সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১১

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১১
সাইয়্যারা খান

— আমার সতীন কি করছে?
দুপুরের প্রশ্নে শাহ নিজের বুকে তাকিয়ে প্রতিত্তোরে বললো,
— বুকে ঘুমাচ্ছে আমার।
— ওহ তাই নাকি? তার টানেই বুঝি নতুন বউ রেখে চলে গেলেন?
— সত্যি বলতে তার টানেই আসা। সে ছাড়া আমি অচল।
— সে কি আমার থেকেও সুন্দর?
শাহ হাসে শব্দহীন। বুকে থাকা অস্তিত্বে হাত বুলায় সন্তপর্ণে। বলে,

— তুমি যে কতটা সুন্দর দুপুর তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না৷ কখনোই না। তোমার পায়ের আঙুল থেকে চুল পর্যন্ত আমার কাছে ভালো লাগে৷ ভীষণ ভালো লাগে। আমি অভিভূত হয়ে দেখি তোমাকে। প্রথম যেদিন তোমাদের বাসায় ছিলাম রাতভর দেখেছি তোমাকে। সকাল হতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছি। তুমি তো ঘুম। আমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না এত সুন্দর মেয়ে মানুষ হয়৷ এত ফর্সা, এত নরম, এতটা তুলতুলে কেউ হয় জানা ছিলো না৷ তোমায় দেখেছি প্রথমে। এই তুমি জিজ্ঞেস করছো আমার বুকে যে আছে সে সুন্দর কি না? উত্তরে অবশ্য বলব, সে দেখতে কালো। আমার মতোই কালো। কথায় বলে না, ‘রতনে রতন চিনে শিয়ালে চিনে মুরগী’। আমি কালো মানিক কালোই চিনেছি।
দুপুর এদিকে চুপ করে আছে। শিয়ালে মুরগী চিনে কথাটায় ভুলভাল আছে৷ প্রবাদটা তো একটু ভিন্ন। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— অপজিট এটরাক্স। কথাটা শুনেন নি?
— শুনেছি তো।
— তাহলে তো কালো মানুষ সাদাতে মজবে। যেমন আপনি।
— আমি ব্যাতিক্রম বুঝলে দুপুর। সাদা, কালো দুটোই চালাতে হয়। দুই বউকে সমাধিকার দেই আরকি।
— থামুন এবার।
— সতীন নিয়ে না এত আগ্রহ তাহলে এখন কেন ভালো লাগছে না?
— জানি না কিন্তু এই দুষ্টামি আর ভালো লাগছে না৷
— দুষ্টামি না তো এটা৷
— শাহ…..
শাহ থামলো। দুপুরের কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। কি ছিলো তা ও জানে। নারীজাতির স্বভাব ছিলো। দুষ্টামিতেও তারা সতীন মানতে চায় না। শাহ আস্তে করে বললো,

— পরে আমার দোষ দিও না কিন্তু।
— ফোন রাখছি….
— না না৷ মাত্র রাত হলো। আজ আধ রাত জাগব তোমার সাথে।
— কারণ?
— বউ রেখে এলাম৷ প্রথমে তো কষ্ট ছিলোই কিন্তু এবার কষ্টটা বেশি। আদর সোহাগের বউ আমার। বুকের ভেতর হাহাকার করে বুঝলে। সারাদিন তো কাজে কেটে যায় রাত হলেই আমার দশা হয় খারাপ। মন চায় ছুটে আসি তোমার কাছে।
— তাহলে নিয়ে চলুন আপনার কাছে।
— দেখছি এ বিষয়টা তবে তার আগে প্রমিজ করো সতীনের সাথে ঝগড়া করবে না৷ দু’জন মিলেমিশে থাকবে।
খট করে ফোনটা কেটে গেলো৷ দুপুর কেটে দিয়েছে। শাহ হেসে ফেলে। তার বুকে থাকা কালো দুপুরের সতীনের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
— তুমি আজ বোবা বলে দুপুর চাইলেও ঝগড়া করতে পারবে না। ও এমনিতেও মিষ্টি একটা মেয়ে। ঝগড়া বিবাদ ওর দ্বারা সম্ভব না৷ আগেভাগে জানিয়ে রাখছি নাহয় তোমাকে দেখে হাজার প্রশ্ন করবে।
দুপুর মন খারাপ করে বসে আছে তখনই দরজায় টোকা পড়ে। দুপুর বলে,

— খোলা তো।
তিব্বি ভেতরে ঢুকে। দুপুর ইশারায় কাছে ডাকতেই লাফ দিয়ে খাটে উঠে৷ আবদার জুড়ে দেয়,
— কিছু খাওয়াও ভাবী৷ পেটে চু চু করছে।
— নুডলস খাবে?
— খাব মানে আঙুল চাটব আমি।
দুপুর উঠে যেতে যেতে বললো,
— আজ ঘুমাও নি এখনও। তোমার ভাই শুনলে দিবে নে।
— ভাইকে কে বলবে?
— তাও ঠিক।
দুপুর নুডলস চড়ালো। তিব্বি ভাবীর আঁচল টেনে ধরে জিজ্ঞেস করে,
— তোমার মন খারাপ ভাবী?
— হ্যাঁ।

মাথাটা ঠিক বাচ্চাদের মতো নাড়লো দুপুর। তিব্বি ভাবীর হাতটা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,
— কেন? আম্মু বকেছে তোমাকে শাশুড়ীদের মতো? তুমি কিন্তু শাবানা সাজবে না ভাবী৷ আমরা প্রতিবাদ করব৷ আমি আছি তোমার সাথে। এখনই পুলিশ ডাকব।
দুপুর হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
— নিজের মা’কে পুলিশ দিয়ে ধরাবে?
— না না কি বলো।
— তাহলে?
— ভাইকে ডাকব৷ বিচার বসাব। শাশুড়ী বিরোধী আন্দোলন করব আমরা। তুমি ভিক্টিম আমি সাপোর্টার৷ বাবাকেও দলে নিতে হবে ভাবী৷ বাবা হবে আই উইটনেস।
— ওওও। তোমার ভাই কি হবে?
— বিচারক।
দুপুর ফিক করে হেসে ফেললো৷ নুডলস তখন তৈরী। দুপুর তা বাটিতে বাড়ছে। তিব্বি হাত নেড়ে নেড়ে তখনও বলছে,

— এটা কোন কথা না কিন্তু ভাবী৷ আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করব।
— হু চলো।
ওরা বসলো খাটের উপর। নিজের ভাইয়ের জায়গাটা মে’রে দিলো তিব্বি৷ ভাবীর পাশে ভাবীর সাথেই খাচ্ছে সে। দুপুরের ফোনে ছবি তুলে হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে নিচে লিখলো, ‘নাইট ডেট উইথ মাই ক্রাশ’ সাথে দুটো লাব ডাব ইমোজি। শাহ’র ফোনে কট করে শব্দ হতেই ও চেক দিলো সাথে সাথে হিংসায় জ্বলজ্বল করে উঠে ঐ কালো মনির দুটো চোখ। রাগে চোয়াল শক্ত হলো। কপালে আঙুল ঘঁষে মা’কে ফোন দিতে চাইলো কিন্তু তার ব্যাক্তিতের সাথে ব্যাপারটা বেশ দৃষ্টিকটু। শাহ’র ঘুম উড়ে গেলো৷ বউ কাছে আনতেই হবে। রাতবিরেত এই তিব্বি গিয়ে তারই বিয়ে করা বউয়ের সাথে সময় কাটাবে এসব মানবেই না শাহজেব৷ কিছুতেই না৷

চেয়ারম্যান বাড়ীতে আজ সকাল সকাল বিশাল আয়োজন। বাড়ীতে নতুন বউ। চেয়ারম্যান সাহেব নিজে টেবিলে আছেন। পত্রিকায় তার সম্পূর্ণ দৃষ্টি। তাসরিফ ভোরে উঠে কোথায় জানি গিয়েছিলো। ফিরেছে খানিক আগে। পশ্চিম দিকের দরজাটা বন্ধ। সাহস করেও কেউ টোকা দেয় নি। তাসরিফে’র মা রান্নাঘরে বুয়াদের কাজ বুঝাচ্ছেন। তার বেশ ভুষাই বলে দেয় সে এই বাড়ীর একমাত্র কর্তী। গায়ের কাপড় আর গহনা গুলো নিজের গর্ব করে যেন বলে, আমরা এই বাড়ীর গিন্নীর শরীরে আছি। আঁচলে প্রাচীন আমলের মতো বিড়াট চাবির গোছা। তার নড়চড়ে সেগুলো ঝনত ঝনত শব্দ করে মাঝেমধ্যে।
তাসরিফ বিছানায় বসা তখন৷ বাথরুম থেকে আস্তেধীরে পা ফেলে বের হচ্ছে সায়রা। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ওকে ধরে বিছানায় আনে তাসরিফ। কপালে গালে হাত ছুঁয়ে দেখে তাপমাত্রা। গলার দিকটায় বিশ্রী দাগটা শুরুতেই চোখের নজর কাড়ছে। সায়রা একদম চুপচাপ আছে। তাসরিফ ওর পেঁচিয়ে থাকা চুলগুলো খুলে নরম তয়লা দিয়ে চেপে চেপে মুছছে। এমনি সময় খুব বেশি কথা না বলা তাসরিফ বউ এর সামনে খুব কথা বলছে। চুলগুলো যত্ন করে মুছতে মুছতে বলছে,

— আপনি হলেন একটা পুতুল, বুঝলেন য়রা। আপনাকে আমি নিজের হাতে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখব। আপনার এখন থেকে কোন কাজ নেই। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ সবটা আমি করব ঠিক আছে। এখন আপনি বলুন তো আমি কি এখানে খাবার আনব নাকি বাইরে গিয়ে খাবেন? আপনার কষ্ট হবে এমন কোন কাজই এখানে হবে না য়রা। বললাম না আপনাকে পুতুল বানিয়ে রাখব আমি৷
গলার স্বর সায়রা’র চেপে চেপে আসছে। ফ্যাচফ্যাচে কণ্ঠে বলে উঠে,
— শুধু শয্যাশায়ী হলেই হবে তাই তো? এতটুকু কষ্ট কি আর কষ্ট?
তাসরিফের বুকটায় মোচড় খেলো। চঞ্চল কণ্ঠে ভাটা পড়লো। পেছন থেকে সামনে এসে সায়রা’র গাল দুটো নিজের হাতে নিয়ে বললো,

— আপনি ভুল ভাবছেন য়রা। গতরাতে তো আমি….
সায়রা’র মুখটা দেখে তাসরিফ কথাটুকু গিলে নেয়৷ নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরে। তার চোখ জ্বলছে কিন্তু কেন? এই চোখ বিনাকারণে কেন জ্বলবে? কারণ তো অবশ্য অনেক বড়। সায়রা গতরাতে তাকে বাঁধা দেয় নি কিন্তু সায়ও দেয় নি। তাসরিফ কি তাহলে খুব বেশি ভুল করে ফেললো? তার পুতুলটাকে সে কষ্ট কখনোই দিতে পারে না৷ ভেজা চুলগুলো নেড়েচেড়ে চিরুনী চালায় তাসরিফ। সায়রা’র পরণে থাকা আনারকলির ওরনাটা দিয়ে আস্তে করে মাথা ঢাকে। সকাল সকাল সে যা পেরেছে কিনে এনেছে। খোলা ছিলো না কিছুই।পরিচিত বন্ধুর অনলাইন ব্যাবসা। তার থেকেই আপাতত যা পেরেছে এনেছে। সায়রা’র মুখে দুটো হাত বিচরণ করছে। আলতো করে মুখটায় ক্রিম লাগাচ্ছে। গলার লাল দাগটায় মলম লাগাচ্ছে। তাসরিফ আস্তে করে বলে,
— ব্যথা আছে য়রা?
সায়রা নির্বাক। তার ভেতরে কিছুর চাপা আর্তনাদ যা কেউ শুনতে পায় না৷ এত কাছাকাছি থাকা তাসরিফও না। তাসরিফ অপলকভাবে দেখছে সায়রা’কে। মন তো পড়া যায় না কিন্তু এই দুটো যে মানুষের বড় শক্র। মনের খবরের সমাচার হয় এই চোখের পর্দায় যা মনের মানুষ পড়ে নেয় খুব সহজে। ঝামেলাহীনভাবে।

সায়রা’কে নিয়ে টেবিলে উপস্থিত হয় তাসরিফ। চেয়ারম্যান সাহেব হাসিমুখে বললেন,
— তামজিদটা থাকলে ঘরটা ভরা লাগতো আমার। বউমা এটা নিজের বাড়ী মনে করবে না বরং এটা তোমারই বাড়ী। মেয়ে নেই আমার বুঝলে মা। তোমাকে মেয়ে ডেকে স্বাদ মেটাব।
সায়রা টু শব্দ ব্যায় করে না৷ আরেকজনের মেয়ের জীবন কয়লা করা মানুষের বাপ কি না চায় মেয়ের পিতা হতে? আচ্ছা এরা কি আদৌ জানে মেয়ে কি? একটা মেয়ে তার মা-বাবার কতটা আদরের তা কি এরা জানে? বুঝে একটুও? সায়রা’র মন বলে না বুঝে না৷ বুঝলে আজ দুপুরটা ভালো থাকতো। চার পাঁচ বছর তার নষ্ট হতো না।
টেবিল ভর্তি নাস্তা৷ তাসরিফ সায়রা’র প্লেট সাজালো। সায়রা ছুঁয়েও দেখছে না৷ তাসরিফে’র মা স্বামীকে বেড়ে খাওয়াচ্ছেন। তিনি আছেন চাপা এক ভয়ে। গতকালের কান্ডটা তো আর ছোট না৷ আশেপাশের দুই চারজন মহিলাদের সাথে সায়রা আর তার পরিবার নিয়ে কটুকথা বলছিলেন তিনি। বুড়ো বয়সে তার ভাই আর মা মিলে তাসরিফে’র ঘাড়ে ঝুলিয়েছে সায়রাকে সহ নানান ভাবে হেয় করেছেন। তিনি জানতেন সায়রা শুনছে কিন্তু কোন ভাবেই বুঝেন নি এতদূর গড়াবে। যদি তাসরিফ জানে তাহলে সে মা আর বোন মানবে না৷ এই মেয়েটার জন্য সে পা গ ল ছিলো। তিনি নিজে সাক্ষী।
তাসরিফ আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

— খাচ্ছেন না কেন য়রা? এগুলো পছন্দ না? আমি কি অন্য কিছু আনব?
সায়রা এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে উঠে যায়। আস্তে ধীরে হেঁটে হেঁটে রুমে চলে যায় ও। তাসরিফের গলাটায় শুধু ঢোক গেলা হচ্ছে। তার বুকের ভেতর যেমন শান্তি তেমনই একটা খুঁতখুঁত করা কাজ করছে। হঠাৎ ই বলে উঠে,
— ওহ শিট! ও এগুলো খাবে কিভাবে? আমি কেন বুঝলাম না? ওর তো গলায় ব্যথা। ওর জন্য স্যুপ করতে হবে।
মা-বাবাকে উপেক্ষা করে তাসরিফ রান্না ঘরে গিয়ে নিজে রান্না করলো। রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিতেই চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১০

— তাসরিফে’র পা গ লা মি দেখে আমি শুধু ভাবছি তামজিদ দেশে ফিরে এবার দুপুরকে বিয়ের পর কোন উন্মাদনাই না দেখাবে।
তখনই ফোন আসে তার। বড় ছেলের ফোন পেয়ে তারাতাড়ি ফোন ধরলেন চেয়ারম্যান সাহেব। ওপাশ থেকে কিছুই শোনা গেলো না অবশ্য। চেয়ারম্যান সাহেব স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে উচ্ছসিত কণ্ঠে বললেন,
— শুনছো, তামজিদ ফিরছে শিঘ্রই।

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১২