সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে শেষ পর্ব 

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে শেষ পর্ব 
জাওয়াদ জামী

” বউ , তোমার মুখখানা এমন মলিন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ লাগছে? আমার কাছে এসো তো, দেখি কি হয়েছে। ” কুহুর দিকে তাকিয়ে উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল তাহমিদ। একহাতে কুহুকে টেনে নেয় নিজের কাছে।
” কিছুই হয়নি আমার। এমনি একটু ক্লান্ত লাগছে। আপনি এত অস্থির হচ্ছেন কেন! এখানে চুপটি করে বসুন। আমি পায়েস রান্না করেছি , আপনি খেয়ে বলবেন কেমন হয়েছে। ” কুহু তাহমিদকে শান্ত করতে চাইল।
” আমার বউ রান্না করেছে আর আমি খাব না এটা হতে পারে না। তবে খাওয়ার আগেই আমাকে বলবে তোমার সমস্যার কথা। তোমার কি হয়েছে সেটা জানতে না পারলে আমি কিছুই খেতে পারব না। সোনা বউ , আমাকে বল তোমার কি হয়েছে? ”

তাহমিদকে টেনশন করতে দেখে কুহু নিজের সমস্যার কথা না বলে থাকতে পারল না।
” কয়েকদিন থেকেই শরীরটা ক্লান্ত লাগে, খেতে ইচ্ছে করে না। গত কয়েক মাস ধরে পেটে হালকা ব্যথা করত। তবে দুইমাস থেকে ব্যথা বেড়েছে । ” কুহু একে একে সব সমস্যার কথা খুলে বলল।
সবকিছু শুনে তাহমিদের কপাল কুঁচকে গেল। ওর চোখমুখে চিন্তার রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
” দুই মাস ধরে সমস্যা অথচ আমাকে কিছুই জানাওনি! আমি তোমাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি , কি হয়েছে? কিন্তু তখনও তুমি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গেছ। তুমি এমন কেন বলতো ? বাড়ির প্রতিটা সদস্যের সেবা করতে গিয়ে , তাদেরকে ভালো রাখতে গিয়ে নিজের দিকে নজর দাও না। এমনকি আমাকে জানাও না তোমার শারিরীক অবস্থার কথা। আমাকেই বারবার জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হয়। কেন , কুহু? ”
তাহমিদের চিন্তিত মুখ দেখে শঙ্কায় ছেয়ে গেল কুহুর মন। তবে কি ওর খারাপ কোন অসুখ হয়েছে ? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” খারাপ কিছু হয়েছে আমার ? আপনাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? ”
কুহুর কথায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসবার চেষ্টা করল তাহমিদ । ওর আশংকা কুহুকে বুঝতে দিতে চায় না।
” আমাকে চিন্তিত দেখানো মানেই কি তোমার সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটবে ! এতগুলো দিন তুমি কষ্ট পেয়েছ ভেবেই আমার চিন্তা হচ্ছে । আমার কথা মন দিয়ে শোন , আগামী তুমি আমার সঙ্গে হসপিটালে যাবে। আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলছি। ” তাহমিদ ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেল।
” কালকেই যেতে হবে ? অন্য ডক্টরের কাছে যেতে হবে কেন ? আপনিও তো ডক্টর । আপনার চেম্বারে গেলে হবে না? ” কুহুর সত্যিই ভয় হচ্ছে।
” আমি কোন গাইনেকোলজিস্ট নই । তোমার চিকিৎসা একজন ভালো গাইনেকোলজিস্টের কাছে হওয়া দরকার। কাল আমি দুপুরেই বাসায় ফিরব । তুমি তৈরি হয়ে থেক। ”
” আপনি কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছেন ? আপনি বোধহয় বুঝতে পেরেছেন , আমার সমস্যা কি। বুঝেছেন তাই না ? ”

কুহুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ওকে এক হাতে নিজের কাছে টেনে নিল তাহমিদ। চুমু দিল ওর শ্যামাঙ্গিনীর চোখেমুখে ।
” তোমার নিজের সমস্যা বলে যেটাকে মনে করছ , সেটা আসলে তোমার একার নয়। যেদিন আমি তোমাকে নিজের করে পেয়েছি , সেদিন থেকেই তোমার সবকিছুর আধাআধি ভাগ হয়ে গেছে। এবং সেই সবকিছুর মধ্যে সমস্যা, দুঃখ-কষ্ট এসবও পরে। তাই কখনো বলবে না তোমার একার সমস্যা , একার দুঃখ । এসবের ভাগীদার আমিও । আমি কখনোই শুধু স্বামী হয়ে থাকতে চাইনি । আমি তোমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতে চেয়েছি । তোমার সকল ব্যথা, চাওয়া-পাওয়া নিজের করে নিতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি আমাকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে চাও। ” তাহমিদ গলায় আবেগ ঢেলে বলল।

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর চোখে সুখের অশ্রুর দল এসে ভীড় করল । ও জানে, এই মানুষটা ওর ভালো থাকার কারন। এই মানুষটাকে ছাড়া কুহু এক পা-ও ফেলতে পারে না। এই মানুষটার অনুপ্রেরণা না পেলে , তাকে পাশে না পেলে কুহু কবেই হতাশায় নিমজ্জিত হত । মানুষটা ওর জীবনে এসেছে শান্তির কারন হয়ে, স্বস্তির ছায়া হয়ে। কুহু পরম ভরসায় ওর একান্ত পুরুষের বুকে মাথা রাখল।

” আপনারা কেউ কিছু বলছেন না কেন ? কি হয়েছে আমার? ডক্টর আংকেলও কিছু বললেন না। আবার আপনিও কিছু বলছেন না । মা-বড়মাকে জিজ্ঞেস করলে তারাও পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। পাঁচটা দিন ধরে আপনাদেরকে বারবার জিজ্ঞেস করছি, কি হয়েছে আমাকে বলুন। কিন্তু আপনারা আমার প্রশ্নের কোনও উত্তরই দিচ্ছেন না। এমনকি রিপোর্টও আমাকে দেখতে দিচ্ছেন না। কেন? আমাকে বলুন কি হয়েছে আমার? ” কথাগুলো বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল কুহু। তাহমিদ কিছু বলল না। শুধু ওকে জড়িত নিল বুকের মাঝে।
অনেকক্ষণ পর কুহু কান্না থামিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল।
” এভাবে চুপ করে থাকবেন না। আমাকে সত্যিটা বলুন। আপনাদের নীরবতা আমাকে পোড়াচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার । আমাকে সত্যিটা না বললে আমি ডক্টর আংকেলকে গিয়ে জিজ্ঞেস করব। ”
কুহুর জোড়াজুড়িতে শেষ পর্যন্ত তাহমিদকে মুখ খুলতেই হল।

” কুহু মা , তুই এভাবে ভেঙে পরেছিস কেন বল তো? অথচ আমরা এতদিন তোকে ধৈর্যশীলা ভেবে এসেছি। শোন কুহু মা , একটা কথা সব সময়ই মনে রাখবি , সৃষ্টিকর্তা তার প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা নিতে পছন্দ করেন। তিনি তার প্রিয় বান্দাদের দুঃখ-কষ্ট , বিপদ-আপদ, রোগ-শোকে ফেলে তাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেন। ধরে নে এটাও তোর একটা পরীক্ষা । তিনি তোর পরীক্ষা নিচ্ছেন তোকে দুঃখ দিয়ে । খোঁজ নিলে জানতে পারবি , পৃথিবীর কোনও মানুষই পরিপূর্ণ নয় । প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কোন না কোন অপূর্ণতা থাকেই । এটা মানতে হবে তোকে । তবেই তোর কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে। ” আফরোজা নাজনীন কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।
বড়মার কথায় কুহু হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। চিরপরিচিত এই ধৈর্যশীলা মেয়েটি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। কারও সান্ত্বনাবাণীতেই ওর কান্না থামছে না ।

” বারবার আমাকেই কেন পরীক্ষা দিতে হয় , বড়মা ? কি দোষ করেছি আমি ? সৃষ্টিকর্তা আমাকে এতটাই ভালবাসলেন যে আমার হবার ক্ষমতাই কেড়ে নিলেন ! আমি চিরটাকাল সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাবার চেষ্টা করেছি , সব সময় তার ইবাতদ করার চেষ্টা করেছি ৷ তবুও তিনি কেন আমাকে এত কঠিন পরীক্ষায় ফেললেন ? তারচেয়ে বরং তিনি আমার আয়ু কেড়ে নিতে পারতেন , তবুও আমি নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। মরে গিয়েও উনাকে সন্তান উপহার দিতে পারতাম। সৃষ্টিকর্তা কেন আমাকে বন্ধ্যা করলেন? যে মানুষটা আমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসে তাকে একটা সন্তান দিতে পারব না। এটা আমি মানতে পারছি না , বড়মা। আমি নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছি না , বড়মা। সব সময় আমাকেই কেন কষ্ট পেতে হয়? ” কুহু আহাজারি করে কাঁদছে ।
কুহুকে এভাবে কাঁদতে দেখে আফরোজা নাজনীনও কেঁদে ফেললেন।

” কুহু মা , তোকে এভাবে কাঁদতে দেখলে আমার ছেলেটাও যে শেষ হয়ে যাবে । তুই যত কাঁদবি, ও তত কষ্ট পাবে। আর এমনিতেও কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা । কিন্তু সেটা প্রকাশ করছে না। মা রে , মানুষের জীবনে সন্তানই সব নয় । এই যে বললি , মরে গিয়েও সন্তান উপহার দিতে পারতিস। কিন্তু তুই কি একবারও ভেবে দেখেছিস , তুই মরে গেলে আমার ছেলেটার কি হবে ? আমরা সবাই জানি , তাহমিদের কাছে তুই কি । তোকে ছাড়া এক মুহূর্ত বেঁচে থাকার কথা ও চিন্তাই করে না । তোর প্রতি ফোঁটা চোখের পানি ওকে বুকে পাঁজর ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে । ছেলেটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তুই তো কেঁদে নিজের কষ্ট প্রকাশ করছিস। কিন্তু আমার ছেলেটা যে সেটাও পারছে না । তোর কাছে একটাই অনুরোধ কান্না থামা , শান্ত হ, ধৈর্য ধর ।

তোদের দু’জনের হাসিমুখ আমরা দেখতে চাই । সন্তান না হওয়া দোষের কিছুই নয় । পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা নিঃসন্তান। তারাও কিন্তু একটা সময় সব ভুলে সুখী হতে চায় । একটা সন্তানই যদি বাবা-মাকে সুখী করতে পারত , তবে তাওহীদ আমাকে অপমান করত না। আমাকে আঘাত দিত না। সন্তান কখনো বাবা-মার সুখের চাবিকাঠি হয় না। এটা যত তাড়াতাড়ি মানতে পারবি, ততই তোর জন্য ভালো। আমার কথা শোন , চোখের পানি মুছে ফেল । সত্য মেনে নিয়ে বাঁচতে শিখ। অতীতেও তুই আমাদের কাছে যেমন আদরের কুহু ছিলি। ভবিষ্যতেও সেটাই থাকবি । একটা সন্তান কখনোই আমাদের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি করতে পারবে না । ” তাহমিনা আক্তার কুহুর হাত ধরে রেখেছেন। তিনি পরম মমতায় কথাগুলো বললেন।

শ্বাশুড়ির কথায় তার দিকে তাকায় কুহু । এই মানুষগুলোকে কষ্ট দেয়ার সাধ্য ওর নেই । কিন্তু কিছু কিছু বিষয় নিজের হাতে থাকে না । যখন শুনল এন্ডোমেট্রিওসিস নামক এক ধরনের জটিল রোগে ও আক্রান্ত। তখন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল। ও হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল । কিন্তু তাহমিদ তখনও ধৈর্য হারায়নি। ওকে ভালবেসে বুকে টেনে নিয়েছিল । আদ্র গলায় বলেছিল , চাই না আমার সন্তান সুখ । আমি তোমাকে নিয়েই সুখী হতে চাই ।
কুহু চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। ওকে মানুষটার কাছে যেতে হবে। মানুষটা ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে ।

” বউ , তোমার মলিন মুখখানা যেন এক পৃথিবীর দুঃখ আর নিরবতার স্বাক্ষী বহন করছে। যা আমার বুকে কাঁটা হয়ে বিঁধছে। বেঁচে থাকার জন্য সন্তান অপরিহার্য নয়। আমি তোমায় নিয়েই পূর্ণ। যেখানে তুমিই আমার সব, সেখানে সন্তানের কি প্রয়োজন ? এই তো দু’জনে মিলে বেশ আছি । হোক না দু’জনেই আমাদের পৃথিবী। দু’জনে হাত ধরে হাঁটব পৃথিবীর আনাচেকানাচে। কোন পিছুটান থাকবে না আমাদের । একসঙ্গে বুড়ো হব । নির্জন পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা ঘর থাকবে আমাদের ৷ সময়-অসময়ে সেখানে কেউ বাগড়া দিতে যাবে না । কোন নিয়মের বেড়াজালে কেউ আটকাতে পারবে না আমাদের। আমাদের স্বাধীন দুনিয়ায় আমরাই হব রাজা-রানি। কেমন হবে বল তো? ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কোথায় এই মানুষটা কষ্টের সাগরে ভেসে যাবে। ও কিন্তু না , এই মানুষটা যে ওকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। এমন মানুষও হয়!

” এটা পাওনা ছিল আমার । আমি একজন মায়ের কাছ থেকে তার ছেলেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি জন্যই সৃষ্টিকর্তা আমার মা হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি যদি সেদিন ভাইয়ার পক্ষে থাকতাম, সবাইকে বলতাম ভাইয়াকে মেনে নিতে, তবে আজ আমাকে কাঁদতে হত না। ভাইয়া খুব আশা করে ছিল আমার ওপর । সে বিশ্বাসই করে ফেলেছিল আমি সবাইকে রাজি করাব। কিন্তু আমি সেটা করিনি। আমি ভাইয়ার সঙ্গে বেইমানি করেছি। তার ফল আজ ভোগ করছি। ” কুহু হু হু করে কেঁদে উঠল।
কুহুকে কাঁদতে দেখে তাহমিদ অস্থির হয়ে গেল। ও কুহুর চোখের পানি সহ্য করতে পারে না ।

” তুমি আর বেইমানি! এটা কি যায় তোমার সঙ্গে? তোমার ধারনা ভুল । ভাইয়া যা করেছে , সেটা তার প্রাপ্য ছিল। এর ভেতরে নিজেকে জড়িয়ে মিছেই কষ্ট পাচ্ছ তুমি । বেইমানি তুমি করোনি। বেইমানি করেছে তাওহীদ নামের এক বেইমান। সে সবাইকে ঠকিয়েছিল । তোমার এই সমস্যার সূত্রপাত ঘটেছিল আরও কয়েক বছর আগে। তখন তো তুমি আমার বউ ছিলে না। আর আমার ভাইয়াকেও তুমি চিনতে না । এবার আমাকে বল , ভাইয়াকে না মেনে নেয়ার সাথে তোমার সম্পৃক্ততা আছে ? সে তার নিজের কর্মফল ভোগ করছে। ঐ বিষয়টার সাথে নিজেকে কেন জড়াচ্ছ ? তুমি তো কুসংস্কারাচ্ছন্ন মেয়ে ছিলে না । এসব কুসংস্কার মনে ঠাঁইও দিতে নেই। এতে কষ্ট বাড়ে বৈ কমে না। ” তাহমিদ নানানভাবে বোঝাল কুহুকে। একসময় কুহুও তাহমিদের কথা মেনে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল।

” কোকিলা , এদিকে আয় । মন দিয়ে আমার কথা শোন , সিক্তাকে দেখেশুনে রাখবি কিন্তু। ও যেমন ত্যাঁদড় মেয়ে, ওকে কোন কথাই শোনানো যায় না। বেশি লাফাতে দিবি না ওকে। শেষে দেখা যাবে আমার বাচ্চাটা পৃথিবীতে ল্যান্ড করতে না করতেই বাঁদরামি শুরু করে দেবে । এটা কিন্তু হতে দেয়া যাবে না । তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি , ওর জন্মের কয়েকদিন পরই ওকে তোর কাছে দিয়ে দেব । তুই ওর মা হবি । কারন সিক্তা একটা গাধী । ও কোন কাজেরই নয় । আমার বাচ্চাটার ঠিকমত যত্নই নিতে পারবে না ও । যেটা তুই খুব ভালো পারবি। ” আনান কথাগুলো বলে কুহুর আড়ালে চোখ মুছল।

কুহু আনানের কথা শুনে মলিন হাসল। ও জানে , আনান ভাইয়া কেন তার সন্তান ওকে দিতে চাইছে। কিন্তু কুহু তো এটা হতে দেবে না। ও কোনও মায়ের বুক খালি করে তার সন্তান নিজের কাছে রাখতে পারবে না। এতটা স্বার্থপর ও হতে পারবে না। তাই কুহু মলিন হেসে বলল,
” এমন কথা বলো না , ভাইয়া। সিক্তা মা হিসেবে পারফেক্ট হবে দেখো । আর তাছাড়া নিজের সন্তানের যত্নআত্তি করতে সব মা-ই ভালো পারে। তাই সিক্তার সন্তান সিক্তার কাছেই থাকবে। ”
” আমি কিন্তু সত্যিই বাচ্চাদের যত্ন নিতে পারি না কুহু। তোর কাছে ও থাকলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারব । ” সিক্তা কুহুর কথার প্রত্যুত্তরে বলল৷

” সিক্তা , এই বিষয় নিয়ে কোন কথা হবে না । আমি জানি, তোরা আমার জন্য নিজের সন্তানের মায়া কাটাতে চাচ্ছিস। কিন্তু আমি সেটা হতে দেব না । তোর সন্তান তোর কাছেই থাকবে। এবার তুই দুধ টুকু খেয়ে নে । ভাইয়া , তুমিও এসব নিয়ে আর কোনও কথা বলবে না। আমার শুনতে ভালো লাগে না। ”
কুহুর ধমক খেয়ে চুপসে গেল আনান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বোকা হাসল।
রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের কথপোকথন শুনল দৃষ্টি। বোনের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছল মেয়েটা । ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল । আপন মনেই বলল,

” তুমি আমাকে ধমক দিয়ে আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারবে না, আপু । আমার প্রথম সন্তানের মা হবে তুমি। হোক না সেটা দুই বছর কিংবা দশ বছর পর । যেই তুমি আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে নিজেকে উৎসর্গ করেছ , আমার সেই আপুর মুখে হাসি আমিই ফোটাব। ”

” বউ , আগামী একমাস সবকিছু থেকে ছুটি নেব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি । এই একমাস তোমার সঙ্গে কাটাব। অনেক দূরে যাব তোমাকে নিয়ে। ”
তাহমিদের বাড়ানো হাতে ধরা দিল কুহু। ওর বুকের উষ্ণতায় নিজেকে সমর্পন করল। যেন পৃথিবীর সকল নিরাপত্তা সেখানেই বিরাজ করছে। কুহুর চোখ বেয়ে ঝরে পরল এক ফোঁটা অশ্রু।
” কোথায় যাবেন? ”
” বিশ্ব ভ্রমনে। বল , তুমি কোথায় যেতে চাও? ”
” মক্কা, মদিনায় নিয়ে যাবেন আমাকে? ”

চমকে কুহুর দিকে তাকায় তাহমিদ। মেয়েটা তখনও ওর বুকে মুখ গুঁজে রয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আমার বউ যেতে চেয়েছে আর নিয়ে যাব না, এটা ঘটতে দেব বলে তোমার মনে হয়! আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে বউয়ের আদেশ অমান্য করব ! ব্যাগ গোছানো শুরু করে দাও। ”
” আপনি ভালো কেন? ”
” তুমি ভালো তাই। ”
” ভালবাসি । খুব ভালবাসি আপনাকে। ”
কুহুর কথা শেষ হওয়া মাত্রই তাহমিদ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কুহুর ঠোঁটে দীর্ঘ চুম্বন করল। এরপর ঘোর লাগা গলায় বলল,
” আমিও তোমাকে নিজের থেকে বেশি ভালবাসি, বউ। আজীবন তোমাকে এভাবেই ভালবেসে যেতে চাই । তোমাকে পেতে চাই বহু রূপে। যে রূপ দেখার অধিকার শুধু আমার। তোমাতে পূর্ণ আমি বিরাজ করতে চাই তোমার শিরা-উপশিরায়। আমার ভালবাসায় তোমাকে মত্ত করতে চাই। যতটা মত্ত হলে , আমাকে না দেখে থাকার কথা চিন্তা করলেও তোমার বুক কেঁপে উঠবে। তোমার হৃদয়ে ঝড় তুলবে আমার অনুপস্থিতি। আমার ভালবাসায় তুমি নিজেকে গরবিনী ভাববে৷ ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫৫

” আমি গরবিনী আপনার ভালবাসায়। আপনাকে ছেড়ে এক মুহুর্ত থাকার কথা আমি চিন্তাও করতে পারি না। আপনিই আমার বেঁচে থাকার কারন। আপনাতে মত্ত হয়েছি অনেক আগেই। ”
কুহুর কথা শুনে হেসে ওকে কোলে তুলে নিল। খুশিতে ওর চোখে পানি এসে গেছে । আজ সত্যিই নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে । এই ধূলির ধরায় আজীবন বেঁচে থাকার লোভ জাগল মনে। এই মেয়েটিকে আরও আরও ভালবাসার সুযোগ চায়। অনন্ত কাল এই মেয়েটার সঙ্গে কাটাতে চায়।
কুহু মুগ্ধ নয়নে দেখছে ওর পুরুষকে। যে পুরুষের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে ওর জন্য নিখাঁদ ভালবাসা। কুহু হেসে ওর পুরুষের গলা শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরল।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here