সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ৩৪+৩৫+৩৬

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ৩৪+৩৫+৩৬
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

চাঁদ কারো থেকে মাহিমের নাম শুনে ঘৃণা নিয়ে মনে মনে বলল,” তুই আসলেই জানোয়ার মাহিম। প্রতি নিয়ত এতো মানুষ মরে! তুই মরতে পারিস না? তোর মরণ হয় না কেন? মাশুম বাচ্চাটার চোখের পানি মূল্য তোকে দিতেই হবে, মিলিয়ে নিস।” কথাটা বলে চাঁদ ঘুমন্ত ইচ্ছের দিকে তাকাল।

একে একে সবাই কবরস্থান থেকে বাসায় ফিরল। রনিতের বাবা মা আর বড় ভাই এসেছিলেন। রনিত এবং ইচ্ছের মামা ভিডিও কলে মৃত বোনকে দেখল। ইচ্ছের মামা জীবিত থাকতে বোনের খোঁজ নেয়নি৷ অথচ বোনের মৃত্যুতে ঠিকই অশ্রু ঝরাচ্ছে। ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝেনা’ ব্যাপারটা ঠিক এই রকম। বেশ কিছুক্ষণ পর প্রত্যয় প্রিয়ম ফিরে আগে ইচ্ছের কাছে গেল। ইচ্ছে প্রত্যয়দের ফ্ল্যাটে ঘুমাচ্ছে। তুয়া ছলছল চোখে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ই খুব কষ্ট হচ্ছে, আর ইচ্ছে বাবা মা সে তো কাঁদবেই! এদিকের সব কাজ সম্পূর্ণ করে প্রত্যয়রা বাসায় ফিরতে চাচ্ছিল। তখন তুয়ার আব্বু আম্মু ওদের বাঁধ সাধলেন। প্রত্যয় উনাদের বুঝিয়ে বললেন, এখানে ইচ্ছে থাকলে আরো ভেঙে পড়বে। ওর বাবা মাকে খুঁজবে, কান্না করবে। তখন ওকে সামলানো আরো মুশকিল হয়ে যাবে। একথা শুনে উনারা প্রত্যয়ের কথা মেনে নিলেন। প্রত্যয়দের কারো মন ভাল নেই! তাই জোরাজুরি করেও কেউ কিছু মুখে দিল না। মূলত এখন সবাই ইচ্ছেকে নিয়ে বেশ চিন্তিত।
এদিকে, ইচ্ছে ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল। চাঁদ বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছে। এজন্য সে ইচ্ছের যাওয়াটা টের পেল না। আর বাকিরা তুয়াদের বাসায় কথা বলছিল। যাতে ইচ্ছের ঘুমটা নষ্ট না হয়। নিচে ইচ্ছেদের আগের ফ্ল্যাটে গিয়ে ইচ্ছে দরজা ধাক্কাচ্ছে। আর কেঁদে কেঁদে ডাকছে,”আম্মু!আম্মু! দলজা খুলো। আমি বাছায় যাব। আব্বু! দলজা খুলো! তোমাল লাজকন্যা দুঃখু পাচ্ছি। আমি ডাকছি আব্বু! আম্মু! ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তুরাগ ফোনে রিচার্জ করে উপরে উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। ইচ্ছে করুন সুরে ওর আব্বু আম্মুকে ডাকছে। কেঁদে কেঁদে পুরো মুখটা লাল করে ফেলেছে। ডাগর ডাগর চোখে দু’টো থেকে অঝরের অশ্রু ঝরছে। ওর হাতে পায়ে এখনও ব্যান্ডজ করা। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকিও উঠে গেছে। তুরাগ ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে বলল,”জানপাখি কাঁদে না সোনা। তুমি তো গুড গার্ল আমার সোনা পাখিটা।” ইচ্ছে এখন কারো কথা শুনতে নারাজ। ওর এখন আব্বু আম্মুকে চাই-ই চাই। ইচ্ছে আম্মু! আম্মু! করে উচ্চ শব্দে কাঁদছে। ইচ্ছের কান্না শুনে প্রিয়ম দৌড়ে এসে ইচ্ছেকে কোলে নিল। ইচ্ছে প্রিয়মের গলা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বমি করে দিল। তুরাগ ইচ্ছের কপালের দুইপাশ চেপে ধরল। প্রত্যয় পানি এনে ইচ্ছের মাথায় পানি দিয়ে, একটু পানি খাওয়াল। ইচ্ছে প্রত্যয়ের কোলে গিয়ে বুকের সাথে লেপ্টে গেল। যেন নিষ্প্রাণ একটা দেহ। প্রত্যয় পকেট থেকে রুমাল বের করে ইচ্ছের মাথা মুছে ইচ্ছেকে নিয়ে গাড়িতে বসল। প্রিয়ম ওর আম্মুদের ডেকে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল। তুয়ারা এসে গাড়িতে বসলে গাড়ি চলতে শুরু করল। ইচ্ছে ক্লান্ত হয়ে থেমে থেমে ফুপাচ্ছে। চিৎকার করে কান্নার ফলে ইচ্ছের গলা বসে গেছে।
প্রিয়ম আদুরে সুরে ইচ্ছেকে বলল,”ইচ্ছেমনি আমার সঙ্গে কথা বলবেনা? আমি কিন্তু মেলা দুঃখু পাচ্ছি।” তুয়া কান্নারত কন্ঠে বলল,” ইচ্ছে পুতুলের বিয়ে দিবি না?” ইচ্ছে কারো সঙ্গে কথা বলছেনা। শুধু বার বার কপালে হাত দিচ্ছে। প্রত্যয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আলতো করে ইচ্ছের কপাল টিপে দিতে লাগল। আরাম পেয়ে ইচ্ছে চোখ বন্ধ করে নিল। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল,”ইচ্ছেমনি চানাচুর খাবে? তুমি না খেলে কিন্তু প্রিয়ম পুরোটা খেয়ে নিবে।” ইচ্ছে বসে যাওয়া গলাতে বলল,”প্রত্তুয় আমি কানাচুর থাবো না। আমি আম্মু যাব।”

ইচ্ছের মনযোগ ঘুরাতে প্রিয়ম পার্কের সাইডে গাড়ি থামাল। তারপর ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে বেলুন ওয়ালার কাছে গেল। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি, হরেক রকমের বেলুন আছে। বেলুন গুলোর কানও আছে। সাথে স্মাইলিং ইমুজি বেলুনও আছে। প্রিয়ম ইচ্ছেকে বেলুন দেখিয়ে মন খারাপ করে বলল,” না হাসলে বেলুন ওয়ালা আমাদেরকে বেলুন দিবে না। এবার কি করব?” বেলুন ওয়ালা ভাবলেন এরা বাবা মেয়ে। বাবা বেলুন দিয়ে মেয়ের রাগ ভাঙ্গাচ্ছেন। তাই উনি হেসে বললেন,”একটু হাসো তো আম্মা তাহলে বেলুন দিমু।” ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে ছলছল চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। তারপর দাঁত দেখিয়ে বলল,”এই যে আমি হাসচি।” ইচ্ছের কথা শুনে প্রিয়ম আর বেলুন ওয়ালা দু’জনে হেসে উঠল। প্রিয়ম অনেক গুলো বেলুনের সুঁতো ইচ্ছের হাতের কব্জিতে বেঁধে দিল। হরেক রকম বেলুন একসঙ্গে বাতাসে উড়তে লাগল। উড়ন্ত বেলুন দেখে ইচ্ছের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটল।

প্রত্যয় গাড়িতে বসে ওদেরকে দেখছে। একটু আগে ইচ্ছে কাঁদছিল। আবার এখন বেলুন পেয়ে হাসছে। একেই বলে বাচ্চা! চাঁদ তুয়া গাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়াল। প্রিয়ম দোকানে গিয়ে অনেকগুলো চকলেট কিনে ইচ্ছেকে দিল। তবুও ইচ্ছের মনটা একটু ভার হয়ে আছে। তারপর প্রিয়ম পুনরায় ইচ্ছেকে প্রত্যয়ের কোলে দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগল। তুয়া চাঁদ ইচ্ছের থেকে চকলেট আর বেলুন চাচ্ছে। ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে ওদের বলল,”উম! এগুলো ছব আমাল।” কথাটা শুনে প্রত্যয় মুচকি হেসে ইচ্ছের বেলুন গুলো জানালার বাইরে রাখল। উন্মুক্ত বাতাসে বেলুন গুলো অবাধ্য হয়ে উড়তে লাগল। তখন ইচ্ছে মিষ্টি হেসে উড়ন্ত বেলুনগুলো দেখতে লাগল।

চাঁদ জানালার বাইরে দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে, পৃথিবীতে খারাপ মানুষ না থাকলে বেশ ভাল হত। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। কারন ভাল মন্দের পালা নিয়েই তো পৃথিবী। আচানক বেলুন ফাটার শব্দে চাঁদ চমকে উঠল। ওরা জ্যামে আঁটকে গেছে। পাশের গাড়িতে থাকা একটা মেয়ে পিন দিয়ে পরপর দু’টো বেলুন ফুটো করে দিয়েছে। বেলুন ফাটতে দেখে ইচ্ছে কেঁদে দিল। প্রত্যয় মাথা বের করে কিছু বলার আগে তুয়া হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নেমে গেল। প্রত্যয়ের আব্বু জিজ্ঞাসা করলেন,” আম্মু নামছ কেন?” তুয়া,’একটু দরকার আছে আব্বু’ বলে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গেল। আর দৌড়ে পেছনের দিকে গেল। প্রত্যয় ইচ্ছেকে প্রিয়মের কোলে দিয়ে সেও তুয়ার পিছু নিল। আর বলে গেলে, ওদের চলে যেতে। তুয়া কারন ছাড়া এভাবে বের হত না আর একথা প্রত্যয়ের অজানা নয়। সেই কারনটা জানতেই প্রত্যয় তুয়ার পিছু গেল। প্রিয়ম ইচ্ছেকে পাশের সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দিল। একটু চিন্তিত হয়ে ইচ্ছের সঙ্গে গল্প করতে লাগল। প্রায় দশ মিনিট পর, জ্যাম ছুটলে প্রিয়মরা বাসার দিকে রওনা হল।

তুয়া প্রত্যয়কে নিয়ে নামীদামি একটা কফিশপে এসেছে। ওদের ঠিক সামনের চেয়ারে একজন মাথা নিচু বসে আছে। প্রত্যয় কফি অর্ডার করে অন্য চেয়ারে গিয়ে বসল। তুয়া তখন শান্ত ভঙ্গিতে বলল,”মিতু তুই আমাকে এড়িয়ে চলিস কেন? আমি ধর্ষিতা বলে নাকি অন্য কোনো কারণে?” মিতু নিরুউত্তর রইল। তুয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,”বাহ! এই তোর বন্ধুত্ব? ধর্ষিতা হয়েছি বলে এভাবে পর করে দিলি?” মিতু দাঁত কটমট করে বলল,” কেন এড়িয়ে চলি তোর আরেক বফ প্রিয়মকে জিজ্ঞাসা কর। গাছেরও খাবি আবার তলারও কুড়াবি। আর ভেবেছিলি আমি কিছু বুঝব না?” তুয়া অবাক হয়ে বলল,”প্রিয়ম আমার বফ? একথা তুই বলতে পারলি?” মিতু আরো একটু চেঁতে উঠে বলল,”ভুল কি বলেছি? মজা তো দু’জনের থেকেই নিস। এখন আবার সাধু সাজছিস?” তুয়া কিছু বলার আগে প্রত্যয় তুয়ার পাশের চেয়ারে বসে বলল,” ভাষা সংযত করে কথা বলুন। সংযত ভাষা হচ্ছে ভদ্রতার পরিচয়” মিতু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,” ডক্টর প্রত্যয় নিজে অক্ষম বলে বউয়ের দায়িত্বটা ভাইকে দিয়েছেন ? নাকি অন্য কোনো ঘাপলা আছে?”

মিতু কথাটা শেষ করতেই মিতুর গালে একসাথে দু’টো থাপ্পড় পড়ল। বাম গালে দিয়েছে তুয়া আর ডান গালে দিয়েছে প্রিয়ম। একসাথে দু’টো থাপ্পড়ে মিতুর নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে ওর মাথা ঘুরতে লাগল। প্রিয়ম কখন এসেছে কেউ বুঝতে পারেনি। প্রিয়ম রেগে মিতুকে দাঁড় করিয়ে আরেকটা থাপ্পড় বসাল। প্রত্যয় দ্রুত উঠে প্রিয়মকে থামাল। তখন মিতুর বফ কফিশপে প্রবেশ করল। এবং মিতুর করুণ অবস্থায় দেখে চেচিঁয়ে উঠল। মিতুর বফ হচ্ছে ডক্টর কাউসার। প্রত্যয় কাউসারকে দেখে অবাক হলেও প্রকাশ করল না। কাউসার দ্রুত মিতুকে ধরে বসিয়ে পানি খাওয়াল। প্রত্যয় পুরো কফিশপ এক ঘন্টার জন্য বন্ধের ব্যবস্থা করল। যাতে ব্যাপারটা সোস্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল না হয়। যুগ হিসেবে এখন তো এসবই বেশি হয়। তাই বুদ্ধিমানের মতো প্রত্যয়ের এই ব্যবস্থা। তুয়া মিতুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ওর রুচি হচ্ছে না মিতুর সঙ্গে কথা বলার। থাপ্পড় খেয়ে মিতুর অবস্থা খুব খারাপ।
প্রিয়ম রেগে কিছু বলার আগে প্রত্যয় ওকে থামিয়ে মিতুকে বলল,”এসব কথা বলতে আপনার বিবেকে বাঁধল না? যদিও বিবেকহীন মানুষরা সবই পারে। হুম এটাও জানি! আপনি তাদের দলেরই অন্তর্ভুক্ত। সে যাই হোক, নিজের ফেন্ডকে ধর্ষিতা প্রমান করে খুব শান্তি পেয়েছিলেন, তাই না মিস মিতু?
তুয়া হতবাক হয়ে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল।

প্রত্যয় আবার বলতে শুরু করল,” হুম! প্রিয়ম আপনাকে কলেজ থেকে টিসি নিতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু আমি আপনাকে সুযোগ দিতে চেয়েছিলাম। কারন আমি ভেবে ছিলাম আপনি নিজেকে শুধরে নিবেন। কিন্তু আপসোস অমানুষরা মানুষের আয়ত্তে থাকেনা। তাই নিজেদের শুধরাতে পারেনা। ” এসব শুনে তুয়ার মাথাতে একটা প্রশ্ন এসে ধাক্কা খেলো,’এসবের পেছনে মিতু ছিল?’ আর এসব প্রত্যয় প্রিয়ম জেনেও ওকে জানায়নি। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তুয়ার মস্তিষ্কশূন্য হয়ে হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। প্রত্যয় তুয়ার সামনে পানির গ্লাস এগিয়ে খেতে বলল। কাউসার তখন রেগে প্রিয়মকে বলল,” মাদ*** ওকে মারার সাহস কোথায় পে?” কথাটা শেষ করার আগে প্রত্যয় স্বজোরে কাউসারের নাক বরাবর ঘুষি মেরে শান্ত কন্ঠে বলল,”খবরদার মা তুলে কথা বলবেন না।” কাউসার নাক ধরে তাৎক্ষণিক মেঝেতে বসে পড়ল। প্রিয়ম তখন বলতে লাগল ,
-“ডক্টর কাউসার মিতুর আপন খালাতো ভাই সাথে বফও হয়। ওরা দু’জন বখাটেকে টাকা দিয়ে এসব করিয়েছিল। মিতুর রাগ তুয়ার উপর আর কাউসারের রাগ ভাইয়ার উপর। মিতু তুয়ার বান্ধবী হলেও বরাবরই সে হিংসুটে টাইপের। মিতু পূর্ব নামের এক ছেলে পছন্দ করত। কিন্তু ছেলেটা নাকি তুয়াকে পছন্দ করত। আর মিতু ভাবত তুয়া এখানে কলকাটি নেড়েছে। তাছাড়া তুয়ার ডায়রীতে ভাইয়াকে নিয়ে হয়তো কিছু লিখা ছিল। সেটা মিতু দেখেছিল এবং মনে মনে তুয়ার উপর রেগে ছিল। কারন মিতু প্রথম দেখাতে ভাইয়াকে পছন্দ করেছিল। আগের বারের মতো তুয়া ভাইয়াকেও ওর থেকে নিয়ে নিল।

এদিকে, ডক্টর কাউসারের ভাইয়ার প্রতি রাগের কারণ ছিল ভিন্ন। একদিন অন্য হসপিটালে ভাইয়া এক পেশেন্টের সার্জারি করতে গিয়েছিল। অপারেশন চলাকালীন কাউসার ভাইয়াকে দ্রুত হসপিটালে ফেরার খবর পাঠায়। কারন ভাইয়ার হসপিটালে কাউসারের মাকে ভর্তি করা হয়েছিল। উনিও ছিল হার্টের পেশেন্ট। উনার মায়ের অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। একথা কাউসারও জানত। সার্জারি চলাকালীন পেশেন্টকে ফেলে সেদিন যেতে পারেনি ভাইয়া। ডক্টর ঈশান প্রাথমিক চিকিৎসা করার আগে কাউসারের মা মারা যায়। তখন থেকে কাউসারের ভাইয়ার প্রতি এতো রাগ। সে ভাবে ভাইয়ার অবহেলায় ওর মাকে হারিয়েছে। আর এরা দু’জনই রাগ তুলতে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে তুয়াকে। মিতু ভেবেছিল, ধর্ষণ না হয়েও ধর্ষিতার কালিমা তুয়া সহ্য করতে পারবেনা। ফলস্বরূপ সে সুইসাইড করবে আর মিতুর পথ পরিষ্কার হবে। তারপর বুদ্ধি খাঁটিয়ে ভাইয়ার মনে নিজের জায়গা তৈরী করে নিবে। কিন্তু অপাসোস ওদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। মিতুকে অপহরণ করে ভয় দেখিয়ে আমি এসব জেনেছি। আর মিতুকে টিসি নিয়ে অন্য কলেজে যেতে বাধ্য করেছি।”

মিতু টিস্যুতে নাকের রক্ত মুছে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”বেশ করেছি। আমার সব পছন্দের জিনিস সব সময় ওই কেড়ে নেয়। দরকার হলে ভবিষ্যতেও করব।” তুয়া ছলছল চোখে মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মিতুকে তার বড্ড অচেনা লাগছে। এদের দু’জনের মুখেই একবিন্দু অপরাধবোধের চিহ্নটুকু নেই। কাউসার এখনও প্রত্যয়কে অপরাধী ভাবে। এতে প্রত্যয়ের কিছু যায় আসেনা। কারন আল্লাহ জানে তার মনের কথা। প্রিয়ম কথাগুলো বলে চুপ হয়ে গেল। তুয়া দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কাঁদছে। প্রত্যয় তুয়াকে নিয়ে দুই পা বাড়িয়ে কাউসারের দিকে তাকিয়ে বলল,”আমার হসপিটাল আপনাকে আর প্রয়োজন হবেনা। আমি মনে করি ‘দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভাল।’
কথাটা বলে আর না দাঁড়িয়ে তিনজনে বেরিয়ে গেল। কাউসার আর মিতু বসে রাগে ফুঁসতে লাগল। ওইদিকে, ইচ্ছে চাঁদের সঙ্গে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে গেছে। প্রত্যয় বাসায় ফিরে ইচ্ছেকে ওদের বেডের মাঝখানে শুইয়ে দিল। তারপর ওরা ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ইচ্ছের পাশে শুয়ে পড়ল। মিতুর কাজে তুয়া বোকার মতো কান্নাকাটি করল না। বরং বিপদ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাল। প্রত্যয় অপর পাশে আধশোয়া হয়ে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিল। ডক্টরদের তো ডিগ্রী আর পড়ার শেষ নেই। তুয়া গলা খাকারি দিয়ে প্রত্যয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে দিল। প্রত্যয় তুয়ার কাজে মুচকি হাসল। তুয়া শুয়ে শুয়ে ওর বই পড়তে লাগল। কারন কিছুদিন পর ওর এইচএসসি পরীক্ষা।

এদিকে ইচ্ছে সরতে সরতে তুয়ার কোলের মধ্যে ঢুকে গেছে। রাত একটার দিকে কেবল তুয়ার চোখ দু’টো লেগে এসেছিল। আর প্রত্যয় পানি খাচ্ছিল। হঠাৎ ইচ্ছে ঘুমের ঘোরে তুয়ার বুকের কাছে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল,”আম্মু দিদি থাব! দিদি দাও! আম্মু! দিদি থাব! ইচ্ছের এমন কাজে তুয়া হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। প্রত্যয় তুয়া দু’জনেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছের এখনও বেষ্ট ফিডিংয়ের অভ্যাস আছে, একথা ওরা জানত না। সারাদিন না খেলেও রাতে ঘুমানোর আগে খাওয়া ওর অভ্যাস। এজন্য ঘুমের ঘোরে তুয়াকে ওর আম্মু ভেবেছে। তুয়া ছলছল চোখে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটা ঘুমের ঘোরেও ওর আম্মুকে খুঁজছে।
প্রত্যয় ইচ্ছেকে সুন্দর করে শুইয়ে বলল, ” এই মাশুম বাচ্চাকে সামলাব কিভাবে? এতো এখনও দুধের বাচ্চা।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩৫]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

পরেরদিন অফিসে যাওয়ার পথে তুরাগের সঙ্গে ইলার দেখা হয়ে গেল। তুরাগ না দেখার ভাণ করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। ইলা তুরাগের পথ আঁটকে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,”শুনলাম গ্রামের গেঁয়ো একটা মেয়েকে বিয়ে করেছ?অবশেষে গেঁয়ো মেয়ে জুটল তোমার ভাগ্যে, আহারে!” তুরাগ নিরুত্তর হয়ে ইলার মুখের দিকে তাকাল। ইলার কথাবার্তা চাল চলনে অহংকার ঝরে পড়ছে। তুরাগকে চুপ দেখে ইলা পুনরায় হেসে বলল,”বামুন হয়ে চাঁদ হাত বাড়ালে এমনই হয়। থাক কষ্ট পেও না! একদিন বউকে নিয়ে চেম্বারে এসো দান হিসেবে নাহয় ফ্রিতে চিকিৎসা দিব।”
কথাটা শুনে তুরাগ ওর ঘাড়টাকে ডানে বামে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,” ফকিন্নির দান আমার প্রয়োজন নেই।” তুরাগের কথায় ইলা রেগে আঙ্গুল তুলে বলল,”হাও ডেয়ার ইউ তুরাগ? মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ।” তুরাগ হেসে ইলার আঙ্গুল নামিয়ে বাঁকা হেসে বলল,”সম্পর্ক চলাকালীন আমার থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে এখন এসেছিস ভাষণ শুনাতে?বাহ রে! বাহ! এই না হল শিক্ষিত বুদ্ধিমতী ফকিন্নি। যার কাছে সম্পর্কের চেয়ে টাকার মূল্য সবচেয়ে বেশি। সে নাকি আমাকে দান করবে, হাস্যকর তো।” ইলা চুপ হয়ে আড়চোখে তুরাগের দিকে তাকাল। তুরাগ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”হুম আমি তোর মতো শিক্ষিত, সুন্দরী, ম্মার্ট বউ পায়নি। কিন্তু একটা মানুষকে বিয়ে করেছি, অমানুষকে নয়। পথ ছাড়! তোর মতো মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে রুচি বাঁধছে, ইয়াক থু!”

কথাটা বলে তুরাগ গাড়িতে বসে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। ইলা রেগে তুরাগের গুষ্ঠি উদ্ধার করতে লাগল। ওদের সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়েছে ইলার লোভের জন্য। ওদের সম্পর্ক চলাকালীন ইলা অযুহাত দিয়ে তুরাগের থেকে লাখ লাখ টাকা নিত। ওর এটা ওটা আবদার প্রায় লেগেই থাকত। তুরাগও সরল মনে ইলার সব আবদার পূরণ করত। প্রিয় মানুষটার আবদার তুরাগ কখনও অপূর্ণ রাখত না। এখন সেই ইলা ডক্টর হওয়ার পর তুরাগকে এড়িয়ে চলে। কথায় কথায় অপমান করে ছোট করে। তুরাগ ওর ব্যবহারে কষ্ট পেলেও হেসে উড়িয়ে দিত। কিছুদিন পর তুরাগ জানতে পারে, ইলা একজন ডক্টরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তখন ইলা একথাটা অকপটে অস্বীকার করে। ওদের এনগেজমেন্ট ঠিক পর ইলা সেই ডক্টরের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়। একথা ইলার বান্ধবী তুরাগকে প্রমানসহ দেখায়। তুরাগ ইলাকে জিজ্ঞাসা করায় তখন ইলা এবার স্বীকার করে নেয়। এবং অহংকারী গলায় বলে,”আমার সঙ্গে তোমাকে মানায় না তুরাগ। আর সমানে সমানে নাহলে আমি সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারব না।” ইলার কথা শুনে তুরাগ ভেজা কন্ঠে বলেছিল,”অহংকার পতনের মূল। তোরও খুব শীঘ্রই পতন ঘটবে। তোর নোংরা শরীর বেঁচে তুই আরো বড়লোক হ, ব্লাডি বিচ।”

একথা বলে তুরাগ ইলার সঙ্গে সম্পর্কের ইতি ঘটিয়েছিল। এবং মূলত এজন্যই তুরাগ তিন্নিকে বিয়ে করে। যাতে ইলার নামটা ওর জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারে। তুরাগ ইলাকে সত্যিই খুব ভালবাসত। কিন্তু ইলার তো ভালবাসা নয়! বেশি বেশি টাকা আর হাই সোসাইটি প্রয়োজন ছিল। এজন্য সে তুরাগকে ফেলে এক ডক্টরকে বেঁছে নিয়েছে। কারন নিঃসন্দেহে ডক্টরদের অনেক টাকা।
রনিতের আম্মু লাল শাকের বেঁছে সেগুলো কাটছেন। আর
দিশা কাঁচা মরিচের বোঁটা ছাড়াচ্ছে। সে এখন সংসারে টুকটাক কাজ করে। স্বামীর মার খেয়ে শাশুড়ির সঙ্গে আর খারাপ ব্যবহার করেনা। একটুদূরে রনিতের দাদী বসে পান সাজাচ্ছেন। দিশা ওর শাশুড়ি আর দাদী শাশুড়ির দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বলল, “মা একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? ওই ডাক্তার ইচ্ছেকে উনার কাছে রেখে দিল। কিন্তু উনি স্বার্থ ছাড়া ইচ্ছেকে রেখেছে বলে মনে হচ্ছে না ?” রনিতের দাদী পানে চুন লাগাতে লাগাতে বললেন,”হ্যাঁ লো নাতবউ কথাখান তো ভাবিনি লো। কি স্বার্থে ডাক্তার ছেড়িডারে রাখল ক দেহি?”
দিশা আলু টুকরো করে কেটে রেখে বলল,”ক্যান দাদী ইচ্ছের বাপ মায়ের মেলা টাকা পয়সা আছে তো। আবার ইচ্ছেদের ঘরভর্তি জিনিসপত্রও তো কম না। ওই ডাক্তার বুদ্ধি করে সবটাই গুপ্তাই নিল। বিনামূল্যে অন্যের বাচ্চাকে পালার যুগ আর নাই দাদী।” রনিতের আম্মু কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে বললেন,”পলক মরার দিন ডাক্তারের স্ব-পরিবারকে দেখালাম। দেখে তো উনাদের এমন মনে হল না। পোশাক- আশাক আর দামী গাড়ি দেখে মনে হল টাকা পয়সা ওয়ালা। ওরা এসব নিবে কেন?” শাশুড়িকে অন্য সুরে কথা বলতে দেখে দিশা মুখ বাঁকিয়ে বলল,”যার যত বেশি থাকে সেই তত লোভী হয় আম্মা। তাছাড়া ইচ্ছে কি ডাক্তারের রক্তের কেউ যে সারাজীবন বিনাস্বার্থে পালবে?”
দাদী পুরো পান মুখে পুরে সুর টেনে বললেন,” হ লো বইন ঠিকই কইছোস। এই যুগে মা মরলে বাপ তালোই হয়। আর ডাক্তার তো ছেড়িডার বংশের আনাকোণারও কেউ না।”

প্রত্যয় আজকে সকাল থেকে ইচ্ছেকে সময় দিয়েছে। চাঁদ তুয়া দু’জনেরই পরীক্ষা। তাই ওরা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। ইচ্ছে ঘুম থেকে উঠে ওর আব্বু আম্মুর জন্য কাঁদছিল। প্রত্যয় প্রিয়ম আর ওদের আম্মু মিলে অনেক কষ্ট থামিয়েছে।
প্রত্যয়ের আব্বু ইচ্ছেকে নতুন পোশাক এবং খেলনা এনে দিয়েছে। ওগুলো পেয়ে ইচ্ছে খুব খুশি।
দুপুরে প্রত্যয়রা সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। ইচ্ছে চেয়ারে বসে টেবিলে হাত পাচ্ছে না। তাই ওকে টেবিলের উপর বসানো হয়েছে। সেও বাবু হয়ে চুপটি করে টেবিলের উপর বসে আছে। প্রত্যয়ের আব্বু ইচ্ছের প্লেটে ঝোল ছাড়া মুরগির রান তুলে দিলেন। ইচ্ছে তখন ওর দুই পাটি দাঁত এক করে শরীর ঝাঁকিয়ে হাসল। ওর হাসি দেখে সবাই হেসে উঠল। কেউ তখনও খাওয়া শুরু করেনি। প্রত্যয়ের আব্বু তখন ‘বিসমিল্লাহ্’ শব্দ করে উচ্চারণ করে মুখে ভাত পুরে প্রত্যয়ের আম্মুর দিকে তাকালেন। প্রত্যয়ের আম্মুও একই কাজ করে প্রত্যয়ের দিকে তাকালেন। প্রত্যয় করে তুয়ার দিকে তাকাল। তুয়া প্রিয়মের দিকে আর প্রিয়ম চাঁদের দিকে। আর চাঁদ ইচ্ছের দিকে। ইচ্ছের আগে কোনোদিন এমন কিছু বলেনি। তাই সে ততক্ষণে রানে এক কামড় বসিয়ে দিয়েছে। সবার বিসমিল্লাহ বলা দেখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রানটা রেখে দিল। তারপর সবার মতো সেও বলল,”মিছমিন্না।” প্রত্যয়ের আব্বু মৃদু হেসে বললেন,

-” আমার সাথে সাথে বলো তো ইচ্ছেমণি, বিসমিল্লাহ্।”
-“বিছনিন্নাহ্।”
-বিসমিল্লাহ্।”
-“বিছমিন্নাহ্।”
-“বাহ! অনেক সুন্দর হয়েছে এবার খাও।”
তারপর সবার দেখে ইচ্ছে খাওয়া শুরু করল। বাচ্চারা আগে পরিবারের থেকে শিক্ষা রপ্ত করে। তারপর বাইরে থেকে। পরিবার যদি ভাল অভ্যাসে অভ্যাস্ত হয়। তাহলে ছোট্ট শিশুটাও সহজেই ভাল অভ্যাসগুলো নিজের মধ্যে ধাতস্থ করতে পারে। কেউ যদি বাচ্চার সামনে খাবার খেয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আল্লাহর শুকরিয়া না জানায়। বার বার আল্লাহ শব্দটা উচ্চারণ না করে। তাহলে সে বাচ্চাটাও শুকরিয়া করতে শিখবেনা, সাথে আল্লাহ শব্দটার সাথেও পরিচিত হবেনা।
ইচ্ছে খুশি মনে ভাত বাদে মুরগির রানে কামড় দিচ্ছে। আর প্রত্যয়ের পাবদা মাছ খুব পছন্দ। সে একমণে মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছে। ইচ্ছে তখন ওর আধ খাওয়া এঁটো মুরগির রান প্রত্যয়ের দিকে বাড়িয়ে বলল,”প্রত্তুয় মুগলিল লান কাও।” প্রত্যয় হেসে এক কামড় নিল। ইচ্ছে ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে প্রিয়মের দিকে রানটা এগিয়ে দিল। প্রিয়ম এমনভাবে কামড় দিল, হাঁড় ছাড়া রাণে মাংস অবশিষ্ট থাকল না। ইচ্ছে হাঁড়টার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে প্রত্যয়ের আব্বু দিকে তাকালেন।
যার অর্থ প্রিয়মকে কিছু বলা হোক। প্রত্যয়ের আব্বু গলা পরিষ্কার করে বললেন, “প্রিয়ম এটা তো ঠিক নয়। ইচ্ছেকে সরি বলে ইচ্ছের প্লেটের ভাতটুকুও খেয়ে নাও।” ইচ্ছে ওর প্লেট কোলের উপর তুলে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। কারন প্রত্যয়ই ওর শেষ ভরসা। প্রত্যয় হেসে আরেক পিস রান ইচ্ছের প্লেটে দিয়ে বলল, “এটা তাড়াতারি খাও! নাহলে প্রিয়ম আবার খেয়ে নিবে।” ইচ্ছে আদুরে সুরে বলল,”তুমি তালাতালি থাওয়ায় দাও প্রত্তুয়।”

প্রত্যয় হাত ধুয়ে ইচ্ছেকে যত্ন করে খাওয়াতে লাগাল। প্রত্যয়ের আম্মু হেসে দুই ছেলের দিকে তাকালেন। প্রিয়ম অনায়াসে ওর ভাগের মুরগির রান দু’টো ছেড়ে দিল। অথচ অন্য কাউকে দিলে এতোক্ষণে তুলকালাম বাঁধিয়ে দিত। আর প্রত্যয় ওর কথা নাই বা বললেন। এমন সোনার টুকরো ছেলেদের মা হয়ে উনি খুব গর্ববোধ করেন।
আজকে রনিতকে খুব হেনোস্তা হতে হয়েছে। এই অফিসের এমডি অজানা কারণে বাঙালীদের পছন্দ করেন না। বাঙালীদের হেনোস্তা করা উনার নিত্য দিনের কাজ। আর
উনারা ব্যবহারে বোঝা যায়, বাঙালীরা তার চোখের বিষ।
আজকে সামান্য একটা ভুলের জন্য উনি রনিতকে জনসম্মুক্ষে অপমান করেছেন। রনিত সরি বলাতে উনি রেগে ইংলিশেতে বললেন, “গেঁয়ো অশিক্ষিত! এখানে রং তামাশা করতে আসেন? কাজে মন না বসলে বেরিয়ে যান, স্টুপিড!”
কথাটা বলে এমডি ফাইলটা ছুঁড়ে মারলেন। রনিত মাথা নিচু করে ফাইলের কাগজ গুলো তুলে বেরিয়ে গেল। তারপর ওর ডেস্কে গিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে কনট্রোল করল। রনিত খুব কষ্ট পেয়েছে। কারন এর আগে সে এমন ব্যবহার কোথাও পায়নি। আর পরের অধিনে চাকরি করলে কথা হজম করতে হবে। স্যালারি টাকাটা নিতে খুব মিষ্টি লাগে। কিন্তু পুরোটা মাস যে কষ্ট করে সে বুঝে। চাকরি মানে সুখকর কাজ নয়। কারো কারো কাছে হাসির আড়ালে অপমান লুকানোর গল্পও থাকে।

দুপুরে খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে ইচ্ছে প্রিয়মের সঙ্গে খেলছে। আর তুয়া প্রত্যয়ের কাছে পড়তে বসেছে। কঠিন পড়া গুলো বুঝে নিচ্ছিল। পড়ার সঙ্গে দু’জনের খুনশুটিও চলছে। তুয়া মনোযোগ দিয়ে একমনে পড়ছে। প্রত্যয় আচানক তুয়ার গাল চেপে ধরে পরপর দু’টো আদর দিয়ে বলল,” উহুম একটা কথাও না। পড়ার সময় কথা বললে মনোযোগ নষ্ট হয়।” তুয়া হেসে প্রত্যয়ের বুকে হেলান দিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেল। প্রত্যয় বইটা রেখে তুয়াকে সুন্দর করে শুইয়ে দিল। নিজেও এক ঘন্টা ঘুমিয়ে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে গেল।
ইচ্ছে তখন প্রিয়মের ফোনে কার্টুন দেখছিল। প্রত্যয় গিয়ে সোফাতে বসল। চাঁদ আমতা আমতা করে প্রত্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,”ভ ভাই ভাইয়া ছাদে যাবেন?” প্রিয়ম কথাটা শুনেও না শোনার ভাণ করল। প্রত্যয় কিছু ভেবে হেসে বলল, “হুম চলো।” চাঁদ জোরপূর্বক হেসে আড়চোখে প্রিয়মের দিকে তাকাল। প্রিয়ম উঠে বাইরের চাবি এনে ইচ্ছেকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা এখন অনেকটা সময় বাইকে করে ঘুরবে। প্রত্যয় চাঁদকে নিয়ে ছাদে গেল। ছাদে বসার জন্য দোলনা ছাড়াও চেয়ার পাতা আছে। প্রত্যয় চাঁদের মুখোমুখি বসে বলল,”যা বলার র্নিভয়ে বলতে পারো। আগেও বলেছি আমাকে ভাসুর নয় ভাইয়া ভাববে।” চাঁদ ঢোক গিলে মুচকি হাসল। প্রত্যয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে চাঁদের চোখে পানি ছলছল করছে। প্রত্যয় চাঁদকে সময় দিল। একটুপরে, চাঁদ মাথা নিচু করে বলতে লাগল,

” আমার আর প্রিয়মের বিয়েটা জোর করে দেওয়া হয়েছে। আমরা আগে কেউ কাউকে চিনতাম না। ভাইয়া, আমি খালার কাছে বড় হয়েছি। একদিন খালা হঠাৎ করে মারা যায়। খালাদের ইতালিতে নিজস্ব ব্যবসা ছিল। আমার খালাতো ভাই সেখানে স্ব-পরিবারে চলে যাওয়া সিধান্ত নেয়। কিন্তু আমি তাদের গলার কাঁটা হয়ে গিয়েছিলাম। তার কিছুদিন পর, ইতালি যাওয়ার আগে ভাবি দেশেই ঘুরতে যেতে চাচ্ছিল।
ভাইয়া আমাদের সবাইকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল। এবং সেখানেই প্রিয়মের সযত্নে আমাদের দেখা হয়। ভাবির পূর্ব পরিচিত ছিল প্রিয়ম। কিন্তু প্রিয়ম ভাবিকে চিনত না। ভাইয়া ভাবির থেকে প্রিয়মের খবর নিয়ে ওকে কিডন্যাপ করায়। তারপর ভ ভা ভাবির ছবির সঙ্গে প্রিয়মের ছবি ইডিট করে জোড়া লাগিয়ে প্রিয়মের নুড পিক বানায়। ভাইয়া প্রিয়মকে নুড পিক গুলো দেখায়। আর প্রিয়মকে বলে আমাকে বিয়ে করতে। প্রিয়ম কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। ওর কথা ছিল পিক ভাইরাল করুক! তাও বিয়ে করবেনা। ভাইয়া রেগে ওকে মেরেছিলও। তাতেও প্রিয়ম রাজি হচ্ছিল না।

ভাইয়া কিছু একটা ভেবে প্রিয়মের ফোন কেড়ে নিয়ে গ্যালারি থেকে ঢুকে। সেখানে ‘আমার ভাইয়া’ নামে ফাইলে আপনার অনেক গুলো ছবি ছিল। সেখান থেকে আপনার ছবি নিয়ে ভাইয়া নুড করতে চাচ্ছিল। প্রিয়মের কথা ছিল সে মরে গেলেও বিয়ে করবেনা। কিন্তু আপনার কথা বলাতে সে থম মেরে গেল। বার বার নিষেধ করতে লাগাল। তখন ভাইয়া বুঝে গেল, আপনি প্রিয়মের দূর্বল পয়েন্ট। বিয়েতে একটা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে কবুল বলে জানতাম। কিন্তু সেদিন দেখেছিলাম, প্রিয়মকে কাঁদতে কাঁদতে কবুল বলতে। আর আমার হাতেও কিছু করার ছিল না। তাই মনের অমিলে দু’জন বিয়ের বন্ধণে আবদ্ধ হয়েছিলাম। সেই সাথে প্রিয়ম ওর ইচ্ছে, আকাঙ্খা, ভালবাসা, শখ আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়েছিল।”

প্রত্যয় শেষ কাহিনীটুকু জানত না। কারন প্রিয়ম সেদিন এতটুকু ঘটনা আড়াল করেছিল। প্রত্যয় সবটা শুনে কষ্ট পেলেও কিছু বলল না। তবে আবার প্রমাণ হল প্রিয়মই প্রত্যয়ের প্রাণ নয়! প্রত্যয়ও প্রিয়মের প্রাণ। আর চাঁদ প্রিয়ম দু’জনেই পরিস্থিতির স্বীকার। এজন্য প্রত্যয় এতদিন জেনেও কিছু বলতে পারেনি। একদিকে ভাই! অন্য দিকে অসহায় মেয়েটা। প্রত্যয়ের বিবেক চাঁদকে বাসা থেকে বের করতে পারেনি। সে বলতেও পারেনি সব দোষ চাঁদের। জীবনের অদ্ভুত গোলক ধাঁধায় এসে পড়েছে সে। না পারছে ভাইটার জীবন গুছিয়ে দিতে। আর না পারছে মেয়েটার আশ্রয়টুকু কেড়ে নিতে।
চাঁদ কথাগুলো বলে হেঁচকি তুলে কাঁদছে। ওর ও সব ধৈর্য্য শেষ। প্রিয়মের সামনে দাঁড়লে ওর দোষী মনে হয়। সে তো চাইলেও প্রিয়মের ভালবাসা পাচ্ছে না। বরং প্রিয়মের কাছে আরো খারাপ হয়ে হচ্ছে। চাঁদ এটাও বুঝে, প্রিয়ম আঘাত পেয়ে ওর হৃদয়ের দ্বার বন্ধ করে ফেলেছে। সে দ্বারে আর কাউকে প্রবেশ করানো সম্ভব নয়। চাঁদকে এভাবে কাঁদতে দেখে প্রত্যয় চাঁদের মাথায় হাত রেখে নরম সুরে বলল,”এখন তুমি কি চাচ্ছো?”
চাঁদ নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল, “পাপীর শাস্তি! আর প্রিয়মের মুক্তি।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩৬]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

চাঁদ নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল, “পাপীর শাস্তি! আর প্রিয়মের মুক্তি।” প্রত্যয় চাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,”প্রিয়মকে ছাড়া থাকতে পারবে? কষ্ট হবেনা?”
কথাটা শুনে চাঁদ প্রত্যয়ের পা ধরে হাউমাউ করে কাদঁতে লাগল। প্রত্যয় দ্রুত চাঁদকে উঠিয়ে বসিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,” সবার জীবন কাহিনী এক নয় চাঁদ? সুখ দুঃখের সুতোয় বাঁধা আমাদের এই জীবন। একটা মানুষ আঘাত পেলে সময়ের পরিবর্তনে নিজেকে সামলে নিতে পারে। কিন্তু মানুষটা যখন সব আঘাত গুলো একসঙ্গে পায়। তখন তার উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকেনা। আমার ভাইটাও তার ব্যাক্তিক্রম নয়। ওকেও ওর ক্ষতটা সারানোর একটু সময় দাও!”
চাঁদ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে চোখ মুছে বলল, ” আমাদের সঙ্গে হওয়া অপরাধের শাস্তি চাই ভাইয়া। প্লিজ! প্লিজ আপনি কিছু করুন। নাহলে ইচ্ছের মতো আরো বাচ্চাদের এতিম হতে সময় লাগবেনা।” এর মধ্যে ইচ্ছের কথা শুনে প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। চাঁদ ঢোক গিলে নিচু স্বরে বলল,”মাহিম আমার ভাইয়ার ঘনিষ্ট বন্ধু। ওরা দু’জনেই কয়েক বছরে ধরে এসব কাজে লিপ্ত।”

কথাটা শুনে প্রত্যয় আর প্রত্যুত্তর করল না। চাঁদ ওর ভাইয়া রাশেদ এবং মাহিমের কুকর্মের কথা বলতে লাগল। সবটা শুনে প্রত্যয় শান্ত কন্ঠে বলল,”একথা আর কাউকে জানিও না চাঁদ। সময় হলে আমি সবাইকে জানাব।” চাঁদ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে উঠে চলে গেল।
প্রত্যয় রনিতকে ফোন করে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করল। প্রত্যয়ের আলোচ্য বিষয় ছিল ইচ্ছেকে নিয়ে। রনিত প্রত্যয়ের পুরো কথা শুনে অবাক এবং দ্বিমত জানাল। এই নিয়ে দু’জনের বেশ কিছুক্ষণ কথা চলল। একপর্যায়ে প্রত্যয়ের যুক্তিতে হার মেনে রনিতকে সম্মতি দিতে হলো। আর প্রত্যয় কল কেটে ট্রাক ড্রাইভারদেরকে দু’টো বাসার ঠিকানা দিল। একটাতে, ইচ্ছেদের সব ইলেকট্রনিক জিনিস আর আরেকটাতে সব আসবাবপত্র। ইলেকট্রনিক জিনিস বিনা ব্যবহারে নষ্ট হয়ে যায়। অযথা জিনিস গুলো নষ্ট না করে রনিতরাই ব্যবহার করুক। এটা ভেবে ইলেকট্রনিক জিনিসগুলো প্রত্যয় রনিতদের বাসায় পাঠাল। আর ইচ্ছের আম্মু শখের আসবাবপত্র সব প্রত্যয়দের আগের ফ্ল্যাটে তোলা হলো। সেগুলো সহজে নষ্ট হবেনা। এগুলোর রাখার পেছনে একটা কারণ আছে। যাতে ইচ্ছে বড় হয়ে অভিযোগ করতে না পারে, ওর আম্মুর জিনিস কেন অন্যদের দিল? কেন প্রত্যয় আমানত হিসেবে রাখল না? আর ইচ্ছের আম্মু জিনিসে শুধু ইচ্ছের অধিকার। তাই প্রত্যয়ের এই ব্যবস্থা। যাতে ইচ্ছে বুঝতে শিখে ওর আম্মু জিনিস গুলো ছুঁয়ে দেখতে পারে।

প্রত্যয় নিচে গিয়ে রেডি হয়ে সরাসরি ব্যাংকে গেল। ইচ্ছের আব্বু আম্মুর টাকা, গয়না, এবং জমির দলিল ব্যাংকের লকারে রাখল। এবং ইচ্ছের আঠারো বছরের আগে ইচ্ছে ছাড়া অন্যকেউ এসব তুলতে পারবেনা। প্রত্যয় সেই ব্যবস্থাও করল। তারপর ব্যাংকের কাজ সেরে সে হসপিটালে চলে গেল। সন্ধ্যার পর, প্রিয়ম ইচ্ছেকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে এসেছে। পুরো পার্কে আরো অনেক মানুষ আছে। হরেক রকম লাইটের ঝলকানিতে পার্কটা দারুণ লাগছে দেখতে। ইচ্ছে কোল্ড ড্রিংকস খেতে খেতে প্রিয়মকে বলল,”প্রিউুম প্রত্তুয়কে এতটু ফুন কলো।” প্রিয়ম সময়টা দেখে বলল,”ভাইয়া তো এখন হসপিটালে এখন মনে হয় ব্যস্ত আছে।” ইচ্ছে ভ্রু দু’টো কুঁচকে চোখ বড় বড় করে বলল,”ফুন দিতে বলেচি।”
প্রিয়ম ভয় পাওয়ার ভাণ করে মুখ কাচুমাচু করে বলল,”দ দি দিচ্ছি তো!” প্রিয়মের মুখ দেখে ইচ্ছে খিলখিল করে হাসতে লাগল। প্রত্যয় এই সময় প্রিয়মের কল পেয়ে ব্যস্তাতার সুরে বলল,”প্রিয়ম একটু পরে ফোন দিচ্ছি।” ইচ্ছে তখন ওর বুকে নিজে থাবা দিতে দিতে বলল,”আমি! আমি! আমি লাজকন্যা ইচ্ছে।” ইচ্ছের কথা শুনে প্রত্যয় মৃদু হেসে বলল,”রাজকন্যা আমি এখন একটা দুষ্টুকে সূচ দিচ্ছি। একটুপরে তোমার সঙ্গে কথা বলি!” সূচের কথা শুনে ইচ্ছে বলল,”আচ্চা শুনো তুমি একটা সূচ আনবা। আমি প্রিউুমকে সূচ দিব। প্রিউুম আমাল একটা কথাও শুনে না।” প্রত্যয় হেসে ‘আচ্ছা’ বলে কল কাটল। প্রিয়ম কথাটা শুনে ইচ্ছেকে দৌড়ানি দিল। আর ইচ্ছে খিলখিল করে হেসে ঘাসের উপর দৌড়াতে লগাল।

পরেরদিন সকালে রনিতকে বাসার সামনে মাল ভর্তি ট্রাক এসে থেমেছে। দিশার তো খুশির অন্ত নেই। সে দৌড়াদৌড়ি করে জিনিস গুলো আস্তে ধীরে নামাতে বলছে। কোথায় কোনটা রাখবে জায়গা ঠিক করে দিচ্ছে। দিশার দিকে তাকিয়ে রনিতের আম্মু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পলকের জিনিস গুলোও দিশা নিয়েছে। এখন ইচ্ছের আম্মুর এতোগুলো জিনিসও সে পেল। মাঝখান থেকে সব ওর। কালকে বিকালে প্রত্যয় রনিতকে এসব বিষয়ে কথা বলেছিল। রনিত ওর বাসায় একথা জানানোর পর দিশা সারারাত ঘুমাতে পারেনি। কখন ট্রাক আসবে সে সেই অপেক্ষাতেই ছিল।কয়েকজন মিলে একে একে সব জিনিস নামাল।
দিশা জিনিসগুলো চেক করে হঠাৎ চেঁতে গেল। ইলেকট্রনিক জিনিস ছাড়া কিছু না দেখে রেগে ওর শাশুড়িকে বলল,” ওই ডাক্তার খুব চালাক দেখলেন আম্মা। দামী দামী জিনিসগুলো নিজে নিয়ে। আমাদের কি সব হাজিবাজি দিয়েছে।”

রনিতের আম্মু ইশারায় দিশাকে থামতে বলছেন। কিন্তু দিশা থামছেনা সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। রনিত তখন ভিডিও কলে ওর আম্মুর সঙ্গে কথা বলছিল। সে সবটাই শুনে ফোনটা দিশাকে দিতে বলল। দিশা কিছু বলার আগে রনিত বলল,” লোভটা কমাও! আজ মরলে কাল দু’দিন। বাপের জন্মে এসব জিনিস চোখে দেখেছ? যে এখন বড় বড় লেকচার দিচ্ছ! ওই ডাক্তারের নখের যোগ্যও তুমি নও! তাহলে কোন বিবেকে উনার দিকে আঙুল তুলছ?” দিশা রেগে বলল, “আমরা কি দান চেয়েছি? কে বলেছে উনাকে মহান হতে?” রনিত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “মহান হতেও মন লাগে। তোমার তো তাও নেই।” দিশা ফোনটা ওর শাশুড়ির হাতে দিয়ে চলে গেল। আর রনিত রেগে সঙ্গে সঙ্গে কল কাটল। রনিতের আজ মনে হচ্ছে, দিশা অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। নাহলে অবুজ বাচ্চাটার কথা না ভেবে জিনিসপত্রের কথা ভাবে!
দুইদিন আগে তুরাগ তিন্নিকে নিয়ে সাজেক ঘুরতে গেছে। ইলার সঙ্গে দেখার হওয়ার পর ওর মনটা বিগড়ে গিয়েছিল। ওর শুদ্ধ বাতাস আর একাকী পরিবেশের প্রয়োজন ছিল। ছেলের সিধান্তে তুরাগের আব্বু আম্মু সম্মতি দিয়েছে। কারণ ছেলে মেয়ের খুশিতে উনারা খুশি। যদিও তুরাগ তুয়াকে যেতে বলেছিল। তুয়ার পরীক্ষা, প্রত্যয়ের হসপিটাল আবার ইচ্ছেকে নিয়ে ওর ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। তাই তুয়া তিন্নিকে নিয়ে ঘুরে আসতে বলেছে।

বিকালে, প্রত্যয় ওটি থেকে বের হয়ে ওর চেম্বারে যাচ্ছিল। তখন সায়ন ওকে ফোন দিয়ে জানাল মাহিম এখন লকাপে।
সে একটা গ্রামে গা ঢাকা দিয়ে ছিল। মাহিমকে ধরে সায়ন নাকি ইচ্ছেমতো মেরেছে। মাহিমের বউও লকাপে আর ওদের বাচ্চাটা পুলিশ কাস্টাডিতে। প্রত্যয় সায়নকে রাশেদের কথা জানাল। সায়ন ওর মন্ত্রী মামার সাহায্যে ইতালিতে রাশেদের খোঁজে ফোর্স পাঠাল। সাথে গুপ্তচরও পাঠাল। এরা এক একটা নর্দমার কীটের থেকেও জঘন্য। এরা বাইরে থাকা মানে কারো প্রাণনাশ। প্রত্যয়ের কথা, পাওয়ার এবং প্রমানের ভিত্তিতে সায়ন শক্ত হতে কেসটা ধরল।
গুটি গুটি পায়ে সময় দিন এগিয়ে যাচ্ছে। চাঁদ তুয়ার চারটে পরীক্ষা হয়ে গেছে। দু’জনের মোটামুটি ভালোই পরীক্ষা দিচ্ছে। ইচ্ছে এই কয়েকদিনে দুই একবার ওর আব্বু আম্মুর জন্য কেঁদেছে। ইচ্ছে খুব কাঁদলে ওর আব্বু আম্মুর কবর দেখিয়ে আনা হয়। ইচ্ছে এখন জানে ওর আব্বু আম্মু অসুস্থ। তাই উনারা আল্লাহর কাছে গেছে। আল্লাহ ওর আব্বু আম্মুকে খুব ভালবাসে। ছোট্র অবুজ বাচ্চাটা তাই বিশ্বাস করেছে। সে প্রত্যয় প্রিয়মের জন্য গিয়ে আব্বু আম্মুর কবরে দোয়া করে আসে। কবরে পাতা বা ময়লে পড়লে পরিষ্কার করে। আর বাসায় ফিরার আগে দুই কবরে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে,”ধুমাও আব্বু! ধুমাও আম্মু! আল্লাহ তুমাদের অনেক ভালুপাশে। তুমলা মুন খালাপ কলবা না। আমি আদল করছি তুমলা ধুমাও!” প্রত্যয় প্রিয়ম ইচ্ছেকে নিয়ে গেলেই কবর জিয়ারত করে আসে। এখন যতদিন যাচ্ছে, ইচ্ছে প্রত্যয়দের আপন করে নিচ্ছে। ইচ্ছে এখন ওর মনমতো প্রত্যয় প্রিয়মের কাছে ঘুমায়। ওর জন্য সব রুম উন্মুক্ত করা।

প্রিয়ম কয়েকমাস আগে গানের সঙ্গে মডেলিং শো এর অফার পেয়েছে। প্রথমে সে না বললেও পরে প্রত্যয়ের কথাতে রাজি হয়েছে। আজকে প্রিয়মের মডেলিং শো এর ডেট। তাই সকালে রেডি হয়ে সে সেখানে যাচ্ছিল। ইচ্ছে জেদ ধরায় ইচ্ছেকেও প্রিয়ম সঙ্গে নিল। আর প্রত্যয় গেল হসপিটালে। সে দুপুরে আসবেনা এটাও জানাল। চাঁদ তুয়া প্রত্যয়ের আম্মুর সঙ্গে টুকটাক কাজ করছে। আবার একটু করে পড়ছে। প্রত্যয়ের আম্মু নিষেধ করলেও শুনছেনা। দুপুরের ইচ্ছে প্রিয়ম ফিরল না। বরং ফোন করে জানাল ফিরতে রাত হবে। তাই প্রত্যয়ের আব্বু আম্মুসহ সবাই খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। সন্ধ্যার পরে ইচ্ছেরা ফিরল।সারাদিন দুষ্টুমি করে রাতে খেয়ে ইচ্ছে প্রিয়মের বুকে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে। প্রিয়মও আলতো করে ইচ্ছের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাসায় সবার প্রাণ এখন ছোট্র ইচ্ছে। ওর খিলখিল করা হাসি, দুষ্টুমি, অভিমান, দিয়ে বাসাটাকে মাতিয়ে রাখে।

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ৩১+৩২+৩৩

রাতে প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু উনারা বেলকণিতে বসে আছেন। স্বামীকে চিন্তিত দেখে প্রত্যয়ের আম্মু উনার পাশে বসে বললেন,” কিছু হয়েছে তোমার? দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছে।” প্রত্যয়ের আব্বু চিন্তিত হয়ে বললেন, “আমার দুই ছেলে ইচ্ছেকে খুব ভালবাসে। তাই বলে ওদের রুমে রোজ ইচ্ছেকে রাখাটা ঠিক হবেনা। ছেলেরা বিয়ে করেছে! তাদের প্রাইভেসি দরকার আর ইচ্ছেও বড় হচ্ছে। চাঁদ তুয়া আজ কিছু না বলছেনা। কাল বলবেনা এর গ্যারান্টি কি? চাঁদ প্রিয়মের সম্পর্ক কেমন আমরা সবাই জানি। এখন ওদের সঙ্গে ইচ্ছে থাকা মানে,, আমি কি বলতে চাচ্ছি তুমি বুঝতে পারছ? শুধু ইচ্ছে নয় আমাদের সবার কথা ভাবা উচিত।”

প্রত্যয়ের আম্মু স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এতটুকু বাচ্চা বোডিংয়ে থাকতে পারবে? আর তোমার ছেলেরা কি রাজি হবে?” প্রত্যয় আব্বু কিছুক্ষণ থম মেরে বললেন, “সবার জন্য যেটা ভালো হবে আমি তাই করব। আর আমার কথা শুনতে ছেলেরা বাধ্য।”
তখন রাত একটা বাইশ। চাঁদ তখন টেবিলে বসে একমণে পড়ছিল। প্রিয়ম ইচ্ছেকে ওর আব্বুর রুমে রেখে চাঁদকে উঠিয়ে স্বজোরে বিছানায় ধাক্কা দিল। আচানক এমন করাতে চাঁদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। প্রিয়মের এমন ব্যবহারের কারণ চাঁদের অজানা। চাঁদ কিছু বলার আগে প্রিয়ম ওর শার্ট খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে বলল,” আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার খুব শখ তোর, তাই না? আমার ছোঁয়া শরীরের মাখার বড্ড ইচ্ছে তোর? ওকে আজকেই আমি তোর শখ পূরণ করব। ”

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ৩৭+৩৮+৩৯