সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৩
জাওয়াদ জামী
” খুব ইনজয় করছ, তাইনা? শপিং করতেও বোধহয় ভালোই লাগছে? কি কেনাকাটা করলে? ” কুহু দোতলার দক্ষিণের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। বেলকনি সংলগ্ন এই রুমটা কেউই ব্যবহার করেনা। কুহু এখানে মাঝেমধ্যে এসে দাঁড়ায়। আজকে মন খারাপ থাকায় এখানে এসে দাঁড়িয়েছে।
তাহমিদের প্রশ্নবানে জর্জরিত কুহু অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল তাহমিদেরই দিকে। লোকটা যে ওর ওপর রাগ করেছে এটা স্পষ্ট। কুহুর ভিষণ চিন্তা হচ্ছে।
” আমি শপিংয়ে যেতে চাইনি। ফুপু জোর করে পাঠালো। ফুপুর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে হত। কিন্তু হঠাৎ প্রেশার বেড়ে যাওয়ায় ফুপু আমাকে পাঠালো। ভাইয়া এতকিছু কিনতে পারতনা। ”
” গিয়েছ ভালো করেছ। তোমার কাজিনের সঙ্গে তুমি শপিংয়ে যেতেই পার। ইনফ্যাক্ট সিনেমায় যেতেও বাঁধা নেই। ”
” আর যাবোনা। ”
” আমি কিন্তু জিজ্ঞেস করিনি , কেন গিয়েছিলে? তুমি অযথাই চাপ নিচ্ছ। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর কান্না পেল। মানুষটা কেন ওর সমস্যার কথা বুঝতে পারছেনা! শপিংয়ে না গেলে ফুপু কষ্ট পেত। শেষ মুহূর্তে এসে ফুপুর শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে ভাইয়া গিয়েছিল ওর সঙ্গে।
” আপনি রাগ করছেন কেন? আমাকে একটুও বোঝেননা আপনি। ” এতটুকুই বলতে পারল কুহু। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
কুহুকে কাঁদতে দেখে চমকায় তাহমিদ। কুহুর এমন আচরণ ওর কাছে অপ্রত্যাশিত। তাহমিদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই রাখী আক্তারের গলা শুনল।
বড়মার গলা শুনে কুহু বেলকনি থেকে বড়মার কাছে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর তাহমিদও নিচে গেল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” ভাই , দুইটা দিন আমাদের এখানে থেকে যাও। দুইদিন পর আমিও ঢাকা ফিরব। দু’জন একসঙ্গে যাব। ” নিহান তাহমিদকে রিকুয়েষ্ট করল।
” থাকতে পারবনা রে। কয়েকটা মাস ভিষণ ব্যস্ত থাকব। কোথাও থাকার সুযোগ পাবোনা। ”
” আরে ভাই, নিহান এত করে যখন বলছে, তখন থেকেই যাও। আমিও কয়েকবছর পর মামার বাড়িতে এসেছি। তুমি থাকলে আমারও ভালোই লাগবে। ”
রোহানের কথা শুনে হাসল তাহমিদ।
” আমাকে জোর করোনা। সত্যিই আমি ব্যস্ত আছি। কয়েক বছরের জন্য দেশের বাহিরে যেতে হবে। তাই কাজ একটু বেশিই। ”
” তাহমিদ ভাইয়া, এ কি শুনছি আমি? তুমি নাকি কালই চলে যাবে? এত ঢং তুমি জানো! ফুপুর বাড়িতে এসেছ, কোথায় দুই-চার দিন ঘুরে বেড়াবে, কব্জি ডুবিয়ে খাবে। কিন্তু না তোমাকে চলে যেতে হবে। দুনিয়ায় যেন তুমি একটাই ডক্টর। ” দৃষ্টি বিরক্ত নিয়ে বলল।
” এই পিচ্চি, তোকে এতকিছু শুনতে কে বলেছে? তুই বরং আমাদের জন্য কফি নিয়ে আয়। শোন, এভাবে আমার সঙ্গে কথা না বলে নিহানের সঙ্গে বলিস। এতে ওকে টাইটও দেয়া হবে, আবার তুই ওকে হাতের মুঠোয়ও রাখতে পারবি। এতে আখেরে তোরই লাভ হবে। ”
” কফি খোর একটা। দশ মিনিট সময় দাও। কফি নিয়ে আসছি। ”
” তাহমিদ, একটা কথা বেশ বুঝতে পারছি। আমাদের নিহান বেচারা দৃষ্টিকে বিয়ে করে ভালোই ফেঁসেছে। বেচারা আমাদের সামনে যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন, ও কিন্তু দৃষ্টির সামনে গেলেই কেন্নোর মত গুটিয়ে যায়। দৃষ্টিকে যমের মত ভয় পায় নিহান। ” কথাগুলো বলেই রোহান হেসে উঠল। ওর সঙ্গে হাসিতে যোগ দিল তাহমিদও। শুধু নিহান বেচারা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বসে রইল।
” এই যে তোমাদের কফি। শুধু কফি নয়, কফির সাথে টফিও আছে। ” দৃষ্টি কুহু দু’জনেই ট্রে ভর্তি করে খাবার এনেছে।
” এতকিছু আনতে তোকে কে বলেছে? ” তাহমিদ জিজ্ঞেস করল
” রান্নাঘরে গিয়ে দেখি আপু সবার জন্য নাস্তা বানাচ্ছে। তাই নিয়ে আসলাম। আনান ভাইয়া কোথায়? ”
” আনানকে বাহিরে পাঠিয়েছি। চলে আসবে। কুহু, তুমি ঢাকা যাচ্ছ কবে? এদিকে বেশ কয়েকদিন ক্লাস মিস দিয়েছ , আর কতদিন মিস দেবে? এত ক্লাস মিস দিলে পিছিয়ে পরবেনা? ” তাহমিদ দৃষ্টির প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কুহুকে প্রশ্ন করল।
” চার-পাঁচ দিন পরই যাব। মিডটার্মের বেশি দেরি নেই। ”
” আবার চার-পাঁচ দিন কেন? এমনিতেই ফুপার অসুস্থতার পর থেকেই তোমার পড়াশোনা হচ্ছেনা। তার ওপর আরও চার-পাঁচ দিন লেইট করতে চাইছ? আমি রাজশাহী থেকে ফেরার পথে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি তৈরী হয়ে থেকো। ফুপার দেখাশোনার জন্য মানুষ আছে। তোমাকে না থাকলেও চলবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে অবাক হয়ে গেছে কুহু। সে কখনোই জনসম্মুখে কুহুর সঙ্গে এভাবে কথা বলেনি। আজ তার কি হয়েছে? তবে কুহু প্রশ্নটা করার সাহস পেলোনা। পাছে যদি সে রাগ করে।
মুখ ফুটে শুধু বলল,
” আমি তৈরী থাকব। ”
তাহমিদের কথায় অধিকারবোধের দেখা মিলল। রোহান প্রথমে তাকায় কুহুর দিকে। কুহুর চেহারায় স্বস্তির ছাপ চোখ এড়ালোনা ওর। এরপর রোহান তাকায় তাহমিদের দিকে। তাকিয়েই রইল এক দৃষ্টিতে। তাহমিদ কিছু একটা বলার জন্য তাকাতেই রোহানের সঙ্গে ওর চোখাচোখি হল। রোহানের চোখে তখন হাজারো প্রশ্নেরা ভীড় করেছে। তাহমিদ সেটা বুঝতে পারল। তাই মৃদু হেসে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল, কুহু ওর কে। উত্তর পেয়ে মলিন হাসল রোহান। নিজেও চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল, ঠিক আছে। ঘটনাগুলো নীরবেই ঘটল। কেউই কিচ্ছুটি বুঝতে পারলনা।
” ফুপু , আমি ঢাকা যাওয়ার সময় কুহুকে সঙ্গে নিয়ে যাব। ওকে বাসস্ট্যান্ডে যেতে বলো। ”
” আর কয়েকটা দিন পরে গেলে হতোনা? তোর ফুপাকে নিয়ে আমার একা একা কষ্টই হবে। ”
” ফুপু, ওর মিডটার্মের বেশি দেরি নেই। এখানে থাকলে ওর পড়াশোনা হবে? ওর রেজাল্ট খারাপ হলে কিন্তু দিদুনের কাছে তোমাকেই কৈফিয়ত দিতে হবে। তাই যা করার বুঝেশুনে করো। তুমি চাইলেই আর একটা মেইড রাখতে পার। এছাড়াও দৃষ্টি আছে। তোমার কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ”
আম্মার কাছে কৈফিয়ত দেয়ার কথা শুনে ভয় পায় রাখী আক্তার। কুহু থাকলে তার কোন কাজ করতে হতোনা। সব কাজ কুহুই করত। এখন কুহু চলে গেলে সে আর বসে থাকতে পারবেনা৷ অনেক চিন্তাভাবনা করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলো রাখী আক্তার।
” ঠিক আছে। ও যাক। তুই কয়টার গাড়িতে উঠবি? ”
” এখনই বলতে পারছিনা। টিকিট কেটে তোমাকে বলব। ”
” খারাপ লাগছে? কাজিনের সঙ্গে সিনেমায় যাওয়া হলোনা। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চা-কফি খাওয়া হলোনা। তা-ও শুধুমাত্র আমার জন্য। ”
তাহমিদের কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান করে জানালার বাহিরে তাকাল কুহু। এই লোকটা সুযোগ পেলেই ওকে খোঁচা দিচ্ছে। বাসে ওঠার পর থেকে এ নিয়ে পাঁচবার ওকে প্রশ্নটা করেছে তাহমিদ। কুহু চাইছে রাগতে। কিন্তু যে-ই তাহমিদের দিকে তাকাচ্ছে তখনই রাগ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এখন তো নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে কুহুর।
” কি এভাবে চুপ মেরে আছো কেন? কাজিনের কথা মনে পরছে? যাবে নাকি তার কাছে? নাকি তাকে ডেকে নেব? ” কুহুকে নিরব থাকতে দেখে আবারও জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।
কুহু অনেক কষ্টে রাগ জমা করেছিল। তাহমিদের প্রশ্ন শুনে যেই ওর দিকে তাকালো ঠিক তখনই ওর রাগ গায়েব। রাগের বদলে হেসে উঠল ফিক করে।
কুহুকে হাসতে দেখে কপাল কুঁচকে তাকাল তাহমিদ। মেয়েটার হাসির কারন ওর বোধগম্য হচ্ছেনা। তাই চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” এই মেয়ে, হাসছো কেন? খুব মজা পাচ্ছ? নাকি কাজিনের বিরহে মাথার নাট বল্টু ঢিলা হয়েছে? ”
” কোন উত্তর শুনতে আপনার ভালো লাগবে বলুন? আপনার ভালো লাগার ধরনের ওপর নির্ভর করছে আমার উত্তর। ”
” ইমপ্রেসিভ! চালাকি করছ আমার সঙ্গে? চালাকিতে তুমি আমার সঙ্গে পেরে উঠবেনা সেটাকি জানো? ”
” খুব জানি। কিন্তু তাই বলে চালাকি করতে পারবনা সেটা তো হয়না। চেষ্টা আমি করে যাব। ”
” তাহলে ধরে নেব কাজিনের বিরহে দেবদাসী হয়ে গেছ? ” প্রশ্নটা করে তাহমিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল কুহুর দিকে।
কুহু হাসল। ওর হাসি তাহমিদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল। ইচ্ছে করছে, জানালা দিয়ে মেয়েটাকে ছুঁড়ে ফেলতে । কিন্তু সেটা করতে পারবেনা তাহমিদ। কারন এই মেয়েই ওর বেঁচে থাকার কারন৷
” সিরাজগঞ্জ পৌঁছে গেছি। একটা আইসক্রিম কিনে দেবেন? আপনার ঝাঁঝালো কথাবার্তা শুনে আমার ভেতরটা গরম হয়ে গেছে। একটু ঠান্ডা না হলেই নয়। ” তাহমিদকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে চাইল কুহু।
” একটা নয় দশটা এনে দেব। ” দাঁতে দাঁত পিষে বলল তাহমিদ।
” দশটা লাগবেনা। বড়জোর দুইটা আনলেই হবে। একটা আমার একটা আপনার। আমি আইসক্রিম খাব আর আপনি বসে বসে দেখবেন এটা হয়না। ”
কথার মাঝেই কুহু ব্যাগ থেকে ছোট্ট বক্স বের করল। এগিয়ে দিল তাহমিদের দিকে।
তাহমিদ বক্স খুলে হেসে ফেলল। ওর পছন্দের নাড়ু আছে বক্সে। এবার তাহমিদ কুহুকে রাগানোর সুযোগ মিস করলনা।
” কাজিনের জন্য বানিয়েছিলে বুঝি? ”
এবার তাহমিদের কথায় কুহুর ভিষণ রাগ হলো । চোখ কটমট করে তাকাল তাহমিদের দিকে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে জবাব দিল,
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩২
” হুঁ , আপনি কাজিনের জন্য বানিয়েছিলাম। এবার খুশি? বাসায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত যদি একটাও কথা বলেন, তবে আমি বাস থেকে নেমে যাব। ”
কুহুর হুমকিতে কাজ হলো। তাহমিদ ওকে বিরক্ত করা বন্ধ করল। মাঝখানে কুহুর জন্য আইসক্রিম, চিপস, জুস কিনল। এবং নিরবেই সেগুলো কুহুকে দিল। তাহমিদকে চুপ করাতে পেরে কুহুও ভিষণ খুশি। ও একটু পরপর তাহমিদকে দেখছে আর হাসছে। তবে সেটা গোপনে।