সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৯ (২)

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৯ (২)
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

দুপুরের রোদের তাপে শস্য ক্ষেতে প্রকৃতির ঝুমঝুমির সুর বাজছে। আলোতে মাখা প্রজাপতির সাথে পাল্লা দিয়েছে মেঘ। চারদিকে হেমন্তের শীতল বাতাস। সকালের মুহুর্তটা আজ বড্ড তাড়াতাড়ি পার হলো। ঘড়িতে সময় অনেক!
চঞ্চলতায় মোড়ানো নৈসর্গের মাঝে বুকের ভেতর এক পশলা বিষাদ নিয়ে নাহিদ বিছানায় শুয়ে আছে। পাশের টেবিলে সকালের সেই শুকনো বাসি রুটি। কোণায় টলটল করছে গ্লাসের জল। নিরলস দুপুরে নাহিদের উদাস মন কোনোদিকে নেই। ভাবুক চিত্তে কেবল নূহার দখলদারি নিয়ে অদূরের দেয়াল দেখছে সে৷ নূহা ওভাবে বলতে পারল ওকে?

“ আপনাকে আমার সহ্য হয় না!” কথাটা উচ্চারণের আগে একটু বিঁধলও না?
অমন মুখের ওপর দোর আটকে দেয়ার চিত্রতে আরেক দফা ব্যথায় ঘায়েল হলো নাহিদ। শেষ কদিন ধরে মেয়েটাকে এক ফোঁটাও হাসতে দেখেনি ও। অথচ সেবার ছাদে! নাহিদ যখন গাছ লাগাচ্ছিল? ঝর্ণার মতো উচ্ছ্বলতা নিয়ে হাসছিল নূহা। ছাদের কথা ভাবতেই
চট করে একটা ব্যাপার নাহিদের মাথায় চলে এলো।
নূহা যে সেদিন বলেছিল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ মনকে কখনো অন্যের দ্বারস্থে ফেলে রাখতে নেই। এর দায়িত্ব আমাদের,শুধু আমাদের। মন বড্ড নাজুক। আপনি হাতের মুঠোয় নিয়ে ওকে শাসন করতে পারবেন না। কিংবা যা বোঝাবেন ও তাই বুঝবে না। ওকে আকাশের মুক্ত পাখিদের মতো উড়তে দিতে হবে। ও উড়বে,যত ইচ্ছে উড়বে। শুধু আপনি দূর থেকে একটু যত্ন,আরেকটু ভালোবাসা দিয়ে ওকে আগলে রাখবেন। ব্যস! ও-ও একদিন ফুলের মতো বিশেষ কিছু উপহার দেবে আপনাকে। কিন্তু তা না করে আপনি যদি ওকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে রাখেন তাহলে চলবে কী করে বলুন তো?”
সহসা ঝট করে উঠে বসল নাহিদ। বুকের ভেতর অদ্ভুতুরে জ্বালাপোড়া ঘ্রাণ। আচ্ছা,ও কি মনটাকে কেবল মিথিলার দ্বারস্থে ফেলে রাখছে না? যার কাছে কী না ওর মনের কোনো মূল্যই নেই! আর এই বোকামির চক্করে ও কি নূহার মতো মেয়েকে হেলায় হারিয়ে ফেলছে?

নাহিদের অন্তরে এক অন্যরকম দ্বি সত্তা মাথা তুলে দেয়। একজন বলে,নূহাকে কষ্ট দিস না। অন্যজন বলে, ও তোর বন্ধু। বন্ধুর সাথে আবার ভালোবাসা কীসের? দুটোর যন্ত্রণায় অতীষ্ঠ হয়ে ছেলেটা হাঁসফাঁস করে উঠল।
যদিই ভালোই না বাসবে তাহলে ও সারাক্ষণ কেন নূহাকে নিয়ে ভাবে? নূহা খেলো, কী খেলো না, নূহা কাদল কী হাসল! কেন এসব নিয়ে এত মাতামাতি তার!
নূহা কথা না বললে ওর বুক পোড়ে কেন? যে মিথিলার শোকে অর্ধবছর নাহিদ হাহুতাশ করে কাটাল, সে ফিরে এসেছে।
কিন্তু কই,ওর তো সামান্য খুশিও হচ্ছে না। নিজের মাঝে আনন্দের লেশমাত্র নেই। বারবার,বারবার শুধু নূহাকে মনে পড়ে। নাহিদ মস্তিষ্কের দোলাচলে
থম মেরে গেল।

কোনোভাবে নিজের অজান্তে নূহাকে ভালোবেসে ফেলেনি তো!
নাহলে মেয়েটার কথা ভাবলেই দুনিয়াটা এমন ঝিমঝিম করে কেন?
তক্ষুনি কারো পায়ের আওয়াজ এলো কানে। । নাহিদ মুখ তুলে চায়। মিথিলা এসেছে দেখেই সটান দাঁড়িয়ে পড়ল। হাসির ফোয়ারা নিয়ে এগিয়ে আসা মেয়েটার পানে প্রশ্ন ছুড়ল তৎপর,
“ তুমি? ভেতরে এলে কী করে? দরজা তো…”
“ হাঁ করে খুলে রেখেছ। দিন দুপুরে কেউ এমন করে?
যদি চোর ঢুকে যেতো!”
নাহিদ হিসেব মেলাতে পারল না। দরজা খোলা রেখে এসেছে? সেই কখন এলো ওই ফ্ল্যাট থেকে,এতটা সময় খোলা ছিল?
আর ও কিচ্ছু খেয়ালও করেনি। সব ধ্যান কি নূহা নিয়ে গেছে?
ছেলেটা ফের বিরক্ত হয়। আবার নূহার কথা কেন? ভুল করে দরজা খোলা রেখেছে হয়ত! তাতেও নূহার প্রসঙ্গ তুলবে কেন?

আজকাল ওর সব ভাবনা, সব চিন্তা কেন ওই মেয়েটাতেই আটকায়!
ওপাশ হতে দুরন্ত পায়ে এগিয়ে এলো মিথিলা। হাত ধরল ওর। প্রফুল্ল চিত্তে বলল,
“ তোমার জন্যে আমি কিছু কেনাকাটা করেছি,বোসো দেখাই।”
হাতটা আলগোছে ছাড়িয়ে নিলো নাহিদ। তবে বসল চুপচাপ। মিথিলা খেয়াল করলেও,ধরা দিলো না। নিজের মত ব্যস্ত হয়ে একের পর এক ব্যাগ মেলল সামনে। দু বছরের প্রেমে নাহিদকে একটা সুতোও দেয়নি সে।
সেখানে আজ প্রথম বার দুটো শার্ট, একটা ঘড়ি,সানগ্লাস কিনে এনেছে।
অথচ সে ছেলে ফিরেও দেখল না। বিরস চিত্তে অন্য কোথাও চেয়ে রইল।
মন-মস্তিষ্ক সবটা অকেজো নূহার চিন্তায়।

মেয়েটা কাঁদছিল তখন। এখন কী করছে? ঠিকঠাক খাচ্ছে তো!
নাহিদ কী সব ভুলে আরেকবার যাবে? নিজের হাতে চোখের জল মুছিয়ে বলবে,
“ আমার শোকে এত কান্না কীসের, আপনার? খেয়ে নিন তো।”
উদাস নাহিদকে দেখে মিথিলার হাসি মুছে গেল। বাহু ঝাঁকিয়ে বলল,
“ কী হলো? দেখো কী কিনলাম?”
নাহিদ নড়ে উঠল ঠিকই, তবে ধ্যানের ফিতে ছেঁড়েনি। মনের কথা জ্বিভ ফস্কে বেরিয়ে এলো,
“ নূহা কি খেয়েছে?”

মিথিলা থমকে যায়। চোখের চাউনীতে হতবুদ্ধিভাব!
নিজের কথায় নাহিদ নিজেও ভড়কে গেল কিছু । অপ্রস্তুত ভাব লোকাতে চটজলদি চোখ নামাল সে। কিন্তু মিথিলা শান্ত থাকতে পারেনি। চটে আসা মেজাজে,হতবাক আওড়াল,
“ নাহিদ, তুমি নূহাকে নিয়ে ভাবছো? আমি তোমার জন্যে কত্ত কিছু কিনে আনলাম আর তুমি পড়ে আছো ঐ মেয়েটাকে নিয়ে? তার মানে আমিই ঠিক, নূহার সাথে তোমার কিছু চলছে! কী চলছে তোমাদের? বলো, কী চলছে!”

নাহিদ চ সূচক শব্দ করল। খুব আস্তে বলল,
“ চেঁচিও না প্লিজ! এখন এসব ভালো লাগছে না আমার।”
অনুনয়ে দমল না তরুণী। বরং জ্বলে উঠল স্ফূলিঙ্গের ন্যায়,
“ ভালো লাগছে না মাই ফুট। আমার সামনে বসে অন্য একটা মেয়েক নিয়ে তুমি ভাববে আর আমি তোমার ভালো লাগছে না বলে চুপ করে থাকব?
আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, নাহিদ। নূহার সাথে তোমার কেমন সম্পর্ক? কেন ওকে নিয়ে এত কনসার্ন তুমি?”
“ আমরা বন্ধু, মিথিলা। বন্ধুকে নিয়ে তো বন্ধুই কনসার্ন হবে। আল্লাহর দোহাই একটু আস্তে কথা বলো। চারপাশের মানুষ শুনবে।”
“ শুনলে শুনবে। তারা জানুক, তুমি আমাকে ঠকাচ্ছো। একদিকে আমাকে আশায় রেখেছো, আর অন্য দিকে ওই মেয়ের প্রতি…”

নাহিদ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। শান্ত,তবে কড়া কণ্ঠে বলল,
“ বারবার ওই মেয়ে ওই মেয়ে করবে না। ওর একটা নাম আছে। ছোটো হলেও তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলা একটা মানুষের ভদ্রতা,মিথিলা। আশা করি বিদেশে গেলেও এটুকু ভদ্রতা এখনও বিসর্জন দাওনি?”
মিথিলা তাজ্জব হয়ে বলল,
“ তুমি নূহার জন্যে আমার সাথে এভাবে কথা বলছো, নাহিদ? কই, আগে তো এরকম করোনি। কোনোদিন আমার হ্যাঁ-য়ের বিপরীতে চোখ তুলেও না বলতে শুনিনি তোমাকে। তাহলে হঠাৎ এত পালটে কেন? নূহার জন্যে,তাই না?”
নাহিদের ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল। সবদিকে শুধু নূহা। তার মাথায়,মনে, চিন্তায়-চেতনায়,মিথিলার প্রশ্নে। শুধু নূহা, নূহা আর নূহা। এসবের মাঝে নিজের মেজাজ ধরে রাখা দুঃসহ হয়ে পড়ল। অতীষ্ঠতায় চ্যাঁচিয়ে উঠল সে,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ, নূহার জন্যে। সব নূহার জন্যে। আমি পালটে গেছি নূহার জন্যে। শ্বাস নিচ্ছি নূহার জন্যে। যা করছি সব, সব নূহার জন্যে। কেন জানো?

কারণ,ওর সাথে আমার গভীর প্রেম। কী শুনতে চাও তুমি,মিথিলা? আমি ওকে ভালোবাসি কি না? হ্যাঁ, বাসি। ও আমার কে?
ও আমার বউ। পেয়েছ উত্তর? হয়েছে শান্তি? ফর গড শেইক মুখটা বন্ধ রাখো এবার!”
মিথিলা স্তব্ধ,নির্বাক। কিছুক্ষণ হাঁ করে নাহিদের ফরসা মুখে চেয়ে রইল। বিহ্বল আওড়াল,
“ এত কথা শিখেছো তুমি, নাহিদ? এত কিছু বললে আমাকে? সত্যি, অবাক না হয়ে পারছি না। নূহা তাহলে ট্রেনিংটা তোমায় ভালোই দিচ্ছে!”
নাহিদ ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,

“ বারবার ওকে টানবে না,মিথিলা।”
“ কেন, খারাপ লাগে বুঝি?”
তার স্পষ্ট জবাব,
“ হ্যাঁ,লাগে।”
“ তাই? এত ভালোবাসো?”
“ হ্যাঁ।”
একটু আগের কথাগুলো রাগের বশে বললেও,এই উত্তর আপনা-আপনি বেরিয়ে এলো তার।
নাহিদ জড়বুদ্ধি হয়। হতভম্ব চোখ ফেলে মিথিলার ওপর। স্তম্ভিত মেয়েটার নয়ন জোড়া ছলছল করে উঠল। মুখের ওপর বলা কথা নিতে না পেরে এক ছুট্টে ঘর ছাড়ল সে।
নাহিদ বিধ্বস্ত চিত্তে ধপ করে খাটে বসে পড়ল। হতাশ গলায় বলল,

“ আমি এটা কেন বললাম? নূহাকে ভালোবাসি কেন বললাম আমি?”
ওদিক থেকে কোনো উত্তর আসেনি।
তবে ছেলেটার অনুশোচনা হলো।
ভাবল, রাগ করে মিথিলাকে একটু বেশিই বলে ফেলেছে। সদ্য সংসারচ্যুত মেয়েটা। হয়ত মন মেজাজ ঠিক নেই। কী বলতে কী বলছে! ও একটু মাথা ঠান্ডা রাখলেই পারতো। এই সময় সহানুভূতির বদলে এত কড়া কড়া কথা শোনানো উচিত হয়নি ওর। নাহিদ তড়িৎ উঠে এলো।
এক প্রস্থানে দুই কাজ সাড়তে৷ মিথিলার ব্যাপারটা সামলানোও হবে। আর…
ঐ আরের পরটুকু সে আর উচ্চারণ করতে চাইল না। যা হচ্ছে,হোক না।

নূহা ভীষণ বিভ্রমে ভুগছে।
মিথিলা হুট করে বলছে আজকেই ঢাকা ফিরে যাবে। না, ওকে বলেনি৷ মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার সময় শুনেছে।
তারওপর কাঁদছেও। চোখমুখ ডুবুডুবু জলে। যে কান্নার তোড় দেখে নূহা নিজের কান্না ভুলে গেল। সকাল থেকেই তার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। চারপাশ শুধু বিষণ্ণতায় মোড়ানো। তার মধ্যে আবার এসব!
কী হয়েছে বুঝতেও পারছে না। এই তো হাসতে হাসতে শপিংয়ে গেল। আবার ফিরল কেঁদে কেঁদে। ব্যাপারটা কী? ও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল পাশে।
মিথিলা যা যা কিনেছে নাক টেনে টেনে ব্যাগে ভরছে সেসব। এমনিতে তো জামাকাপড় আনেনি। যতটুকু ওই আজকের কেনা!

কিন্তু কাঁদছে কেন এ মেয়ে? যার জীবনে মিস্টার ঢেঁড়সের মতো মানুষ আছে,চোখের জল তাকে ছুঁতে পারে কখনো!
কৌতূহলে টিকতে না পেরে কাছে এলো নূহা। কাঁধে হাত রাখল, তুরন্ত হাতটা ঝাড়া মারল মিথিলা।
“ খবরদার, আমাকে ছোঁবে না।”
নূহা আকাশ থেকে পড়ল।
বুঝতে না পেরে বলল,
“ এভাবে কথা বলছো কেন? কী করেছি আমি?”
“ কী করেছ? আমার থেকে আমার নাহিদকে কেড়ে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করছো কথাটা! লজ্জাও করছে না?”
নূহা আশ্চর্য হলো।
কোটরে ফ্যালফ্যালে বিস্ময়। এ মেয়ে পাগলের মতো কী বলছে এসব? এই তো সকালে শুনল নাহিদের সাথে মিল হয়েছে। তাহলে!
মিথিলা চোখমুখ লাল করে বলল,

“ অসভ্য মেয়ে! কেন, এত ছেলে থাকতে তোমার নাহিদের ওপরেই গলে পড়তে হবে কেন? ও আমাকে ভালোবাসে জেনেও কী করে ওর পেছনে পড়ে থাকো তুমি? সামান্য লজ্জাও নেই? এত বেহায়া তুমি! নাহিদ আজ প্রথমবার আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেছে। শুধু তোমার জন্যে,নূহা। কী দেখিয়ে পটিয়েছ ওকে? রূপ তো তেমন নেই। তাহলে, শরির? পাশাপাশি থাকো, আবার মাঝেমধ্যে একা। ফাঁকা বাসায় কতবার এনেছ ওকে?”
নূহার ব্রক্ষ্মতালুতে রাগের আগুন দাউদাউ করে উঠল। কারো কথা শুনে নেতিয়ে থাকার মেয়ে সে নয়। পোক্ত জবাব দেবে,পূর্বেই পেছন হতে চ্যাঁচিয়ে উঠল কেউ,
“ মিথিলা!”

এক চিৎকারে কেঁপে উঠল ওরা। ত্রস্ত ফিরল সেথায়। নাহিদ লম্বা পায়ে এগিয়ে এলো। দাঁড়াল নূহার পাশে।
শিথিল চিবুকে নম্রতা নেই। ভীষণ অবিশ্বাস নিয়ে বলল,
“ ছি, ছি মিথিলা! আমি ভাবতেও পারছি না এই কথাগুলো তুমি বললে! নিজের কানে না শুনলে তো বিশ্বাসই হতো না। নূহার লজ্জা নিয়ে প্রশ্ন তুলছো?
আর তুমি,তোমার লজ্জা করল না? একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে এমন নোংরা কথা বলতে!”
মিথিলা অচিরেই চুপসে গেল। থতমত ভাবটা জেঁকে বসল মুখে। নাহিদ আবার এইসময় এখানে এসেছে কেন? অপ্রস্তুত চিত্তে ঘনঘন ঠোঁট চোবাল জ্বিভে। সাফাই দিতে হাঁ করবে,থমকাল ওর কঠোর গলায়,
“ তোমার সাহস কী করে হয় ওকে এসব বলার?
তুমি কী ভেবেছিলে, মিথিলা? টাকার জন্যে অন্যের কাছে যাবে,তারপর ফিরে এসে মিথ্যে বলা কান্নাকাটি করলেই ব্যস! আবার তোমার হাতের পুতুল হবে নাহিদ? সব কি এতটাই সহজ,মিথিলা?”
পরপরই তার কণ্ঠ বুজে এলো। বলল,

“ তোমাকে আমি নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু তুমি তা ধরে রাখতে পারোনি।
আমার ভালোবাসাকে দুপায়ে ঠেলে দিয়ে,অন্য কাউকে বেছে নিয়েছিলে। তখন কি একবারও আমার কথা ভেবেছো? আমি কষ্ট পাব,কী নিয়ে বাঁচব,আদৌ ভেবেছিলে এসব? ভাবোনি।
তাহলে আজ যদি নূহার সাথে আমার কিছু থেকেও থাকে তা নিয়ে ওকে চার্জ করার তুমি কে? হু আর ইউ?”
মিথিলা কিংকর্তব্যবিমুঢ়! নাহিদকে আজ বড্ড অচেনা লাগছে। এই নাহিদকে তো সে চেনে না। এত শক্ত কথা,এমন কঠিন চাউনী ছেলেটার হলো কবে!
মুখোমুখি দাঁড়ানো নূহার দিকে এক পল চাইল সে। মেয়েটা ততোধিক বিহ্বলিত! হাঁ করে নাহিদকে দেখছে। যেই চাউনীটায় মিথিলার রাগ হলো। জ্বলে উঠল শরীর।
হতবাক চিত্ত আড়াল করে মুখ খুলল পরপরই,

“ চার্জ করছি,কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো! একজনকে ভালোবাসার কথা বলে আরেকজনকে নিয়ে থাকতে তুমি পারো না,নাহিদ। এটাকে ঠকানো বলে!”
নাহিদ পালটা জবাব দিলো,
“ তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে,মিথিলা। আমি কিন্তু তোমাকে বলিনি আমি তোমায় ভালোবাসি!”
“ তার মানে?”
“ মানে,আমি তোমাকে ভালোবাসতাম। বাসি না!”
অমনি মিথিলার শরীর এক পা পিছিয়ে গেল। নিস্তব্ধ আওড়াল,
“ কী? তাহলে, তাহলে যে সকালে আমার মাথায় হাত রাখলে! বললে আমি আছি? সেসবের মানে কী?”
নাহিদের চোখেমুখে বিস্তর অগ্নিশিখা। শুভ্র মুখটা লাল। কাটকাট বলল,

“ মানে তেমন কিছুই না। তুমি কাঁদছিলে তাই একজন মানুষ হিসেবে সান্ত্বনা দিয়েছি। তার অর্থ তো এটা নয় যে, আমি তোমায় বলেছি তোমাকে ভালোবাসি! বা বিয়ে-টিয়ে করে বাচ্চার বাবা হয়ে যাব। আমি তোমাকে ভালোবাসতাম মিথিলা। খুব ভালোবাসতাম। আমাকে এভাবে ঠকানোর পরেও বাসতাম । কিন্তু এই ভালোবাসা তুমি নিজের হাতে শেষ করেছ। কখন করেছো জানো? আজ সকালে।
অতগুলো মিথ্যে বানিয়ে বানিয়ে বলে,আরেকবার প্রমাণ করেছ তুমি আসলে বিশ্বাস করার যোগ্যই নও।”
মিথিলার স্তম্ভ মুখটা ভ্যাবাচ্যাকা খেল। ঢোক গিলল শঙ্কিত চোখে। নাহিদ নীরস হেসে বলল,

“ আমি বোকা,গাধা। সব। কিন্তু কোনটা ভালোবেসে বাধ্য হয়ে ছেড়ে যাওয়া,আর কোনটা টাকার লোভে ছেড়ে যাওয়া এটুকু বোঝার মতো জ্ঞান আমার আছে। তুমি আমার জীবনের প্রথম নারী। সেজন্যে তোমার প্রতি আজও আমার একটা সফট কর্নার আছে,মিথিলা। তোমার চোখের পানি আজও আমার খারাপ লাগার কারণ। কিন্তু তাই বলে এটা ভেবে ফেলো না,আমি আবার তোমার ফাঁদে পা দিচ্ছি। বিশ্বাস করো,যদি সত্যিই তুমি তোমার বাবার জন্যে বাধ্য হয়ে আমাকে ছাড়তে আমি নিজের সারাটা জীবন তোমার অপেক্ষায় বিলিয়ে দিতাম। কিন্তু তাতো নয়! তুমি লোভের বশে ছেড়েছিলে আমায়।
তাই তোমাকে আবার আমার মন ভাঙার দ্বিতীয় সুযোগ দেবো না,মিথিলা।
মিথিলা বিমূর্ত,বাকরুদ্ধ। অস্পষ্ট আওড়াল,

“ নাহিদ!
“ এত কথা আমি তোমাকে বলতাম না! কখনোই বলতাম না। কোনো অভিযোগও করতাম না। যদি না আজ তুমি নূহাকে এভাবে অপমান করতে।
আমি আর কত ঠকব বলোতো? একটা কাদার দলা অবধি আছাড় খেতে খেতে শক্ত পিণ্ড হয়ে যায়।
সেখানে, আমি তো মানুষ। রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। একবার তোমাকে মন দিলাম,আর তুমিও যেভাবে টুকরো টুকরো করে দিলে,বহু কষ্টে ওই মন আমি জোড়া লাগিয়েছি। আমার আর এত স্পর্ধা নেই তোমাকে ফিরতি সুযোগ দেয়ার।”

“ তাহলে আমি কী করব?
ফিরে যাব? তবে তুমি খুশি হবে?”
“ সেটা তোমার ব্যাপার। নিজেরটুকু তো তুমি অনেক ভালো বোঝো। এবারেও বুঝবে আশা করি!”
পরিষ্কার জবাব মিথিলার আরেকটা ধাক্কা। নাহিদ বড্ড শান্ত মানুষ। কখনও রাগ করতে দেখেনি। শান্ত মানুষ গুলো হঠাৎ রেগে গেলে খুব ভয়ানক লাগে বুঝি!
মেয়েটা চোখের মাঝে অবাধ বর্ষা নিয়ে বলল,
“ বুঝেছি। এসব তুমি শেখাচ্ছো নূহা,তাই না?”
হতচেতন মেয়েটা নড়ে উঠল। কথা শুনতে পায়নি চাইল এমন ভাবে। কিছু বলার আগে জবাব দিলো নাহিদ,
“ ও আমাকে কিছু শেখায়নি। যা বলেছি,বলছি সব আমার জীবন থেকে, জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে।”
তারপর নূহার হাত ধরল সে। ঐ তুলতুলে মুঠোয় নিজের অমৃসণ মুঠো গাঁথল। মেয়েটা চমকাল। থমকে দেখল সে হাত।
নাহিদ বলল,

“ নূহা অন্তত তোমার মত নয়,মিথিলা। যে একটু ভালো থাকার আশায় আমাকে ছেড়ে দেবে। তুমি যখন আমাকে পুরো নিঃস্ব করে রেখে গেছিলে?
তারপর প্রথম আমি মন থেকে কবে হেসেছিলাম জানো? নূহার সাথে দেখা হওয়ার পর।
ওর সাথে কথা বললে আমার মনে হোতো, আমার কোনো দুঃখ নেই। কোনো বিষণ্ণতা নেই। আমি চিরসুখী একজন মানুষ!

তাই ওকে নিয়ে যদি আমি ভালো থাকতে চাইও এতে দোষের কিছু নেই। পৃথিবীতে সবাই ভালো থাকতে চায়। তুমি চেয়েছ,আমিও চাই। আমি যেমন তোমার আর তোমার বরের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হতে যাইনি,তুমিও এসো না। সময় আছে,সুযোগ আছে মনের সব কালি পরিষ্কার করে নতুন ভাবে বাঁচো।”
মিথিলা প্রহৃত! টইটম্বুর জলমাখা নয়ন জোড়া মেলে রাখল দুজনের হাতের দিকে। নূহারও একই দশা। মেয়েটা স্তম্ভিতের তোড়ে কথা বলতে পারছে না।
মিথিলা অসহায় চোখে ফের নাহিদের দিকে চায়। যদি একটু মায়া হয় তার! কিন্তু সে মানুষ আশ্চর্যভাবে নিজেকে প্রস্তর করেছে আজ । অনীহার তোপে একবার দেখলও না তাকে।
মিথিলা আহত শ্বাস টানল। এই পরিস্থিতির জন্যে তো সে নিজেই দায়ী। কী করবে,কী বলবে? নাহিদ তো আর ওর হাতের মুঠোয় নেই।

কাঁধ ব্যাগটা তুলে চুপচাপ বেরিয়ে গেল মেয়েটা। মনে হলো জীবনের যুদ্ধে গোঁ হারান হারা এক অবলা সৈন্য সে। যেখানে প্রতিপক্ষ নূহা। আর ট্রফি স্বয়ং নাহিদ। ঠিক জয়ের শেষ সীমায় এসে নূহা সেই ট্রফি ছিনিয়ে নিয়ে গেল। চারপাশে দর্শকের হাত তালি। নূহার হাসিতে উজ্জল মুখ।
আর মিথিলা? মিথিলা শুধু আর্ত চোখে দেখল সবটা।
বুকের ভেতর পরাজয়ের এই উত্তালতা চাপা দিয়ে আজীবনের মতো হয়ত চলে গেল সে।
নূহা তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। একবার হাত দেখছে,একবার নাহিদের মুখ। এতক্ষণ যা শুনল,যা ঘটল সেসব সত্যি? না কি স্বপ্ন? ঘুম থেকে উঠলে আবার ভেঙে যাবে না তো!
মিথিলার প্রস্থানপথ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাহিদ।

পাশ ফিরতেই দেখল নূহা ঠোঁট ফাঁকা করে চেয়ে । বিহ্বল চাউনীজোড়া অনুসরণ করতেই,হাতটা ছেড়ে দিলো ও। এতক্ষণের শক্তপোক্ত মুখায়বে রাতারাতি জড়োতা এসে ভিড়ল। কিন্তু তাও নাহিদের চোখ সরে না। পাতা নড়ে না।
দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষণ
নিশ্চল চেয়ে থাকে। সময় কাটল। মুহুর্ত পেরোলো। রয়েসয়ে কথা বলতে চাইল নাহিদ।
কিন্তু নূহা শুনল না। সেদিনের মতোই আজকেও আচমকা ঝাঁপ দিলো বুকে। নাহিদের পিঠ শক্ত হয়ে যায়। দুধ-সাদা সফেদ স্রোত কলকল করে বুকে। অন্তঃপটে কী আশ্চর্য কাঁপন।
নূহা শক্ত করে ধরেছে। পেলব হাতের বাঁধন বড্ড দৃঢ়। ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল,
“ এত ভালোবাসেন! তাও শুধু শুধু কষ্ট দিলেন আমায়! আর আপনাকে ছাড়ছি না,নাহিদ। এই যে ধরেছি পারলে গিয়ে দেখান তো!”

ভেজা কণ্ঠে মেয়েটার নিপাত অভিমান। রিনরিনে এই কণ্ঠের মায়ায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ল নাহিদ।
মোহ নেই,আকর্ষণ নেই। কিন্তু কোনো অলীক টানে তার মনে হলো নূহাকে বুক থেকে সরানোর সাধ্য নেই।
অজান্তে কিংবা অহেতুক, মৃদূ হাসল নাহিদ। অপেক্ষার এক বিস্তর অন্ত দিতে হাত তুলে নিজেও ধরল নূহাকে। দুটো দেহ মিশে যায়। চুকে যায় সব দুরুত্বের সুর। যার প্রমাণ রাখতে বলল সে,
“ যাব না। আমার কূল হারা তরিটা যে শেষমেশ আপনার তীরে ডুবছে,এটুকু বুঝতে আমি বড্ড দেরি করে ফেললাম!”

জামশেদ আজ মন্ত্রণালয়ে যাননি। নিজ
বাড়ির উঠোনের একদম ডানদিকের কোণায়, আরেকটা ছোট্ট এক তলা বাড়ি আছে তার। অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন এটাকে।
খুব দরকারি, কিংবা গোপন কাজগুলো এখানে বসেই সাড়েন। মাঝেমধ্যে এলাকার লোকজনও এসে দেখা করে যায়।
তবে ভদ্রলোকের আজ কাজে মন নেই। তীব্রর ব্যাপারটার সুরাহা নাহলে শান্তি পাচ্ছেন না।
কাল থেকে অনেকবার ওকে ফোন করেছেন,কিন্তু রিসিভ হয়নি। এত্ত গোঁয়ার এই ছেলে! বাপকে বাপ বলে মানে না। সম্মান দেয় না।

তিনি বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিলেন। চোখের চশমা খুলে মাথা রাখলেন চেয়ারে। দু আঙুলে ভ্রু দুটো ঘষলেন ক-বার! মাথাটা এত ব্যথা করছে! এই ব্যস্ততা,রোজকার ঝামেলা,অশান্তি নিতে নিতে দুদণ্ড শ্বাস ফেলার ফুরসত নেই। তাও যদি ছেলের মতিগতি নিজের সাথে মিলতো! মন্ত্রীর ছেলে হয়ে রাজনীতির ধারেকাছে নেই। কোথাকার কোন মেয়ের নেশায় গাজীপুরে পড়ে আছে। কিছু বলাও যায় না। দাঁতের মাথায় বিষ নিয়ে ঘোরে। একটা মাত্র ছেলে হওয়ায় যে জ্বালায় ভুগছেন জামশেদ,এই জ্বালা আর কারোর না হোক।
তক্ষুনি সামনের দরজা ঠেলে ঝড়ের মত কেউ একজন ভেতরে এলো। তটস্থ চোখে চাইলেন জামশেদ। তীব্রকে দেখেই শশব্যস্ত সোজা হলেন আবার।

“ তুমি? এই সময়!”
তীব্রর চোখমুখ পাথুরে৷ বরফের চেয়েও শীতল তার স্বর,
“ আবুলকে ডাকুন।”
জামশেদ বিভ্রান্ত।
বুঝতে না পেরে বললেন,
“ আবুলকে? কেন?”
“ বলব। আগে ডাকুন।”

ছেলের হাবভাব সন্দিহান। আবুলটা আবার কী করল? দেখতে মিনমিনে হলেও বেশি বোঝার স্বভাব ওটার আছে। কিন্তু তীব্রকে তো চেনে,জানে। তারপরেও ওর ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সাহস করেনি তো!
মনের প্রশ্ন মনেই রাখলেন তিনি। কথা না বাড়িয়ে রিসিভার কানে গুঁজলেন। বললেন কাউকে,
“ আমার রুমে এসো!”
তীব্র দাঁড়িয়ে আছে। জামশেদ বললেন,
“ বোসো!”
ও বসল না। ঘাড় ডলতে ডলতে দু এক পা পায়চারি করল সমানে। জামশেদ তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন ছেলেকে। এত সুন্দর ছেলেটা! না স্বাস্থ্য,না উচ্চতা না গায়ের রং, কোনো কিছুরই কোনো কমতি নেই। রাজনীতির মাঠে অল্প বয়সী ছেলেদের চেহারা ভালো হওয়া মানে সোনায় সোহাগা! ইস,একটু যদি এদিকে মন দিতো ছেলেটা!
তার ভাবনার মাঝেই আবুল এলেন। দরজায় টোকা দিয়ে বললেন,

“ আসব স্যার?”
জামশেদ বললেন,
“ এসো।”
তীব্রর সহসা দাঁড়িয়ে যায়। বিলাই,সাদা চোখের নিশানা হতেই ঘাবড়ে গেলেন আবুল।
গতকাল পুষ্পিতাকে তুলে আনতে ভাড়া গুণ্ডা পাঠিয়েছিলেন তিনি। না,তিনি নন। তবে যাদের ঠিক করেছিলেন ওরাই ওদের দল থেকে পাঠিয়েছিল। আবুল বলেছিলেন,
মেয়েটাকে তুলে এনে যা ইচ্ছে করতে। তবে লাশও যেন কেউ খুঁজে না পায়! অথচ তার অত আমোদ-আয়োজন এক লহমায় ব্যর্থ হলো সব! জানা গেল,ওরা কিছুই করতে পারেনি। কোনো এক অজ্ঞাত লোক এসে আচমকা হামলা করায় জান নিয়ে পালিয়ে এসেছে উলটে। আবুল নিশ্চিত ওটা তীব্র ছিল না। তাই এই ব্যাপারে যথেষ্ট নিশ্চিন্ত তিনি।
তীব্র নির্ঘাত কিছু জানে না। কিছু টেরও পায়নি। আর পেলেও নিজের বাবাকে টপকে ওনাকে সন্দেহ করবে? প্রশ্নই আসে না কোনো।
ঠোঁটে ফুরফুরে হাসি টানলেন আবুল। বিনয়ী গলায় বললেন,

“ আসসালামু আলাইকুম স্যার,কেমন আছেন?”
কথায় দাঁড়ি পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দড় ঘুষির তোপে থুবড়ে পড়লেন মেঝেতে। প্রকাণ্ড হকচকালেন আবুল। জামশেদও ভড়কে গেলেন কিছু। উঠে দাঁড়ালেন তড়াক করে। আর্তনাদ করে বললেন,
“ এ কী,কী করছো?”
তীব্র জবাব দিলো না। গিয়েই আবুলের কলারটা খপ করে ধরল। পুঁটি মাছের মতো টেনে তুলল ওপরে। আবুল ত্রাসে জবুথবু। হাঁটুতে অবাধ ভূমিকম্প।
তীব্র একটা কথাও খরচ করল না। শক্ত হাতের প্রহার বসাল পেটে।
তলপেটে একেকটি ঘুষিতে আবুলের রুহু গলায় ঝুলে আসে। নাক দিয়ে রক্ত বের হয়। জামশেদের মাথা চক্কর কাটছে। কী
করবেন, না করবেন, কী করে থামাবেন তীব্রকে সব মিলিয়ে আধপাগল দশা।
তীব্র একের পর এক চড় মারল,লাথি মারল। বিরতি হীন হাত দিয়ে মারার পর টানতে টানতে নিয়ে ছুড়ে ফেলল দেয়ালে। আবুলের কপাল গিয়ে ঠুকল সেথায়। ব্যথায় চ্যাঁচালেন তিনি। মাথা ফেটে চামড়া ছিলে আসে। চশমার কাঁচ ভেঙে টুকরো হয়ে যায়।

গোটা মানুষটাকে একটা ফুটবলের মতো ব্যবহার করল তীব্র। একবার ধরল, আবার ছুড়ল দেয়ালে।
তারপর হিড়হিড় করে নিয়ে গেল জানলার কাছে। এসির জন্যে থাই গ্লাস টানা। তীব্র একটা কপাট সরায়। ফাঁকা অংশে আবুলের ডান হাত রাখে। এপাশ থেকে জানলার গ্লাস জোরসে ঠেলতেই সেটা তিরের বেগে আবুলের কব্জি লুফে নেয়। হাড় সুদ্ধ থেতলে চুরমার করে আঙুল। আবুল গগনবিদারী চিৎকার দিতেই জামশেদের হুশ ফেরে। সচল মস্তকে ত্রস্ত ছুটে এলেন তিনি। আবুলের হাত কেটে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে। সাদা টাইলস মেখে একাকার।
তীব্র থেমে নেই। এত চিৎকার,এত ককিয়ে ওঠা কোনো কিচ্ছুতে মায়া হলো না। নিজের কাজে মত্ত সে।
হাতটা ওখানে চেপে রেখে একবার কাচ সরায়,পরপর ঠেলে দেয় আবার । প্রতিবার এসে এসে রুগ্ন কব্জি পিষে দেয় ওটা।
জামশেদ আটকাতে চাইলেন। পেছন থেকে ছেলেকে টানতে টানতে বললেন,

“ ছাড়ো ওকে। মারছো কেন? বেয়াদব ছেলে! আমি বলছি ছাড়ো।”
জামশেদ গাট্টাগোট্টা লোক। কিন্তু তীব্রকে এক চুলও টলাতে পারলেন না। শেষে নরম করলেন স্বর,
“ বাইরের কেউ শুনলে আমি ঝামেলায় পড়ে যাব, তীব্র। অনেক মেরেছ,থামো প্লিজ। বাবা অনুরোধে করছি তোমাকে। ”
তীব্র কথা শুনল এবার। মুঠো হতে ছাড়ল আবুলকে।
লোকটা তখন নিজের ভেতর নেই। ব্যথায়, যন্ত্রণায় গোটা শরীর বিবশ। ধপ করে নেতিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলেন।
খুকখুক করে কাশিটায় মুখ দিয়ে রক্ত এলো। শুভ্র দাঁত লাল রঙে চোবানো।
এই বয়সে এত আঘাতের ভার নিতে পারছে না শরীর।
অথচ ওকে শ্বাস ফেলারও সময় তীব্র দিলো না। নাকের ডগায় জুতোর প্রহার বসাল ফের। বলল ধমকে,
“ সর এখান থেকে!”

আবুলের চিত্ত ছলকে ওঠে। ত্রস্ত গুটিয়ে এক হাত দূরে সেটে যায়।
জামশেদ রেগে আগুন হয়ে বললেন,
“ রাস্তায় গুণ্ডামি করেও সাধ মেটেনি তোমার? এখন আমার অফিসে এসে কোরছো? হয়েছেটা কী? মারলে কেন ওকে? ও আমার পিএ,তাকে তুমি মন চাইলেই মারধর করতে পারো না। ইউ হ্যাভ টু রেসপেক্ট হিম!”
তীব্র উত্তর দিলো না। বড়ো শান্ত দেহে সোজা হেঁটে টেবিলের কাছে এলো। জলে ভরা গ্লাসটা তুলে পানি খেল দু-ঢোক। টিস্য দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বসল চেয়ারে। বলল,

“ ও পুষ্পিতাকে কিডন্যাপ করতে লোক ভাড়া করেছিল। আমি ওকে এই চমৎকার কাজের পারিশ্রমিক দিয়েছি। কিন্তু আমার এখনও মন ভরেনি, ড্যাড। মে আই এগেইন!”
এত ঠান্ডা! এত ধীরস্থির জবাব তার। যেন এই কণ্ঠের মালিক কারো গায়ে টোকাও দিতে পারে না।
কিন্তু জামশেদের চোখ কপালে ঠেকে গেল। বিস্ময়াবহ চোখে দেখলেন আবুলকে। পরপরই
নীরবে কটমট করে উঠলেন। যে পরিকল্পনা উনি নিজে বাতিল করেছেন,সেটাই খাটিয়েছে আবুল? কেন,কী উদ্দেশ্যে?

তার রাজনৈতিক সত্তায় জেগে উঠল ভিন্ন এক চিন্তা। আবুল কি কোনোভাবে বিরোধী কারো সাথে হাত মিলিয়েছে? যাতে তার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়,আগামী বছর মন্ত্রীত্ব না পান এসব কী তারই অংশ?
না কি চাইছিল তীব্রর সাথে যুদ্ধ বাঁধুক!
আহত আবুলকে দেখে দেখে দু রকম ভয় ভদ্রলোকের মনে মাথা তুলল। আবুল যদি সত্যিই অন্য দলের সাথে হাত মেলায় তবে তো তার এতদিনের সব সিক্রেট ফাঁস করে দেয়ার কথা। হয়ত দিয়েছেও।
দুধ-কলা দিয়ে শেষমেশ কী না কালসাপ পুষলেন এত কাল? আর দ্বিতীয় ভয়টা তীব্রকে নিয়ে।
পুষ্পিতার ক্ষতির কথা আগে সে ওনার মুখ থেকে বেরিয়েছিল। কোনোভাবে যদি সেটা বলে দেয় আবুল, তবে যে সব যাবে। রক্তাক্ত আবুল এখন জামশেদের গলার কাঁটা।
যাকে অতি সত্বর উপড়ে ফেলা উচিত।

নিজের রাগ মেটাতে,কিংবা তীব্রর চোখে ভালো সাজার নাটক? কোনো এক স্বার্থে ক্রোধে ফুঁসে উঠলেন জামশেদ।
“ কী, ওর এত বড়ো সাহস? আমার ছেলের হবু বউয়ের ক্ষতি করতে চাইছিল?”
আবুল এমনিতেই আধমরা। বুকের ওপর জামশেদের শক্ত বুটের লাথিতে কাত হয়ে পড়ে গেলেন।
কিন্তু ছেলের হবু বউ কথাটায় তীব্র কপাল গুছিয়ে ফেলল।
চোখের ভাঁজে তীক্ষ্ণতা। জামশেদ বললেন,
“ তুমি কোনো টেনশান করো না। বাবা আছি। এই কীটের ব্যবস্থা আমি করব। ওর কত্ত বড়ো কলিজা দেখছি আমি। যাক গে, তুমি মাথা ঠান্ডা করো। ঠান্ডা কিছু আনিয়ে দেবো,খাবে?”
তীব্র ভ্রু কুঁচকে বলল,

“ কী ব্যাপার বলুন তো! হঠাৎ ভোল পাল্টে ফেললেন যে! কাল পুষ্পিতার কথা শুনে অফিস মাথায় তুললেন,আজ সোজা হবু বউমা?”
জামশেদ অপ্রস্তুত নন। এর উত্তর তার আগেই সাজানো। হেসে বললেন,
“ কী করব বলো! বাবা হই তো। সন্তানের কাছে বাবাদের হার মানতে হয়। তুমি যা চাও তাই মেনে নিলাম! আফটার অল তোমার ভালো থাকাই তো সবার আগে। আর আমি তোমার মাকেও জানিয়েছি। তিনি দেখতে চাইছেন মেয়েটাকে।”
মায়ের কথায় তীব্রর ক্ষুব্ধ ভাবমূর্তি শিথিল হয় । রাগটা একটু কমে আসবে,তক্ষুনি গুঙিয়ে উঠল আবুল। ও বিরক্ত হয়ে বলল,

“ কেঁচোটাকে সরান এখান থেকে। দেখলেই কিন্তু মারতে ইচ্ছে করছে।”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ। এটাকে জেলে দেয়ার ব্যবস্থা করি দাঁড়াও।”
তীব্র বাধ সাধল।
“ না। তাহলে কিন্তু আপনারই ক্ষতি!”
ভদ্রলোক প্রশ্ন নিয়ে চাইলেন। ও বলল,
“ এত বছর আপনার পা চেটেছে। খুঁটিনাটি সব জানে। জেলের হাওয়া লাগলেই কিন্তু মুখের রস উগড়ে দেবে। আপনাদের মত মন্ত্রীরা তো আর ফেরেশতা হয় না। জনগণ যদি আপনার স্বরূপ জেনেই বসে, তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালানো ছাড়া কিন্তু উপায় থাকবে না। কোথাও একটা আটকে রাখুন, যান।”

জামশেদ হতবাক,হতবিহ্বল! তীব্রর বুদ্ধির মারপ্যাঁচ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এই চিন্তা তার মাথায় আগেই ছিল। রাজনীতিতে গুম,খুন এসব কি আর নতুন শব্দ! আবুলকে নিয়ে তেমন কিছুই ভেবে রেখেছেন তিনি। কিন্তু একই সময় একই কথা তীব্রর মাথাতেও এসেছে? উনি তো কেবল ছেলের কাছে স্বচ্ছ সাজতে জেলের কথা বললেন।
অথচ তীব্র!
যে ছেলে এসব পলিটিক্সের ছায়াও মাড়াল না। ঘাটতে এলোও না কোনোদিন।
এইজন্যে,শুধুমাত্র ছেলের বিচক্ষণতাকে মুঠোয় রাখতে তার সব আবদার মুখ বুজে মেনে নেন জামশেদ।
চেষ্টা করেন ওকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আগামী দিনগুলোয় এই ছেলেই তো তার মুখ উজ্জ্বল করবে। আলোয় ভরবে তার বংশের নাম। যোগ্য সন্তান হবে জামশেদ তালুকদারের!

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৯

কিন্তু সেই মুগ্ধতার হাসি ঠোঁটের ভাজে চাপা দিলেন ভদ্রলোক। বেল টিপলে সিকিউরিটি গার্ড এসে দাঁড়ালেন দরজায়। জামশেদ ফিসফিস করে কিছু বললেন তাদের। ওসব শুনতে তীব্র ফিরেও চাইল না। রাগ কমাতে ফোনের ওয়ালপেপার সামনে মেলে রাখল । যেখানে এক সুরূপার হাসিমুখ আকাশের চাঁদ হয়ে ভাসছে।
দুজন গার্ড ভেতরে এলেন। দুপাশ থেকে মর মর অবস্থার আবুলকে তুলে নিলেন সাথে। কেবিনের রক্তগুলো ক্লিনার ধুয়েমুছে সাফ করে গেল।
সরব ধ্বংসলীলা বইয়ে দেয়া কক্ষ নীরব হলো নিমিষে। অথচ বাইরের কেউ কিচ্ছু টের পেলো না। আজকের জামানায়,এ আর নতুন কী!

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫০