সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৪

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৪
জাওয়াদ জামী

” কুহু মা, আগেই বলে রাখছি কোন হোস্টে-ফোস্টেলে থাকতে পারবিনা তুই। তুই আর শিহাব এখানেই থাকবি। শিহাবকে ভালো কোন স্কুল দেখে ভর্তি করিয়ে দেবে তোর বড় মামা। তুই ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই চলে আসবি কিন্তু। ” আফরোজা নাজনীন কুহুর মাথায় হাত রেখে বললেন।
কুহু দিদুনের কাছে বিদায় নিতে এসেছে। মামীরা সবাই দিদুনের রুমেই আছেন। বড় মামীর কথায় অধিকারবোধ স্পষ্ট। তিনি এবং এই বাড়ির প্রত্যেকেই চান কুহু এখানে থেকেই ক্লাস করবে। কিন্তু কুহুর চাওয়াটা ভিন্ন। আজকে সেই কথা সবাইকে জানাতে হবে৷

” মামী, আমি বুঝতে পারি আপনারা সবাই আমাকে এবং শিহাবকে ভালোবাসেন। আমাদের জন্য আপনারা চিন্তাও করেন। তেমনি আমরা তিন ভাইবোনই আপনাদের সম্মান করি । আপনারা আমাদের কোন আদেশ করলে, সেটা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা নেই আমাদের। কিন্তু আজকে আমি অপারগ। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ছোটখাটো দেখে একটা ফ্ল্যাট নেব। শিহাবকে নিয়ে সেখানেই থাকব। ” কুহু মৃদুস্বরে বলল।
” এ কি বলছ তুমি, কুহু সোনা? তুমি একা একা শিহাবকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকবে? আমরা ঢাকায় থাকা স্বত্বেও তুমি ভাড়া বাসায় থাকবে? ” দিদুন চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন।
” কুহু মা, এসব তুই কি বলছিস? আমরা থাকতে তুই আলাদা বাসায় থাকবি? কেন, মা? ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। আরও অনেক খরচ আছে৷ তুই কিভাবে কি করবি? ” তাহমিনা আক্তারও চমকে গেছেন কুহুর কথায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” কুহু, আমাদের কোন আচরনে তুই কি কষ্ট পেয়েছিস? ” আফরোজা নাজনীন শুধু এতটুকুই জিজ্ঞেস করলেন।
সকলের প্রশ্নবাণে জর্জরিত কুহু ধীরে ধীরে সকলেরই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করল।
” আপনারা আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি চাইনা এখানে থাকতে। কারন প্রথমত, এটা আমার চাচার শ্বশুর বাড়ি। আমি কোনভাবেই চাইনা আমাদের কারনে আমার চাচার সম্মানহানি হোক। আমরা এখানে থাকতে শুরু করলে অনেকেই জিজ্ঞেস করবে, আমরা কেন এখানে আছি? এছাড়াও এখানে দৃষ্টির সম্মানও জড়িত। আমি চাইনা আমাদের কারনে নিহান ভাইয়া, দৃষ্টি কারও হাসির পাত্র হোক। অনেককিছুই চিন্তা করে আমাকে সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে, দিদুন। তবে আমি এখানে থাকবনা মানেই এই নয় যে, আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখবনা, এখানে আসবনা। সময় পেলেই আমি আপনাদের কাছে আসব। ”
কুহুর কথা শুনে দিদুন একে একে চার পুত্রবধূর দিকেই তাকালেন। তারা সকলেই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন কুহুর দিকে। পুরো রুম জুড়ে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। কেউ কিছুই বলছেন না। অনেকক্ষণ পর দিদুনই কথা বললেন।

” ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়া মানেই একটা সংসারের যাবতীয় কিছু থাকবে সেখানে। সে অনেক খরচের ব্যাপার। এত টাকা তুমি কিভাবে জোগাড় করবে, কুহু সোনা? তোমার একার পক্ষে প্রতিমাসে এত টাকা জোগাড় করা কষ্টদায়ক হয়ে যাবে। এছাড়াও তোমাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও আছে। একা একা তোমাদের একটা ফ্ল্যাটে রাখার কথা চিন্তা করতেই আমাদের ভয় হয়। ” চিন্তিত বদনে বললেন আয়েশা সালেহা।

” নানা ভাই বেঁচে থাকতেই মায়ের নামে পাঁচ বিঘা জমি দিয়েছিলেন। তা-ও প্রায় পনেরো বছর আগে। এতদিন মামা সেই সম্পত্তি ভোগ করছে। মা কখনোই ঐ জমির কোন হিস্যা নেয়নি। মায়ের অসুস্থতার সময় মামা ইচ্ছে করেই পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছিল। কয়েকদিন আগে আমি মামার কাছে সেই জমি বিক্রির কথা বলেছিলাম। ছোট নানা ভাই মানে আমার নানা ভাইয়ের ছোট ভাই বলেছেন, বর্তমানে সেই জমির দাম পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকা। মামাকে সেই কথা বলায়, মামা পঁচিশ লক্ষ টাকা দিতে চেয়েছে। দৃষ্টি আর শিহাবের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছি। দৃষ্টিও বলেছে, জমিটা বিক্রি করে দিতে। আর সেই টাকা থেকেই আপাতত এখানকার খরচ চালাব। এছাড়াও বাবার কিছু জমি আছে। সেই জমিটুকুও বিক্রি করতে বলেছে বড় চাচা। সেখানে বাবা আর চাচার জমি একসাথে আছে। বড় চাচা তার অংশের জমি বিক্রি করতে চায়, তাই আমাকেও বলছে বিক্রি করতে। সেই জমিটুকু বিক্রি করলে হয়তো পাঁচ লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে। এছাড়াও নিহান ভাইয়াকে কয়েকটা টিউশনি খুঁজে দিতে বলেছি। ” ” কথাগুলো বলে থামল কুহু।
রুমে উপস্থিত সকলেই বুঝলেন কুহু কি করতে চায়। তাই তারা আর কিছুই বললেননা।

” কুহু, হয়েছে তোর? আর কতক্ষণ বসিয়ে রাখবি আমাকে? তুইও কি সিক্তার মত সাজুনি কন্যা হয়েছিস? সিক্তা যেমন সাজতে গিয়ে সারাদিন পার করে ফেলে, তুইও কি ওর সঙে মিশে ওর মত হয়ে গেলি? ” নিহান সোফায় বসে চিৎকার দিয়ে বলল।
” তুমি আমার নামে দূর্নাম করলে নাকি সুনাম করলে? উত্তরটা যদি দয়া করে দিতে তবে আমি কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। ” নিহানের পাশে বসে বলল সিক্তা।
” কি সিদ্ধান্ত নিবি? আর আমার উত্তরের সাথে তার কি সম্পর্ক? ”
” প্রতিবাদের একটা বিষয় আছেনা? তুমি আমাকে সাজুনি কন্যা বললে, আবার বললে, আমার সঙ্গে মিশে কুহু আমার মত সাজুনি কন্যা হয়েছে। এটার প্রতিবাদ। এবং সেই প্রতিবাদ যেন-তেন হবেনা। হবে দুর্ধর্ষ প্রতিবাদ। ”
” তোর দুর্ধর্ষ প্রতিবাদের সংজ্ঞা আগে শুনি। তারপর বলছি, কি বলেছি আমি। তবে তার আগে কুহুকে ডাক। ওকে বিচারকের ভূমিকায় থাকতে হবে। ”

” তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন কুহু তোমার ছোট! ”
” ছোটই তো। আমি ওর বড়। ”
” পুরোনো সম্পর্ক ভুলে যাও। নতুন সম্পর্কে মনযোগ দাও। নতুন সম্পর্কের দিক দিয়ে কুহু তোমার বউয়ের বড় বোন। মানে তোমার বড় শালিকা। সেই হিসেবে কুহু তোমার কাছ থেকে দিনে অন্তত তিনবার সালাম পায়। এ পর্যন্ত ওকে কয়বার সালাম দিয়েছ? ”
” সিক্তা কিন্তু ভুল কিছু বলেনি, নিহান। তোর কাছ থেকে কুহুর কিন্তু সালাম প্রাপ্য। তাই কুহু আসামাত্রই ওকে সালাম দিয়ে ‘ আপু ‘বলে ডাকবি। ” সিক্তার কথার সাথে সায় জানিয়ে বললেন নাজমা আক্তার।
” মামী, তুমিও এই পাগলীর সঙ্গে তাল মেলাচ্ছ! ”
” এই, এই আমাকে পাগলী বলবেনা একদম।আমি কিন্তু এখন দৃষ্টিকে ‘ ভাবী ‘ বলে ডাকি। ও যতই আমার থেকে ছোট হোক না কেন, ও এখন তোমার স্ত্রী। বোঝাতে পেরেছি? ”

” বুঝেছি। কি আর করা, কুহু চাইলে ওকেও আমি ‘ আপু ‘ বলেই ডাকব। ”
” সম্পর্কে হিসেব তো তুই ভালোই জানিস রে, টেপ রেকর্ডার। আর কি কি জানিস বলতো? ” আনান এসে সিক্তার মাথায় টোকা দিয়ে বলল।
” তোমাকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর সব টেকনিক আমার জানা আছে। এ্যাপ্লাই করব নাকি? ”
” তোরা এসে গেছিস? নিহান তোকে কিন্তু গত রাতেই আসতে বলেছিলাম। আসলিনা কেন? ” তাহমিদ বাহিরে থেকে এসে সোফায় বসে জিজ্ঞেস করল নিহানকে।
” জরুরী কাজ পরে গিয়েছিল, ভাই। তাছাড়া আনানও একটু অসুস্থ ছিল। তাই আসতে পারিনি। ”
” আনান, তোর কি হয়েছে? ”

” কিছু না, ভাই। ভাইয়া নিজের দোষ আমার ঘাড়ে চাপাতেই কথাটা তোমাকে বলেছে। ”
” চুপ মিথ্যুক। সারা রাত ওয়াশরুমের দরজার সামনে বসেছিলি ভুলে গেছিস? আর বলোনা ভাই, বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে কিসব আজেবাজে খাবার খেয়েছে, আর তাতেই লুজ মোশন শুরু হয়েছিল। সারা রাত আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। ”
নিহানের কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সিক্তা। হাসতে হাসতে ওর দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
” ওরে সুপারম্যানের নাকি লুজ মোশন হয়েছে! এই পেট নিয়ে এত বাহাদুরি করে! একদিন না বলেছিলে, তোমার পেটে গেলে লোহাও হজম হয়ে যাবে? এই তার নমুনা? ওয়াশরুম রক্ষা কমিটির সভাপতির পদ তুমিই ডিজার্ভ কর। ঐ আনাইন্না, লুজটা কি খুব বেশিই ছিল, নাকি একটু কড়া ছিল? আজ থেকে তোমার নাম দিলাম, বাথরুমের রাজা। ” হাসতে হাসতে সিক্তার পেট ব্যথা হয়ে গেছে।

” সিক্তা, এটা কোন ধরনের বেয়াদবি? ছেলেটা অসুস্থ আর তুই ওকে পঁচাচ্ছিস? আনান, তুই রুমে গিয়ে শুয়ে থাক। আমি তোর খাবার রুমে দিয়ে আসছি। তোর চোখমুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। নিহান, তোরই বা কাণ্ডজ্ঞান কেমন? ছেলেটা অসুস্থ আর আমাদের জানাসওনি? ” আফরোজা নাজনীন ধমকে থামিয়ে দিলেন সিক্তাকে।
” মামী, কাউকে জানানোর মত অবস্থায় আমাকে রেখেছিলনা ও। পাঁচ মিনিট পর পর ওয়াশরুমে গেছে। প্রতিবারই গোসল করে বেরিয়ে এসেছে। কাপড় পাল্টানোর সুযোগ পায়নি। ওইভাবেই বসে ছিল ওয়াশরুমের সামনে। আমি ওকে প্রতিবারই স্যালাইন বানিয়ে দিয়েছি আর ওর মাথায় বাতাস দিয়েছি। পরে আমার ফ্রেন্ড ডক্টর নিয়ে এসেছে। আম্মু-আব্বু কাউকেই জানাইনি। ”
আফরোজা নাজনীন আনানকে রুমে পাঠিয়ে দিলেন। নাজমা আক্তারকে বললেন,
” নাজমা, তুই আনানের জন্য নরম করে ভাত রান্না কর। আর শহিদুলকে ডাব আনতে পাঠিয়ে দে। ছেলেটা ঠিকমত দাঁড়াতে পারছেনা। ”
বড় জায়ের কথামত নাজমা আক্তার রান্নাঘরে গেলেন।

” চলেই যাচ্ছ? আবার কবে আসছ? দিদুনের কাছে শুনলাম, তুমি নাকি শিহাবকে নিয়ে আলাদা থাকবে? পারবে থাকতে? ” দিদুনের রুমে কুহুকে দেখে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।
” খুব তাড়াতাড়ি আসব। ”
” তাহলে এই বাড়িতে থাকছোনা? ”
” সম্ভব হবে না। তবে মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসব। ”
” নিহান চারটা টিউশনি ঠিক করেছে শুনলাম। একরুমের একটা ফ্ল্যাটও দেখেছে। এরপর এসে ফ্ল্যাটটা দেখে এসো। আমার কাছে নিরাপদ মনে হয়েছে। তোমার পছন্দ হলে এ্যাডভান্স করবে নিহান। ঐ বিল্ডিংয়ের মালিকের ছেলে আমার বন্ধু। কোন সমস্যা হবেনা। আর একটা কথা, রাতে কোন টিউশনি করাবেনা। সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফেরার চেষ্টা করবে। অবশ্য ঐ বিল্ডিংয়েরই চারটা স্টুডেন্ট পড়তে চায়। ”

” এত আগেই ফ্ল্যাটও দেখেছে ভাইয়া! ”
” আজকেই দু’জন গিয়ে দেখে এসেছি। ভর্তির সময় এসে তুমি একবার দেখে এস। বাসাটা আমাদের এখন থেকে খুব একটা দূরে নয়। তবে বুয়েটের কাছাকাছি। ভর্তি হওয়ার পর একবারে সব ঠিকঠাক করে যেও। ”
” হুঁ। ”
” কুহু, চল বেরিয়ে পরি। দেরি করলে বাস মিস করবি। ” নিহান এসে তাড়া দিল।
” আনান ভাইয়া কোথায়? ”
” ঘুমাচ্ছে। ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৩

” ভাইয়াকে কয়টা দিন এখানেই থাকতে বল। ভাইয়া খুব দুর্বল হয়ে গেছে। বড়মা শুনলে কান্নাকাটি শুরু করবে। ”
” আম্মুকে কিছু জানানোর দরকার নেই। আব্বুও অসুস্থ। দু’জনেই চিন্তা করবে। ”
” বলবনা। তুমি একটু দাঁড়াও, আমি মামীদের থেকে বিদায় নিয়ে আসি। ”
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল কুহু, নিহান আর তাহমিদ।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৫