সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৯
জাওয়াদ জামী
” আপনি কি সত্যিই ইউকে যেতে চান না! কেন এমন পাগলামি করছেন? বিয়ের পর কিন্তু অনেকেই বাহিরে পড়তে যায়। তবে আপনি কেন ছেলেমানুষী করছেন? কেন এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? নিজের ভালো বুঝতে চাইছেন না কেন? ” কাতর গলায় জিজ্ঞেস করল কুহু।
” আমি কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেইনি, বউ। আমি শুধুমাত্র আমার বউকে রেখে যেতে চাইনা জন্যই দেশে থাকতে চাচ্ছি। ” কুহুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল তাহমিদ।
” মা বলেছিলেন, ছোটবেলা থেকেই আপনার স্বপ্ন ছিল স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার। আজ যখন সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে, আপনি বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, তখন কেন যেতে চাইছেন না? এমন সুযোগ বারবার আসেনা। সুযোগটা আপনি হেলায় হারাবেন না। ”
” তোমাকে ছেড়ে ইউকে কেন , ঢাকার বাহিরে গিয়ে একদিনের জন্যও আমার থাকা সম্ভব নয়। এজন্যই আমি ইউকে থেকে ফিরে এসে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিছু মানুষের জন্য সেটা সম্ভব হলোনা। তারা আমার কাছ থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিতে উদগ্রীব হয়ে গিয়েছিল। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” শুধুমাত্র আমার জন্য আপনি নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দেবেন! এটা আমি হতে দেবোনা। আপনি ইউকে যান। বাড়ির সকলেই চান আপনি বিদেশ থেকে পড়ে দেশে এসে গরীব-দুঃখীদের সেবা করুন। তাদেরকে আপনি নিরাশ করবেননা। ”
” বিদেশে না পড়েও গরীব-দুঃখীদের সেবা করা যায়। আমি প্রতি শুক্রবার গরীব-দুঃখীদের বিনা টাকায় চিকিৎসা করব। তাদের ঔষধ থেকে শুরু করে অপারেশনও করাবো নিজ খরচে। এবং এটা আমি আজীবন করব। ”
” আপনি সত্যিই ইউকে যেতে চান না? ”
” তোমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাইনা। পেশার খাতিরে যদি ঢাকার বাহিরে কোথাও গিয়ে রাত কাটাতে হয়, সেখানেও তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। শুধুমাত্র ওর জন্য মানুষটা ইউকে যাবেনা এটা ভাবলেই নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। এমন কেন মানুষটা? তবে কুহু হাল ছাড়তে চাইলনা। কিছু বলার জন্য মুখ খুলল। তবে তার আগেই তাহমিদের মজবুত বাঁধনে আটকা পরল। ওকে কথা বলার সুযোগ দিলনা তাহমিদ। ব্যস্ত হয়ে পরল তার নারীকে নিয়ে।
” মা, আপনার কি শরীর খারাপ? আপনাকে এন মনমরা লাগছে কেন? সকাল থেকেই দেখছি চুপচাপ আছেন। ” কুহুর ডাকে চমকে পেছনে তাকালেন তাহমিনা আক্তার। চোখের পানি মুছে হাসার চেষ্টা করলেন।
” আয়, আমার কাছে এস বস। তাহমিদ কোথায়? ” তাহমিনা আক্তার প্রসঙ্গ পাল্টাতেই কুহুকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
” বন্ধুর ফোন পেয়ে উনি বাহিরে গেছেন। এবার বলুন আপনার কি হয়েছে? সকাল থেকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু আপনি একবারও উত্তর দেননি। এখন আবার রুমে বসে কাঁদছেন। আপনাকে কাঁদতে দেখলে আপনার ছেলে, বাবা কতটা কষ্ট পাবে জানেননা? আপনার মুখ ভার দেখলে আমারও কষ্ট হয়। মাকে হারিয়ে আপনাকে পেয়েছি মা হিসেবে। সেই আপনিই যদি আমার কাছ থেকে নিজের কষ্ট লুকাতে চান, তবে আমার খারাপ লাগবে , মা। ” কুহু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল।
কুহুর কথা শুনে তাহমিনা আক্তার চমকে উঠলেন। এই মেয়েটা যে তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে সেটা বুঝতে পারেন তিনি। বাসায় থাকলে মেয়েটা তার আশেপাশেই থাকবে, এটাসেটা করে দেবে, গল্প করবে । এগুলো ভালোই লাগে তাহমিনা আক্তারের। আর এজন্যই বোধকরি কুহুকে সত্যিটা বলতে বাধ্য হলেন। তিনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন,
” কত বছর হয়ে গেছে বড় আপাকে দেখিনা। তুলিটার কোন খবর পাইনা। অসুস্থ মেয়েটা কেমন আছে জানিনা। বড় আপাই আমাকে কোলেপিঠে করে বড় করেছে। এমনও দিন গেছে, আপা নিজের খাবার আমাকে খাইয়েছে। আজ সেই আপার সঙ্গে আমার যোজন যোজন দূরত্ব। আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আপা। এই দুনিয়ায় আপাই আমার একমাত্র আপনজন ছিল। অথচ আমার কুলাঙ্গার ছেলের ভুলে সেই আপা আমাকে পর করে দিয়েছে। ” কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তাহমিনা আক্তার।
কুহু দু হাতে আগলে নিল তাহমিনা আক্তারকে। আলতো হাতে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
” কাঁদবেন না, মা। অনেক বছর যখন ধৈর্য ধরেছেন, আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ আপনাকে নিরাশ করবেন না। দেখবেন একদিন ভাইয়াও নিজের ভুল বুঝতে পারবে। ভাইয়া ফিরে আসবে আপনাদের কাছে। মা, আমরা সন্তানরা সব সময়ই নিজেদের বুদ্ধিমান মনে করি। বাবা-মা যে সন্তানের ভালো চায়, সেটা আমরা বুঝতে পারিনা। কিন্তু একটা সময় ঠিকই বুঝতে পারি আমরা ভুল ছিলাম। দেরি হলেও স্বীকার করতে বাধ্য হই , বাবা-মা সন্তানের ভালোর জন্যই নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। ভাইয়াও বুঝবে সে ভুল ছিল। তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। একদিন দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি যেমনট চেয়েছিলেন তেমনটাই ঘটবে। ”
তাহমিনা আক্তার মলিন হেসে তাকালেন কুহুর দিকে। এই মেয়েটাকে তিনি যতই দেখেন, ততই অবাক হন। একটুকু মেয়ের মাঝে ধৈর্য, সততা, সহনশীলতা আর নিষ্ঠা দেখে তিনি সত্যিই প্রতিবারেই অভিভূত হন।
” তোর কথাই যেন ঠিক হয় রে , মা। তোর মুখে আশার বানী শুনে এখন আমার নিজেরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
” এবার তাহলে মন খুলে হাসুন। আর আমাকে কথা দিন , আর কখনোই মন খারাপ করে থাকবেন না। ”
কুহুর কথায় সত্যি হেসে ফেললেন তাহমিনা আক্তার। তিনি কুহুর কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
” কথা দিলাম আমার, মা। আর কোনদিনই মন খারাপ করে থাকব না। ”
” এবার তাহলে চলুন রান্নাঘরে যাই। আপনি শুধু আমাকে বলে দিন রাতে কি রান্না হবে। আমি রান্না করব আপনি দেখবেন। ”
” তোকে রান্না করতে হবে না। আমিই সব রান্না করব। তুই বসে বসে দেখবি আমি কিভাবে রান্না করি। ”
” আগে তো রান্নাঘরে চলুন, পরে দেখা যাবে কে রান্না করবে। ” কুহু শ্বাশুড়িকে নিয়ে রান্নাঘরে গেল।
” কুহু , একবার আমার রুমে আসবি? ” রান্না শেষ করে রুমে আসতেই রাখী আক্তার কুহুর রুমে এসে বললেন।
রাখী আক্তারের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হলো কুহুর। এই কয়দিনে বড়মার চেহারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। বড়মা ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করেনা, রুম থেকে বের হয়না। এই কয়দিনে বড়মা হাসতে ভুলে গেছে।
” তুমি আগে এখানে এসে বস, বড়মা। মা কাবাব বানিয়েছে। আমার জন্য আলাদা করে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি দুইটা কাবাব খেয়ে আমাকে বল, কেমন খেতে হয়েছে। ” কুহু ইচ্ছে করেই রাখী আক্তারকে রুমে ডাকল।
” আমাকে রুমে দেখলে তাহমিদ রেগে যাবে। ওর যা রাগ। ছোটবেলা থেকেই ওর রাগকে ভয় পায় সকলে। তুই-ই আমার রুমে আয়। তোর চাচা বাহিরে গেছে। ও আসার আগেই তোর সঙ্গে কিছু কথা বলব। ”
কুহু কথা না বাড়িয়ে রাখী আক্তারের সঙ্গে তার রুমে গেল।
” কি বলবে , বড়মা? ”
” কুহু রে, আমাকে মাফ করে দিস, মা। তোদের সঙ্গে অন্যায় করেছি আমি। তোদেরকে অপমান করেছি , সকলের সামনে ছোট করেছি, কষ্ট দিয়েছি। সবকিছুর জন্যই তোর কাছে ক্ষমা চাইছি আমি। আমার অপরাধের বোঝা ভারী হয়ে গেছে। সেজন্যই আজ সকলে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তোদের কাছে ক্ষমা চেয়ে অপরাধের বোঝা হালকা করতে চাই। ” কুহুর হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পরল রাখী আক্তার।
” এভাবে বলতে নেই, বড়মা। তুমি আমার মাতৃসমা। মা হয়ে সন্তানের কাছে কেন ক্ষমা চাইবে তুমি! যেই তুমি আমরা ভুল করলে তুমি শাসন করবে। আমাদের আদর করে বুকে টেনে নেবে। সেই তুমি কেন ক্ষমা চাইবে? তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ এটাই আমাদের কাছে অনেক কিছু। তুমি আর এভাবে চুপচাপ থেকো না। তোমাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগেনা। তুমি গিয়ে বড়মা, মা, চাচী, দিদুন সবার সঙ্গে সময় কাটাও। দেখবে তোমারও ভালো লাগবে। ”
” তুই সত্যিই অসাধারণ একটা মেয়ে, কুহু। তোর মত মেয়ের জন্ম দিতে সবাই পারেনা। আইরিন নিজেও অসাধারণ ছিল বলে, তোর মত অসাধারণ মেয়েকে জন্ম দিতে পেরেছে। জানিনা, আমার দোয়া কাজে লাগবে কি না। তবুও তোকে দোয়া করছি , তুই সুখী হবি। দুনিয়ার সকল সুখ তোকে এনে দেবে তাহমিদ। এই বাড়ির সকলেই তোকে মাথায় তুলে রাখবে। তুই হবি এই পরিবারের মধ্যমণি। তোর ছোঁয়ায় এই বাড়িটা দুনিয়ার বুকেই এক খণ্ড স্বর্গে পরিনত হবে। সারাজীবন এমনই থাকিস, মা। ”
বড়মার কথাগুলো শুনে খুশিতে কুহু কেঁদে ফেলল। এমন বড়মাকেই তো ওরা সব সময় চেয়ে এসেছে।
” আচ্ছা, তুমি এত পাষাণ কেন? তুমি এতটা শক্ত মনের মানুষ, সেটা আমি আগে জানলে তোমার সঙ্গে বিয়েতে রাজি হতাম না। ”
দৃষ্টির রাগী গলার স্বর শুনে নিহান ওর দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল।
” কি ব্যাপার কোন কারন ছাড়াই আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিস কেন? আমি আমার কি করলাম! ”
” দুইমাস হচ্ছে চাচাকে দেখিনা। চাচা সেই যে ঢাকা থেকে গেছে, তারপর আর তুমি নাটোর যাওনি ৷ আমার কি সেখানে যেতে ইচ্ছে করে না? ”
” ঘটনা কি? বাড়িতে যাওয়ার জন্য এমন উতলা হচ্ছিস কেন? ”
” আমার শ্বশুর বাড়িতে আমি যেতে চাইছি এখানেও ঘটনা জানতে চাচ্ছ তুমি! স্বীকার করতেই হবে তুমি একখান চিড়িয়া। সব কিছুতেই সন্দেহ করার প্রবনতা তোমার মধ্যে ব্যাপকহারে টের পাচ্ছি। লাভ নেই। আমাকে অযথা সন্দেহ নিজের বিপদ ডেকে এনো না বলে দিচ্ছি। আমাকে কবে বাড়িতে নিয়ে যাবে সেটা বল? ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৮
” আগামী পঁচিশ দিনের মধ্যে ছুটি নিতে পারব না। তাই বাড়িতে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে লাভ নেই। ”
” পঁচিশ দিন মাই ফুট। আমি আগামী শুক্রবার সকালেই শ্বশুর বাড়িতে থাকতে চাই। তুমি না নিয়ে গেলে আমি একাই বাড়িতে চলে যাব। আর একবার বাড়িতে গেলে আমাকে দুই বছরের আগে নিয়ে আসতে পারবে না, তার গ্যারান্টি আমি দিতে পারি। ”
দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে নিহান প্রমাদ গুনল। দৃষ্টির মুখ দেখেই নিহান বুঝে গেছে এই মেয়েটা ওকে মিথ্যা হুমকি দিচ্ছেনা।