সুগন্ধি ফুল পর্ব ৫৫

সুগন্ধি ফুল পর্ব ৫৫
জান্নাত সুলতানা

-“আবরাজ।”
সকাল থেকে এই নিয়ে বউ তার এগারো বার ডাকলো তাকে। আবরাজ এবার পূরণ দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে চাইলো। শীতল এই চাহনি ফিজার সর্বাঙ্গে কম্পন ধরাতে যথেষ্ট। তবুও পিটপিট করে তাকিয়ে আছে মেয়ে টা। গতকাল থেকে কেঁদেছে প্রচুর। যার ফলে চোখমুখের অবস্থা খুব ভয়াবহ। আবরাজ ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ফেললো। হঠাৎ হঠাৎ মেয়ে টা কি যে করে হয়তো নিজেও জানে না। সে অফিস পর্যন্ত যায় নি এই মেয়ের জন্য। অথচ সে বিকেল হতেই বিছানা জুড়ে শাড়ীর মেলা বসিয়ে তাকে ডেকে যাচ্ছে। সে যতবারই উত্তর করে ততবারই আবার চুপ করে যায়। আবরাজ বিরক্ত হচ্ছে না। তবে বউয়ের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি-না ভেবে ভেবে আরও হয়রান হয়ে জবাব দিচ্ছে। এবারেও তাই হলো। সে বেশ শান্ত স্বরে বলে উঠলো,

-“কখন থেকে ডেকে যাচ্ছো। ফর হোয়াট?”
ফিজা আবারও ঠোঁট কামড়ে ধরে। আবরাজ একটু বেসামাল হয় কি? অবশ্যই হয়। বউয়ের এমন বাচ্চামিতে সে একটু নয় অনেক টা বেশি নিজের ওপর ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে। ফিজা একটা শাড়ী হাতে তুলে নিলো। পাতলা অর্গ্যানজা সিল্কের। বলাবাহুল্য আবরাজের দেওয়া প্রায় সবগুলো শাড়ী অর্গ্যানজা সিল্কের, শিফনের পাতলা শাড়ী এবং জর্জেটের পাতলা শাড়ী গুলোর মধ্যে একদম দেহের ভাঁজ স্পষ্ট করে দেওয়ার মতো মোলায়েম চকচকে। রঙ গুলো একে-অপরকে ছাপিয়ে আছে যেনো। ফিজার হাতের শাড়ির রঙটা পান্না সবুজের মতো গভীর কিন্তু হালকা ঝকঝকে। এমন শাড়ী গায়ে দিলে যেনো শরীর নিজেই আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মুখিয়ে বসে। পাড়ে রেশমি কাজ ও ছোট ছোট তামার রঙের বিটস দিয়ে সূক্ষ্ম নকশা। চলার সময় হালকা ঝনঝন শব্দ হবে এব্যাপার শাড়ী দেখে ফিজা শিওরিটি দিতে পারে। তাই এটা সে পড়বে না বলেই ঠিক করলো। এখন এই শাড়ী আবরাজ দেখলে নিশ্চয়ই তাকে এটা পড়তে বাধ্য করবে। ফিজা তাই দ্রুত হাতে সেটা আরেকটা শাড়ির নিচে ফেলে দিলো। তবে ফিজার কপাল কি আর এতো ভালো? প্রবাদ আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়৷ ঠিক যেনো ফিজার এই মূহুর্তে প্রবাদ টার সাথে নিজের পরিস্থিতির মিল খুঁজে পেলো। আবরাজ ঠিক ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। লাল টকটকে শাড়ী টার নিচ থেকে সেই সবুজ শাড়ী টা খুঁজে হাতে নিলো। ফিজার দিকে শাড়ী টা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“টেক দিস।”
এটা নাও। মানে এটা পড়ে নাও। এটাই কি বলতে চাইছে এই পুরুষ? কিন্তু এটা যে ফরসা শরীরে বেশ চকচকে দেখাবে, মেয়েলী ভাজ প্রতিটি দৃষ্টিগোচর হবে। এর আগে যা শাড়ী পড়েছে প্রায়শই শাড়ী সব শরীরের রঙের সঙ্গে মিশে যেতো। কিন্তু সবুজ আর ফরসা শরীরে শাড়ী বেশ চোখে লাগবে। ফিজা তবুও শাড়ী টা হাতে নিলো। আবরাজ ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে উঠলো,
-“নাউ, ক্যান আই হ্যাভ এ কিস?”
ফিজা প্রথমে বুঝতে পারে নি। সে তখনও শাড়ী নিয়ে ঘোরে আছে। তাই আবরাজের দিকে না তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“ইয়াহ, শিওর। হোয়াই ন,,,

যখন মনে হলো কি নিয়ে কথা হচ্ছে। কি প্রসঙ্গে এমন কথা হলো তখনই মেয়ে টার মুখ ফ্যালফ্যাল হয়ে এলো। আবরাজ বাঁকা হাসলো। বউয়ের বোকামি সে বহুদিন পর দেখলো। কবে যে দেখে ছিলো ঠিক মনে নেই। তবে এমন ভুল মাঝেমধ্যে হলে মন্দ হয় না। নিজের অধরে বউয়ের অধর চেপে ধরে গভীর এক অধর চুম্বনে লিপ্ত হলো আবরাজ। ফিজার দম আঁটকে আসে। যখনই আবরাজ নামক পুরুষের এই শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ তার নাজুক নরম ঠোঁট স্পর্শ করে তখনই তাকে ক্ষত-বিক্ষত করতে ভুলে না। আবরাজ সময় নিলো। নিজ থেকে ছাড়ার অভ্যাস এই পুরুষের ডিকশনারিতে বোধহয় নেই। না কর্ম ছাড়লো না নিজের বউ কে আর নাই নিজের শত্রুদের। দানবীয় হাতের বিচরণ যখন নিজের কোমরে ফিজার হাত টা তখন আবরাজের চুলের দিকে ঠিক ঘাড়ে খামচে ধরে আছে। আবরাজ যখনই তাকে আদুরে স্পর্শ করে সাথে থাকে তার সেই চিরচেনা অভ্যাস। বউ কে ক্ষত-বিক্ষত করতে পুরুষ টার ভালো লাগে। এবারও ব্যাতিক্রম হলো না। শেষ মূহুর্তে এসে শব্দ করে চুমু খেয়ে তবেই ছাড়লো। ছাড়ার সাথে সাথেই বউ কে জড়িয়ে ধরে বলে স্লো ভয়সে ফিসফিস করে বললো,
-“এখন একটু কাঁদো৷ রাতে প্রচুর কাঁদাব গড প্রমিজ, মিসেস আবরাজ খান।”

একই বাড়িতে থেকেও মেহরিন বোনের সাথে দেখা করতে পারছে না। কিছু টা ইচ্ছে করে আবার কিছু টা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। প্রথমত সে জানে বোনের সাথে দেখা করলে সে এ-সব বলা থেকে নিজে কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত বোনের জীবনে কি দুঃখ কম আছে? উঁহু, দীর্ঘ চার বছর স্বামী তাকে ফেলে দূরে ছিলো। এরপর যখন এলো তখন একটু সুখের আশা কি দেখা দিয়ে ছিলো সেটাও এখন অমাবস্যার চাঁদ। বিয়ের সাড়ে পাঁচ বছরে এসে মাতৃত্ব সাধ পেতেই যাচ্ছিলো সেটাও মরিচীকা মাত্র হয়ে ধরা দিলো। যার কোনো ভিত্তি নেই। মেহরিন এতো কিছু ভেবেছে কখনো? উঁহু, বোনের একতরফ কষ্ট সে বা কেউ উপলব্ধি করে নি। এখন সে কি একটু অনুমান করতে পারছে বোন তার ঠিক কতোটা কষ্ট ছিলো? সে-ও নিশ্চয়ই এই কষ্ট কখনোই বুঝতে পারতো না। যদি না তার-ও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো।

গভীর চিন্তাভাবনা কিংবা নেগেটিভ পজিটিভ দিক কোনটাই মেহরিন করে না। সর্বক্ষণ চুপচাপ আর নিজের মতো থাকতে স্বাচ্ছদ্যবোধ করে। অথচ তার জীবনে জড়িয়ে যাওয়া বিশেষ মানুষ টা তাকে কত কিছু চিনতে সাহায্য করেছে। এটাও দুঃস্বপ্ন। মেহরিন ফ্লোরে বসে আছে। এলোমেলো পোশাকআশাক বিধস্ত, বিবরণ, মলিন হয়ে থাকা চেহারা। চোখ ফুলে আছে। নাদুসনুদুস মুখ। নিশ্চয়ই বাজে লাগে? একদম নয়। আব্রাহামের নিকট চমৎকার লাগে এই রমণীর এমন বিধস্ত রূপ কেও। সে আয়েশ করে বসে আছে বিশাল আকারের মাস্টার বেড রুম টার ঠিম মাঝের বেগুনি কার্পেটের ওপর ফেলে রাখা ধূসর রঙের সোফায়। পুরুষ টার চলাফেরায় রাজকীয় একটা ভাব সবসময় থাকে। যেমন টা আগে মেহরিন শুধু এবং শুধুই আবরাজ খানের অধীন ভাবলেও এই একই রকম ভাবসাব যে আব্রাহাম খানের মধ্যে ও বিদ্যমান থাকতে পারে সেটার ধারণা তার ছিলো না। আবরাজ খান কে নিয়ে সে মা এবং বোনের কাছেই বেশি জেনেছে। তবে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আব্রাহাম খান কে।

ডান পা বাঁ পায়ের ওপর তুলে বসে আব্রাহাম। পুরুষ টার হাতে তখন সিগারেট। সব কিছু ঠিক ছিলো। এরমধ্যে এই সিগারেটের বর্ণনা করতে মেহরিনের একদমই ভালো লাগলো না। সে নিজের দৃষ্টিতে বিরক্তি প্রকাশ করে চক্ষুদ্বয় ঘুরিয়ে নিলো। তবে সামনে বসা পুরুষের একদম ভালো লাগলো না সেটা। আত্মসম্মান প্রখর কি-না এই পুরুষের! তার বউ তার দিকে তাকাবে। ড্যাবড্যাব করে তাকাবে। সারাদিন তাকিয়ে থাকবে। অবভিয়াসলি সে তাকানোতে মুগ্ধতা নিয়ে তাকাবে। তাকে দেখবে মন দিয়ে দেখবে। চোখে থাকবে স্নিগ্ধতা। সেই দৃষ্টিতে বিরক্ত কেনো আসবে? ছোট্ট একটা গোল পাত্র। আধসাদা, ধূসর ছাইয়ে ভরা। চারপাশে কয়েকটা দাগ। সময়ের ছোঁয়ায় কালচে হয়ে গেছে। পাত্রের কিনারায় আধপোড়া একটা সিগারেট পড়ে আছে। সেখানেই আব্রাহাম আবরাও আধখাওয়া সিগারেটে গুঁজে রাখলো। ছাইয়ের স্তূপে জড়িয়ে আছে বহুদিনের নীরবতা। অনেকদিন হয় পুরো একটা সিগারেট খাওয়া হচ্ছে না। ভালো লাগছে না কেনো জানি। আব্রাহাম গম্ভীর হয়ে বসে থেকেই তর্জনী আঙুল টা বাঁকিয়ে ইশারা করে মেহরিন কে ডাকলো,

-“কাম হেয়ার।”
মেহরিন চাইলো। দৃষ্টিতে কোনো জড়তা নেই। যার অর্থ সে আসবে না। আব্রাহাম ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কি অদ্ভুত সে মেয়ে টার দৃষ্টি পড়তে পারে অথচ মেয়ে টার মন পড়তে জানে না। মেহরিন আসে না। আব্রাহাম ওঠে দাঁড়ালো। মেহরিনের সামনে এসে ঝুঁকে আচমকাই কোলে তুলে নিলো ওকে। মেহরিন চমকে গেলো তবে গলা জড়িয়ে ধরলো আব্রাহামের। আব্রাহাম ওকে কোলে নিয়ে সোফায় বসলো আবার। এরপর রয়েসয়ে পুরুষ টা বলে উঠলো,

সুগন্ধি ফুল পর্ব ৫৪

-“চলো আমার একটা গেইম খেলি। যদি এভাবে বসে থেকে তোমার বিরক্তি চলে আসে তাহলে আমি তোমার সামনে বসে থাকবো, আর যদি বিরক্তি না আসলে তুমি আমার সামনে বসে থাকবে, ডিল ইজ ডান ফুলিশ গার্ল!”
মেহরিন চমকাবে না-কি থমকে যাবে? সে সেই হিসাব কষতে গিয়ে যখন চিন্তায় বিভোর আব্রাহাম তখন নিজের কাজে ব্যাস্ত। মেয়ে টার বিরক্ত নয়। লজ্জা ঘিরে ধরলো মূহুর্তে। গলায় রাখা হাত টা আস্তে আস্তে শীতল হয়ে এলো।

সুগন্ধি ফুল শেষ পর্ব