সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪
জাওয়াদ জামী
” ভাই, কি কপাল তোমার, ছোট ভাইয়ের বিয়েতে তুমি দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়াবে আর তোমার ছোট ভাই বউ নিয়ে ইস্টুপিস্টু করবে। আর আমারই বা কপাল দেখ, তোমার মত পোড়া কপাইল্যা মানুষ নিয়ে আমার কারবার। আমার কথা মন দিয়ে শোন, বিয়ের এই কয়টা দিন আমার সাথে থাকবে। আমার মত একজন হ্যান্ডসাম ছেলের সাথে তোমাকে দেখলে মেয়েরা তোমার প্রতি আগ্রহী হবে। ” আনান ভাব নিয়ে কথাগুলো বলল।
আনানের কথা শুনে তাহমিদ ওর দিকে রাগী চোখে তাকায়। কিন্তু তাহমিদকে থোড়াই কেয়ার করে!
” তো মিস্টার হ্যান্ডু সরি হ্যান্ডসাম, এই পর্যন্ত কয়টা মেয়েকে পটাতে পেরেছিস? আমি যতদূর জানি, এখন পর্যন্ত তোর একটাও প্রেম হয়নি। কোন এককালে, কোন এক মেয়েকে প্রোপোজ করতে গিয়ে কুকুরের তাড়া খেয়েছিলি তুই। তখন থেকেই আমি জানি, তুই কুকুর কপালে। মানে মেয়েদের আশেপাশে ঘুরঘুর করেও তাদের এটেনশন পাসনি। বুঝেছিস? নাকি আরও গভীরে যেতে হবে? ” বিগলিত হাসি হেসে বলল তাহমিদ।
তাহমিদের কথা শুনে আনানের মুখ চুপসে গেল। চারপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ তাহমিদের কথাগুলো শুনেছে কিনা।
” জীবনে আর কখনো যদি আমার গোপন কথা তোমার কাছে শেয়ার করেছি, তবে আমার নাম আমি নিজেই পাল্টে রাখব। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” নামের দরকার পরলে আমার কাছ থেকে ধার নিতে পারিস। আমার স্টকে ইউনিক সব নাম আছে। কারন আমি জানি, অদূর ভবিষ্যতে নতুন নামের দরকার হবে তোর। ”
” তোমার ইউনিক নাম তোমার স্টকেই রাখ। ভবিষ্যতে তোমার নিজের ব্যাটেলিয়নের জন্য দরকার হবে। তোমার ইউনিক নামগুলো যে কোন ধরনের হয়, সেটা আমার থেকে কে আর ভালো জানে। ”
” আমার ভবিষ্যত ব্যাটেলিয়নের জন্য চিন্তা না করে নিজের ভবিষ্যৎ নাম নিয়ে চিন্তা কর। মনে কর, কয়েকজন সুন্দরী মেয়ের সামনে কেউ তোকে ‘ গেন্দু ‘ অথবা ‘ চান্দু ‘ কিংবা ‘ মফিজ ‘ কিংবা এই ধরনের ইউনিক নামে ডাকল। তখন তোর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? ”
” তার মানে তুমি ধরেই নিয়েছ ভবিষ্যতে আমার পাল্টানোর সিচুয়েশন আসবে! আর সেইমতন তুমি নামও ভেবে নিয়েছ! ”
” একশোভাগ নয় হাজারভাগ নিশ্চিত আমি। বড় ভাই হিসেবে আমারও কিছু দ্বায়িত্ব আছে। ”
” তাহমিদ ভাইয়া, তুমি কখন এসেছ! ” ওদের দু’জনের কথার মাঝে জিজ্ঞেস করল শিহাব।
” শিহাব, তার আগে তুই বল, এতক্ষণ তুই কোথায় ছিলি? আমি গত একঘণ্টা যাবৎ তোকে খুঁজছি। ” শিহাবকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।
” আপুদের সাথে বাজারে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আসবে জানলে বাড়িতেই থাকতাম। আমাদের গ্রামে কতদিন থাকবে, ভাইয়া? ”
” তুই যে কয়দিন রাখবি, সে কয়দিনই থাকব। এবার বল কয়দিন রাখবি আমাকে ? ” শিহাবের পিঠে চাপড় মেরে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।
” আমি কিভাবে জানব, তোমার কয়দিন ছুটি আছে! তুমি নাকি পড়ার চাপে কোথাও যেতে পারোনা। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি। ” ম্লানমুখে জবাব দিল শিহাব।
” কি রে শিহাব, ঘটনা কি? এই চিজকে তুই হুজুর হুজুর করছিস কেন? নিজের ভালো চাইলে আমার দলে নাম লেখা। আমি অন্তত তোকে কোন আজেবাজে নামে ডাকবনা৷ ” আনান শিহাবের পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে দিয়ে বলল।
” শিহাব, শোন আগামী দুই-একদিনের মধ্যেই ঢাকঢোল পিটিয়ে তোকে আনানের মুরিদ বানিয়ে দেব। তোর একমাত্র পীর বাবা হবে সে। পীরে ঘুরঘুরি বাবা রহমতুল্লাহি চান্দু মফিজ। অত্র এলাকার একমাত্র পীর হিসেবে আনান পরিচিতি পাবে। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ এসে তার মুরিদ হবে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সহিত বাবার জন্মদিন পালিত হবে। সুযোগ বুঝে বাবা তোর মাধ্যমে ঘোষনা দেবে, সে চিরকুমার থাকতে চায়। এরকম আরও অনেককিছুই ঘটবে। বিষয়টা কেমন হবে বল? ”
” সেই মজা হবে, ভাইয়া। তুমি কি সত্যিই আনান ভাইয়াকে পীর বানিয়ে দেবে? আনান ভাইয়া অন্য সব পীরদের মত লুঙ্গী, পাঞ্জাবি আর টুপি পরে চেয়ারে বসে থাকবে, আর অনেকগুলো মানুষ ভাইয়াকে হুজুর বলে ডাকবে? ” আনন্দে হাত তালি দিয়ে বলল শিহাব।
” শুধু মানুষ নয় রে, পাগলা। তোর ভাই আশেপাশের কয়েক গ্রামের কুকুরদেরও নেতা হবে। কুকুরা সব আনানের কথা শুনবে। ওরা হুটহাট কাউকে তাড়া করবেনা। কেউ কাউকে প্রপোজ করতে গেলে তাড়ানি দেবেনা। ” মুচকি হেসে বলল তাহমিদ।
” শিহাব, চল বাড়িতে অনেক কাজ আছে। সম্মানিত ভাই, আপনিও চলুন। অনেক কাজ করতে হবে আমাদেরকে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট টিম চলে এসেছে । তাদেরকে সবকিছু দেখিয়ে দিতে হবে। ” মুখ কালো করে বলল আনান।
” চল যাই। ” হাসি চেপে বলল তাহমিদ।
বাড়িতে উৎসবমুখর পরিবেশ। স্টেজজুড়ে হলুদের গন্ধ। স্টেজজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে গাঁদা, রজনীগন্ধা, কামিনী আর বেলি। ফুলের গন্ধে মন চঞ্চল হয়ে উঠছে। পুরো স্টেজ উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে। মঞ্চের পেছনে রঙিন কাপড়ের পর্দা সবার নজর কেড়েছে। পর্দার মাঝখানে ঝুলছে গাঁদা ফুলের মালা। মাথার ওপরে ছোট-বড় ঝাড়বাতি। স্টেজের ঠিক মাঝখানে ফুলেল আসনে বসে আছে নিহান। ওর চারপাশে ওর বন্ধুবান্ধব, কাজিনরা হৈ-হুল্লোড় করছে। সবাই আনন্দ করলেও নিহানের মুখে হাসি নেই।
” কুহু, তোমরা এখনো বাড়িতেই আছ যে? হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে তো। এখনো তৈরী হওনি তোমরা? তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও। ” আফরোজা নাজনীন কুহুদের বিয়ে বাড়িতে না দেখতে পেয়ে ওদের ডাকতে চলে এসেছেন।
” আমরা না গেলে হয়না, মামী? শরীরটা ভালো লাগছেনা। ” অনিচ্ছায় মিথ্যা বলল কুহু।
” এই মেয়ে, তোকে কি কাজ করতে হবে যে শরীর খারাপ থাকলে যেতে পারবিনা? তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে। ” ধমকে উঠলেন আফরোজা নাজনীন।
” আমার বড় মামী আমাদের বারবার যেতে বলছে। আজকে সকালেই যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি যেতে দিলেননা। এখন মামার বাড়িতে যাই, মামী? ” ভয়ে ভয়ে বলল কুহু।
” কোথাও যেতে পারবিনা তোরা। আমার সাথে নিহানের হলুদে যাবি। এত কিসের ভয় রে, মা? সব ভয় ঝেড়ে ফেলে আনন্দ কর। কোন কিছুকে যখন খুব বেশি ভয় পাবি, ভয়ের নাগপাশে ততই জড়িয়ে যাবি। তাই জীবনে ভয়কে প্রাধান্য না দিয়ে সব সময় নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিবি। ইচ্ছেশক্তির জোরেই মানুষ অনেক কিছু করতে পারে। তোদেরকেও সেটাই করতে হবে। ”
আফরোজা নাজনীন বিভিন্নভাবে বোঝালেন কুহুকে। এরপর আর কুহু তাকে না বলতে পারলনা।
” মামী, একটা রিকুয়েষ্ট করি? ”
” বল। ”
” শাড়ী পরতে চাচ্ছিনা। ”
” পরতে চাচ্ছিসনা নাকি শাড়ী নেই তোদের? মানে রাখী তোদের শাড়ী কিনে দেয়নি এইতো? ”
আফরোজা নাজনীনের প্রশ্নে নিরব থাকল কুহু।
” বুঝেছি। আমার শাড়ী তুই পরবি। আর তাহমিনা শাড়ী পরবে দৃষ্টি। আর তোর ছোট মামীর ছেলে আসেনি। ওর পাঞ্জাবি শিহাবের হয়ে যাবে। ” আফরোজা নাজনীন কুহুকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাহমিনা আক্তারকে ফোন করলেন।
” নিহান, একটু তো হাসবি নাকি? মুখটা পেঁচার মত করে রেখেছিস কেন? জীবনের শেষ হাসিটা আজকে হেসেই নে। কালকের পর থেকে বাকি জীবন হাসি তোর সাথে লুকোচুরি খেলবে, এটা মনে করেও তো একটু হাসতে পারিস? ” তাহমিদের কথা শুনে স্টেজের সকলেই হো হো করে হেসে উঠল।
” ঠিক বলেছ, ভাইয়া। নিহান ভাইয়াকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে নয় শোক পালন করছে সে। ” সিক্তা তাহমিদের কথার সাথে সায় জানাল।
” এই যে ভাঙ্গা টেপ রেকর্ডার, তুই কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটছিস কেন? তোর জামাই বেচারার কথা মনে করে আমি এখন থেকেই কষ্ট পাচ্ছি। তোকে বিয়ে করার পর থেকে বেচারাকে আর হাসতে হবেনা। তোর রাক্ষসীর মত হাসি দেখলে বেচারা নিশ্চয়ই ভয়ে স্ট্রোক করবে। বেচারার ফাটা কপাল। ”
” আনাইন্যা রে, তুই আর একটা কথাও যদি বলেছিস, তোর গলা টিপে দেব আমি। আমি রাক্ষসী? তুই রাক্ষস, তোর বউ রাক্ষসী, তোর বউয়ের চৌদ্দ গোষ্ঠী রাক্ষস/রাক্ষসী। ” খেঁকিয়ে উঠল সিক্তা।
” এই তোরা সরে দাঁড়া। ঝগড়া করার ইচ্ছে থাকলে বাহিরে গিয়ে কর। স্টেজের পরিবেশ নষ্ট করিসনা। ” আফরোজা নাজনীনের ধমকে সবাই চুপ মেরে গেল।
সবাই চুপ করতেই আফরোজা নাজনীন কুহুর হাত ধরে ওকে নিয়ে স্টেজে উঠলেন।
বড়মার দিকে তাকাতেই তাহমিদের চোখ গেল একটা সবুজ পরীর দিকে। কোমড় ছাড়িয়ে গেছে তার চুল। কানের একপাশে গাঁদা ফুল গোঁজা। পার্লের গহনা শোভা পাচ্ছে তার অঙ্গে। ঠোঁটে পিচ রঙের লিপস্টিক। শ্যামলা রঙের মেয়েটিকে এই হালকা সাজেই অপ্সরা লাগছে তাহমিদের চোখে। আনমনেই সে বলে উঠল,
” কে এই শ্যামাঙ্গিনী? ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩
” কুহু, এসেছিস তুই! কি সুন্দর লাগছে তোকে! আমি তোকে কতবার করে আসতে বললাম, কিন্তু তুই আমার কথা শুনলিনা। এখন তো ঠিকই আসলি। ” সিক্তা দৌড়ে গেল কুহুর দিকে।
কুহু নামটা তাহমিদের কাছে পরিচিত লাগল। তবে মনে করার চেষ্টা করলনা নামটা কোথায় শুনেছে। সে তার শ্যামাঙ্গিনীকে দেখতে ব্যস্ত।
আমার থেকে অনেক ভালো লাগে এটা