সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৫
জাওয়াদ জামী
” মামী, এতকিছু কেন করেছেন! এসবের কোনই প্রয়োজন ছিলনা। ”
নতুন বাসায় ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেছে কুহু। ও চারপাশে তাকিয়ে দেখছে। আফরোজা নাজনীন কুহুর আসার আগেই ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে ফ্ল্যাট সাজিয়েছেন। একটা বেডরুম, ড্রয়িং কাম ডাইনিং আর রান্নাঘর সবমিলিয়ে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। সেই ফ্ল্যাটই আফরোজা নাজনীন টুকটাক সাজিয়েছেন। বেডরুমের জন্য খাট, ড্রেসিংটেবিল, আলমারি কিনেছেন। ড্রয়িংরুমে তেমন কিছু রাখেননি। কয়েকটা চেয়ার আর একটা টেবিল রেখেছেন। রান্নাঘরে কিছু হাঁড়ি-পাতিল, প্লেটসহ রান্নার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেছেন।
” তেমন কিছুই করিনি , মা। আম্মা চেয়েছিলেন আরও কিছু কিনতে। কিন্তু তোর বড় মামা নিষেধ করল। বাসা ভর্তি ফার্নিচার রাখলে নাকি সেসব পরিষ্কার করতে গিয়ে তোর পড়াশোনার ক্ষতি হবে। তাই তোর দিদুন আর কিছু কেনার চিন্তা বাদ দিয়েছেন। ” আফরোজা নাজনীন হাসিমুখে বললেন।
” কিন্তু মামী, এতকিছুরও আমার দরকার ছিলনা। এগুলো কিনতে নিশ্চয়ই অনেক টাকা লেগেছে। এত টাকা এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। কিভাবে শোধ সেটাও ভাবতে হবে আমাকে। ” কুহু ইতস্ততভাবে বলল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” এই মেয়ে, তুই টাকা শোধ দেয়ার কথা চিন্তা করছিস কেন! তুই আমাদের বাসায় থাকবিনা ঠিক আছে। কিন্তু বাসা নিয়ে থাকতে গেলে কিছু জিনিসপত্র প্রয়োজন হয়। তোর দিদুন তোকে ভালবেসে এগুলো দিয়েছেন। এখানে টাকা শোধ দেয়ার কথা আসছে কেন? তুই কি জানিস নিহান, আনানের প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্রই তোর দিদুন দিয়েছেন? তার নাতি-নাতনিরা বাহিরে পড়াশোনা করতে গেলেই তিনি সবাইকে কিছুনা কিছু দিয়ে থাকেন। তুইও তার নাতনি, এই অধিকার বোধ থেকেই তিনি তোর জন্য এসব করেছেন। এতে যদি তোর মনে হয়, টাকা শোধ করতে হবে, এটা শুনলে কিন্তু তিনি কষ্ট পাবেন। ”
বড় মামীর কথা শুনে লজ্জা পেল কুহু। কি বলবে সেটা খুঁজে পেলোনা। ওকে নীরব থাকতে দেখে আফরোজা নাজনীনই কথা বললেন।
” শোন মা, কায়েসের সঙ্গে আমাদের কি গভীর সম্পর্ক ছিল সেটা বোধহয় তুই জানিসনা। কায়েস প্রতি সপ্তাহেই আমাদের বাসায় আসত। তোর মা মাসে একদিন হলেও আসত। আমরাও যেতাম তোদের বাসায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তোকে কখনোই দেখিনি। তুই সারাদিন স্কুল-কোচিং নিয়েই ব্যস্ত থাকতিস। তাই তোর জানা নেই আমাদের সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু। তোর দিদুন আইরিনকে নিজের মেয়ে বলেই ভাবতেন। তিনি আইরিনকেও সে কথা বলেছিলেন। আইরিন তোর দিদুনকে আম্মা বলেই ডাকত। তাই তোর দিদুন যদি দিতে চান বা কিছু দেন, তবে সেগুলোর মূল্য পরিশোধের কথা মনেও আনবিনা। বুঝেছিস আমার কথা? ”
” বুঝেছি, মামী। ”
” শোন এখন শুধু ফ্রিজ কেনা বাকি আছে। সময় করে একদিন কিনে ফেলব কেমন? ”
” ফ্রিজ কেনার টাকা আমার মামা দিয়েছে। তবে আপাতত আমার ফ্রিজের দরকার নেই , মামী। কয়েকটা দিন যাক। তারপর কিনে নেব। আগে এদিকটা সামলে নেই, পরিস্থিতি বুঝে নেই তারপর ফ্রিজ কিনলেই হবে। আমি আপনাকে টাকা দিয়ে দেব, আপনি পছন্দ করে কিনবেন। ”
কুহুর কথা শুনে আফরোজা নাজনীন হাসিমুখে সায় জানালেন। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন কুহু কেন ফ্রিজ কিনতে চাচ্ছেনা। মেয়েটার ধৈর্য্য, বুদ্ধি দেখে অবাক হয়েছেন তিনি।
” কি রে, আমড়া কাঠের ঢেঁকি, কি অবস্থা তোর? তোর মত গোবর গনেশ ঢাবিতে পড়বে ভাবলেই আমার নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। ঢাবির মানসম্মান বলে আর কিছু থাকলনা। তোর মত গোবর গনেশকে ঢাবিতে সুযোগ দিয়ে আমার মত বুদ্ধিমান মানুষের মেধাকে অবমাননা করা হয়েছে বুঝলি? তা তোর সাবজেক্ট যেন কি? ” আনান একটু ভাব নিয়ে সিক্তার কাছে জানতে চাইল।
” বায়ো কেমিস্ট্রি আমার সাবজেক্টের নাম। আর কিছু জানতে চাও তুমি? ” সিক্তা দাঁতে দাঁত পিষে বলল।
” কেমিস্ট্রি বানান জানিস? বলতে পারলে আমি বুঝব এখানে তোর বংশের মহাজনদের কোন কেরামতি নেই। ”
” আনানের বাচ্চা, তুই গেলি এখান থেকে? তুই কি বলতে চাস? আমার যোগ্যতা নেই ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার? তুই নিজে পড়িস কি এমন ভালো সাবজেক্টে ? তাতেই এত ভাব নিচ্ছিস? ফালতু কোথাকার। ”
” ফিজিক্স, সাবজেক্টের নাম শুনেছিস নিশ্চয়ই? আমি সেই সাবজেক্টেই পড়ি। তোর মত গোবর গনেশ ফিজিক্সের মূল্য বুঝবে কিভাবে! কেমিস্ট্রিতে পড়ার সুযোগ পেয়ে নিজেকে মেরি কুড়ি ভাবতে শুরু করেছিস নাকি? যতসব পাগলের দল। তোর যে ব্রেইন, দুইমাস পরই দেখবি চোখের জলে নাকের জলে একাকার হয়ে গেছে। ”
” আমাকে এভাবে ইনসাল্ট করবিনা বলে দিলাম। আমি গোবর গনেশ নই। তুই গোবর গনেশ তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী গোবর গনেশ। ফালতু ছেলে। আমার পেছনে না লাগলে তোর শান্তি হয়না? ” রাগে-দুঃখে সিক্তা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
সিক্তাকে কাঁদতে দেখে আনানের চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল। ওর সামান্য কথাতেই এই মেয়ে কেঁদে বাড়িটাকে সাগর বানিয়ে দিচ্ছে! আনানের ইচ্ছে করছে চলন্ত রিক্সার নিচে মাথাটা রাখতে। এতে যদি ওর একটু শিক্ষা হয়। কোন কুক্ষণে যে এই মেয়ের পেছনে লাগতে গেছিল! এখন যদি বড় মামী দেখে, তার মেয়ের চোখের পানি, নাকের পানি দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগর সৃষ্টি হয়েছে, তবে নিশ্চয়ই মামী রাগ করবেন। যদিও বড় মামী রাগ করার মানুষই নন। তবুও বলা যায়না। আনান অনেক ভেবে সিক্তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। যদিও সেটা টেম্পোরারি। সিক্তার কান্না থামলেই ও ক্ষমা উইথড্র করে নিবে।
” সিক্তা, শোন… ”
আনান কথা শেষ করতে পারলনা। তার আগেই সিক্তা বলে উঠল,
” তুই আমার সঙ্গে কথা বলবিনা বলে দিচ্ছি। তুই আমার জীবনের একমাত্র শত্রু। তুই ছাড়া আর কেউ আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলেনা। ” কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে সিক্তার।
আনান সিক্তার কান্না মাখা মুখের দিকে তাকায়। সাথে সাথে ওর ঠোঁটের হাসি মুছে যায়।
ঢাকায় আসার পর থেকে কুহুকে রান্না করতে হয়নি। বড় মামী প্রতিদিন ওদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দেন। ঐ বাড়ি থেকে প্রতিদিন কেউ না কেউ খাবার নিয়ে এখানে আসেন। কুহু অনেকবারই নিষেধ করেছে খাবার আনতে। কিন্তু ওর কথা কেউই শোনেননা। গত দেড়মাস যাবৎ ঐ বাড়ি থেকে খাবার আসছে। এই দেড়মাসে কুহু ঐ বাড়িতে দুইদিন গেছে। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। এই দুইদিন ও তাহমিদকে দেখেনি। তার ইন্টার্নি শেষ। সে অক্সফোর্ডে ক্লিনিক্যাল রিসার্চ স্কলারশিপ পেয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি সে ইল্যাণ্ডে পাড়ি জমাবে। সেসব নিয়েই ব্যস্ত আছে সে।
” কুহু সোনা, কেমন আছো তুমি? আজ কিন্তু তোমাকে যেতে দিচ্ছিনা। আগামী কয়েকটা দিন তুমি এখানেই থাকবে। আগামীকাল রাখী, নিয়াজ আসছে। নিহান, আননকেও আসতে বলেছি। কয়েকটা দিন তোমরা সবাই মিলে আনন্দ করবে কেমন? ”
” ঠিক আছে, দিদুন। বড়মাও আমাকে ফোন করেছিল। বড়মাও চায় দুই-তিন দিন আমি এখানে থাকি। ”
” যাক অবশেষে আমার মেয়ের সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে। শিহাব বাবু কোথায়? ”
” ও বাগানে পিচ্চিদের সঙ্গে খেলছে। ”
” দিদুন, এইবার কুহুকে একটু ছাড়তে হবে তোমার। আমরা একটু ছাদে যাব। নতুন কেনা ফুলগাছটা ওকে দেখাব। ” সিক্তা এসে দাঁড়িয়েছে কুহুর পাশে।
” কুহু সোনা, যাও সিক্তর সঙ্গে। তোমরা আড্ডা দাও। তবে তার আগে বড় বউমাকে বলে যেও, আমার জন্য যেন লেবু পানি পাঠিয়ে দেয়। ”
” ঠিক আছে, দিদুন। ”
” বলতো কুহু, এই ফুলগুলোর নাম কি? ”
” এটা ব্লিডিং হার্ট, এটা রুসেলিয়া। ”
” বাহ্ তুই জানিস! তোকে হারানো কোনভাবেই সম্ভব নয় দেখছি। ”
” আমাদের বাসায় একসময় ছিল, তাই নাম জানি। ”
” এই কুহু, শোন ক্লাসের কোন ছেলেকে কি পছন্দ হয়েছে তোর? কিংবা কোন ছেলে তোকে পছন্দ করেছে? কারো দিক থেকে কোন গ্রীন সিগনাল পেয়েছিস? ”
সিক্তার কথা শুনে কুহু অনেক কষ্টে হাসি আটকাল। সিক্তা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে। ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে।
” ছেলেরা বোধহয় বুঝতে পেরেছে আমার পেছনে ঘুরে কোন ফায়দা নেই। দৃষ্টি সব সময়ই বলে, আমি নাকি নিরামিষ। কথাটা বোধহয় সে ঠিকই বলে। ”
পায়ের আওয়াজ পেয়ে কুহু, সিক্তা দু’জনেই পেছনে তাকাল। তাহমিনা আক্তারকে দেখে দু’জনের ঠোঁটেই হাসি ফুটল। তাহমিনা আক্তারও পাল্টা হাসলেন। তবে সেই হাসিতে প্রান নেই। আছে বিষন্নতা আর দীর্ঘশ্বাস।
” ওহ্ তোরা এখানে! আচ্ছা তোরা গল্প কর। আমি যাই। ” ওদের কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ছাদ থেকে চলে গেলেন তাহমিনা আক্তার।
কুহু কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থাকল।
” সিক্তা, মেজো মামীর কি হয়েছে রে? তার মনটা বোধহয় খারাপ। কাঁদছিলেন মনে হল। ”
” তাওহিদ ভাইয়ার কথা মনে করে কাঁদছে। এটা নতুন কিছু নয়। ”
” তাওহিদ ভাইয়া কে? ”
” চাচীর বড় ছেলে। নিউইয়র্কে আছে। আমাদের কারও সঙ্গে ভাইয়ার যোগাযোগ নেই। ”
” কেন? ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৪
” ভাইয়া রাশিয়ান মেয়েকে বিয়ে করেছে। কিন্তু চাচ্চু চেয়েছিল দেশেই ভাইয়াকে বিয়ে দেবে। ভাইয়া রাজি হয়নি। সবার অমতে বিয়ে করে সে। তারপর থেকেই তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই। এসব নিয়ে অনেক কিছু ঘটেছে আমাদের বাসায়। তাই তার নাম নেয়াও বারণ। কিন্তু চাচী তো মা। সে কিভাবে সন্তানকে ভুলে থাকবে। যখনই ভাইয়ার কথা মনে হয়, তখনই সে কাঁদে। তবে গোপনে। চাচ্চু জানলে রাগ করবে। ”
সিক্তার কথাগুলো শুনে কুহুর মন খারাপ হয়ে গেল। মেজো মামীর মত নারীকে কষ্ট পেতে দেখলে যে কারোও মন খারাপ হয়ে যাবে।