কথা বললনা। নীরবে খাওয়া শেষ করল।
” বড়মা , উঠে বস । তোমাকে খাইয়ে দেব। চাচা তোমার খাওয়ার অপেক্ষা করছে। তুমি খেলেই তবে চাচা খাবে। ” দৃষ্টি রাখী আক্তারের কাছে গিয়ে ডাকল।
” রান্না শেষ? জসিমের মা কবে এত এ্যাক্টিভ হলো রে? দুই ঘণ্টার রান্না এক শেষ করে ফেলেছে ভাবা যায়! ” রাখী আক্তার হাই তুলে উঠে বসল। গতরাত থেকে তার শরীরটা ভালো নেই। হঠাৎই জ্বর এসেছে। তাই সে দৃষ্টিকে কোন কাজে সাহায্য করতে পারছেনা।
” বড়মা কে আমি কাজে সাহায্য করেছি। নইলে বড়মা একা একা সব কাজ করতে পারতনা। বড়মার শরীরও ভালো নেই। আমি পানি এনেছি, তুমি কুলকুচি করে নাও তো। ”
” তুই কি আমাকে অলস বানাতে চাচ্ছিস? তোর কি ধারনা, আমি অলস হয়ে শুয়ে-বসে কাটাব আর তুই আমার সংসারের হাল ধরবি? কর্ত্রী হবি আমার সংসারের? এটি হতে দেবোনা আমি। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন আমার সংসারে আমিই কর্ত্রী। তোর কোন মাতব্বরি চলবেনা। ”
” তোমার সংসার ধুয়ে তুমিই তিনবেলা করে পানি খেও। আমার বয়েই গেছে তোমার সংসারের কর্ত্রী হতে। তোমার এই ভাঙাচোরা, অশান্তিপূর্ণ সংসারে কর্ত্রী হতে আমার জন্ম হয়নি। আমি আমার সংসারের রানী হতে চাই। তোমার ছেলে পড়াশোনা করে কোন চাকরিতে ঢুকলেই আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হবে। আমার আলাদা একটা সংসার হবে, সেই সংসারে তোমার মত দজ্জাল শ্বাশুড়ি থাকবেনা, কোন ঝগড়াঝাটি থাকবেনা, কথার খোঁচা থাকবেনা। সেই সংসার সুখে ভরপুর থাকবে। আমি তেমন একটা সংসারের স্বপ্নই দেখি। তোমার ছেলেরও একটাই স্বপ্ন। ” দৃষ্টি আপনমনে বলেই চলেছে।
দৃষ্টির কথা শুনে রাখী আক্তারের বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। এ কি কথা বলছে এই মেয়েটা? ও আলাদা সংসার পাততে চায়? এই সংসার অশান্তিপূর্ণ? ভাঙাচোরা? এই সংসারে সুখ নেই? নিহানেরও এই একটাই চাওয়া? অথচ নিহান তার প্রথম সন্তান। নিহানের মুখেই প্রথম ‘ মা ‘ ডাক শুনেছে সে। সেই নিহানও ওর মাকে ছেড়ে আলাদা সংসার পাততে চায়? মনের মাঝে অনেক প্রশ্ন ভীড় করলেও রাখী আক্তার সেগুলে মুখে প্রকাশ করলনা। গম্ভীর গলায় বলল,
” আমি দজ্জাল? আমাকে মাইনাস করে সংসার বাঁধার চিন্তা করছিস এখনই? তোর আশা কোনদিনও পূরণ হবেনা। আমি হতে দেবোনা। আমার নিহান কোনদিনই আমার কথার বাহিরে যাবেনা। তেমন ছেলে আমি জন্মই দেইনি। ”
” তোমাকে জানিয়ে আমরা সংসার পাতব নাকি! হুট করে একদিন নিজের নতুন সংসারে চলে যাব। এখানে তো আমার তেমন কিছুই নেই যে সাথে নিব। বিয়ের সব শাড়ি-গহনা তুমি আগেই কেড়ে নিয়েছ আমার কাছ থেকে। তাই শুধু পরনের কাপড় ছাড়া নেয়ার মত আর কিছুই নেই আমার। প্রয়োজন পরলে সেগুলোও নিবনা। এক কাপড়ে বেরিয়ে যাব। তোমার ছেলেও সেটাই চায়। যাতে ভবিষ্যতে তুমি কাপড়ের খোঁটা দিতে না পার। সে তো জানে, তার মা কেমন। তাই কোন রিস্ক নিতে চায়না। ”
” বেয়াদব মেয়ে, আমার ছেলেকে তুই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাস? আমার সাধাসিধা ছেলের মাথায় তুই সংসার আলাদা করার কুবুদ্ধি ঢুকিয়েছিস? তোর মনে এত প্যাঁচ? নিহান আসুক, ওর সামনে তোর মুখোশ আমি খুলে দেব। ”
” তোমার কাছ থেকেই সবকিছু শিখেছি, বড়মা। আমার বড় চাচাও তো সাধাসিধাই ছিল। তাকেও যেমন তার আম্মা-আব্বার কাছ থেকে আলাদা করে দিয়েছিলে তুমি। আমার ব্যাপারটা সেরকমই ধরে নাও। বড় চাচা যদি তোমার কথা মেনে নিয়ে তোমাদের নিয়ে বিদেশে যেতে পারে, তবে তোমার ছেলে কেন আমার কথা মেনে, আলাদা বাড়ি নিতে পারবেনা? আমরা দু’ জন একই বাড়ির বউ, কিন্তু তোমার স্বামী তোমার কথা মানবে, আর আমার স্বামী আমার কথা মানবেনা এটা কি হতে দেয়া যায়? দু’জনে বউ যেহেতু একই বাড়ির, সেহেতু দু’জনের বেলায় নিয়মও একই হওয়ার কথা তাইনা? ”
দৃষ্টির কথা শুনে রাখী আক্তারের মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। আঁড়চোখে সে দৃষ্টির দিকে তাকায়। মেয়েটার ভাবলেশহীন মুখ দেখে তার ভ্রু কুঁচকে গেল। এতটুকু মেয়ের মাথায় এমন বুদ্ধি থাকতে পারে ভেবে সে অবাক হলো। অথচ আইরিন এমন ছিলনা। ও বড্ড সরল ছিল। কায়েসও তাই। কিন্তু দৃষ্টি সম্পূর্ণ আলাদা। আইরিন-কায়েসের মেয়ের মাথায় যে বুদ্ধিতে গিজগিজ করবে, এটা তার ভাবনায়ও ছিলনা। রাগে রাখী আক্তারের মাথা ফেটে যাচ্ছে। এই মেয়ের দুঃসাহস দেখে সে যারপরনাই অবাক। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে বলল,
” বেশি বাড়িসনা, দৃষ্টি। তোর ডানা কাটতে আমার খুব বেশি সময় লাগবেনা। তাই এখন থেকে যা বলবি, মুখ সামলে বলবি। ”
রাখী আক্তারের কথার পাল্টা জবাব দিতে চাইল দৃষ্টি। তবে তার আগেই ওর ফোন বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রীনে চোখ পরতেই দৃষ্টির মুখটা হাসিহাসি হয়ে গেল। রাখী আক্তারের দিকে তাকিয়ে গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বলল,
” তোমার ছেলের ফোন। সে নাকি আমার সাথে বেশি সময় কথা না বলে থাকতে পারেনা। পনেরো মিনিট অন্তর ফোন দেয়া চাই-ই চাই। যাই একটু কথা বলে আসি। তুমি বসে থাক। কথা শেষ করেই আমি খাবার নিয়ে আসব। ” দৃষ্টি ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
রাখী আক্তার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল। তার ভয় হচ্ছে ভিষণ। ছেলেকে হারানোর ভয়। সংসার ভেঙে যাওয়ার ভয়।
” দৃষ্টি, কি করছিস তুই? আম্মু কেমন আছে? জ্বর কমেছে আম্মুর? ” ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করল নিহান।
” দজ্জাল শ্বাশুড়ির সেবা করছিলাম আর অ্যান্টিডোজ দিচ্ছিলাম। ”
” কিসের অ্যান্টিডোজ? ”
” ও তুমি বুঝবেনা। ”
” বুঝিয়ে বললেই তো বুঝি। তুই বুঝিয়ে বল। ”
” সংসার জীবনের কিছু অপকারি দিক শ্বাশুড়ি মাকে বুঝাচ্ছিলাম। যেটা সে এতদিন করে এসেছে। অবশ্য এটাকে বোঝানো বলেনা। বলে ডোজ দেয়া। যেটা তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। আর শোন, বড়মা তোমাকে ফোন দিয়ে অনেককিছুই বোঝাবে। তুমি শুধু বলবে, আমি দৃষ্টির মুখে হাসি দেখতে চাই। আর সেজন্য যা যা করার প্রয়োজন আমি করব। ব্যাস এতটুকুই। বড়মাকে শোধরাতে এতটুকুই যথেষ্ট। মনে থাকবে? ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২২
” মনে না রেখে গর্দান দেই আরকি। গর্দান হারানোর এত শখ আমার নেই। ”
” গুড জামাই। এবার রাখি। বড়মাকে খাইয়ে দেব। পরে তোমার সাথে কথা বলব। তুমি খেয়ে নিও। ”
” লাভ ইউ, বউ। ভালো থাকিস। ”
নিহানের মুখে ‘ বউ ‘ ডাক শুনলে দৃষ্টির কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। আজও তাই হলো। ও হাসিমুখে বলল,
” আমিও। ”
” কি আমিও? ”
” বুঝে নাও। ” কথাটা বলেই ফোন কেটে দিল দৃষ্টি। রাখী আক্তারের কাছে গেল।