সে জন সোনা চিনে না পর্ব ২০
সাইয়্যারা খান
বোকা বোকা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে আছে দুপুর। সন্ধ্যা ছোট বোনকে দুই হাতে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। দুপুরের মস্তিষ্ক নিশ্চল। বুঝে উঠতে পারছে না এখনও কি হয়েছে। ঐ তো শাহ ওকে আস্তে ধীরে ডেকে তুললো এরপর বোরকা পরালো। গাড়ি আসতেই ওরা তাতে চড়ে বসলো। গাড়ি থেকে যখন নামতে বললো দুপুর তখন ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকায়। শাহ অভয় দিয়ে ওকে বের করে। দুপুর দেখলো জায়গাটা ওর অচেনা কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইফাত ওর চেনা। খুব কাছের একজন মানুষ সে।
দুলাভাই নামক মানুষটা দুপুরকে দূর থেকে আগলে আগলে রেখেছে কতগুলো বছর। ফোনালাপেই কত কত সমস্যা সে সমাধান করলো। ইফাত এগিয়ে আসে। দুপুরকে যেতে বলে ওদের সাথে। ঐ তো দুপুর তার শাহ’র হাত ধরে ঢুকলো। এখনও ও দাঁড়িয়েই আছে। অবাক হয়ে। সৌন্দর্য যদি অভিশাপ হয় তাহলে সেই অভিশাপে জলজ্যান্ত মানুষ কয়লা হয়। দুপুর খুব করে ভাবলো, সে কেন ম র লো না? চোখের সামনে দেখে এলো ও তিনটা দেহ। তার কত প্রশ্ন ছিলো মায়ের জন্য জমা। কেন দুপুর বঞ্চিত ছিলো আদর থেকে? কেন মা বিশ্বাস করতো না তাকে? কিসের দায় ছিলো তার? উত্তর গুলো দেয়ার জন্য আজ মা নেই। বাবা নেই। দুষ্ট সেই দাদীটাও নেই।দুপুর বিরক্ত চোখে সন্ধ্যাকে দেখে। ও কেন কাঁদছে এভাবে? কানে বিঁধছে ওর চিৎকার।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শাহ দুপুরের দিকে তাকিয়ে আছে। ও বেশ চিন্তিত। দুপুরকে এখানে বেশিক্ষণ রাখা ঠিক হবে না কিন্তু এখন এখান থেকে যাওয়াটাও তো সমীচীন হবে না।
তখনই হাসপাতালে দুটো ছুটন্ত পা ধেয়ে আসে। দুপুর দেখে শাড়ী পরিহিত ওর মা আসছে যার পেছনে তাসরিফ ছুটছে। না না, মা না সে।
ফুপিকে এই মূহুর্তে পাগলের মতো দেখাচ্ছে। তাসরিফ পেছন থেকে আচমকাই ওর হাত টেনে ধরলো। মুখ থুবড়ে পরতে পরতে বাঁচলো সায়রা। সায়রা নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে আসে। দুপুর সন্ধ্যা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। সায়রা ঝড়ের বেগে এসে দুপুরকে আগলে নিলো। জড়িয়ে নিলো বুকের মধ্যে। দুই গালে অসংখ্য চুমু দিয়ে বলতে লাগলো,
— ঠিক আছিস সোনা? দুপু, ফুপির কলিজা, তুই ঠিক আছিস না?
— ফুপি?
ফুপিয়ে উঠে দুপুর। সায়রা ঢোক গিলে। এখনও দেখে নি ও কাউকে। উত্তর করে ও,
— হু।
— আব্বু নেই ফুপি। আম্মু, দাদী কেউ নেই।
শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে সায়রা। ভেতর ফেটে আসা কান্না চেপে রাখে। দুপুর তখন নিজের আবরণ থেকে বেরিয়ে আসে। চিৎকার করে কেঁদে উঠে। ওর কান্নায় ছটফট করে কেউ। এই মূহুর্তে ঠিক হচ্ছে না কাঁদা। একদমই না৷ মানব ছায়া আরো একটিবার ভেঙে যায়। কারো কান্নায় নিজের কেন এমনটা লাগবে? সায়রা ছাড়ে না দুপুরকে।
জানাজার ব্যবস্থা করলো শাহ আর ইফাত। এ বাড়ীতে ছেলে বলতে আর কেউ নেই। ওদের দৌড়াদৌড়ির মাঝে হাসপাতালের ফর্মালিটি সব তাসরিফ পালন করলো। অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ তিনটা যখন নেয়া হলো তখন তাসরিফ সায়রা’কে অনেক চেষ্টা করলো তার মা, ভাই আর ভাবীকে দেখাতে কিন্তু সায়রা যাবে না। কিছুতেই যাবে না। তাসরিফে’র মন চাইলো ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। একটু স্বান্তনা দিতে কিন্তু পারলো না। সম্ভবই হলো না। ইফাত এসে সন্ধ্যাকে টেনে তুললো। কিছুতেই উঠবে না ও। নিজের বুকের মধ্যে ঠেস দিয়ে ওকে নিয়ে গাড়িতে তুলে ইফাত। ফিরে এসে শাহ’কে বলে,
— দুপু আর ফুপিকে নিয়ে যাই। জানাজার সময় হচ্ছে।
— আমি দেখছি।
শাহ এগিয়ে আসে। সায়রা’র সামনে দাঁড়িয়ে দুপুরকে আস্তে করে বলে,
— দুপুর, উঠে এসো সোনা।
দুপুর তখনও সায়রা’র বুকে। শাহ নিজের হাতটা ওর মাথায় রাখে। পুণরায় ডাকে। দুপুরকে নিয়ে শাহ সরে যায় সেখান থেকে। তাসরিফ বসে সায়রা’র মুখ বরাবর। চিকন হাতটা নিজের হাতের মাঝে নেয়। অনুরোধ করে বলে,
— একটাবার দেখে নিন য়রা। আর কখনো সুযোগ হবে না।
ফ্যাচফ্যাচে কণ্ঠে সায়রা বললো,
— তাদের আমি কখনো মৃত কল্পনা করি নি। করতে চাই না।
— যদি আফসোস হয়….
— যাদের মৃত্যু আমি এই পর্যন্ত শতবার কামনা করেছি তাদের জন্য আফসোস কেন করব? তারা তো মুক্তি পেলো। শুধু আমি বাকি।
— য়রা!
টলমলে চোখে তাকালো সায়রা। তাসরিফ ওর হাতটা আরেকটু চেপে ধরে। সাহস করে নিজের বুকে টানে। সায়রা এলো। বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। গুমরে কেঁদে উঠলো। তাসরিফ ওকে ধরে রাখে নিজের সাথে। ছাড়ে না। এই প্রথমই হোক ওকে নিজের করে ধরেছে ওর য়রা।
আজ বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। চট্টগ্রামে তিনটা কবর খনন করা হয়েছে। তিনটা জীবিত মানুষ যারা পালাতে চেয়েছিলো এক রাজ্য থেকে, কে জানতো তারা হারিয়ে যাবে এই জগৎ থেকে। ছোট্ট জীবনটার সার্থকতাও খুব ক্ষুদ্র। এই তো বৈরী আবহাওয়ায় একটা ট্রাক ধাক্কা দিলো প্রাইভেট গাড়িটাকে। হারিয়ে গেলো চারটি জীবন পৃথিবী থেকে। তাদের মাটিতে চাপা দিয়ে লোকালয়ে ফেরত এসেছে সকলে কিন্তু রেখে এসেছে তাদের সেই অন্ধকারে। যেখান থেকে কেউ ফেরত আসে না।
দুপুরকে কেউ খাওয়াতে পারছে না। হঠাৎ পা’গ’লামো বাড়ছে ওর। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ঝড়ের আঘাতে গাছপালা উল্টে পরছে। সায়রা বারংবার চেষ্টা করেও থামাতে পারছে না৷ দুপুর খাবে না৷ চিৎকার করে কাঁদছে। বারবার বলছে,
— বাবার কাছে যাব ফুপি। আমাকে বাবা এনে দাও। বাবা এনে দাও আমাকে ফুপি।
সন্ধ্যা কাঁদছে হুহু করে। শাহ না পেরে দুপুরকে জোর করবে তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ও। শাহ বিচলিত হলো। জ্ঞান হারালো কেন? এই সময়ে দুপুরের জ্ঞান হারানোটা একদমই ঠিক হচ্ছে না। ওকে নিয়ে পাশের একটা রুমে চলে যায় শাহজেব৷ মুখে পানি ছিটায়। সায়রা কপাল চেক করে দেখে জ্বর আসছে। মাত্রই বলতে নেয়,
— ওকে খায়িয়ে এন্টিবায়োটিক দিতে হবে….
শাহ যেন তেতে উঠে,
— না, না এন্টিবায়োটিক দেয়া যাবে না। এভাবেই উঠবে।
বলেই দুপুরকে ডাকতে থাকে। দুপুর একটু চোখ খুলতেই সায়রা তারাতাড়ি খাবার আনতে যায়। শাহজেবে’র যেন শ্বাস ফিরে এলো। দুপুরের গাল দুটো আঁকড়ে ধরে চিন্তিত গলায় বলে,
— খাবার এলে চুপচাপ খাবে দুপুর। কোন কথা না।
— আমি খাব না। আপনি বাসায় চলে যান শাহ।
শাহ অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকালো। দুপুরের ভেতর কাঁপে সেই দৃষ্টিতে। শাহ’র নরম হাতের এক স্পর্শ তখন দুপুরের উদরে। দুপুর চমকে উঠতেই শাহ খুব ধীরে বললো,
— খেতে যে হবেই।
দুপুর চোখের পানি ছেড়ে দিলো। শাহ ওকে ধরে উঠাতেই দুপুর সরে বসে। আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,
— বাবা কেন আপনার সাথে আমার বিয়ে হতে দিলো শাহ? আমার উত্তর চাই। বাবা নেই কেন শাহ? কেন নেই?
দুপুরের কান্নার বেগ বাড়ছে তখন, পাল্লা দিয়ে বাজছে ফোনটা। শাহ’র বাসা থেকে ফোন আসছে বারবার। আবহাওয়ার জন্য তারা আসতে পারে নি৷ এখনও চেষ্টা করছে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। সায়রা তখন খাবার নিয়ে ঢুকেছে। খুব সামান্য খাওয়ানো গেলো ওকে। সায়রা’কে ধরেই কাঁদছে দুপুর। শত হাজার অভিযোগ কাকে দিবে দুপুর? কে শুনবে এই অভিযোগ?
শাহ বাইরে কোথাও গিয়েছিলো। ফিরলো মাত্র। সায়রাকে বললো,
— আপনি বিশ্রাম করুন এখন একটু। ওকে আমি দেখছি।
দুপুর ছাড়ে না সায়রাকে। ফুঁপিয়ে কাঁদে। সায়রা জিজ্ঞেস করে,
— ও কি অসুস্থ।
শাহ চোখ নামিয়ে নিতেই এত দুঃখে সামান্য হাসলো সায়রা। মনে মনে বললো, “একটুর জন্য নিজের এক মেয়ের সুখের সাক্ষী হলে না ভাইয়া। তোমার জন্য খুব করুণা হয় আমার।”
সায়রা যেতেই শাহ দরজা আটকে দিলো। দুপুর ওর দিকে তাকাচ্ছে না৷ শাহ গায়ের ভেজা শার্টটা খুলে রেখে খালি গায়ে বসলো ওর সামনে। দুপুরের গাল ধরে মুখটা নিজের দিকে ফেরালো। আলতো হাতে চোখটা মুছে দিতে দিতে বললো,
— এত ঘৃণা আমাকে দুপুর?
— আমার উত্তর চাই শাহ।
— নাহয় কি করবে? ছেড়ে দিবে তোমার শাহ’কে।
দুপুর টইটুম্বুর চোখে তাকালো। শাহ ওর নরম গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— না চাইতেও আমাদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয় দুপুর। তুমিও মেনে নাও যেভাবে মেনে নিয়েছিলে আমার গায়ের রং।
দুপুর হঠাৎ চোখ নামালো। শাহ বললো,
— কালো বলে জীবনে কত জায়গায় আটকালাম দুপুর অথচ দেখো এই কালো চাঁদের ঘরে চাঁদমুখের তুমি। কালো বলে তো তুমিও বিয়ে করতে চাও নি। সুন্দররা কখনোই অসুন্দরদের মেনে নেয় না কিন্তু তুমি নিয়েছো। বিয়ের রাতেই নিয়োছো। স্বার্থ কিছুটা তোমারও ছিলো দুপুর। কিছুটা হয়তো আমার।
— আমিই…
— শু…. আমি জানি কি বলবে কিন্তু এটা মেনে নাও দুপুর, তুমি নিজেকে বাঁচাতেই আমাকে বিয়ে করেছো। সৌন্দর্য বৈ তেমন কিছুই নেই। অমান্য করবে? না পড়াশোনা না সাংসারিক গুন। আমি মেনে নিলাম তো দুপুর। তুমিও নাহয় মেনে নাও।
দুপুর তিক্ত সত্যিটা শুনে চুপ করে গেলো। আসলেই তো সুন্দর মুখটা বাদে সে তেমন যোগ্য কেউ না যাকে পেতে এত তামঝাম হবে। শাহ’র বউ হওয়ার যোগ্য তো একেবারেই না।
ওকে চিন্তিত দেখে শাহ নিজের কাছে টানলো। দুপুর ধীরে ধীরে শুধু বললো,
— যেই অ’স্ত্রর ভয় আমার জীবন নরক করেছিলো সেই অ’স্ত্রই কি না কপালে এলো শাহ? আমার বাবা কত কত পুলিশের কাছে দৌড়ালো শাহ। কেউ সাহায্য করে নি। নানা ভাবে লাঞ্ছিত করে তাড়িয়েছে। ক্লান্ত হয়ে ফেরত আসতো বাবা৷ ক্ষমতা আর টাকা পুলিশের ইউনিফর্ম ক্রয় করতে পারে শাহ। তারা জঘন্য হয়। খুব খারাপ হয়। আমি ঘৃণা করি তাদের। সবাইকে।
ঘৃণিত সেই পেশায় জড়িত মানুষটার বুকেই দুপুর কাঁদছে। শাহ জানে এই কথা। মিরাজ সাহেব জেনে শুনেই মেয়ের ভালো চাইতেই শাহ’র সাথে বিয়ে দিয়েছিলো। পরিচয়টা হয়েছিলো শাহ’র বাবা’র অফিসে। পুরাতন কলিগ সবটা শুনে সাহায্যই করেছিলো একপ্রকার। শাহ শুরুতে রাজি ছিলো না৷ আগুন সুন্দরী এই মেয়ে। তার মতো কালো কাউকে কেন বিয়ে করবে? তার মধ্যে পড়াশোনায় মোটামুটি। শাহ অবশ্য জানতো না এই মেয়ে ছোট বেলায় কতটা মেধাবী ছিলো। তার সৌন্দর্যই তাকে ধ্বংস করেছে। ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারে।
শাহ ওর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
— সুন্দরী মেয়েদের ভাগ্য খুব খারাপ হয় দুপুর। খুব খারাপ।
জানালাটা মাত্রই খুললো সায়রা। সন্ধ্যা’কে ইফাত ঘুম পারালো মাত্র। সায়রা চমকে তাকালো বাড়ীর গেটে। সেখানে বৃষ্টিতে ভিজে তাসরিফ দাঁড়িয়ে এক ছাউনির নিচে। জানালা লাগাতে ভুলে গেলো সায়রা। দৌড়ে নামলো নিচে। রাগে ওর গা কাঁপছে। এই ছেলে কি প্রমাণ করতে চাইছে এই বৃষ্টিতে ভিজে? সায়রা’কে দেখে তাসরিফ অবাকই হলো। সায়রা ওর ধরে ভেতরে নিলো। রুমে নিয়ে ভিজে শরীর মুছতে মুছতে রাগী স্বরে বললো,
— কি করছিলে ওখানে?
— আপনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।
— ভেতরে আসা যাচ্ছিলো না? ভিজেছো কেন?
— কেউ তো ডাকলো না য়রা।
সায়রা’র হাত থামলো। নিজেকে সামলে বললো,
— ডাকার মতো তো কিছু রাখো নি। কে ডাকবে? বাসায় যাও নি কেন?
— আপনাকে ছেড়ে বাড়ী যাব?
সে জন সোনা চিনে না পর্ব ১৯
সায়রা ইফাত থেকে কাপড় এনে ওকে দিলো। ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে খাবার নিয়ে এলো। তাসরিফ তাকিয়ে রইলো ওর পানে। প্লেট হাতে নিয়ে সবার আগে সায়রা’কে খাওয়ালো। ঐ শুকনো মুখটা দেখেই তো তাসরিফ বুঝে সবাইকে খাওয়ালেও এই মেয়ে নিজে খায় নি। সবার খেয়াল রাখলেও নিজের রাখে নি।
রুমের বাতিটা নেভাতেই ফুপিয়ে কাঁদে সায়রা। তাসরিফ ওকে ভালোমতো বুকে জড়ালো। বললো,
— কাঁদো। মন খুলে কাঁদো তো য়রা।