সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৮
জাওয়াদ জামী
” কোকিলা রে, আজ থেকে তুই আমার বেয়ান হয়ে গেলি। আমার কি ভাগ্য দেখ, দৃষ্টিকে ভাবী ডাকতে হবে। আর তুই হয়ে গেছিস ভাইয়ার বড় বোন। ভাইয়া এখন থেকে উঠতে-বসতে তোকে সালাম দেবে। ”
আনানের মুখভঙ্গি দেখে না চাইতেও কুহু হেসে ফেলল। ওর ভয় হচ্ছে। বাড়ি ভর্তি আত্নীয় স্বজন থাকায় বড়মা ওদেরকে কিছু বলছেনা। কিন্তু যখন সবাই চলে যাবে, তখন নিশ্চয়ই বড়মা ওদেরকে ইচ্ছেমত অপমান করবে। নিহান ভাইয়ার সাথে দৃষ্টির বিয়েটা হোক, সেটা কিছুতেই চায়নি কুহু। বারবার দুই মামীকে সেকথা বলেছে। কিন্তু তারা কুহুর কোন যুক্তিই শোনেননি। শেষে সাদিক আহমেদ রাশেদীনও কুহুকে অনুরোধ করেছেন। শেষমেশ রাজি হতে হয়েছে কুহুকে। গুরুজনদের অনুরোধ ও ফেলতে পারেনি।
” সালামের হিসেব করতে গেলে কোকিলাকেও তোর সালাম করতে হবে, বুঝলি? কারন সে নিহানের বউয়ের বড় বোন। তোর বেয়ান ঠিকই। কিন্তু সম্মানের দিক থেকে বড়। একবার চিন্তা করে দেখ তুই কোন প্যাঁচে পরেছিস? ” আনানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জবাব দিল তাহমিদ।
এদিকে আনানের কথা শুনে হেসে উঠলেন আফরোজা নাজনীন। তারা কুহুদের বাড়ির উঠানে বসে গল্প করছে। আজ রাতে হয়তো কেউই ঘুমাবেনা। কারন আগামীকাল দৃষ্টির বৌভাত। বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। এখন থেকেই যে যার কাজ করছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” যার যেটা প্রাপ্য তাকে সেটা দিতেই হবে। কুহু এখন সম্মানের দিক দিয়ে নিহানেরও বড়। তাই নিহানের ছোট ভাইবোনেরা ওকে দরকার পরলে সালাম দেবে। ”
” ঠিক বলেছ, মামী। আমার কত সাধ ছিল ছোট বোনের শ্বশুর বাড়ির লোকজন আমাকে সম্মান করবে। প্রয়োজনে-অপ্রোয়জনে সালাম পাব। কিন্তু না। আমার আবার এত রাজ কপাল নয়। সালাম এখন উল্টো আমাকেই দিতে হবে। ”
” তোর সালাম পাওয়ার খুব সাধ, আনান? তুই চাইলে আমি তোকে সেই ব্যবস্থাও করে দিতে পারি। তোদের গ্রামের কয়েকজন মানুষকে ভাড়া করতে পারি তোকে সালাম দেয়ার জন্য। তারা সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা তিনবেলা এসে তোকে সালাম দিয়ে যাবে। এতে তোর দুঃখও ঘুচবে আবার কিছু সওয়াবও অর্জন করতে পারবি। আবার তোর উছিলায় কিছু মানুষও সওয়াব পাবে। ”
বরাবরের মতোই তাহমিদের কথা শুনে আনানের মুখ চুপসে গেল। তাহমিদের কথার পিঠে কি বলবে সেটা খুঁজে পেলোনা। তাই মুখ গোমড়া করে বসে থাকল।
এদিকে তাহমিদের কথা শুনে কুহু ফিক করে হেসে দিল। লোকটার কথাবার্তা শুনে ওর হাসি পায়। আনানের সাথে তার কি শত্রুতা সেটা ভেবে পায়না কুহু। কথায় কথায় আনানকে সে হেনস্তা করে মজা পায় এটাও বুঝতে পারে কুহু।
কুহুকে হাসতে দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকল তাহমিদ। গত দুইদিনে মেয়েটাকে সে হাসতে দেখেনি। মেয়েটা সবসময়ই কিছু একটা ভাবে। হৈ-হুল্লোড়, চিৎকার চেঁচামেচি সে পছন্দ করেনা।তাহমিদ সবসময়ই এমন একটা মেয়েই খুঁজেছে। ও ভাবতেই পারেনি, নিহানের বিয়েতে এসে সে তার স্বপ্ন কন্যার দেখা পেয়ে যাবে।
” দৃষ্টি, চুপ করে আছিস যে? বিয়েটা কি তুই মন থেকে মেনে নিতে পারিসনি? ” নিহান ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।
দৃষ্টি নিহানের কথার উত্তর কি দেবে! ও ভয়েই মরে যাচ্ছে। যেখানে আজ পৃথুর সাথে নিহানের বিয়ের কথা ছিল, সেখানে হুট করেই কনে পাল্টে গেল! পৃথুর জায়গায় ও বিয়ের পিড়িতে বসল। অথচ গত রাতেও সকলেই জানত, কনের নাম পৃথু ।
দৃষ্টিকে নিরব থাকতে দেখে ভড়কে গেল নিহান। ওর মনে শঙ্কা বাসা বাঁধছে। মনের গহীন থেকে কে যেন বলে উঠছে , তবে কি দৃষ্টি তোকে ভালোবাসেনি? সে কি বিয়েটা করতে চায়নি? নিহান সযতনে দৃষ্টির ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল,
” কথা বলছিস না যে? তুই অনিচ্ছায় বিয়েটা করেছিস? ”
নিহানের স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠল দৃষ্টি। ধীরে ধীরে কাঁপুনি বাড়তে থাকল। দৃষ্টিকে কাঁপতে দেখে ভয় পেল নিহান।
” দৃষ্টি এই দৃষ্টি, তুই কাঁপছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে? কি হয়েছে আমাকে বল? ” কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল নিহান।
নিজেকে স্বাভাবিক করতে দৃষ্টির অনেক সময় লাগল। অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল মেয়েটা।
” ভ..ভয় লাগছে। তুমি মেঝেতে ঘুমাও প্লিজ। ”
দৃষ্টির কথা শুনে প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণেই হো হো করে হেসে উঠল নিহান। এতক্ষণে মেয়েটার নিরবতার কারন বুঝতে পেরেছে।
” এত মিষ্টি বউ রেখে মেঝেতে ঘুমাতে পারব! যদি আমার বউ আমার সাথে মেঝেতে ঘুমাতে রাজি হয়, তবে আমিও মেঝেতে ঘুমাব। তবে বাসর ঘরে মেঝেতে ঘুমানো ভালো দেখায়না, কি বলিস? তোকে পেতে কত দোয়া করেছি সেটা যদি জানতিস, তবে আমাকে মেঝেতে ঘুমাতে বলতে পারতি না। ”
” আমি আপুর কাছে যাব। তোমাকে ভয় লাগছে আমার। ” হঠাৎ ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠল দৃষ্টি।
এবার বিপদে পরে গেল নিহান। অসহায় চোখে দরজার দিকে তাকাল। দৃষ্টির কান্নার শব্দ বাহিরে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আত্নীয় স্বজনদের সামনে মুখ দেখাতে পারবেনা৷
” ঠিক আছে বইন, আমি মেঝেতেই ঘুমাব। তবুও তুই কান্না থামা। তোর কান্নার শব্দ কেউ শুনলে মানসম্মান আর থাকবেনা। বালিকা বধূকে নির্যাতন করার দায়ে আমাকে সরকারি শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। ” ফ্যাসফেসে গলায় বলল নিহান।
” সরকারি শ্বশুর বাড়ি আবার কি? তুমি কি আগেও বিয়ে করেছ? আগের বিয়ে গোপন করে, এখন আবার আমাকে বিয়ে করেছ? এই তোমার ভালোবাসা? সুযোগ পেলেই চিরকুট দিতে। সেগুলো পড়ে মনে হত, ভালোবাসা উপচে পরছে। সবই তোমার অভিনয় ছিল? হায়রে পুরুষ! পুরুষ অভিনয়ে সেরা রে। আমি বাহিরে যাব। বড় চাচাকে বলে দেব, তার ছেলের আরেকটা বউ আছে। ” কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে দৃষ্টির।
নিহান দৃষ্টির দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে। ও জানত মেয়েটা একটু বেশিই চঞ্চল। কিন্তু এতটা বোকা সেটা জানতনা। কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে ওর।
” আমার আদরের চাচাতো বইন, আল্লাহর দোহাই লাগে তুই কাঁদিসনা। তুই আমার একমাত্র বউ। ইহকাল-পরকাল দুই কালেই তুইই আমার বউ থাকবি। এবার দয়া করে কান্না থামা। বাবা যদি তোর কান্না শুনতে পায়, তবে আমাকে আস্ত রাখবেনা। আবার অন্য কেউ তোর কান্না শুনলে, আমাকে লজ্জায় পরতে হবে। আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে সবাই। একটু সম্মান ভিক্ষা দে আমাকে। ” নিহান অনুনয় করল। যেকোন মুহূর্তে সে কেঁদে ফেলবে।
নিহানের মুখখানা দেখে হাসি পেল দৃষ্টির। কান্না থামিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পরল। অনেকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলল,
” আমি ছোট মানুষ। আমার সাথে দুরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করবে। নইলে বড় চাচার কাছে বিচার দেব। ”
দৃষ্টির হুমকিতে মুখ কাঁচুমাচু করে বালিশ মেঝেতে ছুঁড়ে মারল নিহান। এরপর ওয়ার্ডরোব থেকে বেডশিট বের করে মেঝেতে বিছিয়ে শুয়ে পরল।
নিহান শুয়ে পরলে দৃষ্টি হাঁফ ছাড়ল। বুকে ফুঁ দিয়ে ও নিজেও শুয়ে পরল।
” কি দিনদুনিয়া আসল, বড় বোন রেখে ছোট বোনের বিয়ে হয়! এখনকার ছেলেমেয়েরা এত পাকনা। মায়ের পেট থেকে বের হয়েই ছেলেদের পেছনে লাইন মারে। ” চোখমুখ কুঁচকে কথাগুলো বলর এক মধ্যবয়সী মহিলা।
উঠানে বসে কয়েকজন গল্প করছে। তবে তারা গল্প কম, সমালোচনা করছে বেশি। নিহানের বউভাতে এসে যখন তারা শুনেছে বউ পাল্টে গেছে, তখন থেকেই কানাঘুষা করছে।
” আরে ভাবী, বড় বোন সুন্দরী হলে তো তার সাথে মানুষ ছেলে বিয়ে করাবে? বউয়ের বড় বোনের গায়ের রঙ দেখেছেন? এমন কালো মেয়েকে কি কেউ ঘরের বউ করতে চাইবে? সব বাবা-মাই চায় তাদের ছেলের বউ সুন্দরী হোক। ” আরেকজন মহিলা আবার পান চিবাতে চিবাতে ফোঁড়ন কাটল।
” ঠিকই বলেছেন, ভাবী। বউ-ঝিয়েরা সুন্দর না হলে বাড়ি মানায়না। ফর্সা বউ বাড়িতে থাকা মানে বাড়ি আলোয় ঝলমল করা। নিহানের বউয়ের বড় বোন যে বাড়িতে যাবে, সেই বাড়ি কোনদিন আলোকিত হবেনা। মনে হবে, দিনদুপুরেও আঁধার নেমেছে। ” কয়েকজন মহিলা খিকখিক হেসে উঠল।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই কথাগুলো কুহুর কানে গেল। কষ্টে ওর চোখে পানি আসল। ও জানে, ওর গায়ের রঙ উজ্জ্বল নয়। ও শ্যামলা। এটা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে। তবে এসব নিয়ে মাথা ঘামায়না কুহু। কিন্তু আজ এই মহিলাদের কথা শুনে সত্যিই ওর কষ্ট হচ্ছে। কোনমতে কান্না চাপিয়ে কুহু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
বাহিরের উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে মেহমানদের রিসিভ করছে তাহমিদসহ কয়েকজন। ঠিক তখনই ওর নজর গেল কুহুর দিকে। মেয়েটা ওড়নায় চোখ মুছতে মুছতে নিজেদের বাড়ির দিকে গেল। খটকা লাগল ওর। কি ঘটেছে দেখার জন্য বাড়ির ভেতরে গেল। তখনো সেই মহিলারা কুহুকে নিয়েই কথা বলছে।
” শুনলাম বউয়ের বোন নাকি ভালো ছাত্রী। ঢাকায় ভালো কলেজে পড়াশোনা করত। সেইজন্য বোধহয় মেয়েটার খুব অহংকার। খানিক আগেই যেচে ওর সাথে কথা বলতে গেছিলাম। ও মা, দেখলাম মেয়েটার মুখ দিয়ে কথাই বের হয়না। রূপ না থেকেই যে অবস্থা, রূপ থাকলে না আরও কত অহংকার করত! এই মেয়েকে যে বিয়ে করবে, তার কপাল পুড়বে। ”
তাহমিদ রেগে সেই মহিলাদের দিকে যেতেই, ওকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেলেন আফরোজা নাজনীন। তিনিও কুহুকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখেছেন।
” আপনারা এখানে নিহানের বউ দেখতে এসেছেন। নিহানের বউয়ের বোনকে অপমান করতে ডাকা হয়নি। আপনারা এসেছেন বউ দেখবেন, খাবেন এরপর চলে যাবেন। কিন্তু আপনারা সেটা না করে অন্যের চেহারার বিশ্লেষণ করছেন? অথচ ঐ মেয়েটা আপনাদেরই মেয়ের বয়সী। এই যে আমাকে দেখছেন? আমার গায়ের রঙও তো শ্যামলা। তবুও আমি ভালো মনের স্বামী পেয়েছি, আদর্শ শ্বশুর বাড়ি পেয়েছি। গায়ের রঙ আমার সুখে বাঁধা হতে পারেনি। যাকে নিয়ে আপনারা কথা বলছেন, সেই মেয়েটা কিন্তু আমার চেয়েও যোগ্য।
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৭
লেখাপড়ায়, বংশ বুনিয়াদিতে, সবকিছুতেই। আমি যদি এই গায়ের রঙ নিয়ে ভালো ঘর পাই, ও কেন পাবেনা? আপনাদের লজ্জা করা উচিত, নিজের মেয়ের বয়সী মেয়েকে নিয়ে কটুকথা কথা বলার জন্য। ও তো আর আপনাদের ছেলের বউ হওয়ার জন্য আপনাদের হাতেপায়ে ধরছেনা যে আপনারা গোলটেবিল বৈঠক করছেন। ”
বড়মাকে উচিত জবাব দিতে দেখে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকল তাহমিদ। এজন্যই বড়মাকে ও এতটা ভালোবাসে