সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৮

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৮
জাওয়াদ জামী

” এই পাগলি , কাঁদছিস কেন ? তুই কি অপরিচিত কারোও বাসায় এসেছিস? এই বাসার সবাই তোর পরিচিত। আমাদের আপনজন এরা। আর তাছাড়া কালকে আমরা এসে তোকে দেখে যাব। তুই কাঁদছিস এ কথা যদি বড়মার কানে যায় , বড়মা কষ্ট পাবে জানিস না ? সিনিয়রও তোর জন্য কাঁদছে। তুই কি সবাইকে কাঁদাতে চাস? ”
তাহমিদের কথা শুনে কান্না থামিয়ে করুণ চোখ ওর দিকে তাকায় সিক্তা।
” বাড়ির সকলের জন্য মন কেমন করছে , ভাইয়া। তোমাদেরকে ছেড়ে আমি কিভাবে থাকব ? ” ফুঁপিয়ে উঠলো সিক্তা।

” এটাই বিধিলিপি। সংসারজীবন নারীদের জন্য পরীক্ষা ক্ষেত্র । বিধাতা নারীদের পদে পদে পরীক্ষা নেন। আর বিয়ে সেই পরীক্ষারই অংশ। মনে কর , আজকে তুই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিস। এরপর বাকি জীবন ধীরে ধীরে সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে। এই পরীক্ষা ক্ষেত্রে বারেবারে তোর পরিবারের সবার কথা মনে হবে , তাদের জন্য কাঁদবি। কিন্তু তারপরও কোনও এক ভালোবাসার টানে এখানেই থাকতে চাইবি। এটাই নারীজীবন। এই জীবনটাই নারীদের পরিপূর্ণতা এনে দেয়। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাহমিদের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে কুহু। মানুষটা কত সহজেই সিক্তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলো! সিক্তার কান্নাও থেমে গেছে। কুহু ভেবে পায় না , একটা মানুষ এত ভালো কিভাবে হয়?
” তবে ভাবিস না নারীরাই শুধু পরীক্ষা দেয়। এই পুরো দুনিয়াটাই পুরুষদের জন্য পরীক্ষা ক্ষেত্র। তাদের কাঁধে তোদের সংসার নামক পরীক্ষা ক্ষেত্রের ভার আজীবন রাজত্ব করে। পুরুষরা হাসিমুখে সেই ভার বহন করতে সদা প্রস্তুত থাকে। তাদেরকে একটু ভালোবাসা দিলেই , তারা নিজের জীবন দিতেও দুইবার ভাবে না। তাই এই জীবন নামক রঙ্গশালায় নারী-পুরুষকে একে অপরের পরিপূরক হতে হয়। তবেই সুখের দেখা মেলে। এবার শোন, আনান যদি কখনো তোকে কষ্ট দেয়, তবে সাথে সাথে আমাকে জানাবি। আমি এসে ওর পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবো। ” সিক্তাকে নিরব থাকতে দেখে আবারও কথা বলল তাহমিদ।
এতক্ষণ আনান ওদের দুই ভাইবোনের কথা শুনছিল। যেই ওর সম্পর্কে কথা বলল তাহমিদ, তখন সে-ও পাল্টা জবাব দিল।

” তোমাদের দু’জনের মধ্যে আবার আমাকে টানছো কেন! আমি নিষ্পাপ বাচ্চা কাউকে কষ্ট দিতে পারি না। এই যে কি সুন্দর করে বোঝাচ্ছিলে তোমার বোনকে। সেটাই করতে। সেটা না করে, আমার বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছ তোমার ঝগড়ুটে বোনকে! আমি কি কখনো আমার বোনকে তোমার বিরুদ্ধে উস্কাই ? তুইই বল কোকিলা , এটা কি ঠিক? ”
” মোটেও ঠিক না। আজকের পর থেকে তুমিও সিক্তার ভাইয়ার সঙ্গে ছোট বোনের জামাইয়ের মত ট্রিট করবে। তবেই সে পথে আসবে। ” কুহু আনানের পক্ষে কথা বলল।
” এই না হলে আমার বোন! এরপর থেকে তোর কথামতই কাজ করব। দেখব তোর হিটলার জামাইয়ের দৌড় কতদূর। ”

” ভুলেও এমনটা করতে যাস না । শেষে দেখবি হাত-পা বিহীন তুই রুমে শুয়ে-বসে ললিপপ খাচ্ছিস। তোর আদরের কোকিলাও তোকে বাঁচাতে পারবে না। আজ এতটুকুই থাক। পরে আবার এ্যান্টিডোজ দিয়ে দেবো। সিক্ত , যাই রে। কাল বিকেলের দিকে এসে তোকে দেখে যাব। ”
” বিকেলে কেন? সকালে আসলে কি হয়! সকালে দিদুন, মা, চাচীদের নিয়ে এসো। ”
” সকালে তমা আপুকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাব। খালামণিকেও নিতে হবে ডক্টরের কাছে। সকালে আমরা কেউই ফ্রি থাকব না। তাই বিকেলেই আসব। আসার সময় তোর পছন্দের খাবার নিয়ে আসব। ঠিক আছে? ”
” ঠিক আছে , ভাইয়া। তোমাদের অপেক্ষায় থাকব। ”
সিক্তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাহমিদ কুহুকে নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলো।

” আজ রাতটা ঐ বাসায় থাকলে কি হতো! আমি চলে আসায় সবাই মন খারাপ করেছে। ”
কুহুর অভিযোগ শুনে তাহমিদ কপাল কুঁচকে তাকাল কুহুর দিকে।
” গত দেড় মাস তোমাকে ছাড়া রাত কাটিয়েছি আমি। শুধুমাত্র তোমার জন্য। তুমি খালামণির বাসায় তোমাকে পাঠাতে বাধ্য করেছিলে আমাকে। তা-ও রাজি হয়েছিলাম মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে নয়তো আমি তাহমিদ বউ ছেড়ে একরাতও থাকবার মানুষ নই। তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না জন্য, ইংল্যান্ডে গেলাম না। আমার সেই বউ যখন দেড়মাস পর আমার বাসায় এসেছে তখন তাকে আরও একরাত বাহিরে রাখবার মত বোকামি করব না আমি। তাই মাথায় এসব আজেবাজে চিন্তা এনে মস্তিষ্ক ক্ষয় করো না। ”
কুহু বুঝলো এই ছেলের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। কি মনে করে যে সে কুহুকে খালমণির বাসায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল, সেটা আল্লাহই জানেন।

” বউয়ের কি মন খারাপ হয়ে গেল? চল কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। কোল্ড কফি খাইয়ে তোমার মুড ঠিক করে তবেই তোমাকে বাসায় নিয়ে যাব। নয়তো দেখা যাবে, রাতে দিদুনের কাছে ঘুমাতে চলে গেলে। তখন আমি অসহায় পুরুষকে বউ বিনা রাত কাটাতে হবে। ”
” কোথাও যাবো না আমি। আমাকে সোজা বাসায় নিয়ে চলুন। বাসায় গিয়ে সবার সঙ্গে বসে কফি খাব। অযথা রেস্টুরেন্টে গিয়ে টাকা খরচ করার দরকার নেই। টাকা খরচ করার জন্য হাত সব সময় নিশপিশ করে! ”
কুহুর সোজাসাপটা জবাব শুনে কাঁধ ঝাঁকিয়ে গাড়ি চালানোয় মন দিল তাহমিদ।

” তমাপু , এখনো জেগে আছ যে! খেয়েছো তুমি? ” তমাকে বসে থাকতে দেখে অবাক না হয়ে পারল না কুহু।
” ঘুম আসছে না। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। তুমি কি আমাকে ঘুম পারিয়ে দেবে? ” তমা ভাবলেশহীন গলায় জিজ্ঞেস করল।
” কেন দেবো না! অবশ্যই দেবো। তার আগে বলো, তুমি খেয়েছ? ঔষধ খেয়েছ? ”
” হুম । তোমার শ্বাশুড়ি আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে। ঔষধও খাইয়েছে। ”
তমার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কুহু। তমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর মাথার কাছে বসলো। হাত রাখলো তমার মাথায়।

” তমাপু , আমার শ্বাশুড়িকে চেনো না তুমি ? ছোটবেলার কথা মনে পরে না তোমার ? এই বাড়িটা তুমি চিনতে পারোনি ? এই বাড়ির মানুষগুলোকে চিনতে পারছো না তুমি ? ” কুহু মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল।
” জানো কুহু , আমার হঠাৎ হঠাৎই মনে হচ্ছে তোমার শ্বাশুড়িকে চিনি । এই বাড়িটাও যেন আমার পরিচিত। বাড়ির মানুষগুলোও তাই । কিন্তু মনে করতে পারছি না এদেরকে কবে দেখেছি। এরা সবাই কত্ত ভালো। কত্ত আদর করছে আমাকে। ”
” একটা গল্প শুনবে , তমাপু? ”
” শোনাও। ”

” এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজা দুই রাজপুত্র , রানি, পিতামাতা, ভাইবোন নিয়ে খুব সুখে ছিল। রানির আবার বড় এক বোন ছাড়া আর কেউ থেকেও ছিলো না । সেই বড় বোনে ছিল আরেক রাজ্যের রানি। তারও ছিল দুই রাজকন্যা আর এক রাজপুত্র। রানির তার বড় বোনের সঙ্গে খুব ভাব ছিল। সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে থাকত দুই বোন । একদিন ছোট বোন তার বোনের কাছে আবদার করল, বড় বোনের দ্বিতীয় রাজকন্যাকে সে নিজের বড় রাজপুত্রের জন্য নিতে চায়। রাজি হলো সবাই। সেদিন থেকেই সেই ছোট রাজকন্যার কি যে হয়ে গেল দিনরাত সেই রাজপুত্রের স্বপ্নে বিভোর থাকে। তাকে নিয়ে স্বপ্ন সাজায়। কল্পনার রাজ্যে ঘুরে বেড়ায়। রাজকন্যা মাঝেমধ্যেই রাজপুত্রের রাজ্যে বেড়াতে যেত। সেই রাজবাড়ীর প্রত্যেকেই রাজকন্যাকে ভিষন ভালোবাসতো। তেমনি রাজকন্যাও চোখে হারাতো রাজপুত্রকে। এদিকে রাজপুত্রও একটু একটু করে ঝুঁকে পরে রাজকন্যার দিকে। তাদের চোখর চোখে কথা হয়। একসময় মনও বিনিময় হলো।

এভাবেই কেটে যায় অনেকগুলো বছর ৷ একদিন রাজপুত্র বানিজ্য করতে গেল ভীনদেশে। রাজকন্যা স্বপ্ন সাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল তার রাজপুত্রের। কিন্তু একদিন সে জানতে পারলো, তার রাজপুত্র আর তার নেই। সে আরেক দেশের রাজকন্যাকে মন দিয়েছে। সুখে ঘর বেঁধেছে তারা সেই ভীন রাজ্যে। ভেঙে গেল রাজকন্যার সকল স্বপ্ন । কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করা আর তার হলো না। সে জড়বস্তুর ন্যায় হয়ে গেল । ধীরে ধীরে লোপ পেল তার স্মৃতি । এদিকে রাজকন্যার শোকে রানি বিছানা নিলেন । দুই বোনের মধ্যে সম্পর্কচ্ছ্যেদ হলো। মুখ দেখাদেখি বন্ধ হলো দুই বোনের। পুত্রের এহেন অবিবেচক কর্মকাণ্ড সহ্য করতে না পেরে রাজা-রানি তার বড় পুত্রকে ত্যাজ্য করলেন। যোগাযোগ রাখলেন না বড় রাজপুত্রের সঙ্গে। রাজবাড়ীর প্রত্যেকের স্মৃতি থেকে বিস্মৃত হলো বড় রাজপুত্র। প্রত্যেকের মনে বড় রাজপুত্রের জন্য ঘৃণা জন্ম নিলো। একি তমাপু, তুমি কাঁদছ কেন? ” কুহু গল্প শেষ করতে পারলো না। তমার কান্নার শব্দে হকচকিয়ে গেল মেয়েটা।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৭

” তোমার গল্প শুনে আমার কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি সব ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখলাম। কেন এমন হলো? আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে? ” তমা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কুহু ওকে কাঁদতে একটুও বাঁধা দিলো না।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here