সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৬

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৬
জাওয়াদ জামী

” দৃষ্টি, আমার একটা কথা রাখবি? ” হলুদের আসর ছেড়ে নিহান বাহিরের উঠানে এসেছে। সবাই বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।
নিহানের গলা শুনে চমকে উঠল দৃষ্টি। ভেতরে ওর দম বন্ধ লাগছিল। তাই বাহিরের উঠানে এসেছে।
” নিহান ভাইয়া, তুমি? তুমি এখন বাহিরে এসেছ কেন? ”
” তোর সাথে কথা ছিল। আমি যা মনযোগ দিয়ে শোন। ”
দৃষ্টি চারপাশে তাকাল। বড়মা ওকে নিহান ভাইয়ার সাথে দেখলে রাগ করবে। এমনকি ওকে দু-চার কথা শুনিয়েও দেবে।

” কি বলবে, তাড়াতাড়ি বল। আমি ভেতরে যাব। ”
” আমার সাথে যাবি? আমাদের দু’জনের ছোট্ট একটা সংসার হবে। আমি পার্টটাইম জব করব। আমাদের কোন অভাব থাকবেনা। ”
” তুমি পাগল হয়েছ, ভাইয়া? কাল তোমার বিয়ে আর আজ তুমি এসব কি আজেবাজে কথা বলছ? বড়মা জানলে কি হবে একবারও ভেবে দেখেছ? ”
” ভেবেছি বলেইতো তোকে আগে এই অনুরোধ করিনি। আম্মু জানলে তোকে কি করত সেটা আমার ভালোই জানা আছে। আম্মু বিয়ে ঠিক করেছে বলেই কি আমাকে বিয়ে করতে হবে নাকি? আমি পৃথুকে নয়, তোকে ভালোবাসি। তোকেই বিয়ে করতে চাই। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” কিন্তু আমি চাইনা। বাড়ি ভর্তি মেহমান, হলুদের অনুষ্ঠান শেষ পর্যায়ে, আর এমন সময় তোমার মতিভ্রম ঘটেছে! সরে দাঁড়াও, আমি বাড়িতে যাব।
” প্লিজ দৃষ্টি, চল আমরা পালিয়ে যাই। তোকে ছাড়া আমি শূন্য। আমার কষ্ট বোঝার চেষ্টা কর। ”
” তোমার কষ্ট বুঝতে গিয়ে আমি আমার ভাইবোনের সমস্যার কারন হতে চাইনা। তোমার কথায় সায় জানিয়ে বাড়ি ছাড়লে, বড়মা আপু আর শিহাবকে কি করবে, সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে চাইনা। আমার এসব কথা শুনতে ভালো লাগছেনা। সরে দাঁড়াও৷ ”
নিহান সরে দাঁড়ায়। দৃষ্টি ওকে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল। দৃষ্টির চলে যেতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল নিহান।

” এই তুমি মেয়েদের মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? নিজেকে কি মেয়ে ভাবতে শুরু করেছ আজকাল? নিজেকে যদি মেয়ে বলেই মনে কর, তবে পাঞ্জাবি ছেড়ে শাড়ি পরছনা কেন? ”
আনানকে ধাক্কা মেরে চেয়ার থেকে ফেলে দিল সিক্তা। বেচারা কয়েকজন মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল। অবশ্য মেয়েগুলো অল্পবয়সী ছিল। তাদেরকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছিল সে। বিষয়টা সিক্তা বুঝতে পেরেই ওকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।

” এই যে রাক্ষসী, তুই আমাকে ফেলে দিলি কেন? ফুটন্ত গোলাপদের সামনে কেবল নিজেকে প্রকাশ করছি, আর তুই সেই মুহূর্তে আমার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালি! আজ এই কাঁটা আমি উপড়ে ফেলব। আমি ভুলে যাব তুই আমার বড় মামার মেয়ে। আমি ভুলে যাব, তোর মা আমার আদরের মামী ”
আনানের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল সিক্তা। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,
” তুমি কি সিনেমায় নাম লিখাবে? আগেই বলে রাখছি, নায়ক সাজতে যেওনা। তোমাকে নায়ক কম কমেডিয়ানের চরিত্রে বেশি মানাবে। তুমি চাইলে আমি আমার ফ্রেণ্ডের সাথে কথা বলব। আমার ফ্রেণ্ডের চাচা পরিচালক। আমি বললে হয়তো তুমি একটা সুযোগ পেতেও পার। ”

” থামবি তুই? আমার মান-সম্মান খেয়ে দিয়ে এসেছিস উপকার করতে? কতগুলো সুন্দরী মেয়ে দেখল, আমি চেয়ার থেকে পরে গেছি। এটা নিয়ে তারা হাসাহাসি করবে জানিস? ঐ মেয়েগুলোর মধ্যে দু’জন আবার আমার এক্সের কাজিন। আমার এক্স একটা নাগিনী। সে যদি শোনে আমি চেয়ার উল্টে পরে গেছি, এটাকে হাতিয়ার বানিয়ে ঐ নাগিনী আমাকে পঁচাবে। এমনিই কি তোকে আমি রাক্ষসী বলি? তুই একটা বদখত চেহারার রাক্ষসী। ” আনান রাগে ফুঁসছে। পারলে ও সিক্তার গলা টিপে দেয়।
” আমাকে খেপানোর শোধ নিয়েছি আমি। এরপর যদি আমার সাথে লাগতে আসো, তবে আবারও তোমাকে জব্দ করব। মনে থাকে যেন কথাটা। ” ভাব নিয়ে বলল সিক্তা।
” যা ভাগ। ” তেড়ে আসল আনান।
আনানকে তেড়ে আসতে দেখে দৌড়ে পালাল সিক্তা।

” তুমি একা এখানে কি করছ? ” তাহমিদের গলা শুনে চমকে পেছনে তাকাল কুহু। তাহমিদকে দেখে ও ভয় পেল।
” মাথা ব্যথা করছে। তাই এখানে এসেছি। ” কুহু বাহিরের উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে।
” মাথা ব্যথা করলে বাড়িতে যাও। চা কিংবা কফি পান কর। এখানে দাঁড়ালে কি মাথা ব্যথা কমবে? রাত একটায় তুমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছ, ভয়ডর নেই তোমার? ”
” এটা আমার গ্রাম। আমার দাদুর বাড়ি। আমাদের বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ভয় করবে কেন! ”
” নিজের বাড়ি হলেই কি ভয় পেতে নেই? মানুষের কথা নাহয় বাদই দিলাম। তোমাদের গ্রামে কি ভূত-পেত্নী নেই? এত রাতে যুবতী মেয়েকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যদি ভূত-পেত্নীর দল এসে তোমার ঘাড় মটকে দেয়, তবে কি করবে শুনি? তোমাদের এদিকে তাল গাছের সংখ্যা নেহাৎ মন্দ নয়। এছাড়া শ্যাওড়া গাছও আছে দেখলাম। এই দুই গাছেই নাকি ভূত-প্রেতের রাজত্ব থাকে। ও মা এখানেও একটা তাল গাছ আছে দেখছি! এই গাছে যে ভূত থাকবেনা তার নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারে? ”

ভূতের কথা উঠতেই ভয় পেল কুহু। আশেপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করল। ছোটবেলা থেকেই ও ভূত নামক অদৃশ্য বস্তুকে ভয় পায়। রাতে একা কখনোই বাড়ি থেকে এমনকি রুম থেকেও বের হয়না। মেয়েটা মনে মনে ভাবছে, কোন কুক্ষণে যে এত রাতে একা বাহিরের উঠানে এসেছিলাম? রাগে, ভয়ে নিজের কপোলে চপেটাঘাত করতে ইচ্ছে করছে।
” আ…আমি ভেতরে যা..যাচ্ছি। ” বলেই এক দৌড়ে আনানদের বাড়ির ভেতরে ঢুকল। কারন বাহিরের উঠান থেকে প্রথমেই আনানদের বাড়িই প্রথমে পরে।

” দৃষ্টি, বাড়িতে চল। ” কুহু ভেতরে ঢুকেই দৃষ্টির কাছে গিয়ে বলল।
” এই মেয়ে, এত রাতে বাড়িতে যেতে হবে কেন? আজকে তোরা আমাদের সাথেই ঘুমাবি। ” আফরোজা নাজনীন কুহুর কথা শুনতে পেয়ে বললেন।
” মামী, এখানে অনেক মানুষ। সবার ঘুমানোর জায়গা না-ও হতে পারে। আমরা বরং বাড়িতেই যাই। সকালে আবার আসব। ”
” কোকিলা রে, তোদের বাড়ির চাবিটা দে। আজকে আমরা কয়েকজন তোদের বাড়িতে ঘুমাব। ” আনান এসে কুহুর কাছে বাড়ির চাবি চাইল।
” কুহু মা, আনানকে চাবিটা দে। ওরা তোদের বড়িতে ঘুমাক। ”
” মামী, ওকেও বাড়িতে থাকতে হবে। রাতে আমাদের চায়ের পিপাসা পেলে ও আমাদেরকে চা বানিয়ে দেবে। ক্ষুধা লাগলে খাবার বানিয়ে দেবে। ”
” এত রাতে মেয়েটাকে তোরা খাটিয়ে মারবি? তারচেয়ে বরং আমিও কুহুর সাথে যাই। আমিও কাজে সাহায্য করব মেয়েটাকে। ”

” দেখেছিস কোকিলা, আমার মামী তোকে কত ভালোবাসে? এমন মামী দুনিয়া ঘুরলেও একটাও খুঁজে পাবিনা। ”
” আফরোজা, আমরা ঘুমাব কোথায়? ” আফরোজা নাজনীনের স্বামী এসে জানতে চাইলেন।
” তোমাকে না ঘুমানোর জায়গা করে দিয়ে আসলাম? তুমি উঠে আসলে কেন? ”
” ঐটা তো রুম নয, যেন গরুর গোয়াল। মনে হচ্ছে এক গোয়াল গরুর মাঝে আমি শুয়ে আছি। চারপাশে এত শব্দ। ঘুম আসার বদলে ছুটে পালাচ্ছে। ” বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে রেখেছেন ভদ্রলোক।
” মামা, তুমি এক কাজ কর, কুহুদের বাড়িতে গিয়ে ঘুমাও। ওদের দক্ষিণের রুমে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে। কোকিলা, তুই বাড়িতে গিয়ে রুমের বিছানা ঠিকঠাক করে দে। ”
” চল মা, আমাকে নিয়ে চল। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব। আফরোজা, তোমার বেয়াদব বাপ কোথায়? তাকে তো দেখছিনা? ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫

” আবারও শুরু করলে? আমার ছেলেটা বেয়াদব হতে যাবে কেন? তোমার এই কথাটা ওর কানে গেলে, ও তার প্রত্যুত্তর দেবে। আর সে ঠিক তখনই তোমার কাছে বেয়াদব উপাধি পাবে। আগে নিজে থেকে খোঁচাবে, আর পরে ছেলেটা কিছু বললে, ওকে দোষ দেবে? ”
” মাফ চাই। তোমার আদরের বাপকে কিছুই বলবনা। চল, মা। আমরা তোমার বাড়িতে যাই। ”
কুহু, দৃষ্টি, শিহাব আর মামাকে নিয়ে বাড়িতে গেল। আফরোজা নাজনীন জানালেন তিনি কিছুক্ষণ পর যাবেন।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৭