সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪০

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪০
জাওয়াদ জামী

” কোকিলা রে, তাড়াতাড়ি আমার জন্য শরবত নিয়ে আয়। বোনের শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি অথচ এ বাড়ির কেউই আমার দিকে নজর দিচ্ছেনা। বাড়ির বউয়ের ভাই বলেই বোধহয় আমার কোন সম্মান নেই এই বাড়িতে। অথচ আমি খালি হাতে বোনের বাড়িতে বেড়াতে আসিনি। এই বাড়ির প্রত্যেক আণ্ডাবাচ্চার জন্য চকলেট, চিপস এনেছি। নিজের জন্যও কিনেছি কতগুলো। এসব কিনতে গিয়ে আমার কতগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল ৷ কিন্তু তোর বাড়ির লোকজন এখন পর্যন্ত আমাকে আপ্যায়ন করলনা। ” রাশেদীন বাড়িতে ঢুকেই হম্বিতম্বি শুরু করল আনান।
আনানের ভাবভঙ্গি দেখে সকলেই মিটিমিটি হাসছেন। কুহুও হাসছে। ও এসে আনানের কাছে দাঁড়ালো।

” এদিকে এসে বস, বউমার বড় ভাই । আপনার জন্য শরবত, পায়েস, কেক, কাস্টার্ড এনেছি। এগুলো খেয়ে নিজেও ধন্য হও, আমাদেরও ধন্য কর। ” আফরোজা নাজনীন ট্রে ভর্তি খাবার এনে টেবিলে রেখে বললেন।
” সত্যিই রে কোকিলা, তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন এতটাও খারাপ নয়। এরা গুণী মানুষের কদর করতে জানে। কত নাস্তা দিয়েছে তোর শ্বাশুড়ি। এগুলো শেষ করতেই আমার একমাস লেগে যাবে। এমন শ্বাশুড়ি হাজার বছর বেঁচে থাকুক। ” বড় মামীকে খাবার আনতে দেখে আনান দাঁত কেলিয়ে বলল।
” এতদিন এসে মামীদের পেছনে ঘুরঘুর করেছিস আর যেই বোনকে তাহমিদের সঙ্গে বিয়ে দিলি, তখনই আমরা বোনের শ্বশুর বাড়ির লোকজন হয়ে গেলাম? তুই তো সুবিধার মানুষ নয়, আনান। খেতে দিলেই আত্নীয় ভালো, নয়তো খারাপ! আজ থেকে আমাদের মামী বলে ডাকবিনা। বোনের শ্বাশুড়ি বলেই ডাকবি। ” নাজমা আক্তার কৃত্রিম রাগ নিয়ে বললেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” যথাজ্ঞা, খালাম্মা। আজ থেকে তোমরা আমার খালাম্মা নট মামী। এই যে খালাম্মা, তোমাদের ছেলের বউয়ের ভাই এসেছে। তোমরা এবার তাকে নিয়ে ব্যস্ত হও। তার পছন্দের খাবার রান্না কর। তোমরা…. । ”
” এই যে বেয়াই, তুমি কি শুধুমাত্র বাচ্চাদের জন্যই চকলেট-চিপস এনেছ? বড়দের জন্য কিছু আনোনি? ফল-মিষ্টি এসব এনেছ? বোনের বাড়িতে আসতে গেলে নানানরকম জিনিসপত্র আনতে হয়, সেটা তোমার জানা আছে তো? কই দেখি আমাদের ফল-মিষ্টি কোথায়? ” আনানের কথা শেষ হওয়ার আগেই সিক্তা এসে ওকে জিজ্ঞেস করল।
” চুপ থাক, ফাজিল মেয়ে। আমি কি এনেছি সেটা কি তোকে দেখাতে হবে? মধুর সুরে বেয়াই ডেকে আমার পকেট ফাঁকা করার ধান্দায় আছিস? আমি ছাত্র মানুষ টাকা খরচ করে ফল-মিষ্টি কেন আনতে যাব? শ্বশুর বাড়িতে এসেছি নাকি যে ফল-মিষ্টি বাধ্যতামূলকভাবেই আনতে হবে? আমি এসেছি বোনের শ্বশুর বাড়িতে। নিজের শ্বশুর বাড়িতে আসিনি। আর আমি শ্বশুর বাড়িতে খালি হাতে যাওয়ার মানুষ নই। ” আনান ধমকে থামিয়ে দিল সিক্তাকে। ধমক খেয়ে সিক্তা চোখ পাকিয়ে তাকাল আনানের দিকে।

” বড় ভাবী, আমাদের কুহুর ভাই দেখছি নিজেরটা ভালোই বোঝে। শ্বশুর বাড়িতে ঠাটবাট নিয়েই যেতে চাচ্ছে কিন্তু বোনের বাড়িতে এসেছে কয়েকটা চকলেট আর চিপস নিয়ে। এই আত্নীয়কে নিয়ে কি করা যায় বলেন তো? এই আত্নীয় যে সুবিধাবাদী এটা বোঝাই যাচ্ছে। ” এবার নাজমা আক্তার তার বড় জা কে বললেন।
” বাদ দে নাজমা, ছেলেটাকে আর ভয় দেখাস না। ও তো সত্যিই বলেছে। স্টুডেন্ট মানুষ এর থেকে বেশি আর কি আনবে। ওকে তোরা খেতে দে। আনান, তুই বোধহয় সকাল থেকে না খেয়ে আছিস? তোকে কতবার বললাম, আমাদের বাসায় এসে থাক। কিন্তু তুই আমাদের কোন কথাই শুনিস না। আমাদের বাসায় থাকিস না ভালো কথা। নিহানের কাছে গিয়ে থাকিস না কেন? দুই ভাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকবি। এতে আমরা সবাই নিশ্চিন্ত থাকব। তুই হোস্টেলে একা একা থাকছিস এটা নিয়ে নিহান সারাক্ষণই চিন্তিত থাকে। তুই ওর কাছে গিয়ে থাকলে ছেলেটা নিশ্চিন্তে চাকরি করতে পারে। ”

” বড়রা সব সময় ছোটদের নিয়ে চিন্তা করবে, এটাই স্বাভাবিক, মামী। আর রইল আমার আপনজনদের কথা। তাদের মত ভালো মানুষ আমি কমই দেখেছি। কিন্তু মামী, আমার তোমাদের বাসায় মাঝেমধ্যে আসতেই বেশি ভালো লাগে। এখানে সবসময়ের জন্য থাকলে সেই ভালো লাগা বঞ্চিত হব আমি। মাঝেমধ্যে এসে তোমাদেরকে বিরক্ত করতে ভালো লাগে আমার। আর পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেটাই করতে চাই আমি। আবার ভাইয়ার কথাই ধর, সে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে। তাই আপাতত ভাইয়াকে বিরক্ত করতে চাচ্ছিনা। আর দৃষ্টিও এখন ছোট। আমি ওদের সঙ্গে থাকলেই দৃষ্টির কাজ বেড়ে যাবে। আমি চাইনা ওর সংসার জীবন শুরু হওয়ার আগেই সংসারের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করুক। ও একটু বড় হোক, বুঝতে শিখুক তারপর ওদের বাসায় গিয়ে থাকব। ”
আফরোজা নাজনীন আনানের কথা শুনে অভিভূত হলেন। তিনি কখনোই ভাবেননি আনানের চিন্তাভাবনা এতটা গভীর। এই আনানকে দেখলে কে বলবে, এই ছেলেটাও এতকিছু চিন্তা করতে পারে! মৃদু হেসে আফরোজা নাজনীন গিয়ে বসলেন আনানের পাশে। বিষন্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

” রাখী কেমন আছে? আজকে ওর সঙ্গে কথা বলেছিলি? ”
” আব্বুর খবর জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব, মামী। আম্মুর কোন খবর রাখিনা। ”
” আমরা না হয় আম্মার কথা রাখতে গিয়ে রাখীর সঙ্গে যোগাযোগ করি না। কিন্তু তুই কেন পাগলামি করছিস, আনান? রাখী তোর মা। যা কিছু হয়ে যাক না কেন, ওর সঙ্গে তোকে কথা বলতেই হবে। নিহানও রাখীর ওপর রাগ করে আছে, আবার তুইও যদি ওর সঙ্গে কথা না বলিস, তবে যে রাখী ভিষণ কষ্ট পাবে। পাবে বলছি কেন? ও কষ্ট পাচ্ছে। সন্তানরা মায়ের সঙ্গে কথা না বললে মায়েদের কি যে ভিষণ কষ্ট হয়, সেটা একমাত্র মা-ই জানে। আজকেই তুই রাখীর সঙ্গে কথা বলবি। ”

” শুধুমাত্র তোমার কথা রাখতেই আম্মুর সঙ্গে কথা বলব আমি। আম্মুর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে আমার মরে গেছে। তোমরা যেমন আম্মুকে শোধরাতে চাও। ঠিক তেমনি আমিও চাই আম্মু শুধরে যাক। নিজের মায়ের দিকে কেউ আঙুল তুলে কথা বলছে, এটা একটা সন্তানের জন্য কতটা লজ্জার সেটা বোধহয় তুমি জানোনা, মামী। ছোট থেকে আজ পর্যন্ত আম্মুকে নিয়ে কোথাও ভালো কথা শুনিনি। কেউ কখনোই বলেনি, আমার আম্মু ভালো মানুষ। এটা যে কতটা কষ্টের সেটা যদি তোমাকে বোঝাতে পারতাম মামী, তবে আমার কষ্ট একটু কমতো। ”
” আনান, তুই এভাবে কথা বলছিস, বাবা? অথচ আমরা সবাই জানতাম, কখনোই কোন দুঃখ তোকে ছুঁতে পারে না। আর সেই তুইই যদি এভাবে ভেঙে পরিস, তাহলে আমরা যে কষ্ট পাবো। আমাদের মনে হবে, শুধুমাত্র আমাদের জন্যই তুই কষ্ট পাচ্ছিস। আম্মাও কষ্ট পাবেন। সবকিছুর জন্য নিজেকে দোষী মনে করবেন তিনি। ”

আফরোজা নাজনীনের কথা শেষ হতে না হতেই আনান স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
” কে বলেছে আমার মন খারাপ? আমি কষ্ট পাচ্ছি? একবার তার নাম বল। আমি তাকে চটকানা দেব। আমাকে তো চেনোনা। আমি কি করতে পারি সেটাও জানো না। ”
” কি করত পারো তুমি? ” সিক্তা জিজ্ঞেস করল।
” কি আবার পারব! কেউ কিছু বললে জুস খেতে খেতে বাসায় আসব। আমি সবাইকে দেখিয়ে দেব, জুস আমার কতটা প্রিয়। ”
আনানের কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সিক্তা। আনান আঁড়চোখে তাকাল সিক্তার দিকে। এই মেয়েটাকে দেখলে ওর সকল কষ্ট নিমেষেই উবে যায়। ওর ভালো থাকার কারনই , সিক্তা।

” ভাইয়া , আজকে কিন্তু তুমি হোস্টেলে যেতে পারবেনা। আমি যেতে দেবোনা। ” অনেকক্ষণ পর কুহু কথা বলল।
” বিয়ে হতে না হতেই তুই আমাকে আদেশ করছিস , কোকিলা! একটাবারও ভাবলি না, তোর আদেশ শুনলে আমার বুকে ব্যথা করতে পারে! এই তোর ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা? প্রয়োজন নেই আমার এমন ভালোবাসার। আমি হোস্টেলেই ভালো আছি। থাকতে হবে না আমাকে এখানে। আমার কাছে হোস্টেলের ডাল বিহীন পাতলা ডাল, পঁচা আলুর তরকারি এসবই পারফেক্ট আছে। এসবের স্বাদ যদি তুই জানতি তবে আমাকে এখানে থাকতে বলতিস না। তোর শ্বাশুড়িরা আমাদের হোস্টেলের রাঁধুনির মত কোনদিনই রান্না করতে পারবেনা। তাই ইনাদের হাতের পঁচা রান্না আমি খেয়ে জিভের স্বাদ নষ্ট করতে চাই না। ”

আনানের কথা শুনে হেসে উঠল সিক্তা। কিন্তু কুহু হাসল না। ও বুঝতে পারছে, আনান আজ এখানে থাকবেনা বলেই এমন উদ্ভট বাহানা দিচ্ছে । তাই কুহু গোমড়ামুখে বলল,
” তালবাহানা করে লাভ হবে না, ভাইয়া। যতই বাহানা করো না কেন, আজকে তোমাকে এখানে থাকতেই হবে। তোমার ভাইও বলে গেছে, তোমাকে যেন আজকে যেতে না দেই। ”
” ভাই কি করে জানল, আজ আমি এখানে আসব? আমি তো ভাইকে কিছুই জানাইনি। ”
” সে আমি কিভাবে বলব। ”

” এই কোকিলা, ভাই কি আজকাল হাওয়ার মাধ্যমে খবর পাচ্ছে? বিষয়টা কিন্তু চিন্তার। আমি তাকে না জানাতেই সে বুঝতে পারল, আজ আমি আসব। একবার চিন্তা করে দেখ, ভাইয়ের সামনে বসে তাকে মনে মনে গালি দিচ্ছি আর সেটা ভাই বুঝতে পারল। তখন সেই হিটলার আমার কি অবস্থা করবে? না বাবা আজ এখানে থেকে আমার কাজ নেই। আমি বরং আরেকদিন আসব। ”
” আজ এমন পালাই পালাই করছিস কেন রে, আনান? তুই যেতে চাইলেই কি আমরা তোকে যেতে দেব? কুহু মা যখন একবার বলেছে তোকে যেতে দেবেনা, তখন আমরা তোকে যেতে দিলে তো। ”
আনান বুঝল বাহানা করে লাভ হবে না। যেতে না পারার দুঃখে মুখ কাঁচুমাচু করে বসে থাকল।

” কি রে তুই নাকি হোস্টেলে যাওয়ার জন্য উতলা হচ্ছিস? ” তাহমিদ আনানের পাশে বসে জিজ্ঞেস করল।
” উতলা হয়ে কি লাভ আছে , ভাই ? তোমার বউ যখন বলেছে, আমাকে যেতে দেবেনা, তখন আমার কি আর সাধ্য আছে এখান থেকে যাওয়ার! ”
” হোস্টেলে যেতে না পারার দুঃখে মুখ অন্ধকার করে বসে আছিস বুঝি? অবশ্য আজকে বোধহয় অন্য কোন প্ল্যান ছিল তোদের। হোস্টেলে না গিয়ে কোন রিসোর্টে যেতিস। সেখানেই বন্ধুবান্ধবরা মিলে হৈ-হুল্লোড় করতিস তাই-না? ” তাহমিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে আনানের দিকে।
তাহমিদের কথা শুনে আনান ওর দিকে চমকে তাকায়। ওর চোখ দুটো রসগোল্লার আকার ধারণ করেছে৷
” ত..তুমি কিভাবে জানলে , ভাই? আমরা কয়েকজন ছাড়া কথাটা আর কেউই জানেনা। ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৯

” তুই কখন কোথায় যাস, কি করিস সবই আমি জানি। কান খুলে শুনে রাখ , সম্প্রতি যে প্ল্যান করেছিলি এটাই যেন প্রথম এবং শেষ প্ল্যান হয়। বন্ধুদের সঙ্গে হোস্টেলে যা করিস কর, কেউ তোকে বাঁধা দেবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি এমন প্ল্যান করিস, তবে তোর পড়াশোনা বন্ধ করার ব্যবস্থা আমি করব। আমি, নিহান আমরা কখনোই এমন দুঃসাহস দেখাতে পারিনি। যারা একটু বখাটে ছিল তাদের সঙ্গে মিশিনি। আর তুই দিব্যি নেশাখোরদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিস। আজকের প্রথম এবং শেষবার তোকে সাবধান করে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে যদি দেখি তুই ঐসব বখাটেদের সঙ্গে মিশছিস , তবে আমি ভুলে যাব তুই আমার ভাই। ”
তাহমিদের কথা শুনে আনান চুপসে গেল। ভাই কি করে এতকিছু জানল সেটা ভেবেই ওর ঘাম ছুটছে।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪১