সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৬
জাওয়াদ জামী
” বাপ , আজকে সিক্তার বিয়ে অথচ কুহু নেই, তুই ওকে বাড়িতে নিয়ে আসছিস না, এটা কি ঠিক করছিস তুই ? বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, অথচ বাড়ির বউ বাড়িতে নেই , এটা কি দৃষ্টিকটু নয় ? মেয়েটার কি আনন্দ করার অধিকার নেই? ” আফরোজা নাজনীনের গলায় স্পষ্ট অসন্তোষ লক্ষ্য করল তাহমিদ।
তাহমিদ বড়মার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। সকাল থেকেই বড়মার মধ্যে চাপা অস্থিরতা দেখেছে সে। আর সেটারই বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছে এখন। তাহমিদ হেসে দুই হাতে বড়মাকে জড়িয়ে ধরল। বড়মার কাঁধে থুতনি রেখে বলল ,
” তোমাদের বাড়ির বউ সময় হলেই চলে আসবে , বড়মা। সে-ও বাসায় আসার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। তোমাদের ছাড়া সে নাকি আর থাকতে পারছে না। ”
” তো নিয়ে আয় ওকে। দেরি করছিস কেন? এই যে বিয়ে বাড়িতে এত কাজ, আমরা হাঁপিয়ে যাচ্ছি। এই সময় মেয়েটা থাকলে কত ভালো হতো বলতো? ও আমাদের হাতে হাতে কাজ করে দিতে পারত। সিক্তার পাশেও তো কাউকে থাকতে হবে নাকি? আর দুই ঘন্টা পরই বরযাত্রী আসবে। আর তুই এখন বলছিস, কুহু বাড়িতে আসার জন্য অস্থির হয়ে গেছে? ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” চলে আসবে, বড়মা। তুমি এত অস্থির হচ্ছ কেন? একটু শান্ত হয়ে বস তো। ”
” কিভাবে শান্ত হব, তুইই বল? এতদিন আমি কুহুকে নিয়ে আসবার বিষয়ে কিছুই বলিনি। এমনকি ওকে কোথায় রেখে এসেছিস সেটাও জিজ্ঞেস করিনি। কারন আমি জানি, তুই কারন ছাড়া কোন কাজ করিস না। গতকাল অথবা আজও কিন্তু তোকে বলতাম না, কুহুকে নিয়ে আয়। যদি না সিক্তার বিয়ে হত আজ। ”
বড়মা যে রাগ করেছে এটা বুঝতে পারছে তাহমিদ। অবশ্য রাগ করারই কথা। বড়মার কাছে এই সংসার , এই সংসারের মানুষগুলোই সব । এদের প্রত্যেককেই বড়মা প্রান দিয়ে ভালোবাসে। তাই কাউকে রেখে নিজের মেয়ের বিয়ে দেয়ার কথা চিন্তাই করতে পারছে না সে।
” বললাম তো কুহু চলে আসবে। সেটা সিক্তর বিয়ের আগেই। আজকের দিনে ও সিক্তার পাশে থাকবে না, এটা হতেই পারে না, বড়মা। আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসব। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের অপেক্ষার অবসান ঘটবে। ততক্ষণ হাসিখুশি থাক। তোমার গোমড়ামুখ দেখে আমরা অভ্যস্ত নই। ” তাহমিদ বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
আফরোজা নাজনীন চেপে রাখা শ্বাস ছাড়লেন পরম স্বস্তিতে। কারন তিনি জানেন , তাহমিদ ওর কথা রাখবে। ও যখন বলেছে , আজ কুহু ফিরবে, তার মানে আজ কুহুকে ফিরতেই হবে।
” মেজো বউমা , কুহু সোনা কি আজ আসবে না? সিক্ত দিদিভাইয়ের বিয়েতে কুহু সোনা থাকতে পারবে না? আজকের এই আনন্দের দিনে কুহু সোনা বাড়িতে নেই সেটা ভাবলেই আমার বুকটা হু হু করে উঠছে। ” আয়েশা সালেহা চোখের পানি মুছে বললেন।
” আমি কিচ্ছু জানি না , আম্মা। এসব আমার একদমই ভালো লাগছে না। বড় ভাই বারবার কুহুর কথা জিজ্ঞেস করছে। এদিকে আমার ছেলে মুখে কুলুপ এঁটেছে। ” তাহমিনা আক্তারের মন হতাশায় ছেয়ে গেছে।
” দাদু ভাই কারন ছাড়া কোন কাজ করে না, এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আজকের দিনেও যে ও কুহুকে নিয়ে আসবে না , এটা মানতে পারছি না। তুমি একটু দাদু ভাইকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে, বউমা? ওকে একবার বলে দেখি। ”
” তাকে আর কোথায় পাচ্ছি , আম্মা! সে অনেক আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। জানি না কখন আসবে। চিরটাকাল ই এই ছেলেটা বিভিন্ন বিষয়ে ত্যাড়ামো করে এসেছে। এই সময় অন্তত এমনটা না করলেও পারত। ”
” রাগ করো না , বউমা। শেষ পর্যন্ত দেখো কি হয়। ”
” সেটাই মা। দেখা ছাড়া আর করতেই বা পারি আমি। ”
আয়েশা সালেহা তাকালেন তাহমিনা আক্তারের দিকে। মেজো বউমার চোখে পানি দেখে তিনি নিরবে কেঁদে উঠলেন।
” বড় ভাবী , আপনি এখানে বসে আছেন যে? মন খারাপ আপনার? সিক্তার কথা ভাবছেন? চিন্তা করবেন না , রাখী আর যাই হোক না কেন সিক্তার সঙ্গে ভালো আচরণই করবে। ও মানুষ হিসেবে যেমনই হোক না কেন , নিজের ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের কিন্তু খুবই ভালোবাসে। আর তাছাড়া সিক্তাকে কিছু বলার সাহস ওর কোনকালেই হবে না। ও জানে, ওর বোকামির কারনে ভবিষ্যতে কি হতে পারে। ” আফরোজা নাজনীনকে গেষ্টরুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কথাগুলো বললেন শাহনাজ পারভীন।
ছোট জায়ের কথা শুনে মলিন হাসলেন আফরোজা নাজনীন। সেই হাসি তার চোখ ছুঁতে পারল না। তিনি বিষন্ন গলায় বললেন ,
” আমি জানি , রাখী তার ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের কতটা ভালোবাসে। ও সিক্তাকে মাথায় তুলে রাখবে এটাও জানি। সেসব নিয়ে একটুও ভাবছি না আমি । আমি তো অন্য চিন্তা করছি। সিক্তা সংসারের কোন কাজই করতে পারে না। দৃষ্টিও তাই। দু’জনে মিলে সংসারের কাজ করতে গিয়ে না ঝামেলা পাকিয়ে ফেলে। দু’জনে কাজের থেকে অকাজ করবে বেশি। আবার ও সারাক্ষণ আনানের সঙ্গে ঝগড়া করে। দু’জনে যদি বিয়ের পরও এভাবে ঝগড়া করে, তবে আশেপাশের লোকজন কি বলবে? এসব নানান ধরনের চিন্তা আসছে মাথায় । ”
আফরোজা নাজনীনের কথা শুনে হেসে উঠলেন শাহনাজ পারভীন। হাসতে হাসতে বললেন,
” দু’টোতে জমবে ভালো। ওরা সারাক্ষণই ঝগড়া করবে। দৃষ্টিও ঠিক সিক্তারই মতই। সারাক্ষণই নিহানের সঙ্গে ঝগড়া করতেই থাকে। ওদের ঝগড়া শুনে প্রতিবেশিরা ওদের বাড়ির নাম, ঝগড়া বাড়ি ‘ দেবে। খারাপ হবে না বিষয়টা। এবার নিচে চলুন তো। অতিথিরা সবাই এসে গেছে। সবাইকে আপ্যায়ন করতে হবে। এই সময় কুহু থাকলে ভালো হতো। ও আবার এসব কাজ ভালো জানে। তাহমিদটা যে কেন ওকে নিয়ে আসছেনা সেটাই বুঝতে পারছি না। আজকের দিনে বাড়ির বউ বাড়িতে থাকবে না, এটা ভালো দেখায় না। ”
” জানি না রে, তাহমিদ যে কি করতে চায়, কেবলমাত্র সে-ই জানে। তবে বলল, আজকেই নিয়ে আসবে কুহুকে। দেখি কি করে। ”
দুই জা কথা বলতে বলতে নিচে গেলেন।
বাগানের একপাশে স্টেজ করা হয়েছে। সেখানেই স্বল্প পরিসরে সিক্তার গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানেই অতিথিদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাহমিদের কয়েকজন ফ্রেন্ড আর সিক্তার বন্ধুবান্ধব মিলে হলুদের অনুষ্ঠান তদারকি করছে। অতিথিদের আপ্যায়ন তারাই করছে। এছাড়াও তাহমিদের গ্রাম থেকে বেশকিছু আত্নীয় স্বজনরা এসেছেন। তারাও সকলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে।
আফরোজা নাজনীন ছোট জা’দের নিয়ে এসে দাঁড়ালেন স্টেজের সামনে। আত্নীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিসহ অনেকেই এসেছে। যাদেরকে ইনভাইট করা হয়েছে। আফরোজা নাজনীন ঘুরে ঘুরে দেখছেন সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কি না। এমন সময় গেট খোলার শব্দ আসলো তাদের কানে। তাহমিদের গাড়ি ঢুকছে।
আফরোজা নাজনীনসহ তার বাকি তিন জা ঘুরে তাকালো সেদিকে। গাড়ি পার্কিং না করে তাহমিদ গাড়িকে সোজা বাড়ির দিকে নিয়ে আসছে। এমনটা সচারাচর ঘটে না। কৌতুহলী হয়ে তিন জা এগিয়ে গেলেন বাড়ির দিকে। গিয়ে দাঁড়ালেন দরজার সামনে। তাহমিদ হঠাৎ গাড়ি থামিয়েছে। তারা দেখলেন দারোয়ান দৌড়ে আসছে। সে দৌড়ে এসে তাহমিদকে কিছু বলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে গেল। তাহমিদ আবারও গাড়ি নিয়ে এগোতে শুরু করেছে। কয়েক মুহূর্ত পরই গাড়ি এসে থামলো রাশেদীন ম্যানশনের সদর দরজার সামনে।
প্রথমেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো তাহমিদ। এরপর সে দরজা খুলে দিলে বেরিয়ে আসলো কুহু। কুহু বেরিয়েই দৌড়ে ওর শ্বাশুড়িদের কাছে আসলো। ওর চোখমুখ ঠিকরে বেরোচ্ছে খুশির আভা। খুশির চোটে কথাই বলতে পারলো না। ইশারায় সবাইকে গাড়ি দেখালো।
তাহমিদ কাউকে নামাচ্ছে গাড়ি থেকে। সকলেই কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকালেন। একটু পরেই তাহমিনা আক্তারের দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হলো। এ কাকে দেখছেন তিনি! দৌড়ে গেলেন গাড়ির কাছে। বড় বোনকে দেখে তিনি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। কেঁদে উঠলেন হাউমাউ করে।
” তাহমিদ , তুই আগে কেন আমাকে জানাসনি কুহুকে আপার কাছে রেখে এসেছিস? ” আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তাহমিনা আক্তার। তিনি কান্না থামাতেই পারছেন না।
” সবকিছু আগেই বলে দিলে আজকে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে পারতাম না , মা। আর জানতেই পারতাম না আমার মা এত কাঁদতে পারে। ” আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল তাহমিদের গলা।
” ফাজিল ছেলে, মায়ের সঙ্গে কেউ এমন মজা করে? ” তাহমিনা আক্তার আঁচলে চোখের পানি মুছলেন।
সকলের মতো আফরোজা নাজনীনও অবাক হয়ে গেছেন। তিনি তাকিয়ে আছেন তাহমিনার বড় বোন তাসলিমা খানমের দিকে। পাঁচ বছর আগের আর এখনকার তাসলিমা খানমের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। তিনি শুকিয়ে গেছেন। তার কথার মধ্য জড়তা লক্ষ্য করলেন আফরোজা নাজনীন। তাসলিমা খানমের পাশে বসে আছে তমা। মেয়েটার চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে লাগছে। ওর চোখের নিচে কালি পরেছে। গায়ের রং ও কমেছে আগের থেকে। অথচ একটা সময় এই মেয়েটাকে অনায়াসেই সুন্দরীদের কাতারে ফেলা যেত। আজ সেই মেয়েটাকে এমন রূপে দেখে কষ্ট হচ্ছে আফরোজা নাজনীনের। তবে ভালোও লাগছে তাদের সবাইকে এই বাড়িতে দেখে। তিনি তাহমিদকে জিজ্ঞেস করলেন,
” তুই কুহুকে তাসলিমা আপার বাসায় রেখে এসেছিলি, বাপ? কিভাবে করলি সেটা! ”
” সবই তোমাদের আদরের বউমার প্ল্যান। আমি শুধু ওকে খালামণির বাড়ির দরজা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলাম। তবে ওর প্ল্যান অনুযায়ী , খালামণির ডক্টরকে কিছু কথা শিখিয়ে দিয়েছিলাম। আর সেই ডক্টর ছিলেন আমার স্যারের স্টুডেন্ট। কুহুর প্ল্যান মত ওকে খালামণির নার্স হিসেবে নিয়োগ দিলেন খালু। এরপর যা করার কুহুই করেছে। ”
” তাহমিনা , তোর ছেলের বউ একটা রত্ন। গত দেড়মাসের সেবায় সে তোর আপাকে অর্ধেকের বেশি সুস্থ করে তুলেছ। তমাও আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়েছে শুধুমাত্র কুহুর জন্য। গত সাতদিন আগেও জানতাম না ও তাহমিদের বউ ৷ যখন জানলাম , তখন কৃতজ্ঞতায় আর তোদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারলাম না। এই মেয়েটার জন্যই তোর আপা এখন হাঁটতে পারে । তমা অনেকটাই স্বাভাবিক আচরণ করছে। আবার এই মেয়েটাই আমাদেরকে এখানে নিয়ে আসলো। ও আমাদের সবকিছুই বলেছে। ” তাসলিমা খানমের স্বামী জাহেদ আহমেদ কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।
দুলাভাইয়ের কথা শুনে চোখে পানি জমলো তাহমিনা আক্তারের। তিনি ধরা গলায় বললেন,
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৫
” ও আমার ছেলের বউ নয়। ও আমার মেয়ে। তাই ও মায়ের কষ্ট বুঝতে পেরেছে। আর সেজন্যই আমার কাছে আমার আপাকে নিয়ে এসেছে। ”
” মা, খালামণিরা জার্নি করে এসেছে। তাদেরকে রুমে নিয়ে যাও। কিছুক্ষণ রেষ্ট নিক সবাই। আগামীকাল সকালে তমা আপুকে ডক্টরের কাছে নিতে হবে। আপুর এই মুহূর্তে ঘুম দরকার। কুহু, তুমি আপুকে আমাদের পাশের রুমে নিয়ে যাও। মা, তুমি কয়েকটা দিন আপুর সঙ্গে থেকো। ”
তাহমিদের কথামত সবাইকে যার যার রুমে নিয়ে গেলেন আফরোজা নাজনীন আর তার তিন জা। আজকে সবাই খুশি। তাহমিনা আক্তার যে তার বোনকে ফিরে পেয়েছে , এটা তাদের কাছে কম পাওয়া নয়।