সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩১

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩১
জাওয়াদ জামী

” আম্মা , নিহানের আব্বু এভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে আমি ভাবতেই পারিনি। কতদিন ধরে ওকে বলছি ডক্টরের কাছে চল। কিন্তু ও আমার কথা শুনলইনা। ডক্টর বলেছে , আগে চিকিৎসা করালে অসুখ এতটা বাড়াবাড়ি হতোনা। এই বয়সে বাইপাস সার্জারি করাতে হবে। সারাজীবন নিয়মকানুনের মধ্যে চলতে হবে। অথচ সে কখনো নিয়মকানুনের ধারেকাছেও যায়নি। ” আম্মার পাশে বসে কাঁদছে আর আহাজারি করছে রাখী আক্তার।

” এভাবে কেঁদোনা। নিয়াজ শুনলে ওর অসুস্থতা আরও বেড়ে যাবে। তোমরা যতদিন খুশি এখানে থাক। নিয়াজের অপারেশন করে, ওকে সুস্থ করে তারপর বাড়িতে যাবে। ” আয়েশা সালেহা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন।
” ওর কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে, আম্মা? আমার নিহানের চাকরির কোন ব্যবস্থাই হলোনা, আনানের পড়াশোনাও শেষ হলোনা। ওদের নিয়ে কিভাবে চলব আমি। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” নিয়াজ ভালো একটা চাকরি করে , রাখী। ও ভালো বেতন পায়। আমি যতদূর জানি, তোমাদের সেভিংসও আছে। নিহানের চাকরিও খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। আবার গ্রামে নিয়াজের সম্পত্তি আছে। বেয়াই ওকে কম দিয়ে যাননি। আর আনানের খরচ ও নিজেই চালাতে পারবে। তারপরও যদি সমস্যা হয় , তবে আমরা আছি। আমার ছেলেরা তাদের একমাত্র বোনকে কখনোই ফেলে দেবেনা। তুমি অযথাই চিন্তা করছ। আজেবাজে চিন্তা বাদ দাও। আর নিয়াজের সামনে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা কর। ওকে বুঝতে দিওনা , আমরা ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি। মনে থাকবে আমার কথা? ”
” মনে থাকবে , আম্মা। তাহমিদ, তোর ফুপার সার্জারি কবে হবে? যত তাড়াতাড়ি পারিস সার্জারির ব্যবস্থা কর। ”
” তুমি চিন্তা করোনা , ফুপু। দুই-এক দিনের মধ্যেই ফুপার সার্জারির ব্যবস্থা করছি। স্যারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। স্যার আজকালের মধ্যেই ফুপাকে হসপিটালে এ্যাডমিট করাতে বলেছেন। স্যার ইউনাইটেডে রুগী দেখেন। ”

” যা করার তুই নিহান, আনানকে সঙ্গে নিয়ে কর। আমার কিছুই ভালো লাগছেনা। ”
” রাখী, ভেঙে পরোনা। নামাজ পড়ে দোয়া কর নিয়াজের জন্য। তোমাকে ভেঙে পরতে দেখলে নিয়াজও ভেঙে পরবে। এই মুহূর্তে ওকে টেনশনে রাখা আমাদের উচিত হবেনা। তাহমিদ, বাপ, তুই তোর ছোট চাচাকে নিয়ে ডক্টরের সঙ্গে আজকেই কথা বল। নিহানকেও সঙ্গে নিস। কথাবার্তা বলে নিয়াজকে হসপিটালে এ্যাডমিট করা। সার্জারি যখন করতেই হবে, তখন দেরি করার দরকার নেই । ”
” দাদু ভাই , বড় বউমা ঠিকই বলেছে। তুমি আজকেই নিয়াজের ভর্তির ব্যবস্থা কর। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করোনা। অপারেশনের জন্য আমি এক লক্ষ টাকা দেব। ”

” নানিমা , তোমার টাকা দিতে হবেনা। তুমি শুধু আব্বুর জন্য দোয়া কর। সার্জারির জন্য যথেষ্ট টাকা আছে আম্মুর কাছে। ” নিহান টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানালো।
” হ্যাঁ আম্মা, কোন টাকা লাগবেনা আমার। টাকা সঙ্গে করে এনেছি আমি। প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে উঠানো যাবে। আপনি শুধু নিহানের আব্বুর জন্য দোয়া করবেন। ”
” আমি আমার মেয়ের জামাইয়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দিতেই পারি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে , তোমাদের কোন টাকা নেই। ”
আম্মার কথার পিঠে আর কোন কথাই বললনা রাখী আক্তার।

” তুমি নাকি ফুপুর সঙ্গে বাড়িতে যেতে চাইছ? ক্লাস না করলে প্রবলেম হবেনা? ”
” যেতে হবেই। আমি আট-দশ দিন পরই চলে আসব। এই কয়েকদিন ক্লাস মিস দিলে তেমন কিছু হবেনা। বড়মা একা একা সবকিছু সামলাতে পারবেনা। দৃষ্টিও তেমন একটা কাজের নয়। ”
” শিহাবকে এখানে রেখে যাও। ও অন্তত ক্লাস করুক। তবে তুমি না গেলেও পারতে। ফুপুকে তো বাসার কাজ কখোনোই করতে দেখিনি। দুইজন মেইড আছে কাজের জন্য। তারপরও তুমি কেন যেতে চাইছ? ”
” আসলে চাচা চাচ্ছে আমি যেন তার সঙ্গে যাই। বড়মা রোগীর টেক কেয়ারের ব্যাপারে তেমন পারদর্শী নয়। ”
” ঠিক আছে যাও। তোমার চাচার বাড়িতে তুমি যাবে , এখানে আমি বাঁধা দেয়ার কে। তবে দেরি না করে তাড়াতাড়ি ফিরে এস। আর শিহাবকে রেখে যেও। ”
তাহমিদের কথায় যেন অদৃশ্য অধিকারবোধ জড়িয়ে আছে। কুহু ওর দিকে স্নিগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকল। দিনকে দিন এই মানুষটা ওর অস্থিমজ্জায় জড়িয়ে যাচ্ছে , এটা কুহু আন্দাজ করতে পারে। বাবা-মার মৃত্যুর পর এমন অধিকারবোধ নিয়ে কেউ ওদের সামনে দাঁড়ায়নি।

” শিহাবের স্কুল এখান থেকে দূরেই হয়। ও একা স্কুলে যেতে পারবেনা। ”
” আমি ওকে স্কুলে দিয়ে আসব। ওকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবেনা। এখানে থাকলে ও খারাপ থাকবেনা। ”
” আমি জানি শিহাব এখানে থাকলে ভালো থাকবে। ”
” কোকিলা, তুই এখানে? এদিকে আমি তোকে খুঁজে মরছি। আমার ব্ল্যাক টি-শার্টগুলো তোর কাছে ছিলনা? ঐগুলো কি এখন তোর কাছে আছে নাকি বাসায় রেখে এসেছিস? ” কুহু কথা শেষ করতে পারলনা। তার আগেই আনান এসে ওকে জিজ্ঞেস করল।

” আমার ব্যাগেই আছে , ভাইয়া। এনে দেবো? ”
” তোর হঠাৎ ব্ল্যাক টি-শার্ট দরকার পরল কেন , আনান? কোথাও যাচ্ছিস নাকি? ”
” তুমি তো জানো ভাই , ব্ল্যাক টি-শার্ট সব সময়ই আমার ফেভারিট। গত দুইদিন ধরে অন্য কালার টি-শার্ট ইউজ করে নিজেকে কেমন বল্টু বল্টু লাগছে। ”
” বল্টু বল্টু লাগবে কেন! তুই তো বল্টুই। আগেও ছিলি , এখনও আছিস। ”
” তোমার কথাগুলো মাইন্ডে নিলাম , ভাই। আজকের কথাগুলোর জন্য ভবিষ্যতে তোমাকে পস্তাতে হবে বলে দিলাম। এমন একদিন আসবে যেদিন তুমি তোমার এমন কঠিন বিষবাক্যের জন্য আমার কাছে ক্ষমা চাইবে। আর সেদিন আমি দয়াপরবশ হয়ে তোমাকে নিঃশর্ত ক্ষমা করে দেব। কারন আমি মহানুভব। আর ক্ষমতাও সেদিন আমার হাতে থাকবে। ”

” সেই দিন কখনোই আসবেনা। কারন যে ক্ষমতাবলে তুই আমাকে ক্ষমা করার কথা চিন্তা করছিস, সেই ক্ষমতা আমি না চাইলে কোনদিনই তোর নিকট হস্তান্তর করা হবেনা। তাই ভবিষ্যতে ক্ষমতা নিজের করে পেতে চাইলে বর্তমানে আমার ইশারায় নাচতে হবে তোকে। আমি চাইলে তুই কত্থক নেচে দেখাবি, আবার আমি চাইলেই তোকে ভারতনাট্যম নাচতে হবে। মোটকথা, যতই ক্ষমতার বাহাদুরি দেখাস, তোর সেই না হওয়া ক্ষমতার রাশ আমার হাতে। তাই হুটহাট মহানুভব সাজার বৃথা চেষ্টা করিসনা। বোঝাতে পেরেছি? নাকি আরও ডিটেইলস এ বলতে হবে? ”

তাহমিদের কথা শুনে আনান স্তব্ধ হয়ে গেছে। ও মাথা চুলকে তাহমিদের কথার মানে বোঝার চেষ্টা করছে। প্রায় মিনিট খানেক চেষ্টার পর ও তাহমিদের কথার অর্থ বুঝতে সক্ষম হলো। টেনশনে আনানের মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। ভাই সবকিছু বুঝতে পেরেছে ভাবতেই ওর ঠোঁটে বোকা বোকা হাসি ফুটল।
কুহু ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছে আনানের দিকে। তাহমিদের কথাগুলো শুনে আনানের মিইয়ে যাওয়া ওর নজর এড়ালো না। কুহু এটা বুঝতে পারছেনা তাহমিদের সামান্য কথাগুলো শুনে আনান ভাইয়া কেন এমন ভিজে বেড়াল সাজলো!

” বড়মা , তুমি একটু ঘুমাও, আমি রান্না সেরে চাচাকে খাইয়ে দেব। চাচার অপারেশনের পর থেকে তুমি ঠিকমত ঘুমাতে পারছনা। এভাবে না ঘুমিয়ে কাটালে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। ”
” সত্যিই রে , আজ পঁচিশ দিন হয়ে গেছে আমি ঠিকমত ঘুমাতে পারিনা। আগে কোনদিন এভাবে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি কিনা সেটা আমার মনে পরেনা। নিহান, আনানের জন্মের পরও আমি ঠিকঠাক ঘুমিয়েছি। কুহু শোন, আমি তাহলে একটু ঘুমিয়ে নেই। তুই রানু আর পাখিকে সঙ্গে নিয়ে রান্না করে ফেল। দৃষ্টিকে তোর চাচার কাছে থাকতে বলে দেই। ও তোর চাচার খেয়াল রাখবে। আজ তোর ফুপু আসবে। রোহানও আসবে। তুই ওদের জন্য রান্না করিস। ফ্রিজে মাছ-মাংস সবই আছে। তোর যা যা ইচ্ছা রান্না কর। তোর চাচার জন্য শুধু স্যুপ করিস। ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩০

” ফুপু আজকে আসবে? ”
” একটু আগেই কথা হলো তার সঙ্গে। তখনই জানালো তারা আসছে। একটু মনযোগ দিয়ে রান্না করবি। তোর ফুপু অনেকদিন আমাদের বাসায় আসেনি। রোহানও আসেনি অনেক বছর হয়ে গেছে। ”
” ঠিক আছে , চাচি। ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩২