স্নিগ্ধবিষ গল্পের লিংক || সানজিদা আক্তার মুন্নী

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১
সানজিদা আক্তার মুন্নী

১৮ বছর বয়সী নাজহার সাথে বিয়ে হলো আজ চৌত্রিশ বছর বয়সি তৌসিরের সাথে।নাজহার পরিবার নিজেদের মান সম্মান রক্ষার্থে নাজহা কে তুলে দিলো তৌসিরের হাতে।দানবের হাতে না মানুষের হাতে দিচ্ছে মেয়ে তারা সেটি একটিবারও ভেবে দেখলো না।মূলত নাজহার দশ নাম্বার চাচা নো”মান তালুকদারের পছন্দ ছিল এই শিকদার বাড়ির সায়েক শিকদার, অর্থাৎ নাজহার দাদাশ্বশুরের মেয়ে সাফা কে।আর নোমান সাহেব তিনখানা বছর ধরে অসম্ভব সাধ্য করে দুই পরিবারকে মানাতে পেরেছেন।দুই পরিবার মেনে নিলেও শিকদার পরিবারের একখানা আবদারও ছিলো বটে।তালুকদাররা তো আবদারের কথা শুনেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন না জানি কার কলিজা বা মগজ চেয়ে বসে!এরা তো মানুষ বটে তবে ভেতরে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট সত্তা লুকিয়ে আছে।

তবে শিকদাররা এবার খারাপ কিছু আবদার করেনি তারা আবদার করেছিলো একজন মেয়ে।সে তালুকদারদের যে কারো হোক, তবে মেয়ের বদলে যেনো মেয়ে তারা পায়।
নাজহাদের বাড়ির মেয়ে তো অনেক আছেন ওর ফুফু তিনজন এখনো কুমারী।তবে বোনদের মধ্যে ও বর্তমানে বড়, ওর বড় চাচাতো চার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।আর শিকদাররা নিজেদের ছেলের জন্য পাত্রী চেয়েছিলেন, ভাইদের জন্য নয় । তাই নাজহার বাপ-চাচারা নাজহা কেই সঁপে দিয়েছেন।মনে করবেন না, উনারা শুধু ওর চাচার পছন্দের জন্য বিয়ে দিয়েছেন এতে জমি-জমার হিসেবটাও বেশ আছে।রাজনীতিতে নিজেদের হাত পাকাপোক্ত করতেই এই আত্মীয়তা। নয়তো দুষমনের সাথে কে ঘা মিশাতে যায়?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নাজহা এটা ঠিক বুঝতে পারছে না, বুঝতে গিয়ে বারংবার বড্ডই কষ্ট হচ্ছে যে-যে ফ্যাস ফ্যাস করে ওর এক চাচার শরীর খণ্ড-বিখণ্ড করেছিলো, তার দাদা কীভাবে সেই লোকের হাতে নাজহা কে তুলে দিলেন?কিন্তু নাজহা বর্তমানে নিরুপায়, উত্তরও পাবে না।জীবনে বাপ-চাচার কথার ওপর কোনো কথা বলেনি,কিন্তু বিয়ের সময় মিনতি করে বলেছিলো“আর যার সাথেই বিয়ে দাও, তাও এই পরিবারে দিও না।”ওর পনেরো জন চাচার মধ্যে কেউ তার কথা শুনেনি।সবাই বলেছেন, “এটাই তোর নিয়তি।”পনেরোজন চাচা শুনে আবার হট্টহাসিতে ফেটে পড়বেন না!আসলে নাজহার দাদা আবার বেশ শৌখিন মানুষ তাই তো বিয়ে করেছেন চার খানা।আল্লাহর হুকুম বলে বলে সন্তান এনেছেন বিশ-একুশজনেরও বেশি।আগের আমলের মানুষ বলে কথা।এর মধ্যে কয়েকজন বে-নালেই মারা গেছেন, কাউকে কুপানো হয়েছে, কাউকে আবার জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে।আচ্ছা যাই হোক এখন বর্তমানে আসি।

নাজহা কে বাসর ঘরে ফুল সাজানো বিছানায় বসিয়ে দিয়ে গেছেন এই বাড়ির মহিলারা।কত কিছু হেনতেন- এনসেন বলে গেছেন নাজহার এসব এক কান দিয়ে ঢুকেছে, অন্য কান দিয়ে চলে গেছে।এসবে ও ভুরুক্ষেপ করেনি।সবাই ওকে লাল শাড়ি পরিয়ে লাল বউ বানিয়ে দিয়েছেন কিন্তু নাজহা এসব খুলে ধবধবে সাদা সেলোয়ার কামিজ পড়ে নিয়েছে।বউ হওয়ার শখ নেই ওর। তাও আবার নিজের চাচার খুনির জন্য বউ সাজার। নাজহার পুরো নাম ” নওরিন সিদ্দিয়া নাজহা” নাজহা কাপর বদলিয়ে রুমের বেলকনিতে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায়।বেলকনিতে সাদা পাতলা পর্দা ফেলা এ পর্দাগুলো আবার আলতো বাতাসে দুলছে।নাজহা অবাক নয়নে তাকিয়ে, হালকা পায়ে বেলকনির রেলিং এর দিকে এগিয়ে নিচের দিকে তাকায়।
নিচে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশ্রী গলা শুনতে পায়”রাজনীতির চিনস না কোনো ল্যাওড়া, আর করতে আসিস রাজনীতির নামে সাউয়া হা*লা মাগা!”

এত বিশ্রী কণ্ঠে শুনে নাজহার বুঝতে বাকি থাকে না
এটাই তার বর, তৌসির শিকদার ।কারণ এমন বিশ্রী গালি ওর পক্ষেই সম্ভব। একবার কিসের ভাষণ দিতে গিয়ে তৌসির চিল্লাপাল্লা থামাতে মাইকেই বলে ওঠেছিল। ” এই খা**নকির পোলারা মুখ বন্ধ কর নয়তো বোম দিয়া সবগুলারে উড়াইয়া দিমু!” আর এইটি নাজহা ভালোভাবেই শুনেছিলো। ভাবা যায় কতবড় গালি বাজ।বক্তব্য দিতে গিয়েও গালি।নাজহা নিচে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে তৌসির একটা চেয়ারে বসে আছে পড়নে সাদা পাঞ্জাবি আর কালো আর সাদার চেকের লুঙ্গি হাতে একটা লোহার বড় দা আর ওর সামনে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে একটহ যুবক।তৌসির কথাটি বলেই নিজের হাতে।থাকা দা দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে সেই যুবকের গর্দানে ছেদ মারে।কিন্তু পুরো গর্দানটা লুটিয়ে পড়ে না মাটিতে দা ভোঁতা হওয়ায় অর্ধেক কেটে গিয়ে ঝুলে থাকে।এটা দেখে নাজহার হাত-পা তিরতির করে কাঁপতে শুরু করে।কিন্তু ও ভয় না পেয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।এগুলো ও প্রথম দেখছে না। এর চেয়ে মারাত্মক দূশ্য দেখে বড় হয়েছে। যুবকটি মাটিতে লুটিয়ে চিৎকার করতে থাকে, ছটফট করতে থাকে।তৌসির কিছু সময় হাতের দা’র দিকে তাকিয়ে তা দূরে ছুড়ে মেরে আশেপাশে দাড়িয়ে থাকা নিজের পালোয়ান দের দিকে তাকিয়ে নাক-মুখ কুঁচকে বলে,“সাউয়ার দা দিয়ে একটা গর্দানও নামাইতে পারলাম না, এই বাল চাল সরা এন তাইকা।”

এ বলে নিজের লুঙ্গির নিচের অংশ এক হাতে লুঙ্গির এক কোণ, আরেক হাতে অন্য কোণ ধরে সামনের দিকে একটু তুলে ধরে কোমরে গুঁজতে গুঁজতে উঠে দাঁড়ায় দাঁড়িয়ে সেই যুবকের অর্থ মৃত দেহের কাছে যায়,তারপর ওর সামনে বসে নিজের দুই হাতে দিয়ে মাথা চেপে ধরে ওর দড় থেকে মাথা আলাদা করে দেয়।প্রাণ কে মুক্তি দেয়।
মাথা আলাদা করে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রক্তাক্ত ডান হাত আর বাম হাতের দিকে তাকিয়ে বলে“নে, এই মাগির পোলা রে নিয়া গাঙ্গে ভাসাই দে। রাজনীতির নামে সাউয়াগিরি করে, হালা জানোয়ার।”এই অর্ডার দিয়েই তৌসির বাড়ির ভেতর চলে আসতে থাকে তৌসির কে বাড়ির ভেতর আসতে দেখে নাজহার ভেতরে হাতুড়ি দিয়ে কংক্রিটের ভাঙন শুরু হয় কারণ এখন এই লোক রুমে আসবে, আর নাজহা ওর সামনাসামনি হতে চায় না।ভয় পায় ওকে।তৌসির রুমে আসে, নিজের পুরো রুমকে এভাবে ফুলে সাজানো দেখে খানিকটা অবাক হয়।

চারদিকে ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে।তৌসির নিজের পড়নে থাকা সাদা পাঞ্জাবিটা খোলতে খোলতে রুমের মধ্যখানে এসে দাঁড়ায়।দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলাতে শুরু করে নতুন বউ খুঁজছে আর কি।কিন্তু ওর বউ তো নেই এখানে।তৌসির পাঞ্জাবিটা বিছানায় ছুড়ে মারতে মারতে আপনমনেই বলে”কি রে কই গেলো তালুকদারের মাইয়া ঐডি?”তৌসির সন্দেহ নিয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়,
আর তখনই কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে পায়।
নাজহা দাঁড়িয়ে আছে, ওর দিকে তাকিয়ে।সাদা ধবধবে একটা থ্রি-পিস পরা।ফর্সা চেহারা, সুন্দর মুখের গঠন।

নাক-মুখ চুরির মতো ধারালো।তবে এগুলোতে তৌসিরের কিছু যায় আসে না বহুত সুন্দরী নারীর শরীর কেনা-বেচা করে অভ্যস্ত তৌসির।কিন্তু তৌসির খানিকটা আটকে যায় আর কিসে?নাজহার চুলগুলো খোপা করা, তবে কিছু চুল বেরিয়ে আসছে।চুলগুলো একদম কালো নয়, বাদামি রঙের।তার ওপর আবার কোঁকড়ানো।এর মধ্যে নাজহার চোখের মণিগুলো সাধারণ নয় বেশ অদ্ভুত কেমন অদ্ভুত? ওর চোখের মণি গভীর সবুজাভ, মাঝখানে কিছুটা ধূসর নীলের ছোঁয়া আছে। মণির চারপাশে হালকা বাদামি রিং আর এরমধ্যে চাঁদের আলো পড়ায় চোখের মধ্যে হালকা সোনালী আভা দেখা যাচ্ছে। মণির চারপাশে সাদা অংশ পরিষ্কার, চোখের পাপড়িগুলো লম্বা ও ঘন। তৌসির অনেক সুন্দরী দেখেছে বটে, তবে এমন সৌন্দর্য। চারপাশে আলাদা আভায় ভরা এই সৌন্দর্য প্রথম দেখলো।তার ওপর আবার নিজের বউ রূপেই।কিন্তু কথাটা হলো, ও যতই সুন্দর হোক, ও তো শত্রু বাড়ির মেয়ে। তৌসির ওকে চোখ দিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখতে থাকে এটা দেখে নাজহা নিজের হাত কচলাতে থাকে।মনে মনে ঠিক করেছে তৌসির যদি কিছু করতে আসে, তাহলে পাশে রাখা টেবিলের কাচের জগ আর গ্লাস দিয়ে তাকে মেরে ফেলবে।মানে নিজেকে শান্তনা দিচ্ছে ঐ আর কি।তৌসির নিজের লুঙ্গির নিচের অংশ একটু তুলে হাতে নিয়ে নাজহার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে“এই, তুমি সত্যিই তো ছিদ্দিকের মাইয়া?”

তৌসিরের এই কথা শুনে নাজহা ভড়কে যায়। কী প্রশ্ন এটি? নাজহা থতমত খেয়ে বলে, “হ হ্যাঁ কেন? কোনো সন্দেহ?”
তৌসির নাজহার দিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ, সন্দেহ তো বটেই। কারণ তোমার বাপ তো কাইল্লা, তাইলে তুমি ধলা কেমনে?”
নাজহা তৌসিরের কথা শুনে তিক্ত সুরে বলে, “আমার আব্বা কালো নয়, শ্যামলা।”
তৌসির ব্যাঙের মতো হাসি দিয়ে বলে, “ঐ শ্যামলা আর কাইল্লা হইলই এক।”
নাজহার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস ফেলে বলে, “সবই দয়ালের খেলা বুঝলা? নয়তো আমার মতো কাইল্লার কপালে তোমার মতো রূপঝরা রূপরাণী ঝুলা, বেশ ভাগ্যের ব্যাপার।”

নাজহা তৌসিরের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “আপনি কালো হলে কালোরা তাহলে কী? আর একমতে ঠিকই আছে, আপনি কালো না হলেও আপনার অন্তর ঠিকই কালো।”
তৌসির নাজহার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলে, “আমার অন্তর কালা ঐডা তুমি ক্যামনে জানলা?”
“ক্যান, একটু আগেই তো দেখলাম নিকৃষ্টভাবে খুন করতে। আপনার অন্তর ভালো হলে ওভাবে খুন করতেন?”
নাজহার কথা শুনে তৌসির হাসি দিয়ে বলে, “এখনো বয়সে অনেক ছোট তুমি। তাই এসব যা দেখছো ভুলে যাও, আর গিয়ে চুপচাপ ঘুমাইয়া পড়ো।”

নাজহা তৌসিরের কথায় থমকে যায়, বেশ লজ্জায় পড়ে যায়। ওকে এই কথা বলা মানে ওর বুঝকে অপমান করা একপ্রকার। নাজহা নিজের কালচে সবুজ চোখের অবুঝ চাহনি নিয়ে তাকায়, আবার চোখ তুলে তৌসিরের দিকে। এই তাকানোতে খানিকটা থমকে যায় তৌসির। মনে মনে প্রশ্ন জাগে, তালুকদাররা ভিন্ন দেশি কাউরে আবার ওর বউ বানাইয়া দিলো না তো? কারণ এই মেয়েটারে দেখতে ইংলিশ ইংলিশ লাগতেছে। তৌসির নাজহাকে আবারও প্রশ্ন করে, “তুমি সত্যিই তো তালুকদারের মাইয়া?”
নাজহা তৌসিরের কথায় বেশ বিরক্তি নিয়ে বলে, “হ্যাঁ! কেন একই প্রশ্ন বারবার করছেন?”
তৌসির হালকা দাঁত চেপে বলে, “তোমার বাপ চাচা সবগুলাই তো গাদ্দারের ধরা, তাই মনে হইলো নিজের সম্পদ না দিয়া অন্য কারো সম্পদ ঝুলাইলো না তো আমার গলায়!”
নাজহা আর চুপ থাকতে পারে না। এইসব কথায় নাজহা বলতে না চাইলেও বলে ফেলে, “আমার বাপ চাচাকে অসম্মান করে কথা বলবেন না!”

নাজহার এই কথা শুনে তৌসির তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে উঠে বলে, “তোমার বাপ চাচা সবগুলা খা**নকির ধরা, ওগো কোনো সম্মান নাই। সাউয়াগুলা সবগুলাই বেইজ্জত!”
এমন বিশ্রী গালি শুনে নাজহার শরীরে রাগে জ্বলতে শুরু করে। নাজহা দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তৌসিরের পানে তাকিয়ে শক্ত সুরে বলে, “নিজের মুখে লাগাম টানুন!”
তৌসির নাজহার উপদেশ শুনে টিটকারির সুরে বলে, “দুঃখিত দুঃখিত! আমি ভেরি দুঃখিত, বাচ্চাদের সামনে গালাগালি করা আসলেই উচিত না!”

নাজহা ভ্রু কুঁচকায় তৌসিরের কথায় ভেরি সরি শুনেছে কিন্তু ভেরি দুঃখীত এই প্রথম শুনলো এর মধ্যে তৌসির ওকেই বাচ্চা বললো! নাজহা কাঠ গলায় বলে, “আমার বয়স যথেষ্ট এবং আল্লাহর হুকুমে আমি যথেষ্ট বুঝদার!”
তৌসির নাজহার কথায় দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ নাজহার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর আফসোসের সুরে বলে, “হালার পুত গো, কাছে চাইলাম বউ আর ওরা আমার গলায় ঝুলাই দিলো লেদা বাইচ্ছা!”

এ বলেই আসমানের দিকে তাকিয়ে দুই হাত বুকের সামনে তুলে নাড়িয়ে নাজহার দিকে তাকিয়ে বলে, “সবই দয়ালের খেলা বুঝলা তালুকদারের মাইয়া! ইচ্ছে ছিলো তোমার দাদার মতো বাইচ্চা কাইচ্চা দিয়া বংশ ভরাইয়া দেওনের। কিন্তু তোমার যে বয়স আর বুঝ, এইডায় আমি এক বাচ্চার বাপও হইতে পারমু কি না সন্দেহ আছে!”
নাজহা তৌসিরের কথায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এই লোক কী বলছে এসব? নাজহা কিছু বলতে যাবে, তখনই তৌসির বলে ওঠে, “যাও, ঘুমাও গিয়া। বাসর টাসর এসব এই জীবনে হইবো না, এসব করলে তুমি বাঁচতা না!”
নাজহা তৌসিরের এই কথার জবাব টাশ করে বলে ওঠে, “নিজের মুখ সামলে নিন, নয়তো ঘাঁ হয়ে যাবে কবে!”
এই বলেই নাজহা রুমে চলে আসে। রুমে এসেই কোথায় যাবে, এই রুমের বসার মতো একটা সোফাও নেই, নাজহা খুঁজে পায় না! এরা এত বড়লোক হয়ে এমন ছোটলোকি করে কেন? ঘরটা বেশ বড়সড়, তবে এখানে ঝাঁকঝমক কিছু নেই। একখানা নরম তোষকে মুড়ানো বড় বিছানা, একটা কাঠের আলমারি, একটা ওয়ারড্রব, তার পাশে ছোট্ট বুকশেলফ আর বেলকনির দরজা সাইডের দেয়ালে জানালার সামনে একটা চেয়ার টেবিল। নাজহা এখন খুঁজে পায় না ও কোথায় ঘুমাবে। তৌসির পিছন থেকে এসে বলে, “আমার লগে এক বিছানায় চাইলে ঘুমাইতে পারো, না চাইলে ঐ টেবিলের কোনায় পাটি রাখা আছে, এইটা বিছাইয়া নিচে ঘুমাও।”

নাজহা তৌসিরের কথা শুনে আর ওর দিকে তাকায় না। ধীরে ধীরে পাটি নিয়ে মেঝেতে বিছিয়ে নেয়। মেঝের উপরেও কোনো কাপড়ের কার্পেট বিছানো নেই, স্রেফ টাইলস করা। নাজহা এসবে অভ্যস্ত নয় বটে, তারপরও পাটি বিছিয়ে বিছানার দিকে তাকায়। সেখানে রাখা আছে কাঁথা। তাই উঠে গিয়ে কাঁথা আর বালিশ নিয়ে মেঝেতেই জায়গা করে নেয়। তৌসির লাইট নিভিয়ে বিছানায় উঠতে উঠতে বলে, “রাইতে ঘুম ভাঙলে বিছানার দিকে আবার তাকাইও টাকাইও না, লুঙ্গির নিচে কিছু পরি টরি না, লুঙ্গি আবার কান্ধে উঠিয়া যাইতে পারে।”

নাজহা তৌসিরের কথায় কোনো উত্তর দেয় না, চুপচাপ বালিশে মাথা রাখে। এক ঘরে এক কুমিরের সাথে ঘুমাচ্ছে, ঘুম কি আর আসবে? না, আসবে না! ভেতরটা খচখচ করছেই তো করছেই। আর খচখচ করার একটাই কারণ, তা হলো নিজের বাপ চাচার স্বার্থপরির কথা। তারা কীভাবে ওর জীবনটা এভাবে শেষ করে দিতে পারলেন? একটুও কি দয়া মায়া নেই? নাজহা ভেবেছিল অন্তত ওর মাস্টার চাচ্চু, লাল চাচ্চু আর ছোট চাচ্চু বুঝবেন, কিন্তু উনারাও বুঝলেন না। মাস্টার বলতে স্কুলের মাস্টার না, উনি ইংলিশে মাস্টার দিচ্ছেন সেই সুবাদে উনাকে মাস্টার চাচ্চু ডাকে। আর লাল চাচ্চু বলতে, তিনি রেগে গেলেই লাল হয়ে যান, সুন্দর বেশি তাই লাল চাচ্চু ডাকা। নাজহার ভেতর ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। তৌসিরের মুখের ভাষা খুব খারাপ, শুধু তৌসিরের নয়, তাদের বাড়ির সবারই এমন, শুনেছে নাজহা। নাজহা খুঁজে পায় না এই প্রশ্নের উত্তর, এই বাড়ির মানুষগুলো এত খারাপ হয়েও এমপি, মন্ত্রী, মেয়র হয় কীভাবে? তাও এক পরিবার থেকে! নাজহার স্বপ্ন ছিল ইন্টার দিয়ে আইইএলটিএস ইংল্যান্ড গিয়ে ভার্সিটিতে পড়তে। ইংল্যান্ড যাওয়ার অনেক ইচ্ছে ওর, কারণ ওখানে গেলে যে নিজের জন্মদাত্রী মাকে দেখতে পাবে এক নজর।

আসলে ওর বাবা-মা আলাদা থাকেন। ওর বাবা নিজের খালাতো বোনকে বিয়ে করেছিলেন, যিনি ব্রিটিশ। নাজহার নানা ব্রিটিশ আর নানু বাংলাদেশি। নাজহার বাবা দেশে থাকতে চান আর নাজহার মা নিজের দেশে যেতে চাইতেন বারবার, তাই একসময় এই চাওয়া না চাওয়ার সমাপ্তি বিচ্ছেদে গিয়ে ঠেকে। নাজহার জমজ ভাই নাজহারকে নিয়ে চলে যান নাজহার না নাওলা ইংল্যান্ড আর নাজহা থেকে যায় দেশে। ছোট ছিল, তখন বুঝেনি ওত কিছু, ফুফু দাদীজানরা যা বুঝিয়েছেন সেই বুঝেই থেকে গেছে। তবে থেকে যাওয়াতে ওর কোনো অবহেলা হয়নি, ওর বাপ চাচারা পুতুলের মতো যত্নে বড় করেছেন ওকে। বাবার চোখের মণি ছিল, তবে সেই মণি কেউ এক সাপের হাতে তুলে দিয়েছেন। নাজহার চাচীরা মায়ের অভাব বুঝতে দেননি ওকে, সবসময়ই আগলে বড় করেছেন। নাজহা বছরে হয়তো দুদিনও নিজের চুল নিজে আঁচড়ায়নি, ওর চুলগুলো বেশ সুন্দর, আলাদা। সে জন্য ওর বড় আম্মা এই চুলের যত্ন অসম্ভব রকম নেন। পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কন্যা সন্তান, তাই ওকে সবাই আলাদাই যত্ন করতেন। কিন্তু কী হলো, এত ভালোবাসা দিয়ে দিনশেষে এক দানবের হাতেই তো তুলে দিলেন! নাজহার যদি তাক্কত থাকতো তবে ওর আব্বার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতো, “আব্বা, নিজের যত্নে গড়া ফুলকে এভাবে ঝড়িয়ে দিতে একটুও কষ্ট হয়নি আপনার?”

কিন্তু আফসোস, এই প্রশ্নটা স্বপ্নেও করা সম্ভব কিনা, তাতেও নাজহার সন্দেহ আছে। নাজহা এমন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখ লাগায়।
কিছু সময় পর।
রাত এখন দুটোর কাছাকাছি। তৌসির ওয়াশরুমে যাবে, ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমঘুম চোখে উঠে বসে বিছানা থেকে, লুঙ্গি ঠিক করে নামতে নামতে ফিসফিসিয়ে বলে, “সাউয়ার এক যন্ত্রণার লাইগা ঘুমাইতেও পারি না।”
এ বলেই উঠে ওয়াশরুমের দিকে যাবে, তখনই নরম কিছু একটার উপর পা পড়ে তৌসিরের সাথে সাথে মড় করে একটা শব্দ হয় একই সাথে নাজহা চিৎকার করে উঠে। তৌসির নাজহার টাখনুর উপর অজান্তেই পা রেখে দিয়েছিল, ঘুমের তালে ভুলে গিয়েছিল যে ওর রুমে এখন নাজহা আছে, তাও মেঝেতে শুয়ে!

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here