সুপ্ত অনুভূতি গল্পের লিংক || মেহরাফ মুন লেখিকার গল্প

সুপ্ত অনুভূতি পর্ব ১
মেহরাফ মুন(ছদ্মনাম)

চোখের সামনেই নিজের ভালোবাসার স্বামীর সাথে নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে বউরূপে দেখতে হবে কোনোদিন কল্পনাও করেনি মুন। এই কী সেই আদ্রাফ ? যার হাত ধরে পরিবারের সাথে বিচ্ছেদ করে চলে এসেছিলো! এত ভালোবাসা কই গেল আদ্রাফের? শুধু মাত্র একটা বাচ্চার জন্যই কী সব? ভেবেছিলো আদ্রাফকে আজ মুনের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সারপ্রায়জ্টা দিবে কিন্তু মুন নিজেই যে এখানে সারপ্রাইজড হয়ে যাবে তা কল্পনাও করেনি। পাশেই নেহা কুটিল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মুন বেদনা-ভরা চোখে আদ্রাফের দিকে তাকালো। তা দেখে আদ্রাফ বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলে উঠলো,
-‘আরে দরজার সামনে থেকে সরো,আমাদের ঢুকতে দাও। নতুন বউকে দরজার সামনে এভাবেই দাঁড়িয়ে রাখবে না-কি?’
মুন স্তব্ধ। সত্যিই কী এটা আদ্রাফ? মুন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো,
-‘তুমিইইই মজা করছো, তাই না আদ্রাফ?’
পাশের রুম থেকেই তখন শাশুড়ি মা বেরিয়ে এসে আদ্রাফকে এই রূপে দেখে খুশিতে বাকহারা। উনার তো অনেকদিনের ইচ্ছে আজ পূরণ হলো, ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে আর যাকে চেয়েছে বউরুপে তাকেই পেয়েছে। আর কীই বা লাগে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘এতদিন পরেই আমার পোলাটার একটা সুবুদ্ধি গজায়ছে, আসো মা।’শাশুড়ি মা নেহাকে উদ্দেশ্য করে ঘরে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল।
-‘আরে আশ্চর্য! এখানে মজার কী দেখছো তুমি? বিয়ে করেছি তা দেখছোই।’আদ্রাফ বলল।
মুন যেন কথা বলতেই ভুলে গেল। দপ করে বসে পড়লো মেঝেতে।
আদ্রাফ আর নেহা দু’জনেই একসাথে মুনকে পেরিয়ে রুমে ঢুকে গেল। আর সেই দিকেই মুন কান্নামাখা চোখে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন পরই নেহা রুম থেকে বেরিয়েই বলে উঠলো,
-‘ মুন,তুই তোর জিনিসপত্রগুলো অন্যরুমে নিয়ে যা। কারণ এখানে আমার জিনিস-পত্রগুলো রাখতে হবে। আর তুই তো আজ থেকে এই রুমে থাকবি না তাই তোর সব জিনিস অন্যরুমে নিয়ে যাওয়াই ভালো।’ এই বলেই নেহা রুমে ঢুকে গেল।

মুন উঠে দাঁড়ালো। নিজেকে শক্ত হতে হবে। কার জন্য কান্না করবে সে? এই মানুষটার জন্য? যে তাঁকে মাঝপথে এসে ছেড়ে দিচ্ছে তাঁর জন্য? মুন চোখের পানি মুছে সেই রুমের দিকে অগ্রসর হলো। এতদিন এই রুমটা তাঁর ছিল কিন্তু এখন আর নেই। মুন রুমে গিয়েই দেখল নেহা বিছানায় বসে আছে আর আদ্রাফ নেই, মনে হয় ওয়াশরুমে। হয়তোবা সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে তাই শাওয়ার নিতে ঢুকেছে।

যেখানেই যাক না কেন ওই মানুষটা, মুন আর ভাববে না ওই মানুষটার কথা। মুন আস্তে আস্তে নিজের রুম থেকে সবকিছু গুছিয়ে নিল। সব নিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শেষবারের মত তাঁদের ভালোবাসার রুমটার চারদিকে তাকালো। এখন থেকে এই রুম আর তাঁর নেই, অন্য আরেকজনের। আদ্রাফের সাথে
এই রুমে তাঁর কত স্মৃতি। এইতো এই জায়গায় আদ্রাফ প্রতিদিন রাতে এসেই তাঁর খোঁপায় বেলিফুল গেঁথে দিতো। মানুষ কিছুদিনের মধ্যে এভাবে কেমনে বদলে যেতে পারে? ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো মুনের। আর তাকাবে না সে এই রুমের দিকে। যতই তাকাবে ততই কষ্ট পাবে মুন। তাই জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে রুমটা থেকে গেস্ট রুমে চলে গেল মুন।

গেস্টরুমে গিয়েই দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসে পড়লো মুন। আদ্রাফ তো মুনের অবস্থা জানতো তারপরেও মুনের সাথে এমন কীভাবে করতে পারলো? আর নেহাও বা কেমন? ও কী জানতো না,মুন এই আদ্রাফের জন্য পরিবারের সাথে বিচ্ছেদ করে চলে এসেছিলো। আর জানলেও বা কী! ও তো বান্ধবী ভাবতোই না , আর ও তখন থেকেই আদ্রাফকে পছন্দ করতো। ছোট থেকেই আমার পছন্দের জিনিসগুলোর উপর নেহার নজর ছিল। ওর সাথেই থাকতাম প্রায় সময়। একই এলাকায় বাসা হওয়াই ওকেই আপন ভেবে সব কথা বলতাম। আমি ওকে বেস্টফ্রেন্ড ভাবতাম ঠিক, কিন্তু ও কোনোদিন ভাবতো না।

মা মারা যাওয়ার পর পরই বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। বিয়ে করতে চায়নি কিন্তু সবার জোরাজোরিতে আমার আরেকটা মা দরকার ভেবে বিয়ে করেছিলেন। হ্যাঁ সবার সামনে আমি একটা আদর্শ মা পেয়েছি ঠিকই কিন্তু আসলে কী তা? প্রথম একবছর ঠিকই ছিল এরপর আরেকটা বোন হওয়ার পর সব রূপ বেরিয়ে আসলো। বাবাও প্রথমে খবরা-খবর নিতো। কিন্তু দিন যতই যায় বাবাও ওই পক্ষেই হয়ে গেল। আমার পড়াশোনাও ঠিকঠাকভাবে করতে দিতো না। সারাদিন রান্না-বান্না, সবকাজ আমাকেই করতে হতো তাঁর উপর সৎমার অত্যাচার তো আছেই, কোনো কাজ ঠিকঠাক মত না হলেই মার-ধর করতো।

এর উপর বোনটার কড়া নজরদারি তো আমার উপর ছিলই। আমার সব পছন্দের জিনিস ওর নজর সবসময় থাকতো। একটা কাপড় পছন্দের থাকলে সেটাও সৎমা আর বোন একসাথে এসে নিয়ে যেত, দিতে না চাইলে মারধর করতো। বাবাকেও উল্টাপাল্টা বোঝাতো। সবাই ওর কথায় শুনতো, বাবাও আমার কথা বুঝতে চায়তো না। ছোটবেলা থেকেই নেহার সাথে বন্ধুত্ব আমার। ও আমার সম্পর্কে এ সবকিছুই জানতো। ঠিক সেই সময়ই আদ্রাফ নামক পুরুষের আগমন আমার জীবনে।

সে আমাদের কলেজের সিনিয়র ব্যাচের ছিল। প্রথম কয়েকমাস লুকিয়ে থাকতাম তাঁর থেকে। কিন্তু এরপর আর পারিনি। তাঁর ভালোবাসার জেদের কাছে হেরে গিয়েছি। সেই কলেজের প্রায় মেয়েই আদ্রাফকে পছন্দ করতো। তেমনি ভাবে নেহাও ছিল তাঁদের মধ্যে। কিন্তু আমি ওকে আমার জীবনে জড়াতে চায়নি। ওর পাগলামির জন্য আমার পরিবারের অবস্থা সব বলেছিলাম। সে তাঁর মাকে নিয়ে গিয়েছিল প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু আমার সৎমা আর সৎবোন এটা সহ্য করতে পারেনি, ওরা আমার ভালো পরিবারে বিয়ে হোক এটা চায়তো না তাই তো বাবাকে বলিয়ে ওদের অপমান করে বের করে দিয়েছিলো।

এরপর পর আমার পড়াশোনাটাই বন্ধ করে দিয়েছিলো, বাইরে যাওয়া একেবারেই বারণ। এই সবকিছুই নেহা জানতো। হয়তো বা উপরে ভালো সাজতো, মনের ভেতর অন্যকিছু ছিল।নেহার সাহায্যেই এক রাতে আদ্রাফের সাথে এক কাপড়েই ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু শাশুড়িমাকে অপমান করেছিল তাই তিনি মানতে পারেনি আমাকে। এই বিয়ের জন্য হয়তো আমার প্রতি নেহার অনেক ক্ষোভ ছিল। কারণ আদ্রাফকে সেও অনেক পছন্দ করতো। সে তাঁর খেলার চাল হিসেবে শাশুড়িমাকেই প্রথমে বেছে নিয়েছিল।

এরপর বাচ্চা না হওয়ার জন্য শাশুড়িমা প্রতিদিনই খোটা দিতো আর আহানকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চাপ দিতো এর পিছনে নেহা তো আছেই। একবছরের প্রেম আর দুইবছরের সংসার জীবনে আদ্রাফ কোনোদিন আমার হাত ছাড়েনি, সবসময় ছায়ার মত পাশে ছিল। শাশুড়িমার কথায় আমি যখন মন খারাপ করতাম তখন আদ্রাফের কথায় ভরসা পেতাম। সে বলতো,’দেখো মুন, আম্মার বয়স হয়েছে, এই বয়সে নাতি-নাতনির একটা শখ থাকে মানুষের, ঠিক আম্মারও তেমন আছে।

কিন্তু চিন্তা করো না, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। বাচ্চা আল্লাহ যখন চাইবে তখনই দিবেন কিন্তু ওনারা মুরব্বি মানুষ এটা বোঝালেও বুঝতে চাইবে না। এই দেখো, এই হাতটা ধরেছি ছাড়ার জন্য নয়, আজীবন একসাথে থাকবো আমরা।’ তখনের কথাটা আজ কোথায় গেল আদ্রাফের। অন্তত আজকের দিনটা হলেও অপেক্ষা করতে পারলো না সে? কিছুদিন ধরেই সে বাসায় দেরিতে ফিরত। কথা বলতো না ঠিকঠাক। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ ভিজে এলো মুনের।

আদ্রাফ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রুমের দিকে তাকাতেই কী যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হলো। কাপড় নেওয়ার জন্য আলমারি কাছে যেতেই দেখতে পেলো ওখানে মুনের কাপড়ের জায়গায় নেহা কাপড় রাখছে।
আদ্রাফ নেহাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘এখানে তো মুনের কাপড় ছিল। ওগুলো কোথায়? আর তুমিই বা আমাদের আলমারিতে কাপড় কেন রাখছো?’
-‘বাহ্ রে! এখন থেকে তো এটা আমাদেরই রুম। মুনের রুম তো পাশেরটা। ওর কাপড় কেন আমাদের রুমে থাকবে বলো?’

আদ্রাফের হঠাৎ খারাপ লেগে উঠলো। এই দুইবছরে মুনকে ওকে ছাড়া কোনোদিন থাকেনি। হাজারো রেগে থাকলেও রাতের মাঝখানে চলে আসতো আহানের পাশে। মেয়েটা আজ একা থাকবে ভাবতেই খারাপ লাগলো। আর এই আলমারিটাতো মুনের ভীষণ প্রিয় ছিল। এভাবেই তাঁর অধিকার এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল? রুমের চারদিকে তাকাতেই কোথাও যেন একটা শূন্যতা অনুভব করল আদ্রাফ।

-‘কী হলো? কই হারিয়ে গেলে? আমি খাবারের ব্যবস্থা করতে বলে আসতেছি মুনকে,কেমন?’
নেহার কথায় আদ্রাফের খেয়াল আসলো। আদ্রাফ নেহাকে ডাকার আগেই নেহা বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
দরজা ধাক্কার শব্দে মুনের খবর হলো। সে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে উঠে দরজা খুলে দেখল নেহা দাঁড়িয়ে আছে হাসি হাসি মুখ করে। বোঝায় যাচ্ছে অনেক খুশি সে আজ। হবেই না কেন? সে তো আজ আমার সবচেয়ে পছন্দের জিনিসটা নিতে পারলো।

-‘মুন,আমাদের জন্য খাবার রেডি করিসনি? একটু রেডি করতি ভালো হতো। জানিসই তো আজ অনেক ধকল গেছে আমাদের দুইজনের। একটু তাড়াতাড়ি কিছুর ব্যবস্থা করতো।’ নেহা বলল।
-‘তুই রুমে যা, আদ্রাফের কিছু লাগতে পারে। আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।’
-‘নেহা, তুই তো সব জানতি আমার ব্যাপারে, তবুও কেন এমন করলি?’
-‘মুন, শোন্, আদ্রাফ তোকে নয় আমাকে ভালোবাসে। ওই সময়েরটা মোহ ছিল ও এখন সেটা বুঝতে পেরে আমার কাছে ফিরে আসছে। তুই প্লিজ আর অশান্তি করিস না। সত্যিই ভালোবেসে থাকলে আমাদের দুজনকে ছেড়ে দেয়।’

নেহা চলে গেল আবার তাঁর রুমে। আর আমি রান্নাঘরে চললাম। আজকের রাতটাই তো আছি এখানে। যাওয়ার আগে আদ্রাফের খুশির দিনে ওর পছন্দের খাবারটাই না হয় রান্না করি। আদ্রাফ গরম গরম খিচুড়ির সাথে ভোনা ভোনা ইলিশ মাছ পছন্দ করে। এই অল্প সময়ে এটাই করা যায়। মুন ফ্রিজ থেকে ইলিশ মাছ বের করে রান্না করার কাজে লেগে গেল। যতই হোক আজ মুনের নিজেরও সবচেয়ে খুশির দিন।
রান্না শেষ করেই সব টেবিলে সাজিয়ে মুন নেহাকে ডাক দিল আদ্রাফকে নিয়ে আসার জন্য। ওরা আসার আগেই মুন গেস্টরুমে গিয়ে দরজা আটকে দিল। তাঁর আজ খাওয়ার মুড নেই ।

আদ্রাফ টেবিলে এসে বসতেই দেখতে পেলো তাঁর পছন্দেরই খাবার সব। টেবিলে তাঁর মা আর নেহা পাশে বসলো। কোথাও যেন প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে শূন্যতা অনুভব করছে আদ্রাফ। এই দুইবছরের প্রতিটা দিনই মেয়েটা খাওয়ার সময় তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো। এটা-ওটা নিয়ে দিতো। আজ কী ওর দায়িত্ব শেষ। আদ্রাফ নিজেই তো মুনের থেকে সেই অধিকারটা নিয়ে নিয়েছে। ভাবতেই এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
আর অন্যদিকে মুন রুমে আলমারি খুলে প্র্যাগনেন্সি রিপোর্টটা বের করল। আজ সবচেয়ে খুশির দিন হওয়ার ছিল। অথচ কী নিয়তি! আজ রাতেই সে অনেকদূরে চলে যাবে এই বাড়ি ছেড়ে । যেখানে আদ্রাফ নামক কোনো ছায়াও পড়বে না।

সুপ্ত অনুভূতি পর্ব ২

গল্পের বাকি পর্ব লেখিকা লেখা শেষ করলে পোস্ট করা হবে