সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১২

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১২
সাইয়্যারা খান

দুপুর বাড়ী ফিরেছে গভীর রাতে। শশুর আর তিব্বি রাত করে দিয়ে গেলো। শাশুড়ী নামক মহিলাটা দুপুরকে জড়িয়ে ধরে যখন কাঁদলেন দুপুর তখন একদমই চুপসে গিয়েছিলো। তার ভেতরে অদ্ভুত এক খারাপ লাগা কাজ করেছিলো তখন। সব ভেঙেচুরে কান্না আসছিলো। দুপুর বরাবরই শান্ত মেয়ে। কান্নাটাও শান্তই থাকে তার। ভেতরের খারাপ লাগা ফুপি বাদে তেমন কেউকে বলা হয় না। ইদানীং খারাপ লাগা নামক তীরটা গিয়ে লেগেছে শাহ’র উপর। বাসায় এসে তার মনটা খুব খারাপ হলো। ফুপির সাথে তাসরিফে’র বিয়ে হয়েছে কথাটা দাদীর কাছে শুনেই মনটা উদাস হয়ে গেলো। দুপুর অবশ্য কাউকে কিছু বললো না। চুপ করে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে খাটে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসলো। মাথাটায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তখন। বাইরের কালো নিকেষ অন্ধকারে তখন নিজেকে দেখে দুপুর। কেন জানি অন্ধকার মানেই আতঙ্ক মনে হয় তার কাছে। চোখের সামনে দেখা মিলে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত মূহুর্ত।

সেবার সপ্তাহ খানিক নিজের কটেজে তামজিদ আটকে রাখলো দুপুরকে। দুপুর তখন ফুলের ঐ নরম কলিটা ছিলো যাতে আকর্ষণ থাকে প্রতিটি মৌমাছির।তাসরিফ অবশ্য বিষাক্ত এক মৌমাছি ওর নিকট। অন্ধকার ঘরে যখন গম্ভীর কণ্ঠে ‘দুপুর’ ডাকটা কানে আসতো তখন চারপাশ কেমন ঝমঝম শব্দ শুরু করে দিতো। দুপুর তখন অন্ধকার ঘরে হাঁটুতে মাথা গুজে বসা। আচমকা ক্যাটক্যাটে একটা শব্দ কানে আসতেই ভয়ে গুটিয়ে যায় ও। কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে তখন ঢুকে তামজিদ। হাতে খাবারের প্লেট। রুমের আলো জ্বালাতেই যেন চোখ দুটো জ্বলে উঠে দুপুরের। টানা বিশ বাইশ ঘন্টা সময় ধরে অন্ধকারে ও। তামজিদ দরজাটা আবার বন্ধ করে এগিয়ে আসে বিছানার কাছে। অতি আদুরে স্বরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— খাবে পাখি উঠো ফাস্ট।
দুপুর তখন চোখ মেলতে অক্ষম। তীব্র আলোক ছটা চোখে বিঁধছে ফলার মতো। কপাল কুঁচকে হাত রাখে চোখের উপর। তামজিদ অবাক হয়ে তাকিয়েই থাকে। মেয়েটাকে দূর থেকে যতটা সুন্দর দেখায় সামনে যেন সেই সৌন্দর্য বাড়ে কয়েকশো গুন। এত সৌন্দর্য বয়ে বেড়ানো তো কঠিন। খুব কঠিন। ঠিক ততটাই কঠিন যতটা কঠিন হলে তামজিদ পা গল হয়েছে। পা গল হয়ে তুলে এনে বন্দী করেছে। পা দুটো যেন অবশ হয়ে আসতে চায় তার। এত সুন্দর হাতের আঙুলই বা কোথায় দেখেছে সে? কোথাও না। দুপুর নামক মেয়েটার মতো সুন্দর সে দেখেনি। কখনোই না। কোথাও না৷ তার অবশ হওয়া পা দুটো ঠেলে বসলো দুপুরের পাশে। বুঝা মাত্রই দুপুর সরে বসে। তামজিদের নিকট বিষয়টা অবশ্য ভালো ঠেকলো না। হাত বাড়িয়ে সে ধরতে চায় দুপুরকে কিন্তু তার আগেই দুপুর উঠে দাঁড়ালো। রাগে আর কান্নায় গাল দুটো গোলাপি হয়েছে তার। তামজিদের বেশ লাগলো দেখতে। মন চাইলো ঐ গালটায় আদর দিতে। নিজের মনোবাসনা পূরণে তৎপর হতেই দুপুর দুই হাতে ধাক্কা দিলো ওকে। তামজিদ’কে অবাক করে দিয়ে আঙুল তুলে শাসিয়ে বললো,

— আটকে রেখেছেন কেন? লজ্জা করে না আপনার। চেয়ারম্যানের ছেলে হয়ে এসব বখাটেপনা দেখান। আপনার বাবা না কত বড় বড় কথা বলে? এই নমুনা তার? আপনার মতো ছেলে?
বলেই দরজার দিকে দৌড়ে গিয়ে লক মোচড়ালো। অবাক দুপুর খেয়ালই করলো না সেটা তালাবদ্ধ বাইরে থেকে। তামজিদ আয়েশ করে বিছানায় বসে ডাকলো,
— এখানে এসো পাখি। খাবে তুমি।
দুপুর পেছনে ঘুরে দেখে নিশ্চিত হয়ে বসা তামজিদ। ওর কান্না পেলো। অনেক কান্না পেলো। বাড়ীতে সবাই চিন্তায় আছে ওর জন্য কিন্তু দুপুর তো এখানে আটকে। কিভাবে পালাবে ও? কি ই বা চাইছে তামজিদ তখনও অস্পষ্ট ওর নিকট। তামজিদ নিজেই উঠে এলো। দুপুরের হাত ধরতে চাইলেই দুই পা পিছালো দুপুর। কোনমতে বলে উঠলো,

— ধরাধরি করতে চান কেন? কি চান আপনি?
— আসো তুমি খাবে। ক্ষুধা পেয়েছে না দুপুর। এসো।
— বোকা মনে হচ্ছে আমাকে? খাওয়াবেন এরপর বলি বানাবেন? আমার আপনাকে সহ্য হয় না। ধরবেন না খবরদার বলে দিলাম।
তামজিদ সেদিন সত্যিই ধরলো না। শুধু ভয় দেখালো,

— তোমার দাদী বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছে দুপুর। যদি না খাও খালের পানিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে কেউ।
দুপুর ভয়ে ভয়ে শুধু ডাল দিয়ে খেয়ে নিলো। ক্ষুধার কাছে সবাই হার মানে। সবাই। তাই তো গ্রোগাসে গিলে দুপুর। তামজিদ শুধু ওকে দেখে। নিজের বিছানায় তার পছন্দের মানুষ। পছন্দ থেকে ভালোবাসাই বটে অথচ ক্ষমতাবান তামজিদ দমিয়ে রেখেছে নিজের প্রবৃত্তি। অপেক্ষায় আছে রমনী মানবে। তার কাছেই আসবে৷
কিন্তু কোন ভাবেই বিগত চার দিন ধরে আটকে রেখে যখন তামজিদ দেখলো ফলাফল শূন্য তখন যেন পৌরষত্বেই আঘাতটা লাগলো। এলাকায় ততদিনে ছড়িয়ে গিয়েছে মিরাজ সাহেবের ছোট মেয়ে নিখোঁজ। কেউ বললো, ‘পালিয়ে গিয়েছে’। কেউ বললো,’ আগুন ধরানো রূপ, মিরাজ সামলে রাখবে না?’। তাদের প্রতিত্তোরে কেউ আবার বললো, ‘এই বাধভাঙ্গা রূপ সামলাবেই না কিভাবে?’

কত মানুষ কত কথা বললো। কেউ স্বান্তনার বাণী শোনালো কেউ টিটকারি মা’রলো। মিরাজ সাহেব ছোট মেয়ের শোকে হাসপাতালে বিছানা নিলেন। স্ত্রী মেয়ের শোক বুকে নিয়ে মাথায় নিলেন স্বামীর চিন্তা। বাড়ীতে বৃদ্ধ শাশুড়ী। একা হাতে এদিক ওদিক দৌড়াল সায়রা। চট্টগ্রাম বসে সন্ধ্যা আর ইফাত এদিক ওদিক খোঁজ লাগালো। ফলাফল শূন্য। চেয়ারম্যানের বাড়ী থেকে অফিস সায়রা’র পদচারণ তখন। তাসরিফে’র সাথে দেখা সাক্ষাৎ কথা শুরু। তাসরিফ তখন মনে মনে শুধু ভাবে, ‘বিচার কার কাছে দিচ্ছো বোকা মানুষ। বিচারকই তো চোর’। আসলেই তো চোর যদি সাহায্যকারীই হয় তাহলে সেই মূহুর্তে কি করা উচিত। যাকে সাহায্যকারী ভেবে সায়রা জুতার তলা খসাচ্ছে সেই তো মূল হোতা।

রাতের খাবার নিয়ে তাসরিফ সেদিন কটেজে যখন ঢুকলো তখন দেখলো চারপাশে অন্ধকার। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই জানলো তামজিদ এখানেই আছে। গতকাল রাত থেকেই সে এখানে। তাসরিফে’র কপালে ভাজ পড়ে। দ্রুত পা ফেলে ভেতরে ঢুকে ও। দুপুরকে আটকে রাখা রুমটা ভেতর থেকে বন্ধ। বেশ কিছুক্ষন দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে সরে যায় ও। পকেট থেকে ফোন বের করে ভাইকে ফোন করতেই রিসিভ হয় তা। তাসরিফ জানায়,
— ভাই রাতের খাবার এনেছি।
— হু।
ব্যাস এতটুকুই। দরজাটা খোলার শব্দে তাসরিফ একটু এগিয়ে আসে। আবছা অন্ধকারে অল্প খোলা দরজার ভেতরে তাসরিফ সেদিন খুব অল্প কিছু দেখে। ফ্লোরে সাদা, নীল মিশ্রিত কলেজ ড্রেস পড়ে আছে। মাথাটা নামিয়ে আস্তে করে সরে দাঁড়ায় ও। তামজিদ ওর থেকে খাবার নিয়ে প্লেটে বাড়তে বাড়তে জিজ্ঞেস করে,

— ওখানে খবর কি?
— এলাকায় জানাজানি হয়ে গিয়েছে। পুলিশ আর আমাদের এখানে দৌড়াচ্ছে ভাবীর ফুপি। ওনার বাবা হাসপাতালে। বাড়ীতে শুধু দাদী আছেন।
তামজিদ ভাবে কিছু একটা অতঃপর বলে,
— চলে যা তাহলে।
তাসরিফ একবার চাইলো ভাইকে জিজ্ঞেস করবে কিছু কিন্তু কেন জানি সেই সাহসটা হলো না তার। একদমই হলো না।
খাবার নিয়ে দুপুরকে দিতেই আতঙ্কিত দুপুর প্লেটে হাত দিলো। তামজিদ ওর দিকেই মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। সাত আট দিনে মেয়েটার মুখ চোখ কেমন হয়ে আছে। ডান গালে বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে আদর করে তামজিদ বলে,
— মাথা ব্যথা আছে?

দুপুর আতঙ্কে মাথা নাড়ে দু’বার। মুখে খাবার তুলে। ওর আতঙ্কিত মুখটা ভালো লাগে না তামজিদে’র। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শুধু। খাওয়া হতে নিজ হাতে মাথা টিপে দেয়।
এর কত পরে গিয়ে ছাড়া হলো দুপুরকে। সেই কলেজ ড্রেসটাই গায়ে পরতে হলো তার। যেভাবে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই তামজিদ ওকে বিদায় দিলো। শুধু বদলে গেলো পোশাকের আড়ালে থাকা ছোট্ট একটা মেয়ের জীবন। চঞ্চলা পা দুটো নিভে গেলো দপ করে। উড়ন্ত পাখিটার পাখা খুব করে ছেঁটে দিলো তামজিদ। ঘর থেকে বের করার আগে হঠাৎ ই জড়িয়ে ধরে তামজিদ। বুকের মাঝে আগলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
— আমার কাছেই ফিরে এসো দুপুর। আমি চাইলেই তোমার ক্ষতি করতে পারতাম কিন্তু আমি করি নি। তোমার মতো পবিত্র ফুলকে অপবিত্র আমি করি নি। আমার বিশ্বাসের সম্মান রেখো। এখন থেকে তুমি শুধু আমাকেই পাবে৷ ছাড় দিচ্ছি কিন্তু ছেড়ে দিচ্ছি না দুপুর। তুমি নিজের ইচ্ছায় আমার বউ হবে। আমি অপেক্ষায় থাকব তোমার।
তামজিদ হয়তো জানে দুপুর পবিত্র অথচ গোটা এলাকা ছড়িয়ে গেলো দুপুর ফিরেছে চৌদ্দ রাত পর বাড়িতে। কতটা নির্মম এই সমাজ হতে পারে তা তামজিদ দেখিয়েছিলো দুপুরকে। হয়তো ভেবেছিলো সম্মান বাঁচাতে মেয়েটা ছুটে আসবে তাকে বিয়ে করতে। চিৎকার করে জানাবে সমাজকে,

— আমাকে উনি খারাপ ভাবে ছোঁয় নি৷ আমি ওনাকে বিয়ে করব। চেয়ারম্যানের বড় ছেলেই আমাকে নিয়েছিলো।
কিন্তু তামজিদে’র সেই কল্পনা কল্পনাই রয়ে গেলো। দুপুরটা সরে গেলো আড়ালে। সবার থেকে দূরে। ছাড় সে তখনও পায় নি মাঝেমধ্যেই বরং বাড়িতে উপস্থিত হয়ে সোজা দুপুরের ঘরে ঢুকতো সে। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েও কোনবারই হ্যাঁ উত্তর পায় নি। মালোশিয়ায় তাদের ব্যাবসা দেয়ার পর থেকে একটু রেহাই পেলো যদিও দুপুর কিন্তু তাসরিফটা বাসায় এসে এসে ফোনটা কানে ধরিয়ে দিবে।
এই আধ রাতে গুমড়ে কেঁদে উঠে দুপুর। উঠে বসে হাউমাউ করে কাঁদে ও। ডাকতে থাকে সায়রা’কে। মায়ের আদর যত্ন তো এই সায়রাই তাকে করতো। নিজের সেই চৌদ্দ রাতের কথা তো দুপুর তাকেই জানিয়েছিলো। ফোন হাতড়ে দুপুর কল দিলো শাহজেবকে। মাঝরাতে সহ সকল এলোমেলো সময়ে কল দেয়া দুপুরের কাজ। শাহ চমকালো না বরং ফোন ধরে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতে চাইলো কিন্তু সম্ভব হলো না অবশ্য। দুপুর ফোন কানে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে,

— আমার বাচ্চা লাগবে শাহ। আমার বাচ্চা লাগবে।
শাহ তাজ্জব বনে যায়। মুহুর্তে সামলায়। স্বভাবসুলভ ঠান্ডা স্বরে বলে,
— আচ্ছা। এবার আমার কাছে নিয়ে আসব এরপর সুন্দর একটা বেবি হবে আমাদের।
আকুল হয়ে দুপুর জিজ্ঞেস করে,
— কবে? কবে নিবেন শাহ?
— কবে আসতে চাও?
— এখনই।
— এখন? রাত তিনটা পাঁচ বাজে যে?
— খুব রাত?
— না অবশ্য না৷ আসব নাকি?
— আসবেন বলছেন?
— তুমি বলো।
— কাল তো অফিস আছে আপনার।
— শুক্রবার আসি?
— বৃহস্পতিবার রাতে আসা যাবে না?
— এত উতলা বুঝি?
— হু।
— লজ্জা পাচ্ছে আমার দুপুর চণ্ডী?
— একটু একটু।

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১১

— আচ্ছা। এখন ঘুমাও তো একটু সোনা। আমি কথা বলছি। ভয়ের কিছু নেই।
দুপুর ঘুমিয়ে গেলো পাঁশ মিনিটে। শাহ ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে।
দুপুর হয়তো ভাবছে একটা বাচ্চা সবটার সমাধান দিবে অথচ সে কি জানে আড়ালে লুকিয়ে কে আছে? আজ দেশের মাটিতে এই রাত তিনটা পাঁচ মিনিটেই তো বিমান বন্দরে একটা মালোশিয়া ফেরত বিমান অবতরণ করলো।

সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৩