সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৭

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৭
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

একটা ফাঁকা ঘর। কিছু আসবাব,আর জানলায় ঝুলন্ত পাতলা ধবধবে সাদা পর্দা। এছাড়া, এখানে আর কিচ্ছুটি নেই। ছাদ থেকে সিমেন্ট খসে পড়লেও আওয়াজ পাওয়া যাবে।
অথচ বাইরে থেকে ছুটে আসা কতগুলো মানুষের হল্লাহল্লির শব্দও সেখানে ভীষণ ফিকে হয়ে পড়ল।
নাহলে কেন কোনও শব্দ পাচ্ছে না পুষ্পিতা? পৃথিবী কি থমকে আছে? ঘড়ির কাঁটা চলছে না? না কি ওর শ্বাস আটকে পড়েছে বুকে! এই জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মত অস্থির ভাবটা কীসের তবে?
কোনও প্রশ্নেরই কোনও সুরাহা সে পায়নি। ফ্যালফ্যালে নজরদুটো শুধু একভাবে তীব্রকে দেখছে।
সে মানুষের দুচোখ ছাপানো অদ্ভুত কোনও
মুগ্ধতায়।

কোটরে বিষ মেশানো মাদকের। যাতে পুষ্পিতার দেহের সমস্ত শিরায় অবধি রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মেয়েটা বেশিক্ষণ ওই নেশালো চোখে চোখ রাখতে পারে না। চট করে নামিয়ে নেয় নিচে। খুব কষ্টে মুখ খোলে,
“ বাইরে সবাই আছে। সরুন,যাব।”
তীব্র নড়ল না। সড়লও না।
একইরকম গায়ের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ আগে যেটা চাইলাম দাও,তারপর।”
“ এমন করছেন কেন?”
“ কথা শুনছো না কেন?”
পুষ্পিতা অসহায় চোখে চাইল। তীব্র হাসল বোধ হয়। মুখের বদল না হলেও,বিলাতি নয়ন ছোটো হয়ে বসেছে। শুভ্র গাল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ দাও।”
পুষ্পিতা আইঢাই করে ওঠে। মুখ ঘুরিয়ে জানায়,
“ আমি পারব না।”
তীব্র দুপাশ হতে দুইবাহু চেপে ধরল। কণ্ঠে নিপাত জেদ,
“ তাহলে আমিও ছাড়ব না।”
পুষ্পিতা একটু নড়ার চেষ্টা করলেও বিশেষ লাভ হয়নি। মানুষটার বলবাণ শরীর বালিশের মত ঠেসে রেখেছে তাকে।
বলল ছটফটিয়ে,
“ ছাড়ুন প্লিজ!”

“ ধার না নিয়ে আমি তো যাব না,ভীতু মেয়ে! সময় নষ্ট না করে, দাও। তুমি যত তাড়াতাড়ি দেবে,তত তাড়াতাড়ি বের হবে এখান থেকে। নাও,কুইক!”
তীব্র গাল আরো এগোলো। পুষ্পিতার পুরন্ত ঠোঁটে ছুঁইছুঁই ভাব। নিরুপায় হয়ে পড়ল মেয়েটা। হাতদুটো এমন শক্ত করে ধরেছে! কোন ফাঁক গলে পালাবে সে?
কিন্তু চুমুটাও বা খাবে কী করে? যেখানে ওনার দিকে সরাসরি তাকাতেও বুক কাঁপে, আড়ষ্টতায় শরীর বুঁদ হয়,সেখানে চুমু!
তীব্র তাড়া দিলো,

“ কী হলো? দাও।”
পুষ্পিতা উপায় না পেয়ে হার মানল।
বলল থেমে থেমে,
“ চচোখ ববন্ধ করুন।”
তীব্র রাজি। চটপট চোখ বুজল। এই মুহুর্তে ভীতু মেয়ের লিপস্টিক পরা ঠোঁটের চুমু তার চাই।
একটা বড়ো শ্বাস নিলো পুষ্পিতা। বুকের সুনামি চেপে ধরে, ঠোঁটদুটো তীব্রর গালে কোনওরকমে বসাল একটুখানি ।
বিদ্যুৎ বেগে সরে এসেই বলল,
“ হয়েছে।”
তার নিঃশ্বাসের গতি জোরালো। বুকের মাঝে অস্থিরতার শেষ নেই। অথচ কথা শুনে মনে হলো, বিরাট যুদ্ধ জিতে এসেছে।

তীব্র সাথে সাথেই ছেড়ে দিলো ওকে। অমনি
ছুট লাগাল পুষ্পিতা। বিধিবাম! পেছন থেকে কনুইটা আবার টেনে ধরল সে।
মেয়েটা চমকে যায়। ফিরে চায় চকিতে। চোখেমুখে হতভম্ব ভাব,
“ কী হলো? যা চাইলেন দিলাম তো!”
তীব্রর ঠোঁটে দূর্বোধ্য হাসি। চাউনীতেও তাই। ঝট করে এক টান মারল, উত্তাল ঢেউয়ের মত বুকের মধ্যে এসে আছড়ে পড়ল পুষ্পিতা। হকচকানো দৃষ্টি তুলতেই ভ্রু নাঁচাল সে,
“ ধার নিলাম,শোধ করব না?”
ইঙ্গিত বুঝতেই বুক ছলকে উঠল তরুণীর। সজোরে মাথা নেড়ে বলল
“ না না,লাগবে না।”

“ আমি তো কথার খেলাপ করি না, ভীতু মেয়ে। এক্ষুনি দেবো বলেছি যখন, এক্ষুনি দেবো। আর সেটা সুদ সমেত।”
পুষ্পিতার হাত- পায়ে ভূমিকম্প নামল। ঘরের বাইরে হট্টগোল বেড়েছে। হাসাহাসি, কথার শব্দ স্পষ্ট। এর মধ্যে কপালে এসে ঠেকছে তীব্রর তপ্ত শ্বাস। আস্তেধীরে সেই উষ্ণ ছোঁয়া আরও ঘনিষ্ঠ হলো। পোড়া,কালচে ওষ্ঠপুট নিজের দিকে এগোতে দেখেই পুষ্পিতার পায়ের জমিন কেঁপে ওঠে। হাঁসফাঁস করে বলে,
“ কেউ দেখবে!”
“ দেখবে না।”
“ নূহা!
আন্টি!
রাহা…

বাকিটা উচ্চারণের আগেই, এক জোড়া নরম-গরম ঠোঁট তিরের মত ধেয়ে এসে মিলে গেল তার অধর ভাঁজে।
পুষ্পিতার পৃথিবী দুলে ওঠে। অনুভূতির অচেনা এই তাণ্ডবলীলায় গোটা শরীর থেমে যায়। তীব্রর তাতে হেলদোল আছে? নেই। জীবনের প্রথম চুমুতে দেহের সমস্ত জোর খাটাতে ব্যস্ত সে।
ওষ্ঠাধরের কোমল ত্বকে একেকটি দাঁতের নিষ্ঠুর স্পর্শে,পুষ্পিতা তখন নিজের মাঝে নেই। চোখ খিচে ঢুকিয়ে নিয়েছে কোটরে। সেই ছোঁয়া গাঢ়ত্বের সীমা পেরোতেই,সে হাতের মুঠোয় নখ দাবালো।
পঞ্চইন্দ্রিয়ের বিকল ভাব নিয়ে একটা সময় শরীরের ভার ছেড়ে দিলো পুষ্পিতা। তুলতুলে দেহ গলল তীব্রর বাম হাতের ওপর। যেটা কোমর ছাপিয়ে সঙ্কোচহীন ঘাড় ছুঁয়েছে তার।

এই ছোঁয়ার মাঝেই যেন বছর কাটে, শতাব্দী ঘনায়। নিঃশ্বাস বদল করার অজুহাতে দুটো দেহের নৈকট্য বেড়ে আসে আরও। কতক্ষণ কাটল কে জানে! তবে হুট করে মেয়েটাকে ছেড়ে দিলো তীব্র। পুষ্পিতা গভীর শ্বাস টানল। পিছিয়ে এলো এক পা। চোখেমুখে বাধ ভাঙা লজ্জা মেয়ের। মাথা তুলে তাকানোও দুঃসাধ্য।
তীব্র নিজের ঠোঁট মুছল। প্রেয়সীর কুণ্ঠায় লালচে মুখখানায় পূর্ণ দৃষ্টি ফেলল এক পল। ভ্রু নাঁচিয়ে শুধাল,
“ আরো চুমু চাই?”

পুষ্পিতার শরীর ছলকে ওঠে। লজ্জায়, ভালোলাগায় দরজা খুলেই বেরিয়ে যায় দৌড়ে।
সহসা সামনে পড়ল নূহা। ওকে দেখেই বলল,
“ কোথায় ছিলি তুই? আম্মু খুঁজল, আমি খুঁজলাম। কেকও…”
হঠাৎ খেয়াল পড়ল পুষ্পিতার অশান্ত গতিবিধিতে। ঠোঁটের দিকে চোখ যেতেই, আর্তনাদ করল,
“ এ কী! ঠোঁট কাটল কী করে? লিপস্টিকও তো উঠে গে…”
মুখোমুখি ঘর হতে তক্ষুনি বেরিয়ে এলো তীব্র। বন্ধুর পেছনে তাকে দেখেই কথা থেমে গেল নূহার।
পুষ্পিতা ঢোক গিলে সাফাই দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কিন্তু যা বোঝার বুঝে ফেলল সে। থতমত খেয়ে নিজেই লজ্জা পেলো বেচারি৷ গলা ঝেড়ে বলল,

“ ছাদে যা। আম্মু ডাকছেন।”
অস্বস্তিতে ডোবানো চোখদুটো নিয়ে নূহা কোথাও পালানোর জায়গা পেলো না। সামনে পড়ল মায়ের ঘর। ত্রস্ত বেগে ওখানেই ঢুকল। পুষ্পিতা তখনও দাঁড়িয়ে। নূহার হঠাৎ ভোল বদল মাথায় ঢোকেনি। ঢুকবে কী করে? তাহলেও যে বুকের কাঁপন কমা চাই। সেটা তো এখনও ঘোড়ার মত ছুটছে।
কিন্তু যার জন্যে এত কিছু! তার এসবে তোয়াক্কা আছে? সে আরামসে আবার পাশে এসে দাঁড়াল। চওড়া দেহ কানের কাছে ঝুঁকিয়ে বলল,
“ স্ট্রবেরী ছিল,রাইট?”
পুষ্পিতা প্রকট চোখে চায়। গলার কাছটা ব্রীড়ায় ফ্যাসফ্যাসে তার। তীব্র বলল,
“ একদিনের এইটুকু ধার-শোধে মন ভরেনি। রোজ পাওয়ার জন্যে হলেও বিয়ে ব্যাপারটা এগিয়ে আনা দরকার। তাই না?”

পুষ্পিতার আকাশে আজ যত আনন্দ মেঘ, ততটাই বুকের ভেতর বর্ষার ঢাল লুকিয়ে রাখছে নূহা। এত আয়োজন,চেনাজানা আত্মীয়, উল্লাস কোনওকিছুতেই এই বর্ষণ থামার নাম নেই। কারণ, সেই ঘুরেফিরে নাহিদ।
এক রাতেই ছেলেটা কেমন পালটে গিয়েছে। দেখে না। কথা বলে না। শরীরে সামান্য ছোঁয়া লাগাতেও ঘোর বিরোধিতা তার।
কেক কাটার সময়ে ঘরে এলেও, টেবিলের কাছে আসেনি। সবার সাথে তাল মিলিয়ে হাত তালি দেয়নি। গলা মিলিয়ে কালকের মত গায়নি,
“ শুভ জন্মদিন, নূহা!”

চুপ করে এক কোণে বসে ছিল। সব অস্বস্তি ঠেলে নূহা যখন কেক হাতে এগোতে নিলো খাওয়াবে বলে? পূর্বেই নাহিদ উঠে বেরিয়ে গেল আবার। ভাঙা কাচের মত খানখান মন নিয়ে চেয়ে থাকা তরুণীতে দেখলও না এক পল। কাল আবেগ খুইয়ে করে ফেলা ভুলটা এত গাঢ় ছিল তাহলে? সেজন্যেই নাহিদ এইভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে ওকে?
নূহার ভেতর ছিঁচকাঁদুনের বিরল সত্ত্বাটা আচমকা কেমন মাথা গজিয়ে উঠছে। প্রেমে পড়া থেকেই হুটহাট কান্না পাচ্ছে তার। বুকের খাঁচায় এক তরফা প্রেমের যে দানব ভর করেছে? তার থেকে কি সত্যিই মুক্তি নেই?
এখন রাত প্রায় নয়টার কাছাকাছি বাজে। এতগুলো ঘন্টা নাহিদ একটাও কথা বলেনি। বন্ধুত্বের পর এটাই ওদের সর্বাধিক দুরুত্ব।

নূহার আর সহ্য হলো না। অনেকক্ষণ তক্কে তক্কে ছিল, নাহিদের সাথে একটু কথা বলার আশায়!
কিন্তু ছাদ,বাড়ি সবখানে গিজগিজে মানুষ। মিরাজরাও আছে। তীব্রর বন্ধু তারা। প্রায়ই বিল্ডিংয়ে যাতায়াত থাকে। একবার তীব্র পরিচয় করিয়েছিল। আয়েশা তাই না ডেকে পারেননি!
পুষ্পিতা একটা টেবিলে খাবার বাড়ার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু বিক্ষিপ্ত চিত্তে প্রচণ্ড হাত কাঁপছে। তীব্রর দুষ্টু সাদাটে চোখ এখনও ঘুরছে তারওপর। ধনুকের ন্যায় নিশানায় রেখে জ্বালাচ্ছে শুধু।
সব ছাপিয়ে চারদিক চেয়ে বিমর্ষ চোখে নাহিদকে খুঁজল নূহা। পেলোও এক সময় । ওই তো, বাবুর্চিদের রান্নার ওখানটায় ব্যস্ত। গামলা ভরে ভরে খাবার নেয়ায় সাহায্য করছে। হুহ,সবদিকে খেয়াল আছে। খেয়াল নেই শুধু নূহার ওপর। এই যে নূহা তার শোকে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, একবারও জিজ্ঞেস করেছে এসে? শুধু
কাজ দেখানো তাই না?

ও হনহন করে এগিয়ে গেল। বক্ষঃস্থলের তীব্র উচাটনই হয়ত সাহস যোগাল এতে!
গিয়েই নাহিদের হাতটা টেনে ফেরাল নিজের দিকে ৷ ছেলেটা চমকাল কিছু। ভড়কানো চোখ নিভে গেল নূহাকে দেখতেই। সারাদিন মুখজুড়ে যেমন উদাসীনতা ছিল? ঠিক অমনটাই ভর করল আবার।
নূহার মস্তক তেতে ওঠে।
এমন ঘোর অবজ্ঞা মেনে নিতে পারে না। চ্যাঁচাল মৃদূ স্বরে,
“ কী সমস্যা আপনার? এমন করছেন কেন? কী করেছি আমি?”
নাহিদ কথা বলল না। ভান করল শুনতেই পায়নি। কাজে মন দিলো চুপচাপ।
নূহা বিহ্বল,বিমুঢ়। সব কিছু চোখের সামনেই কেমন এলোমেলো হলো। আরও কিছু বলবে, হঠাৎ ডাকলেন আয়েশা।
“ নূহা,এদিকে আয়।”

কথা থামল ওর। পরপর দাঁত চেপে বলল,
“ আপনাকে আমি পরে দেখে নিচ্ছি!”
নাহিদ তাও ফিরল না। নূহা গজগজিয়ে হাঁটা ধরে। আচমকা ডাকল সে,
“ মিস নূহা!”
সহসা মেয়েটা থমকে দাঁড়ায়। সারাদিন,সারাদিন পর মানুষটা ডাকল ওকে! ওর নাম বলল। ঝলমলে মুখ আর বুক ভরতি আশা নিয়ে তড়িৎ ফিরে চাইল নূহা।
নাহিদের ঠোঁটে হাসি নেই। আলো নেই। না আছে কোনও রকম কোনও বোধগম্য ইঙ্গিত।
নূহার কণ্ঠ আনচানে,

“ কিছু বলবেন? বলুন না কী বলবেন!”
মেয়েটা ভাবল নাহিদ নিশ্চয়ই ‘সরি’ বলবে। নাহলে বলবে, হয়ত আজ মন ভালো ছিল না। তাই কথা বলেনি।
নাহলে বলবে কাল সে ভেবে দেখেছে ওর কথা। বুঝতে পেরেছে নূহা কি বলতে চায়!
সেই অলীক স্বপ্ন বোনা চোখদুটোয় সরাসরি চাইল নাহিদ।
একটুখানি ভণিতাও করল না। নিষ্প্রভ চেহারায় কেবল ঠোঁট নেড়ে বলল,
“ আমি আপনাকে শুধু বন্ধুই ভাবি। অন্য কিছু নয়!”

কালবৈশাখী হাওয়ায় লণ্ঠনের আলোটাও যেমন দপ করে নিভে যায়? নূহার হাসিমুখ ঠিক অমন ভাবে বিলীন হয়ে গেল। বুকের গতি নিশ্চল। ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাওয়া কষ্ট নিয়ে সে হাঁ করে চেয়ে থাকে। নাহিদ আর দাঁড়াল না। কথাও খরচ করল না। ডাল ভর্তি বড়ো বাটিটা হাতে তুলে পাশ কাটাল নিশ্চুপ।
নূহার পৃথিবী দোদুল্যমান। ভেতরটায় ঘূর্ণিঝড়। দম থিতিয়ে আসবে আসবে করছে। গোটা শরীর সেই প্রকোপে টলে উঠল কেমন। জড়ের মত দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই অধৈর্য হয়ে কাছে এলেন আয়েশা।
“ কী রে, কখন থেকে ডাকছি তোকে! শুনিসনি?”

নূহার চোখ জ্বলছে। কোটরে সুনামি নেমে আসার ভাব। কণ্ঠনালীতে কান্নার ঢেউ। কম্পিত হাত তুলে কোনওরকম গাল-গলার মেকি ঘাম মুছল সে। মেয়ের হাবভাবে খটকা লাগে আয়েশার। বললেন,
“ কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিবি একটু?”
নূহা যেন সুযোগ পেয়ে গেল। চোখ নিচে রেখেই মাথা নাড়ল একটু!
তিনি বললেন,
“ আচ্ছা, তাহলে যা। এদিকে এত লোক! কোনদিক ছেড়ে কোন দিকে যে যাব। আমি বরং তোর সাথে পুষ্পিতাকে পাঠাই।”
“ লা..লাগবে না, আম্মু। আমি পারব!’’

গড়গড়িয়ে বলে দিয়ে সম্মুখে টালমাটাল পা বাড়াল মেয়েটা। সিঁড়ির হাতল ধরে হাতড়ে হাতড়ে নামল। ঘরে ঢুকল অমন বিশ্রান্ত পায়ে।
পুরো বাড়িতে তখন কেউ নেই। সবাই ছাদে।
শূন্য ঘরটাই নূহার কাঁদার জন্যে উপযুক্ত স্থান। পেলব হাতে দোর চাপিয়ে তাতে পিঠ ঠেসে দাঁড়াল সে। টের পাচ্ছে বক্ষভাগে উথলে আসা যন্ত্রণা।
অমনি দুপাশে মাথা নাড়ল মেয়েটা। শক্ত করে একটার পৃষ্ঠে আরেকটা ঠোঁট চেপে ধরল। পণ করল,কাঁদবে না। কিছুতেই না। প্রেমে পরাস্ত হয়ে কান্নাকাটি মানায় না ওকে।
হলো না! ভালোবাসা, অনুভূতি দুইয়ের যাতাকলে সমস্ত প্রয়াস ভেঙেচূড়ে গেল। গলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে কে যেন কান্না গুলো টেনে আনল বাইরে।

অমনি দরজা ঘেঁষে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল নূহা। দুহাতে মুখ চেপে হুহু করে কেঁদে উঠল জোরে।
নাহিদ ওকে ভালোবাসে না, এ তো জানা কথা। তাহলে এই সত্যিটা মেনে নিতে কেন এত কষ্ট হচ্ছে নূহার? এমন মরে যাওয়ার মত অসহ্য বেদনাটাই বা কীসের?
কান্নার দমকে মেয়েটার কোনও উত্তর মিলল না। তবে পাগল পাগল মনে হলো নিজেকে। নাহিদ অমন পাষণ্ডের ন্যায় কথাটা বলতে পারল ওকে?
আচমকা কলিংবেল বাজল। ধড়ফড় করে চোখ মুছল নূহা। এই দুঃখ, দূর্বলতা সব তার একার। এসব ও কাউকে দেখাবে না। ভাবল, পুষ্পিতা এসেছে।

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৬

ত্রস্ত উঠে দোর খুলল নূহা।
ওপাশের মুখখানা দেখতেই চমকে উঠল পিলে।
বিস্ময়ে নিস্তব্ধ হয়ে আওড়াল ,
“ মিথিলা আপু!”

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৮