সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫৫

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫৫
জাওয়াদ জামী

নিস্তব্ধ রজনী । আকাশে থালার মত চাঁদ উঠেছে। তার রূপালি আলোয় ধরিত্রী সেজেছে মোহনীয় রূপে। সে যেন এক লজ্জা রাঙা বধূ। তমা মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করছে রাত আর রূপালি আলোর মাখামাখি। আজকের রাতের রূপ যেন একটু বেশিই সুন্দর। থেকে থেকে দূরে কোথাও রাতজাগা পাখি ডেকে উঠছে। তমা অবাক হয়ে ভাবে , এই ইট-পাথরের নগরীতে রাতজাগা পাখিরও আনাগোনা আছে! আচ্ছা ওরা কোথায় দিনের বেলা কোথায় লুকিয়ে থাকে ? ওরা কি দিনের আলোয় বেরোতে লজ্জা পায়? নিজের এমন বোকা বোকা চিন্তায় হেসে ফেলল তমা। ধেৎ পাখিদেরও আবার লজ্জা আছে নাকি !

হঠাৎই কারও স্পর্শে চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসল মেয়েটা। পেটে কারও ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে একটু ভয়ই পেল। তবে মুহূর্তেই মনে পরল , এত রাতে ওর বেডরুমের লাগোয়া বেলকনিতে অচেনা কারও আসার সুযোগ নেই। তবে যার রুম সে যখন খুশি তখন আসতে পারে। কথাটা ভেবেই লজ্জায় রাঙা হল তমার কপোল। ঠোঁট কামড়ে লাজুক হেসে মুখ নিচু করল। হঠাৎই কি মনে করে সন্ধ্যায় বিয়ের শাড়ি পরেছিল। এরপর একে একে বিয়ের গহনায় সাজিয়েছে নিজেকে। আর এই মুহূর্তে সেটাই লজ্জার কারন। ওকে শাড়ি পরতে দেখে ডক্টর কি অন্য কিছু ভেবেছে? আর যদি ভেবেও থাকে , সেটা কি ভুল? ও কি ডক্টরের জন্যই নিজেকে বধূবেশে সাজায়নি? তমা বুঝতে পারছে , ধীরে ধীরে গাঢ় ডক্টরের ছোঁয়া। তার অবাধ্য দু হাত বিচরণ করছে তমার কোমড় থেকে উদর। সে থুতুনি রেখে তমার কাঁধে। দাঁড়ির ঘঁষায় কাঁধের উন্মুক্ত চামড়া জ্বলছে । ঠোঁট কামড়ে জ্বলুনি সহ্য করল। তার গভীর ছোঁয়ায় কেঁপে উঠছে তমা। ডক্টর কি সেটা বুঝতে পেরেই বারংবার ওর শরীরে কাঁপুনি ডেকে আনছে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” এভাবে মুখ ঘুরিয়ে রাখলে আমার বউটাকে কিভাবে দেখব ! সে কি জানে না , তাকে দেখার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি ? নাকি সে ইচ্ছে করেই আমাকে কামনার আগুনে জ্বালাতে চাইছে? যদি সেটাই হয়ে থাকে, তবে সে সফল হয়েছে। সে আমাকে ভালোভাবেই জ্বালাতে পেরেছে। ”
ছোট ছোট চুমুতে তমাকে অস্থির করে তুলেছে ফারদিন। তমা বেলকনির গ্রীল শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। এই ডক্টর কি ওকে পুনরায় পাগল বানিয়ে দেবে নাকি! নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেল মেয়েটার। ওকে নিরব থাকতে দেখে ফারদিন ফিসফিসিয়ে বলল,
” আমি যখন জ্বলেছি, সেই কামনার আগুনে এবার তোমাকেও জ্বলতে হবে , জান। নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য বেশি সময় পাবে না তুমি । কারন আমি সময় নষ্ট করতে পছন্দ করি না একদমই। ” কথাগুলো বলেই তমাকে কোলে তুলে নিল ফারদিন।

অকস্মাৎ ফারদিনের এমন কাণ্ডে হকচকিয়ে গেল তমা। ভয় পেয়ে আঁকড়ে ধরল ফারদিনের গলা। মুহূর্তেই দু’জনের চোখাচোখি হল। ফারদিনের চোখে আমন্ত্রণ দেখতে পেল মেয়েটা। বুঝতে বাকি রইলনা এটা কিসের আমন্ত্রণ। লাজুক হেসে ফারদিনের বুকে মুখ লুকাল সে। তমার হাসি দেখে ফারদিন বুঝে গেল , হাসিতেই লুকিয়ে আছে সম্মতি। আজ এই রাতেই দু’জনের সম্পর্ক পরিপূর্ণ হতে চলেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে রুমে ঢুকে পা দিয়ে দরজা বন্ধ করল।

” আনান ভাইয়া , নিহান ভাইয়া তাড়াতাড়ি এসো সিক্তাপু সেন্সলেস হয়ে গেছে। ”
দৃষ্টির চিৎকার শুনে দুই ভাই তাদের রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসল। রান্নাঘরের মেঝেতে সিক্তাকে এলোমেলোভাবে পরে থাকতে দেখে দু’জনেই ছুটে গেল সেদিকে।
আনান হাঁটু গেঁড়ে বসল সিক্তার কাছে। নিহান জগ থেকে পানি নিয়ে বসল সিক্তার আরেক দিকে।
পানি ছিটিয়ে দিল ওর চোখেমুখে।
” সিক্তা, কি হয়েছে তোর? চোখ খোল। সিক্তা? ” আনান পাগলের মত সিক্তাকে ডেকেই যাচ্ছে।
দৃষ্টি ততক্ষণে ফোন দিয়েছে আফরোজা নাজনীনের কাছে।
কিছুক্ষণ পর সিক্তার জ্ঞান ফিরলে ওকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল আনান। একটু আগেই তাহমিদ ফোন করে জানিয়েছে , ওরা আসছে।

” ইয়েএএএ আমি বড়মা হব । আমাদের বাসায় একটা গুলুমুলু, কিউটের ডিব্বা পুঁচকে আসবে । ওকে আমি সারাক্ষণ নিজের কাছে রাখব। ওকে গোসল করাব , সাজিয়ে দেব ওর সব কাজ আমি করে দেব। ”
দৃষ্টির কথা শুনে হেসে ফেললেন আফরোজা নাজনীন। হাসছে রুমের সকলেই। কিন্তু আনান তখনও স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না ডক্টরের কথা। পৃথিবীতে একটা প্রানের আগমনের কারন যে ও নিজে এটা ভাবতেই ওর শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। ও বাবা হতে চলেছে! একটা ছোট্ট শিশু আধোআধো স্বরে ওকে ‘ বাবা ‘ ডাকছে কথাটা ভাবতেই এক অজানা আনন্দের নাগ পাশে জড়িয়ে যাচ্ছে সে।
সিক্তা আঁড়চোখে তাকাল আনানের দিকে। খুশিতে ঝলমল আনানের মুখখানা দেখে ওর কান্না পেল। কিন্তু আশেপাশে মা-চাচীরা আছে বলে কাঁদতে পারল না।

” বাপ , এবার আমরা বাসায় যাই । সিক্তাকে আমাদের সঙ্গেই নিয়ে যেতে চাচ্ছি । আনান , তুই কিন্তু বাঁধা দিতে পারবি না। ডক্টর কি বলেছে সেটা তো শুনেছিস তুই। ” আফরোজা নাজনীন প্রথমে তাহমিদকে, পরে আনানকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
” হুঁ চলে যাও । আনান বাঁধা দেবে কেন! সিক্তার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো নয় সেটা ও ডক্টরের কাছে শুনেছে । তারপরও যদি বাঁধা দেয়, তবে ওকে এখানে বেঁধে রেখে সিক্তাকে বাড়িতে নিয়ে যাব । কি রে দিবি নাকি বাঁধা? ”
” পাগল হয়েছি নাকি আমি ! তোমাকে বাঁধা দেয়া আর পাগলা ষাঁড়ের সাথে লড়াই করা একই কথা। ষাঁড়ের মত তোমার শিং না থাকলে কি হবে, তুমি গুঁতাবে মুখ দিয়ে। তোমার কথা শুনলেই আমার কলিজা শুকিয়ে যায়। তোমার মেয়েকে নিয়ে যাও, মামী। আমি বাসায় গিয়ে ওর ব্যাগ গুছিয়ে একটু পর গিয়ে দিয়ে আসব। ”
আনানের কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল দৃষ্টি। ও লক্ষ্য করেছে , সিক্তাপুর সঙ্গে বিয়ের পর থেকেই আনান ভাইয়া তাহমিদ ভাইয়াকে মাঝেমধ্যে খোঁচায়। আর তাহমিদ ভাইয়াও সেটা নীরবে সহ্য করে। কিন্তু ও এটা বোঝে না , আগে যেখানে তাহমিদ ভাইয়া আনান ভাইয়াকে উঠতে বসতে নাচাত, এখন উল্টো আনান ভাইয়া তাকে নাচাতে চায়, এটা কেন?

দৃষ্টিকে হাসতে দেখে ওর দিকে চোখ কটমট করে তাকাল তাহমিদ। বোকা মেয়েটাকে কতবার বলবে , সব সময় এভাবে হাসতে হয় না? তাহমিদের চোখে চোখ পরতেই দৃষ্টির হাসি বন্ধ হয়ে গেল। ভাইয়া যে ওর ওপর রেগে গেছে এটা বুঝতে বাকি নেই ওর।
এদিকে দৃষ্টির চোপসনো মুখ দেখে নিহানের হাসি পেল। ও ভালো করেই জানে , দৃষ্টি ওকে ভয় না পেলেও ভাইকে ঠিকই ভয় পায়। একমাত্র ভাই-ই পারবে ওকে ঠিক করতে।
আফরোজা নাজনীন আর তাহমিনা আক্তার মিলে সিক্তাকে ধরে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেলেন। দৃষ্টি আনানের সঙ্গে চলল নিজেদের ফ্ল্যাটে। নিহান গেল অফিসে।

” ভাইয়া, ঐ নিহান ভাইয়া, কথা বল না কেন? শুনতে পাও না নাকি! তাকাও না আমার দিকে। ”
দৃষ্টির ঘ্যানঘ্যান থেকে রক্ষা পেতে ওর দিকে তাকাল নিহান।
” কি বলবি বল। তবে বেশিক্ষণ তোর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারব না। আপাতত তোর দিকে তাকানোর চাইতেও অফিসের কাজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ”
” তোমার আমি ছাড়া বাকি সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। নইলে আমার দুই বছর পর সিক্তাপুর বিয়ে হয়েও সে আমার আগেই মা হতে চলেছে। এদিকে আমি বাচ্চা নিতে চাইলে তুমি আকাশ থেকে মাটিতে টুপ করে পর। এত অবিচার কেন আমার প্রতি? ”

” তুই নিজেই একটা বাচ্চা। একটা বাচ্চা হয়ে তুই বাচ্চা নিতে চাস! হাউ ফানি! সামলাতে পারবি তুই ? নিজেকেই সামলাতে পারে না যে মেয়ে সে বাচ্চা সামলাবে কিভাবে! আরও দুই বছর যাক। তারপর বাচ্চার কথা চিন্তা করিস। ”
” বিয়ের দুই বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমাকে তোমার বাচ্চা মনে হয় ? আরও দুই বছর পর বাচ্চা নিলে আমার বাচ্চারা তোমাকে বাবা ডাকতে চাইবে তার নিশ্চয়তা কি ? বুইড়া ব্যাডা , বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার বয়স হতে হতে তোমার চুল-দাঁড়ি সব পেকে তুমি ঝুনো নারকেল হয়ে যাবে সেটা কি জানো? বাচ্চারা তাদের বুড়ো বাপকে দেখে লজ্জা পাবে না বল? ”

” আমাকে এখন যেমন দেখছিস, আগামী দশ বছর পরও তেমনই দেখবি । তাই বাচ্চাদেরও লজ্জা পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাই এমন উল্টাপাল্টা চিন্তা না করে পড়তে বস। আর আমাকেও কাজ করতে দে । ”
” বুঝি আমি সব বুঝি । আমাকে তোমরা কেউই ভালবাসো না । ভালোই যদি বাসতে তবে বাচ্চাকাচ্চা দিয়ে এই বাড়ি ভরে যেত । সবাই বলত , দৃষ্টি এবার তুই একটা বাচ্চা নে। কিন্তু এ কথা কেউই বলে না । আমাকে তোমরা শত্রু ভাব বলেই বাচ্চা নেয়ার কথা বল না। ” ন্যাকাস্বরে কান্না জুড়ল দৃষ্টি।
দৃষ্টিকে কাঁদতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাতের কাগজপত্র একপাশে সরিয়ে রেখে ওকে হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিল নিহান। চুমোয় ভরিয়ে দিল বোকা মেয়েটাকে। ফিসফিসিয়ে বলল,

” তোকে আমি কতটা ভালবাসি সেটা যদি জানতিস , তবে আমাকে দুদণ্ড চোখের আড়াল হতে দিতি না । আমার নামেই তোর হিয়ায় প্রেমের কম্পন হত , আবার আমার নামেই লিখা হত তোর প্রতিটা শ্বাস। তোকে খুব বেশি ভালবাসি বলেই , এখনই বাচ্চা নিতে চাই না। তুই এখনো অনেক ছোট। আরেকটু বড় হ , তখন প্রতি বছর একটা করে বাচ্চা নেব। বাচ্চা সামলানো খুব সহজ কাজ নয় । আমাদের বাসায় নতুন যে পুচকু আসতে চলেছে তাকে কিভাবে যত্ন করতে হবে সেটা শিখে নে। ও আসলে ওর সঙ্গে বেশি বেশি সময় কাটাবি । বাচ্চা লালনপালনের আদ্যোপান্ত শিখে নে। তারপর বাচ্চা নিস , আমি কিছুই বলব না। ততদিনে আমাদের পুচকুও বড় হয়ে যাবে । আরেকটা কথা , আমিও খুব করে চাই একটা ছোট্ট দৃষ্টি আসুক আমার পৃথিবীতে। যার দুষ্টুমিতে মেতে উঠবে পুরো বাড়ি। যাকে ঘিরে গড়ে উঠবে আমাদের নতুন পৃথিবী। তার নামও ঠিক করে রেখেছি। আমাদের প্রিন্সেস হবে আমাদের সুখের চাবিকাঠি। ”

নিহানের কথা শুনে খুশিতে কেঁদে ফেলল দৃষ্টি। ফোঁপাতে ফোপাঁতে জিজ্ঞেস করল,
” কি নাম ঠিক করেছ ? আমাকে আগে বলোনি কেন? তুমি খুব খারাপ। আর প্রিন্সেসই বা কেন? প্রিন্সও তো আসতে পারে। ”
” আসুক না , যে আসবে আসুক। আমি তোকে আমার স্বপ্নের কথা বলেছি । আমার হৃদয়ের গহীনে সাজানো স্বপ্ন যেটা কখনোই কাউকে ব্যক্ত করিনি। আজকে তুই জানলি সেটা। তার নাম এখন বলা যাবে না । দুই বছর পর জানতে পারবি। ”

” আবারও দুই বছর ! তাহলে এতদিন তুমি আলাদা রুমে থাকবে । আমার কাছে আসারও চেষ্টা করবে না। ”
” হুররর, তোকে ছাড়া যেখানে একটা রাতও কাটানো সম্ভব নয় , সেখানে আমাকে দুই বছর আলাদা থাকতে বলছিস! সম্ভব নয় । প্রয়োজনে প্রিন্সেস নয়মাস পরেই আসবে। ” কথাটা বলেই মনে মনে প্রমাদ গুনল নিহান। আবেগের বশে কি বলে ফেলল ! এবার পাগলিটাকে সামলাবে কিভাবে?
” সত্যিই ! নয়মাস পরেই আসবে আমাদের প্রিন্সেস ? এখন থেকে ঠিক নয়মাস পর ? তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছ , এই মুহূর্তে… ” কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই দৃষ্টি বুঝল ও কি বলতে চেয়েছিল। লজ্জায় দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরল।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫৪

নিহান ভ্রু কুঁচকে তাকাল দৃষ্টির দিকে । মেয়েটাকে লজ্জা পেতে দেখে ঘুমন্ত কামনা জেগে উঠল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল দৃষ্টিকে।
” ঠিক ধরেছিস । এই মুহূর্তেই আমার তোকে চাই। ” নিহান নিজেও আর কিছু বলল না। দৃষ্টিকেও কিছু বলার সুযোগ দিল না।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here